প্রচলিত দিবস পালন || যেসব অনুষ্ঠানাদি ইসলাম স্বীকৃত নয়






প্রচলিত দিবস যা ইসলাম স্বীকৃত নয়


রাসূল যা করেননি আমরা তা করি এমন সব অনুষ্ঠান পালন করা বৈধ নয়। আর এসব অনুষ্ঠান বা দিবস উদযাপন যদি ধর্মের নামে করা হয় তাহলে সেটা হবে চরম গুনাহের কাজ।

মুখে ভাত একটি জঘন্য বিদআত


অন্নপ্রাশনের অনুকরণে বহু নামধারী মুসলিম পরিবারও নিজেদের ছেলে-মেয়েদের মুখে প্রথম ভাত দেয়ার জন্য জাঁকজমকভাবে মুখে ভাত অনুষ্ঠান করে থাকে। মুখে ভাত অনুষ্ঠানে আয়োজন থাকে নানা ধরনের খাবারের। নির্দিষ্ট আচার পালন করে উপস্থিত সকলে একে একে শিশুর মুখে ভাত তুলে দেয় এবং সে সাথে সমালোচনা, গান বাজনা আনন্দ ফুর্তিও করা হয়।

এই অবসরে অনেকে প্রচলিত মিলাদও পড়িয়ে থাকে। সচেতন মুসলিম মাত্রই বুঝতে পারবেন যে, মুখে ভাত একটি বিজাতির অনুকরণে একটি জঘন্য বিদআত।

জন্মদিন পালন ইসলামে বৈধ নয়


শিশুর জন্মদিন (হ্যাপি বার্থ ডে) পালন করা এবং সেদিনে আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব মিলিত হয়ে কোনো উৎসব উদযাপন করা, সেদিনে শিশু (বা বুড়ো) কে বিশেষ দুআ, সালাম বা উপহার পেশ করা, বয়স অনুসারে বছর গুনতি করে মোমবাতি জ্বালিয়ে তা ফুঁ দিয়ে নিভানো। অতঃপর কেক কেটে খাওয়া প্রভৃতি বিধর্মীয় প্রথা, মুসলমানদের জন্য এই জন্মদিন বৈধ নয়। বৈধ নয় এ উপলক্ষ্যে দাওয়াতে অংশগ্রহণ করাও। বৈধ নয় সে উপলক্ষ্যে এ শিশুকে দুআ, মুবারকবাদ ও উপহার দেয়া।

(ফাতাহওয়া ইসলমিয়্যাহ ১/৮৭, ১১৫, মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৩০২) নিঃসন্দেহে জন্মদিন একটি সুন্নাত; তবে তা ইহুদী ও খ্রিস্টানদের সুন্নাত। ইসলাম ও নবীর সুন্নাত বর্জন করে বিজাতির সুন্নাত অবলম্বন করা মুসলমানদের জন্য বড়ই ধিক্কার ও ন্যাক্কারজনক ।

প্রিয় নবী (সাঃ) সত্যই বলেছেন, “অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির সুন্নাত অনুসরণ করবে বিঘত-বিঘত এবং হাত-হাত (সম) পরিমাণ। এমন কি তারা যদি গো-সাপের (সাণ্ডা) গর্তে প্রবেশ করে, তাহলে তোমরাও তাদের পিছনে পিছনে যাবে। (এবং তাদের কেউ যদি রাস্তার উপর প্রকাশ্যে সঙ্গম করে, তাহলে তোমরাও তা করবে!)” সাহাবাগণ বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি কি ইহুদী ও নাসারার অনুকরণ করার কথা বলছেন?' তিনি বললেন, “তবে আবার কার?” (বুখারী, মুসলিম ২৬৬৯, হাকেম, আহমদ, সহীহুল জামে' ৫০৬৭ নং) নবী (সাঃ) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি যে জাতির অনুরূপ অবলম্বন করে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই দলভুক্ত।” (আহমদ ২/৫০, আৰূ দাউদ ৪০৩১, সহীহুল জামে' ৬০২৫ নং)


