বে-নামাযীর ভয়াবহ শাস্তি || বেনামাযীর ১৫টি শাস্তি || বিলম্বে নামাজ আদায়ের শাস্তি ||




ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মদ আল-গাযযালী (রহঃ) ছিলেন একজন যুগস্রেষ্ট সাধক ও আলেম। ইসলামের খেদমতে তাঁর বয়ান এবং তাঁর লেখা কিতাবগুলোর মাঝে এমন একটি যাদুকরী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যা অন্য কারো লেখায় বা বয়ানে এতটা প্রভাব সৃষ্টি করে না। তাঁর লেখা কিতাবগুলো পড়ে অতি সহজেই প্রতিটি পাঠকের হৃদয় বিগলিত হয়ে উঠে। “ বে-নামাযীর শাস্তি” শীর্ষক এই প্রবন্ধখানা ইমাম গাযযালীর লেখা “মুকাশাফাতুল কুলূব” বা “আত্মার আলোকমণি” কিতাবের অনুস্মরণে লেখা হয়েছে।



বে-নামাযীর শাস্তি


আল্লাহ্ তা'আলা দোযখীদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেনঃ


ما سَلَكَكُمْ فِي سَقَره قَالُوا لَونَكَ مِنَ الْمُصَلِينَ ، ولمنَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَهُ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ 

“কোন্ বস্তু তোমাদের দোযখে দাখেল করলো? তারা বলবে- আমরা না নামায পড়তাম, আর না দরিদ্রদের খানা খাওয়াতাম, আর (যারা সত্য ধর্মকে বিলুপ্ত করার চেষ্টায় রত ছিল সেই) প্রচেষ্টাকারীদের সাথে আমরাও চেষ্টা রত থাকতাম। (মুদ্দাসির : ৪২-৪৫)

নামায ত্যাগকারী ব্যক্তি আল্লাহর নিরাপত্তা হতে বঞ্চিত

ত্ববরানী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আমাকে এমন কিছু উপদেশ দান করুন, যে অনুযায়ী আমল করলে আমি বেহেশতে প্রবেশ করতে পারি। হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেনঃ 'তোমাকে যদি কঠিন শাস্তিও দেওয়া হয় বা আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তবুও আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো না। পিতা-মাতার অবাধ্যতা করো না, এমনকি তারা যদি তোমাকে তোমার ধন-সম্পদ ও সর্বস্ব থেকে বঞ্চিতও করে দেয়, তবুও তাদের অবাধ্যতা থেকে বিরত থাক। আর স্বেচ্ছায় কখনও নামায ত্যাগ করো না। কারণ, নামায ত্যাগকারী ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহদৃষ্টির বহির্ভূত হয়ে যায়।
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তোমাকে হত্যা করা হলে বা অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হলেও আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো না, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করো না। তারা যদি তোমাকে তোমার ধন-সম্পদ ও স্ত্রী- পরিজন থেকে পৃথক হয়ে যেতে বলে, তবুও তাদের বাধ্য থাক। ফরয নামায স্বেচ্ছায় কখনও ত্যাগ করো না। কারণ, এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর নিরাপত্তা হতে বঞ্চিত। শরাব পান করো না। কারণ, শরাব সর্ববিধ পাপের মূল। গুনাহ্ থেকে পরহেয কর, কেননা গুনাহ্ আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও রোষের কারণ হয়। জেহাদের ময়দান হতে পলায়ন করো না, এমনকি ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি দেখা দিলেও নয়। সাধারণভাবে মৃত্যু (মহামারী) দেখা দিলেও তুমি দৃঢ়পদ থাক। সামর্থ অনুযায়ী পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ কর, তাদের প্রতি শাসনের বেত্র উত্তোলিত রাখতে অবহেলা করো না, সদা আল্লাহর ভয় প্রদর্শন কর।'

ইবনে হাব্বানে বর্ণিত হয়েছে, 'মেঘলা দিনে সঠিক সময়ে আগে-ভাগে নামায পড়। যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করলো, সে কুফরী করলো।'

অপর এক রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক নামায ত্যাগ করবে, আল্লাহ্ তা'আলা তার নাম দোযখের দরজায় লিখে দিবেন, যা দিয়ে সে প্রবেশ করবে।

বায়হাক্বী শরীফে আছে, যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করলো, তার এরূপ ক্ষতি হলো, যেমন তার ধন-সম্পদ ও আত্মীয়-পরিজন ধ্বংস হয়ে গেল।

হযরত আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

وَاللهِ يا معشر قريش لَتَقِيمُنَّ الصَّلوةَ وَالتَّؤْتُنَّ الزَّكَاةَ اَولا بعثن عليكم رجلا فيضرب اعناقكم على الدين

“ওহে কুরাইশবংশীয় লোকেরা! শুনে রাখ, – আল্লাহর কসম, তোমরা অবশ্যই নামায পড়, যাকাত আদায় কর। তা নাহলে তোমাদের উপর এমন লোককে জয়ী করে দেওয়া হবে, যে দ্বীনের জন্য তোমাদেরকে হত্যা করবে।”

মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ্ তা'আলা ইসলামে চারটি বিষয়কে অতি অবশ্য ও অপরিহার্য কর্তব্যরূপে ফরয করে দিয়েছেন : নামায, যাকাত, রমযানের রোযা ও হজ্জে বাইতুল্লাহ। যদি কেউ যে কোন একটিও পরিত্যাগ করে বাকী তিনটির উপর আমল করে, তবুও কোন কাজে আসবে না, যাবৎ সে সব কয়টি বিষয়ের উপর আমল না করবে।

নামাযে গাফেল ব্যক্তির শাস্তি

হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ হতে সকল তত্ত্বজ্ঞানী এ ব্যাপারে একমত যে, 'বিনা উযরে যদি কেউ নামায আদায় না করে সময় পার করে দেয়, তাহলে এরূপ ব্যক্তি কাফের।
হযরত আইয়ূব (রহঃ) বলেন : 'নামায ত্যাগ করা কুফরী –এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নাই। আল্লাহ্ তা'আলা বলেন :

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِم خَلَفٌ اَضَاعُوا الصَّلوةَ وَاتَّبَعُواالشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيَّاهُ إِلَّا مَنْ تَابَ

“তাদের পর এমন নালায়েক লোক জন্মালো, যারা নামায বিনষ্ট করে দিল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। সুতরাং তারা শীঘ্রই বিপদ দেখবে। অবশ্য যারা তওবা করছে।” (মারইয়াম : ৫৯)

হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) বলেন : 'উক্ত আয়াতে উল্লিখিত اضَاعُوا শব্দের অর্থ 'একেবারে নামায ত্যাগ করা নয়; বরং এর অর্থ, নামাযের নির্ধারিত সময় পার করে দেওয়া- এরূপ ব্যক্তিদের জন্য উপরোক্ত আয়াতে শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্যতম তাবেয়ী হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (রহঃ) বলেন :
اَضَاعُوا الصَّلوةَ অর্থ হচ্ছে, তারা নামাযের ব্যাপারে এতোই গাফেল যে, যোহরের সময় পার হয়ে আছরের সময় উপস্থিত হয়ে যায়, অনুরূপ আছর পার হয়ে মাগরিব, মাগরিব পার হয়ে ইশা, ইশা পার হয়ে ফজর-তবুও তারা নামাযের ব্যাপারে সচেতন হয় না। এহেন অবস্থা থেকে যদি তারা তওবা না করে, তবে তাদের জন্য উপরোক্ত আয়াতে غَيَّا (জাহান্নামের একটি উপত্যকা)-এ পতিত হওয়ার ঘোষণা রয়েছে।

আল্লাহ্ তা'আলা বলেন :
·
يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ اَمْوَالُكُمْ وَلَا أولادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

“হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে তোমাদেরকে গাফেল করতে না পারে। আর যারা এরূপ করবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (মুনাফিকুন : ৯)

উক্ত আয়াতে ذِكْرِ দ্বারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। যে সকল লোক পার্থিব ধন-সম্পদের মোহে পতিত হয়ে ক্রয়- বিক্রয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্যে বা পরিবার-পরিজনের মায়া-মমতার দরুন নামাযে অবহেলা প্রদর্শন করবে, তারা নির্ঘাত ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে:

فَوَيلٌ لِلْمُصَلِينَهُ الَّذِينَ هُم عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَهُ

“অতএব বড় সর্বনাশ ঐ সকল নামাযীর জন্য যারা নিজেদের নামাযকে ভুলে থাকে।” (মাউনঃ ৪,৫ )

হযরত সাদ ইবনে ওয়াক্কাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন 'আমি উক্ত আয়াতের মর্ম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেছেনঃ এরা হচ্ছে ওইসব লোক, যারা নির্ধারিত সময় পার করে নামায পড়ে।' হযরত মুসআব ইবনে সাদ (রহঃ) বলেনঃ ‘উক্ত আয়াত সম্বন্ধে আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নামাযে ভুল-ভ্রান্তি বা এদিক-সেদিক চিন্তা করা থেকে তো আমরা কেউ মুক্ত নই ? তিনি বললেনঃ আয়াতের অর্থ এই নয়, বরং এ আয়াতে ওইসব লোকের কথা বলা হয়েছে, যারা নামাযের নির্ধারিত সময় পার করে দেয়। وَيلٌ দ্বারা কঠিন শাস্তি বুঝানো হয়েছে। আবার কেউ বলেছেন : وَيلٌ জাহান্নামের একটি উপত্যকা দুনিয়ার সমস্ত পাহাড় পর্বতকে যদি একত্রিত করে তাতে নিক্ষেপ করা হয়, তবে সেই উপত্যকার তাপে বিগলিত হয়ে যাবে। নামাযের ব্যাপারে অবহেলাকারী এবং অসময়ে নামায পাঠকারীদের জন্য তা' হবে আবাসস্থল। অবশ্য যারা সত্যিকার তওবা অনুতাপ করবে এবং উক্ত অবহেলা পরিহার করবে তারা নিষ্কৃতি পাবে।

সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব

হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :

صلاته اَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ العَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عَمَلِهِ فَإِن صَلَحَت فقد افلح و انجحَ وَإِنْ نَقَصَتْ فَقَدْ خَابَ


“কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার যে আমলের হিসাব হবে, তা হচ্ছে নামায। যদি নামায সঠিক হয়, তবে সে কৃতকার্য ও উত্তীর্ণ হবে। আর যদি নামায ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে সে অকৃতকার্য ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” ত্ববরানী ও ইবনে হাব্বানে বর্ণিত হয়েছে, একদা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায প্রসঙ্গে বলেছেন:

اَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ العَبْدُ يَومَ الْقِيَامَةِ مِنْ عَمَلِهِ صَلَاتُهُ فَإِن صَلَحَت فَقَدْ اَفْلَحَ وَانجَحَ وَإِنْ نَقَصَتْ فَقَدْ خَابَوَخَسِرَ.

"যে ব্যক্তি নামাযের হেফাজত করবে, কেয়ামতের দিন সেই নামায তার জন্য জ্যোতি, প্রমাণ ও মুক্তিস্বরূপ হবে। আর যে ব্যক্তি এর হেফাজত করবে না, তার জন্য তা জ্যোতি, প্রমাণ ও মুক্তিস্বরূপ হবে না। সুতরাং কিয়ামতের দিন সে কারুন, ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালাফের সাথে হবে।”

দুই ওয়াক্ত নামায একত্রে পড়ার শাস্তি

নামায ত্যাগকারী লোকদের হাশর উপরোক্ত ব্যক্তিদের সাথে এজন্যে হবে যে, যে ব্যক্তিকে ধন-সম্পদের মায়া-মোহ নামায থেকে বিরত রেখেছে, তার সামঞ্জস্য হয় কারূনের সাথে, তাই এরূপ লোকের হাশর হবে তারই সাথে। যে ব্যক্তিকে রাজত্বের মোহ নামায থেকে উদাসীন করে রেখেছে, তার সামঞ্জস্য হয় ফেরাউনের সাথে, তাই এরূপ লোকের হাশর হবে তারই সাথে। আর যে ব্যক্তিকে চাকরী নকরী বা মন্ত্রীত্বের মোহ নামায থেকে গাফেল করে রেখেছে, তার সামঞ্জস্য হয় হামানের সাথে, তাই এরূপ লোকের হাশর হবে হামানেরই সাথে। অনুরূপ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকার্যরত লোকদের সামঞ্জস্য উবাই ইবনে খলফের সাথে, তাই তাদের হাশর হবে তারই সাথে।'

অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, 'যে ব্যক্তি বিনা উযরে দুই ওয়াক্ত নামায (এক ওয়াক্তকে বিলম্বিত করে অপর ওয়াক্তের সাথে) একত্রিত করে পড়লো, সে কবীরা গুনাহে লিপ্ত হলো।'

আছরের নামায ত্যাগের ক্ষতি

নাসায়ী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, 'নামায সমূহের মধ্যে একটি নামায এমন রয়েছে, যে ব্যক্তি তা পরিত্যাগ করলো, সে এরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হলো, যেন তার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল। সেটি আছরের নামায।'


অন্য এক রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে, 'উক্ত আছরের নামায তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা এর হক রক্ষা করে নাই। এখন তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই নামাযের হেফাজত করবে, তাকে দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হবে। এই নামাযের পর তারকা উদিত হওয়া (অর্থাৎ সন্ধ্যা) পর্যন্ত আর কোন নামায নাই।'

আহমদ, বুখারী ও নাসায়ী শরীফে বর্ণিত, যে ব্যক্তি আছরের নামায ত্যাগ করলো, তার আমল ধ্বংস হয়ে গেল।

