সাহাবাগণের জীবনকথা-৬ || হযরত আলী (রাঃ) এর জীবনী (দ্বিতীয় পর্ব)






হযরত আলী (রাঃ)


হযরত আলী (রাঃ)কে খলিফা নির্বাচন:

হযরত উসমানের (রা.) শহীদ হওয়ার পর মদিনাতে একটি সর্বব্যাপী বিশৃংখলা এবং নৈরাজ্য বিরাজ করছিল।পাঁচ দিন যাবত রাজনৈতিক ডামাডোলের পর, মিসরীয় বিদ্রোহীদের নেতা, ইবনে সাবা, হযরত আলী (রাঃ)-এর পক্ষে এই বলে রায় দেয় যে, তিনিই একমাত্র খলিফা হওয়ার অধিকারী কারণ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) যার সপক্ষে একটি ওসিয়্যত করেছিলেন। ২৩শে জুন ৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে, হযরত উসমানের (রাঃ) মৃত্যুর ছয় দিন পর, হযরত আলী (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হন এবং জনগণ তাঁর হাতে একে একে বায়'আত গ্রহণ করেন।।

হযরত আলী (রাঃ) এর শাসনকাল:

খেলাফতের নির্বাচনের পরপরই তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী, মদীনা থেকে ইরাকের কুফায় সরিয়ে নেন, যা ছিল অধিকতর কেন্দ্রীয় একটি স্থান।তাঁর নির্বাচনের পরপরই তিনি জনগণের বিশেষ করে মহানবী (সাঃ) এর প্রভাবশালী সাহাবী যেমন হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ) এর উত্থাপিত 'হযরত উসমান(রাঃ)-এর হত্যাকারীদের যথাশীঘ্র শাস্তির জনপ্রিয় দাবীর সম্মুখীন হন। হযরত আলী (রাঃ) ঘোষণা করেন যে, তাঁর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রাষ্ট্রে শান্তি- শৃংখলা পুনঃস্থাপন করা এবং কেবল তারপরই তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখীন করতে পারবেন। কিন্তু হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ), হযরত আলী(রাঃ) এর এই সিদ্ধান্তে রাজী হননি; তারা সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করা শুরু করেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ), যিনি প্রকৃত অবস্থা অবগত ছিলেন না, তিনিও হযরত উসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ) এর সাথে যোগ দেন। তিনজনে মিলে বসরার উদ্দেশ্যে এক সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। হযরত আলী (রাঃ) যুদ্ধ এবং রক্তপাত এড়াতে যারপরনাই চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, তাঁর এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) এর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়, যদিও, হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবায়ের (রাঃ) যুদ্ধের পূর্বেই সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং অন্য কোন শত্রুর দ্বারা নিহত হন।

হযরত আয়েশার (রাঃ) সৈন্যরা পরাজিত হয় কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং তাঁর নিরাপত্তার খেয়াল রাখেন। তিনি তাঁর ভাই মোহাম্মদ বিন আবু বকর (রাঃ) এর রক্ষাবেষ্টনীতে তাঁকে মদীনায় প্রেরণ করেন। এটি 'উটের যুদ্ধ' নামে খ্যাত। কারণ হযরত আয়েশা(রাঃ) যুদ্ধের সময় উটের উপর সওয়ারী ছিলেন। পরবর্তীতে, হযরত আয়েশা (রাঃ) জীবনভর হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অনুতপ্তা ছিলেন। উটের যুদ্ধের পর হযরত আলী (রাঃ), হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কে, যিনি তখনও তাঁর হাতে বায়'আত গ্রহণ করেননি, ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর নিকট আত্বসমর্পণ করার আহ্বান জানান। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এই অজুহাতে তাঁর নিকট নিজেকে সমর্পণ করেনি যে, হযরত উসমান (রাঃ) যিনি উমাইয়া বংশোদ্ভূত ছিলেন, তার রক্তের প্রতিশোধ প্রথমে নিতে হবে।

আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ), আমর বিন আস (রাঃ) এর সহায়তায়, সৈন্য প্রস্তত করা শুরু করে। হযরত আলী (রাঃ), অন্য কোন বিকল্প না পেয়ে, মুয়াবিয়ার সাথে লড়াই করার জন্য জন্য সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হতে হয়। ৫৬৭ খ্রীস্টাব্দের জুলাই দুই সৈন্য বাহিনী 'সিফফিনে' যুদ্ধে উপনীত হয়। দু'পক্ষেই ব্যাপক হতাহত হয়; কিন্তু যুদ্ধ এই মতৈক্যে শেষ হয় যে, বিষয়টি একটি মধ্যস্থতা কমিটিতে নিষ্পত্তি হবে। এই কমিটিতে হযরত আলী (রাঃ) এর পক্ষে আবু মুসা আল আসরি (রাঃ) এবং আমীর মুয়াবিয়ার পক্ষে আমর বিন আস (রাঃ) প্রতিনিধিত্ব করেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই মধ্যস্থতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কারণ আমর বিন আস (রাঃ) আবু মুসা আল আসরি (রাঃ)-এর সাথে গৃহিত সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাড়াঁন।

একটি বড় দল, যারা মধ্যস্থতার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল, হযরত আলী (রাঃ) থেকে সরে গিয়ে তাদের জন্য এক নতুন আমীর নির্বাচিত করে নেয়। এই দলটিকে 'খারেজী' অর্থাৎ'ব্যতান্ত্রিক' বলা হয়ে থাকে। সর্বপ্রথম, হযরত আলী (রাঃ) তাদেরকে বুঝিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তা নিস্ফল হয়। যা ভয়াবহ যুদ্ধে মোড় নিলে প্রচুর খারেজী নিহত হয়। এই বিপর্যস্ত পরাজয়ের পর খারেজীরা হযরত আলী (রাঃ), হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এবং আমর বিন আস (রাঃ) কে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরবর্তী দু'জন হত্যা প্রচেষ্টা হতে বেঁচে যেতে সক্ষম হলেও হযরত আলী (রাঃ) ফযরের নামাজের জন্য মসজিদে যাবার সময় আক্রমণকারীর দ্বারা গুরুতর আহত হন। দু'দিন পর এই অমিত সাহসী এবং ধর্মপ্রাণ খলীফা ৪০ হিজরীর ২০ রমযানে পরলোক গমন করেন। এই সময়ে তাহার ৩৭ বত্সর বয়সী বড় ছেলে আল হাসানকে (রাঃ) ইমামতি হস্তান্তর করেন৷ নিঃসন্দেহে, হযরত আলী (রাঃ) খেলাফতের পবিত্রতা এবং মর্যাদা রক্ষার খাতিরে তাঁর জীবন কুরবান করেন। তিনিও সেই দশজন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সাঃ) যাঁদের বেহেস্তের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।

হযরত আলী (রাঃ) এর শেষের দিগুলো

হযরত আলী (রাঃ) এর শেষ রমজানঃ

আলী (রাঃ) এর জীবনের শেষ রমযান মাস ছিল অন্য এক রকম রমযান। মাস ভিন্ন এক পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছিল। আলীর পরিবারের জন্যও রমযান প্রথম দিক থেকেই অন্য রকম ছিল। ভয় শঙ্কার একটি মিশ্রিত অবস্থা বিরাজমান ছিল। ইসলামের ইতিহাসে চরমপন্থী হিসেবে বিবেচিত খাওয়ারেজ বা খারেজীরা আলী (রাঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েছিল। তাই আলী (রাঃ)' জীবনধারা রমযানে অতীতের রমযানগুলোর মত ছিল না।
হযরত আলী (রাঃ)' শক্তিমত্তার একটি বর্ণনা নাহজুল বালাগা থেকে এখানে বর্ণনা করব। তিনি বলেছেন,
যখন আয়াত 'মানুষ কি ভেবে নিয়েছে আমরা ঈমান এনেছি কথা বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না’ (আনকাবুত -২।)

নাযিল হলো তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর উম্মতের জন্য ফেতনা কঠিন পরীক্ষা আসবে।
فَقُلتُ:يا رَسولُ الله (ص) ماهذهِ الفتنةٌ الّتي اخبرك الله تعالى بها


তখন রাসূলকে প্রশ্ন করলাম: হে আল্লাহর রাসূল! আয়াতে আল্লাহ যে ফেতনার কথা বলছেন সেটা কি? তিনি বললেন:
يا علىُّ اِنّ امتى سيفتنونَ من بعدي


