সাহাবাগণের জীবনকথা- ৫|| হযরত আলী (রাঃ) এর দ্বীনি এলম, প্রজ্ঞা ও বীরত্বের অপূর্ব কাহিনী





হযরত আলী (রাঃ) এর দ্বীনি এলম, প্রজ্ঞা ও বীরত্ব



মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ঘনিষ্ঠ অনুসারী যে চারজন বিশেষ মর্যাদাবান সাহাবী খোলাফায়ে রাশেদীন হিসেবে মুসলিম উম্মার কাছে সম্মানিত, হযরত আলী (রাঃ) হলেন তাঁদের অন্যতম তিনি মহানবী (সাঃ) এর জামাতা তিনি যেমন ছিলেন বীর যোদ্ধা তেমনি ছিলেন জ্ঞানী বিদ্বান রাসূল (সাঃ) তাঁকেজ্ঞানের দরজাআখ্যায়িত করেন শৌর্য-বীর্যের জন্য তিনিআসাদুল্লাহআল্লাহর সিংহ ইয়াদুল্লাহআল্লাহর হাত উপাধিতে ভূষিত হন তিনি ৫৮৬টি হাদীস বর্ণনা করেন এবং তিরাশিটি সশস্ত্র জিহাদে বিজয় লাভ করেন


সাহাবীদের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ এবং আরবী ভাষা সাহিত্যে ছিলেন সুপন্ডিত অনন্য জ্ঞান প্রজ্ঞার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বিশেষ নৈকট্যে থেকে সূরা নাজিলের প্রেক্ষেতসহ আয়াতসমূহের অর্থ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ লাভ করেন তিনি তিনি আল কুরআনের অন্যতম সংকলক হযরত ওমর (রাঃ) কে হিজরত হতে মুসলিম সন গণনার পরামর্শ দেন তিনিই হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, আলী না হলে ওমর ধ্বংস হতো


আলী (রাঃ) এর অসাধারণ বাগ্মিতা সাহসিকতার কাছে সকল প্রতিদ্বন্দ্বীই হার মানতো তিনি ছিলেন সুকবি তাঁর কবিতার বিভিন্ন সংকলন হয়েছে দীওয়ান--আলী তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কাব্য সংকলন মুসলিম বিশ্বে তো বটেই, এর বাইরেও তাঁর কাব্য সমাদৃত হয়েছে সার্বজনীন কালোত্তীর্ণ বাণী শিল্পসৌন্দর্যে গ্রন্থ কালজয়ী


হযরত আলী (রাঃ) মানবিক সকল মহত গুণে কর্মে অত্যুজ্জ্বল এক মর্দে মুজাহিদ তাঁর অসাধারণ বিচারবুদ্ধি প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার ধৈর্য, বীরত্ব ত্যাগ সাধনা অতুলনীয় তিনি মানবতার মূর্তপ্রতীক

হযরত আলী (রাঃ) এর মতো এত সব বড় বড় মহত গুণে উজ্জ্বল ব্যক্তি আর নেই মুসলিম জাতির মর্যাদা গৌরব সমুন্নত করে রেখেছেন তিনি ইতিহাসে আলী (রাঃ) সত্যি-আলী এমন বিশাল মহত ব্যক্তির মহত্ত্ব কার্যাবলী যত বেশি আলোচনা করা যায়, যত বেশি প্রচার করা যায়, পাঠকগণ ততবেশি অনুপ্রাণিত উজ্জীবিত হবেন


উদ্দেশ্য সামনে রেখে হযরত আলী (রাঃ) এর অসাধারণ প্রজ্ঞা সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি, সাহসিকতা, বীরত্ব ত্যাগ-সাধনা, ন্যায় বিচার মানবতা বোধ সম্পর্কে টুকরো টুকরো কিছু চমকপ্রদ ঘটনা গল্পাকারে গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত দীওয়ান--আলী থেকে কয়েকটি কবিতা সংযোজন করে দেয়া হয়েছে কবিতার টুকরোগুলো মনিমুক্তার মতো উজ্জ্বল মূল্যবান উপদেশপূর্ণ আশা করি সবার ভালো লাগবে, বিশেষ করে তরুণ সমাজ প্রেরণা পাবেন


মহানবী (সা) এর বাণী

এক. আমি প্রজ্ঞার নগরী আর আলী তার তোরণ

দুই. হে আলী, তোমার সাথে আমার বন্ধন, তুমি আমার ভাই জগতে এবং পরজগতে

তিন. যে ব্যক্তি আমার বন্ধু সে আলীরও বন্ধু, আর যে আলীর বন্ধু সে আমারও বন্ধু

চার. আলী আমার একাংশ আর আমি আলীর একাংশ

পাঁচ. আলীর তলোয়ারের এক আঘাত আসমান জমিনের সবার ইবাদতের চেয়ে শ্রেয়

ছয়. হারুন যেমন মুসার প্রতিনিধি, আমার পক্ষ থেকে তুমিও সেরূপ প্রতিনিধি

পরিচয়: হযরত আলী (রাঃ) শৌর্যে-বীর্যে আশ্চর্য রকম দীপ্তিময় একটি নাম বিশ্বের ইতিহাসে অনেক জ্ঞানী-গুণী, ধ্যানী সাধক কবি সাহিত্যিক, রাষ্ট্রনায়ক, সাহসী সেনানায়ক বীর যোদ্ধা এবং আরো অনেক মহত গুণের অধিকারী ব্যক্তি রয়েছেন কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) এর মতো এত সব বড় বড় মহত গুণের উজ্জ্বল ব্যক্তি আর নেই তিনি অতুলনীয় আলী (রাঃ) সত্যি-আলী মুসলিম জাতির মর্যাদা এবং গৌরব সমুন্নত করে রেখেছেন ইতিহাসে


মহানবী (সাঃ) নবুওত প্রাপ্তির দশ বছর আগে হযরত আলী (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন প্রিয় রাসূল (সাঃ) এর রক্তের সাথে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আলীর পিতা আবু তালিব মুহাম্মদ (সাঃ) এর আপন চাচা সেই সূত্রে তিনি নবীজীর আপন চাচাতো ভাই তাঁর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ নবীজীর ফুফু

হযরত আলীর (রাঃ) জন্ম হয়েছিল কাবা ঘরে কারো কারো মতে কাবা শরীফের ভিতরে নয়, পাশে কোন হাশেমীর ঘরে তবে একথা সত্য যে, তাঁর জন্মস্থানে পবিত্র কাবা ঘরের ছোঁয়া ছিল এই পবিত্র পরশই ক্রমে তাঁর জীবনকে করেছে উজ্জ্বল মহান তাঁর নানার নাম ছিল আসাদ তাই তাঁর মাতা ফাতিমা ছেলের নাম রেখেছিলেন-আসাদ আসাদ অর্থ সিংহ বস্ত্তত হযরত আলীর জীবনী আলোচনা করলে এই নামের সার্থকতা উপলব্ধি করা যায় সিংহের মতোই তেজ আর শক্তি ছিল তাঁর

ছেলের আসাদ নামটি পিতা আবু তালিবের পছন্দ হয়নি ভাবলেন, তাঁর ছেলের নাম হবে আরো সুন্দর, আরো মিষ্টি কি দেয়া যায় নামতিনি ছেলের নাম রাখলেন-আলী । আলী শব্দের অর্থ-সমুন্নত

তাঁর ছেলে সমস্ত ভয়ভীতি, লোভলালসার ঊর্ধ্বে হিংসা ঘৃণা ছুবে না তাঁর পা ত্যাগে সাধনায় জ্ঞানে গুণে হবে অতুলনীয় । পিতার দেয়া নামেরও তিনি ছিলেন সার্থক রূপকার