নামায ত্যাগের ভয়াবহ শাস্তি

ইমাম বুখারী (রহঃ) হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রাযিঃ) থেকে রেওয়ায়াত করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করতেন, তোমাদের কেউ কি কোন স্বপ্ন দেখেছ? কেউ কোন স্বপ্ন দেখে থাকলে তাঁর নিকট বলতেন, যা আল্লাহ্ চাইতেন। একদিন সকালে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : 'রাতে আমার নিকট দু'জন আগন্তুক (ফেরেশতা) আসলো। তারা আমাকে জাগিয়ে উদ্বুদ্ধ করে বললো, চলুন! আমি তাদের সাথে চললাম। এভাবে আমরা একজন লোকের নিকট পৌঁছলাম, সে কাত হয়ে শুয়েছিল। অপর একজন তার নিকট পাথর হাতে দাঁড়ান। সে তার মাথা লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করছে, এতে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে, আর পাথর অনেক নীচে গিয়ে পড়ছে। সে আবার পাথরের পিছনে পিছনে গিয়ে পাথরটি নিয়ে আসতে না আসতেই তার মাথা পূর্বের ন্যায় ভাল হয়ে যাচ্ছে। ফিরে এসে সে পুনরায় পূর্বের ন্যায় আচরণ করছে। আমি ফেরেশতাদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করলাম, সুবহানাল্লাহ্! বলুন, এরা কারা? তারা বললেন, সামনে চলুন। আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে অপর একজনকে পেলাম, যে চিৎ হয়ে শুয়েছিল। আরেকজন তার নিকট লোহার সাঁড়াশী হাতে দাঁড়ান ছিল। সে এই সাঁড়াশী দ্বারা একের পর এক তার মুখমণ্ডলের একাংশ চিরে গলার পিছন পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। অনুরূপ তার নাসাভ্যন্তর ও চোখ চিরে পিছন পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। বর্ণনাকারী বলেন, আবূ রাজা বেশীর ভাগ সময় এরূপ বলতেন, সে একদিকে কেটে অপর দিকে কাটতো। অপর দিকে কাটা শেষ হতে না হতেই প্রথম দিকটা পূর্বের ন্যায় ভাল হয়ে যেত, এভাবে বারবার এরূপই করতো যেরূপ প্রথম করেছিল। আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ্ বলুন, এরা দুজন কে? তারা বললেন, সামনে চলুন। সামনে আমরা একটি চুলার নিকট গিয়ে পৌঁছলাম। তিনি বললেন, আমার মনে হয় তিনি বলেছিলেন, আমি সেখানে শোরগোলের শব্দ শুনতে পেলাম, যাদের নীচ থেকে আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করছিল। আগুনের আওতায় আসলেই তারা উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে উঠতো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তারা বললেন, সামনে চলুন। সামনে অগ্রসর হয়ে আমরা একটি নহরের নিকট পৌঁছলাম। আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, সেটি ছিল রক্তের লাল নহর। নহরে একজনকে সাতরাতে দেখলাম। নহরের পাড়ে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, যার নিকট ছিল অসংখ্য পাথরের স্তূপ। সাতারকারী লোকটি সাতরানো শেষ করে দাড়ানো লোকটির নিকট এসে মুখ খুলে দিতো। আর সে তার মুখে একটি পাথর নিক্ষেপ করতো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তারা বললেন, সামনে চলুন। আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে একজন বীভৎস চেহারার লোক দেখতে পেলাম, যেরূপ তোমরা কোন বীভৎস চেহারার লোক দেখে থাক। তার নিকট ছিল আগুন। সে আগুন জ্বালাচ্ছিল আর তার চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ লোক কে? তারা বললেন, সামনে চলুন। সামনে আমরা এক ঘন সন্নিবিষ্ট বাগানে উপনীত হলাম। বাগানটি বসন্তের রকমারি ফুলে সুশোভিত ছিল। বাগানের মাঝে ছিল একজন লোক। যার আকৃতি এতখানি দীর্ঘকায় ছিল যে, আমরা তার মাথা দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাঁর চারপাশে এত বিপুলসংখ্যক বালক ছিল, যেরূপ আর কখনও আমি দেখি নাই। জিজ্ঞাসা করলাম, এ লোক কে? আর এরাই বা কারা? তারা বললেন, সামনে চলুন, সামনে চলুন। অবশেষে আমরা এক বিরাট বাগানে গিয়ে উপনীত হলাম। এরূপ বড় ও সুন্দর বাগান আমি আর কখনও দেখি নাই। তাঁরা আমাকে বললেন, এর উপর আরোহণ করুন। আমরা তাতে আরোহণ করলে একটি শহর আমাদের নজরে পড়লো। সেটি ছিল সোনা ও রূপার ইট দিয়ে তৈরী। আমরা ওই শহরের দরজায় পৌঁছলাম। দরজা খুলতে বললে আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। ভিতরে প্রবেশ করে আমরা কিছু লোকের সাক্ষাৎ পেলাম। যাদের শরীরের অর্ধেক খুবই সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল। যেরূপ তোমরা খুব সুন্দর কাউকে দেখে থাক। আর অর্ধেক ছিল খুবই কদাকার। যেরূপ তোমরা খুব কদাকার কাউকে দেখে থাক। তারা উভয়ে ঐ লোকদের উদ্দেশ্যে বললো যাও, তোমরা এ ঝর্ণায় নেমে পড়। দেখা গেল প্রস্থের দিকে লম্বা প্রবহমান একটি ঝর্ণা রয়েছে। তার পানি ছিল সম্পূর্ণ সাদা। তারা গিয়ে ঝর্ণায় নেমে পড়লো। তারপর তারা আমাদের নিকট আসলো। দেখা গেল তাদের কদাকৃতি দূর হয়ে গেছে। এখন তারা খুব সুন্দর আকৃতিবিশিষ্ট হয়ে গেছে। ফেরেশতাদ্বয় আমাকে জানালেন, “এটাই ‘আদন' নামক বেহেশত, এটাই আপনার বাসস্থান। আমি উপরের দিকে তাকালাম, দেখলাম-- ধবধবে সাদা মেঘের ন্যায় এক অট্টালিকা। তাঁরা আমাকে জানালেন, 'এটাই আপনার প্রাসাদ।' আমি বললাম, “আল্লাহ্ আপনাদের উভয়ের কল্যাণ করুন, আমাকে ছেড়ে দিন আমি এতে প্রবেশ করবো। তাঁরা বললেন, এখন নয়, তবে এতে আপনি অবশ্যই প্রবেশ করবেন। আমি তাদের বললাম, সারা রাত্র ধরে আমি অনেক অনেক আশ্চর্য জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম, এগুলোর তাৎপর্য কি? তারা উভয়ে বললেন, এখন আমরা তা আপনাকে জানাবো। প্রথম যে ব্যক্তির নিকট আপনি গিয়েছেন, যার মাথা পাথর মেরে মেরে চৌচির করা হচ্ছিল, সে কুরআন মুখস্থ করে (তার উপর আমল) ছেড়ে দিতো, আর ঘুমিয়ে ফরজ নামায ত্যাগ করতো। আর যে ব্যক্তির নিকট আপনি গেলেন, যার গলদেশের পিছন পর্যন্ত চেরা হচ্ছিল, আর নাসাভ্যন্তর ও তার চোখ পিঠ পর্যন্ত চেরা হচ্ছিল, সে সকাল বেলা আপন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো আর চতুর্দিকে মিথ্যার বেসাতি করে বেড়াতো। আর ঐ উলঙ্গ নারী-পুরুষ যাদেরকে প্রজ্জ্বলিত চুলায় দেখেছেন, তারা ছিল যেনাকার পুরুষ ও যেনাকার নারী। আর যে লোক ঝর্ণায় সাঁতরাচ্ছিল, যার নিকট দিয়ে আপনি গিয়েছিলেন, যে পাথরের লোকমা খাচ্ছিল, সে ছিল সুদখোর। আর ঐ কদাকার ব্যক্তি যাকে আপনি আগুনের নিকট দেখেছিলেন আর যে আগুন জ্বালিয়ে তার চার দিকে দৌড়াচ্ছিল, সে দোযখের দারোগা মালেক ফেরেশ্তা। বাগানে যে দীর্ঘাকৃতির লোককে দেখেছেন, তিনি ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম। আর তাঁর চারপাশে যে বালকদেরকে দেখেছেন, তারা ছিল ঐসব শিশু যারা স্বভাবধর্মের (ইসলাম) উপর মৃত্যুবরণ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, মুসলমানদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল, হে আল্লাহর রাসূল! মুশরিকদের সন্তানরা কোথায়? তিনি বলেছেন, তারাও সেখানে ছিল। আর যাদের অধিক অংশ অত্যন্ত সুন্দর ছিল আরেক অংশ ছিল অত্যন্ত কদাকার, তারা ছিল ঐসব লোক, যারা ভাল-মন্দ উভয় কাজ মিশ্রিতভাবে করেছিল। আল্লাহ্ তাদের ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।


