কাফিররেদের ভয়াবহ পরিণাম (পর্ব-৩)






 সুরা আন-নাহাল     আয়াত: ১০৬ 

১৬:১০৬ مَنۡ کَفَرَ بِاللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ اِیۡمَانِهٖۤ اِلَّا مَنۡ اُکۡرِهَ وَ قَلۡبُهٗ مُطۡمَئِنٌّۢ بِالۡاِیۡمَانِ وَ لٰکِنۡ مَّنۡ شَرَحَ بِالۡکُفۡرِ صَدۡرًا فَعَلَیۡهِمۡ غَضَبٌ مِّنَ اللّٰهِ ۚ وَ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ

আয়াতের বাংলা অনুবাদ
১০৬. যে ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে এবং যারা তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা উন্মুক্ত করেছে, তাদের উপরই আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব। ঐ ব্যক্তি ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয় (কুফরী করতে) অথচ তার অন্তর থাকে ঈমানে পরিতৃপ্ত।

আয়াতের তাফসীর

ঈমান আনার পর কুফরকারীর জন্য রয়েছে মহাশাস্তি

১০৬. কেউ তার ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফরী করলে এবং কুফরীর জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি(১); তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরীর জন্য বাধ্য(২) করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচলিত।(৩)

মুরতাদ চিরস্থায়ী জাহান্নামে যাবে

(১) দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় স্থানেই মুরতাদের জন্য রয়েছে শাস্তি। মুরতাদ আখেরাতে চিরস্থায়ী জাহান্নামে যাবে। দুনিয়াতে তার শাস্তি হলোঃ মৃত্যুদণ্ড। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে তার দ্বীন (ইসলাম) পরিবর্তন করে তাকে তোমরা হত্যা কর”। [বুখারীঃ ৬৯২২] এটা এ জন্যই যে, সে হক্ক দ্বীনের প্রতি অপবাদ দিচ্ছে। যে শুধু নিজেকে ধ্বংস করছেন তার সাথে হাজারো মানুষের মনে দ্বীন সম্পর্কে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এতে করে সে মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তাকে বাধ্য করা হয়নি। সে বুঝে-শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছে সুতরাং এর বিপরীতটি তার থেকে গ্রহণ করা যাবে না।

(২) إكراه এর শাব্দিক অর্থ এই যে, কোন ব্যক্তিকে এমন কথা বলতে অথবা এমন কাজ করতে বাধ্য করা, যা বলতে বা করতে সে সম্মত নয়। আয়াতের অর্থ হচ্ছে এমন জোর-জবরদস্তি, যা মানুষকে ক্ষমতাহীন ও অক্ষম করে দেয়। এমন জবরদস্তির অবস্থায় অন্তর ঈমানের উপর স্থির ও অটল থাকার শর্তে মুখে কুফর কালেমা উচ্চারণ করা জায়েয। [কুরতুবী]


ইসলামের প্রথম শহীদ

(৩) এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দিয়ে কুফরী কালাম উচ্চারণ করতে বাধ্য করা হয়, যদি প্রবল বিশ্বাস থাকে যে, হুমকিদাতা তা কার্যে পরিণত করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখে, তবে এমন জবরদস্তির ক্ষেত্রে সে যদি মুখে কুফরী কালাম উচ্চারণ করে, তবে তাতে কোন গোনাহ নেই এবং তার স্ত্রী তার জন্য হারাম হবে না। তবে শর্ত এই যে, তার অন্তর ঈমানে অটল থাকতে হবে এবং কুফরী কালামকে মিথ্যা ও মন্দ বলে বিশ্বাস করতে হবে। আলোচ্য আয়াতটি কতিপয় সাহাবী সম্পর্কে নাযিল হয়, যাদেরকে মুশরিকরা গ্রেফতার করেছিল এবং হত্যার হুমকী দিয়ে কুফরী অবলম্বন করতে বলেছিল।

যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, তারা ছিলেন আম্মার, তদীয় পিতা ইয়াসির, মাতা সুমাইয়্যা, সুহায়েব, বেলাল এবং খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহুম। তাদের মধ্যে ইয়াসির ও তার স্ত্রী সুমাইয়্যা কুফরী কালাম উচ্চারণ করতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। ইয়াসিরকে হত্যা করা হয় এবং সুমাইয়্যাকে দুই উটের মাঝখানে বেঁধে উট দুটিকে দু’দিকে হাকিয়ে দেয়া হয়। ফলে তিনি দ্বিখণ্ডিত হয়ে শহীদ হন। হযরত ইয়াসির হলেন ইসলামের প্রথম শহীদ, হযরত সুমাইয়্যা হলেন ইসলামের প্রথম নারী শহীদ। দু’জন মহাত্মাই ইসলামের জন্য সর্বপ্রথম শাহাদাত বরণ করেন। [দেখুন, বাগভী; কুরতুবী]

