রবিউল আউয়াল মাসের বির্তক || ঈদ-ই-মিল্লাদুন্নবী কি ও কেন ?






ঈদ-ই-মিল্লাদুন্নবী কি ও কেন ?


মিলাদ শব্দের অর্থ জন্মগ্রহণ করা। ঈদ অর্থ আনন্দ । ঈদ-ই-মিল্লাদুন্নবী অর্থ নবী হযরত রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর দুনিয়াতে আগমন তথা জন্মগ্রহণে খুশি হয়ে আনন্দ উৎসব পালন করা ।

মিলাদ শরীফের হাকিকত হচ্ছে হুজুর সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র জন্মগ্রহণের সময়ের পূর্বাপর অবস্থা বর্ণনা করা অর্থাৎ গর্ভাবস্থার ঘটনাবলী, নূরে মোহাম্মদীর কারামত, তাঁর বংশ পরিচয়, তাঁর আগমনের পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা এবং তাঁর আগমনে আনন্দিত হয়ে সকলে মিলে আনন্দ খুশি উদযাপন করা, লোক সমাগম করে মাহফিলের আয়োজন করা এবং দোয়া-কালাম পাঠ নামাজ রোজা পালন করে তা তার পবিত্র দরবারে নজর পেশ করা এবং সেমাই শিরণী খাওয়া ও বিতরণ করা যেমন অন্যান্য ঈদের দিনে করা হয় । এসব অবশ্যই হতে হবে শরীয়ত সম্মত উপায়ে ।

আল্লাহ্ পাকের করুনা, দয়া, নেয়ামত ও রহমত প্রাপ্তিতে যে আনন্দ উৎসব করা যায় এবং হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর আমাদের মাঝে আগমন যে আমাদের জন্য মস্ত বড় নেয়ামত ও রহমত এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এই অধ্যায়ে করা হয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে এই অধ্যায়টি চারটি খন্ডে বিভক্ত করা হয়েছে-

১। প্রথম খন্ডে আমরা দেখব পবিত্র কোরআন অনুযায়ী হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য এক মস্ত বড় নেয়ামত ও রহমত এবং এই নেয়ামত ও রহমত প্রাপ্তিতে আমাদের কি কর্তব্য বলে পবিত্র কোরআন পাকে আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন ।

২। দ্বিতীয় খন্ডে আমরা দেখব অন্যান্য নবীগণ আল্লাহ্ পাকের নেয়ামত প্রাপ্তিতে তাদের উম্মতদেরকে কি করার হুকুম দিয়েছেন এবং সেই নেয়ামত প্রাপ্তিতে কি ধরনের আনন্দ খুশি তারা করেছেন ।

৩ । তৃতীয় খন্ডে আমরা দেখব আল্লাহ্ পাকের নেয়ামত প্রাপ্তিতে আনন্দ উৎসব করা যায় কিনা? এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিস কি বলে?

৪। চতুর্থ খন্ডে আমরা দেখব পবিত্র মক্কা হতে হিযরত করে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যখন মদীনা শরীফে আগমন করেন তখন মদীনা শরীফের আবাল বৃদ্ধ বানীতা তাঁকে কি ধরণের সম্বর্ধনা দিয়েছেন এবং এতে তিনি খুশি ও আনন্দিত হয়েছেন নাকি এ অভ্যর্থনা জানানোতে তিনি নাখোশ হয়েছেন? তদ্রূপ তাবুক অভিযান হতে ফেরার পর উনাকে যে অভ্যর্থনা দিয়েছেন তারও বিষদ বর্ণনা করা হয়েছে ।

প্রথম খন্ড

এই খন্ডে আমরা দেখব আল্লাহ্ পাক তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে আমাদের মাঝে প্রেরন করে আমাদের প্রতি এক মহা করুনা, দয়া ও রহমত নাজিল করেছেন এবং এই মহান নেয়ামত প্রাপ্তির প্রতিদানে আমাদের কি করা কর্তব্য বলে পবিত্র কোরআনে পাকে আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন-

পবিত্র কোরআন পাকে আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন-

১ । “ওয়া মা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামীন ।” -সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৭

অর্থঃ - হে নবী আমি আপনাকে সমস্ত বিশ্ব ভ্রমান্তের রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।

২ । ইয়ারিফুনা নিয়ামাতুল্লাহি ছুম্মা ইয়ুনফিকুরূনাহা ওয়া আকছারুহুমুল কাফেরুন । --সূরা আন-নাহল, আয়াত-৮৩, রুকু-১১

অর্থঃ - তারা আল্লাহর নেয়ামতকে " [মুহাম্মদ (সাঃ)]” চিনে, কিন্তু তারা তা অস্বীকার করে, তাদের অধিকাংশই কাফের ।

৩ । পবিত্র কোরআন পাকে আল্লাহ্ পাক এরশাধ করেন-

“আল্লাহ্ মুমিনদের উপর অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন তাদের নিজেদের মধ্য হতে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করে, যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পড়ে শুনান, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন । যদিও তারা এর পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল । ---সূরা আল ইমরান, আয়াত-১৬৪ ।

৪ । অন্যত্র আল্লাহ্ পাক এরশাধ করেন-

“তোমাদের কাছে আগমন করেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকেই এমন একজন রাসূল যার নিকট তোমাদের দুঃখ-কষ্ট দুঃসহ বেদনাদায়ক, যিনি তোমাদের অতিশয় হিতাকাঙ্খী এবং মুমিনদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল ও দয়াময় । - -সূরা তওবা, আয়াত-১২৮

