রবিউল আউয়াল মাসের আমল ও ফজিলত || জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালনের ইতিহাস







রবিউল আউয়াল মাসের আমল ও বিশেষ ফজিলত


রবিউল আউয়াল মাস ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস, এ মাসে মানবতার সবচেয়ে বড় রহমত নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। মহানবী (সাঃ)-এর জন্মের পূর্বে আরব উপদ্বীপই শুধু নয় তথাকথিত সুসভ্য রোম এবং পারস্যও অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অত্যাচার আর বিশৃঙ্খলা দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। নবী (সাঃ) একত্ববাদের শাশ্বত সত্য বাণী নিয়ে এলেন, এটিই একমাত্র বাণী যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা জ্ঞান, সাম্য আর শান্তির দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে। এ ছিল এমনই এক বিশ্বাস (ঈমান) যা অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে সমগ্র পৃথিবীকে সত্য জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছিল।

সে কারণে মহানবী (সাঃ)-এর জন্ম মানব ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইসলামে যদি জন্মবার্ষিকী পালন করার কোনো স্থান থাকত তাহলে নিঃসন্দেহে তার সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হতেন মহানবী (সাঃ)। কিন্তু ইসলামী শিক্ষার ধারাই হচ্ছে তা লৌকিকতা পরিহার করে বাস্তবতার দিকে ধাবিত করে। সে কারণেই ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা হিন্দুধর্মের বিপরীতে ইসলামে উৎসবের সংখ্যা খুব অল্প, বছরে মাত্র দু'টি ঈদ, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। এ ঈদের দিন দুটি খ্যাতিসম্পন্ন কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্বের জন্মের সাথে সম্পৃক্ত নয়, এ দিনে সংঘটিত ইতিহাসের কোনো বিখ্যাত ঘটনার সাথেও এ দিনকে সম্পৃক্ত করা যায় না।

প্রত্যেক বছর উভয় ঈদে দু'টি আনন্দদায়ক মুহূর্তকে সামনে রেখে আল্লাহর প্রতি শোকর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। প্রথম আনন্দদায়ক মুহূর্ত হলো সারা মাস রমযানের রোযা শেষ করা এবং দ্বিতীয় আনন্দদায়ক মুহূর্ত হলো ইসলামের অন্যতম ভিত্তি হজ্বের সমাপ্তিলগ্ন।
ঈদ উৎসব পালনের জন্য ইসলাম যেসব পদ্ধতি নির্দেশ করে সেগুলোও অনৈসলামী প্রথার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে মিছিল, আলোকসজ্জা, লৌকিক আনন্দ উদযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে আছে সম্মিলিতভাবে নামায আদায় এবং একে অপরের বাসায় যাওয়া, যেগুলো লৌকিক আনন্দ প্রদর্শনের বিপরীতে পারস্পরিক সৌহার্দ আনয়ন করে। অন্যদিকে, ইসলাম কোনো ব্যক্তির জন্মদিন উৎসব পালনে উৎসাহিত করে না, তিনি যতই মহান অথবা গুরুত্বপূর্ণ হোন না কেন। আল্লাহর নবীগণ হচ্ছেন সেই সব মানুষ, সমগ্র মানুষদের মধ্যে যাঁদের মর্যাদা সবচেয়ে ওপরে। কিন্তু মহানবী (সাঃ) অথবা তাঁর সম্মানিত আসহাবদের মধ্যে কেউই তাঁদের জন্মদিন অথবা অন্য কোনো বার্ষিকী পালন করেন নি। এমনকি মহানবী (সাঃ)-এর জন্মদিন, যেই দিনটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে খুশির দিন হিসেবে বিবেচিত সেটিও তিনি অথবা তাঁর সম্মানিত আসহাবগণ উদযাপন করেন নি।

মহানবী (সাঃ)-এর সাহাবাগণ তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় একশত বছর বেঁচে ছিলেন, মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি তাঁদের অগাধ ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা মহানবী (সাঃ)-এর জন্মদিন অথবা মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করেন নি। তাঁরা নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন ইসলামের প্রচার, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শিক্ষার বাস্তবায়ন এবং পৃথিবীর চতুর্দিকে ইসলামের বাণীকে পৌঁছে দিয়ে মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপে ইসলামের বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করে।