তবে আয়াতের অর্থ এ নয় যে, প্রাণ বাঁচাবার জন্য কুফরী কথা বলা বাঞ্ছনীয়। বরং এটি নিছক একটি “রুখসাত” তথা সুবিধা দান ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি অন্তরে ঈমান অক্ষুন্ন রেখে মানুষ বাধ্য হয়ে এ ধরনের কথা বলে তাহলে তাকে কোন জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে না। অন্যথায় আযীমাত তথা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ঈমানের পরিচয়ই হচ্ছে এই যে, মানুষের এ রক্তমাংসের শরীরটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও সে যেন সত্যের বাণীরই ঘোষণা দিয়ে যেতে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুবারক যুগে এ উভয় ধরনের ঘটনার নজির পাওয়া যায়। একদিকে আছেন খাব্বাব ইবনে আরত রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে জ্বলন্ত অংগারের ওপর শোয়ানো হয়। এমনকি তাঁর শরীরের চর্বি গলে পড়ার ফলে আগুন নিভে যায়। কিন্তু এরপরও তিনি দৃঢ়ভাবে ঈমানের ওপর অটল থাকেন। বিলাল হাবশীকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) লোহার বর্ম পরিয়ে দিয়ে কাঠফাটা রোদে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। তারপর উত্তপ্ত বালুকা প্রান্তরে শুইয়ে দিয়ে তার ওপর দিয়ে তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তিনি আহাদ আহাদ শব্দ উচ্চারণ করে যেতেই থাকেন। [দেখুনঃ ইবনে মাজাহঃ ১৫০]

আর একজন সাহাবী ছিলেন হাবীব ইবন যায়েদ ইবন আসেম রাদিয়াল্লাহু আনহু। মুসাইলামা কাযযাবের হুকুমে তাঁর শরীরের প্রত্যেটি অংগ-প্রত্যংগ কাটা হচ্ছিল এবং সেই সাথে মুসাইলামাকে নবী বলে মেনে নেবার জন্য দাবী করা হচ্ছিল। কিন্তু প্রত্যেক বারই তিনি তার নবুওয়াত দাবী মেনে নিতে অস্বীকার করছিলেন এভাবে ক্রমাগত অংগ-প্রত্যংগ কাটা হতে হতেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। অন্যদিকে আছেন আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু। আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখের সামনে তাঁর পিতা ও মাতাকে কঠিন শাস্তি দিয়ে দিয়ে শহীদ করা হয়।

তারপর তাকে এমন কঠিন অসহনীয় শাস্তি দেয়া হয় যে, শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তিনি কাফেরদের চাহিদা মত সবকিছু বলেন। এরপর তিনি কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হন এবং আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনাকে মন্দ এবং তাদের উপাস্যদেরকে ভাল না বলা পর্যন্ত তারা আমাকে ছেড়ে দেয়নি” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন “তোমার মনের অবস্থা কি?” জবাব দিলেন “ঈমানের ওপর পরিপূর্ণ নিশ্চিত।” একথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “যদি তারা আবারো এ ধরনের জুলুম করে তাহলে তুমি তাদেরকে আবারো এসব কথা বলে দিয়ো।” [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩৫৭, বাইহাকীর আস-সুনানুল কুবরা ২/২০৮-২০৯]।

আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ আস-সাহমী (রাঃ) এর ঈমান

তবে ঈমানের উপর অবিচল থাকার কিছু নিদর্শন সাহাবাদের জীবনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরবর্তী সময়েও পাওয়া যায়। প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ আস-সাহমীকে রোমের নাসারাগণ কয়েদ করে তাদের রাজার কাছে নিয়ে গেলে তাদের রাজা তাকে বললঃ নাসারাদের দ্বীন গ্রহণ কর, আমি তোমাকে আমার রাজত্বের ভাগ দেব এবং আমার কন্যাকে তোমার সাথে বিয়ে দেব। তিনি তাকে বললেনঃ যদি আমাকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বীন থেকে বিচ্যুত হওয়ার বিনিময়ে তুমি যা কিছুর মালিক তা এবং আরবদের সমস্ত সাম্রাজ্যও দাও, তবুও আমি ক্ষণিকের জন্যও তা করব না। রাজা বললঃ তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করব।

