দ্বীনি বিষয়ে জিজ্ঞাসা ও জবাব || ইসলামিক প্রশ্ন ও উত্তর (পর্ব - ০১)






শৈশবে মৃত শিশুর ধর্ম


প্রশ্ন-০১: অমুসলিমদের সন্তান, যারা শৈশবে মারা যায়, তারা কি কাফের? আবার মুসলিম শিশু শিরক করে শৈশবে মারা গেলে তাদেরকে কাফের সম্বোধন করা যাবে কি না জানতে চাই ।


উত্তর: এর দুটো দিক আছে । প্রথম হল একজন অমুসলিমের সন্তান শিশু অবস্থায় মারা গিয়েছে— আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে, ইসলাম মূলত মানুষের ঐচ্ছিক কর্মের উপর নির্ভর করে । জন্ম, বংশ, কার সন্তান, কার পরিবারে জন্ম নিয়েছে, কীভাবে মৃত্যুবরণ করেছে— এটা বড় বিষয় নয়। কাজেই যে শিশুটা জন্মেছে, এখনো বড় হয় নি, সে প্রাপ্তবয়স্ক হয় নি । তাই তার তো কোনো পাপ নেই। কাজেই, কোনো শিশু শিরক করতে পারে না । কুফর করতে পারে না। সে তো সচেতন হয় নি এখনো। এজন্য অমুসলিমের সন্তান যখন মারা যায় তখন তাকে অমুসলিম বা কাফের বলা যায় না, রাসূল (স) বলেছেন:

كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِرَانِهِ، أَوْ يُمَحِسَانِهِ

প্রতিটি মানবসন্তানই ফিতরাতের উপরে, মানবীয় প্রকৃতির উপরে, তাওহীদের উপরে জন্মগ্রহণ করে। তার ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান, অগ্নিপূজক ইত্যাদি কোনো পাপ থাকে না । বড় হওয়ার পরে পিতামাতার মাধ্যমে বা সমাজের মাধ্যমে সে নির্দিষ্ট একটা ধর্ম গ্রহণ করে। কাজেই এই পর্যায়ে যাওয়ার আগে যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তাকে আমরা মুশরিক বলতে পারি না। ঠিক তেমনি মুমিনের সন্তানও যদি মারা যায় এই পর্যায়ে, তাকেও আমরা কাফের বলতে পারছি না। সে যদি অপরাধ করেও থাকে সেটা পিতামাতাকে দেখে দেখে করে । সে পাপী নয় ।


নামাজের পরে মোনাজাত


প্রশ্ন-০২: ওহাবি আর সুন্নি এই জিনিসটা আমার কাছে ক্লিয়ার না। আমার ছেলে হাফেয, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, সে ওহাবি মাদরাসায় পড়ে। এখন আমরা দেখি যে ওদের মাদরাসায় নামাযের পরে মুনাজাত হয় না। আমি ওকে বলি, আব্বু, তুমি মুনাজাত কর না কেন, মুনাজাত না করলে মনে হয় যেন নামাযটা পরিপূর্ণ হয় না। ও বলে, আম্মু, আমাদের মাদরাসায় ওগুলো করে না । এই মুনাজাতের ব্যাপারটা আমি জানতে চাই ।