উপরে বর্ণিত ১নং আয়াতে আল্লাহ্পাক প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে “আলামিন” বা বিশ্ব জগতের রহমত বলে উল্লেখ্য করেছেন । “আলামিন” দ্বারা সেই বিশ্ব জগতকে বুঝিয়েছেন যেই বিশ্বজগতের প্রতিপালক স্রষ্টা স্বয়ং আল্লাহ্ পাক। যেমন সূরা ফাতেহায় বলা হয়েছে- “আলহামদু লিল্লাহে রাব্বিল আলামিন।” অর্থাৎ সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি বিশ্ব ভ্রমান্তের (আলামিনের) প্রতিপালক বা “রব”। কাজেই প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম শুধু আমাদের জন্যই রহমত নয় সমগ্র বিশ্ব জগতের জন্য রহমত বলে আল্লাহ্ পাক উল্লেখ্য করেছেন ।

২নং আয়াতে আল্লাহ্ পাক কিতাবধারী তথা ইহুদী-নাসারাদেরকে উদ্দেশ্যকরে বলছেন, তারা আল্লাহ্ প্রেরিত নেয়ামত তথা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে চিনে অথচ তারা তাকে অস্বীকার করে এবং এই অস্বীকৃতির জন্য তাদেরকে কাফের বলে উল্লেখ্য করেছেন। এখানে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ্ পাক তাঁর পক্ষ হতে নেয়ামত বলে সম্বেধন করেছেন।

তারা আল্লাহ্ পাকের এই নেয়ামতকে কিরূপ চিনি তা বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ্ পাক পবিত্র কোরআন পাকে সূরা বাকারার আয়াত নং ১৪৬ তে উল্লেখ করেছেন-

(ক) আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাঁকে (নবীকে) সেইরূপ চিনে যেরূপ তারা তাদের নিজেদের সন্তানগণকে (সন্দেহাতীতভাবে) চিনে এবং তাদের একদল জেনে শুনে সত্য গোপন করে থাকে। -সূরা বাকারা, আয়াত-১৪৬

শুধু ইহাই নহে ইহুদীগণ যে এই নেয়ামতের উছিলা দিয়ে আল্লাহ্ পাকের নিকট প্রার্থনা করত তাও আল্লাহ্ পাক উল্লেখ্য করেছেন পবিত্র কোরআন পাকের অন্যত্র যেমন-

(খ) তারা (ইহুদীরা) এর পূর্বে (এ নবীর আবির্ভারের পূর্বে) এ নবীর উছিলা দিয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করত । -সূরা-বাকারা, আয়াত-৮৯

অর্থাৎ তারা যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে জয় লাভের জন্য আমাদের নবীর উছিলা দিয়ে আল্লাহ্ পাকের নিকট প্রার্থনা করতেন। কাজেই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যে আমাদের তথা সমস্ত মানব জাতির জন্য একটি বড় নেয়ামত তা স্পষ্টই প্রতীয়মান ।

উপরে উল্লিখিত ৩নং আয়াত দ্বারা বুঝা যায় আল্লাহ্ পাক রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে আমাদের মাঝে প্রেরণ করে আমাদেরকে বড়ই অনুগ্রহ তথা দয়া করেছেন। কারণ তিনি হলেন আমাদের জন্য রহমত ও নেয়ামত।

শুধু তাই নয় অত্র আয়াতে আল্লাহ্ পাক উল্লেখ করেছেন- এই রহমত ও নেয়ামতকে আমাদের মাঝে প্রেরণ করে আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে অনুগ্রহ করেছেন আমাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়ার জন্য এবং আমাদেরকে গোমরাহী তথা পথভ্রষ্ঠতা হতে উদ্ধার করার জন্য। এতে স্পষ্টই বুঝা যায় তাঁর আগমন না হলে আমরা স্পষ্টই ধ্বংস হয়ে যেতাম এবং দোযখের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতাম । কাজেই তিনি আমাদের জন্য এক অতিবড় নেয়ামত ও রহমত । তাই তাঁর এক নাম “(নেয়ামতুল্লা)” অর্থাৎ “আল্লাহর নেয়ামত” ।

চতূর্থ আয়াতে আল্লাহ্ পাক স্বয়ং তাঁর হাবিবের চারটি চারিত্রিক গুণাবলীর প্রসংশা করেছেন । আল্লাহ্ পাক স্বয়ং বলছেন এ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের দঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারেন না, তিনি তাঁর উম্মতের অতিশয় হিতাকাঙ্খী ও মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াময়। শুধু তাই নয় পবিত্র কোরআন পাকের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ্ পাক তাঁর হাবিবের অসংখ্যা গুণাবলীর উল্লেখ করে তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেছেন যা লিখে শেষ করা যাবে না ।

যাকে পাঠিয়ে আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে এত উপকার করেছেন। যার আগমন আমাদের জন্য রহমত ও নেয়ামত যিনি আমাদের দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারেন না । যিনি আমাদের অতিশয় হিতাকাঙ্খী, আমাদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াময়, যার আগমনের ফলে আমরা গোমরাহী তথা ধ্বংস হতে রক্ষা পেয়েছি, যিনি আমাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিয়ে আমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের উচ্চ শিখরে পৌছিয়েছেন, এতবড় রহমত ও নেয়ামত প্রাপ্তিতে আমাদের কি করা কতব্য?