জন্মদিন পালন কিভাবে এলো


প্রকৃতপক্ষে, যে সকল ধর্ম আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বলে দাবি করে তাদের কোনোটিই জন্মদিন অনুষ্ঠান পালনের জন্য উৎসাহিত করে না। জন্মদিন পালনের এ প্রথা মূলত মুশরিকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এমনকি, বড়দিন উৎসব, খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব যার মাধ্যমে খ্রিস্টানরা যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন পালন করে থাকে, এ বড়দিনের কথা বাইবেল বা গোড়ার দিকের খ্রিস্টান গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায় না। যিশুখ্রিস্টের জন্মের চারশত বছর পর বড়দিন উৎসব জনপ্রিয়তা লাভ করে। কলিয়ের ইনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্যমতে, “যিশু খ্রিস্টের সঠিক জন্মতারিখ নির্ণয় করা সম্ভব নয়, গসপেলের বর্ণিত বর্ণনা থেকেও না, অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস থেকেও না। খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতাব্দী পর্যন্ত চার্চ মুশরিক রীতি অনুসরণ করে জন্মদিন পালনের বিপক্ষে ছিলেন। এতদসত্ত্বেও ইপিফেনী (যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে ভোজ) অনুষ্ঠান ধর্মীয়ভাবে আদায় করার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন আলেক্সান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লিমেন্ট খ্রিস্টীয় ২০০ সালে মিশরে এ ভোজ অনুষ্ঠানের উল্লেখ করেছেন এবং এ অনুষ্ঠান অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করা হতো এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে। কনস্টান্টিনোপল জয়ের পর, রোমের চার্চ এ ভোজ উৎসবের তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ঘোষণা করে, এটি খ্রিস্টীয় ৩২০ অথবা ৩৫৩ সালের ঘটনা। চতুর্থ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে সকল খ্রিস্টান সমাজ এ দিনে যিশুখ্রিস্টের জন্মোৎসব পালন করা শুরু করে, ব্যতিক্রম ছিল ইস্টার্ন চার্চ, তারা এ উৎসব পালন করত ৬ জানুয়ারি।

সূর্যদেবতাকে উপলক্ষ করে রোমানদের মিগ্রিক ভোজ উৎসবই সম্ভবত ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্টের জন্মোৎসব পালনের প্রতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে, তাছাড়া এটাও সম্ভবত একটা কারণ যে, এদিনে শনি গ্রহকেন্দ্রিক স্যাটুরনালিয়া সংঘটিত হতো। একই প্রকারের বর্ণনা পাওয়া যায় এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে। যেখানে আরো কিছু বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। নিচের অনুচ্ছেদটি এ ব্যাপারে আলোকপাত করবে।

“চার্চের আদি উৎসবগুলোর মধ্যে ক্রিস্টমাস অন্তর্ভুক্ত ছিল না এবং খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বে এ ব্যাপারে কোনো ঐকমত্যও ছিল না যে ক্যালেন্ডারের কত তারিখে এ দিনটি আসা উচিত, জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে নাকি মার্চের ২৫ তারিখে নাকি ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে। যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে ২৫ ডিসেম্বরের সবচেয়ে পুরোনো উল্লেখ পাওয়া যায় ফিলোস অব এন্টিওকে। এছাড়া এ জন্ম তারিখ আদতে অজানা কিংবা অপ্রকাশিত ছিল। এ ফিলোস অব এন্টিওক ল্যাটিন ভাষায় মাগদেবুরিগ কর্তৃক সংরক্ষিত আছে। মূলতঃ এসবের পরিপ্রেক্ষিত ছিল গাউলসদের বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করত যেহেতু তারা ২৫ ডিসেম্বর ঈশ্বরের জন্ম দিবস পালন করে সেহেতু তাদের উচিত মার্চের ২৫ তারিখ পুনরুত্থান দিবস পালন করা"

এ দুই উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্টভাবে যেগুলো প্রমাণিত হয় তা হলো-

১. জন্মোৎসব পালনের প্রথা মূলতঃ একটি বহু ঈশ্বরবাদী (মুশরিকি) প্রথা। কুরআন মাজীদ কিংবা হাদীসের কোথাও এর উল্লেখ নেই। 

২. ঈসা (আ.)-এর সঠিক জন্ম তারিখ অজানা এবং এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অসম্ভব।

৩. খ্রিস্টীয় প্রাথমিক শতাব্দীগুলোতে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন পালন করা হতো না।

৪. খ্রিস্টীয় চতুর্থ অথবা পঞ্চম শতাব্দীতে এটি ধর্মীয় ভোজ উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এর পেছনে বহু ঈশ্বরবাদী (সূর্যউপাসক) দের প্রভাব ছিল।

