হজ্জ সফরের সহজ গাইড (পর্ব-১)




হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

হজ্জের উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা

বাংলাদেশ থেকে সরকারি অথবা বেসরকারীভাবে যারা হজে যাবেন তারা এ গাইডে তাদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্যাদি সংক্ষিপ্তাকারে পাবেন।
হজ ইসলামের সর্বোৎকৃষ্ট ইবাদাতগুলোর অন্যতম। কোনো ইবাদত কবুলের জন্য ৩টি শর্ত পূরণ প্রযোজ্য –

(১) আল ঈমান: ঈমানের সকল বিষয়ের ওপর সঠিক বিশ্বাস (সহীহ আকীদা) স্থাপন করা।
(২) আল ইখলাস: নিয়ত ও ইবাদত একমাত্র একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আনুগত্যের জন্য করা।
(৩) ইত্তিবাউস সুন্নাহ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত যে শরী‘আত নিয়ে এসেছেন তার অনুসরণের মাধ্যমে করা।

বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন মাযহাব, দল ও মতের অনুসারীরা হজ পালনের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করলেও হজের মৌলিক বিধি-বিধান প্রায় সকলেরই এক।
এদের মধ্যে কে সঠিক আর কে সঠিক নয় সেটি নিরুপণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কুরআন ও সহীহ হাদীসের তথ্যসূত্র দিয়ে আমি এমন একটা পন্থা দেখিয়ে দিতে চেষ্টা করবো যে উপায়ে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ করেছেন এবং তাঁর সাহাবীগণ হজ পালন করেছেন। দীনের জ্ঞান শিক্ষা করা সকলের ওপর ফরয। তাই আমি আমার বইটি পড়ার অনুরোধ করবো এবং পাশাপাশি অন্য লেখকের আরো বই পড়ার পরামর্শ দিব। এরপর আপনার নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে যাচাই বাছাই করে যেটি সঠিক মনে হবে আপনি সেটিকে অনুসরণ করুন। কারো জ্ঞানের ওপর নির্ভর না করে আপনি নিজে জ্ঞান অর্জন করুন এবং তারপর আমল করুন। যতই অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকের সাথে আপনি হজে যান না কেন কেউ আপনাকে ত্রুটিহীন হজ করার বা মাকবূল হজের নিশ্চয়তা দিবে না। তাই নিজ হজ নিজ জ্ঞানের ভিত্তিতে করুন এবং নিজে আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ থাকুন।
আমার প্রত্যাশা -বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন হজ এজেন্সিগুলো তাদের হজ প্রশিক্ষণ গাইড হিসেবে এ গাইডটি ব্যবহার করবেন।

হজের তাৎপর্য

হজ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বুনিয়াদি স্তম্ভ।
হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ; সংকল্প করা বা ইচ্ছা করা।
আল্লাহর নির্দেশ মেনে ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সৌদি আরবের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে সফর করা এবং ইসলামী শরী‘আহ অনুসারে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার নামই হজ।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১০ম হিজরীতে একবার স্বপরিবারে হজ পালন করেন।
৯ম বা ১০ম হিজরীতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে হজকে ফরয করা হয়।
হজ সম্পন্ন করতে জিলহজের ৮ থেকে ১৩ তারিখে মধ্যে আরবের মক্কা, মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে হয়।
হজ সম্পাদনের অন্যতম একটি অংশ হলো ৯ যিলহজ আরাফা ময়দানে অবস্থান করা। এ আরাফা ময়দান হাশরের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে।
হাদীসে হজযাত্রীদের আল্লাহর মেহমান হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদে সূরা আল-হাজ (২২ নং সূরা) নামে একটি সূরা রয়েছে, যেখানে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচিত হয়েছে।
নারীদের জন্য হজ হলো জিহাদের সমতুল্য। আর এটি জান্নাত লাভের একটি অবলম্বন স্বরূপ।
হজ একজন মুসলিমের মাঝে শান্তি ও শুদ্ধি আনয়ন করে এবং অতীতের সকল পাপ মোচন করে দেয়।
হজ সফরে ইহরামের (কাফন) কাপড় পরে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে পরকালের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
হজের সফরে আল্লাহর বিধি-নিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে মুমিনের জীবন লাগামহীন নয়। মুমিনের জীবন আল্লাহর রশিতে বাঁধা।
হজের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেওয়া আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
হজ মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী মহাজাতিতে পরিণত হতে উদ্বুদ্ধ করে।
এখন বাংলাদেশ থেকে হজ সফর সম্পাদন করতে ১৫-৪০ দিন সময় লাগে।
বর্তমানে সমগ্র পৃথিবী থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৫-৩০ লক্ষাধিক মুসলিম হজ পালন করেন।

