সূরা আল-ইনশিকাক তেলাওয়াত, উচ্চারণ, অনুবাদ ও তাফসীর || তেলাওয়াত: কারী শেখ আব্দুল বাসিত || Surah Al-Inshiqaq Tafseer ||

সূরা আল-ইনশিকাক তেলাওয়াত

কারী শেখ আব্দুল বাসিত

সূরা আল-ইনশিকাক, কুরআন মাজিদের ৮৪ নম্বর সূরা। 
এই সূরার মোট আয়াত সংখ্যা ২৫ টি। 
সূরা আল-ইনশিকাক এর বাংলা অর্থ- খন্ড বিখন্ড করণ। 
এই সূরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। 

সূরা আল-ইনশিকাক আরবী উচ্চারণ

Surah Al-Inshiqaq Arabi Uccharon. 

১  اِذَا السَّمَآءُ انۡشَقَّتۡ
২  وَ اَذِنَتۡ لِرَبِّهَا وَ حُقَّتۡ
৩  وَ اِذَا الۡاَرۡضُ مُدَّتۡ ۙ
৪  وَ اَلۡقَتۡ مَا فِیۡهَا وَ تَخَلَّتۡ
৫  وَ اَذِنَتۡ لِرَبِّهَا وَ حُقَّتۡ ؕ
৬  یٰۤاَیُّهَا الۡاِنۡسَانُ اِنَّکَ کَادِحٌ اِلٰی رَبِّکَ کَدۡحًا فَمُلٰقِیۡهِ
৭  فَاَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ کِتٰبَهٗ بِیَمِیۡنِهٖ ۙ
৮  فَسَوۡفَ یُحَاسَبُ حِسَابًا یَّسِیۡرًا
৯  وَّ یَنۡقَلِبُ اِلٰۤی اَهۡلِهٖ مَسۡرُوۡرًا ؕ
১০  وَ اَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ کِتٰبَهٗ وَرَآءَ ظَهۡرِهٖ 
১১  فَسَوۡفَ یَدۡعُوۡا ثُبُوۡرًا 
১২  وَّ یَصۡلٰی سَعِیۡرًا 
১৩  اِنَّهٗ کَانَ فِیۡۤ اَهۡلِهٖ مَسۡرُوۡرًا
১৪  اِنَّهٗ ظَنَّ اَنۡ لَّنۡ یَّحُوۡرَ 
১৫  بَلٰۤی ۚۛ اِنَّ رَبَّهٗ کَانَ بِهٖ بَصِیۡرًا
১৬  فَلَاۤ اُقۡسِمُ بِالشَّفَقِ
১৭  وَ الَّیۡلِ وَ مَا وَسَقَ 
১৮  وَ الۡقَمَرِ اِذَا اتَّسَقَ
১৯  لَتَرۡکَبُنَّ طَبَقًا عَنۡ طَبَقٍ
২০  فَمَا لَهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ
২১  وَ اِذَا قُرِئَ عَلَیۡهِمُ الۡقُرۡاٰنُ لَا یَسۡجُدُوۡنَ 
২২  بَلِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یُکَذِّبُوۡنَ 
২৩  وَ اللّٰهُ اَعۡلَمُ بِمَا یُوۡعُوۡنَ 
২৪  فَبَشِّرۡهُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ 
২৫  اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَهُمۡ اَجۡرٌ غَیۡرُ مَمۡنُوۡنٍ

সূরা আল-ইনশিকাক, বাংলা উচ্চারণ

Surah Al-Inshiqaq Bangla Uccharon. 