পবিত্র কোরআন পাকে আল্লাহ্পাক নিজেই এর উত্তর দিচ্ছেন এভাবে-

১ । ইয়া আইয়্যু হাল্লাজিনা আমানুযকুরু নেয়মাতুল্লাহ আলাইকুম ।” -সূরা আহযাব, আয়াত-৯, পারা-২১

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ। তোমাদের প্রতি প্রেরিত নেয়ামতের যিকির (স্বরন কর অর্থাৎ আলোচনা কর ও তার জন্য শোকরিয়া আদায় কর ।

২। ইয়া আইয়া হান্‌নাসু কুরু নেয়ামাতুল্লাহ্ আলাইকুম - সূরা, ফাতির, আয়াত-৩, পারা-২২

অর্থ : হে মানবজাতি তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতের যিকির কর (অর্থাৎ আলোচনা কর ও শুকরিয়া আদায় কর) ।

৩ । “ওয়া আম্মা বে-নেয়ামতে রাব্বুকা ফাহাদ্দিস।” -সুরা ওয়াদ্দোহা

অর্থঃ স্বীয় প্রভুর প্রেরিত নেয়ামতের গুণকীর্তন কর ।

৪ । ওয়াশকুরু নিয়মাতাল্লাহি ইনকুনতুম ইয়াহু তাবুদুন । - সূরা আন-নাহল, আয়াত-১১৪

অর্থ : আল্লাহর নেয়ামতের শোকর গুজারী কর যদি তোমরা তারই ইবাদত করে থাক ।

৫। “কুল বে-ফাদলিল্লাহে ওয়া বে-রাহমাতেহে ফা বে-জালেকা ফালাইয়াফরাহু হুয়া খাইরুম মিম্মা ইয়াজমাউন" । --সূরা ইউনুস, আয়াত-৫৮ ।

অর্থঃ হে হাবিব, সবাইকে বলে দিন তারা যেন আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে বেশী বেশী করে আনন্দ প্রকাশ করে। ইহা তাদের সমস্ত ধনসম্পদ অপেক্ষা উত্তম ।

উপরোক্ত আয়াতসমূহ হতে স্পষ্টতই বুঝা যায় আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমাদের মাঝে আমার হাবিবকে নিয়ামত ও রহমতরূপে প্রেরণ করে তোমাদের প্রতি আমি যে অনুগ্রহ করেছি তার জন্য তোমরা বেশী বেশী আনন্দ প্রকাশ কর, শোকর গুজার কর এবং বেশী করে তাঁর গুণকীর্তন ও আলোচনা (যিকির) কর। রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর আগমণ তথা জন্মগ্রহণ বা বেলাদতে ইহাই করার হুকুম আমাদেরকে আল্লাহ্ পাক দিচ্ছেন এবং উপরোক্ত ৫ নং আয়াতে এও বলে দিচ্ছেন যে এসব কর্ম-কান্ড করা তোমাদের অর্জিত সমস্ত ধন-সম্পদ অপেক্ষা অনেক উত্তম এবং এসব করার হুকুম দিয়ে ইহা আমাদের জন্য ওয়াজিব করে দিয়েছেন ।

দ্বিতীয় খন্ড

এই খন্ডে আমরা দেখব অন্যান্য নবীগণ আল্লাহ্ পাকের নেয়ামত প্রাপ্তিতে তাঁদের উম্মতদেরকে কি করার জন্য হুকুম দিয়েছেন এবং সেই নেয়ামত প্রাপ্তিতে কি ধরনের আনন্দ খুশি তারা করেছেন- 

১। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-

“ওয়া লিন্‌ নাজআলাহু আ-ইয়াতাল নিন্ নাসে ওয়া রাহমাতাম্ মিন্না।" --সূরা মরিয়ম, আয়াত-২১, রূকু-২

অর্থঃ এবং আমি তাঁকে (হযরত ঈসা (আঃ) মানুষের জন্য একটি নিদর্শন এবং আমার তরফ থেকে রহমত স্বরূপ প্রেরণ করতে চাই ।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ পাক হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা কালে এই আয়াতে স্পষ্টভাবে হযরত ঈসা (আঃ) কে আল্লাহর পক্ষ হতে মানুষের প্রতি রহমত বলে স্বয়ং উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ হযরত ঈসা (আঃ) এর আগমন তথা নবীর আগমন মানবজাতির প্রতি আল্লাহর পক্ষ হতে রহমত। আল্লাহ্ পাকের বানী হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে নবীদের আগমন মানব জাতির প্রতি এক মহা রহমত তাতে কোন প্রকার সন্দেহ নাই ।

কারণ তাঁদের আগমনের ফলেই মানবজাতি ধ্বংসের হাত হতে এবং দোযখের আগুন হতে রক্ষা পায়। এবং দুনিয়াতে রহমত ও নেয়ামত প্রাপ্ত হয়ে সমস্ত বালা-মুসিবত হতে মুক্ত হয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে পারে ।

অন্যত্র পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-

“ওয়া ইজ কালা মূসা লে কাওমিহি ইয়া কাওমিজ কুরু আলাইকুম ইজ জ্যা আলাফিকুম আম্বিয়্যিয়া ওয়া জ্যাআলাকুম মুলুকাও ওয়া আতাআকুম মা লাম ইয়্যুতি আহাদাম মিনাল আলামীন । - সূরা মায়েদা, আয়াত-২০

অর্থঃ এবং যখন মূসা তাঁর সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায় তোমাদের প্রতি আল্লাহ্ পাকের নেয়ামতের যিকির (স্মরণ) কর যে তিনি তোমাদের মধ্য হতে পয়গাম্বর প্রেরণ করেছেন, তোমাদেরকে বাদশাহ্ করেছেন এবং তোমাদেরকে তাই দিয়েছেন যা আজ পর্যন্ত সমগ্র জাহানের মধ্যে কাউকে দেননি।”

