আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অবদান

‘আওয়ামী লীগ’ এবং ‘বাংলাদেশ’ মাওলানা ভাসানীর কাছে ঋণী


[১২ই ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ১৪৩-তম জন্মদিন। ক্ষণজন্মা প্রবাদ পুরুষ গণ মানুষের এই নেতাকে আমরা অনেকেই ভুলে গিয়েছি। অথচ এই মানুষটির জন্ম না হলে বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্ম হতো না। ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশের সৃষ্টি ইত্যাদি এসব কিছুই হতো না যদি একজন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এদেশে জন্ম গ্রহণ না করতেন। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ১৪৩-তম জন্মদিনে আমরা এই মহান নেতাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি।]

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বর্তমান আওয়ামী লীগ নামের দলটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু সেকথা এখন আর কেউ মুখে বলেন না। আসুন, আমরা এই প্রবন্ধে ছোট্ট পরিসরে হলেও সত্য ইতিহাস জানার চেষ্টা করি।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ভাসানী

জন্মগতভাবে সিরাজগঞ্জের সন্তান হলেও মওলানা ভাসানীকে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশ থেকে বহিষ্কৃত ও বিতাড়িত হতে হয়েছিল। একজন নেতা হিসেবে তাঁর উত্থান ঘটেছিল পার্শ্ববর্তী প্রদেশ আসামে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যখন স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় মওলানা ভাসানী তখন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন । পাকিস্তান হওয়ার পর পর স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী এবং প্রথম ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ চলে গিয়েছিল গণবিচ্ছিন্ন কুচক্রী নেতাদের দখলে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকার বা মুসলিম লীগের যে কোনো ধরনের সমালোচনা ও বিরোধিতাকে সে সময় রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অন্যদিকে বন্ধ করা হয়েছে মুসলিম লীগে প্রবেশের সকল দরজা। মুসলিম লীগকে এমনভাবেই কুচক্রী নেতারা কুক্ষিগত করেছিলেন যে, সাধারণ মানুষ দূরে থাকুক, এমনকি মওলানা ভাসানীর মাতা একজন প্রধান নেতাকেও দলের প্রাথমিক সদস্যপদ দেয়া হয়নি । সে অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মে একদলীয় স্বৈরশাসনের সূচনা ঘটেছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক পাকিস্তানী শাসকরা পূর্ব পাকিস্তান বিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়েছেন বাধাহীনভাবে। পরিণামে স্বায়ত্তশাসনের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) বঞ্চিত হয়েছে, প্রাদেশিক রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ চলে গেছে কেন্দ্রের দখলে । চাকরি ও ব্যবসায়ও সুযোগ পায়নি পূর্ব পাকিস্তানীরা । বাংলাভাষী জনগণের প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান বিরোধী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোরও উদ্যোগ নিয়েছিল । এমন পরিস্থিতিতে সে সময় সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিরাধী দল গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নেন মওলানা ভাসানী । প্রদেশ জুড়ে বিকাশমান অসন্তোষ এবং বিচ্ছিন্নভাবে চলমান বিভিন্ন আন্দোলনকে সমন্বিত করার মাধ্যমে বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানী এক 'রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন' আহ্বান করেন । ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই কর্মী সম্মেলনেই গঠিত হয়েছিল প্রদেশের প্রথম বিরোধী দল 'পূর্ব পাকিস্তান অওয়ামী মুসলিম লীগ ।' দলের ৪০ সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটিতে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি,
আতাউর রহমান খানসহ তিনজনকে সহ-সভাপতি, টাঙ্গাইলের যুবনেতা শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক এবং ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করা হয়েছিল । দলের নাম প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জানানো হয়েছিল, এটাও 'মুসলিম লীগ', তবে 'জনগণের মুসলিম লীগ' এবং সে কারণেই 'আওয়ামী' শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে ।

ভাষা আন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর ভূমিকা

বাংলাদেশের জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ১৯৫৭ সালের জুলাই পর্যন্ত দলটির সভাপতি হিসেবে তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্রে ও প্রদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) সরকার গঠন করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের যে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার প্রধান নির্মাতা। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাকও তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন (৩০ নভেম্বর, ১৯৭০)। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর আজকের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব বাংলার ওপর শোষণ, বঞ্চনা ও অবিচারের সূচনা হলে প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ক্রমাগত তীব্রতর করেছিলেন। স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প হিসেবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সংগঠিত করার মাধ্যমে মওলানা ভাসানী সমগ্র পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিলেন । স্বাধীনতামুখী সে অবস্থান থেকে জনগণকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি ।
১৯৪৮ সাল থেকে বিকশিত ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়েও মওলানা ভাসানীর ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্কের প্রাথমিক পর্যায়ে কেবল জনসভার ভাষণে বা বিবৃতিতে নয়, পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পার্লামেন্ট বা ব্যবস্থাপক সভায়ও তিনি বাংলা ব্যবহারের দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন । যেমন প্রাদেশিক ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে মওলানা ভাসানী ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার দাবি জানিয়েছিলেন । বিষয়টি নিয়ে পার্লামেন্টের ভেতরে তিনি অবশ্য আর কথা বলার বা দাবি জানানোর সুযোগ পাননি । কারণ, স্বল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগ সরকার ব্যবস্থাপক সভায় তাঁর সদস্যপদ বাতিল করিয়েছিল।

ওদিকে পাকিস্তানের জাতির পিতা ও গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ 'উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' বলে ঘোষণা দেয়ার পর থেকে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল। জিন্নাহকে অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও ঢাকা সফরে এসে কথিত 'প্রাদেশিকতার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে অত্যন্ত 'অশোভন' আখ্যা দিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মীমাংসা হইয়া গিয়াছে।' (১৮ নভেম্বর, ১৯৪৮) তখনও পর্যন্ত আসাম মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি হিসেবে পরিচিত মওলানা ভাসানী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত মন্তব্য ও পূর্ব বাংলাবিরোধী বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এভাবে বিরোধিতার মধ্য দিয়েই তাঁর সরকারবিরোধী ভূমিকার শুরু হয়েছিল। ফলে তাঁর ওপর নেমে এসেছিল নির্যাতন । তিনি দক্ষিণ টাঙ্গাইল থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তাঁর এই নির্বাচনকে বাতিল করে দেয়। সেই সাথে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়ার ওপর আরোপিত হয় নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু সরকারের সঙ্গে আপস করার পরিবর্তে মওলানা ভাসানী আন্দোলনের পথে এগোতে থাকেন, প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম প্রভাবশালী বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আবারও বাংলা ভাষা ও কথিত 'প্রাদেশিকতার সমালোচনা করলে প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরকালেই আর্মানিটোলা ময়দানে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভা থেকে রাষ্ট্রভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পূর্ব বাংলার দাবি তুলে ধরা হয়। আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয় ।

লিয়াকত আলী খানের পর প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্তি পেয়ে ঢাকা সফরকালে খাজা নাজিমউদ্দিনও উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির বিরোধিতা করার পাশাপাশি তিনি মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধেও কঠোর বক্তব্য রেখেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন মওলানা ভাসানীকে 'ভারতের চর' হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্য পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট করা। জবাবে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, জনগণ মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে বলে এবং নিজেদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে পড়তে শুরু করেছে বলেই খাজা নাজিমউদ্দিন বেসামাল হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে 'আবোলতাবোল' অভিযোগ আনছেন। খাজা নাজিমউদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে সর্বস্তরের বিশিষ্ট নাগরিকদের এক সভায় গঠিত হয়েছিল 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ'। ৪০ সদস্যবিশিষ্ট সে কর্মপরিষদের এক নম্বর সদস্য ছিলেন মওলানা ভাসানী । আবুল হাশিম ও আতাউর রহমান খানের মতো প্রবীণ নেতাদের পাশাপাশি অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা ও আবদুল মতিনের মতো ছাত্র ও যুবনেতারাও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি ঢাকা নগরীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪ ফেব্রুয়ারি যে ধর্মঘটের এবং সভা ও শোভাযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে সে সবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়েছিল। একাধিক বিবৃতি ও ভাষণে মওলানা ভাসানীও কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রাজধানীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সেদিন পাঁচ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে সমবেত হয় এবং দীর্ঘ মিছিল নিয়ে বিক্ষোভ করে । বিকেলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় দেয়া ভাষণে মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার সঙ্গে মুসলিম লীগ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার কঠোর সমালোচনা করেন এবং রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ১৫০ নম্বর মোঘলটুলিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে সেটা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না প্রশ্নে দীর্ঘ বিতর্ক চলে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে অলি আহাদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাকে সমর্থন জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, যে সরকার গণআন্দোলনকে বানচাল করার জন্য অন্যায়ভাবে আইন প্রয়োগ করে সে সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞাকে মাথা নত করে মেনে নেয়ার অর্থ স্বৈরাচারের কাছে আত্মসমর্পণ করা। মওলানা ভাসানীর এই দৃঢ় অবস্থানের ফলে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষিত হয়। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে এক মাসের জন্য সব মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে ।

তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ সে পরিস্থিতিতে ঢাকার ৯৪ নবাবপুরে অবস্থিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় অফিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের জরুরি সভা। এতে দীর্ঘ বিতর্কের পর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে বেশি ভোট পড়লেও পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই বিক্ষোভ মিছিল বের হয়েছিল। সে মিছিলের ওপরই গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। আগের কর্মসূচি অনুযায়ী মওলানা ভাসানী এ সময় ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রদেশের বিভিন্নস্থানে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সাংগঠনিক সফরে ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণ ও ছাত্রহত্যার খবর জেনেই তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন। মোহাম্মদ সুলতানের মতে তিনিই জানাজার নামাজে ইমামতি করেছিলেন। অন্যদিকে গাজীউল হক বলেছেন, তিনি মোনাজাত পরিচালনা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রধান সমর্থক সাপ্তাহিক সৈনিক' লিখেছে, 'মেডিকেল কলেজের সম্মুখে তিনি (অর্থাৎ মওলানা ভাসানী) লক্ষ লোকের একটি গায়েবানা জানাজায় নেতৃত্ব করেন।' (বশীর আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস', পৃ- ৩৭৪-৩৭৭)

২২ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন, 'ঢাকায় যাহা ঘটিয়াছে তাহার নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নাই। কোন সভ্য সরকার এরূপ বর্বরোচিত কান্ড করিতে পারে দুনিয়ার ইতিহাসে তার নজির খুঁজিয়া পাই না । ........আমি মোমেনশাহী, পাবনা, কুমিলা সফর করিয়া গতরাত্রে ঢাকায় ফিরিয়া যাহা দেখিলাম তাতে আমার কলিজা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। নূরুল আমীন সরকার অবশেষে জাতির ভবিষ্যৎ ছাত্রসমাজকে দমাইবার জন্য চরম পন্থা অবলম্বনে মাতিয়াছে । আমি দাবী করি, অবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হউক, পুলিশী গুলীর তদন্ত করার জন্য হাইকোর্ট জজ ও জনপ্রতিনিধি নিয়া গঠিত কমিশন নিযুক্ত করা হউক । আমি অপরাধীদের প্রকাশ্য বিচার দাবী করিতেছি। এই ব্যাপারে যাদের গ্রেফতার করা হইয়াছে তাদের মুক্তি দেওয়া এবং যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হইয়াছে অবিলম্বে তাহা প্রত্যাহার করা হউক। সর্বোপরি শহীদদের পরিবারপরিজনকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হউক।...' (সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২)

ভাষা আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকার অসংখ্য ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করেছিল। মাওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করতে না পেরে তাঁর বিরুদ্ধে জারি করেছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা। মাওলানা ভাসানী আদালতে হাজির হয়ে গ্রেফতার বরণ করেছিলেন ১০ এপ্রিল (১৯৫২)। কারাগারেও তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। রাষ্ট্রভাষা ও স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন দাবি পূরণ এবং আন্দোলনকালে গ্রেফতার করা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি আদায়ের জন্য মওলানা ভাসানী এ সময় নতুন ধরনের অনশন শুরু করেন। সারাদিন তিনি রোজা রাখতেন অর্থাৎ পানাহার করতেন না। অনশন ভাঙতেন সন্ধ্যার পর। তাঁর অনুপ্রেরণায় অন্য বন্দিদের অনেকেও একইভাবে অনশন শুরু করেন। রাজবন্দি অলি আহাদ ও ধনঞ্জয় দাশ লিখেছেন, মওলানা ভাসানীর পরামর্শে তারা ৩৫ দিন রোজা রেখেছিলেন এবং এর ফলে কারাগারের ভেতরে- বাইরে বন্দিদের মুক্তির জন্য আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে অনেকে মুক্তিও পেয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল। রোজা রাখার ধারাবাহিকতায় ১৮ এপ্রিল থেকে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন। এতে তাঁর শরীর খারাপ হতে থাকে, সে খবর প্রকাশিত হলে জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। জনমতের চাপে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কারাগারে মওলানা ভাসানী একদিনের অনশন করেছিলেন ।

এভাবেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সেকালের আরো অনেক নেতাও প্রাথমিক পর্যায়ে অংশ নিয়েছিলেন সত্য কিন্তু তাদের সবাইকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যেমন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা গাজীউল হক জানিয়েছেন, 'মওলানা ভাসানীসহ যে ৪২ জন নেতা এই আন্দোলনের সপক্ষে ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রিত্ব ও রাষ্ট্রদূতের পদ নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। (ধানসিঁড়ি সংকলন, চতুর্থ প্রকাশনা, ১৯৮০, পৃ- ৫৮) এখানে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা সম্পর্কেও জানানো দরকার । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণ ও ছাত্রহত্যার পর সমগ্র প্রদেশে যখন সরকারের বিরুদ্ধে ধিক্কার উঠেছিল এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন যখন আরো দুর্বার হচ্ছিল তেমন এক পরিস্থিতির মধ্যেও ২৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দরাবাদ থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, '... ঘটনা বর্তমানে ঘটিলেও বহু পূর্বেই পূর্ব বংগে ভাষা সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দিয়াছে । আমি সেই সময় একটি জনসভায়ও এক বিবৃতিতে বলিয়াছিলাম, যে-আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তদনুসারে উর্দুই হইবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।... বাংলার বুকে অবশ্য উর্দুকে জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইবে না, তবে বিদ্যালয়ে আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষারূপে ইহা পড়ান হইবে এবং যথাসময়ে এই প্রদেশবাসীগণ এই ভাষার সহিত পরিচিত হইয়া উঠিলে প্রদেশের শিক্ষিত সমাজ ও সরকারী কর্মচারীগণ আপনা হইতেই ইহা পড়িতে ও লিখিতে শুরু করিবে। তখন উর্দু তাহাদের নিকট গৌরবজনক মর্যাদাই লাভ করিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানীরাও দুই ভাষাভাষী হইবে ।...' (দৈনিক আজাদ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)

উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এই বক্তব্যের কঠোর বিরোধিতা করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল । দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, 'সংবাদপত্রে জনাব সোহরাওয়ার্দীর এক বিবৃতি দেখিয়া আমরা অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম । উহাতে তিনি পরোক্ষভাবে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের জন্য ওকালতী করিয়াছেন।... উহাতে তাহার ব্যক্তিগত অভিমতই প্রকাশিত হইয়াছে বলিয়া বুঝিতে হইবে এবং আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করিতেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মোছলেম লীগ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহিত না হওয়া পর্যন্ত এবং সরকার কর্তৃক কার্যকরী না করা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালাইবে। আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার দাবী করা হইয়াছে এবং এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হওয়ার পর হইতেই আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার জন্য আন্দোলন করিয়া আসিতেছি।' (দৈনিক আজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)

দলের পাশাপাশি মাওলানা ভাসানী নিজেও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষেই ভূমিকা পালন করেছিলেন। মূলত আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে মাওলানা ভাসানীর অব্যাহত দাবি ও চাপের কারণেই ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। (দৈনিক আমার দেশ, শহীদ দিবস সংখ্যা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২)

'৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মাওলানা ভাসানীর ভূমিকা

নিজেদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস জানা না থাকলে কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীর পক্ষেই মুক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ইতিহাস জানা না থাকার কারণে অনেক ত্যাগ আর জীবনের বিনিময়ে গড়ে ওঠা নতুন নতুন আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। অন্যদিকে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ষড়যন্ত্রসহ বিভিন্ন পথে অঙ্গত সুবিধা নেন একশ্রেণীর অসৎ রাজনীতিক। পাকিস্তানের ২৪ বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বিভ্রান্তি ও অসততার কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রতারণার শিকার হতে হয়েছিল । কোনো কোনো নেতার উদ্যোগে সুপরিকল্পিতভাবে প্রদেশের অধিবাসীদের বঞ্চনার শিকার বানানো হয়েছে। সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসেও নস্যাৎ হয়ে গেছে একাধিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন ।

প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়ার জন্য ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানকে পর্যালোচনায় নেয়া যেতে পারে । বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে এই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তি এবং পাকিস্তানের 'লৌহ মানব' হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিদায় ছিল সে গণঅভ্যুত্থানের প্রধান অর্জন। বলা দরকার, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিজেই তার পরিণতির তথা '৬৯-এর ছাত্র- গণঅভ্যুত্থানের কারণ বা প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসনের অবৈধ পথে ক্ষমতা দখলের পর থেকে গৃহীত বিভিন্ন নীতি ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে তিনি পাকিস্তানে তার স্বৈরশাসনকে সর্বব্যাপী করেছিলেন । অব্যাহত রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং জনগণকে অধিকারবঞ্চিত রাখার পাশাপাশি ১৯৬২ সালে তিনি এমন এক শাসনতন্ত্র বা সংবিধান চাপিয়ে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারও স্বীকৃত হয়নি। আইয়ুবের সংবিধানে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের ওপর সংখ্যাসাম্যের বিধান চাপানো হয়েছিল। সে বিধান অনুযায়ী সাধারণ ভোটারদের ভোটে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার করে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্ৰী' বা বেসিক ডেমোক্র্যাট নির্বাচিত হতেন। এদের বলা হতো 'বিডি মেম্বার'। বিডি মেম্বাররাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে এবং প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য তথা এমপিএ ও এমএনএদের নির্বাচিত করতেন। টাকা ও সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে বিডি মেম্বারদের ভোট সহজেই কেনা যেতো বলে কোনো নির্বাচনেই জনগণের ইচ্ছা ও আশা-আকাংক্ষার প্রতিফলন ঘটতে পারতো না। বিডি মেম্বাররা একই সঙ্গে সরকারের অনুচরবৃত্তিও করতেন। তাদের চিহ্নিত করা হতো আইয়ুব খানের 'দালাল' হিসেবে। এভাবে অনুচর ও দালাল তৈরির পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণ ও জাতিগত নিপীড়ন চালানোর ব্যাপারেও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার পূর্বসুরীদের অনুসরণ করেছিলেন। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকেও তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত রেখেছিলেন।

এই বৈষম্য, দুর্দশা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আইয়ুব শাসনের প্রথম দিনগুলো থেকেই বিভিন্ন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা নিয়েছিল প্রদেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ। ১৯৬০ সালে সূচিত সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের ধারায় ১৯৬২-র সেপ্টেম্বরে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে তারা প্রথম সাফল্য অর্জন করেছিল। উল্লে খযোগ্য দ্বিতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিনগুলোতে অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রধান বিষয়ে পরিণত করে শেখ মুজিব তার ৬ দফা উত্থাপন করেছিলেন (ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬)। নতুন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হলেও ৬ দফা প্রণীত হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার (১৯৫৪) ১৯ তম দফার ভিত্তিতে 1 ফলে কর্মসূচি হিসেবে স্বায়ত্তশানের দাবি উত্থাপনের এই পদক্ষেপের মধ্যে নতুন বা বৈচিত্র্যের কোনো উপাদান ছিল না। কিন্তু এমন এক সময়ে ৬ দফা উপস্থাপিত হয়েছিল, যখন যুদ্ধে পরাজয় এবং তাসখন্ত চুক্তির মাধ্যমে ভারতের হাতে 'জাতীয় স্বার্থ ও সম্মান' তুলে দেয়ার অভিযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকরা আইয়ুব- বিরোধী জোর প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ দফাকে আইয়ুব খান আত্মরক্ষার অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। পরিণামে শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেফতারবরণ করতে হয়েছিল। গ্রেফতার, জামিন এবং আবারও গ্রেফতারের ধারায় শেষ পর্যন্ত তিনি প্রতিরক্ষা আইনের অধীনে দীর্ঘকালের জন্য বন্দী হয়ে পড়েছিলেন (৯ মে, ১৯৬৬)। আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য অন্য নেতাদেরও আটক করা হয়েছিল। গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ঢাকায় পালিত হরতালের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন অর্জন এবং আন্দোলনে তাদের টেনে আনার প্রচেষ্টায় ব্যর্থতা ছিল সেদিনের এই পরিণতির প্রধান কারণ ।

৬ দফা আন্দোলনের এই ব্যর্থতা নানা দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছিল। ৬ দফার প্রশ্নে দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। 'পিডিএমপন্থী' এবং '৬ দফাপন্থী' নাম নিয়ে দুটি আওয়ামী লীগ তৎপরতা চালাতে শুরু করেছিল। ন্যাপেও ভাঙন ঘটেছিল ৬ দফার প্রশ্নে। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ৬ দফা সমর্থন করেনি, বিকল্প কর্মসূচি হিসেবে হাজির করেছিল ১৪ দফা (৪-৭ জুন, ১৯৬৬)। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের খান আবদুল ওয়ালী খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে দলে ভাঙন ঘটিয়ে গঠন করা হয়েছিল 'মস্কোপন্থী' ন্যাপ (১৬-১৭ ডিসেম্বর, ১৯৬৭)। এই ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তানী নেতারা ৬ দফাকে 'জাতির মুক্তি সনদ' হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর এই ভাঙন এবং দুর্বলতার পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নকে দৃঢ়তর করার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপরও বেশি নির্যাতন চালাতে শুরু করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি তাকে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'র প্রধান আসামী হিসেবে জড়িত করা হয়েছিল। সে পরিস্থিতিতেও আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। অনেকটা গোপনে অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে অভিযুক্ত শেখ মুজিবকে 'আত্মপক্ষ সমর্থনের উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানপূর্বক প্রকাশ্যে বিচার অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের প্রতি 'আবেদন' জানানো হয়েছিল (২১ জানুয়ারি, ১৯৬৮)। আওয়ামী লীগ তখন এমনকি ষড়যন্ত্র মামলাটিকে মিথ্যা বা সাজানো মামলা হিসেবে অভিহিত করার মতো অবস্থায়ও ছিল না। '৬৮ সাল জুড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলেছে, শুনানির বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, যার ভিত্তিতে বলা যাবে, '৬ দফাপন্থী' আওয়ামী লীগ মামলাটির বিরুদ্ধে কোনো মিছিল বা সমাবেশ করেছিল। ঢাকায় তো বটেই, প্রদেশের অন্য কোথায়ও দলটির তৎপরতা দেখা যায়নি। অনেকস্থানে আওয়ামী লীগের নেতারা এমনকি দলের অফিসে যাতায়াতও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখানে কৌতূহলোদ্দীপক একটি তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। তথ্যটি হলো, শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং 'পিডিএমপন্থী' আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান কৌসুলী বা আইনজীবী হিসেবে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন ।

৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের শুধু নয়, সব মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থাও সে সময় শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। প্রতিবাদহীন রাজনৈতিক স্থবিরতার সেই দিনগুলোতে আইয়ুব বিরোধী সফল আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে বিভিন্ন ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান স্বায়ত্তশাসনের জন্য দাবির বিরোধিতা এবং প্রয়োজনে 'অস্ত্রের ভাষা' প্রয়োগের হুমকি উচ্চারণ করেছিলেন। ৫ ডিসেম্বর ঢাকার 'রমনা গ্রীন'-এর সমাবেশে আইয়ুব খান চ্যালেঞ্জের সুরে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, আন্দোলন বা বিক্ষোভের পথে তাকে যা তার সরকারকে টলানো যাবে না । প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এসব উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদে 'জুলম প্রতিরোধ দিবস' পালন শেষে ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়োজিত বিশাল জনসভা থেকে মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন (৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৮)। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ উত্থাপিত বিভিন্ন দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে খাজনা-ট্যাক্স দেয়া বন্ধ করা হবে জানিয়ে মওলানা ভাসানী তাঁর বিখ্যাত 'ঘেরাও আন্দোলন'-এর কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন ।

ঘেরাও আন্দোলনের সূচনাও ঘটেছিল সেদিনই। পল্টন ময়দান থেকে জনসভার মানুষকে মাওলানা ভাসানী নিয়ে গিয়েছিলেন গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করতে। ঘেরাওকারী জনতার ওপর পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জসহ প্রচণ্ড নির্যাতন চালায় এবং এর প্রতিবাদে পরদিন, ১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী ঢাকায় হরতাল আহ্বান করেন। এই হরতাল পালনকালে পুলিশের গুলিতে দু'জন শহীদ এবং ১৬ জন আহত হওয়ায় ৮ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করেন। সে হরতালও সফলভাবে পালিত হয়। মওলানা ভাসানী ১৪৪ ধারা অমান্য করে বায়ুতুল মোকাররম প্রাঙ্গণে লক্ষাধিক মানুষকে নিয়ে শহীদদের গায়েবানা জানাজার নামাজে ইমামতি করেছিলেন ।

