মোবাইল ব্যবহারের ইসলামিক রীতিনীতি || মোবাইল ফোনে বিয়ে, বন্ধুত্ব, তালাক কি বৈধ?







মোবাইল ফোনে বিয়ে


আমাদের দেশের অনেককেই বিভিন্ন কারণে স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে ভিন্‌ দেশে পাড়ি জমাতে হয়। যাপন করতে হয় প্রবাসী জীবন। এসব প্রবাসীদের সমস্যার অন্ত নেই। ঝামেলারও শেষ নেই। প্রবাসের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে বিয়ের বিষয়টি অন্যতম। কেননা কর্মব্যস্ততা, পড়াশুনা, আসা-যাওয়ার ব্যয়ভার, বিমানের টিকেট করার জটিলতা ইত্যাদি কারণে পাত্র ও পাত্রীপক্ষ মিলে বিয়ে ঠিকঠাক করলেই তাৎক্ষণিকভাবে দেশে এসে বিয়ে সম্পন্ন করা তাদের পক্ষে অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ বিয়ে তাদের করতেই হবে। তাছাড়া পছন্দমত পাত্র-পাত্রী তো চাইলেই পাওয়া যায় না! প্রবাসীদের এসব সমস্যা বিবেচনা করেই অতি সম্প্রতি মোবাইল ফোন বা টেলিফোনে বিয়ের প্রচলন হয়েছে।

মোবাইল বা টেলিফোনে বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, বিয়ে ঠিকঠাক হলে নির্ধারিত দিনে পাত্র- পাত্রী উভয়পক্ষের অভিভাবক, বর-কনে ও উকিল- সাক্ষীরা দুদেশের দুটি ফোনের পাশে জড়ো হন। তারপর ফোনে একপক্ষ ঈজাব তথা বিয়ের প্রস্তাব দিলে অপর পক্ষ কবুল তথা প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং উভয় দিকের সাক্ষীরা তা শুনেন। এভাবেই বিয়ে সম্পন্ন হয়।

আপাতদৃষ্টিতে টেলিফোনে বিয়েকে অনেক সহজ ও সুবিধাজনক মনে হয়। বিদেশ থেকে আসা যাওয়ার খরচ বাঁচে। বাঁচে সময়ও। তাছাড়া নানা ঝামেলাও এড়ানো যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টেলিফোনে বিয়েতে কিছু সুবিধার পাশাপাশি বেশকিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেমন আইন অনুসারে সঙ্গে সঙ্গে বিয়েটি রেজেস্ট্রি করা যায় না। কারণ রেজেস্ট্রির জন্য বর-কনে উভয়কে রেজেস্ট্রি বইয়ে স্বাক্ষর করতে হয়। পাত্র-পাত্রীর অনুপস্থিতিতে স্বাক্ষরের অভাবে দ্রুত রেজিস্ট্রি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে বহুমুখী সমস্যার আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠে। যেমন, কোনো কারণে যে কোনো পক্ষের বিয়ে অস্বীকার, সাক্ষীদের পক্ষে অপর পক্ষকে সনাক্ত করতে না পারা, স্বামী-স্ত্রীর দীর্ঘদিন দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়ায় দাম্পত্য-কলহ প্রভৃতি ।

তবে এসব সমস্যার চাইতে বড় কথা হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে ফোনের মাধ্যমে বিবাহ শুদ্ধ হয় না। কারণ ইসলামি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী বিয়ে সঠিক ও শুদ্ধ হওয়ার জন্য বর-কনে অথবা তাদের উকিলকে বিবাহের মজলিশে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে। সেই সাথে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকতে হবে দুজন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দুজন মহিলাকে। সহজ কথায়, বিবাহ সহিহ হওয়ার জন্য বিবাহের মজলিশে উভয়পক্ষ ও সাক্ষীদের উপস্থিতি শর্ত। ফোনে বিয়ের ক্ষেত্রে যেহেতু এসব শর্ত পাওয়া যায় না তাই ফোনের মাধ্যমে বিবাহ শুদ্ধ হয় না।

অবশ্য ফোনে বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার একটি বিকল্প পদ্ধতি আছে। তাহলো, পাত্র বা পাত্রী নিজের পক্ষ থেকে ফোনের মাধ্যমে কোনো আপনজন বা অন্য কোনো লোককে উকিল বানাবে। উক্ত উকিল, দু'জন সাক্ষীর সামনে প্রস্তাব পেশ করবেন। তখন অপরপক্ষ (পাত্র বা পাত্রী বা তাদের উকিল) কবুল তথা প্ৰস্তাব গ্রহণ করবেন। এতে বিবাহ হয়ে যাবে। কারণ এখানে উভয়পক্ষ (অর্থাৎ বর বা বরের উকিল এবং কনে বা কনের উকিল) ও সাক্ষীগণের উপস্থিতি একই মজলিশে পাওয়া গেছে। [জাদীদ ফেকহী মাসায়িল, খণ্ডঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ২৪৮ ] ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠাঃ ১৬৩; ফাতাওয়ায়ে নিজামিয়া, খণ্ডঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ২০৭]

