রবিউল আউয়াল মাসের বির্তক || মিলাদ রজনী সমস্ত রজনী অপেক্ষা উত্তম || কখন হতে মিলাদ শরীফ পালিত হচ্ছে ||







মিলাদ রজনী সমস্ত রজনী অপেক্ষা উত্তম


আল্লাহ্ পাক পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন- “ওয়াজকুরু হুম বে আয়ামিল্লাহ্” -সূরা ইব্রাহীম, আয়াত-৫

অর্থাৎ  তাদেরকে আল্লাহর দিবসগুলি স্মরণ করিয়ে দিন ।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, সমস্ত দিন ও রাতকে আল্লাহ্ পাকই সৃষ্টি করেছেন। সকল দিন আল্লাহরই তবে সেটা কোন দিবস যাকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য আল্লাহ্ পাক নির্দেশ দিচ্ছেন ।

তফসীরকারকগণ বলেন "আয়ামুল্লাহ্” বা আল্লাহর দিনগুলি দ্বারা সে সব দিনগুলিকে বুঝানো হয়েছে যে গুলোর মধ্যে আল্লাহ্ পাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ তথা নেয়ামত ও রহমত দান করেছেন। যেমন- শবে কদর, শবে বরাত, শবে মেরাজ, কোরবানীর ঈদের দিন, ১০ই মহরম এর দিন, নবীগণের জন্ম দিন ইত্যাদি । ঈমানদারগণ সকলেই জানেন সরকারে দো-জাহা রাহমাতাল্লিল আলামিন, শাফিউল মুজনাবীন, নেয়ামতুল্লাহ্, আহমদে মোজতবা হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হলেন আল্লাহ্ পাকের তরফ হতে সমগ্র জগতের জন্য সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম নেয়ামত ও রহমত । বাকী সব নেয়ামত ও রহমত তাঁরই অবদান কেননা আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-

“হে হাবীব আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না।” - হাদিসে কুদসী

সুতরাং যে দিনে এই মহান নেয়ামত ও রহমত দান করা হয়েছে সে দিনকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং মানুষকে বলে দেয়া যে, এটা ঐ দিবস যে দিবসে আল্লাহ্ তায়ালা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে পাঠিয়ে মুমিনদের প্রতি বড় অনুগ্রহ ও উপকার করেছেন। যেমন সূরা আল ইমরানের ১৬৪নং আয়াতে বর্ণিত আছে।

নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন ।

কাজেই সেই দিবসকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই আল্লাহ্ পাক প্রথমোক্ত আয়াতে বিশেষভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মিলাদ রজনী শবে কদর অপেক্ষাও উত্তম। কেননা মিলাদ, রজনীতে স্বয়ং হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আত্মপ্রকাশ করেছেন আর শবে কদর হুজুর পাককে দান করা হয়েছে। যে রজনী পবিত্রতম স্বত্ত্বার আত্মপ্রকাশের দ্বারা সম্মান লাভ করেছে তা সেই রজনী অপেক্ষা অবশ্যই উত্তম যা তাঁকে দান করার জন্য সম্মানিত হয়েছে এবং এতে কোন বিরোধ নাই। দ্বিতীয়তঃ শবে কদর রজনীতে শুধু হুজুর পাকের উম্মতের জন্য রয়েছে অনুগ্রহ ও ইহসান আর মিলাদ রজনীতে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব ভ্রামাণ্ডের জন্য নেয়ামত ও রহমত।

বিশ্ব বরেণ্য মুহাদ্দেস হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলবী (রঃ) তাঁর বিখ্যাত কিতাব “মাছাবাতা বিছুসুন্নাহ" এর ৮১ পৃষ্ঠায় বলেছেন, “মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর রজনী শবে কদর এর রজনী হতে নিঃসন্দেহে উত্তম, কেননা মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর রাত্রি স্বয়ং প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর আগমনের রাত্রি আর শবে কদরতো তাকেই প্রদান করা হয়েছে ।

ইমাম আবু বকর ইবনে খতীব কুসতুলানী তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত কিতাব “মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া” এর ১ম খন্ডের ২৬,২৭ নং পৃষ্টার মধ্যে এর পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান দলিল পেশ করেছেন। একই ভাবে তুলনা করলে দেখা যাবে সমস্ত রজনী অপেক্ষা উত্তম রজনী হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মিলাদ বা জন্ম গ্রহনের রজনী।


কখন হতে মিলাদ শরীফ পালিত হচ্ছে ?


এই অধ্যায়ে আছে-
ক) মিলাদ আল্লাহ্ পাকের সুন্নত
খ) মিলাদ ও কেয়াম ফেরেস্তাগণের সুন্নত 
গ) মিলাদুন্নবী উদযাপন নবীগণের সুন্নত 
ঘ) সাহাবাগণের দ্বারা মিলাদুন্নবী মাহফিলের প্রমাণ

১। স্বপ্রনোদিত হয়ে নিজ গৃহে মিলাদ উৎযাপন
২। রাসূলে পাকের অনুমতি নিয়ে তাঁর সামনে মিলাদ উৎযাপন 
৩ । রাসূলে পাক নির্দেশ দিয়েছেন মিলাদ উদ্যাপনে
৪ । রাসূলে পাকের অনুমতি ব্যতিরেকে স্বপ্রনোদিত হয়ে মিলাদ উৎযাপন

