আল কুরআনের বিষয়ভিত্তিক পরিসংখ্যান এবং আল কুরআনের গানিতিক মোজেযা


আল কুরআনের বিষয়ভিত্তিক পরিসংখ্যান


আল-কুরআন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হওয়া ঐশীগ্রন্থ। এটি একমাত্র গ্রন্থ যাতে কোনোরকম সন্দেহ নেই তাদের জন্য- যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনেন, সালাত কায়েম করেন। জাকাত আদায় করেন যারা পরকালের ওপর নিশ্চিত বিশ্বাস রাখেন। মুত্তাকিদের জন্য এটি একটি পরিপূর্ণ জীবনযাপন পদ্ধতি এবং তাদের মুক্তির সনদ। আল-কুরআন এমন এক গ্রন্থ যেখানে শিক্ষা, সমাজ, পরিবার, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ব্যবসায়, ইহকাল, পরকাল সবই রয়েছে। এ যে এক ঐশীগ্রন্থ তার প্রমাণ মেলে নানাভাবে। ছোট এ লেখায় মহাগ্রন্থ কুরআনের সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে এক টুকরা আলোচনা পেশ করছি। এতে বোঝা যাবে এটা কোনো মানবসৃষ্ট গ্রন্থ নয়, বরং তা এক বিস্ময়কর ঐশীগ্রন্থ।

আল কুরআনে কোন বিষয়ে কতটি আয়াত


জান্নাতের ওয়াদা বিষয়ক আয়াত ১০০০টি, 
জাহান্নামের ভয় বিষয়ক আয়াত ১০০০টি, 
নিষেধ বিষয়ক আয়াত ১০০০টি, 
আদেশ বিষয়ক আয়াত ১০০০টি, 
উদাহরণ বিষয়ক আয়াত ১০০০টি, 
কাহিনী বা ঘটনা বিষয়ক আয়াত ১০০০টি, 
হারাম বিষয়ক আয়াত ২৫০টি, 
হালাল বিষয়ক আয়াত ২৫০টি, 
আল্লাহর পবিত্রতা বিষয়ক আয়াত ১০০টি,
বিবিধ বিষয়ক আয়াত ৬৬টি।

রুকুর ইতিহাস ও সংখ্যা


কুরআনের নোসখায় প্রথম দিকের আখমাস' এবং আশারের' আলামত পরবর্তী যুগে এসে পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং অন্য একটা আলামতের ব্যবহার এতে প্রচলিত হতে থাকে। এ নতুন পদ্ধতির চিহ্নটিকে রুকু বলা হয়। আয়াতে আলোচিত বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ রেখে চিহ্নটি নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রসংগ যেখানেই এসে শেষ হয়েছে সেখানেই পৃষ্ঠার পাশে রুকুর চিহ্ন দেয়া হয়েছে।

এ চিহ্নটি কখন কার দ্বারা প্রথম প্রচলিত হয়েছে এ সম্পর্কিত কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য যদিও পাওয়া যায় না, তবে এই চিহ্ন দ্বারা যে আয়াতের মোটামুটি একটা পরিমাণ নির্ধারণ করা উদ্দেশ্য তা বুঝা যায়। যেটুকু সাধারণত নামাযের এক রাকয়াতে পড়া যায় তাকেই এখানে পরিমাণ হিসেবে ধরা হয়েছে। যেহেতু নামাযে এই পরিমাণ তেলাওয়াত করে রুকু করা যায়, সে কারণেই বোধ হয় একে রুকু বলা হয়।

সমগ্র কুরআন মজীদে মোট পাঁচশ চল্লিশটি রুকূ রয়েছে। প্রতি রাকাতে যদি এক রুকু করে তেলাওয়াত করা হয় তাহলে রমযান মাসের সাতাশের রাতে তারাবীর নামাযে কুরআন তেলাওয়াত শেষ হয়ে যায়।

