ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা- ৬ || জীবনের লক্ষ্য || মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্য || ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য ||





জীবনের লক্ষ্য

জীবন দর্শনের পর একটি সংস্কৃতির উৎকর্ষ অপকর্ষ নিরূপণ করার জন্যে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তাহলো এই যে, সে মানুষের সামনে কোন্ লক্ষ্যবস্তুটিকে পেশ করে? এ প্রশ্নটি এ জন্যে গুরুত্বপূর্ণ যে, মানুষ যে বস্তুটিকে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে নির্ধারিত করে নেয় তার যাবতীয় ইচ্ছা-বাসনা ও বাস্তব কর্মপ্রচেষ্টা সেই লক্ষ্যেরই অনুগামী হয়ে থাকে। সেই লক্ষ্যটির বিশুদ্ধতা বা অশুদ্ধতার ওপরই মানসিকতার ভালো-মন্দ এবং তার জীবন যাত্রা প্রণালীর শুদ্ধি-অশুদ্ধি নির্ভর করে । তার উন্নতি ও অবনতির ওপরই চিন্তা ও ভাবধারার উন্নতি-অবনতি, নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষ অপকর্ষ এবং অর্থনীতি ও সামাজিকতার উন্নতি-অবনতি নির্ভরশীল। এরই সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হওয়ার ওপর মানুষের ইচ্ছা-বাসনা ও চিন্তা-ভাবনার সুসংবদ্ধতা বা বিক্ষিপ্ততা, তার জীবনের যাবতীয় তৎপরতার শৃংখলা বা বিশৃংখলা এবং তার শক্তিক্ষমতা ও যোগ্যতা প্রতিভার এক কেন্দ্রীকরণ বা বিকেন্দ্রীকরণ নির্ভর করে। এক কথায়, এই জীবন লক্ষ্যের বদৌলতেই মানুষ চিন্তা ও কর্মের বিভিন্ন পথের মধ্যে থেকে একটি মাত্র পথ নির্বাচন করে নেয় এবং তার দৈহিক ও মানসিক শক্তি, তার বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উপায়-উপকরণকে সেই পথেই নিয়োজিত করে। কাজেই কোন সংস্কৃতিকে নির্ভুল মানদণ্ডে যাচাই করতে হলে তার মূল লক্ষ্য-বস্তুটি অনুসন্ধান করা আমাদের পক্ষে নিতান্তই আবশ্যক ।

নির্ভুল সামগ্রিক লক্ষ্যের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য

কিন্তু আলোচনা ও অনুসন্ধানের পরে পা বাড়াবার আগে সংস্কৃতির লক্ষ্য বলতে বুঝায়, তা আমাদের নির্ধারণ করে নেয়া উচিত। একথা সুস্পষ্ট যে, আমরা যখন ‘সংস্কৃতি' শব্দটা উচ্চারণ করি, তখন তা দ্বারা আমাদের ব্যক্তিগত সংস্কৃতিকে বুঝি না, বরং আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতিকেই বুঝি। এ কারণেই প্রতিটি লোকের ব্যক্তিগত জীবনের লক্ষ্য সংস্কৃতির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে না । কিন্তু এর বিপরীতভাবে একটি সংস্কৃতির যা লক্ষ্যবস্তু হবে, অনুবর্তীদের মধ্যকার প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনের লক্ষ্য হওয়া একান্ত অপরিহার্য – সে সম্পর্কে তাদের চেতনা থাকুক না থাকুক। এই দৃষ্টিতে সচেতনভাবেই হোক আর অবচেতনভাবেই হোক, লোকদের একটি বিরাট দলের সম্মিলিত সামগ্রিক জীবনের লক্ষ্য যা হবে, তাই হচ্ছে সংস্কৃতির লক্ষ্যবস্তু এবং এই লক্ষ্যবস্তুর লোকদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের ওপর এতোটা প্রাধান্য লাভ করতে হবে যে, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব জীবন লক্ষ্য হিসেবে এই দলীয় জীবন লক্ষ্যকে গ্রহণ করতে হবে।

এ ধরনের সামগ্রিক জীবন লক্ষ্যের জন্যে একটি অপরিহার্য শর্ত এই যে, লোকদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের সাথে তার পূর্ণ সংগতি ও সামঞ্জস্য রাখতে হবে এবং তার ভিতরে যুগপৎ ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য হবার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে। এ জন্যে যে, সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য যদি লোকদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের প্রতিকূল হয়, তাহলে তার পক্ষে প্রথমতই সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য হওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, যে চিন্তাধারাকে লোকেরা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ না করবে, তা কখনো সামগ্রিক চিন্তাধারার মর্যাদা পেতে পারে না। যদি কোন প্রচণ্ড শত্রুর প্রভাবে তা সামগ্রিক জীবন লক্ষ্যে পরিণত হয়ও, তবু ব্যক্তির জীবন লক্ষ্য এবং সমাজের জীবন লক্ষ্যের মধ্যে অবচেতন- ভাবেই একটি সংঘাত চলতে থাকবে। অতপর ঐ বিজয়ী শক্তির প্রভাব হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথেই লোকেরা আপন আপন জীবন লক্ষ্যের দিকে ঝুঁকে পড়বে। আর সেই সঙ্গে সমাজের জীবন লক্ষ্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সমাজ সত্তার আকর্ষণ ও সংযোগ শক্তি বিলীন হয়ে যাবে এবং পরিণামে সংস্কৃতির নাম- . নিশানা পর্যন্ত মুছে যাবে। এ জন্যেই মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্য যা হবে, প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতির নির্ভুল লক্ষ্যবস্তু ঠিক তাই হতে পারে। আর কোন সংস্কৃতির আসল বৈশিষ্ট্য এই যে, তাকে এমন একটি সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য পেশ করতে হবে, যা হুবহু ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যও হতে পারে।

এ দৃষ্টিতে আমাদের সামনে দু'টি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং এ দু'টির মীমাংসা ছাড়া আমরা সামনে এগোতে পারি নাঃ

একঃ   স্বাভাবিকভাবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্য কি ?
দুইঃ  দুনিয়ার অন্যান্য সংস্কৃতিগুলো যে লক্ষ্যবস্তু পেশ করেছে, মানুষের এই স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্যের সঙ্গে তা কতখানি সংগতিপূর্ণ ?

মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্য

মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্যের প্রশ্নটি এই যে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে দুনিয়ায় কি উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করে এবং তার প্রকৃতি কোন্ জিনিসটি কামনা করে ? এটা জানার জন্যে আপনি যদি প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেন যে, দুনিয়ায় তার উদ্দেশ্য কি, তাহলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বিভিন্নরূপ জবাব পাবেন। এবং নিজেদের লক্ষ্য বাসনা ও আশা আকাংখা সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন, সম্ভবত এমন দু'জন লোকও খুঁজে পাবেন না। কিন্তু সবগুলো জবাবকে বিশ্লেষণ করলে আপনি দেখতে পাবেন যে, লোকেরা যে জিনিসগুলোকে নিজেদের লক্ষ্য বলে অভিহিত করছে, তা আদপেই কোন লক্ষ্যবস্তু নয়, বরং একটি বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যম মাত্র ; আর সে বিশেষ লক্ষ্যটি হচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্য ও মানসিক প্রশান্তি। ব্যক্তি বিশেষ যতো উঁচু দরের মননশীল ও বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন হোন, যতো উন্নতমানের সংস্কৃতিবানই হোন, আর জীবনের যে কোন দিক ও বিভাগেই কাজ করুন না কেন, তার যাবতীয় চেষ্টা-সাধনার মূলে একটি মাত্র লক্ষ্যই নিহিত থাকে আর তাহলো এই যে, সে যেন শান্তি, নিরাপত্তা, আনন্দ ও নিশ্চিন্ততা লাভ করতে পারে। সুতরাং একে আমরা ব্যক্তি মানুষের স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্য বলে অভিহিত করতে পারি।

দু'টি জনপ্রিয় সামগ্রিক লক্ষ্য এবং তার পর্যালোচনা

দুনিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতি যেসব সামগ্রিক লক্ষ্য পেশ করেছে সেগুলোর পুংখানুপুংখরূপ বিচার করলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে বহু পার্থক্য বর্তমান। এখানে তা নির্ণয় করা আমাদের উদ্দেশ্যও নয়, আর তা সম্ভবও নয়। তবে মূলনীতির দিক থেকে সেগুলোকে আমরা দু'ভাগে ভাগ করতে পারি:
এক ঃ যে সংস্কৃতিগুলোর বুনিয়াদ কোন ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ভাবধারার ওপর স্থাপিত নয় সেগুলো তাদের অনুবর্তীদের সামনে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য লাভের লক্ষ্য পেশ করেছে। এই লক্ষ্যটি কতিপয় মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত। এর বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো হচ্ছে এই-
* রাজনৈতিক প্রাধান্য ও আধিপত্য লাভের কামনা ।
* ধন-সম্পদে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের আকাংখা, তা দেশ জয়ের মাধ্যমে হোক আর শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করেই হোক ।
* সামাজিক তরক্কীতে সবার চেয়ে অগ্রাধিকার লাভের বাসনা, তা জ্ঞান- বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে হোক আর কৃষ্টি সভ্যতার ক্ষেত্রে শান-শওকতের দিক দিয়ে হোক ।

দৃশ্যত এই সামগ্রিক জীবন লক্ষ্য ও উপরোল্লিখিত ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের পরিপন্থী নয়। কেননা একথা এতোটুকু চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বলা যেতে পারে যে, সমাজের জন্যে এ লক্ষ্যবস্তু নিরূপিত হয়ে গেলেই ব্যক্তির জীবন লক্ষ্যও সেই সঙ্গে নির্ণীত হয়ে যায়। এই লক্ষ্যটির এই বাহ্যিক ধাঁধার কারণেই একটি জাতির লক্ষ-কোটি মানুষ তাদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যকে এর ভেতরে বিলীন করে দেয় । কিন্তু দূরদৃষ্টি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রকৃত- পক্ষে এই সামগ্রিক লক্ষ্যবস্তুটি ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবন লক্ষ্যের একেবারেই পরিপন্থী। একথা সুস্পষ্ট যে, প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভে ইচ্ছুক জাতি দুনিয়ায় কেবল একটিই নয় বরং একই যুগে একাধিক জাতি এই লক্ষ্যটি পোষণ করে থাকে এবং তারা সবাই একে অর্জন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। এর অনিবার্য ফলে তাদের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়ে যায়, প্রতিরোধ, প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক প্রচণ্ড গোলযোগ দেখা যায় আর এই হট্টগোল ও বিশৃংখলার মধ্যে ব্যক্তির শান্তি, স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আজকে আমাদের চোখের সামনে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ঠিক এই অবস্থাই বিরাজমান। তবু যদি ধরেও নেয়া যায় যে, কোন এক যুগে শুধু একটি মাত্র জাতিই এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সচেষ্ট হবে এবং এ ব্যাপারে অন্য কোন জাতি তার পথে বাধ সাধবে না, তবু এর সাফল্যে লোকদের ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্যের উপস্থিতি সম্ভব নয়। কারণ এরূপ সামগ্রিক লক্ষ্যের এটা স্বাভাবিক প্রকৃতি যে, এ শুধু আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতারই সৃষ্টি করে না, একটি জাতির আপন লোকদের ভেতরও পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলে। এর ফলে অন্য জাতির লোকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার, দৌলত, হুকুমত, শক্তি, শান-শওকত ও বিলাস-ব্যসনে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ, অপরের রেযেকের চাবি নিজের কুক্ষিগত করা, অর্থোপার্জনের সকল সম্ভাব্য উপায়-উপকরণের ওপর নিজের একক মনোপলি প্রতিষ্ঠা, লাভ ও স্বার্থটুকু নিজের অংশে এবং ক্ষতি ও ব্যর্থতা অন্যের ভাগে পড়ার কামনা, নিজেকে হুকুমদাতা এবং অন্যকে অধীন ও আজ্ঞানুবর্তী বানিয়ে রাখার প্রচেষ্টা জাতির প্রতিটি ব্যক্তির জীবন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত এ ধরনের লোকদের কামনা ও বাসনার কোথাও গিয়ে নিবৃত্তি হয় না, এজন্যে হামেশা অস্থির ও অনিশ্চিত থাকে। দ্বিতীয়ত এই শ্রেণীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা যখন একটি জাতির লোকদের মধ্যে পয়দা হয়, তখন তার প্রতিটি গৃহ ও প্রতিটি বাজারই একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফলে দৌলত, হুকুমত ও বিলাস-ব্যসন যতো বিপুল পরিমাণই সঞ্চিত হোক না কেন, শান্তি ও স্বস্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা, আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য একেবারে দুর্লভ হয়ে দাঁড়ায়।

