রমজানের আমল || রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা:) যে ১৫টি আমল করতেন ||





রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা:) যে ১৫টি আমল করতেন


দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল একটি বছর। নিকটবর্তী হল রমজান। এ মাস র‌হমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। পুরো মাস জুড়ে দিনের বেলা রোজা রাখাকে আল্লাহ তায়ালা ফরজ করে দিয়েছেন। যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি।

রোজা ফরজ হয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরতের এক বছরেরও বেশি সময় পরে। অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরী সনে। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয় বছরের মতো পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন। মোট নয়টি রমজানে রোজা পালন করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে রোজার মাস যাপন করেছেন বা করতে বলেছেন তাই আমাদের আদর্শ। তাই আসন্ন রমজান কিভাবে কাটাতে পারি সে ব্যাপারে জেনে নেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রমজানের কর্মসূচি।

১. রোজা: রোজা হলো রমজানের প্রধান আমল। রোজার পুরস্কার অসীম। আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে দিবেন। আবার শরয়ীত সম্মত সমস্যা ছাড়া রোজা না রাখার শাস্তিও ভয়াবহ।
 
২. সেহরি: রোজা রাখার উদ্দেশ্যে ভোর রাতে খাবার খাওয়ার নাম সেহরি। সেহরি খাওয়া সুন্নত।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরিতে এক চুমুক পানি হলেও পান করতে বলেছেন। আরো বলেন,যারা সেহরি খায় ও পান করে তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা রহমত করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য উত্তম দোয়া করেন। (মুসনাদে আহমদ) তবে কখনো সেহরি না খেতে পারলে এই অজুহাতে রোজা না রাখা কিছুতেই বৈধ নয়।

৩. ইফতার করা: সূর্য ডোবার পর রোজা সমাপ্ত করার জন্য যে পানাহার তাই ইফতার। খেজুর, কিসমিস বা পানি দিয়ে ইফতার করা উত্তম। সূর্য ডোবার পর ইফতার করতে দেরি না করা উত্তম ও সওয়াবের কাজ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন মনুষ ততদিন পর্যন্ত কল্যাণের পথে থাকবে যতদিন পর্যন্ত তারা শীঘ্র শীঘ্র ইফতার করে। ( মিশকাত : ১৯৭৯ )

৪. ইফতার করানো: রোজাদারকে ইফতার করানো খুবই উত্তম কাজ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করায় তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়, জাহান্নাম থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হয় এবং সে রোজদারের সমপরিমাণ সওয়াব পায় আর রোজাদারের সওয়াবও কম করা হয় না। (মিশকাত:১৯৬০)

৫. তারাবীহ: তারাবীহ পড়া সুন্নত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবীকে সুন্নত করে দিয়েছেন। ( ওসওয়ায়ে রাসূলে আকরাম সা: পৃ:২৬৮) তারাবীহতে কুরআনুল কারীম ধারাবাহিকভাবে তিলাওয়াত করা বা শোনাও সুন্নত।(বেহেশতী গাওহার)

৬. কুরআন তিলাওয়াত: রমজান কুরআন নাজিলের মাস। কুরআনের সম্মানেই এ মাসের সম্মান। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য মাসের তুলনায় কুরআনের তিলাওয়াত এ মাসে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতেন।

৭. কুরআনের দাওর করা: দাওর মানে পরস্পরকে শুনানো। প্রতি রমজানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং জিবরাঈল আলাইহিসসালাম একবার পূর্ণ কুরআন দাওর করতেন। তবে জীবনের শেষ রমজানে দুবার দাওর করেছেন। ( বুখারী:৪)

৮. কুরআন বোঝর চেষ্টা: কুরআন হলো মানুষের কাছে আল্লাহর পয়গাম, বান্দার প্রতি প্রভূর চিঠি। কী আছে এই চিঠিতে তা জানা অন্তত জানতে চেষ্টা করা সবার কর্তব্য। আর রমজানেই যেহেতু এর প্রেরণের সূচনা তাই এ মাসই তা বুঝতে সচেষ্ট হওয়ার উত্তম সময়।

৯. নফল ইবাদত: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে বেশি বেশি নফল ইবাদত করতেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন রমজানের একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরজের সমতুল্য। ( মিশকাত:১৯৬০)