তিনি আরো বলেন, “সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে আমাদেরকে ত্যাগ করে অন্য কারো সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তোমরা ইহুদীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না, আর খ্রীস্টানদেরও সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।” (তিরমিযী ২৬৯৫ নং ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ২১৯৪ নং)

এছাড়া জন্মদিনের খুশী ও উৎসব করা অত্যান্ত বোকামী। জীবন থেকে একটি বছর ঝরে গেলে তার জন্য আক্ষেপ ও দুঃখ করা উচিত, খুশী নয়।

লৌকিকতার সাথে উপহার-সামগ্রীর প্রত্যাশা। আশা ভঙ্গ হলে নানা আলোচনা সমালোচনা।তদানুরূপ বৈধ নয় বড় বড় ব্যক্তিত্বের জন্মবার্ষিকী অথবা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা। প্রথমতঃ আমাদের শরীয়তে তা পালন করার কোনো বিধান নেই। ইসলামে কত লক্ষ লক্ষ আম্বিয়া, সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীন, আয়িম্মা, মুহাদ্দেসীন, মুফাসসেরীন, আউলিয়া, শায়খুল ইসলাম, শায়খুল হাদীস, রাজা-বাদশা ও কবি-সাহিত্যিকদের জন্ম-মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু তাঁদের কারো জন্ম অথবা মৃত্যু দিবস পালন করা হয়নি পূর্ববর্তীদের যুগে।

আর দ্বিতীয়তঃ তা পালন করতে হলে প্রায় প্রত্যহ কারো না কারো জন্মদিন পালন করে আনন্দ ও শোক এবং হাসি ও কান্না উভয়ই প্রকাশ করতে হবে। আর সেই সাথে বছরের প্রায় সকল দিনগুলোতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে কাজ বন্ধ করে সমাজকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হবে।

অতএব মহান ব্যক্তিবর্গের মহান চরিত্র ও কার্যাবলী নিয়ে আমরা তাঁদেরকে স্মরণ করব। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁদের মহান স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে জাগরিত রাখব আমাদের চরিত্র ও কর্মের মাধ্যমেই। আর তাঁদের স্মৃতিকে কেবল আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে জড়িয়ে রাখব না। এই সংকল্পই হওয়া উচিত প্রত্যেকটি কর্মপ্রিয় খাঁটি মুসলিমের।

মৃত ব্যক্তির বাড়ির ভোজ


মরা-বাড়ির পক্ষ হতে সাধারণভাবে গ্রাম ও আত্মীয়-স্বজনকে (অলীমার মতো দাওয়াত দেয়া এবং আত্মীয়দের সেই দাওয়াত গ্রহণ করা বিধেয় নয়। বরং তা বড় বিদআত । ১৫৩ (মু'জামুল বিদা ১৬৩ পৃঃ) বিধেয় হলো কোনো আত্মীয় অথবা প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে মরা-বাড়ির লোকেদের জন্যই পেট ভরার মতো খানা-পিনা প্রস্তুত করে পাঠানো।

আব্দুল্লাহ ইবনে জা'ফর বলেন, জা'ফর (রা) শহীদ হওয়ার পর যখন তাঁর সে খবর পৌঁছল, তখন নবী করীম (সাঃ) বললেন, “জাফরের পরিজনের জন্য তোমরা খাদ্য প্রস্তুত কর। কারণ, তাদের নিকট এমন সংবাদ পৌঁছেছে; যা তাদেরকে বিভোর করে রাখবে।” (আবূ দাউদ ৩১৩২, তিরমিযী ৯৯৮, ইবনে মাজাহ ১৬১০) সাহাবী জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ বাজালী (রা) বলেন, 'দাফনের পর মরা বাড়িতে খানা ও ভোজের আয়োজনকে এবং লোকদের একত্রিত করাকে আমরা জাহেলিয়াতের মাতম হিসেবে গণ্য করতাম। (যা ইসলামে হারাম।) (আহমদ ৬৯০৫, ইবনে মাজাহ ১৬১২, সহীহ ইবনে মাজাহ ১৩০৮) কিন্তু যে সমাজে সে সহানুভূতি ও সহায়তা নেই, সেখানে কি হবে? বদনাম নেয়া ভালো হবে, নাকি জাহেলিয়াতি কর্ম?