১) ইযাছ ছামাউন শাক্কাত।
২) ওয়া আযিনাত লিরাব্বিহা-ওয়া হুক্কাত।
৩) ওয়া ইযাল আরদুমুদ্দাত।
৪) ওয়া আল কাত মা-ফীহা-ওয়া তাখাল্লাত।
৫) ওয়া আযিনাত লিরাব্বিহা-ওয়া হুক্কাত।
৬) ইয়াআইয়ুহাল ইনছা-নুইন্নাকা কা-দিহুন ইলা-রাব্বিকা কাদহান ফামুলা-কীহ।
৭) ফাআম্মা-মান ঊতিয়া কিতা-বাহূবিয়ামীনিহ।
৮) ফাছাওফা ইউহা-ছাবুহিছা-বাইঁ ইয়াছীরা-।
৯) ওয়া ইয়ানকালিবুইলা-আহলিহী মাছরূরা-।
১০) ওয়া আম্মা-মান ঊতিয়া কিতা-বাহূওয়ারাআ জাহরিহ।
১১) ফাছাওফা ইয়াদ‘ঊ ছুবূরা-।
১২) ওয়া ইয়াসলা-ছা‘ঈরা-।
১৩) ইন্নাহূকা-না ফীআহলিহী মাছরূরা-।
১৪) ইন্নাহূজান্না আল্লাইঁ ইয়াহূরা।
১৫) বালা-ইন্না রাব্বাহূকা-না বিহী বাসীরা-।
১৬) ফালাউকছিমুবিশশাফাক।
১৭) ওয়াল্লাইলি ওয়ামা-ওয়াছাক।
১৮) ওয়ালকামারি ইযাত্তাছাক।
১৯) লাতারকাবুন্না তাবাকান ‘আন তাবাক।
২০) ফামা-লাহুম লা-ইউ’মিনূন।
২১) ওয়া ইযা-কুরিআ ‘আলাইহিমুল কুরআ-নুলা-ইয়াছজুদূন (ছিজদাহ-১৩)।
২২) বালিল্লাযীনা কাফারূইউকাযযিবূন।
২৩) ওয়াল্লা-হু আ‘লামুবিমা-ইয়ূ‘ঊন।
২৪) ফাবাশশিরহুম বি‘আযা-বিন আলীম।
২৫) ইল্লাল্লাযীনা আ-মানূওয়া ‘আমিলুস সা-লিহা-তি লাহুম আজরুন গাইরু মামনূন।

সূরা আল-ইনশিকাক বাংলা অনুবাদ

Surah Al-Inshiqaq Bangla Onubad

১. যখন আসমান ফেটে যাবে।
২. আর তার রবের নির্দেশ পালন করবে এবং এটাই তার করণীয়।
৩. আর যখন যমীনকে সম্প্রসারিত করা হবে। 
৪. আর তার মধ্যে যা রয়েছে তা নিক্ষেপ করবে এবং খালি হয়ে যাবে।
৫. আর তার রবের নির্দেশ পালন করবে এবং এটাই তার করণীয়। 
৬. হে মানুষ, তোমার রব পর্যন্ত (পৌঁছতে) অবশ্যই তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ পাবে।
৭. অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে;
৮. অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে।
৯. আর সে তার পরিবার-পরিজনের কাছে আনন্দিত হয়ে ফিরে যাবে।
১০. আর যাকে তার আমলনামা পিঠের পেছনে দেয়া হবে,
১১. অতঃপর সে ধ্বংস আহবান করতে থাকবে।
১২. আর সে জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে।
১৩. নিশ্চয় সে তার পরিবার-পরিজনদের মধ্যে আনন্দে ছিল।
১৪. নিশ্চয় সে মনে করত যে, সে কখনো ফিরে যাবে না।
১৫. হ্যাঁ, নিশ্চয় তার রব তার প্রতি সম্যক দৃষ্টি দানকারী।
১৬. অতঃপর আমি কসম করছি পশ্চিম আকাশের লালিমার।
১৭. আর রাতের কসম এবং রাত যা কিছুর সমাবেশ ঘটায় তার।
১৮. আর চাঁদের কসম, যখন তা পরিপূর্ণ হয়। 
১৯. অবশ্যই তোমরা এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ করবে।
২০. অতএব তাদের কী হল যে, তারা ঈমান আনছে না? 
২১. আর যখন তাদের কাছে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় তখন তারা সিজদা করে না।[সাজদাহ] 
২২. বরং কাফিররা অস্বীকার করে।
২৩. আর তারা যা অন্তরে পোষণ করে আল্লাহ তা সবিশেষ পরিজ্ঞাত।
২৪. অতএব তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। 
২৫. কিন্তু যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন প্রতিদান। 

সূরা আল-ইনশিকাক তাফসীর

Surah Al-Inshiqaq Tafseer

১. যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে(১),
(১) আর সেটা হবে কিয়ামতের দিন। [ইবন কাসীর]