শৈশবে আলী (রাঃ) এর পেট কিছুটা মোটা ছিল নিয়ে সমবয়সীরা তাঁকে যথেষ্ট হাসি ঠাট্টা করত তাতে তিনি মোটেও চটতেন না বরং তাদের হাসিপরিহাস যেন নিজেও উপভোগ করতেন আবু সাঈদ তামীমী বলেছেন, আমরা তাঁকে পেটমোটা বলে উপহাস করলে তিনি মোটেও রেগে যেতেন না, উল্টো পরিহাস করে বলতেন, হ্যাঁ, পেটটি আমার মোটাই বটে, তবে তা বেশি খাবার কারণে নয় এতে অনেক বিদ্যাবুদ্ধি আর ইলম জমা আছে বলেই এমন মোটা দেখাচ্ছে


মহানবী (সাঃ) আলীকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন একবার আবদুল্লাহ ইবন আববাস জিজ্ঞেস করেন, আববাস মহানবী (সাঃ) কয়জন পুত্র ছিলেন সবাই বাল্যকালে মারা গেছেন তবু কোনটিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন? হযরত আববাস (রাঃ) জবাব দেন-আলীকে আব্দুল্লাহ আবার বলেন, আববা, আমি তো তাঁর পুত্রদের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছি


হযরত আববাস বলেন, মহানবী (সাঃ) তাঁর পুত্রদের চেয়ে আলীকেই বেশি ভালবাসতেন তিনি বাইরে না গেলে আলীকে আমি অতি অল্প সময়ের জন্যেও তাঁর কাছ ছাড়া হতে দেখিনি আলী মহানবীর প্রতি যেরূপ অনুরক্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কোনো পুত্রকেও আমি পিতার প্রতি তত অনুরক্ত ভক্তি পরায়ণ দেখিনি


হযরত আলী (রাঃ) দশ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে মজার একটি ঘটনা আছে মহানবীর ঘরের দিকে চোখ পড়ে বালক আলীর চমকে ওঠলেন তিনি বিস্ময়ে বড় বড় চোখ করে তাকালেন এমন কান্ড আগে তিনি দেখেননি রাসূল (সাঃ) আর বিবি খাদিজা (রাঃ) তাঁদের কপাল মাটিতে ঠেকাচ্ছেন অথচ সামনে কেউ নেই, কিছু নেই সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রশংসা করছেন প্রার্থনা শেষ হলে আলী তাঁদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বিষয়টির কথা মহানবী (সাঃ) মধুর হেসে বললেন, আমরা এক আল্লাহর ইবাদত করেছি


তিনি তাঁকেও সত্যের ছায়ায় আসার পরামর্শ দিলেন এবার ভাবনায় পড়লেন আলী বাপদাদার ধর্ম মূর্তিপূজা ছোট থেকে দেখে আসছেন এখন বিনা চিন্তায় কি করে একে গ্রহণ করবেন? ইসলাম যে সত্যের কথা বলছে তা তিনি বুঝেছেন তবু কেমন একটা বাধো বাধো লাগে বাবাকে না জানিয়ে তো কিছু বলা যায় না তাই বাবার অনুমতি নেয়ার জন্য মহানবী (সাঃ) এর কাছে সময় চেয়ে নেন


মহানবী এবার ভাল করে বুঝালেন আলীকে বললেন, ব্যপারে কারো সাথে আলোচনা করা ঠিক হবে না তুমি নিজেই গভীরভাবে চিন্তা করো নিজের মন থেকেই উত্তর পেয়ে যাবে সত্যি সত্যিই তিনি উত্তর পেয়ে গেলেন তাঁর মনে পড়লো পিতার কথা পিতা আগেই বলেছিলেন, মুহাম্মদ (সাঃ) এর যে কোন আদেশ বিনাদ্বিধায় মেনে নেবে তাই পরেরদিন ভোরে তিনি মহানবী (সাঃ) এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন পঁচিশ বছর বয়সে হযরত আলী (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর আদুরে কন্যা ফাতিমাকে বিয়ে করেন ফাতিমার বয়স তখন পনের কি ষোল


হযরত আলী (রাঃ) আপন সত্তাকে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর সত্তার মধ্যে বিলীন করে দিয়েছিলেন তাঁর জীবন ছিল এক দর্পন স্বরূপ এই দর্পনের মধ্যে রাসূল (সাঃ) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই প্রতিফলিত হতো আল্লাহর রাসূলের সমগ্র রূপটি যদি কোনো মানুষের মধ্যে দেখার ইচ্ছে হয়, তবে হযরত আলীর চরিত্র এবং জীবন যাত্রার দিকে তাকাতে হবে


অপত্য স্নেহ আদর ভালবাসায় নবী (সাঃ) আলীকে লালন পালন করেন তাঁরই শিক্ষায় আলীর চরিত্র মহামানবীয় গুণে মাধুর্যমন্ডিত হয়ে ওঠে

হযরত আলী (রাঃ) খলিফা ছিলেন, সেনানায়ক ছিলেন, পন্ডিত ছিলেন, কবি ছিলেন, বাগ্মী ছিলেন এবং সব কিছুর উপরে তিনি ছিলেন মানুষ মানব গুণের চরম পরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল তাঁর মধ্যে

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের অপর এক সাফল্য আলীর মানস গঠন তাঁরই যতন্ন পরিশ্রম হাতের ছোঁয়া এবং সাধনার ফসল আলী (রাঃ) মানবতার গৌরব সাধনার পথে সিদ্ধির পথে অগ্রসর হতে হতে মানুষ এমন স্তরে উন্নীত হয় যখন হয়তো স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যে অন্তরাল থাকে না স্রষ্টা আপন সৃষ্টিতে গর্ববোধ করেন


রোম সম্রাটের প্রশ্নের জবাব

হযরত ওমর (রাঃ) খেলাফত কালে রোম সম্রাট কয়েকটি জটিল প্রশ্ন দূতের মাধ্যমে হযরত ওমর (রাঃ) এর কাছে পাঠান খলিফা প্রশ্নগুলো পাঠ করে বুঝতে পারলেন এর জবাব দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় তবে কে জবাব দিবেন? জবাব তো দিতেই হবে খলিফা সোজা চলে গেলেন হযরত আলীর (রাঃ) কাছে তাঁকে দেখালেন প্রশ্নগুলো হযরত আলী (রাঃ) প্রশ্নগুলো পাঠ করে তখনই খুব দ্রুত কাগজে জবাব লিখে খলিফার হাতে তুলে দেন খলিফা কাগজগুলো ভাঁজ করে দূতের হাতে দেন দূত জিজ্ঞেস করেন, জবাবদাতা কেহযরত ওমর (রাঃ) বলেন, আলী ইনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পিতৃব্যপুত্র, জামাতা এবং বন্ধু


মুক্তি পেয়ে গেল কয়েদী

ভাষা আল্লাহর এক অপরিসীম নিয়ামত মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে অন্যতম পার্থক্য ভাষা একই ভাষার একই শব্দের রয়েছে নানা রকম অর্থ মর্ম কখনো ব্যবহার হয় মূল অর্থে আবার কখনো ব্যবহার হয় রূপক অর্থে বক্তার ভাষার অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে ঘটে বিপদ ভাষার মারপ্যাঁচ বুঝতে না পালে শ্রোতার যেমন লজ্জা পেতে হয়, বক্তার ভাগ্যে ঘটে যায় জেল-হাজত বাস এমনি এক ঘটনা ঘটেছিল দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের সময়ে এক ব্যক্তি উপস্থিত হলো তাঁর দরবারে সে নির্ভীক চিত্তে খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বললো, নিশ্চয় আমি ফিতনাকে ভালোবাসি, হককে অপছন্দ করি এবং যা দেখিনি, তার সাক্ষ্য প্রদান করি 

সাংঘাতিক কথা!