মিলাদ আল্লাহ্ পাকের সুন্নাত


প্রিয় নবীজির মিলাদ তথা পবিত্র জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা আমরা পবিত্র কোরআন পাকে দেখতে পাই । সর্বপ্রথম পবিত্র মিলাদুন্নবীর সূচনা করেন স্বয়ং আল্লাহ্ পাক ।

সূরা আল ইমরানের ৮১-৮২ নং আয়াতে রোজে আজলের দিনে তথা ওয়াদা গ্রহণের দিনে আল্লাহ্ পাক স্বয়ং সমস্ত আম্বিয়া কেরামদের একত্রিত করে তার প্রিয় হাবিবকে দুনিয়াতে প্রেরণের শুভ সংবাদ দেন। শুধু তাই নয়, তিনি সমস্ত আম্বিয়া কেরামদের নিকট হতে ওয়াদা গ্রহণ করেন, তারা যেন প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ জামানায় তাদের নিজ নিজ উম্মতের কাছে আল্লাহর এই প্রিয় হাবিবের দুনিয়ায় আগমনের বার্তা পৌঁছে দেন। অর্থাৎ দুনিয়াতে আমাদের প্রিয় নবীজির শুভাগমন বার্তা তথা জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা যেন নিজ নিজ উম্মতের নিকট করেন। যাকে প্রকারান্তরে মিলাদ মাহফিল উদযাপন বলা যায়। যার ফলশ্রুতিতে অন্যান্য সকল ধর্মগ্রন্থেও আমরা প্রিয় নবীজির জন্মবৃত্তান্ত আলোচিত হতে দেখতে পাই । যেমন পবিত্র কোরআন পাকে আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-

“(হে হাবীব), স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্ সমস্ত নবীগণের নিকট থেকে তাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, আমি তোমাদের যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তশরীফ আনয়ন করবেন তোমাদের নিকট রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যিনি তোমাদের কিতাবগুলোর সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চয়ই তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করবে এবং এরশাদ করলেন তোমরা কি অঙ্গীকার করলে এবং এ সম্পর্কে কি আমার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলে। সবাই আরজ করল, আমরা স্বীকার করলাম। এরশাদ করলেন, তবে তোমরা একে অপরের উপর স্বাক্ষী হয়ে যাও এবং আমি নিজেও তোমাদের সাথে স্বাক্ষীদের মধ্যে রইলাম । সুতরাং এরপর যে কেউ ফিরে যাবে তবে সেসব লোক ফাসিক (নাফরমান) । -সূরা আল-ইমরান, আয়াত-৮১,৮২

আল্লাহ্ পাক যে নবীগণেরও মিলাদ পাঠ করেন তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ সূরা মরিয়ম। এ সূরাতে আল্লাহ্ পাক যে কত সুন্দরভাবে হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালামের পুত্র হযরত ইয়াহইয়্যা (আঃ) এর মিলাদ পাঠ করেছেন তা পবিত্র কোরআন পাকের সূরা মরিয়মের ২নং আয়াত হইতে ১৪নং আয়াত পর্যন্ত পড়লে মুগ্ধ হতে হয়। শুধু তা নয়। মিলাদ শেষে ১৫নং আয়াতে হযরত ইয়াহইয়্যা (আঃ) এর প্রতি আল্লাহ্ পাক স্বয়ং সালাম পেশ করেছেন । আমি এখানে সূরা মরিয়মের ২ হইতে ১৪ নং আয়াতের বঙ্গানুবাদ তুলে ধরছি। যাতে মিলাদের সুন্দর বর্ণনা শৈলী সকলেই বুঝতে পারবেন- আয়াত নং ২ হতে ১৪ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হল-

২. এটা হচ্ছে বিবরণ তোমার প্রতিপালকের (আল্লাহ্ পাকের) ঐ রহমতের যা তিনি আপন বান্দা যাকারিয়ার প্রতি করেছেন।

৩. যখন সে আপন প্রতিপালককে নীরবে আহবান করেছে ।

৪. আরজ করল, হে আমার প্রতিপালক আমার অস্থি দুর্বল হয়ে গেছে এবং আমার চুলগুলো থেকে উজ্জ্বল শুভ্রতা প্রকাশ পেয়েছে এবং হে আমার প্রতিপালক, তোমাকে আহবান করে কখনো আমি ব্যর্থকাম হইনি ।

৫. এবং আমার মনে আমার পরে আমার স্বজনদের সম্পর্কে আশংকা রয়েছে এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা, সতরাং আমাকে তোমার নিকট থেকে এমন কাউকে দান করো যে আমার কাজ সম্পাদন করবে ।

৬. যে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং ইয়াকুবের বংশধরদের উত্তরাধিকারী হবে। এবং হে আমার প্রতিপালক তাকে পছন্দনীয় করো ।

৭. (প্রতি উত্তরে আল্লাহ্ পাক বলেন) হে যাকারিয়া আমি তোমাকে সুসংবাদ শুনাচ্ছি এক পুত্রের যার নাম ইয়াহইয়্যা, এর পূর্বে আমি এ নামে কাউকেই নামকরণ করিনি ।