মাওলানা ভাসানীর ঘেরাও আন্দোলন অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানের সব অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল । মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সূচিত সফল এই ঘেরাও আন্দোলন প্রদেশের বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত ছাত্র সমাজকেও ঐক্যবদ্ধ হতে প্রেরণা যুগিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর সমন্বয়ে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত 'ছাত্র সংগ্রাম কমিটি'র পক্ষ থেকে ১৪ জানুয়ারি ঘোষিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ১১ দফা। ছাত্র সমাজের কর্মসূচি হলেও ১১ দফার মধ্যে শ্রমিক-কৃষকসহ সকল শ্রেণীর মানুষের দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সেই সাথে ছিল সংবিধান ও পররাষ্ট্রনীতিসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব। প্রথম দফায় শিক্ষা সংক্রান্ত ১৭টি দাবি উল্লেখ করার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা দুটিতে শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল।

সকল শ্রেণীর মানুষের কর্মসূচি হওয়ায় ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থান ঘটতে থাকে এবং ভাসানীপন্থী ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান, স্কুল ছাত্র মতিউর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর ড. শামসুজ্জোহাসহ শতাধিক সংগ্রামীর মৃত্যু মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে আইয়ুব সরকারের ভিত্তিকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেয়। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে সর্বত্র মানুষ ঘেরাও-মিছিল ও ভাঙচুরের মতো কর্মকান্ডের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিতে এগিয়ে আসতে থাকে। ওই দিনগুলোতে গ্রামে গ্রামে মানুষ বিডি মেম্বারদের ঘেরাও করেছে । আইয়ুবের দালাল হিসেবে পরিচিত বিডি মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে । অনেক এলাকায় তহশিল অফিসও পুড়িয়ে দিয়েছে তারা। মানুষ একই সঙ্গে খাজনা-ট্যাক্স দেয়াও বন্ধ করেছিল ।

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ১১ দফার সমর্থনে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও আন্তরিক ভূমিকা পালন করেছিলেন মাওলানা ভাসানী। বিরামহীন সফর, ভাষণ এবং ঘেরাও মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার মাধমে তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলেন । অভ্যুত্থান ব্যাপক হয়ে ওঠার সাথে সাথে ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগও অংশ নিয়েছিল। কিন্তু দলটির অংশগ্রহণ এবং ১১ দফার প্রতি সমর্থন সর্বাত্মক বা প্রশ্নাতীত হতে পারেনি। এর কারণ, ১১ দফা ঘোষিত হওয়ার পরপর '৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক অন্য সাতটি দলের সঙ্গে আট দলীয় জোট 'ড্যাক' বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিল। ড্যাক-এর আট দফা কর্মসূচিতে সেকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি স্বায়ত্তশাসন শব্দটি পর্যন্ত ছিল না, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের মতো দাবিও অনুপস্থিত ছিল। তাছাড়া দুই পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাশাপাশি শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করা হয়েছিল (ঙ) তথা পঞ্চম পঞ্চম দফায়। উল্লেখ্য, ড্যাক-এর শরিক দলগুলো ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলাম পার্টি, পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ, এনডিএফ এবং জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। পশ্চিম পাকিস্তানের ধুরন্ধর রাজনীতিক এবং শেখ মুজিব বিরোধী পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানকে ড্যাক-এর আহ্বায়ক বানানো হয়েছিল।

গণঅভ্যুত্থানের প্রচণ্ডতায় বিপন্ন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আত্মরক্ষার কৌশল থেকে ড্যাক-এর শরণাপন্ন হয়েছিলেন, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তিনি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ১ ফেব্রুয়ারি। ড্যাক-এর পক্ষ থেকে অনুকূল সাড়া এসেছিল তাৎক্ষণিকভাবে, বন্দী নেতা শেখ মুজিবও প্যারোলে বৈঠকে যোগ দিতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী তাকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র- জনতা । আইয়ুবের প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মওলানা ভাসানীও 1 গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকে তিনি 'আত্মহত্যার শামিল' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় মওলানা ভাসানী ‘চরমপত্র' উচ্চারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, 'প্রয়োজন হলে ফরাসী বিপ্লবের মতো ক্যান্টনমেন্টে ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করা হবে।' মওলানা ভাসানীর এই ঘোষণায় গণঅভ্যুত্থান আরো বেগবান ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র- জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে। হতাহত হয় অজানা সংখ্যক আন্দোলনকারী । ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার কারফিউ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় । গণঅভ্যুত্থানের প্রচন্ড চাপে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন, শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তরা এবং সেই সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক নেতারাও মুক্তি পান ।

কিন্তু শেখ মুজিব মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই নিশ্চিত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান বিভ্রান্ত এবং স্তিমিত হতে শুরু করেছিল। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার উদ্দেশে 'নিশ্চিন্ত থাকার উপদেশ দিয়ে মুক্তি লাভের চারদিনের মধ্যেই শেখ মুজিব আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন ( ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯) । সেখানে তিনি ভাষণ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন আরো পরে- ১০ মার্চ । এই ভাষণে ১১ দফার কথা উচ্চারণ করলেও শেখ মুজিব তার মূল বক্তব্য এবং বিভিন্ন প্রস্তাব উপস্থিত করেছিলেন নিজের বিস্মৃতপ্রায় কর্মসূচি ৬ দফার ভিত্তিতে। গোলটেবিল চলাকালে শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্তি দিয়ে গোপন সমঝোতারও প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু একদিকে মওলানা ভাসানীর তীব্র বিরোধিতা এবং অন্যদিকে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে চলমান প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থানের চাপে এই সমঝোতা চেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায়। সংসদীয় সরকার পদ্ধতি ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেষরক্ষা করতে ব্যর্থ হন। সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয়, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবর্তিত হয় সামরিক শাসন (২৫ মার্চ, ১৯৬৯)।

আইয়ুব সরকারের পতন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ও সংসদীয় সরকার পদ্ধতির নীতিগত স্বীকৃতি আদায় ছিল ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ সাফল্য। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিপুল আত্মত্যাগ এবং অসম সাহসী সংগ্রাম সত্ত্বেও ১১ দফার তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মূল দাবিগুলোর কোনো একটিও অর্জিত হয়নি। আইয়ুব সরকারের দমন-পীড়ন ও হত্যা এবং পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিকে রাজনীতিকদের অন্তর্ঘাতী তৎপরতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনবিমুখ নীতি ও কার্যক্রম ছিল মহান সে গণঅভ্যুত্থানের ব্যর্থতার প্রধান কারণ। এদেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শেষদিকে আন্দোলন আবর্তিত হয়েছিল প্রধানত শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিকে কেন্দ্র করে। ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা ছিল, মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিব তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিব ছাত্র-জনতাকে নিরাশ ও বিভ্রান্ত করেছিলেন। কারণ, পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সরকারের পতন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হলেও গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব অংশ নেয়ায় আইয়ুব খান তখনকার মতো বেঁচে গিয়েছিলেন ।

পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে, নিজেকে রক্ষার এবং গণঅভ্যুত্থানকে বিভ্রান্ত ও নস্যাৎ করার কৌশল হিসেবেই আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করেছিলেন। একই কারণে মওলানা ভাসানী নিজেই শুধু বর্জন করেননি, শেখ মুজিবকেও বৈঠকে অংশ না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য যেহেতু কোনো গোলটেবিল বৈঠকের প্রয়োজন পড়েনি, সেহেতু স্বায়ত্তশাসনসহ ১১ দফার বাকি দাবিগুলোও আন্দোলনের মাধ্যমেই আদায় করা

যাবে। এটা যুক্তিরও কথা ছিল। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর পরামর্শ উপেক্ষা, করে শেখ মুজিব ২৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ফাঁদে পা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় আইয়ুব খানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কৌশলই সফল হয়েছিল। ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবের দিকে আশায় তাকিয়ে থাকায় এবং মাঝখানে ঈদুল আযহার ছুটি পড়ে যাওয়ায় গণঅভ্যুত্থান স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সরে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবর্তিত হয়েছিল সামরিক শাসন (২৫ মার্চ, ১৯৬৯)। সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন ।

জনপ্রিয়তার প্রভাব ব্যবহার করে নিজের বিস্মৃতপ্রায় কর্মসূচি ৬ দফাকে পুনর্বাসিত করার পথেও শেখ মুজিব জনগণকে নিরাশ করেছিলেন । ১৯৬৬ সালের জুন আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির সময়কাল তথা ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জনগণের নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতার কারণে কেবল নয়, ৬ দফা বিরোধী আওয়ামী লীগ প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বাধীন ড্যাক-এ আওয়ামী লীগের যোগদানের অবমাননাকর ঘটনার মধ্য দিয়েও ৬ দফার বর্থতা ও এর প্রতি জনগণের সমর্থনহীনতার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। তারপরও শেখ মুজিব তার ৬ দফাকেই তুলে এনেছিলেন। কারণ, ১১ দফার মধ্যে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতী জনতার মুক্তির লক্ষ্যাভিসারী সঠিক কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। শেখ মুজিবের পক্ষে ১১ দফার মতো প্রগতিশীল কর্মসূচি সমর্থন ও গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না । আসলে জনগণের মুক্তি অর্জনের মৌলিক প্রশ্নেই শেখ মুজিবের দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতি ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ। সেই সাথে ছিল নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষাও । না হলে ১১ দফাকে নিয়েই তিনি এগিয়ে যেতেন। কেননা, এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা দুটি মূলত তার ৬ দফার আলোকে প্রণীত হয়েছিল । কিন্তু উচিত হলেও তিনি তা করেননি। বরং কিছুদিন পর্যন্ত ১১ দফা ও ৬ দফা' বলার পর ধীরে ধীরে গোটা ১১ দফাকেই তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন, ধরে রেখেছিলেন নিজের ৬ দফাকে। নির্বাচনী কর্মসূচিও তিনি ৬ দফাকেই বানিয়েছিলেন। জনপ্রিয়তার প্রভাব খাটিয়ে এমন এক প্রচারণাকেও শক্তিশালী করেছেন যেন '৬৯- এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ৬ দফার ভিত্তিতেই! যেন ১১ দফা কোনো বিষয় ছিল না! আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো, এত বছর পরও অমন প্রচারণাই চালানো হয় ৷

অন্যদিকে তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এ ধরনের দাবি ও প্রচারণাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয় না। যে কেউ ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে জানার জন্য সে সময়ের পত্রপত্রিকা পড়ে দেখতে পারেন। দেখবেন, আইয়ুবের পতন ঘটেছিল আসলে অসামরিক প্রশাসন ভেঙে পড়ায় । মওলানা ভাসানীর আহবানে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠেছিল। বিডি মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের মানুষ ঘেরাও করেছে, অনেককে গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে পিটিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। একযোগে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তহশিল অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে। অবস্থা বেগতিক দেখে বিডি মেম্বার ও চেয়ারম্যানরা দলে দলে পদত্যাগ করেছেন। শেষদিকে পুলিশও সরকারের সব আদেশ মানতে চায়নি। সবকিছুর পেছনে ছিল মওলানা ভাসানীর ভূমিকা। তাঁর সে ভূমিকার জন্য বিশ্বের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক 'টাইম' ম্যাগাজিন মওলানা ভাসানীকে 'প্রোফেট অব ভায়োলেন্স' আখ্যা দিয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের সময় মওলানা ভাসানীকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করেছিল। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লেখা আইয়ুব খানের চিঠির মধ্যেও এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে । এতে আইয়ুব খান প্রধানত প্রশাসন ভেঙে পড়ার এবং অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কারণই জানিয়েছিলেন । (চিঠিটির জন্য দেখুন : অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫- ৭৫', পৃ. ৪৩০-৩৮) আইয়ুব খানের এ চিঠির ভিত্তিতে একথা অন্তত বলার সুযোগ নেই যে, গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার কারণে তাকে সরে যেতে হয়েছিল । বাস্তবে তাকে উৎখাত করেছিল '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ।

আলোচনার সমাপ্তিকালে বলা যায়, মাওলানা ভাসানী ছাড়া অন্য নেতাদের অসততা, ষড়যন্ত্র, দৃষ্টিভঙ্গি এবং গণবিরোধী অবস্থান ও ভূমিকার কারণে সম্পূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও জনগণের অংশগ্রহণের দৃষ্টিকোণ থেকে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সম্পূর্ণরূপেই বিজয় অর্জন করেছিল। সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হলেও মহান এ গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও প্রেরণা পরবর্তীকালেও জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং অনিবার্য করে তুলেছে ১৯৭১-এর স্বাধীনতাকে । বিশ্বে- ষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় হেসেবে চিহ্নিত করা যায়। সে গণঅভ্যুত্থানে প্রধান ভূমিকা ছিল মাওলানা ভাসানীর । [দৈনিক আমার দেশ-এর নিয়মিত কলাম 'অনুসরণ', ২৪ জানুয়ারি, ২০১৩ (আংশিক পরিবর্তিত)]