সে আর যায় কোথায়!


এত বড় দুঃসাহস খলিফা ওমরের সামনে যাকে মহানবী (সাঃ) মুসলিম উম্মার মধ্যে আল্লাহর নির্দেশ পালনে কঠোরতম ব্যক্তি বলেছেন তাঁর সামনে থেকে কি এই ব্যক্তি রেহাই পেতে পারে? সে নিজেই তিনটি অন্যায়ের স্বীকৃতি প্রদান করছে প্রথম কথা, যে ফিতনাকে ভালোবাসে, যে ভালোবাসার কোনো প্রশ্নই ওঠতে পারে না দ্বিতীয় কথা, যে হক অপছন্দ করে, অথচ হককে পছন্দ করাই স্বাভাবিক তৃতীয় কথা, যে না দেখে সাক্ষ্য প্রদান করে, যা গুরুতর অন্যায় তাই খলিফা ওমর (রাঃ) তখনই তাকে বন্দী করে পাঠালেন কয়েদ খানায়


লোকটি তার বক্তব্যে কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করল না আবার খলিফাও স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন বিধায় কোনো রকম সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন মনে করা হলো না চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো সংবাদটা মহান খলিফা ওমর, যিনি সত্য প্রতিষ্ঠায় আর অন্যায় মিথ্যা দূরীকরণে বজ্রকঠোর তাঁর সামনে এমন নির্ভয় স্বীকারোক্তি করে লোকটা শুধু অন্যায়ই করেনি, এর জন্য শুধু জেল নয়, আরো কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার জনগণ তার সে কঠিন শাস্তির দিন গুনছে

মহাজ্ঞানী রহস্য উন্মোচনকারী সূক্ষ্মদর্শী হযরত আলী (রাঃ) শুনতে পেলেন ঘটনাটা তিনি সাথে সাথেই বুঝতে পারলেন লোকটির কথার মর্ম তিনি সোজা চলে গেলেন ওমরের দরবারে শুরু করলেন কথাবার্তা


হযরত আলী: হে আমীরুল মুমিনীন, আপনি অন্যায়ভাবে লোকটিকে বন্দী করেছেন

খলিফা: কেন? সে নিজ মুখে স্বীকার করেছে, একটি নয়, তিনটি অপরাধ করেছে

হযরত আলী: লোকটি বলেছে, আমি ফিতনাকে ভালোবাসী এর দ্বারা সে বুঝাতে চাচ্ছে যে, সে সম্পদ সন্তানকে ভালোবাসে কেন না, আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের সম্পদরাজি সন্তানাদি হচ্ছে ফিতনা লোকটি আরো বলেছে যে, সে হককে অপছন্দ করে কথার দ্বারা সে বুঝাচ্ছে যে, সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে যা অবশ্যই হক চিরসত্য কেন না, আল্লাহ বলেছেন, মৃত্যু যন্ত্রণা অবশ্যই আসবে তৃতীয় কথা, লোকটি বলেছে, আমি যা দেখিনি, তা সাক্ষ্য দিই একথার অর্থ হলো, সে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ আছেন এবং এক, অথচ সে তাঁকে দেখেনি

হযরত আলী (রাঃ) এর এই ব্যাখ্যা শুনে খলিফা ওমর (রাঃ) লোকটির কথার মর্ম বুঝতে পারলেন এবং তখনি চিৎকার দিয়ে বলে ওঠলেন, হায়! যদি না হতো আলী, তাহলে অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেতো ওমর এরপর কি আর লোকটি হাজতে থাকতে পারে? সাথে সাথেই সে মুক্তি পেল লোকমুখে চারদিকে প্রচারিত হতে লাগলো হযরত আলী (রাঃ) এর তত্ত্বজ্ঞান আর অসাধারণ বিচার ক্ষমার কথা।

বেশি খেলেন কে?


মহানবী (সাঃ) তখন মদীনায় একবার হাদিয়া হিসেবে কিছু খেজুর পেলেন সামনে উপস্থিত ছিলেন আলী (রাঃ) তাই মহানবী (সাঃ) আলীকে নিয়ে সেই খেজুর খাওয়া শুরু করলেন উভয়ে সম্পর্কে চাচাত ভাই হলেও একজন ছিলেন নবী আরেকজন উম্মত বয়সেও ছিল বিস্তর তফাত অন্য দিকে একজন ছিলেন শ্বশুর আর অন্যজন জামাতা

তাই ছোট ভাই জামাতা হযরত আলী (রাঃ) খুব লাজুকের মতো খেজুর খাচ্ছিলেন নবীজী (সাঃ) এর পাশে বসে কোনো দিকে খেয়াল নেই তাঁর খেয়েই চলেছেন একটি একটি করে আর বীচি রাখছেন সামনে

প্রিয় নবী (সাঃ) খেজুর খাচ্ছিলেন আর দেখছিলেন  আলী (রাঃ) এর অবস্থা যেন নিরামিষ খেজুর ভোজন অনুষ্ঠান তাই নবী (সাঃ) একটু কৌতুক হাসিখুশী করতে চাইলেন আলীর সাথে জন্য তিনি নিজের খাওয়া খেজুরের বীচিগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে রাখতে লাগলেন আলীর সামনে সমাপ্ত হলো খেজুর ভোজন পর্ব


নবীজী (সাঃ) এর সামনে বীচি নেই অথচ আলীর সামনে বীচির স্তূপ হযরত আলী কিন্তু এদিকে খেয়াল করেননি তাঁর চোখে ধরা পড়েনি বিষয়টি শুরু হলো কৌতুক

প্রিয় নবী (সাঃ) : যার সামনে খেজুরের বীচি বেশি, সেই খেয়েছে বেশি

প্রিয় নবীর একথা শুনে খেয়াল হলো আলীর

তিনি চেয়ে দেখলেন যে, কোনো বীচি মহানবী (সাঃ) এর সামনে নেই সব বীচি জমা হয়ে আছে তাঁর সামনে তিনি বুঝতে পারলেন রহস্য তবে একনজর দেখে নিয়েই তৎক্ষণাৎ তিনি জবাব দিলেন, যা ছিল বাস্তবভিত্তিক সূক্ষ্মজ্ঞানের পরিচায়ক রসেভরা মধুময় কৌতুক হলেও নবীজী (সাঃ) এর আদব রক্ষা করে উম্মতের কিভাবে কথা বলা উচিত, তাও কিন্তু আলী (রাঃ) ভুলে যাননি

আমরা হলে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে বলে ফেলতাম, আপনি বীচি রেখেছেন আমার সামনে, আবার আমাকে বলছেন, আমি বেশি খেয়েছি বা বলতাম, কেনো আমার সামনে বীচি রেখেছেন? যা নবীজী (সাঃ) এর মর্যাদার পরিপন্থী হয়ে যেতো হযরত আলী (রাঃ) এসব কোনো জবাব না দিয়ে নবীজী (সাঃ) যেমন সম্বোধনহীন প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, তেমনি তিনিও সম্বোধনহীন পরোক্ষ জবাব দিলেন অত্যন্ত ভদ্র বিনায়বনত কণ্ঠে:

আলী : যার সামনে বীচি নেই, তিনি বীচিসহই খেজুর খেয়েছেন

ভেবে দেখার বিষয়, প্রশ্ন ছিল বেশি খাওয়া নিয়ে আর উত্তর হলো বীচিসহ খাওয়া নিয়ে হয়তো আলী (রাঃ) বেশি খেয়েছিলেন তাই তিনি পাশ কাটিয়ে গেলেন

জন্য কে রাখলো বীচি বা নবীজী (সাঃ) এর খাওয়া বীচি কোথায় গেল, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না আলী অথচ কৌতুকের জবাব কৌতুকসুলভই হলো ওদিকে নবুওতী মর্যাদার খেলাফও হলো না

আলী (রাঃ) এমন সুসংহত জবাব দিবেন তাৎক্ষণিকভাবে তা হয়তো নবীজী (সাঃ) ভাবতে পারেননি তাই বিস্ময়ে তিনি আলীর দিকে চেয়ে, হাসতে লাগলেন স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি

প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই গেল- বেশি খেয়েছেন কে?


