সাহাবাগণের জীবনকথা-১৪ || জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবা হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফ (রাঃ) || পর্ব - ২

(দ্বিতীয় পর্ব)

ইমাম হিসাবে আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর নামাজ আদায়ঃ

নবম হিজরীতে তাবুক অভিযানকালে একদিন ফজরের নামাযের সময় রাসূল সা. প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যান। ফিরতে একটু দেরি হয়। এদিকে নামাযের সময়ও হয়ে যায়। তখন সমবেত মুসল্লীদের অনুরোধে আবদুর রহমান ইমাম হিসাবে নামাযে দাড়িয়ে যান। এদিকে রাসুল সা. ফিরে এলেন, এক রাকায়াত তখন শেষ। আবদুর রহমান রাসূলুল্লাহর সা. উপস্থিতি অনুভব করে পেছন দিকে সরে আসার চেষ্টা করেন। রাসূল সা. তাঁকে নিজের স্থানে থাকার জন্য হাত ইশারা করেন। অতঃপর অবশিষ্ট দ্বিতীয় রাকায়াতটিও তিনি শেষ করেন এবং রাসুল সা. তাঁর পেছনে ইকতিদা করেন। ইমাম মুসলিম আবু দাউদ তাঁদের সহীহ গ্রন্থদ্বয়ে সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছেন।

প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা. অন্তিম রোগশয্যায়। জীবনের আশা আর নেই। তাঁর পর খলীফা কে হবেন সে সম্পর্কে চিন্তাশীল বিশিষ্ট সাহাবীদের ডেকে পরামর্শ করলেন। হযরত আবদুর রহমানের সাথেও পরামর্শ করেন এবং হযরত উমারের কিছু গুণাবলী তুলে ধরে পরবর্তী খলীফা হিসাবে তাঁর নামটি তিনি প্রস্তাব করেন। আবদুর রহমান ধৈর্য সহকারে খলীফার কথা শুনার পর বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। তবে স্বভাবগতভাবেই তিনি একটু কঠোর।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) বিচারকের দায়িত্ব পালন করেনঃ

হযরত আবু বকরের রা. খিলাফতকালে আটজন বিশিষ্ট সাহাবীকে ফাতওয়া বিচারের দায়িত্ব প্রদানের সাথে সাথে অন্য সকলকে ফাতওয়া দান থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। আবদুর রহমান ছিলেন আটজনের একজন। হযরত উমারও তাঁর খিলাফতকালে জ্ঞান বিচক্ষণতার অধিকারী সাহাবীদের ছাড়া অন্য সকলকে বিচার কাজ থেকে বিরত রাখেন। এমনকি যে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদকে তিনি ‘খাযিনাতুল ইলম’ (জ্ঞানের ভাণ্ডার) বলে অভিহিত করতেন, তিনিও যখন পূর্ব অনুমতি ছাড়াই ফাতওয়া দিতে শুরু করেন, তাঁকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। জ্ঞানের যে শাখায় যিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন হযরত উমার তাকেই কেবল সে বিষয়ে মতামত প্রকাশের অনুমতি প্রদান করেন। সম্পর্কে সিরিয়া সফরকালে ‘জাবিয়া’ নামক স্থানে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘যারা কুরআন বুঝতে চায়, তারা উবাই বিন কা, যারা ফারায়েজ সম্পর্কে জানতে চায়, তারা যায়িদ বিন সাবিত এবং যারা ফিক্ সংক্রান্ত বিষয়ে অবগত হতে চায়, তারা মুয়ায বিন জাবাল আবদুর রহমান বিন ’আউফের সাথে যেন সম্পর্ক গড়ে তোলে।’’

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) খলিফা উমর (রা:) এর উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেনঃ

খলীফা হযরত উমার হযরত আবদুর রহমানকে বিশেষ উপদেষ্টার মর্যাদা দেন। রাতে তিনি যখন ঘুরে ঘুরে নগরের মানুষের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন, অনেক সময সংগে নিতেন হযরত আবদুর রহমানকে এবং নানা বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন।

একদিন রাতে খলীফা উমার বের হলেন আব্দুর রহমানকে সংগে নিয়ে নগর পরিভ্রমণে। দূর থেকে তাঁরা লক্ষ্য করলেন একটি বাড়ীতে আলো। কাছে গিয়ে দেখলেন বাড়ীর দরজা-জানালা সব বন্ধ; কিন্তু ভেতর থেকে কিছু লোকের উচ্চকণ্ঠ ভেসে আসছে। খলীফা উমার আবদুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন,

আপনি ভেতর থেকে আসা আওয়ায শুনতে পাচ্ছেন?