২. আর তার রবের আদেশ পালন করবে এবং এটাই তার করণীয়।(১)
(১) এখানে কেয়ামতের দিন আকাশ ও পৃথিবীর উপর আল্লাহ্ তা'আলার কর্তৃত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, (وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ) এর মধ্যে أَذِنَتْ অর্থ শুনেছে তথা আদেশ পালন করেছে। সে হিসেবে (وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا) এর শাব্দিক অর্থ হয়, “সে নিজের রবের হুকুম শুনবে।” এর মানে শুধুমাত্র হুকুম শুনা নয় বরং এর মানে সে হুকুম শুনে একজন অনুগতের ন্যায় নির্দেশ পালন করেছে এবং একটুও অবাধ্যতা প্রকাশ করেনি। [সা’দী] আর حُقَّتْ এর অর্থ “আদেশ পালন করাই তার ওয়াজিব কর্তব্য ছিল”। কারণ সে একজন মহান বাদশার কর্তৃত্বাধীন ও পরিচালনাধীন। যাদের নির্দেশ অমান্য করা যায় না, আর তার হুকুমের বিপরীত করা যায় না। [ইবন কাসীর; সা’দী]

৩. আর যখন যমীনকে সম্প্রসারিত করা হবে।(১)
(১) مُدَّتْ এর অর্থ টেনে লম্বা করা, ছড়িয়ে দেয়া। [ইবন কাসীর] পৃথিবীকে ছড়িয়ে দেবার মানে হচ্ছে, সাগর নদী ও সমস্ত জলাশয় ভরে দেয়া হবে। পাহাড়গুলো চুৰ্ণবিচূর্ণ করে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়া হবে। পৃথিবীর সমস্ত উঁচু নীচু জায়গা সমান করে সমগ্ৰ পৃথিবীটাকে একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করা হবে। কুরআনের অন্যত্র এই অবস্থাটিকে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, মহান আল্লাহ “তাকে একটা সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেবেন। সেখানে তোমরা কোন উচু জায়গা ও ভাঁজ দেখতে পাবে। না।” [সূরা ত্ব-হা: ১০৬–১০৭] হাদীসে এসেছে, ‘কেয়ামতের দিন পৃথিবীকে চামড়ার ন্যায় টেনে সম্প্রসারিত করা হবে। তারপর মানুষের জন্য সেখানে কেবলমাত্র পা রাখার জায়গাই থাকবে।” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪/৫৭১]

একথাটি ভালোভাবে বুঝে নেয়ার জন্য এ বিষয়টিও সামনে রাখতে হবে যে, সেদিন সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষের জন্ম হয়েছে ও হবে সবাইকে একই সংগে জীবিত করে আল্লাহর আদালতে পেশ করা হবে। এ বিরাট জনগোষ্ঠীকে এক জায়গায় দাঁড় করাবার জন্য সমস্ত সাগর, নদী, জলাশয়, পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, মালভূমি, তথা উঁচু-নীচু সব জায়গা ভেঙ্গে-চুরে ভরাট করে সারা দুনিয়াটাকে একটি বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পরিণত করা হবে। [দেখুন: ফাতহুল কাদীর; সা’দী]

৪. আর যমীন তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে ও শূন্যগর্ভ হবে।(১)
(১) অর্থাৎ পৃথিবী তার গর্ভস্থত সবকিছু উদগিরণ করে একেবারে শূন্যগর্ভ হয়ে যাবে। পৃথিবীর গর্ভে গুপ্ত ধন-ভাণ্ডার, খনি এবং সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মৃত মানুষের দেহকণা ইত্যাদি রয়েছে। যমীন এসব বস্তু আপন গৰ্ভ থেকে বাইরে নিক্ষেপ করবে। অনুরূপভাবে যত মৃত মানুষ তার মধ্যে রয়েছে সবাইকে ঠেলে বাইরে বের করে দেবে। [ফাতহুল কাদীর; সা’দী]

৫. এবং তার রবের আদেশ পালন করবে এটাই তার করণীয়।(১)
(১) যখন এসব ঘটনাবলী ঘটবে তখন কি হবে, একথা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। কারণ এ পরবর্তী বক্তব্যগুলো নিজে নিজেই তা প্ৰকাশ করে দিচ্ছে। এ বক্তব্যগুলোতে বলা হচ্ছেঃ হে মানুষ! তুমি তোমার রবের দিকে এগিয়ে চলছে। শীঘ্র তাঁর সামনে হাযির হয়ে যাবে। তখন তোমার আমলনামা তোমার হাতে দেয়া হবে। আর তোমার আমলনামা অনুযায়ী তোমাকে পুরস্কার দেয়া হবে। [কুরতুবী] সুতরাং উপরোক্ত ঘটনাবলী ঘটলে কি হবে তা সহজেই বুঝা যায় যে, মানুষ তখন পুনরুত্থিত হবে। তখন পুনরুত্থানের ব্যাপারে কেউ সন্দেহ পোষণ করবে না। কারণ বাস্তবতা যখন এসে যাবে তখন সন্দেহ করার আর সুযোগ কোথায়?