পক্ষান্তরে খাবারের ব্যবস্থা না হলে নিজেদের তথা দূরবর্তী মেহমানদের (যাদের সেদিন বাড়ি ফিরা অসম্ভব তাদের) জন্য তো নাচারে ডালভাত করতেই হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সুনামের লোভে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাছ, গোশতের ভোজবাজিতে আত্মীয় স্বজন, জানাযার কর্মী মাদ্রাসার স্টাফ ও ছাত্রবৃন্দ (!) পাড়া-প্রতিবেশী এবং কখনো বা গোটা গ্রামকে সাদরে নিমন্ত্রণ করা হয় ও তা পরমানন্দে খাওয়ানোও হয়, তথা কিছুতে একটু লবণ কম হলে দুর্নাম করতেও কসুর হয় না। এমন ভোজবাজি যে জাহেলি যুগ থেকেও নিকৃষ্টতর তাতে কারো সন্দেহ থাকতে পারে না। মুসনাদে আহমদের (৫/২৯৩) এক হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যে, একদা মহানবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবিগণ এক জানাযার কাজ সেরে ফিরে এলে কুরাইশের এক মহিলা তাঁদেরকে একটি ছাগল যবাই করে দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘটনার সাথে মরা বাড়িতে ভোজ করার বা খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। যেহেতু সে মহিলা ঐ মৃতব্যক্তির কেউ ছিল না; বরং ঐ সময় দাওয়াত হয়েছিল বলে হাদীসে তার উল্লেখ এসেছে । অতএব উক্ত হাদীস থেকে পেটপূজারীদের দলীল গ্রহণ করা বা একপাত খাওয়ার জন্য ঐ হাদীসকে দলীল স্বরূপ পেশ করা সত্যিই হাস্যকর।

মৃত্যু-বার্ষিকী পালন বৈধ নয়


কেউ মারা গেলে তাঁর ব্যক্তিত্ব যত বড়ই হোক, তার স্মরণে প্রত্যেক বছর তার মৃত্যু-তারিখে কোনো স্মরণ সভা, শোক দিবস, দুআ- মজলিস, মীলাদ-মাহফিল, ঈসালে-সাওয়াব, উরস-উৎসব, মৃত্যু-বার্ষিকী, ভোজ-আয়োজন ইত্যাদি বিদআত। ঈসালে সাওয়াব করতে হলে শরীয়তসম্মত পন্থাতেই করতে হবে । নচেৎ সাওয়াব ঈসাল হবে না ।

কারো স্মরণ তাজা করতে হলে তাতে লাভ-লোকসান খতিয়ে দেখতে হবে এবং শরীয়তের অনুমোদন থাকতে হবে। নচেৎ হিতেবিপরীত হলে ফল কি?

মৃত্যু-বার্ষিকী পালন করা বৈধ হলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু তারিখে তা পালন করা বিধেয় হতো এবং তিনি খোদ সাহাবা (রা)-কে এ বিষয়ে কোনো না কোনো নির্দেশ বা ইঙ্গিত দিয়ে যেতেন। পক্ষান্তরে আমরা যদি বুযুর্গদের জন্ম ও মৃত্যু-বার্ষিকী পালন করি, তাহলে বছরের প্রায় প্রত্যেকটি দিন এক একটি পর্বে পরিণত হয়ে যাবে। আর বর্তমান প্রথায় তা পালন করতে করতে প্ৰায় প্ৰত্যেক দিনই হালুয়া-রুটি, মীলাদ মাহফিল, শোক অথবা আনন্দ, ছুটি ও বন্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে । তাহলে তা কি আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে?