পারার ইতিহাস ও সংখ্যা


কুরআন শরীফ সমান ত্রিশটি ভাগে বিভক্ত। এগুলোকে পারা বলা হয়। আরবীতে বলা হয় জয়। পারার এ বিভক্তি কোনো বিষয়বস্তুভিত্তিক ব্যাপার নয়; শুধু তেলাওয়াতের সুবিধার্থে সমান ত্রিশটি ভাগে একে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। তিরিশ পারায় এ বিভক্তি কার দ্বারা প্রথম সম্পন্ন হয়েছে সে তথ্য উদ্ধার করা আসলেই কঠিন। অনেকের ধারণা, হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু- যখন কুরআন শরীফের অনুলিপি তৈরী করেন, তখন তিনিই এটা করেছেন এবং তা থেকেই তিরিশ পারার প্রচলন হয়েছে, কিন্তু নির্ভরযোগ্য কোন সূত্রে তা প্রমাণিত হয়নি। আল্লামা বদরুদ্দীন যারকাশীর মতে তিরিশ পারার এ নিয়ম বহু আগে থেকেই চলে আসছে। বিশেষত এ ত্রিরিশ পারার রেওয়াজ কুরআনের ছাত্রদের মাঝেই বেশী প্রচলিত হয়েছে। তিরিশ পারার এ বিভক্তি মনে হয় সাহাবায়ে কেরামের যুগেই চালু হয়েছে। শিক্ষাদান কার্যের সুবিধার জন্যে হয়তো এটা করা হয়েছে।

মনযিলসমূহ ও এর বিভক্তিকরণ


মনযিল কিভাবে এলো তার আলোচনা প্রসংগে অনেকেই এ ঘটনাটি উল্লেখ করেন। আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও মোসনাদে আহমদের বর্ণনা অনুযায়ী একদিন বনী সাফাবী গোত্রের এক প্রতিনিধি দল রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম--এর খেদমতে হাযির হলে রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তাদের কাছে আসতে কিছু বিলম্ব হয়। এই দেরী হওয়ার কারণ উল্লেখ করে রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি কুরআন তেলাওয়াতে ছিলাম, আজকের দিনের নির্ধারিত অংশ পুরো করতে একটু দেরী হয়ে গেছে।

প্রথম মনযিল সূরা আল ফাতেহা থেকে সূরা আন নেসা, দ্বিতীয় মনযিল সূরা আল মায়েদা থেকে সূরা আত তাওবা, তৃতীয় মনযিল সূরা ইউনুস থেকে সূরা আন নাহল, চতুর্থ মনযিল সূরা বনী ইসরাঈল থেকে সূরা আল ফোরকান, পঞ্চম মনযিল সূরা আশ শোয়ারা থেকে সূরা ইয়াসীন, ষষ্ঠ মনযিল সূরা আস সাফফাত থেকে সূরা আল হুজুরাত, সপ্তম মনযিল সূরা ক্বাফ থেকে সূরা আন নাস।

কুরআনে বর্ণিত দশ জন মহিলা 


নিম্নে কোরআনে বর্ণিত দশ জন মহিলার নাম এবং কুরআনের যে সূরায় যেভাবে এসেছে সূরার নামসহ দেওয়া হলঃ

১. আয়েশার বর্ণনা কোরআনে আছে, তবে সূরা আন নূরে সরাসরি তার নাম উল্লেখ করা হয়নি,
২. উম্মে মুসা সূরা আল কাছাছ,
৩. উম্মে মুসা সূরা আল কাছাছ ,
৪. ইমরাতে ফেরাউন সূরা আল কাছাছ,
৫. ইমরাতে ইমরান সূরা আলে ইমরান,
৬. ইমরাতে ইবরাহীম সূরা হুদ, সূরা আয যারিয়াত,
৭. ইমরাতুহু (আবু লাহাবের স্ত্রী) সূরা লাহাব,
৮. ইমরাতাইনে সূরা আন নামল,
৯. ইমরাত সূরা আন নামল ,
১০. ইমরাতুল আযীয সূরা ইউসুফ।