৮. আরজ করল, হে আমার প্রতিপালক, আমার পুত্র কোত্থেকে হবে? আমার স্ত্রী ত বন্ধ্যা এবং আমি বার্ধক্যের কারণে শুকিয়ে যাবার অবস্থায় পৌঁছে গেছি।

৯. বললেন এরূপই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন, “তা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমিতো এর পূর্বে তোমাকে ঐ সময় সৃষ্টি করেছি যখন তুমি কিছুই ছিলে না ।

১০. আরজ করলো “হে আমার প্রতিপালক আমাকে কোন নিদর্শন দিয়ে দাও । বললেন, “তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি তিন রাত তিন দিন মানুষের সাথে বাক্যলাপ করবে না, একেবারে সুস্থ থাকা সত্ত্বেও।

১১. অতঃপর (হযরত যাকারিয়া আঃ) আপন সম্প্রদায়ের নিকট মসজিদ থেকে বের হয়ে আসলো। তারপর তাদেরকে (সম্প্রদায়ের লোকদেরকে) ইঙ্গিতে বললো, “সকাল-সন্ধ্যায় (আল্লাহর) পবিত্রতা ঘোষণা করতে থাকো ।

১২. (যখন ইয়াহইয়্যা (আঃ) এর বয়স প্রায় তিন বৎসর তখন আল্লাহ পাক
তাকে বলেন) “হে ইয়াহইয়্যা কিভাবটা (তাওরাত) দৃঢ়তার সাথে ধারণ কর।” এবং (আল্লাহ্ পাক ইয়াহইয়্যা (আঃ) এর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন) আমি তাকে শৈশবেই নবুয়ত প্রদান করেছি।

১৩. এবং আমার নিকট থেকে দয়া এবং পবিত্রতা এবং সে পরিপূর্ণ খোদা ভীতিসম্পন্ন ছিল ।

১৪, এবং আপন মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহারকারী ছিল, উদ্ধত ও অবাধ্য ছিল না।”

এ পর্যন্ত বর্ণনা করার পর আয়াত নং ১৫ তে আল্লাহ পাক স্বয়ং তার প্রতি সালাম পেশ করেন এভাবে

“ওয়া সালামুন আলাইহি ইয়াওমা বুলিদা ওয়া ইয়াওমা ইয়ামুতু ওয়া ইয়াওমা ইয়ুবআছু হাইয়্যা।”

অর্থাৎ আর তার প্রতি সালাম (শান্তি) যে দিন জন্মগ্রহণ করেছে, যেদিন মৃত্যুবরণ করবে এবং যে দিন জীবিতাবস্থায় পুনরুত্থিত হবে।”

এই আয়াতে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান আল্লাহ্ পাক তাঁর জন্মদিনে এবং মৃত্যু দিবসে সালাম পেশ করেছেন। নবীদের মৃত্যু দিবসেও তাদের প্রতি সালাম পেশ করতে হয়, ইহা আল্লাহ্ পাকের সুন্নত ।

মিলাদুন্নবী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম উদযাপনের বিরুদ্ধবাদী দল যারা এযুক্তি দেখান যে ১২ই রবিউল আওয়াল আমাদের নবীর মৃত্যু দিবসও কাজেই আমরা সেদিন শোক পালন করব না কি আনন্দ করব তাদের জন্য ইহা একটি উত্তম উদাহরণ যে, নবীগণের জন্মদিনে আল্লাহ্ পাকের সুন্নত অনুযায়ী যেমন সালাম পেশ করতে হয় তেমনি তাদের মৃত্যু দিবসেও সালাম পেশ করতে হবে। বরং এটা বিশ্বাস রাখতে হবে এবং কোরআন হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত যে নবীগণ মরেন না বরং তাঁরা জীবিত। শুধু এতটুকুই যে তারা লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যান ।

কী সুন্দর এ মিলাদ শরীফ ও সালাম পেশ । সত্যিই মনোমুগ্ধকর । আমরাও ঠিক একইভাবে আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মিলাদ শরীফ তথা জন্মবৃত্তান্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করার সময় সালাম পেশ করে থাকি- 

ইয়া নবী সালামু আলাইকা, ইয়া রাসূল সালামু আলাইকা ।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ পাক অন্যান্য নবীগণেরও জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করেছেন । যেমন-সূরা তোয়াহার ৩৭-৩৯ নং আয়াতে হযরত মূসা (আঃ) এর জন্ম বৃত্তান্ত, জন্মকালের অবস্থা, জন্মগ্রহণের পরে সিন্ধুকে করে নীলনদে ভাসিয়ে দেওয়া, ফেরআউনের গৃহে নিজ মাতৃক্রোড়ে লালিত পালিত হওয়া ইত্যাদি বিষদ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তদ্রুপ সুরা মরিয়ম এর ১৬-৩২ নং আয়াতে হযরত ঈসা (আঃ) এর মিলাদ তথা জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়েছে ।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ পাক হযরত ঈসা (আঃ)-এর মিলাদ বা জন্মবৃত্তান্ত কিভাবে আলোচনা করেছেন তা এখানে হুবহু তুলে ধরছি-

আয়াত নং ১৬ হতে ৩২ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে বর্নিত হল-
১৬. (হে হাবিব) কিতাবে (পবিত্র কোরআনে) মরিয়ামকে স্মরণ করুন, , যখন (সে) আপন পরিবারবর্গ হতে পূর্ব দিকে পৃথক এক স্থানে চলে গিয়েছিল ।