তিনি বললেনঃ তুমি সেটা করতে পার। তারপর রাজা তাকে শূলে চড়াবার আদেশ করল। এরপর তীরন্দাযদের তাকে কাছ থেকে তার হাত ও পায়ের পার্শ্বে তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিল। রাজা তখনও তাকে নাসারাদের দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকল। তিনি অস্বীকার করতে থাকলেন। রাজা তাকে শূল থেকে নামানোর নির্দেশ দিলেন। তারপর একটি বড় ডেকচি আনার নির্দেশ দিলেন। তাতে পানি দিয়ে গরম করা হলো, তারপর তার সামনেই একজন মুসলিম কয়েদীকে এনে তাতে ফেলা হলো, ক্ষনিকেই কয়েদীটি হাডিতে পরিণত হলো। এমতাবস্থায়ও তার কাছে নাসারাদের দ্বীন গ্রহণের দাওয়াত দেয়া হলো কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। তখন তাকে এ ডেকচির মধ্যে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হলো। তারপর তাকে যখন নিক্ষেপ করার জন্য উপরে উঠানো হলো তখন তিনি কাঁদলেন। তখন রাজা আশ্বস্ত হলো এবং তাকে ডাকল।

তখন তিনি বললেনঃ আমি তো এজন্যই কেঁদেছি যে, আমার আত্মাতো একটি মাত্র যা এ মূহুর্তে ডেকচিতে আল্লাহর ওয়াস্তে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, আমার আকাংখা হলো যে, হায়! যদি আমার শরীরের প্রত্যেক পশমের পরিমাণ আত্মা হতো এবং সবগুলি আত্মা আল্লাহর জন্য এধরনের শাস্তি পেত। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, রাজা তাকে কয়েদ করে রেখে তাকে কয়েকদিন কোন খাবার সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকল। তারপর তাকে মদ এবং শুকরের গোস্ত দেয়া হলো। কিন্তু তিনি এর কাছেও ঘেষলেন না। তখন রাজা তাকে ডেকে বললোঃ তোমাকে খেতে বারণ করেছে কিসে? তিনি তখন বললেনঃ যদিও আমার জন্য এ অবস্থায় এ দু’টো বস্তু খাওয়া বৈধ তবুও আমি তোমাকে আমার বিপদগ্ৰস্ততা থেকে খুশী হতে দিতে পারি না। তখন রাজা তাকে বললোঃ তাহলে তুমি আমার মাথায় চুমু খাও, আমি তোমাকে ছেড়ে দেব।

তিনি বললেনঃ আমার সাথী সমস্ত মুসলিম কয়েদীকেও ছেড়ে দেবে? রাজা বললোঃ হ্যাঁ। তখন তিনি রাজার মাথায় চুম্বন করলেন। রাজা তাকে ছেড়ে দিল এবং তার সাথের সমস্ত মুসলিম কয়েদীকেও ছেড়ে দিল। তারপর যখন তিনি উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে ফিরে আসলেন তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ প্রত্যেক মুসলিমের উচিত আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফার মাথায় চুমু খাওয়া। আর সেটা আমার দ্বারা শুরু হোক। এ কথা বলে তিনি দাঁড়ালেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফার মাথায় চুমু খেলেন। রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আরদাহুম। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া

 সুরা আল-কাহফ     আয়াত: ১০৬-১০৮ 

১৮:১০৬ ذٰلِکَ جَزَآؤُهُمۡ جَهَنَّمُ بِمَا کَفَرُوۡا وَ اتَّخَذُوۡۤا اٰیٰتِیۡ وَ رُسُلِیۡ هُزُوًا 
১৮:১০৭ اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ کَانَتۡ لَهُمۡ جَنّٰتُ الۡفِرۡدَوۡسِ نُزُلًا
১৮:১০৮ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا لَا یَبۡغُوۡنَ عَنۡهَا حِوَلًا 

আয়াতের বাংলা অনুবাদ
১০৬. ‘এ জন্যই তাদের প্রতিফল জাহান্নাম। কারণ তারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতসমূহ ও আমার রাসূলগণকে বিদ্রূপের বিষয় বানিয়েছে’। 
১০৭. নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের মেহমানদারির জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস।
১০৮. সেখানে তারা স্থায়ী হবে। তারা সেখান থেকে অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হতে চাইবে না। 

আয়াতের তাফসীর
(১০৬) জাহান্নাম, ওটাই তাদের প্রতিফল, যেহেতু তারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আমার নিদর্শনাবলী ও রসূলদেরকে গ্রহণ করেছে বিদ্রূপের বিষয়রূপে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান

ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের জন্য জান্নাতুল ফিরদাউস

১০৭. নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের আতিথেয়তার জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফিরদাউস।(১)

(১) فردوس এর অর্থ সবুজে ঘেরা উদ্যান। এটি আরবী শব্দ, না অনারব এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “তোমরা যখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর, তখন জান্নাতুল ফিরদাউসের প্রার্থনা কর। কেননা, এটা জান্নাতের সর্বোৎকৃষ্ট স্তর। এর উপরেই আল্লাহর আরশ এবং এখান থেকেই জান্নাতের সব নহর প্রবাহিত হয়েছে।” [বুখারীঃ ২৭৯০, ৭৪২৩, মুসনাদে আহমাদঃ ২/৩৩৫]
তাফসীরে জাকারিয়া

