ঐতিহাসিক ও শিক্ষনীয় গল্পঃ হিমসের প্রশাসক ও উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)

হিমসের প্রশাসক ও উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)




উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু আনহু (১) বলেন, খলিফা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে হিমসের ওয়ালি (শাসনকর্তা) হিসেবে পাঠালেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যে তাঁর কোনো খবর পেলেন না। অবশেষে তিনি কাতিবকে (সেক্রেটারি) বললেন, আমার মনে হচ্ছে সে আমাদের আস্থা নষ্ট করেছে। তুমি তাঁকে লেখো - “আমার এ পত্র পৌঁছা এবং পাঠ মাত্র মুসলমানদের কাছ থেকে খাজনা, জাকাত- যা কিছু আদায় করেছো তা নিয়ে মদিনায় চলে আসবে।' চিঠি পেয়ে উমাইর বিলম্ব না করে একটি চামড়ার থলিতে সামান্য কিছু পাথেয় ও পানির একটি পিয়ালা ভরে কাঁধে ঝোলালেন এবং লাঠিটি হাতে নিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলেন।

মদিনা থেকে হিমসের দূরত্ব কয়েকশো মাইল। মদিনায় যখন পৌঁছলেন তখন তাঁর মাথার চুল লম্বা হয়ে গেছে। রোদ, ধুলোবালি ও দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে চেহারা হয়ে গেছে বিবর্ণ। এ অবস্থায় তিনি সরাসরি খলিফার দরবারে পৌঁছে বললেন, আসসালামু আলাইকা ইয়া আমিরাল মুমিনিন!

—আমিরুল মুমিনিন, আপনার প্রতি সালাম! খলিফা তাঁর দিকে চোখ তুলে দেখে, বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলেন, এ তোমার কী হাল হয়েছে?
উমাইর বললেন, আপনি আমার আবার কী হাল দেখলেন? আমি কি সুস্থ নই? আমার ওপর কি দুনিয়াদারির ছোঁয়া লেগেছে? আমি কি দুনিয়ার শিং ধরে টানাটানি করছি?

খলিফা ধারণা করেছিলেন, উমাইর হয়তো প্রচুর অর্থ-সম্পদ সাথে নিয়ে এসেছেন। তাই প্রশ্ন করলেন, তুমি সাথে করে কী নিয়ে এসেছো?

উমাইর বললেন, আমার সাথে আছে শুধু এই থলেটি, যার মধ্যে আমি আমার পাথেয় বহন করি, আর আছে এই বরতনটি, যার মধ্যে আমি আহার করি ও এটা দিয়ে আমি আমার মাথা, কাপড় ধৌত করি। আর আছে এই মশকটি, এর মধ্যে আমি আমার অজু ও খাওয়ার পানি রাখি। আর এই লাঠি, যার উপর ভর দিয়ে চলি এবং শত্রুর মুখোমুখি হলে এর মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করি। জেনে রাখুন, দুনিয়া আমার এই সামান্য সফর-সামগ্রীর অনুগামী ছাড়া আর কিছুই না।

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করলেন, হেঁটে এসেছো?
উমাইর বললেন, হাঁ, হেঁটেই এসেছি।

—কেউ কি তোমাকে একটি বাহন দিয়ে সাহায্য করলো না?
উমাইর বললেন, আমি কারো কাছে বাহন চাইনি, আর কেউ দেয়ওনি।

—তারা খুব খারাপ মুসলমান হয়ে গেছে।
উমাইর বললেন, উমর! আল্লাহ আপনাকে মানুষের গীবত করতে নিষেধ করেছেন। আমি তো তাদেরকে ফজরের নামাজ জামায়াতে আদায় করতে দেখেছি।

খলিফা নির্দেশ দিলেন, উমাইরের নিয়োগ নবায়ন করা হোক।

উমাইর বললেন, আমি আপনার অধীনে বা ভবিষ্যতে অন্য কারো অধীনে আর কোনো দায়িত্ব পালন করবো না। কারণ, অপরাধ থেকে আমি মুক্ত থাকতে পারিনি। সেখানে খ্রিস্টান জিম্মিকে আমি বলেছি, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন। ওহে উমর! আপনি কি আমাকে এমন কাজের জন্য পাঠিয়েছিলেন? যেদিন থেকে আমি আপনার সাথে কাজ করছি সেদিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দিন। এরপর তিনি খলিফার অনুমতি নিয়ে মদিনা থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি নিরিবিলি স্থানে চলে যান এবং স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করতে থাকেন।

একদিন খলিফার মনে হলো, উমাইর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। তাই তাঁকে পরীক্ষার জন্য একশো দিনারসহ হারিস নামক এক ব্যক্তিকে পাঠালেন তাঁর কাছে। যাওয়ার সময় লোকটিকে বললেন, তুমি উমাইরের কাছে যাবে একজন অতিথির ছদ্মবেশে। যদি তাঁর ওখানে পার্থিব ভোগ-বিলাসের কোনো চিহ্ন দেখতে পাও তাহলে সাথে সাথে ফিরে আসবে। আর তাঁকে খুব করুণ অবস্থায় দেখলে এই একশো দিনার তাঁকে দান করবে।