৬. হে মানুষ! তুমি তোমার রবের কাছে পৌছা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাত লাভ করবে।(১)
(১) كدح এর অর্থ কোন কাজে পূর্ণ চেষ্টা ও শক্তি ব্যয় করা। [ফাতহুল কাদীর] মানুষের প্রত্যেক চেষ্টা ও অধ্যবসায় আল্লাহর দিকে চূড়ান্ত হবে। অর্থাৎ মানুষ দুনিয়ায় যা কিছু কষ্ট-সাধনা প্ৰচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে সে মনে করতে পারে যে তা কেবল দুনিয়ার জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ এবং দুনিয়াবী স্বাৰ্থ লাভ করাই এর উদ্দেশ্য। কিন্তু আসলে সে সচেতন বা অচেতনভাবে নিজের রবের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং অবশেষে তাকে তার কাছেই পৌছতে হবে। মানুষ এখানে যে চেষ্টা-চরিত্র করছে, পরিশেষে তার পালনকর্তার কাছে পৌছে এর সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটবে এবং এর শুভ অথবা অশুভ পরিণতি সামনে এসে যাবে। অথবা এর অর্থ প্রত্যেক মানুষ আখেরাতে তার পালনকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং হিসাবের জন্যে তার সামনে উপস্থিত হবে। [দেখুন: কুরতুবী]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাত করতে চায়, আল্লাহও তার সাক্ষাত করতে পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাত করতে চায় না, আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাত করতে অপছন্দ করেন।” আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা (অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন স্ত্রী) বলেন, “আমরা তো মৃত্যুকে অপছন্দ করি।” রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তা নয়। কিন্তু মুমিন ব্যক্তির যখন মৃত্যু ঘণিয়ে আসে, তখন তাকে আল্লাহ তা'আলার সস্তুষ্টি ও সম্মানের সুসংবাদ দেওয়া হয়। তখন তার কাছে মৃত্যু অপেক্ষা অন্য কিছু প্রিয় হতে পারে না। এভাবে সে আল্লাহর সাক্ষাত করতে পছন্দ করে, তাই আল্লাহ্ তা'আলাও তার সাথে সাক্ষাত করতে পছন্দ করেন। আর কাফির ব্যক্তিকে মৃত্যুর সময় আল্লাহর আযাব ও শাস্তির সংবাদ দেওয়া হয়, তখন মৃত্যু অপেক্ষা অপ্রিয় আর কিছু থাকে না। সে আল্লাহর সাক্ষাত অপছন্দ করে বিধায় আল্লাহ্ তা'আলা তার সাথে সাক্ষাত অপছন্দ করেন”। [বুখারী: ৬৫০৭, মুসলিম: ২৬৮৩]

৭. অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে।
৮. তার হিসেব-নিকেশ সহজেই নেয়া হবে।(১)
(১) এতে মুমিনদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাদের আমলনামা ডান হাতে আসবে। এবং তাদের সহজ হিসাব নিয়ে জান্নাতের সুসংবাদ দান করা হবে। তারা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে হৃষ্টচিত্তে ফিরে যাবে। তার হিসেব নেয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হবে না। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে না, ওমুক ওমুক কাজ তুমি কেন করেছিলে? ঐসব কাজ করার ব্যাপারে তোমার কাছে কি কি ওযর আছে? নেকীর সাথে সাথে গোনাহও তার আমলনামায় অবশ্যি লেখা থাকবে। কিন্তু গোনাহের তুলনায় নেকীর পরিমাণ বেশী হবার কারণে তার অপরাধগুলো উপেক্ষা করা হবে এবং সেগুলো মাফ করে দেয়া হবে। কুরআন মজিদে অসৎকর্মশীল লোকদের কঠিন হিসেবা-নিকেশের জন্য “সু-উল হিসাব” (খারাপভাবে হিসেব নেয়া) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। [সূরা আর-রা'দ ১৮]