হযরত আলী (রাঃ) এর শাহাদাতের সুসংবাদঃ

হে আলী! আমার পর আমার উম্মত পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। যখন আলী শুনলেন রাসূল মৃত্যুবরণ করবেন এবং তাঁর পরে কঠিন পরীক্ষা আসবে তখন ওহুদের যুদ্ধের কথা স্মরণ করে বললেন:


يا رسول الله اَوَ ليسَ قد قُلتَ لى يومَ اُحدٍ حيثُ استشهدَ مَنِ استشهدَ منَ المسلمينَ و حيّزتِ عنّى الشّهادةُ


 
ইয়া রসুলাল্লাহ্! ওহুদের দিনে যারা শহীদ হওয়ার তাঁরা শহীদ হলেন এবং শাহাদাত আমার থেকে দূরে চলে গেল, আমি এর থেকে বঞ্চিত হলাম এবং খুবই দুঃখ পেয়ে আপনাকে প্রশ্ন করলাম, কেন মর্যাদা আমার ভাগ্যে ঘটল না। আপনি বললেন,


ابشرُ فانّ الشّهادةَ مِن ورائك


আমি তোমাকে শাহাদাতের সুসংবাদ দিচ্ছি। যদিও এখানে শহীদ হওনি কিন্তু অবশেষে শাহাদাত তোমার ভাগ্যে ঘটবে।"[আলী (রাঃ) সময় পঁচিশ বছরের যুবক ছিলেন এবং এক বছর হলো হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.)-কে বিবাহ করেছেন এবং এক সন্তানের জনক। বয়সের যুবক যখন জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর স্বপ্ন দেখে তখন আলী (রাঃ) শাহাদাতের প্রত্যাশী। উল্লেখ্য, ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের মধ্যে সত্তর জন শহীদ হয়েছিলেন যাদের নেতা ছিলেন হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব(রা.) এবং আলী(.) ওহুদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন।] তারপর মহানবী (সা.) বললেন,

انَّ ذلك لكذلك، فكيفَ صبركَ اذن

 

অবশ্যই এমনটি হবে তখন তুমি কিভাবে ধৈর্যধারণ করবে।আলী তাঁর জবাবে বললেন, এখানে ধৈর্যের স্থান নয়, বরং শোকর করার স্থান।' (নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা নং ১৫৪।)

 

রাসূল (সা.)-এর পবিত্র মুখ থেকে নিজের শাহাদাত সম্পর্কে যে খবর তিনি শুনেছিলেন সে সাথে বিভিন্ন আলামত যা তিনি দেখতেন, কখনো কখনো তা বলতেন যা তাঁর পরিবারের সদস্য এবং নিকটবর্তী শুভাকাঙ্ক্ষী সাহাবীদের মধ্যে শঙ্কা কষ্ট বৃদ্ধি করত। তিনি আশ্চর্যজনক কিছু কথা বলতেন। রমযান মাসে নিজের ছেলে-মেয়েদের ঘরে ইফতার করতেন। প্রতি রাতে যে কোন এক ছেলে বা মেয়ের ঘরে মেহমান হতেন- কোন রাতে ইমাম হাসানের (রাঃ) ঘরে, কোন রাতে ইমাম হুসাইনের (রাঃ) ঘরে, কোন রাতে হযরত যয়নাবের(সা.) ঘরে (যিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে জা'ফরের স্ত্রী ছিলেন) মাসে অন্যান্য সময়ের চেয়ে কম খাবার খেতেন। সন্তানরা এতে খুবই কষ্ট পেতেন। তাঁরা কখনো প্রশ্ন করতেন, 'বাবা, কেন এত কম খান?' তিনি বলতেন, আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় মিলিত হতে চাই যে উদর ক্ষুধার্ত থাকে।' সন্তানরা বুঝতেন তাঁদের পিতা কিছুর জন্য যেন অপেক্ষা করছেন। কখনো কখনো তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেনআমার ভাই বন্ধু রাসূল (সা.) আমাকে যে খবর দিয়েছেন তা অবশ্যই সত্য। তাঁর কথা কখনো মিথ্যা হতে পারে না। খুব শীঘ্রই তা সত্যে পরিণত হবে।'