৫. খ্রিস্টীয় অনেক পণ্ডিত যেমন অরিজিন খ্রিস্টমাসের ঘোরতর বিপক্ষে ছিলেন। তাদের মতে এর মূল উৎপত্তিস্থল মুশরিকদের প্রথা এবং এর পূজকগণ ।

ইসলামী জ্ঞানকোষে জন্মোৎসব অথবা মৃত্যুদিবস পালনের কোনো দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায় না। মহানবী (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় তাঁর বহু সাহাবী (রাঃ) গণ ইন্তেকাল করেছিলেন। মক্কায় অবস্থানকালে তাঁর প্রিয় স্ত্রী সাইয়্যিদাহ খাদিজা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। তাঁর প্রিয় চাচা সাইয়্যেদুনা হামজা (রাঃ) কে উহুদের যুদ্ধে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। কিন্তু নবী (সাঃ) তাঁদের কারো জন্মদিন অথবা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেন নি। তাঁর অনুসারীদেরকে রবিউল আউয়াল মাসে তাঁর জন্মদিন পালন করার জন্যও উপদেশ দেননি।

এরূপ উৎসব অনুপস্থিত থাকার মূল কারণ হলো এসব অনুষ্ঠান মানুষের মনোযোগকে ইসলামের সত্যিকার শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে লৌকিক কর্মসূচির দিকে নিবদ্ধ করে। প্রথম প্রথম এসকল উৎসব উদযাপন হয়ত চূড়ান্ত ভক্তি এবং ধার্মিক ব্যক্তির শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অদম্য বাসনা থেকে শুরু হয়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ সকল উৎসব শেষ অবধি আনন্দ-ফূর্তি উদযাপনের নতুন একটা উপলক্ষ হয়ে ওঠে, আস্তে আস্তে এগুলো বিধর্মীদের অনুষ্ঠানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে থাকে এবং একসময় এগুলোর মধ্যে পাপাচার ঢুকে পড়ে।

এ ব্যাপারে খ্রিস্টমাসের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। খ্রিস্টীয় ভোজ উৎসবের মূল লক্ষ্য ছিল যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনকে স্মরণ করা এবং তার শিক্ষাকে আয়ত্ত করা। কিন্তু এই উপলক্ষটি যখন উৎসবে রূপান্তরিত হলো, বিধর্মীদের উৎসবের উপাদানগুলো ধীরে ধীরে এর মধ্যে অনুপ্রবেশ করা শুরু করল।

এব্যাপারে, এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে-

“কয়েক শতাব্দী ধরে, খ্রিস্টমাস ছিল মূলত চার্চকেন্দ্রিক এবং ধর্মীয় চাহিদা পূরণের নিমিত্তে পালিত হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে খ্রিস্টধর্ম যখন বহুঈশ্বরবাদী (মুশরিক) দের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে লাগল তখন গ্রেগরী দ্যা গ্রেট এবং তৎকালীন মিশনারীদের উদার নীতির কারণে বহুঈশ্বরবাদীদের পালিত শীতকালীন দীর্ঘতম রাত্রি (winter solstice) উদযাপন অনুষ্ঠানের অনেক আচার ধীরে ধীরে খ্রিস্টমাসের সাথে সংযুক্ত হতে থাকল।”

খ্রিস্টমাস পালনের জন্য যে ধরনের কার্যপ্রণালি এর মধ্যে প্রবেশ করানো হয়েছিল সেগুলোর প্রকৃতি পরবর্তী অনুচ্ছেদেই আলোচিত হয়েছে।

“মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ উদ্দীপনার হাত ধরে আমোদ-ফুর্তির ব্যাপারগুলো খ্রিস্টমাসের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকল, যদিও এগুলোর সবই ছিল ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে। তৎকালীন রাজারা বৃহদাকার মিলনায়তনকে সুসজ্জিত করতেন। এখানে তাদের বন্ধুবান্ধব, প্রজা, পরিবারের সদস্যবর্গ আমন্ত্রিত হতেন। তারা সেখানে নৌকা চালাতেন, একত্রে খাবার খেতেন এবং গান করতেন। এছাড়া সেখানে খেলাধুলা, নাচ, সার্কাস এবং বিভিন্ন মুখাভিনেতা দ্বারা অভিনীত মঞ্চনাটক প্রদর্শিত হতো। চার্চগুলো ছিল সেই উৎসবেরই একটা অংশ।”