সৎ লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “এরা এমন লোক যাদের সৎকাজগুলো আমি গ্ৰহণ করে নেবো এবং অসৎকাজগুলো মাফ করে দেবো।” [সূরা আল-আহকাফঃ ১৬] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, কেয়ামতের দিন যার হিসাব নেয়া হবে, সে আযাব থেকে রক্ষা পাবে না। এ কথা শুনে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রশ্ন করলেন, কুরআনে কি (فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا) বলা হয়নি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই আয়াতে যাকে সহজ হিসাব বলা হয়েছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে পরিপূর্ণ হিসাব নয়; বরং কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলমীনের সামনে পেশ করা। যে ব্যক্তির কাছ থেকে তার কাজকর্মের পুরোপুরি হিসাব নেয়া হবে, সে আযাব থেকে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। [বুখারী: ৪৯৩৯, মুসলিম: ২৮৭৬l

৯. এবং সে তার স্বজনদের কাছে(১) প্ৰফুল্লচিত্তে ফিরে যাবে;
(১) কোনো কোনো মুফাস্‌সির বলেন, নিজের লোকজন বলতে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও সাথী-সহযোগীদের কথা বুঝানো হয়েছে। তাদেরকেও একইভাবে মাফ করে দেয়া হয়ে থাকবে। কাতাদাহ বলেন, এখানে পরিবার বলে জান্নাতে তার যে পরিবার থাকবে তাদের বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]

১০. আর যাকে তার আমলনামা তার পিঠের পিছনদিক থেকে দেয়া হবে,
১১. সে অবশ্যই তার ধ্বংস ডাকবে;
১২. এবং জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হবে;
১৩. নিশ্চয় সে তার স্বজনদের মধ্যে আনন্দে ছিল,
১৪. সে তো ভাবত যে, সে কখনই ফিরে যাবে না(১);
(১) অর্থাৎ যার আমলনামা তার পিঠের দিক থেকে বাম হাতে আসবে, সে মরে মাটি হয়ে যাওয়ার আকাঙ্খা করবে, যাতে আযাব থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু সেখানে তা সম্ভবপর হবে না। তাকে জাহান্নামে দাখিল করা হবে। এর এক কারণ এই বলা হয়েছে যে, সে দুনিয়াতে তার পরিবার-পরিজনের মধ্যে আখেরাতের প্রতি উদাসীন হয়ে আনন্দ উল্লাসে দিন যাপন করত। সে তার রবের কাছে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাসী ছিল না। হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত হবে না। কারণ সে পুনরুত্থানে ও আখেরাতে মিথ্যারোপ করত। [ফাতহুল কাদীর]

১৫. হ্যাঁ,(১) নিশ্চয় তার রব তার উপর সম্যক দৃষ্টি দানকারী।
(১) অর্থাৎ সে যা মনে করেছে তা ঠিক নয়। সে অবশ্যই তার রবের কাছে ফিরে যাবে। অবশ্যই সে পুনরুথিত হবে। [ফাতহুল কাদীর]

১৬. অতঃপর আমি শপথ করছি(১) পশ্চিম আকাশের লালিমার,
(১) এখানে আল্লাহ্ তা'আলা তিনটি বস্তুর শপথ করে মানুষকে আবার (إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَىٰ رَبِّكَ) আয়াতে বর্ণিত বিষয়ের প্রতি মনোযোগী করেছেন। শপথের জওয়াবে বলা হয়েছে যে, মানুষ এক অবস্থার উপর স্থিতিশীল থাকে না বরং তার অবস্থা প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হতে থাকে। যৌবন থেকে বাৰ্ধক্য, বাৰ্ধক্য থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে বরযখ (মৃত্যু ও কিয়ামতের মাঝখানের জীবন), বরযখ থেকে পুনরুজ্জীবন, পুনরুজ্জীবন থেকে হাশরের ময়দান তারপর হিসেব-নিকেশ এবং শাস্তি ও পুরস্কারের অসংখ্য মনযিল মানুষকে অতিক্রম করতে হবে। এ বিভিন্ন পৰ্যায় প্রমাণ করছে যে, একমাত্র আল্লাহই তার মা’বুদ, তিনি বান্দাদের কর্মকাণ্ড নিজস্ব প্রজ্ঞা ও রহমতে নিয়ন্ত্রণ করেন। আর বান্দা মুখাপেক্ষী, অপারগ, মহান প্রবল পরাক্রমশালী দয়ালু আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। [বাদায়ে’উত তাফসীর; ফাতহুল কাদীর; সা’দী]