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা গেল, পয়গম্বরের শুভাগমন তার উম্মতের জন্য একটি নেয়ামত, যার যিকির করার জন্য হযরত মূসা (আঃ) তাঁর উম্মতকে নির্দেশ দিচ্ছেন। কেননা নবীর আগমন উম্মতের জন্য বরকত, কল্যাণ এবং মুক্তি লাভের একটি বিরাট মাধ্যম। শুধু তাই নয়, এ আয়াতে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করে যিকির করার জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে ।

(১) তাদের মধ্যে থেকে নবী প্রেরণ

(২) তাদেরকে বাদশাহ্ করেছেন অর্থাৎ গোলামী থেকে আযাদ করেছেন 

(৩) এমনসব নেয়ামত দিয়েছেন যা আজ পর্যন্ত কাউকে দেননি। প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য জিকির করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

মিলাদ শরীফ উদযাপন তথা জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করা নবীর আগমন উপলক্ষ্যে যিকিরের একটি উত্তম মাধ্যম এতে কোন সন্দেহ নাই ।

তৃতীয় খন্ড

পূর্বের প্রথম দুই খন্ডে আমরা দেখেছি যে পবিত্র কোরআন পাকে আল্লাহ্ পাক নবী রাসূল প্রেরনকে আমাদের জন্য মস্ত বড় নেয়ামত ও রহমত বলে উল্লেখ করেছেন এবং এই নেয়ামত ও রহমত প্রাপ্তিতে আমাদের শুকরিয়া আদায় ও বেশি বেশি করে তার জিকির অর্থাৎ আলোচনা ও গুনগান করার জন্য হুকুম দিচ্ছেন এবং আল্লাহ্ পাকের হুকুম মানেই তা করা আমাদের জন্য ওয়াজিব।

এই খণ্ডে আমরা দেখব আল্লাহ্ পাকের নেয়ামত প্রাপ্তিতে আনন্দ উৎসব করা যায় কিনা। এ ব্যপারে কোরআন হাদিস কি বলে?

১। কুল, বে ফাদলিল্লাহে ওয়া বে-রাহমাতেহে ফা বে-জালেকা ফালইয়াফরাহু হুয়া খাইরুম মিম্মা ইয়াজমাউন । -সুরা ইউনুস, আয়াত-৫৮ ৷

অর্থাৎ হে হাবিব, সবাইকে বলে দিন, তারা যেন আল্লাহর নেয়ামত ও রহমত প্রাপ্তিতে বেশী বেশী করে আনন্দ প্রকাশ করে। ইহা তাদের জমাকৃত সমস্ত ধন সম্পদ অপেক্ষা উত্তম।

এ আয়াতে আল্লাহ্ পাক নিজেই স্পষ্টভাবে হুকুম দিচ্ছেন আল্লাহ্ পাকের নেয়ামত ও রহমত পেয়ে বেশী বেশী করে আনন্দ খুশি করার জন্য কেননা এই নেয়ামত ও রহমত নিজেদের জমাকৃত সমস্ত ধন-সম্পদ হতে বহুগুণে উত্তম । আল্লাহ্ পাকের হুকুম পালন করা আমাদের জন্য ওয়াজিব এবং রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য নবীগণ যে তাঁদের উম্মতের জন্য মস্ত বড় নেয়ামত ও রহমত তা পূর্বের আলোচনা হতে স্পষ্ট। কাজেই নবীর আগমনে ঈদ বা আনন্দ খুশি বানাতে হবে ইহা এখান হতে খুবই স্পষ্ট, এর জন্য ব্যখ্যার কোন প্রয়োজন নাই ।

২। আল্লাহ্ পাকের নেয়ামত প্রাপ্তিতে যে আনন্দ বা ঈদ উদ্‌যাপন করা যায় তা আমরা হযরত ঈসা (আঃ) এর নিম্নের দোয়া হতেও দেখতে পাই । যা কোরআন পাকে বর্ণিত আছে। তিনি দোয়া করেছিলেন-

“হে আল্লাহ্ আমাদের জন্য আসমান হতে খাদ্যভর্তি খাঞ্জা প্রেরণ করুন, যাতে এটা আমাদের আগে ও পরে সবার জন্য ঈদে (আনন্দ উৎসব) পরিণত হয়। -সূরা মায়েদা, আয়াত-১১৪ ।

দেখা যাচ্ছে হযরত ঈসা (আঃ) এর দোয়ার রককতে আসমান হতে খাদ্যভর্তি খাঞ্জা অবতরণের সেই নির্দিষ্ট দিনকে তাঁর উম্মতেরা ঈদ হিসাবে পালন করেছিল ।

অথচ হুজুর সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর আগমণ আমাদের জন্য এর চেয়ে শত গুণ বড় নেয়ামত । কাজেই উনার দুনিয়াতে আগমন তথা পবিত্র জন্ম দিনটিও অনেক বড় ঈদের দিন ।

৩। তদ্রুপ ফিরআউনের অত্যাচার হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য হযরত মূসা (আঃ) যখন তাঁর উম্মতদেরকে নিয়ে নীল নদ অতিক্রম করেছিলেন সেই মুক্তি ও আনন্দের দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতি বৎসর তাঁর উম্মতগণ ঈদ উদ্‌যাপন করত এবং ঐ দিনে অর্থাৎ ১০ই মহরমে খুশিতে রোযা পালন করত । পরবর্তীতে আমাদের নবীপাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এই আনন্দের দিনে তাদেরই মত আমাদেরকে রোজা পালনের নির্দেশ দেন। তবে এক দিন নয় দুই দিন। উপরোক্ত ঘটনা হতে দেখা যায়, যে ঘটনা যেদিন ঘটে সেই দিনই অর্থাৎ দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে প্রধানতঃ সেই ঘটনাকে স্মরণ করে ঈদ উৎযাপন করা উচিত। এতে কোরআন ও হাদিসে কোন নিষেধ নেই বরং সম্মতিই আছে ।