মহানবী (সাঃ)-এর জন্মদিন পালনের ইতিহাস


কিছু সম্রাট সহীহ ইসলামী প্রমাণ ছাড়াই ১২ই রবিউল আউয়ালে মহানবী (সাঃ)-এর জন্মদিন পালন করা শুরু করলেন। তারা এ অনুষ্ঠানের নাম দিলেন মওলুদ বা মিলাদ, যেখানে মহানবী (সাঃ)-এর জন্মকাহিনী আবৃত হতো। এ মাসের বারো তারিখে মহানবী (সাঃ)-এর জন্মদিন পালন করাটাই যে ইসলামী শিক্ষার বাইরে তা নতুন উদ্ভাবন শুধু তাই নয়; বরং ১২ই রবিউল আউয়াল যে মহানবী (সাঃ)-এর জন্মতারিখ এ বিষয় নিয়েও বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন তারিখ সাব্যস্ত করেছেন। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য আলেমদের মত হলো মহানবী (সাঃ)-এর জন্মদিন ছিল ৯ই রবিউল আওয়াল। জন্মদিনের তারিখ নিয়ে এ মতপার্থক্য থেকে আরও একটি জিনিস স্পষ্ট হয় যে, এটি ইসলামের কোনো অংশ নয়, যদি তাই হতো তাহলে সঠিক তারিখ নির্ভরযোগ্যসূত্রে সংরক্ষিত থাকত।

নিঃসন্দেহে মহানবী (সাঃ)-এর জীবন হচ্ছে মুসলিমদের শিক্ষা গ্রহণের সর্বোত্তম উৎস। প্রত্যেক মুসলমানের কাজই হচ্ছে তাঁর জীবনের ঘটনাগুলো জানা, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই অনুযায়ী আমল করা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনী নিয়ে আলোচনা করা অতি উত্তম আমল। এটি ঈমান বৃদ্ধি করে। কিন্তু কুরআন এবং হাদীস রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনী আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট একটি দিনকে নির্ধারণ করে দেয় নি; বরং এ উত্তম আমল বছরের প্রত্যেকটি মাসে এবং সকল সময়ে করা উচিত। ইসলামী শরীয়া রবিউল আউয়ালের একটি বিশেষ সময়ে লোকজন জড় হয়ে মহানবী (সাঃ)-এর জন্মোৎসব পালনের আদেশ করে না। এটি একটি নতুন সৃষ্টি বা বিদ'আত যেটি সীরাতের আলোচনাকে শুধু রবিউল আওয়াল মাসে সীমাবদ্ধ করতে চেষ্টা করে। এটি মানুষের মনে এ প্ররোচনা সৃষ্টি করে যে, অন্য যেকোনো মাসে সীরাতের আলোচনার চেয়ে এ মাসে সীরাতের আলোচনা করলে অধিক সাওয়াব লাভ করা যাবে। সত্যি কথা বলতে, মহানবী (সাঃ)-এর সাহাবাগণ সারা বছর ধরে শুধু যে মহানবী (সাঃ)-এর জীবনী অধ্যয়ন এবং তাঁর বার্তাকে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করতেন তা নয়, তাঁরা জীবনের পদে পদে তাঁকে অনুসরণ করতেন এবং তাঁর শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করতেন। যা একজন মুসলমানের কাজ হওয়া উচিত। এ বক্তব্য দ্বারা আমরা এটা বুঝাতে চাই না যে, রবিউল আউয়াল মাসে সীরাতের আলোচনা করা যাবে না। আমাদের মূলবক্তব্য হলো, সীরাতের আলোচনাকে শুধু এ মাসে সীমাবদ্ধ করা উচিত নয় এবং এটাও বিশ্বাস করা উচিত নয় যে, শরীয়া এ মাসে এরূপ আলোচনার ওপর কোনো প্রকারের গুরুত্ব আরোপ করেছে।

এরূপ আলোচনার সময় অপর যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে তা হলো এগুলো যেন শরীয়তের নিয়ম অনুসরণ করে পালন করা হয়। মুসলিমের জীবনের প্রতিটি কাজই হবে শরীয়তকে সামনে রেখে। সুতরাং মহানবী (সাঃ)-এর স্মরণকে উদ্দেশ্য করে কোনো অনুষ্ঠানে যেন কিছুতেই শরীয়া বহির্ভূত কিছু ঢুকে না পড়ে সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত।

প্রায়ই দেখা যায়, বিশেষকরে পাশ্চাত্যে, সীরাত আলোচনা অনুষ্ঠানে পুরুষ মহিলা একই সাথে হিজাব ব্যতীত অংশগ্রহণ করেন। মহানবী (সাঃ)-এর শিক্ষা নারী পুরুষের এরূপ মেলামেশার বিরোধী। কিভাবে একটি সীরাত আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে যদি সেখানে সীরাতের মৌলিক বিষয়কে না মানা হয়?