পরন্তু এটা স্বাভাবিক ব্যাপার যে, খালেছ বৈষয়িক উন্নতি – যাতে আধ্যাত্মিকতার কোন স্থান নেই – মানুষকে কখনো স্বস্তি দান করতে পারে না, কারণ নিছক ইন্দ্রিয়জ আনন্দ লাভ হচ্ছে নিতান্তই এক জৈবিক লক্ষ্য; আর এ কথা যদি সত্য হয় যে, মানুষ সাধারণ জীব মাত্র নয়, তার স্থান তার চেয়ে ঊর্ধে তাহলে এটাও নিশ্চিতভাবে সত্য হতে হবে যে, নিছক জৈবিক আকাংখার পরিতৃপ্তির জন্যে যে জিনিসগুলোর রসাস্বাদন যথেষ্ট, কেবল সেগুলো অর্জন করেই মানুষ নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না।

দুইঃ  যে সংস্কৃতিগুলোর ভিত্তি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ভাবধারার ওপর স্থাপিত তারা সাধারণভাবে মুক্তি বা নাজাতকে নিজেদের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে। নিসন্দেহে যে আধ্যাত্মিক উপাদান মানুষকে স্বস্তি ও মানসিক প্রশান্তি দান করে, এ লক্ষ্যটির ভেতর তা বর্তমান রয়েছে। আর একথা সত্য যে, মুক্তি যেমন একটা জাতির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, তেমনি পৃথক পৃথকভাবে প্রতিটি ব্যক্তিরও জীবন লক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, এটাও আদতে কোন নির্ভুল জীবন লক্ষ্য হতে পারে না। এর কতিপয় কারণ রয়েছে।

প্রথমত, মুক্তির লক্ষ্যের ভেতর এক ধরনের আত্ম-সর্বস্বতা প্রচ্ছন্ন রয়েছে। এর প্রকৃতি হলো, 'সামগ্রিকতাকে দুর্বল করে ব্যক্তিত্বকে সবল করে তোলা। কারণ ব্যক্তি মানুষ যখন কতিপয় বিশেষ কাজ সম্পাদন করেই মুক্তি লাভ করতে পারে, তখন তাকে ব্যক্তি সর্বস্বতার পরিবর্তে সামগ্রিকতার মর্যাদা দান করতে এবং তাকে সুবিন্যস্ত করার জন্যে ব্যক্তিকে সমাজের সাথে একই কর্মনীতি অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, এমন কোন বস্তুই আর এ লক্ষ্যটির ভেতর থাকে না। কাজেই সংস্কৃতির যা আসল লক্ষ্য, এই ব্যক্তি সর্বস্বতার ভাবধারা তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

দ্বিতীয়ত, মুক্তির প্রশ্নটি আসলে মুক্তিলাভের পন্থার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাই এ লক্ষ্যটির বিশুদ্ধ বা অশুদ্ধ হওয়া এটি অর্জনের জন্যে উদ্ভাবিত পন্থার বিশুদ্ধতা বা অশুদ্ধতার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যে ধর্মগুলো সংসার ত্যাগ ও বৈরাগ্যবাদকে মুক্তির পন্থা বলে নির্দেশ করেছে, সেগুলোতে মুক্তি না ব্যক্তিগত জীবন লক্ষ্য হতে পারে, না পারে সামগ্রিক লক্ষ্য হতে। এরূপ ধর্মের অনুগামীগণ শেষ পর্যন্ত দ্বীনকে দুনিয়া থেকে আলাদা করতে এবং দুনিয়াদার লোকদের মুক্তির জন্যে মধ্যবর্তী পন্থা (যেমন দ্বীনদার লোকদের সেবা, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি) উদ্ভাবনে বাধ্য হয়েছে। এর ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, এ লক্ষ্যটি আর মিলিতভাবে ব্যক্তি ও সমাজের এক অভিন্ন লক্ষ্য থাকেনি। দ্বিতীয়ত, দ্বীনদারদের একটি নগণ্য সংখ্যা ছাড়া গোটা সমাজের জন্যে এই লক্ষ্যের ভেতর এমন কোন মহত্ত্ব, গুরুত্ব, আকর্ষণ শক্তি রইলো না, যা তাকে অক্ষুণ্ণ করে রাখতে পারে। এ জন্যে সমগ্র দুনিয়াদার লোকই একে ত্যাগ করে উপরোল্লিখিত বৈষয়িক লক্ষ্যের পানেই ছুটে চলেছে। অন্যদিকে যে ধর্মগুলো মুক্তিকে বিভিন্ন দেবতা ও মাবুদের সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল বলে ঘোষণা করেছে, তাদের মধ্যে অভিন্নতা বজায় থাকে না। বিভিন্ন দল বিভিন্ন মাবুদের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং লক্ষ্যের ভেতরে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং যার সম্পর্ক সূত্র দ্বারা সকল অনুগামীদের গ্রথিত করা সংস্কৃতির আসল কাজ, সেই যথার্থ ঐক্যটিই বাকী থাকে না। তাই এসব ধর্মের অনুসারীরাও পার্থিব উন্নতির পথে চলতে এবং আপন সমাজকে সুসংবদ্ধ করতে চাইলে ভিন্ন লক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে ।