জুলফিকার পেলেন উপহার

বদরের যুদ্ধ

মুসলমান আর কাফিরদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ

মুসলমানদের সংখ্যা খুব কম আনসার আর মুহাজির মিলে সাকল্যে ৩১৩ জন শত্রুপক্ষের শক্তি অনেক তিনশ ঘোড়সওয়ার আর উষ্ট্রারোহী সাতশ উভয় পক্ষ মুখোমুখি স্থান বদর প্রান্তর

সেকালে আরবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে দুপক্ষের শ্রেষ্ঠ বীরদের মধ্যে থেকে প্রথমে দ্বন্দ্বযুদ্ধ হতো

কুরায়েশদের পক্ষ থেকে তিনবীর- উৎরা, শায়বা ওলিদ মাঠে নামলো

মুসলমানদের পক্ষ থেকে এগিয়ে এলেন হামযা, উবায়দা হযরত আলী (রাঃ)

বীরে বীরে শুরু হলো যুদ্ধ

দ্বন্দ্বযুদ্ধ ভীষণ রকম অবস্থা

আলীর হাতে নিহত হলো ওলিদ

হামযা হত্যা করলেন উৎবাকে

প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেও শায়বার হাতে শহীদ হলেন উবায়দা (রাঃ)

এবার আলীর রক্ত টগবগিয়ে উঠলো

তিনি আল্লাহ আকবার বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন

মল্লযুদ্ধ শুরু হলো শায়বার সাথে

কিন্তু মহাবীর আলীর সাথে শায়বার তুলনা?

অল্পক্ষণের মধ্যে শায়বার ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেললেন মহাবীর আলী

এবার যুদ্ধের মোড়টাই ঘুরে গেল

আবু জেহেল এতক্ষণ যুদ্ধের দৃশ্য দেখতে ছিল এবার সে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো

মুসলিম বাহিনী সংখ্যায় অল্প হলেও হযরত আলী (রাঃ) এর বিক্রম কৌশলে আয়ত্তে এসে গেল জয়ী হলো মুসলিম বাহিনী

জয়ের পেছনে যাঁর বীরত্ব ভূমিকা অনন্য তিনি শের--খোদা হযরত আলী (রাঃ) যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করার কারণে রাসূলে করীম (সাঃ) হযরত আলীকে তাঁর জুলফিকার তরবারিটি উপহার দেন

রাসূল (সাঃ) এর নিকট থেকে তরবারি উপহার পাওয়া মানে অতুলনীয় সম্মান উৎসাহ পাওয়া


ওহুদ প্রান্তরে

বদরের যুদ্ধে পরাজিত কুরায়েশদের চোখে ঘুম নেই তাদের গায়ে জ্বালা ধরে গেছে পরাজয়ের অপমানে তারা অধীর অস্থির কিভাবে প্রতিশোধ নেয়া যায়, কিভাবে মুসলমানদের দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা যায়, সে চিন্তায় তাদের চোখে ঘুম নেই

আবু সুফিয়ান সৈন্য আর অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লো শেষমেশ তারা তিন হাজার সৈন্যের এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে মদীনার দিকে অগ্রসর হলো

মহানবী (সাঃ) এর তত্ত্বাবধানে মুসলিম বাহিনীও সংঘবদ্ধ হলো সংখ্যা তাঁদের মাত্র সাতশ

ওহুদ নামক স্থানে শত্রুর সামনে এসে দাঁড়ালো তারা শুরু হলো দ্বন্দ্বযুদ্ধ

বিখ্যাত বীর তালহা কুরায়েশদের পক্ষে

আর মুসলমানদের মহাবীর আলী (রাঃ)

আলী (রাঃ) তো একাই একশ

তাঁর সামনে তালহা তো একটা খড় কুটো

আলীর বিক্রমে অবাক হয়ে যায় সবাই

পরাজয় হলো তালহার এবার কুরায়েশরা সদলবলে পড়লো ঝাঁপিয়ে মুসলিমদের ওপর প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শত্রুর আঘাতে আলীর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে তবু অপরাজেয় এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে হিসেবে একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল মুসলমানদের মুসলিম বাহিনীর ঠিক পিছনে ছিল ওহুদ পাহাড় সেই পাহাড়ের একটা গিরিপথ ছিল এই বিপদের কারণ যুদ্ধের শুরুতেই মহানবী (সাঃ) সেখানে মোতায়েন করলেন একদল তীরন্দাজ হুকুম দিলেন পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেনো না সরে প্রচণ্ড যুদ্ধ যখন কুরায়েশ বাহিনী পিঠ দেখিয়ে পালাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই সেই তীরন্দাজ বাহিনী জয় নিশ্চিত জেনে গনিমত কুড়ানোর জন্যে নেমে পড়লো ময়দানে

আর যাবে কোথায়?

মহাবীর খালিদ, যিনি তখনো মুসলমান হননি, ছোট একটা বাহিনী নিয়ে সেই গিরিপথ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুসলমানদের ওপর

সময়ে খবর রটলো রাসূল (সাঃ) আর নেই

মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারলো ছুটতে শুরু করলো সময়ে কয়েকজন মাত্র সাহাবী নিজেদের জীবন বাজি রেখে মহানবী (সাঃ) এর চারদিক ঘিরে শত্রুপক্ষের আঘাত হজম করে নবীজীকে হেফাজত করছিলেন হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন সাহাবীদের একজন তাঁর বাহুবলে শত্রুরা পালাতে শুরু করলো তাঁর সেদিনের সেই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ দেখে উভয় পক্ষ অবাক হয়ে গিয়েছিল

শুধু বদর আর ওহুদে নয়, তিরাশিটি সশস্ত্র জিহাদে বিজয় লাভ করেন আলী (রাঃ)


লৌহ কবাট হলো ঢাল

খয়বর যুদ্ধ চলছে ইসলামের বড় দুশমন ইহুদিদের সঙ্গে কঠিন যুদ্ধ শত্রুদের অবস্থান মজবুত খাঁটিতে দুর্গের ভিতরে দুর্গের দরজার কবাট ভারি মজবুত আর ভীষণ ভারী কেউ না খুলতে পারছে না পারছে ভাঙতে রাসূল (সাঃ) প্রথম মুসলিম বাহিনীর পতাকা দিয়ে ছিলেন হযরত ওমরের হাতে তিনি একদল সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলেন কিন্তু বিজয় অর্জন করতে পারলেন না ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলন তারপর হযরত আবু বকর (রাঃ) এর নেতৃত্বে মুজাহিদদের পাঠালেন তুমুল যুদ্ধ করলেন কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন তারপর আবার হযরত ওমর (রাঃ) সৈন্য সামন্ত নিয়ে গেলেন প্রাণপণ যুদ্ধ করলেন কিন্তু এবারও দুর্গ অজেয় রয়ে গেল