১৭. অতঃপর সে তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য পর্দা করল । অতঃপর আমি তার কাছে আমার রুহু (ফেরেস্থা জিব্রাঈল আঃ) কে পাঠালাম । সে তার কাছে এক পূর্ণ মানবাকৃতি ধারণ পূর্বক আত্মপ্রকাশ করল ।

১৮. (মরিয়াম) বলল আমি তোমার থেকে দয়াময় আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, যদি তুমি আল্লাহকে ভয় কর ।

১৯. (ফেরেস্তা) বলল আমিতো শুধু আপনার রব এর প্রেরিত (ফেরেস্তা) আপনাকে এক পবিত্র সন্তান দান করার জন্য এসেছি।

২০. (মরিয়ম) বলল কিরূপে আমার পুত্র হবে, অথচ কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি এবং আমি অসতীও নই।

২১. ফেরেস্তা বলল এরূপই হবে। আপনার রব বলেছেন এরূপ করা আমার পক্ষে সহজ । আমি তাকে (হযরত ঈসা আঃ) মানুষের জন্য নিদর্শন ও আমার তরফ থেকে রহমত স্বরূপ করতে চাই। আর এটাতো একটি স্থিরকৃত বিষয় ।

২২. তারপর সে তাঁকে গর্ভধারণ করল এবং তাঁকে নিয়ে কোন দূরবর্তী নির্জন স্থানে চলে গেল।

২৩. অবশেষে প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর বৃক্ষের নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল । সে বলল, হায় এর পূর্বেই যদি মরে যেতাম এবং মানুষের মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যেতাম ।

২৪. পরক্ষনে ফেরেস্তা তার নিম্নদিক থেকে তাকে ডেকে বলল আপনি চিন্তিত হবেন না, আপনার রব আপনার নিম্ন দিকে একটি ঝরণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন ৷

২৫. আর আপনি ঐ খেজুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দিন তাতে আপনার কাছে টাটকা খেজুর ঝরে পড়বে ।

২৬. অতপর আহার করুন, পান করুন ও চক্ষু জুড়ান (সন্তান ঈসা আঃ) কে দেখে। যদি মানুষের মধ্যে কাউকে দেখেন তবে বলে দিন আমি দয়াময় আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোজা মানত করেছি, সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না ।

২৭. অতঃপর সে নবজাত শিশুটিকে কোলে নিয়ে স্বীয় সম্প্রদায়ের কাছে এল। তারা বলল হে মরিয়ম তুমিতো বড় জঘন্য কাজ করে বসেছ ।

২৮. হে হারুনের বোন, তোমার পিতা মন্দ লোক ছিল না। আর তোমার মাতাও অসতী ছিল না।

২৯. তারপর মরিয়ম শিশুপুত্রের প্রতি ইঙ্গিত করল। তারা বলল আমরা এমন শিশুর সাথে কিরূপে কথা বলব, সে এখনও কোলে ।

৩০. শিশু বলল আমিতো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন।

৩১. আর আমি যেখানেই থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে আদেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত কায়েম করতে ও যাকাত দিতে ।

৩২. এবং আমাকে আমার মাতার প্রতি করেছেন একান্ত অনুগত, আর তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত ও দুর্ভাগা ।

আল্লাহ্ পাক কত সুন্দরভাবে হযরত ঈসা (আঃ) এর মিলাদ বা জন্মবৃত্তান্ত এখানে আলোচনা করেছেন। জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করার পর পরবর্তী আয়াতে হযরত ঈসা (আঃ) নিজের প্রতি তেমনিভাবে সালাম পেশ করেছেন, যেমনিভাবে আল্লাহ্ পাক হযরত ইয়াহইয়্যা (আঃ) এর উপর পেশ করেছেন। যেমনঃ -

“ওয়া সালামুন আলাইয়ি ইয়াওমা বুলিদা ওয়া ইয়াওমা ইয়ামুতু ওয়া ইয়াওমা ইয়ুবআছু হাইয়্যা।” --সূরা মরিয়ম, আয়াত-৩৩

অর্থাৎ আমার প্রতি সালাম (শাস্তি) বর্ষিত হোক যে দিন জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করব এবং যে দিন জীবিতাবস্থায় পুরখিত হব।”

কাজেই উপরোক্ত ঘটনা হতে স্পষ্ট বুঝা যায় নবীগণের জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা ও আলোচনা শেষে সালাম পেশ করা আল্লাহ্ পাকের এবং নবীগণের সুন্নত । শুধু তাই নয় মৃত্যু দিবসেও নবীগণের প্রতি সালাম পেশ করতে হবে। উপরোক্ত আলোচনা হতে ইহা স্পষ্ট সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, হযরত ইয়াহইয়্যা ও হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্ম দিনে যদি সালামুন আলাইকা বলে সালাম পেশ করা যায় তবে আমাদের নবী সাইয়্যেদুল মুরসালীন রাহমাতুল্লিল আলামিন হাবিবে খোদা হযরত রাসূল পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র বেলাদত তথা মিলাদ দিবসেও আমরা তাঁর প্রতি ইয়া নবী সালামু আলাইকা বলতে পারি । ইহা আল্লাহ্ পাক ও নবী ঈসা (আঃ) এর তথা নবীগণের সুন্নত।