১৩ই রমযান এমন কিছু বললেন যা অন্য সব দিনের চেয়ে পরিবেশকে বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলল। সম্ভবত জুমআর দিন খুতবা পড়লেন। ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলেন, বাবা মাসের কত দিন বাকি রয়েছে?' উত্তর দিলেন, হে পিতা, ১৭ দিন।' তিনি বললেন, তাহলে আর দেরি নেই। মাথা আর দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হবে। শ্মশ্রু শিগগিরই রঙ্গিন হবে।'


হযরত আলী (রাঃ)এর স্বপ্নঃ

উনিশে রমযান আলী (রাঃ)-এর সন্তানরা রাতের একটি অংশ তাঁর সঙ্গে কাটালেন। ইমাম হাসান (রাঃ) নিজের ঘরে চলে গেলেন। আলী (রাঃ) জায়নামাজে বসলেন। শেষ রাতে উদ্বিগ্নতার কারণে ইমাম হাসান (রাঃ) বাবার নামাযের স্থানে গিয়ে বসলেন (অথবা প্রতি রাতই হয়তো রকম করতেন) (ইমাম হাসান-(রাঃ) ইমাম হুসাইন-(রাঃ)  হযরত ফাতেমা যাহরা-সা.' সন্তান বলে ইমাম আলী-(রাঃ) এঁদের প্রতি আলাদা রকম স্নেহ করতেন। কারণ এঁদের প্রতি স্নেহকে রাসূলুল্লাহ-সা. ফাতেমা যাহরা-সা.' প্রতি সম্মান প্রদর্শন বলে মনে করতেন) যখন ইমাম হাসান(রাঃ) তাঁর কাছে আসলেন তখন তিনি বললেন,


ملكتني عينى و انا جالسٌ فسنح لى رسول الله (ص) فقلتُ يا رسول الله ماذا لقيتُ من امّتك من الاود واللددِ فقال ادعُ عليهم فقلتُ ابدلنى الله بهم خيراً منهم و ابدلهم بى شرَّ لهم منِّي

 
হে পুত্র, হঠাৎ স্বপ্নের মধ্যে রাসূলকে আবির্ভূত হতে দেখলাম। যখন তাঁকে দেখলাম তখন বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার উম্মতের হাতে আমার অন্তর রক্তাক্ত হয়েছে।' প্রকৃতপক্ষে তাঁর সঙ্গে মানুষের অসহযোগিতা এবং তাঁর নির্দেশিত পথে চলার ক্ষেত্রে তাদের অনীহা আলী (রাঃ)-কে তীব্র যন্ত্রণা দিয়েছে। উষ্ট্রের যুদ্ধের বায়আত ভঙ্গকারীরা, সিফফিনে মুয়াবিয়ার প্রতারণা (মুয়াবিয়া অত্যন্ত ধূর্ত ছিল, ভালোভাবেই জানত কি করলে আলীর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করা যাবে। আর সে তা- করত), সবশেষে খারেজীদের রূহবিহীন আকীদা-বিশ্বাস যারা ঈমান এখলাছ মনে করে আলী (রাঃ)-কে কাফের ফাসেক বলত। আমরা জানি না আলী (রাঃ)' সঙ্গে এরা কি আচরণ করেছে! সত্যিই আলী (রাঃ)' উপর আপতিত মুসিবতগুলো দেখে কেউই বিস্মিত না হয়ে পারে না। একটি পাহাড়ও এত ব্যাপক কঠিন মুসিবত সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। এমন অবস্থা যে, আলী (রাঃ) তাঁর এইসব মুসিবতের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এখন যখন রাসূলে আকরাম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলেন তখন বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার উম্মত আমার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। এদের নিয়ে আমি কি করব?' তারপর ইমাম হাসানকে বললেন, 'পুত্র, তোমার নানা আমাকে নির্দেশ দিলেন এদের প্রতি অভিশাপ দিতে। আমিও স্বপ্নের মধ্যেই অভিশাপ দিয়ে বললাম: "হে আল্লাহ! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে মৃত্যু দান কর এবং এদের উপর এমন ব্যক্তিকে প্রভাব প্রতিপত্তি দান কর এরা যার উপযুক্ত।বোঝা যায়, বাক্যের সাথে কতটা হৃদয়ের বেদনা দুঃখ জড়িয়ে রয়েছে!

