শবে বরাত, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক || মধ্য শাবানের রাত্রিতে কি ভাগ্য লিখন হয় ||



শবে বরাত, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক

মধ্য শাবানের রাত্রি বিশেষ মাগফিরাত ও বরকতময়  একটি রাত


এ বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে:

إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ

‘‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’

এ অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী: আবূ মূসা আশআরী, আউফ ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, মুয়ায ইবনু জাবাল, আবু সা’লাবা আল-খুশানী, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে(ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ,পৃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবারানী, আল-মুজাম আল-কাবীর, ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মুজাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু’আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬।)

এ সকল হাদীসের সনদের মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল ও কিছু সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদীসটি সহীহ। শাইখ আলবানী বলেন, ‘‘হাদীসটি সহীহ। তা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।(আলবানী, সাহীহাহ (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ) ৩/১৩৫।)

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রিটি একটি বরকতময় রাত এবং এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। কিন্তু এ ক্ষমা অর্জনের জন্য শিরক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোনো আমল করার প্রয়োজন আছে কি না তা এই হাদীসে উল্লেখ নেই।

মধ্য শাবানের রাত্রিতে কি ভাগ্য লিখন হয়


কিছু কিছু হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয় বা পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত-মউত ও রিযক ইত্যাদির অনুলিপি করা হয়। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল অথবা বানোয়াট। এ অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয় নি।

এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন:

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

‘‘আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’’
(সূরা (৪৪) দুখান: আয়াত ৩-৪)

এ বাণীর ব্যাখ্যায় তাবিয়ী ইকরিমাহ, বলেন, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘মধ্য শাবানের রাতকে’ বুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ বলেন, এ রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ে ফয়সালা করা হয়। 
(তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯)

মুফাস্সিরগণ ইকরিমার এ মত গ্রহণ করেন নি। ইমাম তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার এ ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পরে তার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ইকরিমার এ মত ভিত্তিহীন। তিনি বলেন যে, সঠিক মত হলো, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘লাইলাতুল কদর’-কে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ যে রাত্রিতে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন সে রাত্রিকে এক স্থানে লাইলাতুল কদর: ‘তাকদীরের রাত’ বা ‘মর্যাদার রাত’ বলে অভিহিত করেছেন। 
(সূরা (৯৭) কাদ্র: আয়াত ১)
অন্যত্র এ রাত্রিকেই ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা ‘বরকতময় রজনী’ বলে অভিহিত করেছেন। এবং এ রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। (সূরা (২) বাকারা: আয়াত ১৮৫)
এথেকে প্রমাণিত হয় যে, মুবারক রজনী রামাদান মাসে, শাবান মাসে নয়। (তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯)

পরবর্তী মুফাস্সিরগণ ইমাম তাবারীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, ‘মুবারক রজনী’ বলতে এখানে ‘মহিমান্বিত রজনী’ বা ‘লাইলাতুল কদর’ বুঝানো হয়েছে। তাঁদের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ এবং ‘লাইলাতুল কদর’ একই রাতের দুটি উপাধি। দুটি কারণে মুফাস্সিরগণ ইকরিমার তাফসীরকে বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন:

(ক) ইকরিমার মতটি কুরআনের সুস্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআনে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র বলেছেন যে, একটি মুবারক রাত্রিতে ও একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। এ সকল আয়াতের সমন্বিত সুস্পষ্ট অর্থ হলো, আল্লাহ রামাদান মাসের এক রাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সে রাতটি বরকতময় ও মহিমান্বিত। মুবারক রজনীকে শবে বরাত বলে দাবী করলে এ আয়াতগুলোর স্পষ্ট অর্থ বিভিন্ন অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করতে হয়।

(খ) বিভিন্ন সাহাবী ও তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা ‘মুবারক রজনী’-র ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ রাতটি হলো ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘মহিমান্বিত রজনী’। সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবনু আববাস (রা) ও ইবনু উমার (রা) থেকে অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাবিয়ীগণের মধ্যে থেকে আবু আব্দুর রহমান আল-সুলামী (৭৪ হি), মুজাহিদ বিন জাবর (১০২ হি), হাসান বসরী (১১০ হি), ক্বাতাদা ইবনু দি‘আমা (১১৭ হি) ও আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মাদানী (১৮২ হি) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থ লাইলাতুল কদর। 

(নাহহাস, মা’আনিল কুরআন ৬/৩৯৫; যামাখশারী, আল-কাশশাফ ৩/৪২৯; ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৬৯০; ইবনু আতিয়্যাহ্, আল- মুহাররার আল ওয়াজীয ৫/৬৮-৬৯; কুরতুবী, তাফসীর ১৬/১২৬; আবু হাইয়্যান, আল-বাহর আল-মুহীত ৮/৩২-৩৩; ইবনু কাছীর, তাফসীর ৪/১৪০; সুয়ূতী, আদদুররুল মানসূর ৫/৭৩৮-৭৪২; আবুস সু’উদ, তাফসীর-ই-আবিস সু’উদ ৮/৫৮; শাওকানী, ফাতহুল ক্বাদীর ৪/৫৭০-৫৭২; আলুসী, রূহুল মা’আনী ১৩/১১০; থানবী, তাফসীর-ই আশরাফী ৫/৬১৫-৬১৬; শানক্বীতী, মুহাম্মদ আমীন, আদওয়া আল- বায়ান ৭/৩১৯; সাবুনী, মুহাম্মদ আলী, সাফওয়াতুত তাফাসীর ৩/১৭০-১৭১; মুফতী শফী, মা’আরেফ আল-কুরআন ৭/৮৩৫-৮৩৬)

মধ্য-শাবানের রাত্রিতে দোয়া-মুনাজাত


মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত তৃতীয় প্রকারের হাদীসগুলোতে এ রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ রাতে দোয়া করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমালাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস নেই। এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে কিছু হাদীস দুর্বল এবং কিছু হাদীস জাল।

শবে বরাতে অনির্ধারিত সালাত ও দোয়া


মধ্য শাবানের রাত্রি সম্পর্কে বর্ণিত কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে সালাত আদায় ও দোয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল হাদীস এ রাত্রির সালাতের জন্য কোনো নির্ধারিত রাক‘আত, নির্ধারিত সূরা বা নির্ধারিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হয় নি। শুধু সাধারণভাবে এ রাত্রিতে তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া করার বিষয়টি এ সকল হাদীস থেকে জানা যায়। এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো প্রায় সবই বানোয়াট। দু-একটি হাদীস দুর্বল হলেও বানোয়াট নয়।


শবে বরাতে নির্ধারিত রাক‘আত, সূরা ও পদ্ধতিতে সালাত


শবে বরাত বিষয়ক অন্য কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে, বিশেষ সুরা পাঠের মাধ্যমে, নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক রাকআত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী এই অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট। হিজরী চতুর্থ শতকের পরে রাসুলুলাহ (ﷺ) -এর নামে বানিয়ে এগুলো প্রচার করা হয়েছে। এখানে এ জাতীয় কয়েকটি জাল ও বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করছি।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url