উত্তর: আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন এটা বোঝার জন্য দীর্ঘ আলোচনা দরকার। ওহাবি শব্দটা এসেছে সৌদি আরবের একজন সংস্কারক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের নাম থেকে । যিনি অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি জন্মগ্রহণ করেন এবং আমার যতদূর মনে পড়ে ১৭৯০/৯৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । এই মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক বিদআতের বিরুদ্ধে ছিলেন । তার কর্মের ভুলত্রুটি আছে কিন্তু তিনি বিদআতের বিরুদ্ধে ছিলেন। পরবর্তীতে সারা দুনিয়ার যে কোনো মানুষ বিদআতের বিরোধিতা করলেই তাকে ওহাবি বলা হয়। ওহাবিয়াতের কোনো ডেসক্রিপশন নেই। মুনাজাত না করলে তাকে ওহাবি বলা হয়। আবার অনেক জায়গায় ধুমপান না করলে তাকে ওহাবি বলা হয় । কোনো কোনো জায়গায় কেউ সুন্দর কিরাআত পড়লে তাকে ওহাবি বলা হয়। অর্থাৎ সমাজের প্রচলনের বাইরে যে গেল সে ওহাবি । এটা অনেকটা এমন, মুহাম্মাদ সা. যখন দীন প্রচার করতে লাগলেন, সমাজের মানুষেরা তাঁর কোনো কাজকে খারাপ বলতে পারল না, তখন কাফেররা বলতে লাগল মুহাম্মাদ সাবে' হয়ে গেছে- সাবাআ মুহাম্মাদ । অর্থাৎ আমাদের বাপদাদার প্রচলিত ধর্ম ত্যাগ করে নতুন একটা ধর্ম নিয়ে এসেছে। এটা একটা গালি মাত্র। ঠিক তেমনি ওহাবি শব্দ একটা গালিতে পরিণত হয়েছে । মূলত ওহাবি বলে কোনো জিনিস নেই । দেখবেন সমাজে যারা কুরআন-সুন্নাহ মানতে চায়, রাসূল (সাঃ) এর অনুসরণ করতে চায়- বিদআতকে যারা ভালোবাসে তারা এইসব মানুষকে ওহাবি বলে গালি দেয়। আমরা সবাইকে অনুরোধ করব, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সাঃ) কে অনুসরণ করতে চায় তাকে আপনি কেন গালি দেন! তাহলে তো মুহাম্মাদ (সাঃ) কে গালি দেয়া হয় । এটা হল মূল বিষয় । মূলত ওহাবি বলে কিছু নেই । কেউ বলে ওহাবিরা ওলিদের অস্বীকার করে, কেউ বলে ওহাবিরা রাসূল (সাঃ) কে মানে না- এগুলো সবই ভুল কথা। মূলত যাদেরকে আমরা ওহাবি বলি তারা সবই মানেন। তারা মাযহাব মানেন, তারা সুন্নাত মানেন, তারা ওলিদের মানেন, তারা কুরআন মানেন এবং তারা কেউ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের ভক্ত নয় । কিন্তু তারা বিদআতের বিরোধিতা করেন। এটাই হল সমস্যা। এবার আসা যাক নামাযের পরের মুনাজাতের বিষয়ে । আসলে আমরা তো অভ্যাসের দাস। নামাযটাই মুনাজাত । মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا قَامَ يُصَلِّي إِنَّمَا يَقُومُ يُنَاجِي رَبَّهُ، فَلْيَنْظُرْ كَيْفَ يُنَاجِيهِ

অর্থাৎ যখন তোমাদের কেউ সালাতে দাঁড়ায়, তখন সে তার রবের সাথে মুনাজাত করে । মুনাজাত শব্দের অর্থ কথা বলা । চুপিচুপি কথা বলা। তো যখন আমরা সালাতে দাঁড়াই তখন আমরা মুনাজাত করি। কাজেই রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তুমি কার সাথে কথা বলছ, কী কথা বলছ, সচেতন হয়ে কথা বলো। অতএব সালাতটা পুরোটাই মুনাজাত । আবার আমরা যে দুআ বলি; সালাত দুআ । রাসূল (সাঃ) সালাতের সিজদায় দুআ করতেন, সালাম ফিরানোর আগে দুআ করতেন। আর যেটা নিয়ে আমাদের গোলমাল, অর্থাৎ সালাতের পরের দুআ এটাও রাসূল (সাঃ) করতেন । তবে সমস্যা হল, দলবদ্ধভাবে সবাই মিলে যে মুনাজাতটা করা হয় এভাবে রাসূল (সাঃ) কখনো করতেন না । রাসূল (সাঃ) মদীনার দশ বছরের জীবনে আঠারো হাজার ওয়াক্ত সালাত আদায় করেছেন, এক ওয়াক্ত সালাতেও তিনি সবাইকে নিয়ে দলবদ্ধভাবে হাত তুলে মুনাজাত করেছেন এমন একটা হাদীস নেই। কিন্তু এর বিপরীতে রাসূল (সাঃ) এর শতশত হাদীস আছে, তিনি সালাতের সালাম ফেরানোর পরে একা একা বিভিন্ন দুআ পড়েছেন । আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন। এজন্য যারা রাসূল (সাঃ) এর পুরোপুরি অনুসরণ করতে চান তারা একাকি দুআকে পছন্দ করেন। আপনিও তো একাই দুআ করেন বোন! আপনার সন্তানও একাই দুআ করবে।