আমাদেরকে স্মরণীয় বিষয় স্মরণ করতে হবে। বরণীয় ব্যক্তিবর্গের করণীয় সম্পর্কে সচেষ্ট হলে তবেই আমরা সফলকাম হতে পারব। নচেৎ তাঁদের নামে সিন্নী-মিঠাই বিতরণ করে, ধূপ-মোমবাতি জ্বেলে, ফুল চড়িয়ে মীলাদ-মাহফিল বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান পালন করে আমাদের লোকসান ব্যতীত কোনো লাভ হবে না ।

চাহারাম হারাম


মৃত ব্যক্তির যে স্থানে দম যায় সেই স্থানে কয়েকদিন ধরে রূহ ঘুরাফিরা বা যাতায়াত করে এমন ধারণা নিতান্ত ভ্রান্ত ও বিদআত ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু সেই অলীক ধারণা মতে সে স্থানে কয়েকদিন যাবৎ মাটি লেপা, বাতি জ্বালানো, ধূপধুনো দেয়া এবং মৃত্যুর চতুর্থ দিনে অথবা আগে পিছে কোনো দিন নির্দিষ্ট করে হুজুর ডেকে মিলাদ পড়ে গোশত-ভাত বা মিষ্টি-মিঠাই বিতরণ করে রূহ তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয় অনেক বাড়িতে। এই আচার ও অনুষ্ঠান 'চাহারাম' নামে পরিচিত। বিদআতের সংজ্ঞার্থ যারা জানেন, তাঁরা জানেন যে, চাহারাম অনুষ্ঠানটিও বিদআত। চাহারাম এমন একটি অমূলক ধারণাবশতঃ কৃত এমন একটি আচার, যার কোনো প্রকার সমর্থন শরীয়তে পাওয়া যায় না ।

চালশে বা চেহলাম


কোনো আত্মীয়ের মৃত্যুর চল্লিশতম দিনে তার নামে যে ভোজ-অনুষ্ঠান করা হয় তার নাম চালশে বা চেহলামচালশে বা চেহলাম এর নামে মীলাদ পাঠ বা দুআ-মজলিস করা ইসলামী শরীয়তে অনুমোদন নেই। তাই ইসলামের নামে চালশে বা চেহলাম করা সম্পূর্ণ বিদআত। আসলে এ প্রথাও কিন্তু বিজাতীয় প্ৰথা । (আমেরিকার) ইহুদী ও খ্রিস্টানরা অনুরূপ প্রথা ঐ দিনেই পালন করে থাকে। যেমন পুরনো যুগে মিসরীয় কাফেররা উক্ত প্রথা যথাযথ পালন করত।

বলা বাহুল্য যে, মৃতব্যক্তির আত্মার কল্যাণের জন্য তার মৃত্যুর দিন কিংবা এক সপ্তাহ পর অথবা ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ কিংবা চল্লিশ দিন অথবা বছর পার হলে কোনো প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা বিদআত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ১/১২০-১২১) বলা বাহুল্য যে, আনুষ্ঠানিকভাবে দুআ করে অথবা বিরাট ভোজ-অনুষ্ঠান করে কোনো ফায়েদা নেই। তাতে যদি সমাজের কাছে নাম নেয়ার কিংবা বদনাম থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে থাকে তাহলে তো মৃত ব্যক্তির কোনো কল্যাণই সাধিত হবে না। হ্যাঁ, আপনি যদি আপনার পরলোকগত বাপ, মা বা অন্য কোনো আত্মীয়ের সত্যই কল্যাণ কামনা করেন, তাহলে আপনি তাই করুন, যাতে সত্যই কল্যাণ আছে। আর যাতে কল্যাণ লাভ হবে তা জানতে আমাদেরকে শরীয়তের সাহায্য নিতে হবে।