রাসূল (সাঃ) সংবাদ শুনে বললেন, আগামীকাল আমি এমন একজন বীরের হাতে পতাকা দেবো, যে ঘুরে ঘুরে শত্রুর ওপর হামলা চালায় এবং পলায়ন করে না আল্লাহও তাঁর রাসূল তাঁকে ভালোবাসেন এবং সে আল্লাহ রাসূলকে (সাঃ) ভালোবাসে আল্লাহ তাঁকে বিজয় না দেয়া পর্যন্ত সে ফিরে আসবে না

হযরত আবু বকর হযরত ওমরের বাসনা ছিল যে আল্লাহ তাঁর রাসূলের সেই বিশেষ প্রিয়তম ব্যক্তিটি তাঁদের একজন হবেন হযরত সাদ বিনীতভাবে এসে রাসূলের সামনে দাঁড়ালেন যাতে রাসূলের (সাঃ) দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ে

মুমিনের কাছে আল্লাহ তাঁর রাসূলের (সাঃ) প্রিয় হওয়ার চেয়ে লোভনীয় আর কি আছে? যে কাজটি করলে আল্লাহ তাঁর রাসূল (সাঃ) ভালোবাসেন সে কাজটি করতে কে এগিয়ে যেতে না চায়? সাহাবীরা কখনো কেউ নেতৃত্বের লোভ করতেন না হযরত ওমর (রাঃ) এরও লোভ ছিল না কিন্তু তিনি একদিনের নেতৃত্ব পাওয়ার লোভ করেছিলেন এই একদিন ছিল সেইদিন যেদিন রাসূলের (সাঃ) মুখ থেকে শুনেছিলেন, যে ব্যক্তি পতাকা হাতে নিবে, সে হবে আল্লাহ তাঁর রাসূল (সাঃ) এর প্রিয় বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ফিরে আসবে না

একি চাট্টিখানি খুশি আর গৌরবের কথা! তো পরম আর চরম আনন্দের সংবাদ পরিপূর্ণ সফলতার ঘোষণা সবাই দারুন আগ্রহ আর উত্তেজনায় রাত কাটালেন সবার মন উচাটন টান টান অবস্থা সকালে রাসূল (সাঃ) কার হাতে যে পতাকা দেন!

রাত পোহালো ফজরের পর

রাসূল করীম (সাঃ) না ডাকলেন আবু বকর (রাঃ) কে, না ডাকলেন ওমর (রাঃ) কে সাদকেও ডাকলেন না ডাকলেন হযরত আলী (রাঃ) কে হযরত আলী (রাঃ) তখন চুরোগে আক্রান্ত ছিলেন প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর চোখে মুখে থুথু দিলেন তখনই তাঁর চোখ রোগমুক্ত হলো এরপর সারা জীবনে আর কখনো তাঁর চোখে রোগ ব্যথা বেদনা হয়নি

এরপর তিনি আলী (রাঃ) এর হাতে পতাকা তুলে দিলেন নিজের লৌহ বর্ম তাঁকে পরিয়ে দিলেন এবং জুলফিকার তরবারী হাতে ধরিয়ে দিয়ে দোআ করলেন : হে আল্লাহ, শৈত্য উত্তাপ তোমার নিয়ন্ত্রণে আজ উভয়টি যেনো অনুকূলে থাকে

হযরত আলী (রাঃ) বলেন, সেদিন থেকে আমার ওপর উত্তাপও শৈত্যের কোনো প্রভাব পড়েনি আমি গ্রীষ্মকালেও গরম কাপড় পড়েছি এবং শীতকালেও পাতলা কাপড় পরে বাইরে ঘুরাফেরা করেছি

এরপর হযরত আলী (রাঃ) দ্রুত খয়বর দুর্গের দিকে অগ্রসর হলেন মুজাহিদ বাহিনীর শেষাংশ পৌঁছার আগেই তিন সেখানে গিয়ে  পৌঁছলেন তিনি দুর্গে পৌঁছার সাথে সাথে ইহুদিরা তাঁকে আক্রমণ করে পূর্বের চেয়ে অধিক শক্তি নিয়ে তারা ভীষণভাবে মুসলিম বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক সময় আলী (রাঃ) এর হাতের ঢাল মাটিতে পড়ে যায় তিনি মাটি থেকে ঢাল আর হাতে তুলে নিলেন না দুর্গের কবাট ধরে এক হেঁচকা টান মেরে কবাট খুলে ফেললেন এবং সেই কবাট হাতে ধরে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন এরপর এক পর্যায়ে সেই ভারী লৌহ কবাট পিটের ওপর রেখে মুসলিম বাহিনীর দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করার সিঁড়ি পথ তৈরি করে দিলেন মুসলিম বাহিনী সেই সিঁড়ি পথে দ্রুত দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করলেন

খয়বর দুর্গ বিজিত হলো দুর্গের ভিতরে ইহুদিদের পতাকার পরিবর্তে মুসলিম বাহিনীর কালেমা খচিত পাতাকা পতপত করে উড়তে লাগলো

হযরত রাফে বর্ণনা করেন, যুদ্ধের কাজ সেরে হযরত আলী (রাঃ) দুর্গের সেই ভারী লৌহকবাট অনেক দূরে ছুঁড়ে মারেন আমরা সাত ব্যক্তি অনেক চেষ্টা করেও সেই লৌহ কবাটটি একটুও নাড়াতে পারিনি এই ঘটনা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য ভাষায় মূর্ত হয়েছে এভাবে :

খয়বরজয়ী আলী হায়দার, জাগো জাগো আর বার

দাও দুশমন দুর্গ বিদারী দুধারী জুলফিকার॥

এসো শেরে-খোদা ফিরিয়া আরবে ডাকে মুসলিম ইয়া আলী রবে

হায়দরী-হাঁকে তন্দ্র-মগনে করো করো হুঁশিয়ার॥

আল বোর্জের চূড়া গুঁড়া করা গোর্জ আবার হানো,

বেহেশতী সাকী,মৃত জাতিরে আবে কওসার দানো॥

আজি বিশ্ববিজয়ী জাতি যে বেঁহোশ, দাও তারে নব কুয়ত জোশ, এসো নিরাশার মরুধূলি উড়ায়ে দুলদুল আসওয়ার॥


বাচ্চা  ডিম প্রসবকারী প্রাণী

এক দুষ্টলোক হযরত আলী (রাঃ) এর অগাধ জ্ঞানের জন্য খুব হিংসা করতো এত হিংসা যে, তা নিয়ে সে দিনে কোনো কাজ করতে পারতো না এবং রাতে ঘুমাতে পারতো না তার মাথায় এক চিন্তা কিভাবে আলীকে ঠেকানো যায় সে নানা রকম ফন্দি আঁটতো কিন্তু কোনো কিছুতে তার সঙ্গে পেরে উঠতো না

সে অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটি প্রশ্ন তৈরি করলো প্রশ্নটি হলো, কোন কোন প্রাণী বাচ্চা দেয়, আর কোন কোন প্রাণী ডিম দেয়