বাযযার সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে, অতঃপর হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কিছু লোকের পার্শ্ব দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন, যাদের মাথায় প্রস্তরাঘাত করা হচ্ছে। পাথরের আঘাতে মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং নিক্ষিপ্ত পাথরগুলো ছিটকিয়ে দূরে গিয়ে পড়ছে। আঘাতকারী পাথর তুলে আনার সময়টিতে ঐ চূর্ণ-বিচূর্ণ মাথা পুনরায় ঠিক হয়ে যাচ্ছে এবং পুনরায় ঐ পাথর দিয়ে তাদের মাথায় আঘাত করা হচ্ছে—এভাবে বার বার করা হচ্ছে। হুযুর জিজ্ঞাসা করলেন : এরা কারা? তাদের অপরাধই বা কি? জিব্রাঈল বললেন ও এরা দুনিয়াতে নামায পরিত্যাগ করেছে ; এ দায়িত্বের বোঝায় তাদের মাথা ভার হয়ে রয়েছে।'

খতীব ও ইবনে নাজ্জার রেওয়ায়াত করেছেন, 'নামায ইসলামের পতাকা বা উজ্জ্বল প্রতীক। এই নামাযের জন্য যে ব্যক্তি নিজের অন্তরকে ফারেগ করে নিবে এবং নির্ধারিত সময় ও সুন্নত মুতাবেক আদায় করবে, (তার সম্পর্কে বলা যায়) সে মুমিন।'

নফল দ্বারা ফরযের ঘাটতি পূরণ

অপর এক হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে:

اوّل مَا يُحَاسَبُ بِهِ العَبدُ يَومَ الْقِيَامَةِ صَلَاتُهُ فَإِنْ كَانَ أَتَمَهَا كُتِبَتْ لَهُ تَامَّةٌ وإِن لَم يَكُن اَتَمَّهَا قَالَ لِمَلَائِكَتِهِ انظروا هل تجدون يعبدِى مِن تَطوع فَيُكَمِلُونَ بِها فَرِيضَتَهُ ثُمَّ الزَّكَاةَ كَذَلِكَ ثُمَّ تُوخَذُ الْأَعْمَالُ عَلَى حَسَبِ ذَلِكَ.

'কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার যে আমলের হিসাব নেওয়া হবে, তা হবে নামায। যদি তা সঠিক পাওয়া যায়, তাহলে সে সফলকাম হবে এবং নিজ লক্ষ্যে পৌঁছবে। আর যদি নামাযে গলদ থাকে, তাহলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি তার ফরযগুলোর মধ্যে কোন কম্‌তি থাকে, তবে মহান প্রতিপালক আল্লাহ্ তা'আলা বলবেন, দেখ, আমার বান্দার কিছু নফলও আছে কিনা? এর সাহায্যে তার ফরযগুলোর কমতি পূরণ করে দাও। তারপর সমস্ত আমলের হিসাব এভাবেই পূরণ করা হবে।”

ত্ববরানী শরীফে বর্ণিত হয়েছে :

اوّل مَا يَسْأَلُ عَنْهُ العبد يوم الْقِيَامَةِ يَنْظُرُ فِي صَلَاتِهِ فَإِنْ صَلحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ .


‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দাকে যে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে, তা হবে নামায। নামাযের হিসাব-নিকাশে যদি তাকে সঠিক পাওয়া যায়, তবে সে কামিয়াব। আর যদি নামাযের বিষয়ে কোন গলদ থাকে, তবে সে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।'

নামাযীর জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি

ত্বায়ালিসী ও ত্ববরানী বর্ণিত রেওয়ায়াতে আছে, হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: 'একদা আল্লাহর পক্ষ হতে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম আমার নিকট এসে বললেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা বলেন- আমি তোমার উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছি। যে ব্যক্তি উত্তমরূপে উযূ করে সঠিক সময়ে নামায আদায় করবে এবং রুকু সেজদা পূর্ণভাবে আদায় করবে, তার জন্য আমার নিকট প্রতিশ্রুতি রয়েছে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। আর যে ব্যক্তি তা করবে না, তার জন্য আমার নিকট কোন প্রতিশ্রুতি নাই। ইচ্ছা করলে আমি তাকে শাস্তিও দিতে পারি আর ইচ্ছা করলে মাফও করতে পারি।'

বায়হাকী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, 'নামাযের একটি মীযান (পাল্লা) আছে, যে ব্যক্তি (সঠিকভাবে নামায পড়ে) তা পূর্ণ করবে, সে পরিপূর্ণ সওয়াব পাবে।'

দীলামী রেওয়ায়াত করেন, 'নামায শয়তানের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ করে দেয়, দান-খয়রাত তার পৃষ্ঠ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, একমাত্র আল্লাহর নিমিত্ত ও ইলমের খাতিরে কাউকে মহব্বত করা শয়তানের মূলোৎপাটন করে দেয়, এতদ্বারা শয়তান তোমাদের থেকে এত দূরত্বে সরে যায়, যত দূরত্ব রয়েছে পূর্ব প্রান্ত ও পশ্চিম প্রান্তের মাঝে।'

তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

واتَّقُوا اللهَ وَصَلُّوا خَمْسَكُمْ وَصُومُوا شَهْرَكُمْ وَادُّوا زَكَاةَاموالكم واطيعوا ذوى امرِكُم تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ 


'আল্লাহকে ভয় কর, নির্ধারিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়, তোমাদের (রমযান মাসটির রোযা রাখ, তোমাদের মালের যাকাত দাও, তোমাদের কর্মকর্তার অনুগত থাক, তাহলে তোমরা তোমাদের রব্বের বেহেশতে প্রবেশ লাভ করবে।'

আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল সঠিক সময়ের নামায

বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, 'আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল হচ্ছে সঠিক সময়ের নামায, তারপর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার, তারপর আল্লাহর পথে জিহাদ।'

বায়হাক্বী শরীফে বর্ণিত, হযরত উমর (রাযিঃ) বলেন, এক ব্যক্তি হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলোঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! দ্বীন ইসলামের কোন্ আমলটি আল্লাহ্ তা'আলার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়? তিনি বললেন : 'সঠিক ওয়াক্তে নামায পড়া : যে ব্যক্তি নামায তরক করলো, তার দ্বীন বলতে কিছু রইল না, বস্তুতঃ নামায দ্বীনের স্তম্ভ।' বর্ণিত আছে, নামাযের উক্তরূপ গুরুত্বের কারণেই হযরত উমর (রাযিঃ) কে তাঁর অন্তিমকালীন মারাত্মক যখমীর (আহত ) সময় যখন নামাযের কথা বলা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, অবশ্যই নামাযকে কোন অবস্থায়ই নষ্ট হতে দেওয়া যায় না; কেননা, যার নামায নাই, তার মধ্যে দ্বীন-ইসলামের কোন অংশ নাই। তাই, হযরত উমর (রাযিঃ) এমন অবস্থায় নামায পড়ছিলেন, যখন তাঁর দেহ থেকে রক্ত ঝরছিল।

হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : 'যে ব্যক্তি আওয়াল ওয়াক্তে নামায পড়ে, তার নামায নূরানী হয়ে আরশ পর্যন্ত আরোহণ করে এবং নামাযীর জন্য সে এই বলে দোআ করতে থাকে যে, তুমি যেরূপ যত্নের সাথে আমাকে সম্পন্ন করেছ, আল্লাহ্ তোমাকে তদ্রূপ যত্ন ও সস্নেহে রক্ষণাবেক্ষণ করুন। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি ঠিকমত নামায আদায় করে না, তার নামায কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে উর্ধ্বগগনে উত্থিত হয় এবং উক্ত নামাযকে পুরাতন ছেঁড়া কাপড়ের ন্যায় পুটুলী বেঁধে সেই নামাযীর মুখের উপর নিক্ষেপ করা হয়।


নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন : 'তিন শ্রেনীর লোকের নামায আল্লাহ্ তা'আলা কবুল করেন না। তন্মধ্যে এক শ্রেনীর লোক তারা, যারা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর নামায পড়ে।'

বেনামাযীর ১৫টি শাস্তি

যে ব্যক্তি নামাযের ব্যাপারে গাফলতি ও অবহেলা করবে, তাকে আল্লাহ্ তা'আলা পনেরটি শাস্তি দিবেন। পাঁচটি দুনিয়াতে, তিনটি মৃত্যুর সময়, তিনটি কবরে এবং তিনটি কবর থেকে বের হওয়ার পর হাশরের ময়দানে ।

দুনিয়াতে পাঁচটি শাস্তি, যথাঃ- এক, তার সময় ও জীবিকায় বরকত থাকবে না। দুই, তার চেহারায় নেক লোকের চিহ্ন থাকবে না। তিন, যে কোন নেক আমল সে করবে আল্লাহর নিকট তার কোন সওয়াব পাবে না। চার, তার কোন দো'আ কবুল হবে না। পাঁচ, নেক লোকদের কোন দো'আও তার পক্ষে কবুল হবে না।

মৃত্যুকালীন তিনটি শাস্তি, যথাঃ- এক, অপমৃত্যু ঘটবে। দুই, অভুক্ত অবস্থায় মারা যাবে। তিন, পিপাসার্ত অবস্থায় মৃত্যু হবে ; তখন এত বেশী পিপাসা হবে যে, কয়েক সাগরের পানি পান করালেও তার পিপাসা মিটবে না।

কবরের তিনটি শাস্তি, যথা :- এক, বেনামাযীর কবর এত সংকীর্ণ হবে যে, তার শরীরের দু'দিকের পাঁজর একে অপরের ভিতর ঢুকে যাবে। দুই, কবর অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে এবং দিবা-রাত্রি সে তাতে প্রজ্জ্বলিত হতে থাকবে। তিন, বেনামাযীর কবরে 'সুজা আকরা' নামক এক ভয়ংকর সাপ তার উপর নিয়োগ করা হবে। তার চোখ দুটি হবে আগুনের এবং নখরগুলো হবে লোহার। প্রতিটি নখ এক দিনের পথ অর্থাৎ বার ক্রোশ দূরত্ব পরিমাণ লম্বা হবে। সাপটি মৃত ব্যক্তির সাথে কথা-বার্তা বলবে; নিজকে 'সুজা আক্বরা' বলে পরিচয় দিবে। তার আওয়ায হবে বজ্রের ন্যায় কঠিন। সে বলবে, তোমাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্যই আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। আমি তোমাকে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকব ; ফজরের নামায ত্যাগ করার দরুন যোহর পর্যন্ত, যোহরের নামায ত্যাগ করার দরুন আছর পর্যন্ত, আছরের নামায ত্যাগ করার দরুন মাগরিব পর্যন্ত, মাগরিবের নামায ত্যাগ করার দরুন ইশা পর্যন্ত এবং ইশার নামায ত্যাগ করার দরুন ফজর পর্যন্ত। এভাবে আমি তোমাকে উপর্যুপরি আঘাত হানতেই থাকবো। এই বিষাক্ত অজগরের আঘাত এতই মারাত্মক হবে যে, প্রতি আঘাতে বেনামাযী সত্তর গজ মাটির নীচে ধ্বসে যাবে। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত বেনামাযীর শাস্তি হতে থাকবে।

কেয়ামতের দিন হাশরে তিনটি শাস্তি, যথাঃ- এক, অত্যন্ত কঠিনভাবে বেনামাযীর হিসাব নেওয়া হবে। দুই, বেনামাযীর উপর আল্লাহর ক্রোধ নিপতিত হবে। তিন, বহু অপমান করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।


অপর এক সূত্রে উল্লিখিত হয়েছে, ক্বেয়ামতের ময়দানে বেনামাযীর মুখমণ্ডলে নিম্নোক্ত তিনটি বাক্য লিখা থাকবে, যথাঃ- এক, 'ওহে আল্লাহর হক ধ্বংসকারী। দুই, 'ওহে আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত!' তিন, তুমি যে আল্লাহর হক নষ্ট করেছ, আজকে সেরূপ আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকে বঞ্চিত থাক।