উপরোক্ত হাদিসটিকে কেউ কেউ জাল হাদিস বলে থাকেন। তবে হাদিসটি জাল নয় মর্মে বহু আলেমগন একমত পোষন করেন। সালমানরাদিয়াল্লাহুআনহু কর্তৃকবর্ণিত এ হাদিসটিইবনে খুযাইমা তাঁর “সহীহ”নামকগ্রন্থেবর্ণনা করেছেন।তিনি বলেন: “রমজান মাসের ফযিলতশীর্ষকপরিচ্ছেদ;যদি এ হাদিসটিসহীহ সাব্যস্ত হয়”। এরপর তিনি বলেন: আমাদের নিকট আলীইবনেহুজরআল-সাদী হাদিস বর্ণনা করেছেন;তিনি বলেন: আমাদের নিকটইউসুফ ইবনেযিয়াদ হাদিস বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন: আমাদের নিকট হুমামইবনেইয়াহইয়া হাদিস বর্ণনা করেছেন আলী বিন যায়িদ বিন জাদআন হতে; তিনিসাঈদইবনে আল-মুসাইয়্যিব হতে, তিনি সালমান (রাঃ) হতে;তিনি বলেন:

خطبنارسولاللهصلىاللهعليهوسلمفيآخريوممنشعبانفقال : (أيهاالناس،قدأظلكمشهرعظيم،شهرمبارك،شهرفيهليلةخيرمنألفشهر،جعلاللهصيامهفريضة،وقيامليلهتطوعاً ،منتقربفيهبخصلةمنالخيركانكمنأدىفريضةفيماسواه،ومنأدىفيهفريضةكانكمنأدىسبعينفريضةفيماسواه،وهوشهرالصبر،والصبرثوابهالجنة،وشهرالمواساة،وشهريزدادفيهرزقالمؤمن،منفطرفيهصائماًكانمغفرةلذنوبه،وعتقرقبتهمنالنار،وكانلهمثلأجرهمنغيرأنينتقصمنأجرهشيء. قالوا : ليسكلنانجدمايفطرالصائم،فقال : يعطياللههذاالثوابمنفطرصائماًعلىتمرةأوشربةماءأومذقةلبن،وهوشهرأولهرحمة،وأوسطهمغفرة،وآخرهعتقمنالنار،منخففعنمملوكهغفراللهله،وأعتقهمنالنار،فاستكثروافيهمنأربعخصال : خصلتينترضونبهماربكم،وخصلتينلاغنىبكمعنهما: فأماالخصلتاناللتانترضونبهماربكم : فشهادةأنلاإلهإلاالله،وتستغفرونه،وأمااللتانلاغنىبكمعنهما : فتسألوناللهالجنة،وتعوذونبهمنالنار،ومنأشبعفيهصائماًسقاهاللهمنحوضيشربةًلايظمأحتىيدخلالجنة)

একবার শাবান মাসের শেষ দিনরাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামআমাদের উদ্দেশ্যে খোতবা (ভাষণ) দিলেন। খোতবা দিতে গিয়ে তিনি বলেন: “হে লোকেরা! আপনাদের নিকট এক মহান মাসহাজির হয়েছে। এক বরকতময় মাস এসেছে। এ মাসে এমন এক রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এমাসে সিয়াম পালন করা আল্লাহ ফরজ (আবশ্যকীয়) করেছেন এবং এ মাসের রাতে কিয়াম (নামায আদায়) করানফল (ফজিলতপূর্ণ) করেছেন। এ মাসে যে কোন একটি (নফল)ভালো কাজ করা অন্য মাসে একটি ফরজ কাজ করার সমান। আর এ মাসে কোন একটি ফরজআমল করা অন্য মাসে সত্তরটি ফরজআমল করার সমান। এটি হল- ধৈর্য্যের মাস; ধৈর্য্যের প্রতিদান হচ্ছে- জান্নাত। এটি হল- সহানুভূতির মাস। এটি এমন এক মাস যাতে একজন মুমিনের রিযিক বৃদ্ধি পায়। এ মাসে যে ব্যক্তিকোন একজন রোজাদারকে ইফতার করাবেতার সমূহ গুনাহ মাফ করেদেয়া হবে,সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে এবং তাকে সেই রোজাদারের সমান সওয়াব দেয়া হবে;কিন্তু রোজাদারের সওয়াবে কোন কমতি করা হবে না।তাঁরা বললেন- আমাদের মধ্যে সবার তো একজন রোজাদারকে ইফতার করানোর মত সামর্থ্য নেই।তিনি বললেন: কোন ব্যক্তিযদি একজন রোজাদারকে একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি অথবা এক চুমুক দুধ দিয়েও ইফতার করায়আল্লাহ তাকেও এই সওয়াব দিবেন। এটি এমন মাস এর প্রথম ভাগে রহমত, দ্বিতীয় ভাগে মাগফিরাত এবং শেষ ভাগে রয়েছেজাহান্নামহতেনাজাত। আর যে ব্যক্তি তার কৃতদাসের দায়িত্ব সহজ করে দিবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং জাহান্নাম থেকে তাকে মুক্তি দিবেন। সুতরাং এ মাসে আপনারা চারটি কাজ বেশি করে করুন। দুটি হল যা দিয়ে আপনারা আপনাদের রব্বকে সন্তুষ্ট করবেন। আর দুটি কাজ এমন যা আপনাদের না করলেই নয়।যে দুটি কাজ দ্বারা আপনারা আপনাদের রব্বকে সন্তুষ্ট করবেন: (১) এ বলে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই এবং (২) তাঁর কাছে ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। আর যে দুটো কাজ আপনাদের না করলেই নয় (৩) আপনারা আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করবেন এবং (৪) জাহান্নামের আগুন থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন। আর এইমাসে যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পেট ভরে খাওয়াবে আল্লাহ তাঁকে আমার হাউজ থেকে এক ঢোক পানি পান করাবেন যার ফলে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসার্ত হবে না।”