মিলাদ ও কেয়াম ফেরেস্তাগণের সুন্নত


মাওয়াহেবে লাদুনিয়া, মাদারেজুন নবুয়াত ও অন্যান্য গ্রন্থে বেলাদত প্রসংগে উল্লেখ আছে যে, প্রিয় নবীজি সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র বেলাদতের রাত্রে হযরত আমেনা (রাঃ) এর দুয়ারে দাড়িয়ে ফেরেস্তাগণ সালাত ও সালাম পেশ করেছিলেন এবং চির শত্রু শয়তান দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পলায়নরত অবস্থায় ছিল। এ থেকে বুঝা যায় মিলাদশরীফ ফেরেস্তাগণের সুন্নত এবং এও বুঝা যায় প্রিয় নবীজির পবিত্র জন্মের সময় দাঁড়িয়ে থাকা তথা কেয়াম করা ফেরেস্তাদের কাজ এবং পালিয়ে থাকাটা হচ্ছে শয়তানের কাজ। এখন এটা জনগণের ইখতিয়ার, চাহে ফেরেস্তাদের কাজ অনুযায়ী আমল করুক অথবা শয়তানের কাজ অনুযায়ী ।

অন্য এক হাদিসে হযরত কাব (রাঃ) বলেন, এমন কোন দিন উদয় হয় না- যেদিন ৭০ হাজার ফেরেস্তা নাজিল হয়ে রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর রওজা মোবারক বেষ্টন করে তাদের নূরের পাখা বিস্তার করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নবীজির উপর দরূদ ও সালাম পাঠ করে না। অতঃপর যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে তখন তারা আকাশে আরোহন করে এবং সম সংখ্যক ফেরেস্তা অবতরণ করে তাঁদের মতই দরূদ ও সালাম পাঠ করতে থাকেন ।

এরূপ চলতেই থাকবে। আবার কেয়ামতের দিন যখন জমিন বিদীর্ণ হয়ে যাবে তখন তিনি ৭০ হাজার ফেরেস্তা দ্বারা বেষ্টিত হয়ে প্রেমাষ্পদের রূপ ধারণ করে আসল প্রেমিকের সাথে শীঘ্র মিলিত হবেন। (দারমী ও মিশকাত- বাবুল কারামাত হাশিয়াসহ)।

দেখা যায় ফেরেস্তাগণ কেয়ামের সাথে নবীজী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করেন প্রতিদিন এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা চলতে থাকবে ।

মিলাদুন্নবী উদযাপন নবীগণের সুন্নত

হযরত আদম (আঃ) এর যুগে মিলাদ


হযরত আদম (আঃ) প্রিয় পুত্র ও প্রতিনিধি তথা পরবর্তী নবী হযরত শীষ (আঃ) কে নূরে মোহাম্মদী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর তাজীম করার জন্য নিম্নোক্ত ওসিয়ত করে গেছেন-

“হে প্রিয় বৎস! আমার পরে তুমি আমার খলিফা। সুতরাং এই খেলাফতকে তাকওয়ার তাজ ও দৃঢ় একিনের দ্বারা মজবুত করে ধরে রেখ। আর যখনই আল্লাহর নাম জিকির করবে তার সাথেই মোহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর নামও উল্লেখ করবে । তাঁর কারণ এই, আমি রূহ ও মাটির মধ্যবর্তী থাকা অবস্থায়ই তাঁর পবিত্র নাম আরশ এর পায়ায় লিখিত ছিল। এরপর আমি সমস্ত আকাশ ভ্রমণ করেছি। বেহেস্তের এমন কোন প্রাসাদ ও কামরা পাইনি যেখানে তাঁর নাম লেখা ছিল না ।

আমি তাঁর নাম আরও লিখিত দেখেছি সমস্ত হুরদের স্কন্দ দেশে। বেহেস্তের সমস্ত বৃক্ষের পাতায়, বিশেষ করে তুবা বৃক্ষের পাতায় পাতায় ও ছিদরাতুল মুস্তাহা বৃক্ষের পাতায় পাতায়, পর্দার কিনারায় ও ফেরেস্তাদের চোখের মণিতে ঐ নাম অঙ্কিত দেখেছি ।

সুতরাং হে শীষ! তুমি এই নাম বেশী বেশী করে জপতে থাক। কেননা, ফেরেস্তাগণ পূর্ব হতেই ঐ নাম জপনে মশগুল রয়েছে । -জুরকানী

উল্লেখ্য যে, সর্বপ্রথম দুনিয়াতে ইহাই জিকরে মিলাদুন্নবী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মিলাদ পাঠ ও কেয়াম


হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পুত্র ইসমাইল (আঃ) সহ কাবা গৃহ পুনঃনির্মানকালে তাঁদের উক্ত নির্মাণ কাজ কবুল হওয়ার জন্য এবং স্বীয় বংশে আখেরী নবী তথা হযরত মোহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর যেন শুভ আগমন হয়। তার জন্য মাকামে ইব্রাহিমে যে পাথর আছে সে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে (অর্থাৎ কেয়াম করে) যে দোয়া করেছিলেন তা পবিত্র কোরআন পাকে সূরা বাকারায় ১২৯ নং আয়াতে এভাবে উল্লেখ আছে-