কাজেই প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর জন্ম দিন তথা ১২ই রবিউল আউয়াল যে সমস্ত মখলুকের জন্য একটি বড় ঈদের দিন তথা আনন্দের দিন তাতে কোনই সন্দেহ নাই এবং তা বড়ই শান শওকতের সহিত উদযাপন করা আমাদের উচিত এবং কোরআন পাকের মাধ্যমে তারই নির্দেশ আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে দিচ্ছেন ।

৪ । এখানে আরও একটি ঘটনা বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। আমরা পবিত্র ঈদ-উল-আযহার দিনে অর্থাৎ কোরবানীর ঈদের দিনে লাখ লাখ পশু কোরবানী দিয়ে ঈদ উৎসব পালন করে থাকি। কিন্তু এই ঈদ উৎসব কেন পালন করে থাকি, ইহার মূলতত্ত্ব বা হাকিকত কি ইহা কি আমরা কোনদিন চিন্তা করেছি।

আমরা সবাই জানি আল্লাহ্ পাকের হুকুমে হযরত ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানী দেয়া হয়েছিল সেই ঘটনাটিকে স্মরণ করে আজও আমরা হাজার বৎসর ধরে সেই ঘটনার স্মরনকে জাগ্রত করে রাখার জন্য সেই দিনটিকে ঈদ উৎসব হিসাবে পালন করে আসছি। আসলে কি তাই ?

প্রকৃত পক্ষে হযরত ইসমাইল (আঃ) কে মুক্তি দিয়ে আল্লাহ্ পাক সমস্ত মানব জাতি তথা বিশ্ব জগতের প্রতি এক বিশেষ করুনা ও দয়া করেছেন । কেননা হযরত ইসমাইল (আঃ) এর বংশধর থেকেই আমরা “রাহমাতাল্লিল আলামিন ও নেয়ামাতুল্লাহ আমাদের প্রিয় নবীজি মাহবুবে খোদা হযরত রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে আজকে আমাদের মাঝে পেয়েছি। যদি তিনি সেদিন কোরবানী হয়ে যেতেন তবে আমরা তথা বিশ্বজগত সেই নেয়ামত হতে বঞ্চিত হতাম ও আমাদের মুক্তি ও নাজাতের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। হযরত ইসমাইল (আঃ) কে কোরবানী না দিয়ে প্ৰকৃত পক্ষে আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে যে করুনা ও দয়া করেছেন, তথা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে আমাদের মাঝে প্রেরনের ব্যবস্থা করেছেন সেই জন্য আমরা প্রতি বৎসর তারই শুকরিয়া আদায় স্বরূপ আল্লাহ্ পাকের হুকুমে ১০ই জিলহাজ্ব তারিখে পশু কোরবানী দিয়ে থাকি ও ঈদ উদযাপন করে থাকি । ইহাই হল পবিত্র ঈদ-উল-আযহার মূল তত্ত্ব বা হাকিকত ।

ঠিক যেমনি ভাবে হযরত মূসা (আঃ) কে ১০ই মহরম তারিখে ফেরাউন এর হাত হতে রক্ষা করার দরুন শুকরিয়া স্বরূপ ইহুদীগণ সে দিন আনন্দ উৎসব ও রোজা পালন করে থাকে । এই ঘটনা দুইটি হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে সব ঘটনা যে দিন ঘটে সেই সব দিনেই সেই সব ঘটনাকে স্মরণ করে ঈদ উদযাপন করতে হয় ।

কাজেই হযরত ইসমাইল (আঃ) কে মুক্তি দিয়ে আল্লাহ্ পাক আমাদের প্রতি যে করুনা দয়া ও রহমত দান করেছেন তার শুকরিয়া পালনে যদি আমাদেরকে প্রতি বৎসর ঈদ উৎযাপন করতে হয় এবং তার শুকরিয়া আদায়ে যদি লাখ লাখ পশু কোরবানী করতে হয় তবে আমাদের মাঝে প্রিয় নবীজি রাহমাতাল্লিল আলামিন নেয়ামতুল্লা ও মুক্তির দিশারী হযরত রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর আগমনে আমাদের কি করা উচিত? 


৪র্থ খন্ড

এই খন্ডে আমরা দেখব প্রিয় নবীজি হযরত রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা নগরী হতে হিজরত করে প্রায় ৫০০ মাইল দূরে মদীনা মনোয়ারায় হাজির হলেন তখন মদীনাবাসী আবাল বৃদ্ধ বনিতা তাঁকে সাড়ম্বরে ও শান শৌকতের সাথে যে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তা। তাঁদের সেই হৃদয় নিঙড়ানো ভালবাসা মিশ্রিত অভ্যর্থনা আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে । তাঁদের সেই ভালবাসা মিশ্রিত খোশ আমদেদে হযরত রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন । এক স্থানে তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করেন-

তোমরা কি আমাকে ভালবাস?