১০৮. সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, সেখান থেকে তারা স্থানান্তরিত হতে চাইবে না।(১)

(১) উদ্দেশ্য এই যে, জান্নাতের এ স্থানটি তাদের জন্য অক্ষয় ও চিরস্থায়ী নেয়ামত। যে জান্নাতে প্ৰবেশ করেছে, তাকে সেখান থেকে কখনো বের করা হবে না। কিন্তু এখানে একটি আশংকা ছিল এই যে, এক জায়গায় থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়া মানুষের একটি স্বভাব। সে স্থান পরিবর্তনের ইচ্ছা করে। যদি জান্নাতের বাইরে কোথাও যাওয়ার অনুমতি না থাকে, তবে জান্নাতও কি খারাপ মনে হতে থাকবে?  আলোচ্য আয়াতে এর জবাব দেয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে, জান্নাতের নেয়ামত ও চিত্তাকর্ষক পরিবেশের সামনে দুনিয়াতে দেখা ও ব্যবহার করা বস্তুসমূহ তার কাছে নগণ্য ও তুচ্ছ মনে হবে। জান্নাত থেকে বাইরে যাওয়ার কল্পনাও কোন সময় মনে জাগবে না। অৰ্থাৎ তার চেয়ে আরামদায়ক কোন পরিবেশ কোথাও থাকবে। না। ফলে জান্নাতের জীবন তার সাথে বিনিময় করার কোন ইচ্ছাই তাদের মনে জাগবে না। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া


 সুরা আল-আন’আম     আয়াত: ৯৩ 
৬. আল-আন'আম  ৯৩
৬:৯৩ وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰهِ کَذِبًا اَوۡ قَالَ اُوۡحِیَ اِلَیَّ وَ لَمۡ یُوۡحَ اِلَیۡهِ شَیۡءٌ وَّ مَنۡ قَالَ سَاُنۡزِلُ مِثۡلَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ ؕ وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذِ الظّٰلِمُوۡنَ فِیۡ غَمَرٰتِ الۡمَوۡتِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ بَاسِطُوۡۤا اَیۡدِیۡهِمۡ ۚ اَخۡرِجُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ اَلۡیَوۡمَ تُجۡزَوۡنَ عَذَابَ الۡهُوۡنِ بِمَا کُنۡتُمۡ تَقُوۡلُوۡنَ عَلَی اللّٰهِ غَیۡرَ الۡحَقِّ وَ کُنۡتُمۡ عَنۡ اٰیٰتِهٖ تَسۡتَکۡبِرُوۡنَ 

আয়াতের বাংলা অনুবাদ

সবচেয়ে বড় যালিম কে

৯৩. আর তার চেয়ে বড় যালিম কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে, অথবা বলে, ‘আমার উপর ওহী প্রেরণ করা হয়েছে’, অথচ তার প্রতি কোন কিছুই প্রেরণ করা হয়নি? এবং যে বলে ‘আমি অচিরেই নাযিল করব, যেরূপ আল্লাহ নাযিল করেছেন’। আর যদি তুমি দেখতে, যখন যালিমরা মৃত্যু কষ্টে থাকে, এমতাবস্থায় ফেরেশতারা তাদের হাত প্রসারিত করে আছে (তারা বলে), ‘তোমাদের জান বের কর। আজ তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে লাঞ্ছনার আযাব, কারণ তোমরা আল্লাহর উপর অসত্য বলতে এবং তোমরা তার আয়াতসমূহ সম্পর্কে অহঙ্কার করতে।

আয়াতের তাফসীর
(৯৩) আর যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে কিংবা বলে, ‘আমার নিকট প্রত্যাদেশ (অহী) হয়’, যদিও তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় না এবং যে বলে, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, আমিও ওর অনুরূপ অবতীর্ণ করব’, তার চেয়ে বড় যালেম আর কে? যদি তুমি দেখতে পেতে (তখনকার অবস্থা), যখন (ঐ) যালেমরা মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকবে, আর ফিরিশতাগণ হাত বাড়িয়ে বলবে, ‘তোমাদের প্রাণ বের কর। আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দান করা হবে;[১] কারণ তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে অন্যায় বলতে ও তাঁর আয়াত গ্রহণে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে।’[২]