 

হযরত আলী (রাঃ) এর জীবনের শেষ রাত, শেষ ফজরঃ

আলী (রাঃ) সুবহে সাদিকের সময় ঘর থেকে যখন বের হচ্ছিলেন বাড়ির হাঁসগুলো অসময়ে ডেকে উঠল। আলী বললেন,
دعوهنَّ فانّهنَّ صوائحُ تتبعها نوائح

এখন পাখির কান্না শোনা যাচ্ছে, বেশি দেরি নয় এরপর এখান থেকেই মানুষের কান্না শোনা যাবে।" উম্মে কুলসুম আমিরুল মুমিনীনের সামনে এসে বাধা দিলেন। তিনি বললেন, বাবা, আপনাকে মসজিদে যেতে দেব না। অন্য কাউকে আজ নামায পড়াতে বলুন।' প্রথমে বললেন, '(বোনের পুত্র) জুদাহ ইবনে হুবাইরাকে বল জামাআত পড়াতে।' পরক্ষণেই আলী (রাঃ) বললেন, না আমি নিজেই যাব।' বলা হলো, অনুমতি দিন আপনার সঙ্গে কেউ যাক। তিনি বললেন, না, আমি চাই না কেউ আমার সঙ্গে যাক।'

 

হযরত আলী(রাঃ)' জন্য রাতটি ছিল অত্যন্ত পবিত্র। কেবল আল্লাহই জানেন তাঁর মধ্যে সে রাত্রে কেমন উত্তেজনা ছিল! তিনি বলছেন, 'আমি অনেক চেষ্টা করেছি আকস্মিক শিহরণের রহস্য উদঘাটন করব।' যদিও তাঁর ধারণা ছিল যে কোন বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। যেমন নাহজুল বালাগায় আলী (রাঃ) নিজেই বলছেন,


كم اطردت الايّام ابحثها عن مكنون هذا الامر فابى الله الا اخفاءهُ

 
অনেক চেষ্টা করেছি রহস্যের গোপনীয়তা উদঘাটন করব, কিন্তু আল্লাহ চাননি, বরং তিনি এটা গোপন রেখেছেন।
নিজেই ফজরের আজান দিতেন। সুবহে সাদিকের সময় নিজেই মুয়াজ্জিনের স্থানে দাঁড়িয়ে (আল্লাহু আকবার বলে) উচ্চৈস্বরে আজান দিলেন। সেখান থেকে নামার সময় সুবহে সাদেকের সাদা আভাকে বিদায় জানালেন। তিনি বললেন, 'হে সাদা আভা! হে শুভ্র ভোর! হে প্রভাত! যেদিন থেকে আলী পৃথিবীতে চোখ খুলেছিল তার পর এমন কোন ফজর কি আসবে যে, তোমার উদয় হবে আর আলী ঘুমিয়ে থাকবে? অর্থাৎ এবার আলীর চোখ চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে।' যখন তিনি নেমে এলেন তখন বললেন,

خلّوا سبيلَ المومنِ المجاهدِ                                  في الله ذي الكتبِ و ذي المشاهدِ

في الله لا يعبدُ غيرَ الواحدِ                                  و يوقظُ النّاسَ الى المساجدِ

 
এই মুমিন মুজাহিদের (আলীর) জন্য রাস্তা খুলে দাও যে গ্রন্থ শাহাদাতের অধিকারী, যে একক খোদা ছাড়া আর কারো ইবাদত করেনি এবং মানুষকে মসজিদে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে জাগাতো।"


পরিবারের কাউকে অনুমতি দেননি বাইরে যাওয়ার। আলী (রাঃ) বলেছিলেন, পাখিদের কান্নার পর মানুষের আহাজারি শুনতে পাবে।' স্বাভাবিকভাবেই হযরত যয়নাব কোবরা (.), উম্মে কুলসুম (.) পরিবারের বাকী সদস্যরা উদ্বিগ্ন অবস্থায় ছিলেন, আজ রাতে কি ঘটতে যাচ্ছে? হঠাৎ এক প্রচণ্ড চিৎকারে সবাই ঘটনা বুঝতে পারলেন। একটি আওয়াজ চারিদিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল-


