হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর জন্মের পূর্ববর্তি ঘটনাসমূহ
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও নমরুদের পরিচয়
খ্রিষ্টপূর্ব ২১৬০ সালে ইরাকের অন্তর্গত ব্যাবিলনের উরু নামক স্থানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম তারিক। চাচার নাম ছিল আজর। তখনকার অর্ধবিশ্বের অধিপতি রাজা নমরুদের একজন মন্ত্রী ছিল আজর। রাজ্যের সর্বত্র এক বিশেষ সুনাম, সুখ্যাতি ছিল মন্ত্রী আজরের। মন্ত্রীদের সকলেই ছিল মূর্তি পূজার ভক্ত। মধ্য বয়সে নমরুদ যখন খোদায়ী দাবি করে তখন তারা সকলে নমরুদের ভক্তবৃন্দে অন্তর্ভুক্ত হয়। নমরুদ ছিল অত্যন্ত প্রতাপশালী রাজা। তার সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও যশ ছিল ভুবন বিখ্যাত। সে নামে মাত্র যুদ্ধের মাধ্যমে সিরিয়া, তুর্কিস্তান, হিন্দুস্থান ও রোম জয় করে বিশাল ভূখণ্ডের একছত্র অধিপতি হয়। পরবর্তী সময়ে তার ভয়েও ও প্রতাপে বিনা যুদ্ধেই বহুদেশ বিজয় হয়েছিল।
নমরুদ ছিল বড় অহঙ্কারী। সে তার শক্তি, প্রতিপত্তি ও ধন সম্পদের গৌরবে এক সময় খোদায়ী দাবি করে বসে। সে স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরা, জহরত খচিত একখানি বিশাল সিংহাসন তৈরি করে। এ সিংহাসন তৈরির ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশের বহু কারিগর ও শিল্পীগণ একাধারে দশ বছর নিরলস কাজ করে। সিংহাসনখানি চারটি হাতি বহন করত। সে এক এক সময় সিংহাসন সহ ভ্রমণে যেত। তখন তার সঙ্গে চার হাজার অশ্বারোহী সৈন্য পাহারাদারীর কাজ করত। চার হাজার চাকর নকর ও দাস-দাসী থাকত এবং চার হাজার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিষদবর্গ ও জ্যোতিষি সাথে থাকত।
পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী চারজন বাদশা
পৃথিবীতে চারজন রাজা বাদশা প্রায় সমগ্র বিশ্বের একচ্ছত্র রাজত্ব করেছেন। তার মধ্যে দুজন মুসলমান, হযরত সোলায়মান (আঃ) এবং অপরজন সেকান্দার জুলকারনাইন। বাকি দুজন ছিল কাফের। একজন নমরুদ অপরজন বখতে নছর। নমরুদ ও বখতে নছর নিজ নিজ রাজত্বকালে শক্তির দাপটে সমস্ত ধর্ম-কর্মের বিলুপ্তি সাধন করে নিজ নিজ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। নমরুদ দেব-দেবীকে নিজের সহকারী বলে ঘোষণা দিয়েছিল। সে জনসাধারণকে দেব-দেবীর পূজা অৰ্চনায় বাধা প্রদান করত না বরং উৎসাহ প্রদান করত।
ইব্রাহীমের (আঃ) জন্মের পূর্বাবাস
একদা নমরুদ রাজদরবারে এসে বসল। তখন তার পরিষদবর্গ ছিল খুবই বিমর্ষ। কেউ কোনরূপ কথাবার্তা না বলে চুপ চাপ বসেছিল। অন্যান্য দিন রাজা দরবারে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিষদবর্গ বিভিন্ন রকম কবিতা ও গান গেয়ে রাজার মন তুষ্ট করত। কিন্তু আজকে সকলে ছিল নিরব। তাই রাজা জিজ্ঞেস করল তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা একেবারে বিমর্ষ হয়ে বসে আছ কেন? তখন একজন জ্যোতিষী বলল, হুজুর জাহাপনা! আমরা আজকে পূর্বদিক থেকে উদিয়মান একটি নক্ষত্র দেখেছি, যা আমরা কোন দিন আর দেখিনি। এ নক্ষত্রটি যে অশুভ ইঙ্গিত বহন করছে তাতে সন্দেহ নেই। নমরুদ জ্যোতিষীদের কথা শুনে বলল, সে নক্ষত্রটি কিরূপ এবং উহা কি অশুভ বয়ে আনতে পারে? জ্যোতিষী বলল, জাহাপনা! নক্ষত্রটি প্রমাণ করছে যে, আগামী দু'তিন দিনের মধ্যে এক পিতার বীর্য মাতৃগর্ভে প্রবেশ করবে। যে বীর্যে এমন এক সন্তান পয়দা হবে যিনি আপনার রাজ্য ধ্বংস করবে, আপনার খোদায়ী দাবি অসার করে দিবে।
জ্যোতিষীর কথা শুনে নমরুদ খুব বিচলিত হয়ে পড়ল। জ্যোতিষীদেরকে নমরুদ জিজ্ঞেস করল এর প্রতিকার কি আছে? জ্যোতিষীরা বলল, জাহাপনা এর প্রতিকার আপনি ভাল জানেন। আমরা প্রতিকারের কোন পথ দেখছি না। তখন নমরুদ বলল, এখনই রাজ্যময় ঘোষণা করে দাও আজ থেকে এক সপ্তাহ কোন মানুষ যেন স্ত্রী সহবাস না করে। এ আদেশ অমান্যকারীকে চরম শাস্তি দেয়া হবে। নমরুদের নির্দেশের সাথে সাথে সারাদেশের সর্বসাধারণকে আদেশটি জানিয়ে দেয়া হল।