কা‘বা ও হজ্জের ইতিহাস

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّ أَوَّلَ بَيۡتٖ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكٗا وَهُدٗى لِّلۡعَٰلَمِينَ ٩٦﴾ [ال عمران: ٩٦]

‘‘নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদত গৃহটি (কা‘বা) নির্মিত হয় সেটি বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত। একে কল্যাণ ও বরকতময় করা হয়েছে এবং সৃষ্টিকুলের জন্য পথপ্রদর্শক করা হয়েছে’’। [সূরা-আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬]

বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বা কা‘বাকে বাইতুল আতীকও বলা হয়। কারণ, আল্লাহ এ ঘরকে কাফের শাসকদের থেকে স্বাধীন করেছেন। অথবা আতীক অর্থ প্রাচীন। কারণ এ ঘরটি সর্ব প্রাচীন ইবাদত ঘর। আশ্চর্যের বিষয় হলো -এ ঘরের স্থানটি পৃথিবীর ভৌগলিক মানচিত্রের কেন্দ্রে অবস্থিত।

কা‘বা ঘর নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে একাধিকবার। কারও কারও মতে পাঁচবার: (১) ফিরিশতা কর্তৃক (২) আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক (৩) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক (৪) জাহেলী যুগে কুরাইশ সম্প্রদায় কর্তৃক (৫) ইবন যুবায়ের কর্তৃক। তবে বিশুদ্ধ মতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম কা‘বা ঘর নির্মাণ করেন।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে বলেন,

﴿جَعَلَ ٱللَّهُ ٱلۡكَعۡبَةَ ٱلۡبَيۡتَ ٱلۡحَرَامَ قِيَٰمٗا لِّلنَّاسِ﴾ [المائ‍دة: ٩٧]

‘‘আল্লাহ কা‘বাকে সম্মানিত ঘর করেছেন, মানুষের স্থীতিশীলতার কারণ করেছেন’’। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৯৭]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ﴾ [البقرة: ١٢٥]

‘‘এবং আমরা ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল-কে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের, ই‘তিকাফকারীদের, রুকু ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’’। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৫]

কা‘বা ও হজের ইতিহাসে রয়েছে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মহৎ ইসলামী আখ্যান। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে তার স্ত্রী হাজের ও পুত্র ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামকে মরুময়, পাথুরে ও জনশূন্য মক্কা উপত্যকায় রেখে আসার নির্দেশ দেন -এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ।

প্রচণ্ড পানির পিপাসায় ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তাঁর মা ‘হাজের’ পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে ৭ বার ছুটাছুটি করেন। অতঃপর জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে শিশু ইসমাঈলের জন্য সৃষ্টি করলেন সুপেয় পানির কূপ -যমযম। আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালাম দু’জনে যমযম কূপের পাশে ইবাদতের লক্ষে কা‘বার পুণঃনির্মাণ কাজ শুরু করলেন।

আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আনুগত্য দেখার জন্য আরেকটি পরীক্ষা নিলেন। তিনি ইবরাহীম আলাইহিসকে সালাম স্বপ্নে দেখালেন যে, তিনি তার পুত্রকে কুরবানি করছেন। আর এ স্বপ্নানুসারে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন বাস্তবে তার পুত্রকে জবাই করতে উদ্যত হলেন তখন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন এবং ইবরাহীমের পুত্রের স্থলে একটি পশু কুরবানি করিয়ে দিলেন। সেই থেকে হজের সাথে সাথে চলে আসছে এ নিয়ম, মুসলিম বিশ্বে যা ঈদুল আযহা (কুরবানী ঈদ বা বকরা ঈদ) নামে পরিচিত।

ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর পবিত্র কা‘বা বিভিন্ন জাতি-উপজাতির দখলে চলে আসে এবং তারা একে মুর্তি পূজার জন্য ব্যবহার করতে থাকে এবং এ সময়ে উপত্যকা এলাকায় মৌসুমী বন্যার কবলে পড়ে কা‘বা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

অতঃপর ৬৩০ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিমগণ কা‘বার মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলেন এবং কা‘বাকে পুনরায় আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন।

কুরাইশরা যখন কা‘বা পুণঃনির্মাণ করেন, তখন জান্নাত থেকে আসা পাথর ‘হাজারে আসওয়াদ’কে কা‘বার এক কোণে স্থাপন করা হয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। কা‘বার এক পার্শ্বে একটি স্থান রয়েছে যার নাম ‘মাকামে ইবরাহীম’; এখানে দাঁড়িয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কা‘বার নির্মাণ কাজ পর্যবেক্ষণ করতেন, এখানে একটি পাথরে তাঁর পদছাপ রয়েছে। কা‘বা ঘরের উত্তর দিকে কা‘বা সংলগ্ন অর্ধ-বৃত্তাকার একটি উচু দেওয়াল আছে যা কা‘বা ঘরেরই অংশ যার নাম ‘হাতিম’ বা হিজর। হাজরে আসওয়াদ ও কা‘বা ঘরের দরজার মাঝের স্থানকে ‘মুলতাযাম’ বলা হয়। কা‘বা ঘরকে বৃষ্টি ও ধুলাবালীর থেকে রক্ষার জন্য একটি চাদর দ্বারা আবৃত করে রাখা হয় যা ‘গিলাফ’ নামে পরিচিত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারীরা যেসব পথে ঘুরে হজ পালন করেছেন এর মধ্যে রয়েছে; কা‘বা তাওয়াফ করা, সাফা ও মারওয়া পর্বতের মধ্যে সা‘ঈ করা, মিনায় অবস্থান করা ও আরাফায় উকুফ করা এবং মুযদালিফায় রাত্রিযাপন করা, জামারাতে কংকর নিক্ষেপ করা এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ত্যাগের স্মৃতিচারণ ও আল্লাহর স্মরণকে বুলন্দ করার জন্য পশু যবেহ করা।

একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার; আল্লাহ তা‘আলা কা‘বার ভিতরে অবস্থান করেন না বা আমরা মুসলিমরা কা‘বার উপাসনা করি না বা কা‘বা থেকে কোনো বরকত হাসিল করা যায় না। কা‘বা হচ্ছে ‘কিবলা’ - যা মুসলিমদের জন্য দিক নির্ণায়ক ও ঐক্কের লক্ষ্য। আমরা মুসলিমরা সম্মিলিতভাবে কা‘বার দিকে মুখ করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করি।

কা‘বার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও উচ্চতা:

হজের নির্দেশনা, গুরুত্ব ও পুরস্কার

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَذِّن فِي ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَجِّ يَأۡتُوكَ رِجَالٗا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٖ يَأۡتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٖ ٢٧﴾ [الحج: ٢٧]

‘‘এবং মানষের মাঝে হজের কথা ঘোষণা করে দাও; তারা পায়ে হেঁটে ও শীর্ণ উটের পিঠে করে তোমার কাছে আসবে, তারা দুর-দুরান্তের পথ অতিক্রম করে আসবে (হজ এর উদ্দেশ্যে)’’। [সুরা আল-হাজ, আয়াত: ২৭]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فِيهِ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ مَّقَامُ إِبۡرَٰهِيمَۖ وَمَن دَخَلَهُۥ كَانَ ءَامِنٗاۗ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧﴾ [ال عمران: ٩٧]