تهدّمت واللهِ اركان الهدى وانطمست اعلام التّقى و انفصمتِ العروةُ قتلَ ابنُ عمِّ المصطفى قُتِلَ الوصىُّ المجتبى قُتِلَ علىُّ المرتضى قَتَلَهُ اشقى الاشقياء
 
ধর্ম বা দীনের স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছে, তাকওয়ার ধ্বজা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, মজবুত বন্ধন ছিন্ন হয়ে পড়েছে, মুস্তাফা (সাঃ)' চাচাতো ভাই ওয়াসীকে হত্যা করা হয়েছে, আলী মোর্তজা (রাঃ) নিহত হয়েছেন, তাঁকে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হত্যা করেছে।
وَ لاَ حَوْلَ وَ لاَ قُوَّةَ إِلاَ بِاللهِ العَلِي الْعَظِيْمِ.


হযরত আলী (রাঃ) এর মৃত্যুর পূর্বকালীন ঘটনা মৃত্যু:

মুসলমানরা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের কথা বিস্মৃত হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ একে অন্যকে হত্যার নেশায় মেতে ওঠে। ফলে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে উষ্ট্রের যুদ্ধ ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিফ্ফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গৃহযুদ্ধে রাসুল (সা.) কর্তৃক প্রত্যয়িত তালহা, যুবাইর অনেক বয়োবৃদ্ধ সাহাবাসহ লক্ষাধিক মুসলমান নিহত হন। কার্যত ইসলামী খেলাফত অত্যন্ত দ্রুত অন্তিম সময়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

সিফ্ফিনের যুদ্ধের পর 'দুমাতুল জানদালে' ইসলামী খেলাফতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বৈঠককালে ১২ হাজার সৈন্যের একটি শক্তিশালী বাহিনী খলিফার পক্ষ ত্যাগ করে। ইসলামে 'খারেজি' নামে উগ্রপন্থী সম্প্রদায়ের উদ্ভব তাদের থেকেই।

খারেজি সম্প্রদায় মুসলিম মিল্লাতের জাতীয় শত্রু হিসেবে হজরত আলী, মুয়াবিয়া আমর ইবনুল আস (রা.)কে চিহ্নিত করে তাঁদের একই দিন অভিন্ন সময়ে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আসন্ন মাহে রমজানের ১৫ তারিখ ফজরের নামাজের সময় আক্রমণ পরিচালনার সময় নির্ধারিত হয়। আততায়ীরা নির্দিষ্ট সময়ে বয়োবৃদ্ধ তিন সাহাবির ওপর হামলা করে।

সৌভাগ্যক্রমে আমর ইবনুল আস (রা.) অসুস্থতার কারণে সেদিন মসজিদেই যাননি। আর মুয়াবিয়া (রা.) আততায়ীর আক্রমণে সামান্য আহত হলেও বেঁচে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হজরত আলী (রা.) ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন এবং কুফা জামে মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

সরলতা আত্দত্যাগের প্রতীক ছিলেন হজরত আলী (রা.) মুসলিম জাহানের খলিফা হয়েও নিজ হাতে তাঁকে ফাতেমা (রা.)কে কাজ করতে হতো। দাস-দাসী কোনো দিনই তাঁর ঘরে ছিল না। ইতিহাসবিদ হিট্টি বলেছেন, 'আলী (রা.) ছিলেন যুদ্ধে সাহসী, পরামর্শদানে বিজ্ঞ, বক্তৃতায় স্বচ্ছ, সাবলীল, বন্ধুদের প্রতি অকপট এবং শত্রুদের প্রতি দয়াশীল। আলী (রা.) মাহাত্দ্য শৌর্য-বীর্যের নিদর্শনস্বরূপ ছিলেন।'

মাসুদী বলেন, 'আল্লাহ তাঁহাকে যে গুণাবলি দ্বারা ভূষিত করেন, তাঁহার পূর্ববর্তী পরবর্তী (একমাত্র রাসুলে কারিম ছাড়া) অন্য কারো মধ্যে আমরা খুঁজিয়া পাইব না।' বস্তুত হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের মাধ্যমে খোলাফায়ে রাশেদিনের সমাপ্তি ঘটে।

হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে আরও পড়তে ক্লিক-



★★সমাপ্ত★★

 

সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন মানবতার সেবায়

অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url