ছোট্ট প্রশ্ন কিন্তু জবাবটা অত সহজ নয়

দুনিয়ার কত দেশে কত প্রাণী আছে তার ইয়ত্তা নেই সবপ্রাণী সম্পর্কে জ্ঞান থাকা চাট্টিখানি কথা নয় আর বাচ্চা প্রসবকারী ডিম প্রসবকারী প্রাণীর শ্রেণী ভাগ করতে হলে অনেক সময় গবেষণার প্রয়োজন দুচারদিন বা দুচার মাসের কাজ নয় কয় বৎসর লাগবে কে জানে এই একবিংশ শতাব্দীতেও প্রাণীতত্ত্ববিদগণ দুনিয়ার সব প্রাণী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি আজও সমুদ্রগর্ভে, দুর্ভেদ্য পাহাড় জঙ্গলে এবং মাটির নিচে অনেক অজানা প্রাণী আছে দুষ্ট লোকটা জানতো যে হযরত আলী (রাঃ) কোনো প্রার্থীকে তার প্রার্থনা পূর্ণ না করে কোনো কাজে যান না সে জ্ঞান প্রার্থী হোক, আর ধনপ্রার্থী হোক

তাই লোকটা উক্ত প্রশ্ন আলীর কাছে জিজ্ঞেস করার জন্য একটা সময়ও বেছে নিলো আসরের নামাযের পূর্ব মুহূর্ত সময়ে প্রশ্ন করলে অত অল্প সময়ে উত্তর দিতে পারবে না আর উত্তর দিতে না পারলে নামাযও পড়তে পারবে না নামায হবে কাযা

একদিন হযরত আলী আসরের নামায পড়ার জন্য তাহরিমা বাঁধার জন্য কানের কাছে হাত উঠিয়েছেন, ঠিক তখনই লোকটা তাকে প্রশ্ন করে বসলো : আচ্ছা বলুন তো, কোন কোন প্রাণী ডিম প্রসব করে আর কোন কোন প্রাণী প্রসব করে বাচ্চা?

লোকটার বিশ্বাস, আলী (রাঃ) শুধু ধর্মের কথা জানেন, জিহাদের কৌশল খিলাফত পরিচালনার জ্ঞান রাখেন দুনিয়ার এত সব প্রাণীর খোঁজ খবর রাখবেন কি করে? আর যদিও কোনক্রমে জবাব দেনই, তবে হাজার হাজার প্রাণীর শ্রেণীমত সাজিয়ে তাদের নাম বলতে বলতে আলীর নামায কাযা হয়ে যাবে নিশ্চয় নামায কাযা হলে তিনি মনে খুব কষ্ট পাবেন তাঁর মনে এতটুকু কষ্ট লাগানো কম কথা নাকি?

প্রশ্নকারী অপেক্ষা করতে যাওয়ার আগেই আলী সেই সদাহাস্য মুখটার দিকে একনজর তাকালেন কানের কাছে যে হাত দুটি তুলেছিনে সে হাত তেমনি রেখে মুখে বললেন :  যে সব প্রাণীর শরীর থেকে কান বেরিয়ে পড়া তারা দেয় বাচ্চা, আর যে সব প্রাণীর কান শরীরের ভেতরে প্রবিষ্ট তারা দেয় ডিম, আল্লাহু আকবর বলেই নামায আরম্ভ করলেন

জবাবটি আরবী ভাষায় এতো সংক্ষিপ্ত ছিল যে কুচক্রী লোকটি কূটকৌশল একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় সে মুখ চুন করে চলে গেল

জন্যই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, আমি হলাম জ্ঞানের শহর আর আলী তার দরজা

দুই খলিফা হতবাক

একদা হযরত ওমর, হযরত ওসমান এবং আলী একটি রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিন জনই ছিলেন পরস্পর পাশাপাশি কেউ কারো আগে বা পিছে নয় ওমর ওসমান দুজন ছিলেন দুপাশে মাঝখানে ছিলেন আলী

চলতে চলতে আলাপচারিতার ফাঁকে হযরত ওমর লক্ষ্য করলেন তাঁদের দুজনের মধ্যে আলী খাটো হওয়ার কারণে আরবী লানা শব্দের নূন-এর মতো দেখাচ্ছে হযরত ওমর হযরত ওসমান যথাক্রমে লাম আলিফের মতো লম্বা

হযরত ওমর তাই হযরত আলীকে কৌতুক করে বলতো : আরে তুমি তো লানা-এর নুন বর্ণের মতো আকারে ছোট কৌতুকটি করতে যতটুকু দেরি হলো ওমরের, জবাব দিতে অতটুকু দেরি হলো না আলীর (রাঃ)

হযরত আলী তখনই জবাব দিলেন : যদি না থাকি আমি তবে অবশ্য আপনারা দুজন হয়ে যাবেন লা, না অর্থাৎ কিছুই না আরবী লানা শব্দের নূন বর্ণ বাদ দিলে লাম আলিফ যুক্ত হয়ে লা হয় যার অর্থ নেই আমার অস্তিত্ব ব্যতীত আপনারা দুজনই অস্তিত্বহীন, হাসতে হাসতে বলেন আলী (রাঃ)

কৌতুকের জবাব দিলেন কৌতুক দিয়ে কৌতুকের শাব্দিক মারপ্যাঁচে প্রতিপক্ষ হলেন অস্তিত্বহীন তাৎক্ষণিকভাবে এমন জবাবের জন্য ওমর ওসমান কেউ প্রস্তুত ছিলেন না তারা ভাবতেই পারেননি বলবেন আর কি! শব্দের জালে আটকা পড়ে গেলেন তারা

তারা হতবাক হয়ে গেলেন দুজনের চারটি বড় বড় চোখ গিয়ে পড়লো হযরত আলী (রাঃ) এর উপর

অগ্নিপূজারি হলো লাজবাব

একবার খলিফা হযরত ওমরের (রাঃ) দরবারে উপস্থিত হলো এক অগ্নিপূজক সে খলিফার কাছে প্রশ্ন করলো, তোমাদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন সত্য কি না?

খলিফা বললেন, হ্যাঁ, সত্য

অগ্নিপূজক বললো-তোমাদের ধর্মগ্রন্থে আছে কাফিরদের কবরে সকাল সন্ধ্যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হয়

এরপর সেই লোকটি তার পকেট থেকে বের করলো মাথার দুটি খুলি খুলি দুটি দেখিয়ে সে বললো, এটি আমার পিতার মাথার খুলি আর এটি আমার ভাইয়ের মাথার খুলি যদি তোমাদের ধর্মগ্রন্থের কথা ঠিক অর্থাৎ সত্য হয়, তবে আমার পিতা ভাইয়ের মাথার খুলি আগুনের তাপে গরম থাকার কথা অথচ খুলি দুটি শীতল কেন?

খলিফা অগ্নিপূজারির প্রশ্ন কথা শুনে লোক পাঠালেন হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে তাকে ডেকে আনার জন্য হযরত আলী (রাঃ) এসে উপস্থিত হলেন দরবারে খলিফা তখন তাকে অনুরোধ করলেন অগ্নিপূজারির প্রশ্নের জবাব দিতে

খলিফার কথা শুনে আলী (রাঃ) বুঝতে পালেন মূল বিষয় কুরআন হাদীসের পরিবর্তে এখানে যৌক্তিক উত্তর হচ্ছে প্রণিধানযোগ্য তা বুঝতে তাঁর মুহূর্তও দেরি হলো না

হযরত আলী (রাঃ) তৎক্ষণাৎ একটি হাতুড়ি একখণ্ড লৌহ এনে অগ্নিপূজকের সামনে রেখে বললেন, এই লোহার উপর হাত রাখুন অগ্নিপূজক লোহার উপর হাত রাখলো হযরত আলী (রাঃ) এবার প্রশ্ন করলেন, কি মনে হচ্ছে? লোহা গরম না ঠাণ্ডা?