‘‘আর এতে রয়েছে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ, যে মাকামে ইবরাহীমে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। আর যার সামর্থ্য রয়েছে (শারীরিক ও আর্থিক) তার এ কা‘বায় এসে হজ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয বা অবশ্য কর্তব্য, আর যদি কেউ এ বিধান (হজ) কে অস্বীকার করে তবে; (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ সৃষ্টিকুলের কারো মুখাপেক্ষী নন’’। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ فَمَنۡ حَجَّ ٱلۡبَيۡتَ أَوِ ٱعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَاۚ وَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَإِنَّ ٱللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ ١٥٨﴾ [البقرة: ١٥٨]

‘‘নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহে‎র অর্ন্তগত। যে ব্যক্তি (এ গৃহে) হজ ও উমরাহ করে তার জন্যে এ উভয় পাহাড়ের মাঝে প্রদক্ষিণ করা দোষণীয় নয় এবং কোনো ব্যক্তি নিষ্ঠার সাথে স্বেচ্ছায় সৎকর্ম করলে আল্লাহ কৃতজ্ঞতাপরায়ণ ও সর্বজ্ঞাত’’। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৮]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَتِمُّواْ ٱلۡحَجَّ وَٱلۡعُمۡرَةَ لِلَّهِۚ﴾ [البقرة: ١٩٦]

‘‘এবং তোমরা আল্লাহর জন্য হজ ও উমরাহ পালন কর’’। সূরা আল-বাকারা:আয়াত: ১৯৬]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُونِ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ﴾ [البقرة: ١٩٧]

‘‘আর তোমরা পাথেয় সঞ্চয় করে নাও (হজ যাত্রার জন্য), বস্তুতঃ সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া (আল্লাহভীতি) এবং হে জ্ঞানীরা, তোমরা আমারই তাকওয়া অবলম্বন কর’’। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৭]

বিদায় হজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘হে জনগণ! তোমরা আমার কাছ থেকে হজের নিয়ম-কানুন শিখে নাও’’।[১]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি হজের সংকল্প করে, সে যেন দ্রুত সেটা সম্পাদন করে’’।[২]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘হজ একবার, যে ব্যক্তি একাধিকবার করবে তা (তার জন্য) নফল হবে’’।[৩]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তিনটি দল আল্লাহর মেহমান; আল্লাহর পথে জিহাদকারী, হজকারী ও উমরাহ পালনকারী’’।[৪]
এক হাদীসে এসেছে, ‘‘উত্তম আমল কী -এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞসা করা হলো। উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হলো, ‘‘তারপর কী?’’, তিনি বললেন, আল্লাহ পথে জিহাদ। বলা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মাবরুর হজ।[৫]
বুরাইদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘হজ পালনে অর্থ ব্যয় করা আল্লাহর পথে ব্যয় করার সমতুল্য। এক দিরহাম ব্যয় করলে তাকে সাতশত পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়’’।[৬]
আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ ও জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আগুন যেভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য ও লোহা থেকে খাঁদ দূর করে, তেমনি যদি তোমরা তোমাদের দারিদ্রতা ও পাপ মোচন করতে চাও তাহলে তোমরা পর পর হজ ও উমরাহ পালন কর’’।[৭]
আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যদি কেউ হজ, উমরাহ পালন অথবা জিহাদের জন্য যাত্রা করে এবং পথিমধ্যে যদি তার মৃত্যু হয় তাহলে আল্লাহ এর জন্য তাকে পূর্ণ প্রতিদান দিয়ে দেবেন’’।[৮]
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করে আয়েশা বললেন, ‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি আপনাদের সাথে জিহাদ ও অভিযানে যাব না? তিনি বললেন, তোমাদের জন্য উত্তম জিহাদ হলো হজ (তথা মাবরুর হজ)’’।[৯]
হাদীসে আরও এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কারো ইসলাম গ্রহণ পূর্বকৃত সকল পাপকে মুছে দেয়। হিজরত তার পূর্বের সকল গুনাহ মুছে দেয়, ও হজ তার পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়’’।[১০]
আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ পালন করল এবং নিজেকে গর্হিত পাপ কাজ ও সকল ধরনের পাপ কথা থেকে বিরত রাখল তাহলে সে হজ থেকে এমন নিষ্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক হয়ে ফিরে আসবে যেমন সে তার জন্মের সময় ছিল’’।[১১]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মাবরুর হজের (কবুল হজের) পুরষ্কার বা প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়’’।[১২]
[১] সহীহ মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ
[২] আবু দাউদ; মিশকাত, হাদীস নং ২৫২৩
[৩] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭২১
[৪] নাসাঈ, মিশকাত, হাদীস নং ২৫৩৭
[৫] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪২২
[৬] আহমদ, বায়হাকী
[৭] তিরমিযী, নাসাঈ
[৮] মিশকাত, হাদীস নং ২৫৩৯; মুসনাদে আবী ইয়া‘লা, হাদীস নং ৯১৬ (আল-মাকসাদুল ‘আলী); সহীহ আত-তারগীব আত-তারহীব, হাদীস নং ১২৬৭।
[৯] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৬১
[১০] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭৩
[১১] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪২৪
[১২] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৭৩/১৬৫০