ঘেরাও করেছে, অনেককে গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে পিটিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। একযোগে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তহশিল অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে। অবস্থা বেগতিক দেখে বিডি মেম্বার ও চেয়ারম্যানরা দলে দলে পদত্যাগ করেছেন। শেষদিকে পুলিশও সরকারের সব আদেশ মানতে চায়নি। সবকিছুর পেছনে ছিল মওলানা ভাসানীর ভূমিকা। তাঁর সে ভূমিকার জন্য বিশ্বের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক 'টাইম' ম্যাগাজিন মওলানা ভাসানীকে 'প্রোফেট অব ভায়োলেন্স' আখ্যা দিয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের সময় মওলানা ভাসানীকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করেছিল। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লেখা আইয়ুব খানের চিঠির মধ্যেও এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে । এতে আইয়ুব খান প্রধানত প্রশাসন ভেঙে পড়ার এবং অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কারণই জানিয়েছিলেন । (চিঠিটির জন্য দেখুন : অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫- ৭৫', পৃ. ৪৩০-৩৮) আইয়ুব খানের এ চিঠির ভিত্তিতে একথা অন্তত বলার সুযোগ নেই যে, গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার কারণে তাকে সরে যেতে হয়েছিল । বাস্তবে তাকে উৎখাত করেছিল '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ।

আলোচনার সমাপ্তিকালে বলা যায়, মাওলানা ভাসানী ছাড়া অন্য নেতাদের অসততা, ষড়যন্ত্র, দৃষ্টিভঙ্গি এবং গণবিরোধী অবস্থান ও ভূমিকার কারণে সম্পূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও জনগণের অংশগ্রহণের দৃষ্টিকোণ থেকে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সম্পূর্ণরূপেই বিজয় অর্জন করেছিল। সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হলেও মহান এ গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও প্রেরণা পরবর্তীকালেও জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং অনিবার্য করে তুলেছে ১৯৭১-এর স্বাধীনতাকে । বিশ্বে- ষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় হেসেবে চিহ্নিত করা যায়। সে গণঅভ্যুত্থানে প্রধান ভূমিকা ছিল মাওলানা ভাসানীর । [দৈনিক আমার দেশ-এর নিয়মিত কলাম 'অনুসরণ', ২৪ জানুয়ারি, ২০১৩ (আংশিক পরিবর্তিত)]।

স্বাধীনতা সংগ্রামে মাওলানা ভাসানীর ভূমিকা

পশ্চিম পাকিস্তানের বিজাতীয় শাসন, শোষণ, নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জনের যে আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার প্রধান নির্মাতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর পূর্ব বাংলার প্রতি অবিচারের সূত্রপাত হলে প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে এবং পরবর্তীকালে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত আওয়ামী (মুসলিম) লীগের মাধ্যমে তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ক্রমাগত তীব্রতা দিয়েছিলেন। তাঁর সে আন্দোলন কতিপয় বৈশিষ্ট্যের কারণে ছিল উল্লেখযোগ্য । দেশরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রা ছাড়া বাকি সকল বিষয়ে পূর্ণ কৰ্তৃত্বসহ স্বায়ত্তশাসন চাইতেন তিনি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে- যেখানে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অধিকারের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, স্বায়ত্তশাসনের নামে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক- শোষকদের স্থলে বাঙালীদের প্রতিষ্ঠার মতো উগ্র-জাতীয়তাবাদী পথে কখনো যাননি। বরং সামন্তবাদ, বৃহৎ পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে সমন্বিত করে একযোগে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। কারণ, শোষণ এবং দুঃশাসনের কোনো একটি উৎসকেও অক্ষত রেখে অধিকার আদায় কিংবা ভোগ করতে চাওয়ার কোনো বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি থাকতে পারে না ।

‘আসসালামু আলাইকুম'
স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প হিসেবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালানো ছিল মাওলানা ভাসানীর আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বায়ত্তশাসনসহ প্রদেশের বিভিন্ন দাবি সংবলিত ২১ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে মাওলানা ভাসানী একজন প্রধান নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অবিভক্ত বাংলার দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী কৃষক- শ্রমিক পার্টির নেতা 'শেরে বাংলা' ফজলুল হক এবং আওয়ামী লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু নিরংকুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও মূলত নেতৃত্বের কোন্দলে স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল । মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের বদৌলতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনকি এ ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নাকি ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে! এ সময় থেকেই মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার প্রচারণাকে প্রকাশ্য করেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন এবং ১৯৫৬ সালের ৭ ও ১৫ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত তিনটি পৃথক জনসমাবেশে তিনি শাসনতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দাবি করে বলেছিলেন, না হলে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্নতা তথা স্বাধীনতার কথা চিন্তা করতে হবে। উল্লেখ্য, সেকালে সংবিধানকে 'শাসনতন্ত্র' বলা হতো ।

স্বায়ত্তশাসনের বিধানবিহীন ১৯৫৬-র শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধেও আন্দোলনকে তিনি এগিয়ে নিয়েছিলেন। সে আন্দোলন প্রচণ্ডতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর (১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬)। রচনাকালে স্বায়ত্তশাসনের বিধান না থাকায় যে শাসনতন্ত্রকে সোহরাওয়ার্দী প্রত্যাখ্যান করে পরিষদের অধিবেশন বর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সে একই শাসনতন্ত্রকে তিনি “শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন' দেয়ার উৎস হিসেবে প্রশংসা করতে শুরু করেন। ফলে মওলানা ভাসানী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রধানত স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি মীমাংসার প্রয়োজনে তিনি ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করেছিলেন ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন। সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিকার এবং পূর্ব বাংলার জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেয়ার দাবি জানিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেছিলেন, না হলে ভবিষ্যতে, আজ থেকে দশ বছর পর, এমন সময় আসতে পারে যখন পূর্ব বাংলা পাকিস্তানকে “আসসালামু আলাইকুম' জানানোর প্রবণতা অনুভব করবে। 'আসসালামু 'আলাইকুম'-এর ঘোষণা সে সময় সাধারণ ছিল না বরং ছিল অত্যন্ত গুরুতর । কারণ, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগই তখন কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল : প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এদিকে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য নেতারা। তাদের প্রত্যেকেই সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম' জানানোয় মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীর বিভিন্ন জনসভায় এমনকি সশস্ত্র হামলাও চালানো হয়েছিল। পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তাঁর নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন একটি দল গঠন করেছিলেন (২৫জুলাই, ১৯৫৭)।

'আসসালামু আলাইকুম' জানালেও মওলানা ভাসানী সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানাননি। এর কারণ, শোষণ নির্যাতনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও তখনও পর্যন্ত তা এমন প্রকট আকার নেয়নি যখন মানুষ স্বাধীনতার বিকল্পের কথা ভাববে। পাশাপাশি তাদের মনে তখনও ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের সদ্যার্জিত সাফল্যের আনন্দ, ছিল ইংরেজদের চাইতেও প্রত্যক্ষ শোষক 'হিন্দু' জমিদার- মহারাজাদের শোষণ-নিপীড়নের তাজা স্মৃতি। এজন্যই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা


বা স্বাধীনতার চিন্তা তখনও জনমনে 'হিন্দু' ভারতে ফিরে যাওয়ার ভীতি-আতংকের কারণ হয়ে উঠতো। ওদিকে বাঙালী ধনিক-বুর্জোয়ারাও ছিল অত্যন্ত দুর্বল এবং সংখ্যায় স্বল্প, পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজির সবল প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় তখনও তারা পৌঁছাতে পারেনি। তাছাড়া চরিত্রের কারণেও তারা মওলানা ভাসানীর পেছনে সমবেত হয়নি। কারণ, তাঁর আন্দোলন ছিল শ্রমিক- কৃষক-মেহনতী জনতার স্বার্থে। তিনি চাইতেন সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত নিয়ন্ত্রিত বুর্জোয়া বিকাশ, শিল্প-কারখানার আড়ালে ধনিক শ্রেণীর শোষণ নয় ।

অর্থাৎ বাঙালী বুর্জোয়াসহ জনগণের কোনো একটি অংশই সে সময় স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো চূড়ান্ত পরিণতির জন্য তৈরি ছিল না, মওলানা ভাসানীও তাই আহ্বানকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে। তথাপি 'আসসালামু আলাইকুম'-এর পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ ও নিজামে ইসলাম থেকে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীসহ আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত বাঙালী বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা ভাসানী বিরোধী ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন। তাদের এই তাৎক্ষণিক আঁতাত আয়োজন বাঙালীদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, কি জন্য ও কারা তাদের বিপক্ষ শক্তি এবং কাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া এমনকি স্বায়ত্তশাসনের অধিকারটুকুও অর্জন করা সম্ভব নয়। পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত অধিবাসীদের জাগৃতির লক্ষ্যে এখানেই ছিল মওলানা ভাসানীর 'আসসালামু আলাইকুম'-এ ['-এর সার্থকতা ।

পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনঃ '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান

এরপর দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে না বললেও মওলানা ভাসানী তাঁর স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন সর্বতোভাবে । ১৯৬৬ সালের জুনে তাঁর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষ থেকে উপস্থাপিত ১৪ দফা ছিল এই লক্ষ্যে এক প্রগতিশীল কর্মসূচি। চীন-রাশিয়ার মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাপের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও বিভক্তি তাঁর আন্দোলনকে স্তিমিত করলেও তিনি লক্ষ্যচ্যুত হননি। বরং ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে 'ঘেরাও' আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সূচনা করেছিলেন জঙ্গী এবং বলিষ্ঠ সংগ্রামের। ছাত্র সমাজের ১১-দফা আন্দোলনের সঙ্গে সর্বাত্মক একাত্মতাও ছিল মওলানা ভাসানীর এক বিরাট অবদান। অগ্নিঝরা সেই দিনগুলোতে প্রধানত তাঁর আপোসহীন ও বিরোচিত ভূমিকাই সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতনকে অনিবার্য করে তুলেছিল। বাঙালী ধনিক-বুর্জোয়াদের বিপুল অর্থ ব্যয়, সাম্রাজ্যবাদের আড়াল আনুকূল্য এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতার লোভ পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার মুখে অসহায় করে ফেললেও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মওলানা ভাসানী পরিস্থিতিকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন, যখন সমগ্র পূর্ব বাংলা রুখে দাঁড়িয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক-শোষক এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে । মুখোমুখি সে অবস্থান থেকে জনগণকে ফিরিয়ে আনা আর কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানকেন্দিক মোহ ভাঙনের যে প্রক্রিয়া তিনি ১৯৫০-এর দশকে শুরু করেছিলেন ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান তাকে পরিপক্ক করেছিল। এ ছিল সরাসরি পাকিস্তান-বিরোধী উত্থান ।

১৯৭০-এর জলোচ্ছ্বাস ও স্বাধীনতার প্রথম আহ্বান

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও প্রবল জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে দশ লক্ষাধিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। বেঁচে যাওয়া নরনারীর পুনর্বাসন, নিহতদের দাফন- সৎকার এবং দুর্গত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের আমর্জনীয় অবহেলা আর উদাসীনতা সাধারণ মানুষের মনে প্রচন্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি করে। দায়সারা সংক্ষিপ্ত সফর ছাড়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কিছু করেননি, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কোনো মন্ত্রীও দুর্গত এলাকায় আসেননি। সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলো এমনকি ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত তথ্যও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো ত্রাণ সামগ্রী ফেলে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন, বিতরণের ক্ষেত্রেও ছিল কারচুপি এবং অনিয়ম। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত পাকিস্তানের শাসকদের সে অবহেলা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। এই আচরণের মধ্য দিয়ে শেষবারের মতো বাঙালীদের প্রতি তাদের প্রকৃত মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল । তারা বুঝিয়ে ছেড়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানীরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে কত অবজ্ঞার চোখে দেখতো ।

পূর্ব পাকিস্তানের তথা পূর্ব বাংলার জনগণের সেই কঠিন দুঃসময়ে আশা, আশ্বাস আর ভরসার বাণীমুখে এগিয়ে এসেছিলেন মওলানা ভাসানী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালের বিছানা থেকে ছুটে গিয়েছিলেন উপদ্রুত এলাকা সফরে । মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, সরকারের অবহেলা আর পরিস্থিতির ভয়াবহতা তাঁকে গভীর বেদনা আর বিক্ষোভে প্রচণ্ডভাবে আন্দোলিত করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের আমনবিক অবহেলা এবং অবজ্ঞার প্রতিবাদে উপদ্রুত উপকূলীয় এলাকা থেকে ঢাকায় ফিরেই তিনি করেছিলেন সরাসরি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। ৩০ নভেম্বর এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি 'পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ার' আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “আজ আমি পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি বাঙালীকে তাহাদের জীবন-মরণ প্রশ্নের বিষয়টি পুনর্বার এবং শেষবারের মত দলমত নির্বিশেষে ভাবিয়া দেখিতে আকুল আবেদন জানাইতেছি।... ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট হইতে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানীদের আজাদীর লড়াই নতুনতম এবং শেষ পর্যায়ের রূপ লাভ করিবার অপেক্ষায় আছে মাত্র।... দুই যুগ ধরিয়া বৈষম্য আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করিবার প্রচার ও প্রচেষ্টা চলিতেছে তাহারই সফল সংগ্রামী রূপায়নে আমাদের জীবনের বিনিময়ে হইলেও ঝাঁপাইয়া পড়িতে হইবে। আজ হইতে ১৩ বৎসর পূর্বেই ষড়যন্ত্র অত্যাচার শোষণ আর বিশ্বাসঘাতকতার নাগপাশ হইতে মুক্তিলাভের জন্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে 'আসসালামু আলাইকুম' বলিয়াছিলাম... আজ আশা করি সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোন বাঙালীকে বুঝাইতে হইবে না যে, মানবতাবর্জিত সম্পর্কের মহড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠিয়াছে ।...