উত্তরে তারা বললেন- হ্যাঁ, ইয়া রাসুলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম,

প্রতিউত্তরে রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বললেন- আল্লাহ্ পাকের শপথ, আমিও তোমাদের ভালবাসি, আমিও তোমাদের ভালবাসি, আমিও তোমাদের ভালবাসি । তিনি তিনবার এই প্রতিশ্রুতি তাদের দিলেন ।

ঠিক এমনিভাবে তাবুক যুদ্ধ হতে যখন তিনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন মদীনার আবাল বৃদ্ধ বণিতা তাঁকে একইভাবে শান-শওকতের সাথে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং এতে তিনি অত্যন্ত খুশিও আনন্দিত হয়েছিলেন।

ঘটনা দু'টি হতে দেখা যায় দুনিয়াতে যদি এক স্থান হতে অন্য স্থানে আগমনে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে সাদর সম্বর্ধনা জানালে তিনি খুশি হন তবে অন্য এক জগত হতে যখন এই জগতে তথা ধরাধামে তিনি যে দিন আগমন করেন (অর্থাৎ ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে) সে দিন সবাই মিলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঈদ উৎসব ও জসনে জুলুস করেন তবে রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যে অত্যাধিক খুশি হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নিম্নে হিজরত কালীন সম্ভর্ধনার এবং তাবুক হতে মদীনায় প্রত্যাবর্তনকালীন সম্বর্ধনার অবস্থা কিছুটা বর্ণনা করা হল-

(ক) আমরা যদি রাসূলে মাকবুল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর হিজরতের ইতিহাস খুলে দেখি এবং পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় তিনি পৌঁছার পর আহলে মদীনার আনন্দ উল্লাসের দিকে লক্ষ্য করি, তবে একথা সবার স্বাক্ষ্য দিতে হবে যে, ধরাধামে প্রিয় নবীর শুভাগমনে জগতবাসীর ঈদ পালন করা শরীয়তের নজরে একটি পূণ্যময় বৈধ কাজ ।

যেমন পবিত্র বুখারী শরীফের ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃষ্ঠায় এই মর্মে হাদীস বর্নিত হয়েছে যে, মদীনার মুসলমানগণ মক্কা মোকাররামাহ থেকে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার খবর শুনার পর তাঁকে স্বাগতম জানানোর লক্ষ্যে প্রতিদিন সকাল বেলা মদীনার হাররাহ নামক স্থানে এসে অপেক্ষা করতেন। দ্বিপ্রহরের প্রখর তাপের কারণে তাঁরা বাড়িতে ফিরে যেতেন । এমন সময় একদিন এক ইহুদী কোন কাজে তাদের এক ঘরের ছাদে আরোহন করে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর আগমনের পথের প্রতি লক্ষ্য করছিল। তখন সে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং তার সাথীদেরকে সাদা পোষাকদারী দেখতে পেল। আল্লাহর নবীকে দেখে ইহুদী নিজেকে সামাল দিতে না পেরে উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল, যে আরব সম্প্রদায়, যার জন্য তোমরা অপেক্ষা করছিলে, তোমাদের সে পাওয়া এবং অপেক্ষার ধন এই যে এসে পৌঁচেছে।

মদীনার মুসলমানগণ এই ডাক শুনা মাত্র যুদ্ধের হাতিয়ার নিয়ে বের হয়ে পড়লেন এবং জাহরুল হাররাহ (ছানিয়াতুল বেদা) নামক স্থানে গিয়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন । অর্থাৎ রাছুলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে সুসজ্জিত সামরিক বেশে গার্ড অব অনার প্রদান করলেন এবং অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করলেন।

যুদ্ধের হাতিয়ার-যন্ত্র নিয়ে রাসুল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে অভ্যর্থনা জানানোর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লামা জুরকানী (রঃ) জুরকানী শরীফের ২য় খন্ডে ১৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে-

অস্ত্র স্বস্ত্র নিয়ে তড়িগড়ি করে মদিনাবাসী রাসুল আকরাম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বের হওয়ার কারণ হচ্ছে তাদের শক্তি এবং বাহাদুরী প্রকাশ করা। যা দেখে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাদের নিকট আগমনের পর তাঁর আত্মা বা হৃদয় শান্তনা বোধ করে । তাছাড়া হুজুর সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর নিকট তাদের বয়াত বা অঙ্গিকার নামার যেন সত্যতা পায় । তারা এই মর্মে অঙ্গিকার করেছিল যে, আল্লাহর নবীকে এমনভাবে নিরাপত্তা দিবেন যেমনি তারা নিজেদের এবং তাদের সন্তানাদির নিরাপত্তা বিধান করে থাকেন ।

পবিত্র মক্কার জমিন থেকে পাঁচশত মাইল পাড়িদিয়ে আল্লাহর হাবীব সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে শুভাগমন করার পর মদীনাবাসী যদি তাঁকে বরণ করার খাতিরে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে দলেবলে আনন্দ উল্লাসে করে রাস্তায় রাস্তায় মেতে উঠা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়ে থাকে, তবে অদৃশ্য জগত পাড়ি দিয়ে বস্তু জগতের লোকালয়ে তাঁর শুভাগমনে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করা ও জশনে জুলুস করা জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে হাদীসের সমর্থন থাকার কি কোন সন্দেহ থাকতে পারে ?

আমরা লক্ষ্য করে আসছি যে, এক দেশের রাষ্ট্রধান অন্যদেশে গেলে সে দেশের স্বসস্ত্র বাহিনী তাকে বিমান বন্দরে গার্ড অপ অনার প্রদান করে । একাধিকবার তোপধ্বনির মাধ্যমে আনন্দ উল্লাস করে বিদেশী রাষ্ট্রপতিকে বরন করে নেওয়া হয় । রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রীবর্গ ও রাষ্ট্রপতি বিমান বন্দরে বিদেশী মেহমানাকে অভ্যর্থনায় হাজির হয়ে থাকেন। রং বেরং এর পতাকা, বেনার, তোরন ও অপরূপ সাজে রাস্তাঘাট ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান সাজানো হয়। কচি শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুল নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানাতে রাস্তায় নেমে আসে । দেশ হয়ে উঠে উৎসব মূখর।

তবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং আল্লাহ্ পাকের বন্ধু “রাহমাতাল্লিল আলামিন” লকব নিয়ে জমিনে শুভাগমন করলে তাঁর অভ্যর্থনা ও সম্বর্ধনা করে জগত উৎসবমূখর হয়ে উঠবে তা অযৌক্তিক হবে কেন? রাসুল আকরাম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর বেলাদতের দিন সাধারণ ঈদ বা খুশীর দিন নয় বরং সবচেয়ে বড় ঈদ হিসাবে পালন করা সমাচীন হবে । যেমনটি মদীনাবাসী হিজরতের পর আল্লাহর নবীকে পেয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দ আর খুশীতে মেতে উঠেছিল ।

বুখারী শরীফের ১ম খন্ড ৫৫৮ পৃষ্ঠায় হযরত বারা ইবনে আজিব থেকে এপ্রসঙ্গে নিম্নের হাদীসখানা বর্নিত হয়েছে ।

আমি মদীনাবাসীকে কোন বিষয়ে এমন খুশী হতে দেখিনি যেমনটি রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে পেয়ে খুশী হতে দেখেছি । দারমী শরীফেও হযরত আনাস (রাঃ) হতে অনুরূপ বর্ণনায় হাদীস সংগ্রহ করেছেন। যেমন- হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মদীনায় প্রবেশের দিন আমি উপস্থিতি ছিলাম । আল্লাহর নবী আমাদের নিকট মদীনায় প্রবেশের দিন থেকে উত্তম ও আলোকময় তথা আনন্দের আর কোন দিন আমি দেখিনি ।

ইবনে মাজা শরীফের বর্ণনা নিম্নরূপ- রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যেদিন হিজরত করে মদীনায় প্রবেশ করেছিলেন, সে দিন সমস্ত কিছু আলোকিত হয়েগিয়েছিল। আর যেদিন তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন সেদিন সমস্ত জিনিসে শোকের ছায়া বা অন্ধকার নেমে এসেছিল।

আবু দাউদ শরীফে হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনায় অনুরূপ আল্লাহর নবীকে পেয়ে মদীনাবাসীর আনন্দিত হওয়ার প্রমান পাওয়া যায়। যেমন- রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মদীনার শুভাগমন করলে হাবশীরা তাদের যুদ্ধের হাতিয়ার নিয়ে খুশীতে খেলাধুলা তথা কুচকাওয়াজ করেছেন । মদীনায় আমাদের নিকট রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম প্রবেশের দিন থেকে আনন্দময় ও সুন্দর আর কোন দিনকে দেখিনি। তাঁর আগমনে সবকিছু আলোকিত হয়ে গিয়েছিল ।

আল্লামা কাস্তুলানী মাওয়াহিবে লাদুনীয়া কিভাবে মদীনাবাসী আল্লাহর নবীকে পেয়ে কিরূপ খুশী হয়েছিলেন তাঁর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন । আল্লাহর নবীর আগমনে মদীনাবাসীরা আনন্দিত হয়েছিল। সমস্ত মদীনা মুনাওয়ারা তাঁর প্রবেশের কারণে আলোকিত হয়ে উঠেছিল। সবার অন্তরে আনন্দের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন- রাসুল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর আগমনের দিন মদীনার যাবতীয় জিনিসপত্র আলোকিত হয়েগিয়েছিল । তার আগমনে মেয়েরা ঘরের ছাদে উঠে গান গেয়ে ও দফ বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছে যার মর্মার্থ-

পূর্ণিমার চাদ উদয় হয়েছে 
সানিয়াতুল বিদার পূর্বাচলে। 
আল্লাহর পথে ডাকছেন তিনি
তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সকলে । 
মোদের কাছে প্রেরিত হয়ে এনেছেন আল্লাহর বিধান 
পালন করার জন্য মানব সকলে। (সংক্ষেপে )

-শরহে মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া, আল্লামা যুরকানী (রঃ)

উপরে বর্ণিত একাধিক কিতাবের বর্ণনামতে একথাই প্রমাণিত হয় যে, পবিত্র মদীনা শরীফে আল্লাহর নবী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম শুভাগমন করলে মদীনাবাসী রাসূল প্রেমিকগণ আগমন দিবসে সাধারণ ঈদের আনন্দ উল্লাস থেকেও অধিক আনন্দ প্রকাশ করেছে ।

আর আল্লাহর নবীও তাদের আনন্দ মাখা অভ্যর্থনাকে আন্তরিকভাবে পছন্দ করেছেন ও আনন্দিত হয়েছেন। তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন- তোমরা কি আমাকে ভালবাস?

তারা বলল ইয়া রাসূলাল্লাহ, হ্যাঁ।

এতে আল্লাহর নবী খুশী হয়ে বললেন, আল্লাহর শপথ, আমিও তোমাদেরকে ভালবাসি । একথাটি তিনি তিনবার বলেছেন ।

রাসূল আকরাম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারায় তশরীফ আনয়নের দিন মদীনার অলিগলি আলোকিত হয়ে উঠেছিল। আনসারগণ যুদ্ধহাতিয়ার নিয়ে দলে দলে জুলুছ করে অস্ত্র মহড়া আর কুছকাওয়াজ করেছেন। আনন্দ উল্লাসে হয়ে উঠেছেন আত্মহারা। বিনিময়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নেক দোয়া ও ভালবাসার বানী তাদেরকে উপহার দিয়েছে ।

সে মহামানব যেদিন পৃথিবীতে আসলেন সেদিন আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি জগত আলোকিত হয়ে উঠেছিল। মারহাবা ধ্বনি শোনা গিয়েছে সমস্ত মাখলুকাতের মুখে । বেহেস্তকে সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছিল ।

সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল চারিদিকে। ফেরেস্তা ও হুরগণ সারি বেধে খোশ আমদেদ জানানোর জন্য তার হুজরার চারি পার্শ্বে দণ্ডায়মান ছিল।

জাহেলিয়তের সব অন্ধকার দূর হয়ে জমিনে পড়েছে ইসলামী আলোক ছটা, সমস্ত জগত হয়ে উঠেছিল আনন্দে বাকবাক । এমন মহাদিবসে ঈদ পালন করা জায়েজ হবে এবং আল্লাহর নবী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাতে খুশী হয়ে ভালবাসার নজর উপহার দিবেন ইহাই হচ্ছে শরীয়তের নজরে চুড়ান্ত অভিমত ।

মাওলানা আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী তাঁর মাদারেজুন নুবওতে লিখেছেন- হযরত আব্দুল্লাহ থেকে নূরে মোহাম্মাদী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম রজব মাসের জুমার রাতে হযরত আমেনার পর্দায় আলোকিত হন। আল্লাহ্ পাক রিজওয়ান ফেরেস্তাকে সেই রাত্রে বেহেস্তে খোশবু ছড়িয়ে সমস্ত দরওয়াজা খুলে দিতে আদেশ দেন । মালিক ফিরিস্তাকে দোযখের আগুন ঠান্ডা করে দিতে হুকুম দেন । ইমামুল উলামা হযরত সোহাইল বিন তসতরী এই মত সমর্থন করেন ।

জুরকানী শরীফের ১ম খন্ডে ১৯৭ পৃষ্ঠায় বাবুল আহবার থেকে এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মাতৃগর্ভে আসার বৎসরকে বিজয় আর খুশীর বৎসর বলে নামকরণ করা হয়েছে। তার আলোকে বলা যায় আল্লাহর নবী সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম জমিনে ভূমিষ্ট হওয়ার দিনও হবে বিজয় আর ঈদ বা খুশীর দিন।

(খ) আল্লামা যুকারনী (রহঃ) শরহে মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া গ্রন্থে লেখেন, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যখন ভাবুক যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফিরে আসলেন, তখন তাঁর আগমনী বার্তা শুনে মদীনার নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ, বনিতা সকলে উল্লসিত হয়ে উঠল। তারা শহর থেকে বের হয়ে হযরত নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানাবার উদ্দেশ্যে তাঁর আগমন পথে জমায়েত হল । যেমন লোকেরা রাজা-বাদশাহ ও নেতৃবর্গের অভ্যর্থনার জন্য জামায়েত হয়। হযরত নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম দীর্ঘদিন মদীনায় বাইরে থাকার পর মদীনার আসছিলেন। মুনাফিকরা তাঁকে দুঃখ কষ্ট দেয়ার খবরও মদীনাবাসীর কাছে আগে পৌঁছিয়েছিল । তাই হযরত নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর শুভাগমনের বার্তা পেয়ে নারী-পুরুষ ও বালক-বালিকারা প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানাবার জন্য সতস্ফূর্তভাবে তাঁর আগমন পথে সমবেত হয় । পর্দানশীল মহিলারা তাদের প্রকোষ্ঠের ফাঁক দিয়ে এক নজর আল্লাহর হাবিবকে দেখার জন্য হয় পাগলপারা। যদিও ইসলামের বাস্তব অনুশীলন তাদের মধ্যে অনেক পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল । তখন সকল নারী-পুরুষের কণ্ঠে সতস্ফূর্তভাবে ঝংকারিত হয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল এ ছন্দ মালার কাসিদা দ্বারা ।

পূর্ণিমার চাদ উদয় হয়েছে 
সানিয়াতুল বিদার পূর্বাচলে ।
আল্লাহর পথে ডাকছেন তিনি
তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সকলে । 
মোদের কাছে প্রেরিত হয়ে এনেছেন আল্লাহর বিধান 
পালন করার জন্য মানব সকলে । (সংক্ষেপে )

-শরহে মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া, আল্লামা যুরকানী (রঃ)

ঠিক যেমন ভাবে রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা হতে হিজরত করে মদিনা তশরিফ রাখেন তখন মদিনার আবাল, বৃদ্ধ- বনিতা উপরে বর্ণিত একই কাছিদা গেয়ে নৃত্য করে রাসূল পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কে খোশ আহদেদ জানান। এসব কাজে তিনি না কোন আপত্তি জানিয়েছে না কোন রাগ প্রকাশ করেছেন বরং তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন ।

উপরে বর্নিত সমগ্র আলোচনা হতে ইহা সুস্পষ্ট যে অন্য জগত হতে এই ধরা ধামে আগমনের দিনে আনন্দ খুশি উৎযাপনা করা কোরআন হাদিসের আলোকে আল্লাহ্ পাকের নির্দেশ এবং এতে রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম খশি ও আনন্দিত হন । ইহা আমাদের জন্য তার দোয়া ও মাগফেরাত লাভের একটি উত্তম মাধ্যম ।


বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ প্রবন্ধটি হজরত সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ জুনায়েদ উসমানী’র লেখা “ঈদ-ই-মিল্লাদুন্নবী কি, কেন ও ফজিলত” নামক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, হজরত সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ জুনায়েদ উসমানী সাহেব নিজেকে একজন কাদেরী, চিশতী, ফেরদৌসি, নকশবন্দী, আবুল উলায়ী তরীকাপন্থী হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সংগত কারণেই  সকল আলেম ওলামাগণের মতামত এখানে প্রকাশিত হয়নি।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url