কবর জীবন বা বারযাখী জীবন

[১] ‘যালেম’ বলতে প্রত্যেক যালেমকে বুঝানো হয়েছে এবং এর মধ্যে আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকারকারী ও নবুঅতের মিথ্যা দাবীদারগণ সর্বপ্রথম শামিল থাকবে। غَمَرَاتٌ থেকে মৃত্যু-যন্ত্রণাকে বুঝানো হয়েছে। ‘ফিরিশতাগণ হাত বাড়িয়ে’ অর্থাৎ, জান কবয করার জন্য। اليَوْمَ (আজ) অর্থাৎ, জান কবয করার দিন। আর এই দিন হল আযাব শুরু হওয়ার সময়; যার প্রথম স্থান হল কবর। আর এ থেকে এ কথাও সুসাব্যস্ত হয়ে যায় যে, কবরের আযাব সত্য। তা না হলে হাত বাড়ানো এবং প্রাণ বের করে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার সাথে এ কথা বলার কোন অর্থ থাকে না যে, আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে। স্মরণ থাকে যে, কবর বলতে উদ্দেশ্য বারযাখী জীবন। অর্থাৎ, ইহজগতের জীবনের পর এবং পরজগতের জীবনের (কিয়ামত ঘটার) পূর্বে এটা একটি মধ্যজগতের জীবন। যার সময়কাল হল, মানুষের মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত। এটাকে বলা হয় বারযাখী জীবন। চাহে তাকে কোন হিংস্র পশু খেয়ে নিক অথবা তার লাশ সামুদ্রিক তরঙ্গ-কবলিত হোক কিংবা জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হোক বা কবরে দাফন করা হোক। মরণের পর এ হল বারযাখী জীবন, যেখানে আযাব দেওয়ার শক্তি মহান আল্লাহর আছে।

[২] আল্লাহ সম্বন্ধে অন্যায় বা অসত্য বলার মধ্যে কিতাব অবতীর্ণ হওয়া ও রসূল প্রেরণের কথা অস্বীকার এবং নবী হওয়ার মিথ্যা দাবী করার কথাও শামিল আছে। নবুঅত ও রিসালাতের অস্বীকার এবং তা মেনে নেওয়ার ব্যাপারে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার ব্যাপারটাও অনুরূপ। এই উভয় কারণের ভিত্তিতে তাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান


 সুরা আল-আ’রাফ     আয়াত: ১৮২-১৮৩ 

৭:১৮২ وَ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا سَنَسۡتَدۡرِجُهُمۡ مِّنۡ حَیۡثُ لَا یَعۡلَمُوۡنَ
৭:১৮৩ وَ اُمۡلِیۡ لَهُمۡ ؕ۟ اِنَّ کَیۡدِیۡ مَتِیۡنٌ

আয়াতের বাংলা অনুবাদ
১৮২. আর যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে ধীরে ধীরে এমনভাবে পাকড়াও করব যে, তারা জানতেও পারবে না। 
১৮৩. আর আমি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি। নিশ্চয় আমার কৌশল শক্তিশালী। 

আয়াতের তাফসীর
১৮২. আর যারা আমাদের নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করেছে, অচিরেই আমরা তাদেরকে এমনভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাব যে, তারা জানতেও পারবে না।(১)

(১) অর্থাৎ দুনিয়াতে রিযিক ও জীবনোপকরণের ভাণ্ডার তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিবেন। ফলে তারা মনে করবে যে, তারা যা করে চলছে তা গ্রহণযোগ্য। এভাবেই তারা প্রতারিত হতে থাকবে। অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করবেন। [ইবন কাসীর] অন্য আয়াতেও এসেছে, “অতঃপর তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা ভুলে গেল তখন আমরা তাদের জন্য সবকিছুর দরজা খুলে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেয়া হল যখন তারা তাতে উল্লসিত হল তখন হঠাৎ তাদেরকে পাকড়াও করলাম; ফলে তখনি তারা নিরাশ হল। ফলে যালিম সম্প্রদায়ের মূলোচ্ছেদ করা হল এবং সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্যই [সূরা আল-আনআমঃ ৪৪–৪৫]
তাফসীরে জাকারিয়া

(১৮৩) আর আমি তাদেরকে ঢিল দেব, নিশ্চয় আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। [১]

[১] এ হল সেই ঢিল; যাতে অবকাশ দিয়ে ধীরে ধীরে পাকড়াও করা হয়; যা মহান আল্লাহ পরীক্ষা স্বরূপ ব্যক্তি ও জাতিকে দিয়ে থাকেন। তারপর যখন তার পাকড়াও করার ইচ্ছা হয়, তখন তাঁর শক্তি থেকে কেউ বাঁচতে পারে না। কারণ তাঁর কৌশল অতি শক্ত।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান

 সুরা আল-আনফাল     আয়াত: ৫৫ 

৮:৫৫ اِنَّ شَرَّ الدَّوَآبِّ عِنۡدَ اللّٰهِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ

আয়াতের বাংলা অনুবাদ
৫৫. নিশ্চয় আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী তারা, যারা কুফরী করে, অতঃপর ঈমান আনে না। 

আয়াতের তাফসীর

কুফরকারীরা নিকৃষ্টতম জীব

(৫৫) নিশ্চয় আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব তারাই, যারা সত্য প্রত্যাখ্যান (কুফরী) করেছে। সুতরাং তারা বিশ্বাস (ঈমান আনয়ন) করবে না। [১]

[১] شر الناس (নিকৃষ্টতম মানুষ) এর পরিবর্তে তাদেরকে شر الدوابّ (নিকৃষ্টতম জীব) বলা হয়েছে; যা আভিধানিক অর্থ হিসাবে এটা মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তু প্রভৃতির ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। কিন্তু সাধারণতঃ এর ব্যবহার চতুষ্পদ জন্তুর ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। বুঝা যায় যে, কাফেরদের সম্পর্ক মানুষের সাথে নয়। (বরং জন্তুর সাথে নিজের সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার ও অমান্য করে) কুফরে পতিত হয়ে তারা চতুষ্পদ জন্তু; বরং তার থেকেও নিকৃষ্ট জীব হয়ে গেছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
 সুরা আল-কাহফ     আয়াত: ১০৩-১০৫ 

১৮:১০৩ قُلۡ هَلۡ نُنَبِّئُکُمۡ بِالۡاَخۡسَرِیۡنَ اَعۡمَالًا
১৮:১০৪ اَلَّذِیۡنَ ضَلَّ سَعۡیُهُمۡ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ هُمۡ یَحۡسَبُوۡنَ اَنَّهُمۡ یُحۡسِنُوۡنَ صُنۡعًا
১৮:১০৫ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِ رَبِّهِمۡ وَ لِقَآئِهٖ فَحَبِطَتۡ اَعۡمَالُهُمۡ فَلَا نُقِیۡمُ لَهُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَزۡنًا 

আয়াতের বাংলা অনুবাদ
১০৩. বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন লোকদের কথা জানাব, যারা আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত’?
১০৪. দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করছে যে, তারা ভাল কাজই করছে’! 
১০৫. ‘তারাই সেসব লোক, যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে। ফলে তাদের সকল আমল নিষ্ফল হয়ে গেছে। সুতরাং আমি তাদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন ওজনের ব্যবস্থা রাখব না’। 

আয়াতের তাফসীর

আমলের দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্ৰস্ত

১০৩. বলুন, আমরা কি তোমাদেরকে এমন লোকদের কথা জানাব, যারা আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্ৰস্ত?(১)

(১) এখানে প্রথম দুই আয়াত এমন ব্যক্তি ও দলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যারা কোন কোন বিষয়কে সৎ মনে করে তাতে পরিশ্রম করে। কিন্তু আল্লাহর কাছে তাদের সে পরিশ্রম বৃথা এবং সে কর্মও নিস্ফল। কুরতুবী বলেনঃ এ অবস্থা দুটি কারণে সৃষ্টি হয়। (এক) ভ্ৰান্তবিশ্বাস এবং (দুই) লোক দেখানো মনোবৃত্তি। [কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া

(১০৪) ওরাই তারা, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পন্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করছে।[১]

[১] অর্থাৎ, তাদের আমলগুলো এমন, যা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নয়, কিন্তু তাদের ধারণা যে তারা (আল্লাহর পছন্দনীয়) নেক আমলই করছে। এই আয়াতে কাদের কথা বলা হয়েছে? কেউ কেউ বলেন ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের, কেউ বলেন খাওয়ারিজ (রাজদ্রোহী) সম্প্রদায় ও অন্যান্য বিদআতীদের, কেউ বলেন মুশরিকদের। কিন্তু সঠিক কথা হল, এই আয়াতে ব্যাপকভাবে ঐ সমস্ত ব্যক্তি বা দলকে বুঝানো হয়েছে, যাদের মধ্যে উক্ত গুণাবলী বিদ্যমান। পরের আয়াতে এই ধরনের লোকেদের জন্য আরো কিছু শাস্তির কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান

(১০৫) ওরাই তারা যারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী ও তাঁর সাথে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করে;[১] ফলে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। সুতরাং কিয়ামতের দিন আমি তাদের জন্য কোন ওজন রাখব না। [২]

[১] آيات ربِّهم ‘প্রতিপালকের আয়াত বা নিদর্শনাবলী’ বলতে আল্লাহর একতত্ত্ববাদের ঐ সমস্ত দলীল-প্রমাণ যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। অনুরূপভাবে ঐ সমস্ত আয়াতকেও বুঝানো হয়েছে যা তিনি নিজ গ্রন্থসমূহে অবতীর্ণ করেছেন এবং তাঁর নবী ও রসূলগণ তা মানুষের নিকট পৌছে দিয়েছেন। প্রতিপালকের সাক্ষাৎকে অস্বীকার করা বলতে পরকালের জীবন বা পুনরুত্থানকে বুঝানো হয়েছে।