একেবারে ঠাণ্ডা

এরপর হযরত আলী (রাঃ) হাতুড়ি দিয়ে লোহাখণ্ডের উপর কয়েকবার খুব জোরে আঘাত করলেন হাতুরির আঘাতে লোহার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো এবার আলী (রাঃ) অগ্নিপূজারিকে বললেন, লোহাতে হাত রাখুন

সে লোহাতে হাত রাখলো

আলী (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এবার কি মনে হচ্ছে? লোহা ঠাণ্ডা না কি গরম?

* ভীষণ গরম

* এই লোহা খণ্ড পূর্বে ছিল ঠাণ্ডা, এখন এতে আগুন এলো কোথা থেকে?

প্রশ্ন শুনে অগ্নিপূজক লা জবাব একদম বোকা হয়ে গেল সে কোনো জবাবই দিতে পারলো না এবার হযরত আলী (রাঃ) জবাব দেয়া শুরু করলেন লোহার মধ্যে যে স্রষ্টা অগ্নি রেখেছেন, যদিও আমরা বুঝতে পারি না, সেইরূপ স্রষ্টা তাঁর অসীম কুদরতে এই দুজনের মাথার খুলিতে অগ্নি রেখে দিয়েছেন, অগ্নি জ্বালিয়ে রেখেছেন এবং সেই অগ্নি সর্বদা জ্বলছে আর জ্বলছে, দাউ দাউ করে জ্বলছে, যদিও আমরা তা অনুভব করতে পারছি না

এই জ্ঞানগর্ভ উদাহরণ উত্তর শুনে তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করলো অগ্নিপূজক এবং বাধ্য হলো মেনে নিতে-আল কুরআন হচ্ছে অবশ্যই সত্য

এখানে খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর একটি দোয়া বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : আমাদের এখানে কোনো কঠিন মাসআলা এস গেল, অথচ আলী সেখানে নেই, এমন যেনো আল্লাহ না করেন


হযরত আলী (রাঃ): এক মহাবীরের উপাখ্যান

৪০ হিজরির একুশে রমজান সব-হারানোর বেদনায় গোটা বিশ্ব জগত যেন ব্যথিত, প্রকৃতি যেন নির্জীব, অচল, স্পন্দনহীন ইয়াতিম, বঞ্চিত আর মজলুমের মর্মভেদী কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত! যে অবিস্মরণীয় নিষ্পাপ-ফুলেল সত্তা হিজরি-পূর্ব ২৩ সনের ১৩ই রজব পবিত্র কাবা ঘরে জন্ম নিয়ে তাঁর বহুমুখী সৌরভে অতুলনীয় সব গুণের ছোঁয়ায় বারে বারে ইসলামকে দিয়েছে নব-জীবন এবং টিকিয়ে রেখেছিল ইসলামের প্রকৃত প্রাণ চেতনা সেই পবিত্র ব্যক্তিত্বের শাহাদত শোক-সাহারায় তুলেছে অনন্ত মাতম! প্রায় ১৪০০ বছর ধরে মুমিনের চোখে রক্ত-অশ্রু-ঝরাচ্ছে এই রাত! কিন্তু সে রাতে বিশ্বনবী (সাঃ) পর হেদায়াতের উজ্জ্বলতম প্রদীপ অসময়ে চিরতরে নির্বাপিত হলেও মানুষের অন্তরে তিনি আজো অমর, অক্ষয় এবং ঈমানের অফুরন্ত শক্তির উৎস !

একুশে রমজান পৃথিবী হারিয়েছিল বিশ্বনবী-(সাঃ) শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি শ্রেষ্ঠ অনুসারীকে, হারিয়েছিল বিশ্বনবী (সাঃ) জ্ঞান-নগরীর মহাতোরণকে, হারিয়েছিল রাসূল (সাঃ) পর সবচেয়ে দয়ালু উদার আত্মার অধিকারী মানুষ এবং হেদায়াতের উজ্জ্বলতম প্রদীপকে সেদিন মুসলিম বিশ্ব তার অত্যন্ত দুঃসময়ে হারিয়েছিল সাধনা আধ্যাত্মিক পূর্ণতার সর্বোত্তম আদর্শকে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সাঃ) নিজ হাতে গড়ে তোলা ইসলামের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি সবচেয়ে আপোষহীন নেতাকে কিন্তু অকাল-মৃত্যু সত্ত্বে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের স্বর্গীয় আলোকোজ্জ্বল প্রভা যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পরতে পরতে আদর্শ মুমিনের কর্মতৎপরতার গভীরে অতুলনীয় ক্রমবর্ধমান প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে ।ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতে, আলী (রাঃ) ছিলেন যুবকদের জন্য বীরত্ব সাহসিকতার আদর্শ, সরকার-প্রধানদের জন্য ন্যায়বিচারের আদর্শ, ইবাদত, খোদাপ্রেম ভারসাম্যপূর্ণ অনাড়ম্বর জীবনের জন্য সব মুমিন মুসলমানের জন্যই আদর্শ তাঁর মুক্তিকামীতা বিশ্বের সব মুক্তিকামীর আদর্শ এবং প্রজ্ঞাময় বক্তব্য চিরস্মরণীয় উপদেশগুলো আলেম, বিজ্ঞানী, দার্শনিক চিন্তাবিদদের জন্য আদর্শ

আলী (রাঃ) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব নদী-দখলকারী শত্রুরা যার বাহিনীর জন্য নদীর পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে সেই শত্রুদের পরাজিত করার পরও তিনি ওই নদীর পানি কোনো শত্রুর জন্য নিষিদ্ধ করেননি জালিমদের বিরুদ্ধে আলী (রাঃ) সবচেয়ে কঠোর হলেও তিনি ব্যক্তিগত ক্রোধের বশে নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাদের ওপর আঘাত হানতেন

সিফফিনের যুদ্ধের প্রাক্কালে উভয়পক্ষের লোকক্ষয় এড়ানো বিদ্রোহীদের সুপথে আনার জন্য তিনি এত বেশী অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেছিলেন যে, সে সময় শত্রুরা প্রচারণা চালিয়েছিল যে মহাবীর আলী (রাঃ) মৃত্যুকে ভয় পান! অথচ শাহাদত ছিল তাঁর কাছে এতটা প্রিয় যতটা প্রিয় শিশুর কাছে মাতৃস্তন তিনি খিলাফত লাভের পর সব সাহাবির জন্য সরকার-প্রদত্ত ভাতা সমান করে দিয়ে রাসূল (সাঃ) সুন্নাত পুন:প্রবর্তন করেছিলেন আলী (রাঃ) সর্বত্র প্রকৃত ইসলাম ন্যায়-বিচার কায়েমের তথা সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলেই সুবিধাবাদী, মুনাফিক এবং স্বল্প-জ্ঞানী ধর্মান্ধ বিভ্রান্ত শ্রেণীগুলো তাঁর শত্রুতে পরিণত হয় সত্যের পথে অবিচল থাকলে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেতা তাঁকে ত্যাগ করবেন বলে তিনি জানতেন কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ন্যায়-বিচারের পথ ত্যাগ করেননি ফলে শাহাদতের উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন হযরত আলী (রাঃ)

একদল সরলমনা ধর্মান্ধ ব্যক্তি দুনিয়াপুজারী ক্ষমতালোভীদের প্রতারণার শিকার হয়ে হযরত আলী (আঃ) মতো নিষ্পাপ মুমিনকেও কাফের বলে ঘোষণা দেয়! ইতিহাসে এই শ্রেণী খারেজী বলে খ্যাত এই খারেজীদেরই অন্ধ অনুসারী ইবনে মুলজেম আল আশআসসহ আলী (রাঃ) চরম বিদ্বেষী কয়েক ব্যক্তির ষড়যন্ত্রে শরীক হয় ইবনে মুলজেম ১৯ শে রমজানের ফজরের নামাজের সময় সিজদারত অবস্থায় হযরত আলী (রাঃ) শির মোবারকে বিষাক্ত তরবারির আঘাত হানে আঘাতে আহত আমীরুল মুমিনীন ২১শে রমজানের রাতে শাহাদত বরণ করেন এবং শেষ হয়ে যায় চার বছর নয় মাসের খেলাফত তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩

হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য হল হারুন (রাঃ) নবী ছিলেন, তুমি নবী নও

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগরী, আলী তার দরজা, যে কেউ আমার জ্ঞানের মহানগরীতে প্রবেশ করতে চায় তাকে দরজা দিয়েই আসতে হবে

মহানবী (সাঃ) আরো বলেছেন, হে আম্মার! যদি দেখ সমস্ত মানুষ একদিকে চলে গেছে, কিন্তু আলী চলে গেছে অন্য দিকে, তবুও আলীকে অনুসরণ কর, কারণ, সে তোমাকে ধ্বংসের দিকে নেবে না

বিশ্বনবী (সাঃ) আরো বলেছেন, আমি আলী থেকে, আর আলী আমার থেকে, যা কিছু আলীকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা কিছু আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকে কষ্ট দেয়

হে আলী! ঈমানদার কখনও তোমার শত্রু হবে না এবং মোনাফেকরা কখনও তোমাকে ভালবাসবে না

অনেক সাহাবী হাদিসের ভিত্তিতেই মোনাফেকদের সনাক্ত করতেন

রাসূলে পাক (সাঃ) স্ত্রী বিবি আয়শা হযরত আলী (আঃ) শাহাদতের খবর শুনে বলেছিলেন,

হে রাসূল! তোমার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র শাহাদত বরণ করেছেন আজ এমন এক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন যিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ) পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ

আর এইসব বাণী থেকে এটা স্পষ্ট যে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (.) ছিলেন বিশ্বনবী (সাঃ) পর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব

হযরত আলী (রাঃ) আকাশ-ছোঁয়া বীরত্ব মহত্ত্বে অমুসলিম পণ্ডিতরাও অভিভূত হতবাক হয়েছেন আর ডি ওসবোর্ন বলেছেন, আলী (.) ছিলেন মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বোত্তম আত্মার অধিকারী সর্বোত্তম ব্যক্তি

ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন, সব ধরনের নীচতা কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে আলী (রাঃ) ছিল মহত সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রীক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন

ঐতিহাসিক মাসুদির মতে, রাসূল (সাঃ) চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন আলী (রাঃ)

শাহাদত-প্রেমিক আলী (রাঃ) যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তাঁর সঙ্গীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, সবাই কাঁদছে, চারিদিকে ক্রন্দনের শব্দ, কিন্তু আলী (রাঃ) এর মুখ হাস্যোজ্জ্বল তিনি বলছেন, আল্লাহর শপথ! আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে, ইবাদতরত অবস্থায় শহীদ হব?

ঘাতকের প্রাণঘাতী আঘাতে ধরাশায়ী আমিরুল মুমিনিন ঘটনা নিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা অবিচার না করার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন,

আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানেরা তোমরা এমন যেন না কর, যখন আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেব তখন মানুষের উপর হামলা করবে অজুহাতে যে, আমীরুল মুমিনীনকে শহীদ করা হয়েছে অমুকের এটার পেছনে হাত ছিল, অমুক কাজে উৎসাহিত করেছে এসব কথা বলে বেড়াবে না, বরং আমার হত্যাকারী হল এই ব্যক্তি


আলী (রাঃ) ইমাম হাসান (রাঃ) কে বলেছিলেন,

বাবা হাসান! আমার মৃত্যুর পর যদি চাও আমার হত্যাকারীকে মুক্তি দেবে তাহলে মুক্তি দিও, যদি চাও কিসাস গ্রহণ করবে তাহলে লক্ষ্য রাখবে, সে তোমার পিতাকে একটি আঘাত করেছে, তাকেও একটি আঘাত করবে যদি তাতে মৃত্যুবরণ করে তো করল, নতুবা ছেড়ে দেবে

হযরত আলী (রাঃ) নিজেকে সব সময় জনগণের সেবক বলে মনে করতেন এবং সব সময় অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব বলেছেন, আলী ইবনে আবি তালিবের মতো আরেকজনকে জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নারীকূলের কারো নেই, আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত

হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, আলীর চারটি গুণ ছিল যা অন্য কারো ছিল না আরব অনারবের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসূলের সাথে সালাত আদায় করেছেন দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক জিহাদেই তাঁর হাতে ঝান্ডা থাকতো তৃতীয়তঃ লোকেরা যখন রাসূলের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেত তখনও আলী তাঁর পাশেই থাকতো চতুর্থতঃ আলীই রাসূল (সাঃ) কে শেষ গোসল দিয়েছিলেন এবং তাঁকে কবরে শায়িত করেছিলেন

জীরার ইবনে হামজা তাঁর প্রিয় নেতার গুণাবলী তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন, আলীর ব্যক্তিত্ব ছিল সীমাহীন, তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দোর্দণ্ড, তাঁর বক্তব্য ছিল সিদ্ধান্তমূলক, তাঁর বিচার ছিল ন্যায়ভিত্তিক, সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল, তাঁর প্রতিটি আচরণে প্রজ্ঞা প্রকাশিত হত তিনি মোটা বা সাদামাটা খাদ্য পছন্দ করতেন এবং অল্প দামের পোশাক পছন্দ করতেন আল্লাহর কসম, তিনি আমাদের একজন হিসেবে আমাদের মাঝে ছিলেন, আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন, আমাদের সকল অনুরোধ রক্ষা করতেন তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সম্বোধন করে কিছু বলতে প্রথমে কথা বলতে আমরা ভয় পেতাম না তাঁর হাসিতে মুক্তা ছড়িয়ে পড়তো তিনি ধার্মিকদের খুব সম্মান করতেন অভাবগ্রস্তের প্রতি খুবই দয়ালু ছিলেন এতিম, নিকট আত্মীয় অন্নহীনকে খাওয়াতেন

তিনি বস্ত্রহীনে বস্ত্র দিতেন অক্ষম ব্যক্তিকে সাহায্য করতেন তিনি দুনিয়া এর চাকচিক্যকে ঘৃণা করতেন আমি আলী ইবনে আবি তালিবকে গভীর রাতে বহুবার অবস্থায় মসজিদে দেখেছি যে তিনি নিজ দাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আর্তনাদ করতেন যেন সাপে কামড় খাওয়া মানুষ এবং শোকাহত লোকের মতো রোদন করে বলতেন, হে দুনিয়া, ওহে দুনিয়া, আমার কাছ থেকে দূর হও! আমাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না! এরপর জীরার বলেন, আলী (আঃ) অনুপস্থিতিতে আমি সেই মহিলার মতো শোকাহত যার সন্তানকে তার কোলে রেখে কেটে ফেলা হয়েছে


হযরত আলী (রাঃ) এর জীবনী (প্রথম পর্ব) পড়তে ক্লিক করুন

হযরত আলী (রাঃ) এর জীবনী (দ্বিতীয় পর্ব) পড়তে ক্লিক করুন

হযরত আলী (রাঃ) এর পরিবারের বিষাদময় কাহিনী পড়তে ক্লিক করুন

হযরত আলী (রাঃ) এর বাণী পড়তে ক্লিক করুন



★★সমাপ্ত★★

 

সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন মানবতার সেবায়

অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url