আপনি আপনার আত্মীয়র জন্য দুআ করুন। বিশেষ করে ফরয সালাতের পশ্চাতে সালাম ফিরার আগে ও তাহাজ্জুদে তার জন্য দুআ করতে ভুল করবেন না। আপনার মা-বাপের জন্য আপনি নিজে দুআ করুন। আপনার মা বাপের জন্য আপনার মতো দরদ কি অন্যকারো হতে পারে? আপনার মতো আর কারো দুআতে কি সে আন্তরিকতার ভরসা করতে পারেন? আর জেনে রাখুন যে, দুআ কবুলের সমস্ত শর্ত পূর্ণ থাকলে নিশ্চয় সে দুআ তার উপকারে আসবে। কুরআন মাজীদে মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে । (সূরা হাশর: আয়াত - ১০) 

প্রিয় নবী (সাঃ) ও মৃতব্যক্তির জন্য দুআ করেছেন। যেমন, জানাযার সালাত ও কবর যিয়ারতের বিভিন্ন দুআ। যার প্রায় সবটাই মাইয়্যেতের জন্য দুআ ও ক্ষমা প্রার্থনায় পূর্ণ। পরন্তু মহানবী (সাঃ) এ কথাও বলেছেন, “মুসলিম ব্যক্তির কোনো ভাইয়ের জন্য তার অদৃশ্যে থেকে দুআ কবুল হয়। দুআকারীর মাথার উপর এক ফেরেশতা নিয়োজিত করেছেন। যখনই দুআকারী তার (অদৃশ্য বা অনুপস্থিত ) ভায়ের জন্য দুআ করে, তখনই উক্ত ফেরেশতা বলেন, 'আমীন। আর তোমার জন্যও অনুরূপ।” (মুসলিম ২৭৩৩, আবু দাউদ ১৫৩৪ নং প্রমুখ) আপনার আত্মীয়ের আপনিই অভিভাবক বা ওয়ারেস হলে এবং সে নযর-মানা রোযা রেখে মারা গেলে আপনি তার পক্ষ থেকে কাযা রেখে দেন, তার সাওয়াব তার উপকারে আসবে ।

প্রিয় রাসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি রোযা কাযা রেখে মারা যায় সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার অভিভাবক (বা ওয়ারেস) রোযা রাখবে।” (বুখারী ১৯৫২, মুসলিম ১১৪৭ নং, প্রমুখ)

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, 'এক মহিলা সমুদ্র-সফরে বের হলে সে নযর মানল যে, যদি আল্লাহ তাবারাকা তাআলা তাকে সমুদ্র থেকে পরিত্রাণ দান করেন, তাহলে সে একমাস রোযা রাখবে। অতঃপর সে সমুদ্র থেকে পরিত্রাণ পেয়ে ফিরে এল। কিন্তু রোযা না রেখেই সে মারা গেল। তার এক কন্যা নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট এসে সে ঘটনার উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “মনে কর, তার, যদি কোন ঋণ বাকি থাকত, তাহলে তা তুমি পরিশোধ করতে কি না?” বলল, 'হ্যাঁ।' তিনি বললেন, “তাহলে আল্লাহর ঋণ অধিকরূপে পরিশোধ-যোগ্য । কাজেই তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে রোযা কাযা করে দাও।” (আবু দাউদ ৩৩০৮ নং, আহমাদ ২/২১৬ প্রমুখ)

রমযানের রোযা কাযা রেখে মারা গেলে তার বিনিময়ে আপনি ফিদিয়া (প্ৰত্যেক দিনের পরিবর্তে একটি মিসকীনকে একদিনের খাদ্য অথবা ১ কিলো ২৫০ গ্রাম করে চাল) দিন। তার সাওয়াবও মাইয়্যেতের জন্য উপকারী।