“হে আমার রব তুমি এই আরব ভূমিতে আমার ইসমাইলের বংশের মধ্যে তাদের মধ্য হতেই সেই মহান রাসূলকে প্রেরণ কর- যিনি তোমার আয়াতসমূহ তাদের কাছে পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কোরআন, সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান শিক্ষা দিবেন এবং বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে তাদেরকে পবিত্র করবেন।" -সূরা বাকারা, আয়াত-১২৯ ।

পবিত্র কোরআনের এই আয়াত হতে বুঝা যায় প্রিয় নবাজী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর আর্বিভাবের বহু পূর্বে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে সঙ্গে নিয়ে তার আবির্ভাব, তার সারা জীবনের কর্মচাঞ্চল্য ও মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধতার ক্ষমতা বর্ণনা করেছেন তথা হুজুর পাকের মিলাদ পাঠ করেছেন । এই মিলাদ মাকামে ইব্রাহিমে যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নাই এবং তারই নিদর্শন স্বরূপ প্রিয় নবীজির বরকতে সেই পাথরে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সম্পূর্ণ পায়ের ছাপ অঙ্কিত হয়ে যায় । আল্লাহ্ পাক তাঁর এই দোয়া কবুল ও মঞ্জুর করেন এবং তাঁর প্রিয় হাবির-এর আগমনী বার্তার স্মৃতিস্বরূপ সেই পাথরখানা সংরক্ষণ করার জন্য হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে নির্দেশ দেন ।

শুধু তাই নয় প্রিয় নবীজির মিলাদ ও কেয়ামকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং এর শুকরিয়া আদায় কল্পে পরবর্তী উম্মতগণকে কাবা শরীফ তাওয়াফ করার পর এখানে সেই স্মৃতি বহু পাথরকে সামনে রেখে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা ওয়াজিব করে দেন, যা না পড়লে তাওয়াফ কবুল হবে না ।

ইহা শুধু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর দ্বারা হুজুর পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর মিলাদকে চির জাগরুক করে রাখার নিমিত্তে। এরই স্মরণে প্রিয় নবীজি সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম। প্রায়ই বলতেন, “আমি হযরত ইব্রাহিম এর দোয়ার ফসল।”
সুতরাং আমাদের মিলাদ পাঠ ও কেয়াম করা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সুন্নত। -বেদায়া ওয়ান নেহায়অ-২য় খন্ড

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রতি যখন তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরাকে ফিলিস্তিন থেকে অন্যত্র নেয়ার হুকুম হল, তখন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) স্ত্রী পুত্রসহ (আল্লাহ্ প্রেরিত সওয়ারী বোরাকে চড়লেন । যখনই কোন মনোরম ও উপযোগী স্থান অতিক্রম করতেন, তখনই হযরত ইব্রাহিম (আঃ) বলতেন, হে জিব্রাইল (আঃ) এখানে অবতরণ কর । হযরত জিব্রাইল (আঃ) বলতেন, এখানে নয়। এভাবে চলতে চলতে মক্কায় গিয়ে উপনীত হলেন ।
তখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) বললেন, হে ইব্রাহিম (আঃ) এখানে অবতরণ করুন । নবী হযরত ইব্রাহিম (আঃ) বললেন, এটা কোন স্থান যেখানে নেই কোন দুধ এবং ফসলাদী। হযরত জিব্রাইল (আঃ) বললেন, হ্যাঁ বটে। এখানে আপনার ভবিষ্যৎ বংশধর থেকে সেই নবী আত্মপ্রকাশ করবেন যাঁর মাধ্যমে নবুওয়াতের ধারা অর্থাৎ ওহী প্রেরনের ধারা শেষ হয়ে পূর্ণতা লাভ করবে । - ইবনে সা'আদ ।

হযরত দাউদ (আঃ) এর মিলাদ পাঠ


বেহাকী কিতাবে ওয়াহাব বিন আতবা হতে বর্ণিত আছে-

যবুর শরীফ যা হযরত দাউদ (আঃ) এর প্রতি প্রেরিত গ্রন্থ, তাতে আল্লাহ পাক ওহী নাযিলকরে হযরত দাউদ (আঃ) কে বলেন, “হে দাউদ, অতি শিঘ্র তোমার পরে একজন নবী আসিবেন, যার নাম হবে আহমদ ও মোহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম । আমি তাঁর উম্মতগণকে যে সব নফল ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছি, তা কেবল পূর্ববর্তী নবীগণের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল।

এতে বুঝা যায়, যবুর শরীফেও মিলাদুন্নবী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর উল্লেখ আছে ।

হযরত মূসা (আঃ) এর দ্বারা মিলাদুন্নবী পাঠ


আল্লামা আবু নঈম-এর “হিলিয়াতুল আওলিয়া” নামক কিতাবে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, হুজুর সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তাওরাত কিতাবে হযরত মূসা (আঃ) এর উপর আল্লাহ্ পাকের ওহী নাযিল হল, “যারা আহমদকে মানবে না তাহাদিগকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে । হযরত মূসা (আঃ) আরজ করিলেন আহমদ কে? তখন ইরশাদ হল, তাঁহার চেয়ে অধিক সম্মানিত আর কাহাকেও সৃষ্টি করি নাই । আমি তাঁহার নাম আমার নামের সঙ্গে সংযুক্ত করেছি। তাঁহার উম্মতগণ বেহেস্তে প্রবেশ না করা পর্যন্ত অন্য কাহাকেও সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না । তখন হযরত মূসা (আঃ) আরজ করলেন-

