শিক্ষনীয় গল্পঃ খলিফা হযরত ওমরের (রাঃ) বদান্যতা

খলিফা হযরত ওমরের (রাঃ) বদান্যতা



নীলনদের প্রতি ওমর (রাঃ)-এর পত্র


২০ হিজরী সনে দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে বিখ্যাত সাহাবী আমর ইবনুল 'আছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম মিসর বিজিত হয়। মিসরে তখন প্রবল খরা চলছিল। নীলনদ পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। সেনাপতি আমরের নিকট সেখানকার অধিবাসীরা অভিযোগ করে বলল, হে আমীর ! নীলনদ তো একটি নির্দিষ্ট নিয়ম পালন ছাড়া প্রবাহিত হয় না। তিনি বললেন, সেটা কি? তারা বলল, “এ মাসের ১৮ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমরা কোন এক সুন্দরী যুবতীকে নির্বাচন করব। অতঃপর তার পিতা-মাতাকে রাযী করিয়ে তাকে সুন্দরতম অলংকারাদি ও উত্তম পোষাক পরিধান করানোর পর নীলনদে নিক্ষেপ করব। এর পর নীল নদে পানি আসবে।”

আমর ইবনুল আছ তাদেরকে বললেন, ইসলামে এ ধরনের কাজের কোন অনুমোদন নেই। কেননা ইসলাম প্রাচীন সব জাহেলী রীতি-নীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।” অতঃপর তারা পর পর তিন মাস পানির অপেক্ষায় কাটিয়ে দিল। কিন্তু নীলনদের পানি বৃদ্ধির কোন লক্ষণ দেখা গেল না। অতঃপর সেখানকার অধিবাসীরা দেশত্যাগের কথা চিন্তা করতে লাগল। এ দুর্যোগময় অবস্থা দৃষ্টে সেনাপতি আমর ইবনুল আছ (রাঃ) খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিকটে পত্র প্রেরণ করলেন। উত্তরে ওমর (রাঃ) লিখলেন, হে আমর! তুমি যা করেছ ঠিকই করেছ। আমি এ পত্রের মাঝে একটি পৃষ্ঠা প্রেরণ করলাম । এটা নীলনদে নিক্ষেপ করবে।' ওমরের পত্র যখন আমরের নিকটে পৌছাল, তখন তিনি পত্রটি খুলে দেখলেন সেখানে এ বাক্যগুলি লেখা রয়েছে - 

مصر أما بعد فإن كنت تجرى من قبلك فَلَا تَجْرٍ وَإِن كَانَ الله الْمُؤْمِنِينَ إِلى نيل مصر أ الواحد القهار هُوَ الَّذِي يُجْرِيكَ فَنَسْأَلُ اللهَ تَعَالَى أَنْ يُجْرِيَكَ 

“আমিরুল মুমিনীন ওমর (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে মিসরের নীলনদের প্রতি। যদি তুমি নিজে নিজেই প্রবাহিত হয়ে থাক, তবে প্রবাহিত হয়ো না। আর যদি একক সত্তা, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তোমাকে প্রবাহিত করান, তবে আমরা আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোমাকে প্রবাহিত করেন।”  
অতঃপর আমর (রাঃ) পত্রটি নীলনদে নিক্ষেপ করলেন। পর দিন শনিবার সকালে মিসরবাসী দেখল, আল্লাহ তা'আলা এক রাতে নীলনদের পানিকে ১৬ গজ উচ্চতায় প্রবাহিত করে দিয়েছেন। তারপর থেকে আজও পর্যন্ত নীলনদ প্রবাহিতই রয়েছে। কখনো বিশুষ্ক হয়নি (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/১০০; তারীখু মাদীনাতি দিমাশক ৪৪/৩৩৭; তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাহ আল-কুবরা ২/৩২৬)। 

শিক্ষা : আল্লাহ্র হুকুমেই পৃথিবীর সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। তাঁর নির্দেশ ব্যতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না। অতএব যেকোন দুর্যোগে কেবল তাঁর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। কোন জাহেলী ও শিরকী পন্থার আশ্রয় নেয়া যাবে না । 