কিছু কিছু অনুষ্ঠানে মহিলাগণ পুরুষ শ্রোতাদের সামনে মহানবী (সাঃ) কে স্মরণ করে রচিত গজল বা না'ত পাঠ করেন। কোনো কোনো সময় এ গজলগুলোর সাথে বাদ্য ব্যবহার করা হয়, যা মহানবী (সাঃ)-এর দিকনির্দেশনার পরিপন্থি। এ রকম আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করা অথবা এগুলোতে অংশগ্রহণ করা শরীয়ার দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ বা হারাম। এটি শুধু শরীয়ার আইনের পরিপন্থিই নয়; বরং এরূপ অনুষ্ঠান মহানবী (সাঃ)এর সীরাতের পবিত্রতা নষ্ট করে।

১২ই রবিউল আওয়াল উপলক্ষে আরও যেসব কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় সেগুলোর মধ্যে আছে মিছিল, শোভাযাত্রা, মহানবী (সাঃ)এর কৃত্রিম সমাধিসৌধ তৈরি করা, বিভিন্ন দালানকোঠা বা রাস্তায় আলোকসজ্জা করা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়া এগুলো করতে নির্দেশ দেয়নি; বরঞ্চ এগুলোর ভিত্তি সচেতন বা অবচেতনভাবে অন্য ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এরূপ কোনো কার্যক্রমের নিদর্শন পাওয়া যায় না। 

মহানবী (সাঃ)-এর ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি হলো প্রথমত তাঁর শিক্ষার অনুসরণ করা এবং দ্বিতীয়ত তাঁর মহান আদর্শ বা সীরাতকে প্রত্যেক মুসলিমের মাঝে জাগ্রত করার চেষ্টা করা। শিশুকাল থেকে মুসলিম শিশুর অন্তরে এ শিক্ষাকে গেঁথে দিতে হবে, পরিবারের সদস্যদেরকে শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা একে অনুসরণ করতে পারেন এবং এ মহাবিশ্বে যত মানুষ এসেছে তাদের মাঝে সুন্দরতম চারিত্রিক মাধুর্যের উদাহরণকে তারা যেন নিজের মাঝে ধারণ করতে পারে। এগুলো হতে হবে ভালোবাসা এবং হৃদয়ের উপলব্ধি দিয়ে, শুধু লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নয়; বরং তার সুন্নাহর প্রকৃত অনুসরণের মাধ্যমে। শুধু শোভাযাত্রা বা আলোকসজ্জা করে এ উদ্দেশ্য সাধন করা যায় না। এজন্য প্রয়োজন অবিরত আন্তরিক চেষ্টা এবং অর্থবহ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ।

ইতিহাস ও হাদীসের আলোকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম তারিখ


সহীহ হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন। হাদীসে নববী থেকে তার জন্ম মাস ও জন্ম তারিখ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সাহাবীগণের মাঝেও এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট মত প্রচলিত ছিল না। এ কারণে পরবর্তী যুগের আলেম ঐতিহাসিকগণ তার জন্মতারিখ সম্পর্কে মতভেদ করেছেন। এ বিষয়ে ১২ টিরও বেশি মত রয়েছে। ইবনে হিশাম, ইবনে সা'দ, ইবনে কাসীর, কুসতলানী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক এ বিষয়ে নিম্নলিখিত মতামত উল্লেখ করেছেনঃ

১. কারো মতে তাঁর জন্ম তারিখ অজ্ঞাত, তা জানা যায়নি এবং তা জানা সম্ভব নয়। তিনি সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন এতটুকুই জানা যায়, জন্ম মাস বা তারিখ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা তারা অবান্তর মনে করেন।

২. কারো কারো মতে তিনি মুহাররম মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। 

৩. অন্য মতে তিনি সফর মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।

৪. কারো মতে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় হিজরি শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক মুহাদ্দিস আবু মা'শার নাজীহ বিন আব্দুর রহমান আস- সিনদী (১৭০হি) এ মত গ্রহণ করেছেন।