“... আমি ভাষায় প্রকাশ করিতে পারি না যে, আমাদের এহেন দুর্দিনে সরকার কি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করিয়াছে।... পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার ও টেলিভিশন ১২ লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানিতে কিরূপ বিশ্বাসঘাতকতা ও ক্ষমাহীন ধৃষ্ঠতার পরিচয় দিয়াছে তাহা আজ সাত কোটি বাঙালীকে ভাবিয়া দেখিতে হইবে।... তাহাদের আহলাদ মাখা অনুষ্ঠানের কমতি হয় নাই; বার লক্ষাধিক রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয় নাই। লক্ষ লক্ষ লাশের দাফন-কাফনের কর্তব্যের কথা স্বীকার করা হয় নাই। এর চেয়ে আফসোসের বিষয় আর কি হইতে
পারে ?

“আজ তাই আমাদের সম্মুখে কর্মসূচি পরিষ্কার হইয়া উছিয়াছে । ... অনেক ত্যাগ স্বীকার করিয়াছি, অনেক কোরবানী দিয়াছি। আজ আমাদের হাতে যাহাই অবশিষ্ট আছে সবকিছুই উৎসর্গ করিয়া সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িতে হইবে। এই সংগ্রাম ভাষণ-বিবৃতির নয়- প্রত্যক্ষ মোকাবেলার। এই মোকাবেলা আপোষ নিষ্পত্তিকল্পে চাপ সৃষ্টি করার সংগ্রাম নয়, পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি শোষিত নির্যাতিত বাঙালীর মুক্তিসংগ্রাম। দলমত নির্বিশেষে আজ সবাই আসুন, আমরা এক ও অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করি ।...

“এইদিন আপনারা আওয়াজ তুলুন: পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে এবং আমাদের আজাদী রক্ষা করিতে আমরা সর্বস্ব কোরবানী দিতে সদা প্রস্তুত। সেই সাথে আপনারা বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলুন: আমরা স্বাবলম্বী অত্মনির্ভরশীল এবং শৃঙ্খলমুক্ত হইতে চাই ।...”

প্রচারপত্রের শেষাংশে মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন, 'আমি বিশ্বাস করি, মানবতার নামে আজাদীর লড়াইয়ে আমাদের সাফল্য অনিবার্য ।.... বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামকে রুখিতে পারে পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নাই । সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।'

উল্লেখ্য, পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের দুর্দশা আর অবমাননার সে দুঃসহ দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইনের 'আইনগত কাঠামো আদেশের অধীনে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। স্বাধীনতা দূরে থাকুক, তিনি এমনকি ঘূর্ণিঝড় ও প্রবল জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোরও উদ্যোগ নেননি। সরকারের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেননি। শেখ মুজিব বরং জলোচ্ছ্বাসের কারণে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ


করেছিলেন। ২৬ নভেম্বরের সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেছিলেন, প্রয়োজনে আরো কয়েক লক্ষ জীবন দেয়া হবে তবু নির্বাচন পেছাতে দেয়া হবে না । (ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ, ২৭ নভেম্বর, ১৯৭০)

'ওরা কেউ আসেনি'

অন্যদিকে মাওলানা ভাসানী আগেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলার প্রতি অবহেলা দেখানোর প্রতিবাদে ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি 'প্রতিবাদ দিবস' পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওইদিন পল্টন ময়ানের বিশাল সমাবেশে তিনি প্রকাশ্যে প্রথমবারের মতো পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। তারও আগে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১২ লাখ মানুষের করুণ মৃত্যু এবং সরকারের অবহেলার বর্ণনা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সম্পর্কে বলেছিলেন, বাঙালীর এই ভীষণ দুর্দিনেও 'ওরা কেউ আসেনি'। এরপরই স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমাদের সংগ্রামের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হলে আরো পনেরো বিশ লাখ জীবন দিয়ে অভিষ্ট সিদ্ধি করবো, না হয় মৃত্যুবরণ করবো।' পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে পবিত্র কুরআনের সুরা 'কাফেরূন' থেকে আয়াত উদ্ধৃত করে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, 'লাকুম দীনুকুম ওয়া লিয়া দীন' (তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম)। অর্থাৎ তোমার রাস্তায় তুমি যাও, আমাকে আমার রাস্তায় চলতে দাও। এটা ছিল সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা। তিনি তাঁর স্বাধীনতার দাবি ও সংগ্রামকে আইনসঙ্গত বলেও বর্ণনা করেছিলেন। শেখ মুজিবের প্রতি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়ারগ আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে যারা কোটি কোটি টাকা নির্বাচনী ব্যয় করছে তাদের ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না। তারা নিজেরাই বলুন যে, তারা জনতার শত্রু না মিত্র।' [সাপ্তাহিক মাতৃভূমি, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭০] এই ঘোষণার ভিত্তিতেই মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন বর্জন করেছিল। প্রমাণিত হয়েছে, ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলেই আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরংকুশ বিজয় অর্জন করা এবং শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান নেতায় পরিণত হওয়া সম্ভব হয়েছিল।

স্বাধীনতার পাঁচ দফা কর্মসূচি

নির্বাচনের পর মওলানা ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামের পন্থা ও কর্মসূচি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ৯ জানুয়ারি সন্তোষে এক সম্মেলন আহ্বান করেন । এ উপলক্ষে ৭ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে তিনি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক আন্দোলনের পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। কর্মসূচি পাঁচটি ছিল :


১. স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলা গঠনের প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবিতে জোর গণআন্দোলন গড়ে তোলা;
২. স্বাধীনতার ভিত্তি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি এবং স্বাধীনতার সত্যিকার ফলভোগের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই যে একমাত্র পথ- একথা গ্রামে গ্রামে প্রচার করা;
৩. পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিদেশী পণ্য, ব্যাংক ও বীমা বর্জন এবং পাশাপাশি পূর্ব বাংলার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকে উৎসাহ দান;
৪. বিগত ২৩ বছরে পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক-শোষকদের শোষণ ও বঞ্চনার সঠিক চিত্র ৬২ হাজার গ্রামের অধিবাসীদের সামনে তুলে ধরা; এবং
৫. বাঙালীর দরদী সেজে যারা জনপ্রিয় বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে পরে বিশ্বাসঘাতকতার পথে জনতার মুক্তি সংগ্রামকে অঙ্কুরেই নস্যাৎ করে তাদের ধ্বংস করার জন্য সংগ্রাম শুরু করা। ('ভাসানীর পাঁচ দফা', দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ জানুয়ারি, ১৯৭১)

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীনতা দাবি

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ স্থগিত ঘোষণা করলে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে । প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ৩ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন অর্ধ-দিবস হরতালের কর্মসূচি উপস্থিত করেন। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বানমুখে তৎপর হয়ে ওঠেন। ৪ মার্চ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, 'সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদীদের পরামর্শে যদি ৭ কোটি বাঙালীর এই দাবিকে উপেক্ষা করা হয় তবে বাংলাদেশের ৬২ হাজার গ্রামে জাতি-ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর বাঙালী যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে দাবি প্রতিষ্ঠা করবে।'

বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী আরো বলেন, '১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন সরকার শান্তি-শৃংখলার নামে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। পাকিস্তানের সংহতি ও ইসলামের নামে জনগণকে ভাওতা দিয়েছে । সরকার পুনরায় যেভাবে গণহত্যা ও বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে শুরু করেছে তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। পূর্ব বাংলার শতকরা ৮৫ জন মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত হয়ে বাঙালী আজ মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত । এমতাবস্থায় পাকিস্তানের জন্ম যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে, সরকার যদি তার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার ৭ কোটি বাঙালীকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভোগ করতে বাধা দেয় তাহলে বাঙালীরা শুধু সভা- সমিতির দ্বারাই এর প্রতিবাদ করে বসে থাকবে না।' মওলানা ভাসানী বলেন, তিনি তাঁর ৮৯ বছরের জীবনে এবারের মতো গণজাগরণ এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভ দেখেননি। তিনি বলেন, 'পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও শোষকগোষ্ঠী এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে কোন প্রকার আপোস করতে আর বাংলার জনগণ ইচ্ছুক নয়। কারণ এই গণদুশমনরাই গত ২৩ বছরে সোনার বাংলাকে শোষণ করে শ্মশানে পরিণত করেছে। সরকার ও সাম্রাজ্যবাদের সাথে যে কোনো দল বা ব্যক্তির আপোস চেষ্টার বিরুদ্ধেও তিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। স্বতঃস্ফূর্ত এই নজিরবিহীন জাগরণ এবং ঐক্যের জন্য মওলানা ভাসানী জনগণকেও মোবারকবাদ তথা অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। (দৈনিক পাকিস্তান, ৫ মার্চ ১৯৭১)

স্বাধীনতার জন্য আমরণ সংগ্রামের ডাক

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল সমাবেশে 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' বললেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক আইন প্রত্যাহার করে 'জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর' করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি দাবি জানিয়েছিলেন। 'ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার আহ্বানের পাশাপাশি তিনি 'অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের' কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন । অন্যদিকে ৯ মার্চ মওলানা ভাসানী এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের কপট স্বাধীনতাকে সত্যিকারের স্বাধীনতায় রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার সাধারণ কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানান। মওলানা ভাসানী বলেন, 'আসুন আজ আমরা বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করি যে, পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক পূর্ণ ক্ষমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরণ সংগ্রাম করে যাব ।'

তিনি বলেন, 'জয় বাংলা রব তুলে নিপীড়িত কোটি কোটি বাঙালীর ভোট তথা সমর্থন নিয়ে সেই শক্তির বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক ও সামরিক শাসকদের সাথে হাত মিলিয়ে যেনতেন প্রকারেন একটা আপোষ এবং সমঝোতার সরকার গঠনপূর্বক বঞ্চিত বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণের দ্বিধাহীন ও দুর্বার আকাংক্ষাকে পুনর্বার বানচাল করার যে চক্রান্ত মুষ্টিমেয় বাঙালী শোষক ও তাদের হোতারা করে চলেছে সেই হীন ষড়যন্ত্রকে আমরা শতকরা ৯৫ জন শোষিত নিপীড়িত বাঙালী আঙ্কুরেই প্রতিহত ও বিনষ্ট করব।'

প্রচারপত্রের শেষ অংশে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, 'আসুন, আমরা শেষ ও চূড়ান্তবারের মত পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলনে একত্রিত হই এবং পশ্চিম পাকিস্তানী, সাম্রাজ্যবাদী ও মুষ্টিমেয় বাঙালী শোষকের শত বাধা-বিপত্তি ও আক্রমণকে প্রতিহত করে জয়যাত্রা শুরু করি । '

সেদিনই, ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ঢাকায় পল্টন ময়দানের এক বিশাল জনসমাবেশে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, '১৩ বছর আগে কাগমারী সম্মেলনে আমি আসসালামু আলাইকুম বলেছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানকে বলেছিলাম যে তোমরা তোমাদের শাসনতন্ত্র রচনা কর, আমরা অমাদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করি। আমি ৭ কোটি বাঙালীকে আজ মোবারকবাদ জানাই এজন্য যে, তারা এই বৃদ্ধের কথা এতদিন পর অনুধাবন করতে পেরেছে। শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।

পূর্ব বাংলার অসহায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণের নিন্দা করে মওলানা ভাসানী ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ, মুসলিম লীগ ও আইয়ুব খানের পতনের ইতিহাস বর্ণনা করে বলেছিলেন, এরা নিজেরাই নিজেদের পতন ডেকে এনেছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশে মওলানা ভাসানী আরো বলেছিলেন, “বৃটিশ জাতি বুদ্ধিমান ছিল। তাই তারা উপমহাদেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন হওয়ার মতো পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকেও তাই বলি, অনেক হয়েছে, তিক্ততা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। 'লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন' নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও।”

আপোস বা অহিংসার পথে নয়

মওলানা ভাসানী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, সাত কোটি বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এ প্রশ্নে কোনো প্রকার আপোসও আর সম্ভব নয়। আপোসের সময় চলে গেছে। শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানী বা অন্য কোনো নেতা যদি আপোস করতে চায় জনতা তাকে আস্ত রাখবে না ।