[২] অর্থাৎ, আমার নিকট তাদের কোন মূল্যায়ন হবে না। অথবা অর্থ এই যে, ওদের জন্য আমি ওজনের ব্যবস্থাই করব না যাতে তাদের আমলসমূহ ওজন করা যায়। কারণ আমল তো শুধুমাত্র ঐ সমস্ত তাওহীদবাদী মুসলিমদের ওজন করা হবে, যাদের আমল-নামায় পাপ-পুণ্য উভয়ই থাকবে। কিন্তু ওদের আমল-নামা পুণ্য (নেকী) হতে বিলকুল শূন্য থাকবে। যেমন হাদীসের মধ্যে এসেছে যে, কিয়ামতের দিন মোটা-তাজা মানুষ আসবে, কিন্তু আল্লাহর নিকট তার ওজন মাছির ডানা সমতুল্য হবে না। অতঃপর নবী (সাঃ) উক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন। (বুখারী, সূরা কাহফের তাফসীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান

 সুরা আল-মায়েদা     আয়াত: ৩৩-৩৪ 

৫:৩৩ اِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِیۡنَ یُحَارِبُوۡنَ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ یَسۡعَوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ فَسَادًا اَنۡ یُّقَتَّلُوۡۤا اَوۡ یُصَلَّبُوۡۤا اَوۡ تُقَطَّعَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ اَرۡجُلُهُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ اَوۡ یُنۡفَوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ ؕ ذٰلِکَ لَهُمۡ خِزۡیٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَهُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
৫:৩৪ اِلَّا الَّذِیۡنَ تَابُوۡا مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ تَقۡدِرُوۡا عَلَیۡهِمۡ ۚ فَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

আয়াতের বাংলা অনুবাদ
৩৩. যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যমীনে ফাসাদ করে বেড়ায়, তাদের আযাব কেবল এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। এটি তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে মহা আযাব।
৩৪. তারা ছাড়া, যারা তাওবা করে তোমরা তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের পূর্বে; সুতরাং জেনে রাখ যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

আয়াতের তাফসীর

যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে

৩৩. যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি কেবল এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে বা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে বা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে বা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে(১)। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও আখেরাতে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে(২)।

(১) ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যে কেউ ইসলামের শৃঙ্গে হাতিয়ার ব্যবহার করবে, যাতায়াতকে ভীতিপ্রদ করে দিবে, (ডাকাতি রাহাজানি করবে) তারপর যদি তাদেরকে পাকড়াও করা সম্ভব হয়, তবে মুসলিম শাসকের এ ব্যাপারে ইখতিয়ার থাকবে, তিনি ইচ্ছা করলে তাকে হত্যা করবেন, নতুবা শুলে চড়াবেন, অথবা তার হাত-পা কেটে দিবেন। [তাবারী]

হাদীসে এসেছে, একদল লোক মদীনায় আসল, তারা মদীনার আবহাওয়া সহ্য করতে পারল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে সাদকার উট যেখানে থাকে সেখানে অবস্থানের অনুমতি দিলেন। যাতে তারা উটের দুধ ও প্রস্রাব পান করতে পারে। কিন্তু তারা রাখালকে হত্যা করল এবং উটগুলোকে নিয়ে চলে যেতে লাগল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পিছু ধাওয়া করতে নির্দেশ দিলেন। পরে তারা ধৃত হলো। তখন তাদের হাত-পা কেটে দেয়া হলো, চোখ উপড়ে ফেলা হলো, এবং তাদেরকে মদীনার কালো পাথর বিশিষ্ট এলাকায় ফেলে রাখা হলো। [বুখারী: ১৫০১; মুসলিম: ১৬৭১]

হুদূদ, কিসাস ও তা’যীরাত

(২) ইসলামী শরীআতে অপরাধের শাস্তিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেঃ হুদূদ, কিসাস ও তা’যীরাত। তন্মধ্যে যেসব অপরাধের শাস্তি কুরআন ও সুন্নাহ নির্ধারণ করে দিয়েছে তা হচ্ছে, হুদুদ ও কিসাস। পক্ষান্তরে যেসব অপরাধের কোন শাস্তি কুরআন ও সুন্নাহ নির্ধারণ করেনি; বরং বিচারকদের অভিমতের উপর ন্যস্ত করেছে, সেসব শাস্তিকে শরীআতের পরিভাষায় ‘তাযিরাত’ তথা দণ্ড বলা হয়। কুরআনুল কারীম হুদুদ ও কিসাস পূর্ণ বিবরণ ব্যাখ্যা সহকারে নিজেই বর্ণনা করে দিয়েছে।