জনৈক সাহাবীর মা রমযানের রোযা বাকি রেখে ইন্তিকাল করলে তিনি মা আয়েশা (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, 'আমি আমার মায়ের পক্ষ থেকে কাযা করে দেব কি?” আয়েশা (রা) বললেন, 'না'। বরং তার পক্ষ থেকে প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে এক একটি মিসকীনকে অর্ধ সা' (প্রায় ১ কিলো ২৫০ গ্রাম খাদ্য) সদকা করে দাও।' (ত্বাহাবী ৩/১৪২, মুহাল্লা ৭/৪, আহকামুল জানাই, টীকা ১৭0 )

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, 'কোনো ব্যক্তি রমযান মাসে অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং তারপর রোযা না রাখা অবস্থায় মারা গেলে তার পক্ষ থেকে মিসকীন খাওয়াতে হবে; তার কাযা নেই। পক্ষান্তরে নযরের রোযা বাকি রেখে মারা গেলে তার পক্ষ থেকে তার অভিভাবক (ওয়ায়েস) রোযা রাখবে।' (আবু দাউদ ২৪০১ নং প্রমুখ) আপনার আত্মীয় হজ করার নযর মেনে মারা গেলে, অথবা হজ ফরয হওয়ার পর কোনো ওযরে না করে মারা গেলে আপনি (নিজের ফরয হজ আগে পালন করে থাকলে) তার পক্ষ থেকে তা পালন করে দিন। এর সাওয়াবেও সে লাভবান হবে ।

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ) এর নিকট এসে বলল, 'আমার বোন হজ করার মান্নত করে মারা গেছে। (এখন কি করা যায়?) নবী করীম (সাঃ) বললেন, “তার ঋণ বাকি থাকলে কি তুমি পরিশোধ করতে? লোকটি বলল, 'হ্যাঁ।' তিনি বললেন, “তাহলে আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করে দাও। কারণ, তা অধিক পরিশোধ-যোগ্য।” (বুখারী ৬৬৯৯)

অনুরূপ এক মহিলা বলল, 'হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার বাবা অতি বৃদ্ধ। তার ফরয হজ বাকি আছে। এখন সাওয়ারীতে বসে থাকতেও সে অক্ষম । আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করে দেব? নবী করীম (সাঃ) বললেন, “হ্যাঁ।' তাই কর।” (মুসলিম ১৩৩৪-১৩৩৫ নং প্রমুখ)

অবশ্য ফরয হওয়া সত্ত্বেও যে বিনা ওজরে সময়ের অবহেলা করে হজ না করে মারা গেছে তার পক্ষ থেকে হজ আদায় কোনো কাজে দেবে না । (আহকামুল জানাইয ১৭১ পৃঃ টীকা)

আপনি বেশি বেশি নেক কাজ করুন, তাহলে আপনার মৃত পিতামাতাও উপকৃত হবেন। কারণ, মাইয়্যেতের ছেড়ে যাওয়া নেক সন্তান যে নেক আমল করে তার সাওয়াবের অনুরূপ সাওয়াব লাভ হয় তার পিতা-মাতারও। এতে সস্তানের সাওয়াবও মোটেই কমতি হয় না। কারণ, সন্তান হলো পিতা-মাতার আমলকৃত ও উপার্জিত সম্পদের ন্যায় । আর আল্লাহ তাআলা বলেন-

وان لَّيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى .

অর্থাৎ, এবং মানুষ তাই পায়; যা সে করে। (সূরা নাজম : আয়াত-৩৯)

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, “মানুষ সবচেয়ে হালাল বস্তু যেটা ভক্ষণ করে তা হলো তার নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য। আর তার সন্তান হলো তার নিজ উপার্জিত ধনস্বরূপ।” (আবূ দাউদ ৩৫২৮, তিরমিযী ১৩৫৮, নাসাঈ ৪৪৬৪ ইবনে মাজাহ ২১৩৭ প্রমুখ) তাই সন্তান যদি তার পিতা-মাতার নামে দান করে অথবা ক্রীতদাস মুক্ত করেন তখন তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে বললেন, 'হে আল্লাহর রসূল! আমার অনুপস্থিত থাকা কালে আমার মা মারা গেছেন। এখন যদি তাঁর পক্ষ থেকে কিছু দান করি তাহলে তিনি উপকৃত হবেন কি?” নবী করীম (সাঃ) বললেন, “হ্যাঁ হবে।” সা'দ (রাঃ) বললেন, 'তাহলে আমি আপনাকে সাক্ষ্য রেখে বলছি যে, আমার মিখরাফের বাগান তাঁর নামে সদকা করলাম।' (বুখারী ২৭৫৬ প্রমুখ আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বলেন, আস ইবনে ওয়াইল সাহমী তার পক্ষ থেকে ১০০টি ক্রীতদাস মুক্ত করার অসিয়ত করে মারা যায়। অতএব তার ছোট ছেলে হিশাম ৫০টি দাস মুক্ত করে। অতঃপর তার বড় ছেলে আমর বাকি ৫০টি দাসী মুক্ত করার ইচ্ছা করলে বললেন, 'বাপ তো কাফের অবস্থায় মারা গেছে । তাই আমি এ কাজ আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা না করে করব না।' সুতরাং তিনি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট এসে ঘটনা বর্ণনা করে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি বাকি ৫০টি দাস কি তার পক্ষ থেকে মুক্ত করব?' উত্তরে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, “সে যদি মুসলিম হতো এবং তোমরা তার পক্ষ থেকে দাস মুক্ত করতে, অথবা সদকা করতে অথবা হজ করতে তাহলে তার সাওয়াব তার নিকট পৌঁছত।” (আবু দাউদ ২৮৮৩ নং, বাইহাকী ৬/২৭৯, আহমাদ ৬৭০৪)

আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِنَّا نَحۡنُ نُحۡیِ الۡمَوۡتٰی وَ نَکۡتُبُ مَا قَدَّمُوۡا وَ اٰثَارَهُمۡ ؕؑ وَ کُلَّ شَیۡءٍ اَحۡصَیۡنٰهُ فِیۡۤ اِمَامٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۱۲

উচ্চারণ : ইন্না-নাহনু নুহুয়িল্‌ মাওতা অনাকতুবু মা-ক্বদ্দাম্ ওয়া আসা-রাহুম অকুল্লা শাইয়িন আইনা-হু ফী ইমা-মিম মুবীন ।

অর্থাৎ, আমিই মৃতদেরকে জীবিত করি এবং লিপিবদ্ধ রাখি যা তারা অগ্রে প্রেরণ করে ও যা তারা পশ্চাতে রেখে যায়। আমি প্রত্যেক জিনিস স্পষ্ট গ্রন্থে সংরক্ষিত রেখেছি। (সূরা ইয়াসীন: আয়াত-১২)

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “মানুষ মারা গেলে তিনটি জিনিস ব্যতীত তার আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; সদকায় জারিয়াহ, ফলপ্রসূ ইল্‌ম (শিক্ষা) এবং নেক সন্তান; যে তার জন্য দুআ করে।” (মুসলিম ১৬৩১; আবু দাউদ ২৮৮০, নাসাঈ ৩৬৫৩ নং প্রমুখ)

তিনি আরো বলেন, “মরণের পরেও মুমিনের যে আমল ও নেকী তার সাথে মিলিত হয় তা হলো; এমন ইলম যা সে শিক্ষা করেছেন এবং প্রচার করেছে, তার ছেড়ে যাওয়া নেক সন্তানও মুসহাফ (কুরআন শরীফ) তার নির্মিত মসজিদ ও মুসাফিরখানা, তার খননকৃত নালা বা ক্যানেল এবং তার মালের সদকা যা সে তার সুস্থ ও জীবিত থাকা অবস্থায় দান করে গেছে।” (ইবনে মাজাহ ২৪২ নং)

এ কথা স্পষ্ট যে, নিজের হাতে করে যাওয়া নেকীতেই লাভের আশা করা যায়। তাছাড়া অপরে যে ঠিকমত ঈসালে সাওয়াব করবে তার ভরসা কোথায়?