লোকটি চলে গেল। উমাইরের বাসস্থানে পৌঁছে দেখলো, তিনি দেয়ালের পাশে বসে জামার ময়লা খুটে খুটে তাতে তালি লাগাচ্ছেন। লোকটি সালাম দিল। উমাইর সালামের জবাব দিয়ে তাকে থাকার অনুরোধ করলেন। লোকটি থেকে গেল।

উমাইর- কোথা থেকে এসেছেন?
আগন্তুক- মদিনা থেকে।

উমাইর- আমিরুল মুমিনিনকে কেমন রেখে এসেছেন?
আগন্তুক- একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি হিসেবে।

উমাইর- মুসলমানদের কেমন রেখে এসেছেন?
আগন্তুক- নেককার বান্দা হিসেবে।

উমাইর- আমিরুল মুমিনিন কি এখন আর হদ (শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি) কায়েম করেন না?
আগন্তুক- অবশ্যই, তিনি তাঁর এক ছেলেকে সম্প্রতি ব্যভিচারের শাস্তি প্রদান করেছেন। ছেলেটি মারা গেছে।(২)

উমাইর- আল্লাহ! তুমি উমরকে সাহায্য কর। তোমার ভালোবাসা ছাড়া তাঁর মধ্যে আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।

লোকটি তিন দিন অতিথি হিসেবে থাকলো উমাইরের ঘরে। এ তিনটি দিন শুধু যবের রুটির কিছু টুকরো চিবিয়েই তাকে কাটাতে হলো। এ অবস্থা দেখে লোকটি বললো, এ কয়টি দিন তো আপনি আমাকে প্রায় অভুক্তই রেখেছেন। উমাইর বললেন, আপনি চলে যেতে চাইলে চলে যান। এরপর সে দিনারগুলো বের করে উমাইরের দিকে এগিয়ে দিল। দিনার দেখামাত্র তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, আমার প্রয়োজন নেই।

- একথা বলেই দিনারের থলিটি তিনি লোকটির দিকে ঠেলে দিলেন। এ সময় উমাইরের সহধর্মিণী বললেন, আপনার প্রয়োজন না থাকলে যাদের প্রয়োজন আছে, তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিন।

উমাইর বললেন, এগুলোর ব্যাপারে কিছু করার কোনো অধিকার আমার নেই। তখন স্ত্রী তাঁর ওড়না ছিঁড়ে কয়েকটি টুকরো করেন। তারপর দিনারগুলো ভাগ করে সেই টুকরোগুলোতে বেঁধে আশেপাশের শহিদদের সন্তানদের মাঝে বণ্টন করে দেন।

এদিকে লোকটি খলিফা উমরের নিকট ফিরে গেল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, উমাইর দিনারগুলো কী করেছে?

লোকটি জবাব দিল- আমি তো জানি না।

এবার খলিফা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দিনারগুলো সহ উমাইরকে আসার জন্য লিখলেন। উমাইর হাজির হলেন খলিফার দরবারে।


—খলিফা জানতে চাইলেন, দিনারগুলো কী করেছো?

—আমার যা ইচ্ছা হয়েছে করেছি। তার সাথে আপনার সম্পর্ক কী?

—না তোমাকে বলতেই হবে। খলিফা জোর দিয়ে বললেন।

উমাইর বললেন, আমি সেগুলো আমার আখিরাতের প্রয়োজনে আগে পাঠিয়ে দিয়েছি। 

খলিফা তখন কিছু খাদ্যদ্রব্য ও দুটি কাপড় তাঁকে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। উমাইর তখন বললেন, খাদ্যের প্রয়োজন আমার নেই। বাড়িতে আমি দুই সা’ পরিমাণ যব রেখে এসেছি। সেগুলো খেতে খেতেই আল্লাহ তাআলা হয়তো অন্য রিজিকের ব্যবস্থা করবেন। তবে কাপড় দুইটি নেওয়া যেতে পারে। কারণ আসার সময় আমি দেখে এসেছি, অমুকের মায়ের কাপড় নেই। একথা বলে তিনি কাপড় দুটি বগলদাবা করে বাড়িতে ফিরে আসেন। এর অল্পদিন পরেই তিনি মারা যান।

উমাইরের মৃত্যুর খবর পেয়ে খলিফা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর জন্য ভীষণ ব্যথিত হন ও মাগফিরাত কামনা করেন। তারপর তিনি মদিনার ‘বাকিউল গারকাদ' গোরস্থানে যান। তাঁকে অনুসরণ করে আরো অনেকে যান সেখানে। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের লক্ষ্য করে বললেন, আচ্ছা, আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ বাসনা প্রকাশ করুন তো!