আর দণ্ডনীয় অপরাধের বিবরণকে রাসূলের বর্ণনা ও সমকালীন বিচারকদের অভিমতের উপর ছেড়ে দিয়েছে। বিশেষ বিশেষ অপরাধ ছাড়া অবশিষ্ট অপরাধসমূহের শাস্তির কোন পরিমাণ নির্ধারণ করেনি; বরং বিচারকের অভিমতের উপর ছেড়ে দিয়েছে। বিচারক স্থান, কাল ও পরিবেশ বিবেচনা করে অপরাধ দমনের জন্য যেরূপ ও যতটুকু শাস্তির প্রয়োজন মনে করবেন, ততটুকুই দেবেন।

আলেমরা বলেন, কুরআনুল কারীম যেসব অপরাধের শাস্তিকে আল্লাহর হক হিসাবে নির্ধারণ করে জারি করেছে, সেসব শাস্তিকে ‘হুদুদ’ বলা হয় এবং যেসব শাস্তিকে বান্দার হক হিসেবে জারি করেছে, সেগুলোকে ‘কিসাস’ বলা হয়। কিসাসের শাস্তি হুদূদের মতই সুনির্ধারিত। প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ সংহার করা হবে এবং জখমের বিনিময়ে সমান জখম করা হবে। কিন্তু পার্থক্য এই যে, হুদূদকে আল্লাহর হক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা করলেও তা ক্ষমা হবে না। কিন্তু কিসাস এর বিপরীত। কিসাসে বান্দার হক প্রবল হওয়ার কারণে হত্যা প্রবল হওয়ার পর হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীর এখতিয়ারে ছেড়ে দেয়া হয়। সে ইচ্ছা করলে কেসাস হিসাবে তাকে মৃত্যুদণ্ডও করাতে পারে। যখমের কেসাসও তদ্রুপ।

পক্ষান্তরে যেসব অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করেনি, সে জাতীয় শাস্তিকে বলা হয় ‘তাযীর’ তথা ‘দণ্ড’। শাস্তির এ প্রকার তিনটির বিধান অনেক বিষয়েই বিভিন্ন। তন্মধ্যে তাযীর বা দণ্ডগত শাস্তিকে অবস্থানুযায়ী লঘু থেকে লঘুতর, কঠোর থেকে কঠোরতর এবং ক্ষমাও করা যায়। এ ব্যাপারে বিচারকদের ক্ষমতা অত্যন্ত ব্যাপক কিন্তু হুদূদের বেলায় কোন বিচারকই সামান্যতম পরিবর্তন, লঘু অথবা কঠোর করার অধিকারী নয়। স্থান ও কাল ভেদেও এতে কোন পার্থক্য হয় না। শরীআতে হুদুদ মাত্র পাঁচটিঃ ডাকাতি, চুরি, ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদ- এ চারটির শাস্তি কুরআনে বর্ণিত রয়েছে। পঞ্চমটি মদ্যপানের হদ। এটি বিভিন্ন হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের ইজমা তথা ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত। এভাবে মোট পাঁচটি অপরাধের শাস্তি নির্ধারিত ও হুদূদরূপে চিহ্নিত হয়েছে। [কুরতুবী থেকে সংক্ষেপিত]
তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৪) তবে তোমাদের আয়ত্তাধীনে আসার পূর্বে যারা তওবা করবে (তাদের জন্য) জেনে রাখ যে, আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।[১]

[১] অর্থাৎ যে ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তওবা করে ইসলামী শাসনের আনুগত্যের কথা ঘোষণা করবে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে আর ইসলামী দন্ড-বিধি তার উপর প্রয়োগ করা হবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও উলামাগণের মধ্যে এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে, যেমন কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল অথবা ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করল অথবা কারো মান-ইজ্জত হরণ করল, তাহলে কি এই অপরাধগুলি ক্ষমা হয়ে যাবে, অথবা তার প্রতিশোধ গ্রহণ করা যাবে? কোন কোন উলামার উক্তি হচ্ছে,  ক্ষমা হবে না; বরং প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে। ইমাম শাওকানী (রঃ) ও ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ) গণের উক্তি হচ্ছে, আয়াতের বাহ্যিক শব্দ দ্বারা এটা জানা যাচ্ছে যে, সমস্ত শাস্তিই তার উপর থেকে উঠে যাবে। কিন্তু হ্যাঁ ! যদি গ্রেফতার হওয়ার পর তওবা করে, তাহলে তার অপরাধ ক্ষমার যোগ্য হবে না; বরং সে শাস্তির উপযুক্তই থাকবে। (ফাতহুল ক্বাদীর, ইবনে কাসীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান



***************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url