পক্ষান্তরে শরীয়ত অনুমোদিত ছাড়া অন্যান্য আমল বা পদ্ধতি দ্বারা ঈসালে সাওয়াব করলে তা বেসরকারি ডাকে প্রেরণ হবে যা সঠিক ঠিকানায় পৌঁছবে না । সুতরাং মাইয়্যেতের পক্ষ থেকে তওবা করা, সালাত পড়া, নিজের অথবা ভাড়াটে কারীদের কুরআনখানী, ফাতিহাখানী, কুলখানী, শবীনা পাঠ, চালশে, চাহারম, নিয়মিত বাৎসরিক দুআ মজলিস ইত্যাদি কোনো মতেই ঈসাল বা 'রিসিভড' হবে না । (আহকামুল জানাইয, মু'জামুল বিদ্যা' ১৩৫ পৃঃ)

পরিশেষে জেনে রাখা উচিত যে- নাস্তিক, কাফের, মুশরিক, মুনাফিক ও বেনামাযী, যারা কবরের আযাব ও জান্নাত-জাহান্নাম কিছুই বিশ্বাস করে না, তাদের নামে যদি কোনো শরীয়ত সম্মত ঈসালে সাওয়াব করা হয়, তাহলেও তা তাদের কোন কাজে আসবে না। সুতরাং বিদআতী ঈসালে সাওয়াব, কুরআন-খতম, ফাতিহাখানী, কুলখানী, চালশে, চাহারম, দুআ মজলিস, মীলাদ-মাহফিল, ভোজ অনুষ্ঠান ইত্যাদি তাদের কোনো কাজে আসতে পারে না। যাদের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ছিল না, তাদের নামে ধর্মব্যবসায়ীদের নকল ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ছিল না, তাদের নামে ধর্মব্যবসায়ীদের নকল ধর্মের ধর্মীয় আচার কেন? যাদের পরকালে বিশ্বাস নেই, তাদের পারলৌকিক কল্যাণ বা মুক্তির জন্য এ লৌকিকতা ও আনুষ্ঠানিকতা কেন? এ সব আচার পালনের মাধ্যমে কেবল ছেলেদের বদনাম থেকে বাঁচার, অথবা নাম নেয়ার, অথবা সামাজিক ও প্রথাগত কর্তব্যভার হাল্কা করার, অথবা ভোট নেয়ার কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে না তো?

ফাতেহা ও কুলখানী


কোনো প্রিয়জনের নামে, তার আত্মার কল্যাণের জন্য, তার পরকালে মুক্তি লাভের আশায় মরণের ৩ দিন পর অথবা অন্য কোনো দিনে হুজুর, মুন্সী, মুসল্লী দাওয়াত দিয়ে ঘরে এনে অথবা মসজিদ-মাদরাসায় ৭০ হাজার বার কালেমা ত্বাইয়েবা পাঠ বা ফাতিহাখানী অথবা কুলকানী করিয়ে মৃতের নামে ঈসালে সাওয়াব করা হয় । নির্দিষ্ট পরিমাণে বুট বা ছোলা দিয়ে একবার পড়া হলে একটি করে ছোলা সরিয়ে রাখা হয়। সবশেষে থাকে মুনাজাত ও খানাপিনার ব্যবস্থা । ঈসালে সওয়াবের এমন পদ্ধতি যেহেতু মহানবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাদের যুগে ছিল না, সেহেতু তা বিদআত বিধায় তা একান্ত বর্জনীয়।




****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url