কুরআনে বর্ণিত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহ


১. আ'দ, 
২. সামূদ, 
৩. নূত, 
৪. নূহ, 
৫. সাবা, 
৬. তুব্বা, 
৭. বনী ইসরাঈল. 
৮. আসহাবে কাহফের সাথে সংশ্লিষ্ট, 
৯. আসহাবুস সাবত, 
১০. আসহাবুল কারিয়াহ, 
১১. আসহাবুল আইকা, 
১২. আসহাবুল উখদুদ, 
১৩. আসহাবুর রাস, 
১৪. আসহাবুল ফিল।

কুরআনের গাণিতিক মোজেযা


কুরআন শরীফের সূরা আল ফজর'-এর ৭ নম্বর আয়াতে 'ইরাম' নামক একটি গোত্র কিংবা শহরের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু 'ইরাম'-এর নাম কোনো ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তাই কুরআন শরীফের তাফসীরকারকরাও সুস্পষ্টভাবে এ শব্দটির অর্থ বলতে সক্ষম হননি।

১৯৭৩ সালে সিরিয়ার 'এরলূস' নামক একটি পুরনো শহরে খনন কার্যের সময় কিছু পুরনো লিখন পাওয়া যায়। এ সমর্কে লিখন পরীক্ষা করে সেখানে চার হাজার বছরের একটি পুরনো সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ লিখনগুলোর মধ্যে দেখা গেছে ইরাম শহরের উল্লেখ আছে। এক সময় এরলূস অঞ্চলের লোকজন 'ইরাম' শহরের লোকজনের সংগে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। এ সত্যটা আবিষ্কৃত হলো মাত্র সেদিন অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেড় হাজার বছর আগে নাযিল করা কুরআন শরীফে এই শহরের নাম এলো কি করে? আসলে কুরআন শরীফ হচ্ছে আল্লাহর বাণী, আর আল্লাহ তা'আলা এখানে ইরাম শহরের উদাহরণ দিয়েছেন।

কুরআন শরীফে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর একজন দুশমনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সে হচ্ছে আবু লাহাব। ওহী নাযিল হওয়ার পর যদি আবু লাহাব ইসলাম কবুল করতো তাহলে কুরআন শরীফের আয়াতটি মিথ্যা প্রমাণিত হতো, কিন্তু আবু লাহাব ইসলাম কবুল করেনি এবং কুরআন শরীফের বাণী চিরকালের জন্য সত্য হয়েই রয়েছে।

কুরআন শরীফে সূরা আর রোম'-এ পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংসের ভবিষ্যদ্ববাণী করা হয়েছে এবং যে সময় এই ওহী নাযিল হয় তখন মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা অকল্পনীয় ছিলো যে, রোমকদের যারা পরাজিত করলো তারা অচিরেই তাদের হাতে ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু কুরআন শরীফ এ বিষয়ে ভবিষদ্বাণী করেছে এবং তা এ আয়াত নাযিল হবার ৭ বছর সময়ের মধ্যে, অর্থাৎ ৬২৭ খ্রীষ্টাব্দে এসে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

এ আয়াতে 'ফী আদনাল আরদ' বলে আল্লাহ তা'আলা গোটা ভূ-মন্ডলের যে স্থানটিকে সর্বনিম্ন অঞ্চল' বলেছেন তা ছিলো সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও জর্দানের পতিত ডেড সী' এলাকা। এ ভূখন্ডেই ৬২৭ খৃস্টাব্দে রোমানরা ইরানীদের পরাজিত করে। মাত্র কিছুদিন আগে আবিষ্কৃত ভূ-জরিপ অনুযায়ী এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এই এলাকাটা সারা দুনিয়ার মধ্যে আসলেই নিম্নতম ভূমি। 'সী লেবেল' থেকে ৩৯৫ মিটার নীচে। এ জায়গাটা যে গোটা ভূ-খন্ডের সবচেয়ে নীচু জায়গা এটা ১৪শ বছর আগের মানুষরা কি করে জানবে। বিশেষ করে এমন একজন মানুষ, যিনি ভূ- তত্ত্ব প্রাণীতত্ত্ব ইত্যাদি কোনো তত্ত্বেরই ছাত্র ছিলেন না।