অহিংস আন্দোলন প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী বলেন, আমি কোনোদিন অহিংসায় বিশ্বাস করি না। রসূল (স.) অহিংসায় বিশ্বাস করতে বলেননি । জুলুমের প্রতিশোধ নিতে বলেছেন। জালিমের অত্যাচার যে সহ্য করে এবং যে অত্যচার করে তারা উভয়েই মহাপাপী । তিনি বলেন, অহিংসা অবাস্তব পন্থা ।

মওলানা ভাসানী ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, অন্যথায় মুজিবের সঙ্গে একযোগে বাঙালীর স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করা হবে। শেখ মুজিবকে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় চাইতে বাংলার সংগ্রামী বীর হওয়ার আহ্বান জানান ।

ভাসানীর ১৪ দফা, মুজিবের আপোস আলোচনা

পল্টন ময়দানের এই সমাবেশে স্বাধীনতার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৪-দফা কর্মসূচি উপাস্থাপিত করেছিলেন। এতে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সামাজিকীকরণ ও সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা; সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ বিরোধী কৃষক-শ্রমিকরাজ কায়েমের মাধ্যমে এবং ভাষা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। পূর্ব বাংলার সর্বত্র সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন, সকল প্রকার খাজনা-ট্যাক্স প্রদান বন্ধ, পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিদেশী পণ্য, ব্যাংক-বীমা বর্জন, পতিত কৃষি জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ, চোরাচালান ও কালোবাজারি বন্ধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং বিদেশী সৈন্য যাতে পূর্ব বাংলার মাটিতে আসতে না পারে সেজন্য চট্টগ্রাম ও খুলনার সমুদ্র বন্দরের প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেয়ার আহবান ছিল ১৪ দফার অন্তর্ভুক্ত । [দৈনিক পাকিস্তান, ১০ মার্চ ১৯৭১]

মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার আহ্বান সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চালাতে থাকেন। অন্যদিকে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা এবং একের পর এক নির্দেশনা জারি করতে থাকেন। ১৪ মার্চ ঘোষিত এরকম নির্দেশের সংখ্যা ছিল ৩৫ । ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্রমাগত জটিলতা সৃষ্টি করছিলেন। ১৫ মার্চ করাচীতে তিনি একথা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক সরকার পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । উদ্ভট এ যুক্তির ভিত্তিতেই তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে দুই অঞ্চলের ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানিয়েছিলেন।

অমন এক পরিস্থিতিতে ১৬ মার্চ ঢাকায় শুরু হয়েছিল মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক । বাঙালীর স্বাধীনতার প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে অনুষ্ঠিত সে আলোচনার তৃতীয় বৈঠকের পর ২০ মার্চ শেখ মুজিব বলেছিলেন, 'আলোচনা চালু রয়েছে এবং আমরা অগ্রসর হচ্ছি।' আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'আমি যখন বলি কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে তার থেকেই আপনারা বুঝতে পারেন।' অন্যদিকে ২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা করেছিলেন, 'সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।' শেখ মুজিবও একই সুরে কথা বলতে থাকেন । ২২ মার্চ ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টোর সঙ্গে সোয়া এক ঘণ্টা ধরে আলোচনার পর তিনি বলেছিলেন, 'যদি কোনো অগ্রগতি না হতো তাহলে আমি কেন আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি?'

আপোসের পথ পরিহার করো

এভাবে সমঝোতার জন্য আলোচনার পাশাপাশি শেখ মুজিবের মুখে অগ্রগতির দাবি স্বাধীনতার আকঙ্ক্ষায় উন্মুখ বাঙালীদের প্রতি মুহূর্তে বিভ্রান্ত করছিল, আন্দোলনের গতিবেগকে করছিল স্তিমিত। মওলানা ভাসানীই তখন একমাত্র দেশপ্রেমিক সংগ্রামী নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফরের মধ্য দিয়ে সে সময় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামকে তীব্রতা দিয়েছিলেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্ন আক্রমণে বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম সফরকালে ১৭ মার্চ

উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ বিরোধী কৃষক-শ্রমিকরাজ কায়েমের মাধ্যমে এবং ভাষা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। পূর্ব বাংলার সর্বত্র সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন, সকল প্রকার খাজনা-ট্যাক্স প্রদান বন্ধ, পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিদেশী পণ্য, ব্যাংক-বীমা বর্জন, পতিত কৃষি জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ, চোরাচালান ও কালোবাজারি বন্ধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং বিদেশী সৈন্য যাতে পূর্ব বাংলার মাটিতে আসতে না পারে সেজন্য চট্টগ্রাম ও খুলনার সমুদ্র বন্দরের প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেয়ার আহবান ছিল ১৪ দফার অন্তর্ভুক্ত । [দৈনিক পাকিস্তান, ১০ মার্চ ১৯৭১]

মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার আহ্বান সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চালাতে থাকেন। অন্যদিকে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা এবং একের পর এক নির্দেশনা জারি করতে থাকেন। ১৪ মার্চ ঘোষিত এরকম নির্দেশের সংখ্যা ছিল ৩৫ । ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্রমাগত জটিলতা সৃষ্টি করছিলেন। ১৫ মার্চ করাচীতে তিনি একথা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক সরকার পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । উদ্ভট এ যুক্তির ভিত্তিতেই তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে দুই অঞ্চলের ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানিয়েছিলেন।

অমন এক পরিস্থিতিতে ১৬ মার্চ ঢাকায় শুরু হয়েছিল মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক । বাঙালীর স্বাধীনতার প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে অনুষ্ঠিত সে আলোচনার তৃতীয় বৈঠকের পর ২০ মার্চ শেখ মুজিব বলেছিলেন, 'আলোচনা চালু রয়েছে এবং আমরা অগ্রসর হচ্ছি।' আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'আমি যখন বলি কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে তার থেকেই আপনারা বুঝতে পারেন।' অন্যদিকে ২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা করেছিলেন, 'সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।' শেখ মুজিবও একই সুরে কথা বলতে থাকেন । ২২ মার্চ ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টোর সঙ্গে সোয়া এক ঘণ্টা ধরে আলোচনার পর তিনি বলেছিলেন, 'যদি কোনো অগ্রগতি না হতো তাহলে আমি কেন আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি?'

তিনি বলেছিলেন, ইয়াহিয়া এবং মুজিবের মধ্যে আপোসের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না । তারা আপোস করতে চাইলেও সাত কোটি বাঙালী তা মেনে নেবে না। শেখ মুজিবের প্রতি তিনি আপোসের পথ পরিহার করে সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, স্বাধীনতার সর্বজনীন দাবিতে জনগণ যখন একতাবদ্ধ তখন মতাদর্শগত প্রশ্ন তোলা অনুচিত। তিনি বলেন, প্রথমে প্রধান ইস্যু তথা স্বাধীনতা সম্পর্কে মীমাংসা করতে হবে। পরে যদি দেখা যায় যে, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব হয়নি তখন তিনি আবার সংগ্রাম শুরু করবেন।

মওলানা ভাসানী আরো বলেছিলেন, 'প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখন সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাহীন। এখন সব ক্ষমতা জনসাধারণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনধিদের হাতে। ইয়াহিয়া এখন যা করতে পারেন তা হলো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন- যার কাজ হবে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সম্পদ ও দায়ের হিসাব করা এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে দুই অংশের মধ্যে সে সব বণ্টন করে দেয়া।'

মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যাণ্ড ও ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গ

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চকে মওলানা ভাসানী 'লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন দিবস' ঘোষণা করেছিলেন। সেদিন সন্তোষে তিনি পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে লাল পতাকা উত্তোলন করেন। সন্তোষে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশ তিনি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ডের সঙ্গে শেখ মুজিবের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের নিন্দা করে তিনি আলেচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করার জন্য শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন । মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় আপোস বা ষড়যন্ত্রের পথে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে নস্যাত কিংবা বিপথগামী করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন ।

ভারতে ভাসানীঃ স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা শুরু করলে মওলানা ভাসানী সন্তোষে এক স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে গ্রামে-গঞ্জে গেরিলা বাহিনী গঠন করে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করার এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান । ৩ এপ্রিল পাকবাহিনী তাঁর সন্তোষের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় তিনি ধলেশ্বরীর তীরে বিন্নাফের গ্রামে আশ্রয় নেন । ৫ এপ্রিল তিনি নৌকাযোগে ভারতের উদ্দেশে টাঙ্গাইল জেলা ত্যাগ করেন এবং ১৫ এপ্রিল আসামের ফুলবাড়ি হযে ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী এবং আসামে মওলানা ভাসানীর এককালের সহকর্মী মইনুল হক চৌধুরী ।
 
মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে ভারতে প্রবেশের পর মুহূর্ত থেকে মওলানা ভাসানী তাঁর নিজের স্বাধীনতা খুইয়ে ফেলেছিলেন। 'নকশাল' ও পাকিস্তানী গুপ্তচরদের আক্রমণের মুখে তাঁর নিরাপত্তার অজুহাতে তাঁকে প্রহরাধীন রাখা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে সব সময় থাকতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনো ব্রিগেডিয়ার কিংবা কোনো ম্যাজিস্ট্রেট। প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বাইরে তেমন কাউকেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হতো না। বিশেষ করে বামপন্থী কোনো নেতা-কর্মী কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত অনুসারীদের কেউ যাতে যেতে না পারেন সে বিষয়টি সর্বতোভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল। ন্যাপ সম্পাদক মশিউর রহমান, কৃষক নেতা কমরেড বরোদা ভূষণ চক্রবর্তী, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির নেতা কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই মওলানা ভাসানীর সঙ্গে যোগাযোগ বা সাক্ষাৎ করতে পারেননি। মওলানা ভাসানীর বড় ছেলে আবু নাসের খানকেও জানানো হয়নি তাঁর ঠিকানা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বামপন্থী ছাত্রনেতা তারিক আলীও লন্ডন থেকে এসে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন ।

ভারতে ভাসানী সম্পর্কিত বিতর্ক

মওলানা ভাসানীর অবস্থান সম্পর্কে ভারতের লোকসভায়ও প্রশ্ন উঠেছিল। পশ্চিম বঙ্গ বিধান সভায় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার ১৪ মে অভিযোগ করেছিলেন, মওলানা ভাসানীকে কলকাতাতেই কোথাও অন্তরীণ রাখা হয়েছে। জবাবে মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জী বলেছিলেন, মওলানা ভাসানী কোথায় আছেন তা তিনি বা তার সরকার জানেন না। হরেকৃষ্ণ কোঙার মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, মওলানা ভাসানীর মতো বিশিষ্ট নেতার খোঁজ না জানার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয় । তিনি প্রশ্ন করেন, তাহলে কি মওলানা ভাসানী অন্তর্ধান করেছেন? সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গী কি বাংলাদেশের লড়াইয়ের সহায়ক হবে? (দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ মে, ১৯৭১ )

মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক সাপ্তাহিক 'বাংলাদেশ'-এর ২১ মে ১৯৭১ সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিল 'ভাসানী কলকাতাতেই অন্তরীণ, কিন্তু সরকার নীরব!' সাপ্তাহিকটি 'ভাসানী সম্বন্ধে সরকার নীরব কেন?' শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, ... রাজ্য সরকার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব হইয়া থাকায় গোটা ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করিয়া আরও নানা জল্পনা-কল্পনা এবং গভীর সন্দেহের সৃষ্টি হইতেছে ।... সুতরাং আমরা রাজ্য সরকারের উদ্দেশে দাবী জানাইতেছি যে, অবিলম্বে তারা এই রহস্যজাল ভেদ করুন এবং ভাসানী সাহেবের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করিয়া যে উদ্বেগ এবং সংশয়ের সৃষ্টি হইয়াছে তা দূর করুন।... বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানীকে আজকের সংগ্রামের ময়দানে যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন তাকে অন্তরীণ রাখিতেছে কারা এবং কাদের স্বার্থে, বাংলার মানুষ আজ স্বভাবতই তা জানিতে চাহিবে। আজ

মুজিবুর (শেখ মুজিব) যখন কারাগারে তখন ভাসানীকে অন্যত্র আটকাইয়া বাংলাদেশের সংগ্রামকে কান্ডারীবিহীন করার জন্য এটা বৃহৎ কোন ষড়যন্ত্রের অঙ্গ কিনা আজ সেই সন্দেহও অনেকের মনে জাগিবে ।...'