১৭. আর শপথ রাতের এবং তা যা কিছুর সমাবেশ ঘটায় তার,
১৮. এবং শপথ চাঁদের, যখন তা পূর্ণ হয়;
১৯. অবশ্যই তোমরা এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ করবে।(১)
(১) استق শব্দটি وسق থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ একত্রিত করা, পূর্ণ করা। চন্দ্রের একত্রিত করার অর্থ তার আলোকে একত্রিত করা। এটা চৌদ্দ তারিখের রাত্রিতে হয়, যখন চন্দ্র পূর্ণ হয়ে যায়। [ইবন কাসীর] এখানে চন্দ্রের বিভিন্ন অবস্থার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে। চন্দ্র প্রথমে খুবই সরু ধনুকের মতো দেখা যায়। এরপর প্রত্যহ এর আলো বৃদ্ধি পেতে পেতে পূর্ণিমার চাদ হয়ে যায়। অবিরাম ও উপর্যুপরি পরিবর্তনের সাক্ষ্যদাতা উপরোক্ত বস্তুগুলোর শপথ করে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “অবশ্যই তোমরা ধাপে ধাপে আরোহণ করবে”। طبق এর অর্থ অবস্থা, স্তর, পর্যায় ইত্যাদি। [ইবন কাসীর] تَرْكَبُنَّ শব্দটি ركوب থেকে। এর অর্থ আরোহণ করা। অর্থ এই যে, হে মানুষ, তোমরা সর্বদাই এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ করতে থাকবে। উদ্দেশ্য এই যে, সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মানুষ কোন সময় এক অবস্থায় স্থির থাকে না, বরং তার ওপর পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসতে থাকে। স্বাভাবিকভাবে যে সমস্ত পরিবর্তন হয় তা তো লক্ষণীয়।

তাছাড়া মানুষ নিজেও আল্লাহর দেয়া সহজসরল দ্বীন থেকে বিমুখ হয়ে অন্যান্য বাতিল দ্বীনের অনুসরণে প্রবৃত্ত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা তোমাদের পূর্বের লোকদের হাতে হাতে বিঘাতে বিঘাতে অনুসরণ করতে থাকবে, এমনকি তারা যদি ষাণ্ডার গর্তে ঢুকে থাকে তোমরাও তাদের অনুসরণ করে তাতে ঢুকবে” সাহাবায়ে কিরাম বললেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ইয়াহুদ ও নাসারা? তিনি বললেন, “তারা নয়তো কারা?” [বুখারী: ৭৩২০, মুসলিম: ২৬৬৯] [ইবন কাসীর]। এখানে ইবন জারীর আত-তাবারীর মত হচ্ছে, মানুষকে অবশ্যই কঠিন থেকে কঠিন পর্যায় অতিক্রম করতে হবে। আখেরাতের পর্যায়গুলোও উদ্দেশ্য হতে পারে। [তাবারী; ইবন কাসীর]

২০. অতঃপর তাদের কি হল যে, তারা ঈমান আনে না?
২১. আর যখন তাদের কাছে কুরআন পাঠ করা হলে তখন তারা সিজদা করে না?(১)
(১) অর্থাৎ যখন তাদের সামনে সুস্পষ্ট হেদায়েত পরিপূর্ণ কুরআন পাঠ করা হয়, তখনও তারা আল্লাহর দিকে নত হয় না। سجود এর আভিধানিক অর্থ নত হওয়া, আনুগত্য করা। বলাবাহুল্য, এখানে পারিভাষিক সাজদার পাশাপাশি আল্লাহর সামনে আনুগত্য সহকারে নত হওয়া তথা বিনীত হওয়াও উদ্দেশ্য। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ সূরা পড়ে সাজদাহ করলেন, তারপর লোকদের দিকে ফিরে জানালেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং এ সূরা পড়ার পরে সাজদাহ করেছেন। [মুসলিম: ৫৭৮]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি এশার সালাতে এ সূরা পাঠের পর সাজদাহ করলেন, এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর বললেন, আমি আবুল কাসেম (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পিছনে সাজদাহ করেছি, সুতরাং তার সাথে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সাজদাহ করবই।” [বুখারী: ১০৭৮, মুসলিম: ৫৭৮]

২২. বরং কাফিররা মিথ্যারোপ করে।
২৩. আর তারা যা পোষণ করে আল্লাহ্ তা সবিশেষ অবগত।
২৪. কাজেই আপনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন;
২৫. কিন্তু যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।
তাফসীরে জাকারিয়া


**********************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url