আর এক ধরনের ধর্ম রয়েছে, যার আহ্বান গোটা মাবন জাতির প্রতি নয়, বরং কোন বিশেষ বংশ-গোত্র কিংবা কোন বিশেষ ভৌগলিক এলাকায় বসবাসকারী জাতির প্রতি। এবং এই হিসেবে তার দৃষ্টিতে মুক্তি কেবল ঐ বিশেষ গোত্র ও জাতির জন্যেই নির্দিষ্ট। এ লক্ষ্যটি নিসন্দেহে তাহজীব ও তমুদ্দুনের প্রাথমিক পর্যায়ে একটি সার্থক সামগ্রিক লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে । কিন্তু নির্ভুল বিচার-বুদ্ধির মানদণ্ডে এটিও পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয় না। বিশেষত মুক্তিটা কোন বিশেষ গোত্রের জন্যে নির্দিষ্ট, একথা মানতে মানুষের বিবেক- বুদ্ধি সম্মত নয়। এ জন্যে এরূপ ধর্মের অনুগামীগণ বুদ্ধিবাদী উন্নতির পথে কয়েক পা বাড়িয়েই এ লক্ষ্যের ব্রিরুদ্ধে নিজেরাই বিদ্রোহ করে বসে এবং . তাকে মন থেকে মুছে ফেলে দিয়ে অন্য কোন লক্ষ্য গ্রহণ করে।

তৃতীয়ত, মুক্তির লক্ষ্যটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে যতো পবিত্রই মনে হোক না কেন, পার্থিব দৃষ্টিতে একটি জাতিকে অনুপ্রাণিত করা এবং জাতীয় উন্নতির জন্যে প্রয়োজনীয় চেতনা, উদ্দীপনা, শক্তি ও তৎপরতা সৃষ্টিকারী কোন বস্তুই এর ভেতর পাওয়া যায় না। এ জন্যেই আজ পর্যন্ত কোন উন্নতিকামী জাতি একে নিজের সামগ্রিক লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেনি, বরং যে সমস্ত জাতির ধর্ম এই একটি মাত্র লক্ষ্য পেশ করেছে, তাদের মধ্যে হামেশাই ব্যক্তিগত লক্ষ্যের মর্যাদা পেয়ে আসছে।

এ সকল কারণেই বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক এই উভয় লক্ষ্যই নির্ভুল মানদণ্ডের বিচারে পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয় না। এবার ইসলামী সংস্কৃতি কোন্ বস্তুটিকে তার লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে এবং তার কোন্ কোন্ স্বভাব-প্রকৃতি তাকে একটি নির্ভুল লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তা-ই আমরা দেখবো।

ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য

এ আলোচনার সূচনায়ই একথা ভালোমত মনে রাখা দরকার যে, জীবন লক্ষ্যের প্রশ্নটি আসলে জীবন দর্শন সম্পর্কিত প্রশ্নের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত । আমরা পার্থিব জীবন সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করি এবং দুনিয়ায় নিজেদের মর্যাদা ও নিজেদের জন্যে দুনিয়ার মর্যাদা সম্পর্কে যে মতবাদটি বিশ্বাস করি, তাই স্বাভাবিকভাবে জীবনের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে আমাদের তাবৎ শক্তি ক্ষমতাকে নিয়োজিত করে দেই। আমরা যদি দুনিয়াকে একটা চারণক্ষেত্র বলে মনে করি এবং জীবনটাকে শুধু পানাহার আর পার্থিব বিলাস-ব্যসনে পরিতৃপ্তি লাভের একটা অবকাশ বলে ধারণা করি, তাহলে এ জৈবিক ধারণা নিসন্দেহে আমাদের ভেতর জীবন সম্পর্কে এক জৈবিক লক্ষ্য জাগিয়ে দেবে এবং জীবনভর আমরা শুধু ইন্দ্রিয়জ ভোগোপকরণ সংগ্রহের জন্যেই চেষ্টা করতে থাকবো। পক্ষান্তরে আমরা যদি নিজেদেরকে জন্মগত অপরাধী এবং স্বভাবগত পাপী বলে বিবেচনা করি এবং সেই জন্মগত অপরাধে দুনিয়ার এই কারাগার ও বন্দীশালায় আমাদের নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে ধারণা করে নেই তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মধ্যে এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভের আকাংখা জাগ্রত হবে এবং এ কারণে মুক্তিকে আমরা আমাদের জীবন লক্ষ্য বলে ঘোষণা করবো। কিন্তু দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা যদি চারণভূমি আর বন্দীশালা থেকে উন্নততর হয় এবং মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদেরকে সাধারণ প্রাণী ও অপরাধীর চেয়ে উচ্চ মর্যাদাবান বলে মনে করি তাহলে নিশ্চিতরূপে বৈষয়িক ভোগোপকরণের সন্ধান ও পরিত্রাণ লাভ – এই উভয় লক্ষ্যের চেয়ে উন্নততর কোন লক্ষ্যেরই আমরা সন্ধান করবো এবং কোন তুচ্ছ বা নগণ্য বস্তুর প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না ।