মোবাইল ফোনে বন্ধুত্ব


মোবাইল কোম্পানিগুলো প্রায়ই নিজ নিজ গ্রাহকদের কাছে বিভিন্ন প্রকার ম্যাসেজ পাঠায়। মাঝে মধ্যে দেখা যায়, কোনো কোনো মোবাইল কোম্পানি গ্রাহকদের কাছে এমন ম্যাসেজ পাঠায় যাতে একটি বিশেষ নম্বর দিয়ে একথা বলা থাকে যে, নতুন বন্ধু নির্বাচনের জন্য উক্ত নাম্বারে ডায়াল করুন।

এই নাম্বারে ডায়াল করে পুরুষ-মহিলার সাথে বন্ধুত্ব করা যায়। কিন্তু এভাবে বন্ধুত্ব করা উচিত নয়। কেননা কাউকে না দেখে শুধু কথা শুনে বন্ধুত্ব করলে এর পরিণতি ভালো না হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এমনও হতে পারে যে, বন্ধুত্ব করার জন্য কোনো একজন মিথ্যা পরিচয় দিল এবং পরবর্তীতে সে- ই তার নানাবিধ ক্ষতি বা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াল। আর মেয়েদের সাথে তো এভাবে কথা বলে সময় নষ্ট করা, বন্ধুত্ব করা নাজায়েয, হারাম ও মারাত্মক গুনাহের কাজ। তাই প্রতিটি মুসলমানকে এ গর্হিত কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। [মাসাইলে মোবাইল, পৃষ্ঠাঃ ৩৫]

পাওনাদারের কারণে মোবাইল বন্ধ রাখা


সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করা জুলুম ও মারাত্মক অন্যায়। এই টালবাহানা যে কোনো উপায়েই করা হোক না কেন সবই নাজায়েয। যেমন, দেই-দিচ্ছি বলে অনর্থক পাওনাদারকে ঘুরানো, তারিখ দিয়ে ঐ তারিখমত টাকা দিতে না পারলে আগেই তাকে না জানানো অথবা সে যেন যোগাযোগ করতে না পারে সেজন্য মোবাইল বন্ধ করে রাখা কিংবা মোবাইল খোলা রেখে শুধু পাওনাদারের নাম্বারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখা বা সিম পরিবর্তন করে ফেলা ইত্যাদি। হ্যাঁ, ঋণগ্রহীতা যদি সময়মতো ঋণ পরিশোধে অসমর্থ হয় তাহলে তার উচিত হলো, নিজেই পাওনাদারের সাথে যোগাযোগ করে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সময় বাড়িয়ে নেওয়া। যদি পরবর্তী তারিখেও ঋণ পরিশোধে সে অপারগ হয় তাহলে আবারও নিজ থেকেই যোগাযোগ করে সময় নেওয়া। যাতে পাওনাদার বিন্দুমাত্র পেরেশান না হয় এবং সে যেন ঋণের টাকা প্রাপ্তির ব্যাপারে পূর্ণ আশ্বস্ত থাকে। মোটকথা, দেনাদার যদি নির্ধারিত সময়ে ঋণ আদায়ে অপারগ হয়, তাহলে তাকে পাওনাদের সাথে এমন আচরণ করতে হবে যাতে সে কোনো প্রকার কষ্ট না পায় এবং তার মনে টাকা প্রাপ্তির ব্যাপারে কোনো সন্দেহ না জন্মে। [মুসলিম শরিফ, খণ্ডঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ১৮; তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, খণ্ডঃ ৪ ১, পৃষ্ঠাঃ  ৫০৮; মুসনাদে আহমদ, খণ্ডঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ১৮; আউনুল মাবুদ, খণ্ডঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ১২৯]

মোবাইল ফোনে তালাক


যদি কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে মোবাইলে তালাক দেয় এবং পরে সে এ কথা স্বীকারও করে যে, আমিই তালাক দিয়েছি, অন্য কেউ নয়, তাহলে তার স্ত্রীর উপর তালাক পতিত হবে। [ফাতাওয়ায়ে শামী, খণ্ডঃ ৪, পৃষ্ঠাঃ ৪৫৬]