কুরআন শরীফের এক জায়গায় সমুদ্রের তরংগ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ঢেউ যখন অগ্রসর হয় তখন দুটি ঢেউয়ের মধ্যবর্তী স্থান অন্ধকার থাকে। আমরা জানি হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম- মরুভূমি অঞ্চলের সন্তান ছিলেন, তিনি সমুদ্র কখনো দেখেননি। সুতরাং সমূদ্র তরংগের দুটি ঢেউয়ের মধ্যবর্তী স্থান যে অন্ধকার হয় তা তিনি জানবেন কি করে? এতে প্রমাণিত হয়, হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে কুরআন রচনা করেননি। আসলেই প্রচন্ড ঝড়ের সময় সমুদ্র যখন বিক্ষুব্ধ হয় তখন দ্রুতগতিসম্পন্ন তরংগগুলোর মধ্যবর্তী অংশ সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়।

কুরআনের আরেকটি বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, লোহা ধাতুটির বিবরণ। কুরআনের সূরা 'আল হাদীদ'-এ আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, 'আমি লোহা নাযিল করেছি, যাতে রয়েছে প্রচুর শক্তি ও মানুষদের জন্যে প্রভূত কল্যাণ।' লোহা নাযিলের বিষয়টি তাফসীরকাররা নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন; কিন্তু যেখানে আল্লাহ তা'আলার স্পষ্ট নাযিল' শব্দটি রয়েছে সেখানে এতো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দিকে না গিয়ে আমরা যদি কুরআনের আক্ষরিক অর্থের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভাবনীও ঠিক একথাটাই বলেছে। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন, লোহা উৎপাদনের জন্যে যে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন তার কোনো উপকরণ আমাদের পৃথিবীতে নেই। এটা একমাত্র সূর্যের তাপমাত্রা দ্বারাই সম্ভব। হাজার হাজার বছর আগে সূর্যদেশে প্রচন্ড বিস্ফোরণের ফলে লোহা নামের এ ধাতু মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তা পৃথিবীতে নাযিল হয়। লোহা সমর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তথ্য ঠিক একথাটাই প্রমাণ করেছে। দেড় হাজার বছর আগের আরব বেদুইনরা বিজ্ঞানের এ জটিল সূত্র জানবে কি করে?

এই সূরার আরেকটি অংকগত মোজেযাও রয়েছে। ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী 'সূরা আল হাদীদ' কুরআনের ৫৭তম সূরা। আরবীতে 'সূরা আল হাদীদ' এর সংখ্যাগত মান হচ্ছে ৫৭। শুধু 'আল হাদীদ' শব্দের অংকগত মান হচ্ছে ২৬, আর লোহার আণবিক সংখ্যা মানও হচ্ছে ২৬।
কোরআনে অনেক জায়গায়ই একের সংগে অন্যের তুলনা উপস্থিত করা হয়েছে। এ তুলনা উপস্থিত করার ব্যাপারে একটি অবিশ্বাস্য মিল অবলম্বন করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে, সে দু'টি নাম অথবা বস্তুকে সমান সংখ্যাতেই আল্লাহ তা'আলা তাঁর কেতাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন, কুরআন শরীফে সূরা আলে ইমরান -এর ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, 'আল্লাহ তা'আলার কাছে ঈসার তুলনা হচ্ছে আদমের মতো।'

এটা যে সত্য তা আমরা বুঝতে পারি। কারণ, মানবজন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এঁদের কারোরই জন্ম হয়নি। আদম - 'আলাইহিস সালাম-এর মাতাও ছিলো না, পিতাও ছিলো না এবং ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ও পিতা ছিলো না। এখন এই তুলনাটি যে কতো সত্য তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন আমরা কুরআন শরীফে এ দু'টি নামের মোট সংখ্যা অনুসন্ধান করি। দেখা যাচ্ছে, কুরআন শরীফে ঈসা আলাইহিস সালাম- নামটি যেমন পঁচিশ বার এসেছে, তেমনি আদম আলাইহিস সালাম- নামটিও এসেছে পঁচিশ বার। কুরআনের বাণীগুলো যে মানুষের নয় তা বোঝা যায় এ দু'টি নামের সংখ্যার সমতা দেখে। আল্লাহ তা'আলা যেহেতু বলেছেন, এ দুটো একই রকম। তাই সেগুলোর সংখ্যা গণনাও ঠিক একই রকমের রাখা হয়েছে।