এ নিয়মটিকে সামনে রেখে আপনি যখন দেখবেন যে, ইসলাম মানুষকে আল্লাহর খলীফা এবং দুনিয়ার বুকে তাঁর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছে, তখন এই জীবন দর্শন থেকে স্বাভাবিকভাবেই যে লক্ষ্যের সৃষ্টি হতে পারে এবং হওয়া উচিত, আপনার বিবেক-বুদ্ধি স্বভাবতই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবে। একজন প্রতিনিধি তার মালিকের সন্তুষ্টি ও রেযামন্দী লাভ করবে এবং তাঁর দৃষ্টিতে একজন উত্তম, অনুগত, বিশ্বস্ত ও কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মচারী বলে বিবেচিত হবে – এ ছাড়া তার আর কি লক্ষ্য হতে পারে। সে যদি সত্যনিষ্ঠ ও সদুদ্দেশ্যপরায়ণ হয়, তাহলে মনিবের আজ্ঞাপালনে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া আর কোন বস্তু কি তার উদ্দেশ্য হতে পারে ? সে কি নিজের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি, কোন স্বার্থলাভের আশা, কোন পদোন্নতি বা পুরস্কার লাভ, অথবা খ্যাতি-যশ ও পদমর্যাদা বুদ্ধির প্রলোভনে পড়ে তার কর্তব্য পালন করবে ? অবশ্য মনিব যদি খুশী হয়ে তাকে এসব দান করেন, সেটা আলাদা কথা। মনিব তাকে সুষ্ঠু খেদমতের বিনিময়ে এগুলো দান করার আশ্বাসও দিতে পারেন, এমন কি সঠিকভাবে কর্তব্য পালন করলে মনিব তাকে খুশী হয়ে অমুক অমুক পুরস্কার দান করবেন, একথাও সে জানতে পারে। কিন্তু সে যদি পুরষ্কারকেই নিজের লক্ষ্য বানিয়ে নেয় এবং নিছক স্বার্থলাভের উদ্দেশ্যে কর্তব্য পালন করে তাহলে এমন কর্মচারীকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই কি কর্তব্য নিষ্ঠ কর্মচারী বলতে পারে? এই দৃষ্টান্ত দ্বারা আল্লাহ এবং তাঁর প্রতিনিধির বিষয়টিও অনুমান করতে পারেন। মানুষ যখন দুনিয়ার বুকে আল্লাহর প্রতিনিধি, তখন আল্লাহর রেযামন্দী ও সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া তার আর কী জীবন লক্ষ্য হতে পারে?

ইসলাম মানুষের সামনে যে জীবনদর্শন পেশ করেছে, বিবেক-বুদ্ধি ও স্বভাব-প্রকৃতি তার থেকে এ জীবন লক্ষ্যই উদ্ভাবন করে, আর এ হচ্ছে নির্ভুল ও অবিকৃত ইসলামী লক্ষ্য। কুরআন মজীদের ভাষণসমূহ পর্যালোচনা করলে আপনারা জানতে পারবেন যে, এই একমাত্র লক্ষ্যবস্তুকে মানুষের মনে বদ্ধমূল করে দেয়া এবং তার হৃদয় ও আত্মার ভেতর একে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে এবং এছাড়া অন্য সব লক্ষ্যবস্তুকে সুস্পষ্ট ও দৃঢ়তার সাথে বাতিল করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে:

قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِيْنَ ٥ لَاشَرِيكَ

“হে নবী, তুমি বলে দাও আমার নামায, আমার ইবাদাত, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবকিছুই সেই আল্লাহর জন্যে যিনি সমস্ত জাহানের প্রভু এবং যার কোনই শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেয়া হয়েছে এবং আমিই তাঁর সামনে সর্বপ্রথম মস্তক অবনতকারী - আত্মসমর্পণকারী।” -(সূরা আল আন'আম : ১৬২-১৬৩)

إِنَّ اللهَ اشْتَرى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ، يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ ..... فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ ، وَذَالِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (التوبة : (۱۱۱)

“আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন বেহেশতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, হত্যা করে এবং নিহিত হয়। ... ..... সুতরাং (আল্লাহর সাথে) তোমরা যে বেচা-কেনা করেছো, তার জন্যে আনন্দ করো, প্রকৃতপক্ষে এটাই বড়ো সাফল্য।” -(সূরা আত তাওবা : ১১১ )

সূরায়ে বাকারায় নাফরমান ও ফর্মাবর্দার বান্দাদের পার্থক্য বর্ণনা করে ফর্মাবর্দার বান্দার প্রশংসা করা হয়েছে এভাবে :

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُشْرِى نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللهِ ، وَاللَّهُ رَهُ وفَ بِالْعِبَادِ

“লোকদের ভেতর এমন লোকও রয়েছে, যে নিজের জানকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে বিক্রি করে দেয়; আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল। " -(সূরা আল বাকারা : ২০৭ )

সূরায়ে ফাতহে মুসলমানদের প্রশংসাই করা হয়েছে এই মর্মে যে, তাদের বন্ধুত্ব ও শত্রুতা এবং তাদের রুকু ও সেজদা সবকছুিই আল্লাহর জন্যে :

مُحَمَّدٌ رَّسُولُ اللهِ ، وَالَّذِينَ مَعَهُ أشداء عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَهُمْ
رَكَعًا سُجَّدًا يُبْتَغُونَ فَضْلاً مِّنَ اللهِ وَرِضْوَانًا (الفتح : ٢٩)

“মুহাম্মাদ আল্লাহর প্রেরিত রসূল এবং তাঁর সঙ্গি-সাথীগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং পরস্পর রহমদিল। তোমরা হামেশা তাদেরকে রুকু ও সেজদায় অবনত দেখছো। এরা আল্লাহর ফযল এবং তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে।" -(সূরা আল ফাতহ : ২৯)

সূরায়ে মুহাম্মাদে কাফেরদের ক্রিয়া-কলাপ ব্যর্থ হবার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর জন্যে কিছুই করে না, বরং অন্য উদ্দেশ্যে কাজ করে আল্লাহর অসন্তুষ্টিকেই বরণ করে নেয় :

ذلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا اسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ .

“তাদের ওপর এই জন্যেই আঘাত পড়বে যে, যে বস্তু আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে, তারা তারই অনুসরণ করেছে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে তারা অপছন্দ করেছে। এ জন্যেই আল্লাহ তাদের কৃতকর্মকে বিনষ্ট করে দিয়েছেন।”-(সুরা মুহাম্মদ : ২৮)

সূরায়ে হচ্ছে দুনিয়াবী ফায়দার জন্যে কৃত ইবাদতকে সম্পূর্ণ নিষ্ফল এবং ক্ষতির কারণ বলে অভিহিত করা হয়েছে :

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ ، فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرُ نِ اطْمَانٌ بِهِ : وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ نِ انْقَلَبَ عَلى وَجْهِهِ ، خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ ، ذَلِكَ

“লোকদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যে আগ্রহহীনভাবে আল্লাহর ইবাদাত করে। যদি সে কোন কল্যাণ করলো তাহলে সে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলো। আর যদি কোন পরীক্ষার সময় এলো তাহলে মুখ ফিরিয়ে নিলো । এরূপ লোকই দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো আর এ-ই হচ্ছে সুস্পষ্ট ক্ষতি।"-(সূরা আল হজ্জ : ১১)

সূরায়ে বাকারায় বলা হয়েছে যে, যে দান লোকদের দেখানোর উদ্দেশ্যে করা হবে এবং যে মাল দিয়ে মানুষ অনুগ্রহ জাহির করবে তা হচ্ছে নিষ্ফল ।

এর দৃষ্টান্ত এই যে, কোন এক প্রস্তর খণ্ডের ওপর কিছুটা মাটি পড়ে ছিলো। তোমরা তাতে বীজ বপণ করলে; কিন্তু পানির ঢল এসে তাকে ধুয়ে নিয়ে গেলো। পক্ষান্তরে যে সকল সুকৃতি একাগ্রচিত্তে শুধু আল্লাহরই সন্তুষ্টির জন্যে করা হবে, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন বাগিচার তুল্য, যার ওপর প্রবল বারিপাত হলে দ্বিগুণ ফল ধারণ করে আর প্রবল বারিপাত না হলেও হালকা পানির ছিটাই তার ফল ধারণের পক্ষে যথেষ্ট।-(রুকূ' : ৩৬)

কুরআন মজীদের বিভিন্ন জাগয়ায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে এই বিষয়টিকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যে কোন সৎকাজই করো না কেন, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই করো এবং এর পেছনে আর কোন উদ্দেশ্য পোষণ করো না ।

وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلَانْفُسِكُمْ ، وَمَا تُنْفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاء وَجْهِ اللَّهِ

“তোমরা যা কিছুই দানের খাতে ব্যয় করবে তার ফায়দা তোমাদেরই জন্যে আর যা কিছুই তোমরা ব্যয় করো, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই করতে থাকো।”-(সূরা আল বাকারা : ২৭২)

وَالَّذِينَ صَبَرُوا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلوةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَهُمْ
سِرًّا وَعَلَانِيَةً وَيَدْرَهُ مِنَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَ أُولَئِكَ لَهُمْ عُقْبَى الدَّارِ

“যারা আপন প্রভুর সন্তুষ্টির জন্যে সবর করেছে এবং নামায কায়েম করেছে আর তাদেরকে আমরা যে রুযি দান করেছি তার থেকে গোপনে বা প্রকাশ্যে ব্যয় করেছে আর যারা পুণ্যের দ্বারা পাপকে দূরীভূত করে, এমন লোকদের জন্যেই রয়েছে আখেরাতের ঘর।" -(সূরা আর রাদ : ২২)

جنبها الأنقى الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى وَمَا لَأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى إِلا ابْتِغَاء وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَىه ولسوف يرضى (اليل : ۱۷-۲۱)

“দোযখের আযাব থেকে সেই বড়ো পরহেযগারই বেঁচে যাবে, যে আত্মশুদ্ধির সাথে নিজের মাল দান করে। তার প্রতি কারো কোন অনুগ্রহ নেই যে, তার বদলা তাকে দিতে হবে। বরং সে শুধু তার মহান প্রভুর সন্তুষ্টিই কামনা করে আর তিনি অবশ্যই সন্তুষ্ট হবেন। "
-(সূরা আল লাইল : ১৭-২১ )

فَأْتِ ذَا الْقُربى حقه والمِسْكِينَ وَابْنِ السَّبِيلِ ، ذَلِكَ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يُرِيدُونَ
وجه الله ، وأولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (الروم : (۳۸)

“অতএব তুমি নিকটাত্মীয়কে তার হক বুঝিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও (তার হক)। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাদের জন্যে এ-ই হচ্ছে উত্তম। আর প্রকৃতপক্ষে এরাই কল্যাণের অধিকারী হয়ে থাকে।”-(সূরা আর রম : ৩৮)

وَمَا أَتَيْتُم مِّنْ زَكوة تُرِيدُونَ وَجْهُ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ

“তুমি যে যাকাত দিয়েছো এবং তাদ্বারা তুমি শুধু আল্লাহরই সন্তুষ্টি লাভ করতে চাও তো যারা এরূপ করছে তারাই নিজেদের দানকে দ্বিগুণ চতুর্গুণ করছে।”-(সূরা আর রম ঃ ৩৯)

وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينَا وَيَتِيْمًا وَأَسِيْرَاهِ إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءُ وَلَا شُكُورًا إِنَّا نَخَافُ مِنْ رَبِّنَا يَوْمًا عَبُوسًا فَمُطَرِيرًا فَوقَهُمُ اللهُ شَرِّ ذلِكَ الْيَوْمِ وَلَقُهُمْ نَضْرَةً وَسُرُوران