একজন বললো, আমার যদি প্রচুর ধন-সম্পদ থাকতো, তাহলে তা দিয়ে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এত পরিমাণ দাস মুক্ত করতাম। আরেকজন বললো, আমার দেহে যদি অদমনীয় শক্তি হতো তাহলে আমি যমযম কূপ থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলে হাজিদের পান করাতাম।

এভাবে আরো অনেকে নিজ নিজ মনোবাসনা ব্যক্ত করলো। সবশেষে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি যদি উমাইর ইবনে সাআদের মতো আরো যোগ্য লোক পেতাম তাহলে মুসলমানদের কাজে আমি তাদের সাহায্য নিতাম।

[১] উমাইর ইবনু সা'দ ইবনু উবাইদ ইবনুন নু'মান ইবনু কায়স ইবনু আমর ইবনু আউফ ইবনু মালিক ইবনুল আওস রাদিয়াল্লাহু আনহু হলেন একজন আনসারি সাহাবি। মুজামুস সাহাবাহ গ্রন্থকার ইমাম বাগবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি নাসিজু ওয়াহদিহ উপাধি লাভ করেন। তিনি মুনাফিক জুলাস ইবনু সুয়াইদের বার্তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানাতেন। তিনি এতিম ছিলেন। শাম বিজয়ের সময় তিনি শাহাদাতপ্রাপ্ত হন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে শামের ওয়ালি নিয়োগ করেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর ওফাত পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুনিয়াবিরাগী সজ্জন ব্যক্তি।

[২] এখানে ব্যভিচারের কথা উল্লেখ করা হলেও মূলত তাঁকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল মদ্যপানের অপরাধে। ঘটনাটি হলো— উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর এই পুত্রের নাম ছিল আবদুর রহমান আবু শাহমা। তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীর হয়ে মিশরে যুদ্ধ করে জয়লাভ করার পর সেখানেই আবস্থান করেছিলেন। একদিন তিনি বন্ধুকে নিয়ে নাবিয( খেজুর ভিজিয়ে তৈরি করা শরবত পান করেন। কোনো কারণে নাবিযে মাদকতা চলে এসেছিল। ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদের মধ্যে মাতলামী চলে আসে। পরদিন তিনি তাঁর বন্ধুকে নিয়ে মিশরের তৎকালীন প্রশাসক আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিস্তারিত ঘটনা জানান এবং শরিয়তের নির্ধারিত হৃদ চান। তখন আমার ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে ও তার বন্ধুকে নিজ ঘরের মধ্যেই বেত্রাঘাত করেন। পরবর্তীতে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ঘটনা জানতে পেরে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তিরস্কার করেন এবং বলেন, সাধারণ জনগণের মতো আমার পুত্রকেও জনসমক্ষে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। এরপর তিনি আবু শাহমাকে মদিনায় ফেরত পাঠাতে বলেন। মদিনায় পৌঁছার পর উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজে পুনরায় তাকে জনসমক্ষে বেত্রাঘাত করেন। এর কিছুদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর আবু শাহামা ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফন করা হয়।

[৩] এক সা' = (৪) চার মুদ। ১ মুদ = একটি নির্দিষ্ট আকারের পাত্রের পরিমাণকে মুদ বলা হয়, কাপ বা বল বা মগ জাতীয়। যার আনুমানিক পরিমাণ দুই হাত মুনাজাতের মতো একত্রিত করে তাতে যতটুকু ফসল নেয়া যায়। ওই পাত্রের আকারে ১ মুদ = আনুমানিক প্রায় ০.৭৫০ লিটার অর্থাৎ ৭৫০ মিলিলিটার! এখন ৭৫০ মিলিলিটার আয়তনের পাত্রে ফসল ভরলে যতটুকু হয় তা হচ্ছে এক মুদ। তাহলে ১ সা' = ৪ মুদ = 8x ০.৭৫০মিলি লিটার=৩ লিটার। এখন ১ সা' ফসল-৩ লিটার পাত্রে যেই পরিমান ফসল ধরে স্বাভাবিকভাবে। এভাবে একেক ফসলের ওজন ভিন্ন ভিন্ন হবে!

শায়খ সালেহ আল উসায়মিন ফতোয়া আরকানুল ইসলামে উল্লেখ করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এক সা' ছিল আনুমানিক ২ কেজি ৪০ গ্রাম পাকাপুষ্ট গম। এখন ওই পাত্রের পরিমান অনুযায়ী পাকা পুষ্ট গমের কেজি করলে তা দাড়ায় ২ কেজি ৪০ গ্রাম! এখন ওই পাত্রে যদি খেজুর পূর্ণ করে ওজন দেয়া হয় তখন তো আর ২ কেজি ৪০ গ্রাম হবে না! বেশি হতে পারে! কারণ খেজুরের আয়তন বড় এবং ওজন বেশি! একইভাবে যদি ওই পাত্র পূর্ণ চাল ওজন দেয়া হয় তাহলেও ওজনের তারতম্য ঘটবে!! স্কলারগণ মানুষের সুবিধার্থে এই কেজির সংখ্যা নিরুপন করেছেন যে গম হিসেবে তা ২ কেজি ৪০ গ্রাম থেকে শুরু করে প্রায় ৩ কেজি পর্যন্ত।


💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url