৫. অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ। আল্লামা কুসতলানী ও যারকানীর বর্ণনায় এ মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন। এ মতটি দুজন সাহাবী ইবনে আব্বাস ও জুবাইর বিন মুতয়িম থেকে বর্ণিত। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সিরাতের বিশেষজ্ঞ এ মতটি গ্রহণ করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম ইবনে শিহাব যুহরি (১২৫হি) তার উস্তাদ প্রথম শতাব্দির প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও নসববিদ ঐতিহাসিক তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনে মুতয়িম ( ১০০হি.) থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। কুসতলানী বলেনঃ মুহাম্মদ ইবনে জুবাইর আরবদের বংশ পরিচয় ও আরবদের ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মতারিখ সম্পর্কিত এ মতটি তিনি তাঁর পিতা সাহাবী জুবাইর বিন মুতয়িম (রাঃ) থেকে গ্রহণ করেছেন। স্পেনের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ আলী ইবনে আহমদ ইবনে হাযম (৪৫৬হি) ও মুহাম্মদ ইবনে ফাতুহ আল-হুমাইদী (৪৮৮হি) এ মতটিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। স্পেনের মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল বার (৪৬৩হি) উল্লেখ করেছেন যে, ঐতিহাসিকগণ এ মতটিকে সঠিক বলে মনে করেন। মিলাদের ওপর প্রথম গ্রন্থ রচনাকারী আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনে দেহিয়া (৬৩৩ হি) ঈদে মিলাদুন্নবীর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ “আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বশির আন নাযীর"-এ এই মতটিকেই গ্রহণ করেছেন ।

৬. অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ ১০ই রবিউল আউয়াল। এ মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মদ বিন আলী আল বাকের (১১৪হি) থেকে বর্ণিত। ১ম-২য় শতাব্দির প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আমের বিন শারাহিল আশ শাবী (১০৪হি) থেকেও এ মতটি বর্ণিত। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন উমর আল-ওয়াকিদী (২০৭হি) এ মত গ্রহণ করেছেন। ইবনে সা'দ “আত তাবাকাতুল কুবরা"-য় শুধু দুটি মত উল্লেখ করেছেন, ২ তারিখ ও ১০ তারিখ ।

৭. কারো মতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম তারিখ ১২ই রবিউল আউয়াল। এ মতটি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (১৫১ হি.) গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাতির বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন। (ইবনে হিশাম, আস সিরাতুন নাবাবীয়্যাহ ১/১৮৩) এখানে লক্ষণীয় যে ইবনে ইসহাক সীরাতুন্নবীর সকল তথ্য সাধারণতঃ সনদসহ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এ তথ্যটির জন্য কোনো সনদ উল্লেখ করেননি। কোথা থেকে তিনি এ তথ্যটি গ্রহণ করেছেন তাও জানাননি বা সনদসহ প্রথম শতাব্দির কোনো সাহাবি বা তাবেয়ী থেকে বর্ণনা করেন নি। এ জন্য অনেক গবেষক এ মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। তা সত্ত্বেও পরবর্তী যুগে এ মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইবনে কাসীর উল্লেখ করেছেন যে, ২জন সাহাবি জাবির (রাঃ) ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এ মতটি বর্ণিত।

৮. অন্য মতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম তারিখ ১৭ই রবিউল আউয়াল। 

৯. অন্য মতে তাঁর জন্ম তারিখ ২২ শে রবিউল আউয়াল।

১০. অন্য মতে তিনি রবিউস সানী মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। 

১১. অন্য মতে তিনি রজব মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। 

১২. অন্য মতে তিনি রমজান মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।

তৃতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যুবাইর ইবনে বাক্কার ( ২৫৬হি) থেকে এ মতটি বর্ণিত। তার মতের পক্ষে যুক্তি হলো যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বসম্মতভাবে রমজান মাসে নবুওয়্যাত পেয়েছেন। তিনি ৪০ বৎসর পূর্তিতে নবুওয়্যাত পেয়েছেন। তাহলে তার জন্ম অবশ্যই রমজান মাসে। এছাড়া কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) হজ্বের পবিত্র দিনগুলোতে মাতৃগর্ভে আসেন। সেক্ষেত্রেও তার জন্ম রমজানেই হওয়া উচিত। এ মতের সমর্থনে আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর থেকে একটি বর্ণনা আছে বলে উল্লেখ করেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওফাত দিবস


বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সোমবার ইন্তিকাল করেন ।

কিন্তু এ সোমবারটি কোন মাসের কোন তারিখ ছিল তা কোনো হাদীসে নেই। সাহাবী ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রমযান মাসের ১১ তারিখে ইন্তিকাল করেন। এ একক বর্ণনাটি ছাড়া মুসলিম উম্মাহর সকল ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিসগণ একমত যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু কোন তারিখে ইন্তিকাল করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে ।

বুখারী ও মুসলিম সংকলিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিদায় হজ্জের ৯ই যিলহাজ্জ আরাফায় অবস্থানের দিনটি ছিল শুক্রবার। এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, সে বছর যিলহাজ্জ মাসের ১ তারিখ ছিল বৃহস্পতিবার। আমরা জানি যে, বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে তিনি যিলহাজ্জ মাসের বাকি দিনগুলো এবং মুহাররম ও সফর মাস মদিনায় অবস্থান করেন এবং রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন । কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেন যে, তিনি বিদায় হজ্জের এ দিনের পরে ৮০ বা ৮১ দিন জীবিত ছিলেন। এরপর রবিউল আউয়াল মাসের শুরুতে তিনি ইন্তিকাল করেন।

ইন্তিকালের তারিখ সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরীর তাবেয়ী ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তী ঐতিহাসিকগণের ৪টি মত রয়েছে ১লা রবিউল আউয়াল, ২রা রবিউল আউয়াল, ১২ই রবিউল আউয়াল ও ১৩ রবিউল আউয়াল।

সাধারণভাবে পরবর্তীকালে ১২ তারিখের মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু এখন একটি কঠিন সমস্যা রয়েছে। আমরা জানি যে, আরবি মাস ৩০ বা ২৯ দিনে হয় এবং সাধারণতঃ পরপর ৩টি মাস ২৯ বা ৩০ দিন হয় না। উপরের হাদিস থেকে আমরা জেনেছি যে, যিলহজ্জ মাস শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার। আর বৃহস্পতিবার ১লা যিলহজ্জ হলে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ কোনো ভাবেই সোমবার হতে পারে না। যিলহজ্জ, মুহাররম, সফর তিনটি মাসই ৩০ দিনে ধরলে ১ লা রবিউল আউয়াল হয় বুধবার। দুটা ৩০ একটি ২৯ ধরলে ১লা রবিউল আউয়াল হয় মঙ্গলবার। দুটা ২৯ একটি ৩০ ধরলে ১লা রবিউল আউয়াল হয় সোমবার, আর তিন মাসই ২৯ দিনে ধরলে ১লা রবিউল আউয়াল হয় রবিবার। আর কোনো হিসেবেই ১২ তারিখ সোমবার হয় না। এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য কেউ কেউ ১৩ তারিখের কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন তিনটি মাস ই ৩০ দিনে ছিল এবং মদিনার একদিন পরে চাঁদ দেখা গিয়েছিল। দুটি ব্যাখ্যাই দূরবর্তী।১০

দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবেয়ী ঐতিহাসিক আল্লামা সোলাইমান ইবনে তারখান আত-তাইমী (৪৬-১৪৩হি) বলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অসুস্থতা শুরু হয় ২২ সফর শনিবার। ১০ দিন অসুস্থ থাকার পর ২রা রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি ইন্তিকাল করেন।১১

তাঁর এ মত অনুসারে সে বৎসরের যিলহাজ্জ মুহাররম ও সফর তিনটি মাসই ২৯ দিনে ছিল, যা সাধারণতঃ খুব কম ঘটে। এ জন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ও গবেষক ১লা রবিউল আউয়ালের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে আল্লামা সুহাইলী, ইবনে হাজার প্রমুখ গবেষক, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ২ তারিখের মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। তিনটি কারণে তাঁরা এ মতটি গ্রহণ করেছেন। প্রথমত, তাবেয়ীগণের যুগ হতে সহীহ সনদে কথাটি পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এ মতটি বিদায় হজ্জের পরে তাঁর ৮০ দিন বা ৮১ দিন জীবিত থাকার বর্ণনাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তৃতীয়ত, যারা ১২ বলেছেন তাদের কথার একটি দূরবর্তী ব্যাখ্যা দেয়া যায় যে, আরবীতে 'মাসের দুইকে' 'দশের দুই' পড়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। কেউ হয়তো ২ কে ১৩ পড়েছিলেন ও লিখেছিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসরণ করেছে। ১২