“তারা আল্লাহর প্রতি ভালবাসার খাতিরে মিসকীন, এতীম ও বন্দীকে আহার করায় এবং বলে যে, আমরা তোমাদেরকে শুধু আল্লাহর জন্যেই খাওয়াচ্ছি। আমরা তোমাদের কাছ থেকে না কোন প্রতিদান চাই আর না চাই কোন কৃতজ্ঞতা। আমরা তো আমাদের প্রভুকে সেই দিনের জন্যে ভয় করি যেদিন মানুষের মুখ বিমর্ষ হয়ে যাবে আর তাদের মুখমণ্ডলের চামড়া কুঁকড়ে যাবে। অত এব আল্লাহ তাদেরকে সেই দিনের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছেন এবং তাদেরকে সজীবতা ও স্বাচ্ছন্দ্য দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছেন।" -(সূরা আদ দাহর : ৮-১১ )

للفقراء المهجرين الذين أخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِّنَ اللهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصَرُونَ الله ورسوله ، أولئِكَ هُمُ الصَّدقونه

“ফাই হিসেবে প্রাপ্ত সম্পদে সেইসব গরীব লোকেরও অংশ রয়েছে, যারা হিজরত করেছে এবং যারা আপন ঘর-বাড়ী ও ধন-সম্পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছে ; (এবং যারা এই সবকিছু এ জন্যে স্বীকার করেছে যে,) তারা আল্লাহর ফযল এবং তার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাজে সাহায্য করে। প্রকৃত পক্ষে এরাই হচ্ছে সত্যবাদী।”
-(সূরা হাশর : ৮)

إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بَنْيَانُ مُرصوص -

“আল্লাহ সেইসব লোককে ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে সীসা জমানো প্রাচীরের ন্যায় শ্রেণীবদ্ধ হয়ে লড়াই করে।" -(সূরা আস সফ : ৪)

الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ ، وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي

// “যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, আর কাফেরগণ লড়াই করে যুলুম ও বিদ্রোহের খাতিরে।" -(সূরা আন নিসা : ৭৬)

انَّ اللهَ لا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلا مَا كَانَ لَهُ خَالِصاً وَابْتَغِي بِهِ وَجْهُهُ .

হাদীসে বর্ণিত আছে-
“আল্লাহ কেবল সেই আমলকেই কবুল করেন, যা খালেছভাবে তাঁরই জন্যে করা হবে এবং যা দ্বারা শুধু তাঁর সন্তুষ্টিলাভই লক্ষ্য হবে।”

এ আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইসলাম সর্বপ্রকার পার্থিব ও পরকালীন স্বার্থ পরিত্যাগ করে একটি মাত্র বস্তুকে জীবনের লক্ষ্য, মানুষের সকল প্রয়াস-প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য এবং সমগ্র ইচ্ছা-বাসনা ও আশা-আকাংখার কেন্দ্রবস্তু বলে ঘোষণা করেছে আর সে বস্তুটি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার রেযামন্দী ও তাঁর সন্তুষ্টিলাভ। এবার এ লক্ষ্যটির কোন্ সব বৈশিষ্ট্য বিশেষত্ব একে সর্বোত্তম জীবন লক্ষ্যে পরিণত করেছে, তা-ই আমরা দেখবার প্রয়াস পাবো।

একঃ  স্বাভাবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লক্ষ্যের সামঞ্জস্য – বিশ্বপ্রকৃতি সম্পকে ইসলাম যে মতবাদ পেশ করে, প্রকৃতপক্ষে তা মতবাদের সীমা অতিক্রম করে ঈমান ও প্রত্যয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে। সে মতবাদীটি হচ্ছে এই যে, সৃষ্টির এই অন্তহীন রাজ্যের মালিক ও শাসক হচ্ছেন এক আল্লাহ। সমগ্র সৃষ্টিজগত তাঁরই অধীন ও অনুগত এবং তাঁরই সামনে আত্মসমর্পিত।

وَلَةٌ مَنْ فِي السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ ، كُل لَهُ فنِثُونَ (الروم 

“সমস্ত আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই তার, সবকিছু তাঁর অধীন। এই বিশ্ব কারখানার সমস্ত ক্রিয়া-কলাপ তাঁরই বিধান এবং তাঁরই ইচ্ছার অধীন “আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান নেই।” এই জগত এবং অন্যান্য জগতে যতো জিনিস রয়েছে, তার সবকিছুরই কেন্দ্র হচ্ছেন তিনি। "সবকিছুই তার কাছে প্রত্যাবর্তনকারী।” এরই নাম হচ্ছে ইসলাম, এর অর্থ হচ্ছে আত্মসমর্পণ " বা আজ্ঞানুবর্তী হওয়া । গোটা বিশ্বপ্রকৃতি এবং তার প্রতিটি অণু-পরমাণু ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় — এই দ্বীন ইসলামেরই অনুবর্তী।

وَلَةٌ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرُها (ال عمران : (۸۳)

“সমস্ত আসমান ও জমিনের সবকিছুই – ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় তাঁরই অধীন।"-(সূরা আলে ইমরান : ৮৩)

এই বিশ্বব্যাপী, অপরিবর্তনীয় ও অলংঘনীয় বিধানে গোটা বিশ্ব প্রকৃতির ন্যায় মানুষও সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে এবং তার স্বভাব-প্রকৃতিও আল্লাহর অধীন, অনুগত এবং তারই দ্বীনের অনুবর্তী।

فَاقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا ، فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا ، لَا تَبِيلَ
لِخَلْقِ الله ، ذلك الدين القيم (الروم : ٣٠)

“অতএব তোমার মুখমণ্ডল সেই প্রামাণ্য দ্বীনের প্রতি ফিরিয়ে দাও এবং আল্লাহর সেই প্রকৃতি অনুসরণ কর যে অনুযায়ী আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই। এটাই হচ্ছে প্রামাণ্য দ্বীন।” (সূরা আর রম : ৩০)