এই তুলনার ক্ষেত্রে আরেকটি অলৌকিক বিষয় হলো, যেখানে তুলনাটি অসম সেখানে সংখ্যা দুটিকেও অসম বলা হয়েছে। যেমন, কোরআনে বলা হয়েছে, 'সুদ' এবং 'বাণিজ্য' এক নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এ শব্দ দু'টির একটি কোরআনে এসেছে ছয় বার এবং অন্যটি এসেছে সাত বার।

বলা হয়েছে, জান্নাতের অধিবাসী ও জাহান্নামের অধিবাসী সমান নয়'। জান্নাতের সংখ্যা হচ্ছে আট, আর জাহান্নামের সংখ্যা হচ্ছে সাত।

সূরা আরাফ'-এ এক আয়াতে আছে 'যারা আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে কুকুরের মতো'। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় যখন আমরা দেখি, যারা আমার সুস্পষ্ট আয়াতকে অস্বীকার করে এই বাক্যটি কোরআনে সর্বমোট পাঁচ বার এসেছে। যেহেতু তাদের উদাহরণ দেয়া হয়েছে কুকুরের সাথে, তাই সমগ্র কোরআনে আল কালব' তথা কুকুর শব্দটাও এসেছে পাঁচ বার।

'সাবয়া সামাওয়াত' কথাটার অর্থ হলো সাত আসমান'। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোরআনে এই 'সাত আসমান' কথাটা ঠিক সাত বারই এসেছে। খালকুস সামাওয়াত আসমানসমূহের সৃষ্টির কথাটাও ৭ বার এসেছে, সম্ভবত আসমান ৭টি তাই। 'সাবয়াতু আইয়াম' মানে ৭ দিন। একথাটাও কোরআনে ৭ বার এসেছে।

অংকশত মোজেযা এখানেই শেষ নয়।

'দুনিয়া ও আখেরাত' এ দু'টো কথাও কোরআনে সমান সংখ্যায় এসেছে, অর্থাৎ সর্বমোট ১১৫ বার করে।

'ঈমান ও কুফর' শব্দ দুটোও সমপরিমাণে বলা হয়েছে, অর্থাৎ ২৫ বার করে ।

'গরম' ও 'ঠান্ডা' যেহেতু দুটো বিপরীতমুখী ঋতু, তাই এ শব্দ দুটো সমান সংখ্যক অর্থাৎ কোরআনে ৫ বার করে এসেছে।

আরবী ভাষায় 'কুল' মানে বলো, তার জবাবে বলা হয় কালু' মানে তারা বললো। সমগ্র কোরআনে এ দু'টো শব্দও সমান সংখ্যকবার এসেছে, অর্থাৎ ৩৩২ বার করে।

'মালাকুন' কিংবা 'মালায়েকা' মানে ফেরেশতা কিংবা ফেরেশতারা। কোরআনে এ শব্দটি এসেছে ৮৮ বার- একইভাবে ফেরেশতার চির শত্রু শয়তান' কিংবা 'শায়াতীন' এ শব্দটিও এসেছে ৮৮ বার।

'আল খাবিস' মানে অপবিত্র, আত তাইয়েব মানে পবিত্র। সমগ্র কোরআনে এ দু'টি শব্দ মোট ৭ বার করে, অর্থাৎ একই সংখ্যায় নাযিল হয়েছে।