ক্লাস চলাকালে মোবাইলে কথা বলা


মোবাইলে কথা বলা সরাসরি কথা বলার মতোই। তাই শিক্ষকদের উচিত ক্লাস করা অবস্থায় মোবাইল বন্ধ রাখা। যাতে ক্লাসের কোনো ক্ষতি না হয় এবং ছাত্রদের হক নষ্ট না হয়। আল্লাহ মাফ করুন, আমি এমন অনেক শিক্ষক দেখেছি, যারা ক্লাস চলা অবস্থায় রিং এলে মোবাইল রিসিভ করে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে থাকেন। তারা একটু চিন্তাও করে দেখেন না যে, এর দ্বারা ছাত্রদের হক নষ্ট হচ্ছে এবং অর্পিত দায়িত্ব পালনে ত্রুটি হচ্ছে। অথচ আমাদের আকাবিরদের জীবনী তালাশ করলে দেখা যায়, ক্লাস চলাকালে তাদের কোনো মেহমান আসলে খুব প্রয়োজন হলে অল্প সময়ে কথা সেরে নিতেন এবং এভাবে গোটা মাসে মেহমানদের সাথে কতটুকু কথা বললেন তা হিসেব করতেন। হিসেব করার পর যদি দেখা যেত, সব মিলিয়ে অর্ধ দিনের কম হয়েছে তাহলে অর্ধ দিনের বেতন নিতেন না। আর যদি অর্ধ দিন বা তার চেয়ে বেশি হতো তাহলে পূর্ণ একদিনের বেতন নিতেন না। সুবহানাল্লাহ! তাঁরা কত উঁচু পর্যায়ের পরহেজগার ছিলেন!! আল্লাহ আমাদেরকেও তাদের মতো তাকওয়া-পরহেজগারী নসীব করুন। আমীন ।

যাহোক, এবার পূর্বের কথায় ফিরে আসি। বলছিলাম, ক্লাস চলাকালে মোবাইলে কারো সাথে কথা না বলাই শ্রেয়। আর যদি খুব বেশি প্রয়োজনে একান্ত অপারগ হয়ে বলতেই হয়, তাহলে যথাসম্ভব অল্প সময়ে কথা শেষ করে নিতে হবে। এ ব্যাপারে হিফজ বিভাগের শিক্ষকদেরকে আরো বেশি সতর্ক হওয়া চাই । যখন ছাত্ররা পড়া শুনাবে তখন তারা অন্যের সাথে মোবাইলে কিংবা সরাসরি কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন। কেননা পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের সময় চুপ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। [আল ইমদাদ স্মারক, ২০০৮, পৃষ্ঠাঃ ১৮১]

মহিলা কর্তৃক কল রিসিভ করা


বিনা প্রয়োজনে গাইরে মাহরাম পুরুষদের সাথে মহিলাদের কথা বলা জায়েয নেই। তাই ঘরে কোনো পুরুষ লোক থাকা অবস্থায় মোবাইলে ফোন আসলে মহিলারা রিসিভ করতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, ঘরে কোনো পুরুষ না থাকলে কিংবা অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজনে মহিলাদের জন্য মোবাইল রিসিভ করায় এবং অনর্থক দীর্ঘ কথা পরিহার করে সংক্ষেপে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলায় কোনো দোষ নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কথা যেন অবশ্যই নরম ও মধুর স্বরে না হয়। [ফতোয়ায়ে শামী, খণ্ডঃ ৯, পৃষ্ঠাঃ ৫৩০]

মোবাইল ব্যবহারের ইসলামিক রীতিনীতি

অটো রিসিভ অন করে রাখা


বিনা প্রয়োজনে মোবাইলের মধ্যে অটো রিসিভ করে রাখা ঠিক নয়। কারণ অটো রিসিভ করে রাখার ফলে কারো রিং ভুলক্রমে যদি এই নাম্বারে চলে আসে তাহলে সাথে সাথে তা রিসিভ হয়ে তার টাকা কাটা যাবে। যা ‘অযথা অন্যের ক্ষতি করা'র মধ্যে শামিল হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি বারবার মিসকল দিয়ে বিরক্ত করে অথচ তার সাথে মিসকল দেওয়ার ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি (অর্থাৎ তাকে বলা হয়নি যে, তোমার প্রয়োজন হলে আমাকে মিসকল দিবে, আমিই কলব্যাক করে তোমার সাথে কথা বলব) তাহলে তার মিসকলের বিড়ম্বনা থেকে বাঁচার জন্য স্বীয় মোবাইলে অটো রিসিভ করে রাখা বা তার মিসডকল ধরা জায়েয আছে। [দুররুল মুখতার, খণ্ডঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ৩৩৬]



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url