হাদীসের আলোকে রবিউল আউয়াল মাসের ফযীলত


উপরের আলোচনা হতে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম বা ওফাতের মাস হিসেবে রবিউল আউয়াল মাসের কোনো উল্লেখ হাদীস শরীফে নেই। এ মাসের কোনো বিশেষ ফযীলত বা বিশেষ আমল কোনো কিছুই হাদীসে বর্ণিত হয়নি।

ঈদ এ মিলাদুন্নবী (সাঃ) পালনের ইতিহাস

এ বিষয়ক মিথ্যা গল্প কাহিনীর মধ্যে রয়েছে, “এ মাসের ১২ তারিখ বুযুর্গ তাবেয়ীগণ মুহাম্মাদ (সাঃ) এর রূহের মাগফিরাতের জন্য ২০ রাকা'য়াত নফল নামায পড়তেন। এ নামায দুই রাকায়াতের নিয়মে আদায় করতেন এবং প্রত্যেক রাকা'য়াতে সূরা ফাতিহার পরে ১১ বার করে সূরা ইখলাস পড়তেন। নামায শেষে আল্লাহর হাবীবের প্রতি সাওয়াব রেছানী করতেন। তারা এর বরকতে স্বপ্নের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দর্শন লাভ করতেন এবং দোজাহানের খায়ের ও বরকত লাভ করতেন। অন্য রেওয়ায়াতে বর্ণিত আছে যে, কোনো মু'মিন ব্যক্তি নিম্নের দরূদ শরীফ এ মাসের যে কোনো তারিখে এশার নামাযের পরে ১১২৫ বার পাঠ করলে আল্লাহর রহমতে সে ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-কে স্বপ্নে দর্শন লাভ করবে।.....”১৩

এরূপ আরো অনেক ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে দেখা যায়।১৪ এগুলি সবই বানোয়াট কথা। রাসূলুল্লাহ সা (সাঃ)-এর ইন্তিকালের পরবর্তী তিন যুগ, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের মধ্যে এ মাসটির কোনো পরিচিতিই ছিল না। এ মাসটি যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম মাস সেই কথাটিই তখনো প্রসিদ্ধি লাভ করে নি।

৪০০ হিজরীর দিকে সর্বপ্রথম মিশরের ফাতেমীয় শিয়া শাসকগণ এ মাসে 'মিলাদ' বা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম দিবস পালন করে। ৬০০ হিজরীতে ইরাকের ইরবিল শহরে ৮ ও ১২ই রবিউল আউয়াল মীলাদ বা মীলাদুন্নবী বা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম উদযাপন শুরু হয়। অপরদিকে ভারত ও অন্যান্য দেশে ১২ই রবিউল আউয়ালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইন্তিকাল উপলক্ষ্যে 'ফাতেহা' বা 'ফাতেহায়ে দোয়াজদহম' উদযাপন শুরু হয়।


তথ্যসূত্রঃ
১. সহীহ মুসলিম ২/৮১৯; মুসনাদে আহমদ ৪/১৭২-১৭৩, নং২৫০৬।
২. ইবনে সা'দ আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/৮০-৮১ ।
৩. মাহদী রেজকুল্লাহ আহমাদ আস-সিরাতুন নাবারীয়্যাহ ১০৯ পৃ
৪. ইবনে সাদ, আত-ত্বাকাতুল কুবরা ১/১০০-১০১, ইবনে কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/ ২১৫, আল কাসতালানী, আহমদ বিন মুহাম্মদ, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ১/৭৪-৭৫, আল- যারকানী, শারহুল মাওয়াহীন আল-নানুরীয়া ১/২৪৫/২৪৮, ইবনে রাজাব, লাতায়েফুল মায়ারেফ, প্রথক ১/১৫০।
৫. বুখারী আস সহীহ ১/২৬২, ৪/১৬১৬। মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩১৫; আৰু নুআইম ইসপাহানি, আল মুসনাদ আল-মুসতাখরাজ আলা সহীহ মুসলিম ২/৪৩-৪৪।
৬. ইবনু হাজার, ফাতাহতুল বারী ৮/১২৯।
৭. এ বুখারী ১/২৫, ৪/১৬০০, ১৬৮৩, ৬/২৬৫৩, মুসলিম, ৪/২৩১২-২৩১৩।
৮. ইবনু হাজার, ফাতাহতুল বারী ৮/১৩০।
৯. ইবনু হাজার, ফাতাহতুল বারী ৮/১২৯।
১০. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯-১৩০। 
১১. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯। 
১২. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯-১৩০।
১৩. মুফতি হাবিব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৬-১৭।
১৪. অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ৩০১, ৩২।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url