উল্লেখিতহাদিসের সনদেএকজন রাবী হচ্ছেন- আলী বিন যায়েদ বিন জাদআন।তিনি একজন যয়ীফ বা দুর্বল রাবী। যেহেতু তার মুখস্থশক্তি দুর্বল ছিল।

হাদিসটির সনদে আরও একজন রাবী হচ্ছেন-ইউসুফ বিন যিয়াদ আল-বসরী।তিনি “মুনকারুল হাদিস”।

হাদিসটির সনদে আরও একজন রাবী হচ্ছেন- হুমাম বিন ইয়াহইয়া বিন দীনার আল-আউদী।তার সম্পর্কে ইবনে হাজার ‘আত-তাক্বরীব’গ্রন্থে বলেছেন:ثقة ربما وهم।(তিনি ছিকাহ, তবে কখনো কখনো ভুল করেন)।[“ছিকাহ” পরিভাষাটির মাধ্যমে মুখস্তশক্তি ও দ্বীনদারি দুটো বিষয়ের স্বীকৃতি দেয়া হয়] এই পর্যালোচনার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, এ সনদে হাদীসটি মিথ্যা বা বানোয়াট নয়; তবেযয়ীফ বা দুর্বল। এটি দুর্বল হলেও রমজানের ফযিলত বিষয়ক সহীহ হাদিস তো যথেষ্টরয়েছে। আল্লাহই তাওফিক দাতা।আমাদের নবীর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আল্লাহর রহমত ওশান্তিবর্ষিত হোক।

১০. রাত্রি জাগরণ: রাত-জাগা ইবাদত আল্লাহর খুবই প্রিয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব মাসেই রাত জেগে ইবাদত করতেন। তবে রমজানে এর পরিমাণ বেড়ে যেতো বহুগুণ।

১১. শবে কদর তালাশ: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবে কদর তালাশ করো। হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন রমজানের শেষ দশক শুরু হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমর কষে নিতেন। সারা রাত ইবাদত,যিকির ও দোয়ায় মশগুল থাকতেন। – বুখারী।

১২. পরিবারকে ইবাদতে উৎসাহ দান: হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরের লোকজনকেও জাগিয়ে দিতেন,যাতে তারাও এসব রাত্রির বরকত লাভ করতে পারে। – বুখারী।

১৩. কর্মচারীর চাপ কমানো: রমজান উপলক্ষ্যে কর্মচারী বা অধিনস্তদের কাজের চাপ কমানো উচিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন এ মাসে যে ব্যক্তি তার অধিনস্তদের কাজ হালকা করে দিবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। (শুআবুল ইমান; বায়হাকি)

১৪. দান সদকাহ করা: দানশীলতা নবী চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সব সময়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভাবি অসহায়দের দান সদকা করতেন। আর রমজানে এর পরিমাণ বেড়ে যেতো বহুগুণে। তাঁর রমজানের দানকে হাদীসে কল্যাণবাহী প্রবল বায়ুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। ( বুখারী )

১৫. এতেকাফ: রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করা সুন্নত। হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ওফাত পর্যন্ত সর্বদা রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন।( মিশকাত হা: নং ২০৯২)

এই হল নবিজীর রমজানের কর্মসূচি। এ কর্মসূচি অনুযায়ী আসন্ন রমজান যাপন করলে আশা করা যায় আমরা তাকওয়ার নেয়ামত লাভ করতে পারবো। আল্লাহ তায়ালাই কল্যাণকর কাজের তাওফীক দাতা।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url