এ ধরনের বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব মওলানা ভাসানীর এবং বামপন্থীদের হাতে চলে যাওয়ার আশংকায় ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর সরকার প্রথম থেকেই সতর্ক ছিল। সেজন্যেই তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তরীণ রাখা না হলেও নানা মিথ্যা অজুহাতে কঠোর প্রহরাধীন রাখা হয়েছিল । ভারতে প্রবাসের নয় মাসে মওলানা ভাসানীর দুই সঙ্গী মীর্জা মোরাদুজ্জামান এবং সাইফুল ইসলামের বিবরণী থেকেও একই তথ্য জানা যায় (দেখুন: সাইফুল ইসলামের গ্রন্থ, 'ভাসানী ভারত স্বাধীনতা ঢাকা, ১৯৯৩) । বারবার অনুরোধ জানিয়েও মওলানা ভাসানী যুদ্ধকালে কখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিংবা সীমান্তবর্তী এলাকায় যেতে পারেননি, পরিবর্তে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দিল্লি, লছমনঝুলা, গীতাভবন, ঋষিকেশ এবং হরিদ্বারের মতো তীর্থস্থানগুলোতে। কখনো বা স্বাস্থ্যোদ্ধারের নামে রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ এলাকা দেরাহদুনের নির্জন দুর্গে ।

ন্যায়সঙ্গত স্বাধীনতা সংগ্ৰাম

ভারত সরকারের প্রহরাধীন থাকা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা রেখেছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই তাঁর সে ভূমিকা সাংগঠনিক পর্যায়ের হতে পারেনি, তাঁকে বেছে নিতে হয়েছিল প্রচারণা চালানোর পথ । ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতি সাহায্যের আবেদন জানিয়ে তিনি তাঁর প্রচার অভিযান শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ধংসযজ্ঞের বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন, 'সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তির বর্তমান সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা আখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে । আমি ঘোষণা করতে চাই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক-শোষকদের নগ্ন আক্রমণ এবং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমরা ন্যায়সঙ্গত স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছি।' বিবৃতিতে তিনি এই সংগ্রামকে সর্বান্তকরণে সমর্থনদান এবং বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করার জন্য ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন। (ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান, ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১)

১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সে সরকারের প্রতি তাঁর সমর্থন জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, 'সারা বিশ্বের শান্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশের জনসাধারণ ও সরকারের প্রতি আমার আকুল আবেদন এই যে, যত শীঘ্র সম্ভব আপনারা নবগঠিত গণপ্রজাতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিউন।' (দৈনিক আনন্দাবাজার পত্রিকা, ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১)

বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রতি মাওলানা ভাসানীর আবেদন

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানানোর আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট, গণচীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ ও প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট লিও পোদগর্নি, প্রধানমন্ত্রী এলেক্সি কোসিগিন ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল ব্রেজনেভ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিডু, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল যোসেফ টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং আরব লীগের সেক্রেটারি জেনারেল আবদেল খালেক হাসাওনার কাছে পৃথক পৃথক তারাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। প্রতিটি তারবার্তায়ই তিনি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং নারী নির্যাতনের কথা উলেখ করে অবিলম্বে এই অত্যাচার বন্ধে প্রভাব খাটানোর এবং নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি ।

মাও সে তুঙ এবং চৌ এন লাই-এর প্রতি তারবার্তায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, 'সমাজতন্ত্রের আদর্শ হলো নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার আপনাদের সরবরাহকৃত আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে নির্দয়ভাবে নিরস্ত্র শ্রমিক কৃষক ছাত্র বুদ্ধিজীবী এবং নারী শিশুদের হত্যা করছে । আপনাদের সরকার এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিকার না করলে গোটা বিশ্ব একথাই মনে করবে যে, আপনারা নির্যাতিত জনগণের বন্ধু নন ।

সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের প্রতি তারবার্তায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, “মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আপনাদের দেশ ও জনগণ সব সময়ই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত জনগণের দুর্দিনে বৈষয়িক এবং রাজনৈতিক সমর্থন যুগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান সংগ্রামেও আপনাদের সার্বিক সাহায্য আমরা আশা করি।'

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রতি তারবার্তায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, 'আপনার দেশের সরবরাকৃত অস্ত্রের সাহায্যে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে পাশবিক হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাই একান্ত অনুরোধ, আপনি পাকিস্তানকে নতুন করে কোনো অস্ত্র সরবরাহ করবেন না। পাশাপাশি এমন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যও অনুরোধ জানাচ্ছি যাতে অতীতে সরবরাহ করা অস্ত্র দিয়ে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী আর নিরস্ত্র বাঙালীদের হত্যা করতে না পারে।' (মওলানা ভাসানীর এসব তারবার্তার জন্য দেখুন, তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত 'স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র', ১৯৮২, চতুর্থ খন্ড, পৃ- ৪৭০-৭৬)।

যুদ্ধকালে জনগণের প্রতি আহ্বান

১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের ২৩ বছরে পূর্ব বাংলা ও বাঙালীর দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছিলেন। লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, 'সুতরাং আজিকার স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ কায়েমের যে সংগ্রাম শুরু হইয়াছে তাহা নতুন কিছু নহে। ইহা একটি জাতির বাঁচা-মরার প্রশ্নে পূর্ব স্বীকৃত প্রস্তাব বাস্তবায়নের মহান সংগ্রাম।' প্রচারপত্রে তিনি গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সমর্থন কামনা করেছিলেন। মওলানা ভাসানী ইসলাম ও পাকিস্তানের সংহতির নামে তৎপর দালালদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্যও সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। 'দালাল, বিশ্বসঘাতক ও মোনাফেক হইতে সাবধান হউন' শিরোনামে ৫ মে'র প্রচারপত্রে মওলানা ভাসানী ইসলামের নামে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলমাসহ পশ্চিম পাকিস্তানের আজ্ঞাবহ বিশ্বাসঘাতকদের স্বরূপ তুলে ধরে বলেছিলেন, ... নরপশু সৈনিকদিগের ছত্রছায়ায় এই দালালেরা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া বিভিন্ন টালবাহানায় পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের স্থায়ী শোষণদাসে পরিণত করিতে সুচতুর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছে।' ওই প্রচারপত্রে মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের চার হাজার ইউনিয়নে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার, গ্রামে গ্রামে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টার খোলার, মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করার এবং মুক্তিযুদ্ধে যুবকদের যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আপোস ও রাজনৈতিক সমাধানের বিরোধিতা

১৯৭১ সালের ১৫ মে এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছিলেন। দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, শতকরা ৯৯ জনেরও বেশি মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভাট দেবে। বিবৃতিতে তিনি গণচীনের ভূমিকায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সে দেশের নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে বর্তমান পরিস্থিতিতেও পাকিস্তানের সমর্থনে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন তাতে বিশ্বাবাসী আর একথা বিশ্বাস করবে না যে, নির্যাতিত জনগণের প্রতি চীনের বিন্দুমাত্র মমত্ব আছে। (দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ১৬ মে, ১৯৭১)

যদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র শুরু হলে মওলানা ভাসানী তার প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিতে হোসেন শহীদ সাহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলায়মান পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এবং -খন্দকার মোশতাক আহমদ ও হোসেন আলীসহ কতিপয় দক্ষিণপন্থী নেতা ও আমলা মুজিবনগরে অর্থাৎ কলকাতায় বসে পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে তৎপরতা চালিয়েছিলেন বলে জানা যায়। মওলানা ভাসানী এই ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করে ৩১ মে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, বাংলাদেশের অধিবাসীদের সামনে দু'টি মাত্র বিকল্প রয়েছে- হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, নাহলে মৃত্যু । তাঁর পরিষ্কার ঘোষণা ছিল, আপোস মীমাংসার পথে বাংলাদেশ সমস্যার কোনো সমাধান সম্ভব নয় এবং কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে তেমন উদ্যোগ নেয়া হবে অর্থহীন ।

যারা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন তাদের মনে রাখা উচিত যে, ২৩ বছরের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী এখন জীবন-সংগ্রামে নিয়োজিত। এত বিপুল ত্যাগকে আপোসের পথে নস্যাৎ করতে দেয়া হবে না । (দৈনিক স্টেটসম্যান, ১ জুন, ১৯৭১)

সর্বদলীয় সরকারের বিরোধিতা

স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল পর্যায়ে জাতীয় ঐক্য রক্ষার প্রচেষ্টা ছিল মওলানা ভাসানীর আর এক উল্লেখযোগ্য অবদান। নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে মূলত এককভাবে তাজউদ্দিন আহমদ প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমদ ছাড়াও শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ অন্য কয়েকজন নেতা পদটির জন্য আকাংক্ষী ছিলেন বলে জানা যায়। এজন্য তারা তৎপরতাও চালিয়েছিলেন। ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মতপার্থক্য ও সংঘাত ছিল প্রথম থেকেই। পাশাপাশি ছিলেন 'মস্কোপন্থী' দুই নেতা মনি সিং এবং মোজাফফর আহমদ । বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সোভিয়েত সহানুভূতিকে চাপ হিসেবে কাজে লাগিয়ে তারাও মন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। ফলে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ এবং একে সর্বদলীয়করণের জন্য প্রচন্ড চাপের সৃষ্টি হয়েছিল। এতে বিপন্ন হয়ে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক ও গণচীনের বন্ধুরাষ্ট্র হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি চেয়েছিল সত্য, কিন্তু প্রথমেই বাংলাদেশের পক্ষ নেয়নি। ভারতকে একটি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ করার কৌশল হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বরং ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি শুরু করেছিল ।

১৯৬৯ সালে সংঘটিত চীন-সোভিয়েত যুদ্ধের পর থেকেই এ জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু ভারত সম্মত হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত জড়িয়ে পড়ার পর ওই সামরিক চুক্তিকে সমর্থনের পূর্বশর্ত বানিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারতেরও তখন পাশ কাটানোর সুযোগ ছিল না। ফলে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২৫ বছর মেয়াদী ভারত- সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি'। এই চুক্তি ছিল ভারতের ওপর সোভিয়েত কূটনীতির বিরাট বিজয়। এটা স্বাক্ষর করায় ভারত অনেকাংশে নির্ভরশীল রাষ্ট্রেও পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধই ছিল অন্তরালের প্রধান নির্ধারক। মৈত্রী চুক্তি'র আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে 'পূর্ব পাকিস্তান' বলেছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে 'পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের' জন্যও তাগিদ দিয়েছে। সোভিয়েত মনোভোবে পরিবর্তন ঘটেছিল মৈত্রী চুক্তি'র পর। ভারতের ইন্দিরা সরকারের ইঙ্গিতে মুজিবনগণ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে মস্কোপন্থীদের দুই প্রধান নেতা মণি সিংহ ও মোজাফফর আহমদকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছিল ।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন এর মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে খুশি করতে, যাতে ভারতের প্রতি সোভিয়েতের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটে। এ অবস্থারই সুযোগ নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদকে চ্যালেঞ্জকারীদের সঙ্গে উসকানিদাতার ভূমিকায় নেমেছিলেন সেকালের মস্কোপন্থীরা।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের তথা মুজিবনগর সরকারের সে সংকটকালে আরো একবার প্রকৃত দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী । ৩০ মে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, 'স্বাধীনতা সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ে জাতীয় বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের উদ্যোগ আমি সমর্থন করি না । কেননা এর ফলে নেতৃত্ব নিয়ে সংঘাত সৃষ্টি হবে এবং তা আমাদের সংগ্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে । আমাদের এমন কিছু করা উচিত নয়, যা পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রকে শক্তিশালী করবে।' (দৈনিক স্টেটসম্যান, ১ জুন, ১৯৭১)

উপদেষ্টা পরিষদে
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রবাসী সরকার সর্বদলীয় সরকারের বিকল্প হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের কৌশল গ্রহণ করে। মস্কোপন্থী নেতা মণি সিং- মোজাফজফরদের সন্তুষ্ট করার পাশাপাশি মাওলানা ভাসানী সম্পর্কিত জল্পনা- কল্পনার অবসান ঘটানোও ছিল এর উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে আয়োজিত উপদেষ্টা পরিষদের একমাত্র বৈঠকে মওলানা ভাসানীকে সভাপতিত্ব করতে দেয়া হয় । তিনি তাঁর দীর্ঘ বক্তব্যে সর্বদলীয় সরকার গঠনের বিরোধিতা করেন এই যুক্তিতে যে, মোজাফফর আহমদের মতো অন্য যারা এতে অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহী তাদের প্রত্যেকেই ১৯৭০-এর নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, অনেকের জামানতও বাজেয়াপ্ত, হয়েছে। ফলে তারা মন্ত্রী হলে বা সরকারে যোগ দিলে সে সরকার সম্পর্কেই জনমনে বিভ্রান্তি ও হতাশার সৃষ্টি হবে। জানা যায়, মওলানা ভাসানী তাদের মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন পরিত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। এভাবে প্রধানত মওলানা ভাসানীর হস্তক্ষেপের ফলেই সে সময় প্রবাসী সরকার অনিবার্য বিপর্যয়ের পরিণতি থেকে রেহাই পেয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধও পেরেছিল ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালিত হতে ।

ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। 'চমৎকার আতিথেয়তার জন্য' ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি প্রতিবারই তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী 'উপযুক্ত সময়ের জন্য' অপেক্ষা করতে বলেছেন। জানা যায়, বিভিন্ন সময় চিঠির মাধ্যমেও মওলানা ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে একই অনুরোধ জানিয়েছিলেন ।