প্রশ্ন জাগতে পারে দুনিয়ায় ভালোর চাইতে মন্দই তো বেশী, তাহলে এখানে এ দুটো শব্দকে সমান রাখা হলো কিভাবে। এ কথার জবাবের জন্যে কুরআনের সূরা আনফালের ৩৭ নম্বর আয়াতটির দিকে লক্ষ করা যাক। এখানে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, অপবিত্রকে পবিত্র থেকে আলাদা করার জন্যে তিনি অপবিত্রকে একটার ওপর আরেকটা রেখে পুঞ্জীভূত করেন এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে ফেলে দেন।' এতে বুঝা যায়, যদিও 'পাপ পুণ্য' সমান সংখ্যায় এসেছে, কিন্তু 'পুঞ্জিভূত' করা দিয়ে তার পরিমান যে বেশী তা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

'ইয়াওমুন' মানে দিন। সমগ্র কোরআনে এ শব্দটি ৩৬৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। বছরে যে ৩৬৫ দিন, এটা কে না জানে। ইয়াওমুন শব্দের বহুবচন আইয়াম' মানে দিনসমূহ, এ শব্দটি এসেছে ৩০ বার। আরবী ভাষায় 'চাঁদ' হচ্ছে মাসের সূত্র সূচক, গড়ে বছরের প্রতি মাসে ৩০ দিন, এটাই হচ্ছে চান্দ্রবছরের নিয়ম। হতবাক হতে হয় যখন দেখি, চাঁদের আরবী প্রতিশব্দ 'কামার' শব্দটি কোরআনে মোট ৩০ বারই এসেছে।

'শাহরুন' মানে মাস, কুরআন মজীদে এ শব্দটি এসেছে মোট ১২ বার। 'সানাতুন' মানে বছর, কোরআনে এ শব্দটি এসেছে ১৯ বার। কারণ হিসেবে আমরা সম্প্ৰতি আবিষ্কৃত গ্ৰীক পণ্ডিত মেতনের 'মেতনীয় বৃত্তের কথা উল্লেখ করতে পারি। তিনিই প্রথম এ তত্ত্বটি আবিষ্কার করেন যে, প্রতি ১৯ বছর পর সূর্য ও পৃথিবী একই বৃত্তে অবস্থান করে।

কোরআনে 'ফুজ্জার (পাপী) শব্দটি যতোবার এসেছে, আবরার (পুণ্যবান) শব্দটি তার দ্বিগুণ এসেছে। অর্থাৎ 'ফুজ্জার' ৩ আর আবরার' ৬ বার। এর কারণ হচ্ছে, শাস্তির তুলনায় পুরস্কারের পরিমাণ আল্লাহ তা'আলা সব সময় দ্বিগুণ করে দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। কুরআনের সূরা সাবার ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন 'এ ধরনের লোকদের জন্যেই (কেয়ামতে) দ্বিগুণ পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। এটা হচ্ছে বিনিময় সে কাজের যা তারা দুনিয়ায় করে এসেছে'। এ কারণেই দেখা যায়, গোটা কোরআনে 'পাপী' ও 'পুণ্যবান' শব্দের মতো আযাব' শব্দটি যতোবার এসেছে, 'সওয়াব' শব্দটি তার দ্বিগুণ এসেছে। অর্থাৎ আযাব ১১৭ বার, সওয়াব ২৩৪।

কোরআনে একাধিক জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করলে তিনি তার বিনিময় বাড়িয়ে দেবেন। সম্ভবত এ কারণেই কোরআনে গরীবী শব্দটি এসেছে ১৩ বার, আবার তার বিপরীতে 'প্রাচুর্য' শব্দটি এসেছে ২৬ বার।

কোরআনে কারীমের বিভিন্ন জায়গায় এভাবে গাণিতিক সংখ্যার অদ্ভুত মিল দেখে কুরআনের যে কোনো পাঠকই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবতে থাকে, এটা নিঃসন্দেহে কোনো মানুষের কথা নয়।

