সাহাবাগণের জীবনকথা-৪ || জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবা হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফ (রাঃ)-এর জীবনী, পর্ব - ৩





হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফ (রাঃ)

(তৃতীয় পর্ব)

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) কর্তৃক খলিফা নির্বাচনঃ

হযরত উমার ইনতিকাল করলেন। আবদুর রহমান খলীফা হতে রাজি ছিলেন না। এদিকে হযরত তালহাও তখন মদীনায় ছিলেন না। অবশিষ্ট চার ব্যক্তি খলীফা নির্বাচনের পূর্ণ দায়িত্ব আবদুর রহমানের ওপর ন্যস্ত করেন। হযরত আবদুর রহমানের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা আমানতদারীর সাথে পালন করেন। ক্রমাগত তিন দিন তিন রাত বিভিন্ন স্তরের লোকদের সাথে মত বিনিময় করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হযরত উসমানের পক্ষেই মত ব্যক্ত করেন। অবশেষে উমারের নির্ধারিত সময় তিন দিন তিন রাত শেষ হওয়ার আগে তিনি মানুষকে ফজরের জামায়াতে শরীক হওয়ার জন্য আবেদন জানান। নামায শেষে তিনি সমবেত জনমণ্ডলীর সামনে খলীফা হিসাবে হযরত উসমানের নামটি ঘোষণা করেন। হযরত উমারের ছুরিকাহত হওয়ার পর থেকে তাঁরই নির্দেশে তৃতীয় খলীফা হিসাবে উসমানের রা. নাম ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি জামায়াতের ইমামতি করেন এবং প্রশাসনের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন।

আবদুর রহমান (রা:) ছিলেন সকলের আস্থাভাজনঃ

চব্বিশ হিজরী সনের মুহাররম মাসে হযরত উসমান খলীফা নির্বাচিত হন। সে বছরই তিনি আবদুর রহমানকে আমীরুল হজ নিযুক্ত করেন। মুসলিম উম্মাহ সে বছরের হজটি তাঁরই নেতৃত্বে আদায় করে। হযরত আবদুর রহমান আমরণ খলীফা উসমানের মজলিসে শূরার সদস্য থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ দানের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর বিশেষ খিদমাত আঞ্জাম দেন। হযরত আবু বকর, উমার, উসমান রা- তিন খলীফার প্রত্যেকের নিকটই তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন আস্থার পাত্র।


আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর ইন্তেকালঃ

ইবন সাদের মতে, হযরত আবদুর রহমান হিঃ ৩২ সনে ৭৫ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তবে ইবন হাজারের মতে, তিনি ৭২ বছর জীবন লাভ করেছিলেন। ইবন হাজার কথাও বলেছেন, হযরত উসমান অথবা যুবাইর ইবনুল আওয়াম তাঁর জানাযার ইমামতি করেন এবং তাঁকে মদীনার বাকী’ গোরস্থানে দাফন করা হয়। গোরস্থান পর্যন্ত তার লাশ বহনকারীদের মধ্যে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সা ইবন আবী ওয়াক্কাসও ছিলেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) ছিলেন একজন দানবীরঃ

পূর্বেই আমরা দেখেছি সম্পূর্ণ রিক্ত হস্তে আবদুর রহমান মদীনায় এসেছিলেন। সামান্য ঘি পনির কেনাবেচার মাধ্যমে তিনি তাঁর ব্যবসা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর একজন সেরা ব্যবসায়ী ধনাঢ্য ব্যক্তিকে পরিণত হন। রাসূল সা. তাঁর সম্পদ বৃদ্ধির জন্য দুআ করেছিলেন এবং সে দুআ আল্লাহর দরবারে কবুলও হয়েছিল। কিন্তু সে সম্পদের প্রতি তাঁর একটুও লোভ আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় এবং তাঁর ইনতিকালের পরেও আমরণ তিনি সে সম্পদ অকৃপণ হাতে আল্লাহর পথে মানব কল্যাণে ব্যয় করেছেন।

একবার রাসূল সা. একটি অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি একটি অভিযানে সৈন্য পাঠানোর ইচ্ছা করেছি, তোমরা সাহায্য কর।’ আবদুর রহমান এসে দৌড়ে বাড়ীতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার কাছে চার হাজার আছে। দুহাজার আমার রবকে করজে হাসানা দিলাম এবং বাকী দুহাজার আমার পরিবার-পরিজনদের জন্য রেখে দিলাম।’ রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘তুমি যা দান করেছ এবং যা রেখে দিয়েছ, তার সবকিছুতে আল্লাহ তায়ালা বরকত দান করুন।