– ‘জী হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।

 – ‘কি বলছে, তা-কি বুঝতে পারছেন?’

– ‘সমবেত কণ্ঠের আওয়ায। কেবল শোরগোল শোনা যাচ্ছে। কি বলছে তা বুঝা যাচ্ছে না।’ 

– ‘আপনি কি জানেন বাড়ীটি কার?’

– ‘বাড়ীটি তো রাবীয়া’ ইবন উমাইয়্যার।

উমার বলেন, ‘সম্ভবতঃ তারা মদপান করে মাতলামি করছে। আপনার কি মনে হয়?’ 
– ‘‘আল্লাহ আমাদেরকে গুপ্তচরবৃত্তি থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ওয়ালা তাজাস্সাসূ (গুপ্তচর বৃত্তি করোনা) এবং ওয়ালা তাকফু মা লাইসা লাকা বিহি ইলমুন (যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না)’’

কথা শুনে উমার বললেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন এবং যথাসময়ে স্মরণ করে দিয়েছেন।’- এই বলে তিনি আবদুর রহমানকে সংগে নিয়ে সামনে অগ্রসর হন। হযরত আবদুর রহমান ক্ষেত্রে যে আয়াত দুটি আমীরুল মুমিনীনকে স্মরণ করে দেন, তা হচ্ছে মুসলিম সমাজ জীবনে ব্যক্তির বুনিয়াদী অধিকারের প্রাণস্বরূপ।

১৬ হিজরী সনে ইরাক বিজয়ের ফলে ইরাকে কিসরা শাহানশাহীর পতন হয় এবং ইয়ারমুকে যুদ্ধের পর সিরিয়া থেকে রোমের কাইসার সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। খলীফা জিযিয়া খারাজ নির্ধারণের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। কিন্তু ব্যাপারে তিনি সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ, বিলাল আবদুর রহমানের প্রবল প্রতিবাদের সম্মুখীন হন। অবশেষে মজলিসে শূরার ক্রমাগত বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর খলীফার মতামতই গৃহীত হয়।

খলীফা হযরত উমার রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের ভাতা নির্ধারণের ইচ্ছা করলেন। ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করলেন হযরত আবদুর রহমানের নিকট। তিনি পরামর্শ দিলেন, কুষ্ঠি বিদ্যায় পারদর্শী তিন ব্যক্তি- মাখযামা ইবন নাওফিল, খায়বর ইবন মাতয়াম এবং আকীল ইবন আবু তালিবের ওপর একটি তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণের জন্য। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী খলীফা তাঁদেরকে দায়িত্ব প্রদান করলেন। তাঁরা তালিকা প্রণয়ন করে খলীফার নিকট পেশ করতে আমীরুল মুমিনীন আবদুর রহমান দুজনেই তা পরীক্ষা করেন। হযরত উমার তালিকা দেখার পর বললেন, ‘‘বর্তমান তালিকার ক্রমধারা পরিবর্তন করে আমার নিজের আমার গোত্রীয় অন্য লোকদের নাম রাসূলের সা. সাথে বংশগত সম্পর্কের দিক দিয়ে যখন আসবে তখন লিখবে’’ হযরত আলী হযরত আবদুর রহমান আপত্তি করে বললেন, ‘‘আপনি আমীরুল মুমিনীন। তালিকার সূচনা আপনার নাম দিয়েই হওয়া উচিত।’’ তিনি বললেন, ‘‘না। রাসূলুল্লাহর সা. চাচা ’আব্বাস রা. থেকে শুরু কর, তারপর আলীর রা. নামটি লিখ।’’ ভাতার পরিমাণ তিনি আবদুর রহমানের সাথে পরামর্শ করেই নির্ধারণ করেন। তারপর তা মজলিসে শূরায় পেশ করেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) হজ্জ্বে আমীরের দায়িত্ব পালন করেনঃ