উপরোক্ত হাদীসের সূচনাতে যে পনের সংখ্যার কথা বলা হয়েছিল, তা পূর্ণ না হয়ে চৌদ্দটি পর্যন্ত উল্লিখিত হয়েছে; হয়ত বর্ণনাকারী (রাভী) একটি সংখ্যা বিস্মৃত হয়ে গেছেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, 'কেয়ামতের ময়দানে একজন লোককে আল্লাহ্ তা'আলার সম্মুখে দণ্ডায়মান করা হবে, আল্লাহ্ তা'আলা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার হুকুম করবেন। লোকটি বলবে, হে রব্ব ! কেন আমার জন্য এই হুকুম। আল্লাহ্ বলবেনঃ নামাযের বেলায় তুমি নির্ধারিত সময় পার করে দিয়েছ এবং দুনিয়াতে তুমি মিথ্যা কসমে অভ্যস্থ ছিলে।

নামায ত্যাগকারী ব্যক্তি হতভাগা ও বঞ্চিত

বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, তোমরা আল্লাহ্ পাকের দরবারে এই মর্মে দো'আ করঃ

اللهم لا تدع فينا شقيا ولا محروما.

'আয় আল্লাহ্। আমাদের মধ্যে কাউকে হতভাগা ও বঞ্চিত করো না।'

আল্লাহর রাসূল নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি জান, হতভাগা ও বঞ্চিত কে? সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলে হুযুর বললেন:

تارك الصلوةِ مَحْرُومُ وَ شَقِيٌّ .

'নামায ত্যাগকারী ব্যক্তিই হতভাগা ও বঞ্চিত।'


আরও বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বেনামাযী লোকদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করবে। দোযখে 'লামলাম' নামক একটি উপত্যকা আছে। সেখানে অসংখ্য সাপ রয়েছে। প্রত্যেকটি সাপ উটের ঘাড়ের ন্যায় মোটা এবং এক মাসের দূরত্ব পরিমাণ লম্বা হবে। এগুলো বেনামাযী লোকদেরকে দংশন করতে থাকবে, যার বিষ সত্তর বছর পর্যন্ত উথলে উঠতে থাকবে। ফলে, তাদের দেহ বিবর্ণ হয়ে যাবে।

বনী ইসরাঈলের একজন মহিলা হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামের খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলো, হে মূসা! আমি একটি বড় গুনাহের কাজ করেছি এবং আল্লাহর কাছে তওবাও করেছি, আপনি যদি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দো'আ করে দেন, তাহলে অবশ্যই আমার তওবা কবুল হবে। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এমন কি গুনাহের কাজ করেছ, যদ্দরুন এত ভীত হয়ে পড়েছো? সে উত্তর করলো, আমি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছি এবং প্রসূত সন্তানকে হত্যাও করে ফেলেছি। হযরত মূসা (আঃ) মহিলাটির কথা শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, দূর হও এখান থেকে না জানি আসমান থেকে অগ্নি বর্ষিত হয় এবং তোমার সাথে আমরাও ভস্ম হয়ে যাই। এ কথা শুনে মহিলাটি মনক্ষুন্ন হয়ে সেখান থেকে চলে গেল। অতঃপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) অবতরণ করে বললেনঃ

'হে মূসা, আল্লাহ্ তা'আলা বলছেন, আপনি তওবাকারীনি মহিলাটিকে কেন ফিরিয়ে দিলেন? আমি কি তার চেয়েও বড় অপরাধী কে, তা বলবো? হযরত মূসা (আঃ) জানতে চাইলে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বললেন : ‘তার চেয়েও বড় অপরাধী ঐ ব্যক্তি যে জেনে শুনে স্বেচ্ছায় নামায ত্যাগ করে।

বিলম্বে নামাজ আদায়

জনৈক বুযুর্গ সম্পর্কে বর্ণিত, তাঁর ভগ্নির মৃত্যুর পর যথারীতি তার দাফনকার্য সম্পন্ন করলেন। কিন্তু দাফনের পর ভাইয়ের মনে পড়লো, ভুলবশতঃ টাকার একটি থলিও মাটিতে দাফন করা হয়ে গেছে। থলিটি আনার জন্য লোকজন বিদায় হওয়ার পর পুনরায় কবর খুললেন। কিন্তু তখন তিনি প্রত্যক্ষ করলেন যে, কবরের ভিতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটি দিয়ে কবর আচ্ছাদিত করে দিলেন। ফিরে এসে মাকে ভগ্নির কবরের অবস্থা বর্ণনা করে তার আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মা কেঁদে ফেললেন এবং বললেন,–তোমার বোন নামাযের ব্যাপারে অবহেলা করতো এবং সময় পার করে নামায পড়তো—এ হলো তার অবস্থা যে বিলম্ব করে হলেও নামায পড়তো। এ থেকেই উপলব্ধি করে নেওয়া চাই, যে মোটেই নামায পড়ে না, তার কি দশা হবে! আর আল্লাহ্ আমাদেরকে নামাযের যাবতীয় শর্ত ও হক আদায় করে যত্ন সহকারে তা আদায় করার তওফীক দান করুন, আপনি অনন্ত মেহেরবান ও দয়াশীল।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url