ইব্রাহীম (আঃ)-এর জন্ম ঠেকাতে নমরুদের তৎপরতা
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর পিতা তারিক নমরুদের রাত্রিকালীন পাহারাদারীর চাকরি করতেন। তিনি নমরুদের ঘোষণা শোনার পরে কামলালসায় অস্থির হয়ে উঠলেন। ইব্রাহীম (আঃ)-এর মাতাও অনুরূপ যৌন লিপ্সায় অধির হয়ে উঠেন। এমতাবস্থায় গভীর রাত্রে ইব্রাহীম (আঃ)-এর মাতা রাজদরবারে চলে আসেন এবং নমরুদের মহলে প্রবেশ করেন। সেখানে সে তারিককে তরবারী ও মশাল নিয়ে পাহারারত অবস্থায় দেখতে পান। দারোয়ান ও অন্যান্য পাহারাদারেরা সকলেই ঘুমিয়েছিল। খোদ নমরুদ ঘুমে বিভোর ছিল। এমন সময় তারিক নিজ স্ত্রীকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। হঠাৎ কে যেন তার হাতের তরবারী ও মশাল ছিনিয়ে নিয়ে বলল যাও স্ত্রীর সাথে মিলন করে আস। তারিক তখন তড়িৎ গতিতে নিজ শয়ন কক্ষে গেলেন। পিছনে পিছনে তার স্ত্রীও কক্ষে প্রবেশ করলেন। একান্ত নিরবতার মাঝে তাদের উভয়ের মিলন ঘটল। এ মিলন ক্ষণে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর নূর তারিকের পৃষ্ঠ হতে তার মাতার রেহেমে পৌঁছল। পরক্ষণে তারিক স্ত্রীকে সতর্কতার সাথে বাসায় ফিরে যেতে বললেন এবং নিজে নমরুদের মহলে পৌঁছে দেখেন তার বদলী লোকটি মশাল ও তরবারী নিয়ে সেখানে দণ্ডায়মান রয়েছে। তারিককে দেখা মাত্র মশাল ও তরবারী তার হাতে দিয়ে সে বিদায় হল। সকল কাজের পিছনে আল্লাহ তা'য়ালার কুদরত ছিল সদা সক্রিয়। যেভাবে যা তিনি সম্পন্ন করতে এরাদা করেন সেভাবেই তা সম্পন্ন হয় ।
নমরুদ জ্যোতিষদের ভবিষ্যৎবাণী শোনারপর হতে সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় কাটাত। তিন দিন অহিবাহিত হবার পরে নমরুদ জ্যোতিষীদেরকে ডাকল এবং অশুভ নক্ষত্রের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানতে চাইল। জোতিষীরা বলল, হে মহান প্রভু! আপনার কঠোর ঘোষণায় তেমন ফল উদয় হয়নি। সে অশুভ শক্তি গত পরশু দিন রাত্রে পিতার পৃষ্ঠদেশ হতে মাতার রেহেমে চলে গেছে।
এক বছর সমস্ত শিশুকে হত্যার নির্দেশ
নমরুদ জ্যোতিষীদের কথা শুনে রাজ্যময় ঘোষণা দিল আগামী এক বছর পর্যন্ত আমার রাজ্যে যত সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে তাদেরকে আতুর ঘরেই মেরে ফেলতে হবে । এবার শুধু ঘোষণা নয়। দেশের সর্বত্র গুপ্তচর, পাহারাদার ও সৈন্য মোতায়েন করে দিল। যাতে কোন গর্ভবর্তী তার সন্তানকে জীবিত রাখতে না পারে। দেশ ব্যাপী অভিযান আরম্ভ হল। দৈনিক শতশত সন্তানকে হত্যা করা শুরু হল।
নমরুদ নিজ খোদায়ী দাবি টিকিয়ে রাখার নিমিত্ত দুর্দান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। দেশের অধিকাংশ মানুষ আকাশের খোদার উপর বিশ্বাসী ছিল । তা দেখে নমরুদ একদা ঘোষণা দিল আমি আকাশের খোদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করব। এ মর্মে সে এক পাল পাহাড়ী শুকুন এনে সেগুলোকে তালিম দিতে লাগল। ওরা যেন নমরুদের ছওয়ারী বহন করে আকাশে নিয়ে যেতে পারে এবং সেখানে বসে সে আকাশের খোদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। বাস্তবিকই শিক্ষাপ্রাপ্ত শকুন দ্বারা একদিন সে একটি পালকিতে চড়ে শুন্যে ওঠে গেল। কয়েক ঘণ্টা পরে সে রাজ দরবারে নেমে এসে বলল আকাশের খোদাকে আমি হত্যা করে এসেছি। এই দেখ আমার নিক্ষিপ্ত তীরের মাথায় রক্ত মাখা। এ কথা বলে একটি রক্তমাখা তীর প্রদর্শনের জন্য সকলের সম্মুখে রেখে দিল। দেশের সকল মানুষ তার অনুগত থাকতে বাধ্য। না হয় জীবন রক্ষা পাবে না ভেবে মানুষেরা রাজার কথায় “জি হুজুর” জবাব দিয়ে ক্ষান্ত থাকত।
💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url