দূর্ঘটনায় মারা গেলে


প্রশ্ন-০৩: আমার বাবা দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। আমি শুনেছি যে, দূর্ঘটনায় মারা গেলে শাহাদাতের মৃত্যু হয়, বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়া যায়। এটা আমার জানা খুবই দরকার।

উত্তর: আপনি যেটা বলেছেন, অনেকটা সত্য। রাসূল (সাঃ) শহীদদের কথা বলেছেন- যারা পানিতে ডুবে মারা যায়, কিছু চাপা পড়ে মারা যায় তারা শহীদ । অর্থাৎ আল্লাহ তো মুমিনের ভালো চান। যে মুমিন হঠাৎ করে দুর্ঘটনায় মারা গেল তার মৃত্যুটা দুঃখজনক, এর বিনিময়ে আল্লাহ তাকে শাহাদাত নসিব করেন। তো আপনার আব্বারও দুর্ঘটায় মৃত্যুর কারণে শাহাদাত নসিব হবে, যদি অন্য সমস্যা না থাকে । এবং তিনি শহীদের মর্যাদা ও সুবিধাগুলো পাবেন বলে আমরা আশা করি ।


অ্যাবরশন করা কি গোনাহ


প্রশ্ন-০৪: এক দেড় মাস হল আমার স্ত্রীর গর্ভে সন্তান এসেছে। কিন্তু আমরা আমাদের সমস্যার কারণে এই মুহূর্তে সন্তান নিতে চাচ্ছি না। আমরা এখন অ্যাবরশন করলে কি গোনাহ হবে?

উত্তর: জি, এটা গোনাহ হবে। যদি আপনার সমস্যাটা শরীআতসম্মত না হয় । সন্তান মায়ের গর্ভে যাওয়ার অর্থই হল, যেটা আল্লাহ কুরআনে বলেছেন:

فِي قَرَارٍ مَكِينِ

সে একটা নিরাপদ, সুন্দর অবস্থানে চলে গেছে । এই অবস্থায় তার নিশ্চিত জীবন থেকে তাকে বঞ্চিত করা, এটা হত্যার মতোই । আপনি জন্মবিরতি করেছেন এটা ভিন্ন কথা । কিন্তু সন্তান মাতৃগর্ভে অবস্থানের পরে অ্যাবরশন করা, এটা হত্যার শামিল। তবে যদি মায়ের জীবনের আশঙ্কা থাকে, নিশ্চিতভাবে জানা যায় মায়ের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ সেক্ষেত্রে অ্যাবরশন করাতে পারেন। এটা ডাক্তারের কাছ থেকে নিশ্চিত হতে হবে।


রোযা রেখে নখ-চুল কাটা


প্রশ্ন-০৫: রমাযান মাসে রোযা রেখে নখ-চুল কি কাটা যাবে ?

উত্তর: বোন, উত্তর দেয়ার আগে একটু পেছনে যাই। রমাযানের রোযা কেন নষ্ট হয়! ইবাদত তো আপনার জন্য । আপনি যেন ইবাদতের মাধ্যমে সুন্দর মানুষ হন । আল্লাহ তাআলা পানাহার নিষেধ করেছেন । কাজেই পানাহার নয় এমন সবই করা যায়। নখ- চুল শুধু না, একটা হাত কেটে গেলেও রোযার কোনো ক্ষতি হবে না । আমরা অনেক সময় মনে করি, রক্ত বেরিয়ে গেলে রোযার ক্ষতি হয় । আসলে কিন্তু তা নয়। রাসূল (সাঃ) রোযা অবস্থায় নিজে চিকিৎসার জন্য শরীর ছিদ্র করে হিযামা (শিঙ্গা লাগিয়েছেন) করেছেন । কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, রক্ত বেরোলেও রোযা ভাঙে না, ইঞ্জেকশন নিলেও রোযা ভাঙে না । নখ-চুল কাটলে তো রোযা ভাঙার প্রশ্নই আসে না । রোযার কোনো ক্ষতিও হয় না।


হাফহাতা শার্ট বা টিশার্ট পরে নামায


প্রশ্ন-০৬: হাফহাতা শার্ট বা টিশার্ট পরে কি নামায হবে?