হে আল্লাহ্ আমাকে ঐ উম্মতে মোহাম্মদী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মধ্যে দাখিল কর।

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্নিত । তিনি হযরত কাব ইবনুল আহবার (রাঃ) এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তাওরাত কিভাবে রাসূলুল্লাহ্ এর গুনাবলী ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে কি কি পেয়েছ? তিনি উত্তরে বললেন, আমি একথা পেয়েছি যে তাঁর নাম হবে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ । তিনি মক্কায় জন্ম গ্রহণ করবেন এবং মদীনা তাইয়্যেবায় হিজরত করবেন। তাঁর সাম্রাজ্য হবে সিরিয়া (শাম) পর্যন্ত । তিনি অশ্লীল ভাষায় কথা কলবেন না এবং বাজারে গিয়ে উচ্চস্বরে হৈ চৈ করবেন না। তিনি খারাপ কাজের প্রতিশোধ খারাপ কর্ম বা কথা দ্বারা নিবেন না । তিনি মানুষের অপরাধ ক্ষমা ও মার্জন করবেন। -দারেমী, ইবনে সা'আদ ইবনে আসাকির ।

উপরোক্ত ঘটনাদ্বয় দ্বারা হযরত মূসা (আঃ) এর মিলাদুন্নবী উদযাপন স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় ।

হযরত ঈসা (আঃ) এর মিলাদ পাঠ


হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর উম্মত বনি ইসরাইলকে নিয়ে নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মিলাদ শরীফ পাঠ করেছেন। উম্মতের নিকট তিনি শেষ যামানার নবীর নাম, সানা সিফত এবং তাঁর আগমন বার্তা বর্ণনা করেছেন । যার উল্লেখ পবিত্র কোরআন পাকে এভাবে আছে-

“হে আমার প্রিয় রসূল, আপনি স্মরণ করুন ঐ মায়ের কথা, যখন মরিয়ম এর পুত্র ঈসা বলেছিলেন, হে বনি ইসরাইল আমি তোমাদের নিকট নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছি। আমি আমার পূর্ববর্তী তাওরাত কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি- এমন এক মহান রাসূলের সুসংবাদ দিচ্ছি- যিনি আমার পরেই আগমন করবেন এবং তাঁর নাম হবে আহমদ (সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) । -সূরা আছ সাফ, আয়াত-৬

ইবনে কাছির আল বেদায়া ওয়ান নেয়াহা গ্রন্থের ২য় খন্ডে ২৬১ পৃষ্ঠার উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-

হযরত ঈসা (আঃ) দন্ডায়মান (কেয়াম) অবস্থায় তার উম্মত হাওয়ারীদেরকে (বনি ইসরাইল) নবীজির আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন ।”

শুধুই তাহাই নহে, হাকিম নামক কিতাবে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে হযরত রাসূল পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

আল্লাহ্ তায়ালা নবী হযরত ঈসা (আঃ) এর উপর এই মর্মে ওহী পাঠালেন যে, তুমি মুহাম্মদের প্রতি ঈমান আন । আর তোমার উম্মতের মাঝে যারা তাঁকে পাবে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনার নির্দেশ দাও, যেন তারাও তাঁর প্রতি ঈমান আনে। মুহাম্মদ না হলে আমি আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করতাম না। সৃষ্টি করতাম না জান্নাত ও জাহান্নাম । আমি পানির উপর আমার আরশ সৃষ্টি করায় আমার আরশ কাঁপতে থাকে। অতঃপর যখন আরশ এর উপর “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" লেখা হল, তখন তার কম্পন বন্ধ হল। হাকেম এ হাদিসটি বর্ণনা করে সহীহ বলেছেন।

কাজেই মিলাদ ও কেয়াম পূর্ববর্তী সমস্ত নবীগণের সুন্নত । মিলাদ ও কেয়াম নবীগণের সুন্নত হবে নাই বা কেন? কেননা প্রত্যেক নবী “রোজে আজলে” আল্লাহ পাকের নিকট ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁরা প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ জামানায় তাঁদের উম্মতদের কাছে আখেরী নবীর আগমন বার্তা ও তাঁর সানা-সিফত ও শান মান বংশ পরিচয় ইত্যাদি বর্ণনা করবেন, যাতে দুনিয়ার সমগ্র মানবজাতি আদি হতে অন্ত পর্যন্ত সবাই জানতে পারে আল্লাহ্ পাকের প্রিয় হাবিব হযরত রাসূলে পাক (সঃ) কে ছিলেন ও তার শান মান কি? রাসূল পাকের শান-মান সম্বন্ধে আল্লাহ্ পাক নিজেই বলেছেন-

“হে নবী আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি এই মাখলুক (বিশ্ব ভ্ৰামান্ত) সৃষ্টি করতাম না।” অর্থাৎ এই বিশ্ব ভ্রমান্ত সৃষ্টির মূল কারণই হল আমাদের নবীজির শুভাগমন । -হাদিসে কুদসী ।