রাষ্ট্রপ্রধানের জবাবদিহিতা


মুহাম্মাদ বিন ওবায়দুল্লাহ হ'তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিকটে কিছু কাপড় আসলে তিনি সেগুলি হকদারগণের মাঝে বণ্টন করে দেন। এতে আমাদের প্রত্যেকে একটি করে কাপড় পেল। কিন্তু তিনি নিজে দু'টি কাপড় দিয়ে তৈরী একটি পোষাক পরিধান করে খুৎবা দিতে মিম্বরে আরোহণ করলেন। কিন্তু শ্রোতাদের অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে লোকসকল! তোমরা কি আমার কথা শ্রবণ করছ না? এমতাবস্থার বিখ্যাত সাহাবী সালমান ফারেসী (রাঃ) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, জি না, আমরা শ্রবণ করব না। ওমর (রাঃ) বললেন, কেন হে আবু আব্দুল্লাহ? তিনি বললেন, আপনি আমাদেরকে একটি করে কাপড় দিয়েছেন। অথচ আপনি পরিধান করেছেন (দুই কাপড়ের) বড় পোষাক ! ওমর (রাঃ) বললেন, ব্যস্ত হয়ো না হে আবু আব্দুল্লাহ! অতঃপর তিনি ছেলে আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর দিকে ইশারা করলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর ওমর (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর কসম করে জিজ্ঞেস করছি, আমার পোষাকে যে অতিরিক্ত কাপড় রয়েছে, সেটা কি তোমার নয়? আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বললেন, জি, আমার। অতঃপর সালমান ফারেসী (রাঃ) বললেন, এখন আপনি বক্তব্য শুরু করুন, আমরা শ্রবণ করব (ইবনুল কাইয়িম, ই'লামুল মুওয়াক্কেঈন ২/১২৩; ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ১/২০৩)। 

শিক্ষা : রাষ্ট্রপ্রধান জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন। তাঁকে পরকালে যেমন আল্লাহ্ কাছে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে, তেমনি দুনিয়াতেও তিনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।

আমানতদারিতার অনন্য দৃষ্টান্ত


ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৬ হিজরীতে মুসলিম সৈন্যদল মাদায়েন জয় করেছে। গণীমতের মাল জমা হচ্ছে। এমন সময় এক ব্যক্তি মহামূল্যবান ধন- রত্ম নিয়ে এল। জমাকারী বললেন, এমন মূল্যবান সম্পদ তো আমরা ইতিপূর্বে দেখিনি। তুমি এখান থেকে নিজের জন্য কিছু রেখে দাওনি তো ভাই? লোকটি বলল, 'আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহর ভয় না থাকত, তাহলে আমি কখনোই এ সম্পদ আপনাদের কাছে নিয়ে আসতাম না'। সবাই তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, যদি আমি পরিচয় দেই, তাহলে আপনারা আমার প্রশংসা করবেন। অথচ আমি কেবল আল্লাহর প্রশংসা করি এবং তাঁর নিকটেই প্রতিদান কামনা করি। এরপর তিনি চলে গেলেন। তখন তার পিছনে একজন লোককে পাঠানো হল এবং জানা গেল যে, তিনি হলেন, আমের বিন আবদে কায়েস (তারীখুত তাবারী ২/৪৬৫)।

শিক্ষা : আমানতদারিতা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পক্ষান্তরে আমানতের খেয়ানত করা মুনাফিকের অন্যতম লক্ষণ।

পাত্রী নির্বাচন


ওমর (রাঃ) জনসাধারণের সঠিক অবস্থা জানার জন্য রাত্রিতে ঘুরে বেড়াতেন । এক রাতে একটি ছোট্ট কুটিরের সামনে এলে তিনি বাড়ীর ভিতরের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। মা মেয়েকে আদেশ করছেন, 'দুধের সাথে পানি মিশাও। ভোর হয়ে এল'। মেয়েটি উত্তর দিল, 'না মা, ওমর (রাঃ) দুধে পানি মিশাতে নিষেধ করেছেন। তিনি জানতে পারলে শাস্তি দিবেন'।

মা বললেন, “ওমর দেখতে পেলে তো ? মেয়ে বলল, 'আমি প্রকাশ্যে তাঁর আনুগত্য করব, আর গোপনে তাঁর অবাধ্যতা করব? আল্লাহর কসম! এটা আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে বলল, ওমর (রাঃ) হয়ত আমাদেরকে দেখছেন না, কিন্তু তাঁর প্রভু তো আমাদেরকে দেখছেন! গোপনে সব শুনে ওমর (রাঃ) বাড়ীটি চিহ্নিত করে ফিরে এলেন।

পরে তার ছেলে আছেমের সাথে ঐ মেয়ের বিবাহ দিলেন। তার গর্ভে দু'টি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করল, যাদের একজনের গর্ভে ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর জন্ম হয়েছিল (তারীখু মাদীনাতি দিমাশক ৭০/২৫৩)। 

শিক্ষা : পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যান্য সকল গুণের উপর দ্বীনদারী ও আল্লাহভীরুতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। 


💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url