আযওয়াজে মুতাহ্হারাত (রাসূলুল্লাহর সা. সহধর্মিণীগণ) বেশ আগে থেকেই হজ্জ্ব পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করছিলেন। তেইশ হিজরী সনে খলীফা উমার তাঁদের হজ্জ্ব আদায়ের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেন। তিনি নিজেও তাঁদের সফরসংগী হন। তাঁদের সফর ব্যবস্থাপনার যাবতীয় দায়িত্ব হযরত আবদুর রহমান হযরত উসমানের রা. ওপর অর্পণ করেন। সফরের সময় আবদুর রহমান কাফিলার আগে এবং উসমান পেছনে সশস্ত্র অবস্থায় পাহারা দিয়ে চলতেন। কোন ব্যক্তিকে তাঁদের উটের কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। তাঁরা যখন কোথাও অবস্থান করতেন, এরা দুজন তাঁবুর প্রহরায় নিয়োজিত থাকতেন।

হযরত উমার তাঁর খিলাফতের প্রথম বছর আবদুর রহমানকে আমীরে হজ্জ নিয়োগ করে মক্কায় পাঠান। আর তাঁর সাথে পাঠান নিজের পক্ষ থেকে কুরবানীর একটি পশু। বছর বিশ্ব মুসলিম তাঁর নেতৃত্বেই হজ্জ্ব আদায় করে। খলিফা হযরত উমার রা. ফজরের জামায়াতে ইমামতি করছিলেন। মুগীরা ইবন শুবার পারসিক দাস ফিরোয তাকে ছুরিকাঘাত করে। আহত অবস্থায় সংগে সংগে তিনি পেছনে দণ্ডায়মান আবদুর রহমানের হাতটি ধরে নিজের স্থানে তাঁকে দাঁড় করে দেন এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অতপর আবদুর রহমান অবশিষ্ট নামায দ্রুত শেষ করেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) সর্ম্পকে খলিফা (রা:) এর উসিয়তঃ 

হযরত উমার আহত হওয়ার দশ ঘন্টা পর সমবেত লোকদের বললেন, ‘আপনারা যেমন বলতেন আমিও চাচ্ছিলাম, উম্মাতের বোঝা বহনের ক্ষমতা রাখে এমন এক ব্যক্তিকে আমি আমীর বানিয়ে যাই। পরে আমি চিন্তা করলাম, এমনটি করলে আমার মৃত্যুর পরও এর দায়-দায়িত্ব আমার ওপর বর্তাবে। কারণে, আমার সাহস হলো না। ব্যক্তি- আলী, উসমান, আবদুর রহমান, সা, যুবাইর তালহা। আল্লাহর রাসূল সা. তাদেরকে জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন। তাদের কোন একজনকে আপনারা আমীর নির্বাচন করে নেবেন। জন ছাড়া আমার পুত্র আবদুল্লাহও আছে। তবে খিলাফতের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না। উল্লেখিত ছয় ব্যক্তি যদি খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে তিনজন করে সমান দুদলে বিভক্ত হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ যে দলকে সমর্থন করবে সে দল থেকেই খলীফা হবে। কিন্তু আবদুল্লাহর মতামত যদি সর্বসাধারণের নিকট গৃহীত না হয় তাহলে আবদুর রহমান যে দলে থাকবেন তাঁদের মতই গ্রহণযোগ্য হবে।’ হযরত উমারের পরামর্শের মধ্যে আবদুর রহমান সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠে।

আবদুর রহমান (রা:) এর জীবনীর প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

আবদুর রহমান (রা:) এর জীবনীর তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন


★★সমাপ্ত★★

 

সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url