আর পূর্ববর্তী সমস্ত নবীগণ নিজ নিজ যমানায় নিজ নিজ উম্মতের নিকট আখেরী নবী হযরত রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সানা সিফত পুংখানুপুংখ ভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন বলেই তারা তাঁকে এমন নিখুত ভাবে চিনত বা জানত যেমন নিজের সন্তানদেরকে তাদের পিতা- মাতা চিনে । ইহারই সত্যায়ন পবিত্র কোরআন পাকে আল্লাহ্ পাক সূরা বাকারার ১৪৬ নং আয়াতে করেছেন। যেমন-

আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাঁকে (নবীকে) সেইরূপ চিনে যেরূপ তারা তাদের নিজেদের সন্তানগণকে (সন্দেহাতীত ভাবে) চিনে। এবং তাদের একদল জেনেশুনে সত্য গোপন করে থাকে । -সূরা বাকারা, আয়াত ১৪৬ ।

উপরোক্ত আলোচনা হতে ইহা স্পষ্ট যে পূর্ববর্তী সমস্ত নবীগণই আখেরী নবী হযরত রাসুলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মিলাদ বা জন্মবৃত্তান্ত তাদের নিজ নিজ উম্মতের নিকট করে গেছেন ।

সাহাবাদের দ্বারা মিলাদুন্নবী মাহফিলের প্রমাণ


হুজুর পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর উপস্থিতিতে সাহাবা কেরাম মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করেছেন। এ সম্বন্ধে প্রচুর হাদিস উল্লেখ আছে, তন্মধ্যে নিম্নে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হল-

স্বপ্রনোদিত হয়ে সাহাবাগণ কর্তৃক মিলাদুন্নবী উৎযাপন


১। আল্লামা জালালুদ্দিন সিউতি (রঃ) সাবালাল হুদা ফি মাওলুদে মোস্তফা নামক কিতাবে এবং শাইখ আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে কালবী রচিত “ কিতাব আল-তানবীর ফি মওলুদ আল বসিব ওয়ান নাজির” গ্রন্থে এবং আব্দুল হক এলাহাবাদী রচিত “দোৱে মোনাজ্জাম” গ্রন্থে হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে-

তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সাথে মদিনায় হযরত আবু আমের আনসারীর গৃহে গমন করে দেখি, তিনি তার সন্তানাদি ও আত্মীয়স্বজনকে নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর জন্ম বৃত্তান্ত শিক্ষা দিচ্ছেন এবং বলেছেন আজই সেই দিন । এতদ্দর্শনে নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা'য়ালা তোমার উপর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং আল্লাহর ফেরেস্তাগণও তোমাদের সকলের জন্য মাগফেরাত কামনা করছেন। যারা তোমাদের ন্যায় এরূপ কাজ করবে তারাও তোমাদের মত নাজাত বা পরিত্রান পাবে ।

২। আল্লামা আবুল কাছিম মোহাম্মদ ইবনে ওসমান (রাঃ) রচিত “আদ-দার আল মুনাজ্জাম” কিতাবে এবং ইবনে দাহইয়ার (রাঃ) ৬০৪ খ্রিঃ) রচিত আত্‌- তানভীর গ্রন্থে হযরত আব্দুল্লা ইবনে আব্বান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে-

তিনি বলেন একদিন তিনি কিছু লোক নিয়ে নিজ গৃহে নবীজি সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করে আনন্দ উৎসব করছিলেন এবং তাঁর প্রশংসাবলী আলোচনায় দরুদ ও সালাম পেশ করছিলেন। এমন সময় নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তথায় উপস্থিত হয়ে এ অবস্থা দেখে বললেন তোমাদের জন্য আমার সাফায়াত ওয়াজিব হয়ে রইল।”

উপরোক্ত হাদিস দু'খানি হতে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে সাহাবায়ে কেরামগণও রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর জীবদ্দশায় তাঁর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করতেন এবং ইহাকে,
(১) আল্লাহ্ পাকের রহমত
(২) রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সাফায়াত ও
(৩) ফেরেস্তাগণের মাগফেরাত তথা দোয়া লাভের এক বিশেষ উপকরণ স্বরূপ মনে করতেন।

কাজেই মিলাদ শরীফের মজলিশ আয়োজন সাহাবায়ে কেরামের যুগ হতে প্রতিষ্ঠিত তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই ।

সাহাবীগণ কর্তৃক রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর অনুমতি নিয়ে তাঁর সামনে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত কবিতার ছন্দে বর্ণনা করেছেন তার কিছু বিবরণ-

নিম্নে বর্ণিত কয়েকটি হাদিস হতে আমরা দেখিতে পাই, রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কবিতার ছন্দে জন্ম বৃত্তান্ত, প্রশংসা গীতি শুনে খুবই আনন্দিত হতেন এবং এ জন্য প্রসংশাকারীকে বিশেষভাবে দোয়া করতেন ।



বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ প্রবন্ধটি হজরত সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ জুনায়েদ উসমানী’র লেখা “ঈদ-ই-মিল্লাদুন্নবী কি, কেন ও ফজিলত” নামক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, হজরত সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ জুনায়েদ উসমানী সাহেব নিজেকে একজন কাদেরী, চিশতী, ফেরদৌসি, নকশবন্দী, আবুল উলায়ী তরীকাপন্থী হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সংগত কারণেই সকল আলেম ওলামাগণের মতামত এখানে প্রকাশিত হয়নি।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url