হজ সম্পর্কে ভুল ধারণা ও শাস্তি

অনেক সাধারণ মানুষই সামর্থ্য হওয়ার পরও মনে করেন -কেন কম বয়সে হজ করবো? হজ করলে তো আমাকে হজ ধরে রাখতে হবে! পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম অনুসরণ না করা পর্যন্ত তো হজে যাওয়া ঠিক হবে না! হজ করলে তো আর টিভি, গান-বাজনা দেখা যাবে না! সহজ পন্থায় (অবৈধ) অর্থ উপার্জন করতে পারব না! হজ করার পর যদি আমি খারাপ কাজে লিপ্ত হই তাহলে লোকেই বা কী বলবে!.. সুতরাং এখন জীবনকে উপভোগ করি, আর কিছু টাকা পয়সা উপার্জন করে নেই। আর তারপর বৃদ্ধ বয়সে যখন কোনো কিছু করার থাকবে না তখন গিয়ে হজ করে আসব!! তখন আল্লাহ অবশ্যই আমার অতীতের সকল পাপ মাফ করে দেবেন এবং আমি ইনশা-আল্লাহ জান্নাতে যেতে পারবো!! কি যুক্তি আর বুদ্ধিমান আমরা চিন্তা করেছেন!
-হে আল্লাহ তুমি আমাদের দয়া ও হিদায়াত দান কর। আমরা যদি মনে করি, আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে চালাকি করব, তাহলে মনে রাখবেন এর মাধ্যমে আমরা আসলে আমাদের নিজেদেরকেই বোকা বানাচ্ছি, দোষী করছি এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবো।

যারা সামর্থ্য হওয়ার পরও হজকে মুলতবি করে রেখেছেন তাদের জন্য বড় সতর্কবাণী হলো, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি হজের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ পরিত্যাগ করল, সে ইয়াহূদী হয়ে মরুক অথবা নাসারা হয়ে মরুক -তাতে কিছু যায় আসে না’’।[১]
উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘‘আমার ইচ্ছা হয় যে, কিছু লোককে রাজ্জ্যের শহরগুলোতে প্রেরণ করি এবং তারা খুঁজে দেখুক ঐ সমস্ত লোককে যাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ পালন করে না তাদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করা হোক। কেননা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা হজ পালন করে না তারা মুসলিম নয়, তারা মুসলিম নয়’’।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে হজ পালন করতে চায় সে যেন দ্রুত তা পালন করে। কেননা সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে অথবা কোনো সমস্যায় জর্জরিত হয়ে হজ করার সুযোগ হারাতে পারে”।[২]
হজের সামর্থ্য হওয়ার সাথে সাথেই হজ পালন করা উচিত। কারণ মৃত্যু কখন চলে আসতে পারে তা জানা নেই। অলসতার কারণে একটি ফরয ইবাদত বাকি রেখে মারা গেলে তো আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

[১] সুনানুল কুবরা, হাদীস নং ৮৯২৩
[২] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৩২

কৃতজ্ঞতা: মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান এর লেখা
হজ সফরে সহজ গাইড’ নাম পুস্তক থেকে হুবহু কপি করা হয়েছে।



***************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url