উত্তর: পুরুষদের জন্য নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা ফরয। আর দুই কাঁধসহ উপরের অংশটা ঢেকে রাখা ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। কনুই ঢেকে রাখার কোনো জরুরত নেই। বাংলাদেশে অনেকেই বলেন, হাফহাতা শার্ট, গেঞ্জি ইত্যাদি পরে সালাত আদায় করলে সালাত হয় না- কথাটা আসলে ওই রকম নয়। আসল কথা হল, রাসূল (সাঃ) হচ্ছে এবং অন্য সময়, হজ্জের ইহরামের সময় যে পোশাক পরা হয়, এটা পরেই তিনি আজীবন নামায পড়েছেন মদীনায়। দর্শক, আপনারা হয়ত দেখেছেন ইহরামের পোশাকে কনুইটা খুলে যায়। হাফহাতার মতোই। কাজেই কাঁধ ঢেকে রাখা জরুরি, কনুই ঢেকে রাখা জরুরি নয়। অতএব গেঞ্জি বা হাফহাতা শার্ট পরে সালাত আদায় করলে সালাতের কোনো ক্ষতি হবে না ।


ওয়াজিব নামায


প্রশ্ন-০৭: আমরা জানি ফরয নামায আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। কিন্তু ওয়াজিব নামায কোথা থেকে এসেছে?

উত্তর: এখানে বোঝার একটা সমস্যা রয়ে গেছে। আসলে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল, মাকরুহ, হারাম সবই আমরা আল্লাহর তরফ থেকে পেয়েছি। সকল ইবাদতই আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। এবং সকল ইবাদতের বর্ণনাই রাসূল (সাঃ) দিয়েছেন। আমরা অনেক সময় মনে করি, ফরয আল্লাহর জন্য আর সুন্নাত রাসূল (সাঃ) এর জন্য । এটা গভীরভাবে চিন্তা করলে শিরক হয়ে যায়। সকল ইবাদত আল্লাহকে খুশি করতে এবং সকল ইবাদতই মুহাম্মাদ (সাঃ) এর তরিকায় হতে হবে। ফরযটা যে ফরয এটা আমরা রাসূল (সাঃ) থেকে শিখেছি। মূল বিষয় হল, ফরয ছাড়া সবকিছুই নফল । ইসলামে দুটো ভাগ করা হয়েছে । ফরয এবং নফল । নফলের ভেতরে পর্যায় রয়েছে। যে নফলটা রাসূল (সাঃ) বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, কোনো কোনো ফকীহ এটাকে ওয়াজিব বলেছেন । এটা ইমাম আবু হানীফা রাহ. এবং কোনো কোনো ফকীহর কথা । অন্যান্য ফকীহ ফরয ওয়াজিব আলাদা করেন নি। তাদের দৃষ্টিতে ফরয এবং নফল । ওয়াজিব পরিভাষাটা হানাফি মাযহাবে রয়েছে । এটা ওই সকল নফল, যেটা ফরয নয় কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটাকে ওয়াজিব বলা হয় ।


তথ্যসূত্রঃ
২. সহীহ বুখারি, হাদীস নং-১৩৮৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস- ২৬৫৮
৩. ইবন আবী শায়বা, আল মুসান্নাফ, হাদীস-৮৪৬২; বাযযার, আল মুসনাদ-৬১৪৮ ও ৬৪২৪; ইবন খুযাইমা, আস সহীহ-৪৭৪
৪. 'সূরা মুমিনূন, আয়াত-১৩; সূরা মুরসালাত, আয়াত-২১




***************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url