মওলানা ভাসানীর ভূমিকায় মুল্যায়ন
এভাবেই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ের দিন পর্যন্ত সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়েই মওলানা ভাসানী জনগণ ও স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর অগ্রবর্তী ভূমিকা অব্যাহত রেখেছিলেন। ‘আসসালামু আলাইকুম' উচ্চারণের মাধ্যমে কেবল নয়, ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর সরাসরি স্বাধীনতার আহ্বানও তিনিই প্রথম জানিয়েছিলেন। তথাপি স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি নেতৃত্বের অবস্থানে আসতে পারেননি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বই তাঁকে মেনে নিতে হয়েছিল। এই পরিণতির কারণ পর্যালোচনা করা দরকার ।

স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক আন্দোলনকালে ১৯৫০-এর দশকেই মওলানা ভাসানী এর সাথে সামন্তবাদ, বৃহৎ পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে সমন্বিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর কারণ, তিনি সঠিকভাবেই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, মুক্তির সংগ্রাম এক সমগ্র সংগ্রাম, শোষণের কোনো একটি কারণকেও আক্রমণের বাইরে রাখা যাবে না। কৃষক সমিতি গঠনের সাথে সাথে শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নিয়ে এবং তাকে উৎসাহিত করে তিনি শ্রেণী সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে সমগ্র সংগ্রামকেই সফল করতে চেয়েছিলেন। স্বায়ত্তশাসন অর্জনের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রশ্নে তিনি ন্যাপ-এর মাধ্যমে চেয়েছিলেন আন্দোলনকে প্রশ্নাতীত রাখতে ।

বামপন্থীদের ব্যর্থতা

চীন-রাশিয়ার মতাদর্শগত বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৭ সালে ন্যাপে বিভক্তি ঘটার পর মওলানা ভাসানী বামপন্থী সেই অংশটিকে সঙ্গে পেয়েছিলেন- যারা শান্তিপূর্ণ পন্থার পরিবর্তে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার করতেন, প্রচারণা চালাতেন। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান মওলানা ভাসানী জন্য প্রচণ্ড হতাশা বয়ে এনেছিল। তত্ত্ব আর বাগাড়ম্বরে অগ্রগামী তাঁর বামপন্থী অনুসারীরা সেবারের চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতিতেও দুর্ভাগ্যজনক ব্যর্থতা দেখিয়েছিলেন। এই ব্যর্থতা এবং অন্যদিকে বাঙালী বুর্জোয়াদের অর্থ, সাম্রাজ্যবাদের আনুকূল্য আর সাধারণভাবে পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব রাতারাতি শেখ মুজিবকে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ফলে মওলানা ভাসানীকে সংগ্রামের পথ থেকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছিল, আন্দোলন হারিয়ে গিয়েছিল ষড়যন্ত্র আর আপোসের অন্ধকারে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে অপ্রতিহত হওয়ার সুযোগ দিয়ে বামপন্থীরা এরপর বিপ্লবের স্তর নির্ণয়ের নামে নেতৃত্বের সংঘাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন । পরিণতিতে চারটি প্রধান উপদলের সৃষ্টি হয়েছিল । এদের সবাই ১৯৬৯ সালেই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের কর্মসূচি হাজির করেছিল। শ্রেণী সংগ্রামের নামে কেউ কেউ জোতদার খতমের অভিযানও শুরু করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে যখন বিপ্লব তথা স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, তখন এরা যুদ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণে বেশি মনোযোগী হলেন । কেউ বললেন একে সাম্রাজীবাদী চক্রান্তের ফল, কেউ বা এতে পেলেন রুশ-ভারতের গভীর ষড়যন্ত্র। বামপন্থীদের একটি বিরাট অংশ অন্যায় এবং ভুল পথে যাত্রা করলেন । পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চাইতে এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলেন। 'সঠিক' বামপন্থীরা কলকাতায় গঠন করলেন 'বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি'। যোগাযোগবিহীন অবস্থায়ও মওলানা ভাসানীকে বানালেন এর চেয়ারম্যান। অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো পর্যায়েই ভাসানী অনুসারী বামপন্থীরা স্বাধীনতা ও জনগণের পক্ষে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি ।

সবার আগে স্বাধীনতা

নিজের সহযোগী এই বামপন্থীদের সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর জ্ঞান ও ধারণায় কোনো ভ্রান্তি ছিল না বলেই তিনি তাদের ওপর নির্ভরতার মতো বোকামি করেননি। দেশ আর নির্যাতিত জনগণের প্রতি মওলানা ভাসানীর মমত্ব ছিল সুগভীর, দুর্দিনে তাই তিনি একাই পা বাড়িয়েছিলেন। মার্কসবাদী না হলেও তিনি এই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, জাতীয় প্রশ্ন সুতীব্র হয়ে উঠলে তাকে পাশ কাটিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে শ্রেণী সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়া যায় না। এ কারণেই তিনি সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছিলেন । পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পাকিস্তান ভাঙনের গুরুতর কথাটিকে আইনসঙ্গত করার প্রয়োজনে তাঁকে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবকে অবলম্বন করতে হয়েছিল। এ কারণেই তিনি প্রথমে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ বলার পরিবর্তে 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলেছিলেন।


মওলানা ভাসানী তাই বলে সমাজতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করেননি। ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে পাঁচ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেছিলেন তার দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছিল, 'এবং স্বাধীনতার সত্যিকার ফলভোগের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই যে একমাত্র পথ- একথা গ্রামে গ্রামে প্রচার করা।' ১৭ মার্চ চট্টগ্রামে তিনি বলেছিলেন, 'প্রথমে প্রধান ইস্যু তথা স্বাধীনতা সম্পর্কে মীমাংসা করা হবে। পরে যদি দেখা যায়, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি তখন আবার সংগ্রাম শুরু করা যাবে। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন বিবৃতিতেও তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছিলেন।

সমাজতন্ত্রকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে স্থির রেখে তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং এটাই ছিল বিজ্ঞানসম্মতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এরই পাশাপাশি মার্কসবাদী না হয়েও তিনি শেখ মুজিবের অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন এবং ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে আপোস আলোচনার বিরোধিতা করেছেন এবং ঘটনা প্রবাহকে সশস্ত্র সংঘাতের অনিবার্য ও যুক্তিসঙ্গত পরিণতির দিকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সঠিক সিদ্ধান্ত ও অবদানের কথা খোলা মনেই স্বীকার করা প্রয়োজন ।


সৃষ্টি হলো, তখন এরা যুদ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণে বেশি মনোযোগী হলেন । কেউ বললেন একে সাম্রাজীবাদী চক্রান্তের ফল, কেউ বা এতে পেলেন রুশ-ভারতের গভীর ষড়যন্ত্র। বামপন্থীদের একটি বিরাট অংশ অন্যায় এবং ভুল পথে যাত্রা করলেন । পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চাইতে এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলেন। 'সঠিক' বামপন্থীরা কলকাতায় গঠন করলেন 'বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি'। যোগাযোগবিহীন অবস্থায়ও মওলানা ভাসানীকে বানালেন এর চেয়ারম্যান। অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো পর্যায়েই ভাসানী অনুসারী বামপন্থীরা স্বাধীনতা ও জনগণের পক্ষে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি ।
সবার আগে স্বাধীনতা

নিজের সহযোগী এই বামপন্থীদের সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর জ্ঞান ও ধারণায় কোনো ভ্রান্তি ছিল না বলেই তিনি তাদের ওপর নির্ভরতার মতো বোকামি করেননি। দেশ আর নির্যাতিত জনগণের প্রতি মওলানা ভাসানীর মমত্ব ছিল সুগভীর, দুর্দিনে তাই তিনি একাই পা বাড়িয়েছিলেন। মার্কসবাদী না হলেও তিনি এই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, জাতীয় প্রশ্ন সুতীব্র হয়ে উঠলে তাকে পাশ কাটিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে শ্রেণী সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়া যায় না। এ কারণেই তিনি সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছিলেন । পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পাকিস্তান ভাঙনের গুরুতর কথাটিকে আইনসঙ্গত করার প্রয়োজনে তাঁকে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবকে অবলম্বন করতে হয়েছিল। এ কারণেই তিনি প্রথমে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ বলার পরিবর্তে 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলেছিলেন।

মওলানা ভাসানী তাই বলে সমাজতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করেননি। ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে পাঁচ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেছিলেন তার দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছিল, 'এবং স্বাধীনতার সত্যিকার ফলভোগের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই যে একমাত্র পথ- একথা গ্রামে গ্রামে প্রচার করা।' ১৭ মার্চ চট্টগ্রামে তিনি বলেছিলেন, 'প্রথমে প্রধান ইস্যু তথা স্বাধীনতা সম্পর্কে মীমাংসা করা হবে। পরে যদি দেখা যায়, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি তখন আবার সংগ্রাম শুরু করা যাবে। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন বিবৃতিতেও তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছিলেন।

সমাজতন্ত্রকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে স্থির রেখে তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং এটাই ছিল বিজ্ঞানসম্মতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এরই পাশাপাশি মার্কসবাদী না হয়েও তিনি শেখ মুজিবের অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন এবং ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে আপোস আলোচনার বিরোধিতা করেছেন এবং ঘটনা প্রবাহকে সশস্ত্র সংঘাতের অনিবার্য ও যুক্তিসঙ্গত পরিণতির দিকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সঠিক সিদ্ধান্ত ও অবদানের কথা খোলা মনেই স্বীকার করা প্রয়োজন ।

দুই প্রকার দুশমনের মোকাবিলা করিতে হইবে

নির্বাচনে বিজয়ের আনন্দে পূর্ব বাংলার জনগণকে ভুলিয়ে রেখে যখন পাকিস্তানের ক্ষমতা যাওয়ার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র চলছিল মওলানা ভাসানী তথন স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর প্রচারণাকে ক্রমাগত সর্বাত্মক করেছিলেন। দেশের সকল অঞ্চলে সভা- সমাবেশের পাশাপাশি সময়ের প্রয়োজনে তিনি হাতে কলমও তুলে নিয়েছিলেন। নির্ভুল ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো বিরল কয়েকটি রচনার একটিতে এ সময় তিনি লেখেন : 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলনে আমাদিগকে দুই প্রকার দুশমনের মোকাবিলা করিতে হইবে। প্রথমটি হইল পশ্চিমা প্রতিরোধকারী মহল। দ্বিতীয়টি হইল পূর্ব পাকিস্তানেরই বিশ্বাসঘাতক কিংবা সুবিধাবাদী মহল। বিশ্বাসঘাতকেরা গোড়া হইতেই আমাদের সংগ্রাম ব্যর্থ করিবার চেষ্টা করিবে। সুবিধাবাদীরা স্বাধীনতাকামী সাজিয়া সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তিমুখী আন্দোলনের মোড় পরিবর্তন করিবার চেষ্টা করিবে। প্রথম প্রকারের শত্রুকে জানমালের বিনিময়েই খতম করিতে হইবে। কারণ, তাহারা ধস্তাধস্তিতে বিশ্বাস করে এবং বেনিয়াসুলভ কায়দায় যে কয়দিনই পারে লুটপাট করিয়া যাইবার ইচ্ছা পোষণ করে। দ্বিতীয়তঃ দেশী গোষ্ঠীকে প্রতিরোধ করিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঠিক মূল্যবোধে উদ্দীপিত জনতার হাতে নেতৃত্বদান করিতে হইবে। এই কাজ প্রতিযোগিতার নয়। ইহাতে দরকার শুধু সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের প্রভাবমুক্ত বলিষ্ঠ মানসিকতার ।

'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বরূপ সাম্য ও মুক্তির আদলে রচিত হইবে । সমাজতান্ত্রিক অর্থনীততে এবং সামাজিক ন্যায়বিচারে উদ্বুদ্ধ হইয়া সাত কোটি পূর্ব পাকিস্তানী ইতিহাসের পাতায় সেনালী দিনের যোজনা করিবে। (সাপ্তাহিক 'মাতৃভূমি', ২৩ জানুয়ারি, ১৯৭১)

উপসংহার

স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সুদীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মাওলানা ভাসানী দেশ ও জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ব্যক্তিগত বা দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থকে কখনো প্রাধান্য বা প্রশ্রয় দেননি। ধারাবাহিক নির্যাতন, দলীয় ভাঙন এবং সহযোগীদের দলত্যাগের মতো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি জনগণের আন্দোলনে গতিশীল নেতৃত্ব দিয়েছেন। দিক-নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি জড়িত রেখেছেন নিজেকেও। দেশের স্বাধীনতার জন্যে শেষ পর্যন্ত ভারতের কাছে নিজের স্বাধীনতা তুলে দিয়েও তিনি অবিচল থেকেছেন, তবু স্বাধীনতা যদ্ধে বিভেদ সৃষ্টি হতে দেননি। এখানেই মওলানা ভাসানীর শ্রেষ্ঠত্ব, এখানেই তাঁর দেশপ্রেমের মাহাত্ম্য ।

>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url