কোনো একটি কাজ করলে তার যে অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়াবে তার উভয়টিকে আশ্চর্যজনকভাবে সমান সংখ্যায় বর্ণনা করা হয়েছে। 'গাছের চারা উৎপাদন' করলে 'গাছ' হয়। তাই এ দুটো শব্দই এসেছে ২৬ বার করে। কোনো মানুষ হেদায়াত' পেলে তার প্রতি 'রহমত' বৰ্ষিত হয়, তাই এ দুটো শব্দ কোরআনে এসেছে ৭৯ বার করে। 'হায়াতের' অপরিহার্য পরিণাম হচ্ছে 'মওত' এ শব্দ দুটোও এসেছে ১৬ বার করে। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন 'যাকাত দিলে বরকত আসে, তাই কোরআনে কারীমে 'যাকাত' শব্দ এসেছে ৩২ বার বরকত শব্দও ৩২ বার এসেছে। 'আবদ' মানে গোলামী, আর আবীদ' মানে গোলাম। গোলামের কাজ গোলামী করা, তাই কোরআনে এই উভয় শব্দই এসেছে ১৫২ বার করে। 'মানুষ সৃষ্টি' কথাটা এসেছে ১৬ বার, আর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে 'এবাদাত'; সুতরাং তাও এসেছে ১৬ বার। 'নেশা' করলে 'মাতাল' হয়, তাই এ দুটো শব্দও এসেছে ৬ বার করে।

আর মাত্র দুটো মোজেযা বলে আমরা ভিন্ন আলোচনার দিকে অগ্রসর হবো।

কোরআনে 'ইনসান' শব্দটি এসেছে ৬৫ বার। এবার ইনসান বানাবার উপকরণগুলোকে কুরআনের বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগ করে মিলিয়ে দেখা যাক। প্রথম উপাদান তোরাব' (মাটি) এটি এসেছে ১৭ বার, দ্বিতীয় উপাদান 'নুতফা' (জীবনকণা) এটি এসেছে ১২ বার, তৃতীয় উপাদান 'আলা ক্ব' (রক্তপিন্ড) এটি এসেছে ৬ বার, চতুর্থ উপাদান 'মোদগা' (মাংসপিন্ড) এটি এসেছে ৩ বার। পঞ্চম উপাদান হচ্ছে 'এযাম (হাড়), এটি এসেছে ১৫ বার। সর্বশেষ উপাদান হচ্ছে 'লাহম' (গোশত), এ শব্দটি এসেছে ১২ বার। কোরআনে উল্লেখিত (সূরা হজ্জ ৫) এ উপাদানগুলো যোগ করলে যোগফল হবে ঠিক ৬৫। আর এসব উপাদান দিয়ে যে ইনসান' বানানো হয়েছে তাও ঠিক ৬৫ বারই উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহ তা'আলা কুরআনের সূরা 'আল ক্বামার' এর প্রথম যে আয়াতটিতে চাঁদ বিদীর্ণ হওয়ার সাথে কেয়ামতের মাসের সূত্র সূচক, গড়ে বছরের প্রতি মাসে ৩০ দিন, এটাই হচ্ছে চান্দ্রবছরের নিয়ম। হতবাক হতে হয় যখন দেখি, চাঁদের আরবী প্রতিশব্দ 'কামার' শব্দটি কোরআনে মোট ৩০ বারই এসেছে।

আল্লাহ তা'আলা কুরআনের সূরা 'আল ক্বামার' এর প্রথম যে আয়াতটিতে চাঁদ বিদীর্ণ হওয়ার সাথে কেয়ামতের আগমন অত্যাসন্ন কথাটি বলেছেন, আরবী বর্ণমালার আক্ষরিক মান হিসাব করলে তার যোগ ফল হয় ১৩৯০, আর এই ১৩৯০ হিজরী (১৯৬৯ খৃস্টাব্দ) সালেই মানুষ সর্বপ্রথম চাঁদে অবতরণ করে, জানি না এটা কুরআনের কোনো মোজেযা, না তা এমনিই এক ঘটনাচক্র, কিন্তু আল্লাহ তা'আলার এই মহান সৃষ্টিতে তো ঘটনাচক্র বলতে কিছুই নেই। এ কারণেই হয়তো মানুষের চাঁদে অবতরণের সালের সাথে কুরআনের আলোচ্য আয়াতটির সংখ্যামানের এই বিস্ময়কর মিল আমরা দেখতে পাচ্ছি।


💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url