একবার মদীনায় শোরগোল পড়ে গেল, সিরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নিয়ে একটি বাণিজ্য কাফিলা উপস্থিত হয়েছে। শুধু উট আর উট। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা রা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কার বাণিজ্য কাফিলা?’ লোকেরা বলল,‘আবদুর রহমান ইবন আউফের।’ তিনি বললেন, আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছি, আমি যেন আবদুর রহমানকে সিরাতের ওপর একবার হেলে গিয়ে আবার সোজা হয়ে উঠতে দেখলাম।’ অন্য একটি বর্ণনায় আছে, হযরত আয়িশা (রা:) বলেন, ‘আল্লাহ দুনিয়াতে তাকে যা কিছু দিয়েছেন তাতে বরকত দিন এবং তাঁর আখিরাতের প্রতিদান এর থেকেও বড়। আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ আবদুর রহমান হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

হযরত আয়িশার কথাগুলো আবদুর রহমানের কানে গেল। তিনি বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আমাকে সোজা হয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে হবে।’ অতঃপর তিনি তাঁর সকল বাণিজ্য সম্ভার সাদকা করে দেন। পাঁচ শো, মতান্তরে সাত শো উটের পিঠে মালামাল বোঝাই ছিল। কেউ বলেছেন, বাণিজ্য সম্ভারের সাথে উটগুলিও তিনি সাদকা করে দেন। হযরত আবদুর রহমান ছিলেন উম্মাহাতুল মুমিনীনের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। তাঁদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি আজীবন অকাতরে খরচ করেছেন। তাঁদের নিকট তিনি ছিলেন একজন বিশ্বাসী আস্থাভাজন ব্যক্তি। একবার তিনি কিছু ভূমি চল্লিশ হাজার দীনারে বিক্রি করেন এবং বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ বনু যুহরা (রাসূলুল্লাহর সা. জননী হযরত আমিনার পিতৃ-গোত্র), মুসলমান, ফকীর মিসকীন, মুহাজির

 

হযরত আয়িশার নিকট তাঁর অংশ পৌঁছলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে পাঠিয়েছে?’ বলা হলো, ‘আবদুর রহমান ইবন আওফ।’ তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ ‘আমার পরে ধৈর্যশীলরাই তোমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাবে।

 


আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের মধ্যে বণ্টন করে দেন।

ইবন হাজার ‘আলইসাবা’ গ্রন্থে জাফর ইবন বারকানের সূত্রে উল্লেখ করেছেন, আবদুর রহমান মোট তিরিশ হাজার দাস মুক্ত করেছেন। জাহিলী যুগেও মদ পানকে তিনি হারাম মনে করতেন। হযরত আবদুর রহমান ছিলেন তাকওয়া আল্লাহভীতির এক বাস্তব নমুনা। মক্কায় গেলে তিনি তাঁর আগের বাড়ী-ঘরের দিকে ফিরেও তাকাতেন না। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার বাড়ী-ঘরের প্রতি আপনি এত নাখোশ কেন?’ তিনি বললে, ‘ওগুলি তো আমি আমার আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছি।

একবার তিনি তাঁর বন্ধুদের দাওয়াত দিলেন। ভালো ভালো খাবার এলো। খাবার দেখে তিনি কান্না শুরু করে দিলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’ তিনি বলেন, ‘রাসূল সা. বিদায় নিয়েছেন। তিনি নিজের ঘরে যবের রুটিও পেট ভরে খেতে পাননি।

একদিন তিনি সাওম পালন করছিলেন। ইফতারের পর তাঁর সামনে আনীত খাবারের দিকে তাকিয়ে বলরেন, ‘মুসয়াব ইবন উমায়ের ছিলেন আমার থেকেও উত্তম মানুষ। তিনি শহীদ হলে তাঁর জন্য মাত্র ছোট্ট একখানা কাফনের কাপড় পাওয়া গিয়েছিল। তা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। তারপর আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য দুনিয়ার প্রাচুর্য দান করলেন। আমার ভয় হয়, আমাদের বদলা না জানি দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হয়।’ অতঃপর তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

হযরত উমার তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘আবদুর রহমান মুসলিম নেতৃবৃন্দের একজন।’ হযরত আলী একটি ঘটনা বর্ণনা প্রসংগে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘আবদুর রহমান আসমান যমীনের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি।’ হযরত আবদুর রহমান রাসূলুল্লাহ সা. থেকে সরাসরি উমার রা. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে তাঁর পুত্রগণ, যেমন ইবরাহীম, হুমায়েদ, উমার, মুসয়াব, আবু সালামা, তাঁর পৌত্র মিসওয়ার, ভাগ্নে মিসওয়ার ইবন মাখরামা এবং ইবন আব্বাস, ইবন উমার, জুবাইর, জাবির, আনাস, মালিক ইবন আওস রা. প্রমুখ সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বড় পরিচয়, তিনি আশারায়ে মুবাশ্শারার একজন।

★★সমাপ্ত★★

 

সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন মানবতার সেবায়

অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url