এই মতবাদ অনুযায়ী সমগ্র সৃষ্টিজগতের এমন কি মানুষেরও স্বাভাবিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অভীষ্ট এবং চরম কাম্য হচ্ছে মহাশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা । তাই প্রত্যেকেরই স্বাভাবিক গতি সেই কেন্দ্রস্থলের দিকেই নিবন্ধ। এক্ষণে এক যুক্তিবাদী সৃষ্টি হিসেবে মানুষ এই স্বাভাবিক লক্ষ্য সম্পর্কে চেতনা লাভ করবে এবং বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির সাহায্যে তাকে অনুধাবন করে নিজের ইচ্ছা- প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনার গতিকে তারই দিকে ফিরিয়ে দিবে – এটুকুই হচ্ছে তার কাজ। এমতাবস্থায় তার ও সমগ্র সৃষ্টির স্বাভাবিক লক্ষ্যের সাথে তার বুদ্ধিগত লক্ষ্য সামঞ্জস্যশীল হয়ে যাবে। বিশ্বজাহানের সকল সৈন্য-সামন্ত এবং সৃষ্টি ব্যবস্থার প্রতিটি অণু-পরমাণু এই লক্ষ্যে উপনীত হবার ব্যাপারে তার সহায়তা করবে এবং সে বুদ্ধিগত মর্যাদার কারণে এই বিরাট কাফেলার পুরোধা ও নেতার আসনে অভিষিক্ত হবে। পক্ষান্তরে এ লক্ষ্যবস্তুকে ছেড়ে সে যদি অন্য কোন বস্তুকে বুদ্ধিগত লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তার দৃষ্টান্ত হবে এরূপ, যেমন এক ব্যক্তি কোন একটি কাফেলার সঙ্গে রয়েছে। কাফেলাটি পশ্চিম দিকে চলছে। ঐ লোকটি যে ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়েছে, সেও পশ্চিম দিকেই ছুটছে। কিন্তু কাফেলা বা সওয়ারী ঘোড়ার গতি কোন্ দিক, তা ঐ বেহুশ যাত্রীর জানা নেই। তার মন রয়েছে পূর্বদিকে নিবদ্ধ। সে তার ঘোড়ার পেছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। লাগাম টানাটানি করে এবং সজোরে চাবুক কষিয়ে সে ঘোড়াকে পিছন দিকে ফিরিয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কয়েক পা সে ঘোড়াকে পিছন দিকে টেনেও নেয়। কিন্তু আবার কাফেলার পতি এবং নিজের স্বভাবগত ঝোঁকপ্রবণতায় বাধ্য হয়ে ঘোড়া সেই পশ্চিম দিকেই ছুটতে থাকে। মোটকথা, এভাবে ঐ যাত্রী বারবার নিজের মনন ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঐ মঞ্জিলের দিকেই যেতে বাধ্য হয়, কিন্তু এক সার্থক ও সফলকাম যাত্রীর মতো নয়, বরং এক ব্যর্থ এ বিফলকাম যাত্রীর মতো। কারণ যে জিনিসকে সে আপন মঞ্জিলে মকসুদ বলে ঘোষণা করেছে, সে পর্যন্ত পৌঁছার সৌভাগ্য তার হয় না, আবার যেখানে সে কার্যত গিয়ে পৌঁছে, সেটা না তার গন্তব্যস্থল, আর না সেখানে থাকার কোন প্রস্তুতি, সে গ্রহণ করে ।

দুইঃ  ইসলামী জীবন ব্যবস্থার আকর্ষিক শক্তি - পূর্বে যেমন বলা হয়েছে যে, দ্বীন ইসলামের গোটা ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র ও ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর সত্তা। এর গোটা ব্যবস্থাপনাই ঐ কেন্দ্রের চারদিকে আবর্তন করছে। এই ব্যবস্থাপনায় যাকিছু রয়েছে তা মনন ও প্রত্যয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক আর পূজা-উপাসনা ও ইবাদাত-বন্দেগীর সাথে সম্পৃক্ত হোক অথবা তা দুনিয়াবী জীবনের কোন কারবারই হোক তার প্রতিটি জিনিসেরই গতি ঐ কেন্দ্ৰীয় সত্তার দিকেই নিবন্ধ এবং প্রতিটি জিনিসই তার আকর্ষণ শক্তির প্রচণ্ড তারের সাথে সংযুক্ত হয়ে আছে। খোদ দ্বীন (আনুগত্য) ও ইসলাম (আত্মসমর্পণ) শব্দ দু'টি- --যার থেকে এই ধর্মীয় ব্যবস্থাপনাটি উদ্ভাবিত হয়েছে—তার এই প্রকৃতি ও নিগূঢ় তত্ত্বকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে প্রতিপন্ন করে। দ্বীন ও ইসলাম শব্দের মানেই হচ্ছে এই যে, বান্দাহ তার আল্লাহর সন্তুষ্টির সামনে মাথা নত করে দিবে এবং তাঁরই ইচ্ছার অনুগত হবে।

ومَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسين (النساء : ١٢٥)

"যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে মাথা নত করে দিয়েছে এবং সে সৎকর্মশীলও তার চেয়ে উত্তম দ্বীন আর কার হবে।" -(সূরা আন নিসা : ১২৫)

وَمَنْ يُسْلِمُ وَجْهَةٌ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى

“যে ব্যক্তি আপন মুখমণ্ডল আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয় এবং সেই সঙ্গে সে সৎকর্মশীলও হয়, সে তো অত্যন্ত মযবুত রজ্জু আকড়ে ধরলো।” -(সূরা লোকমান : ২২)

ইসলামের প্রকৃতি এর চেয়ে চমৎকারভাবে অনুধাবন করা যায় আল্লাহর সামনে হযরত ইবরাহীম (আ) এবং তাঁর পুত্রের আত্মসমর্পণ ঘটনা থেকে । পুত্র (হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করুন) বলে নিজকে ছুরিকার নীচে সমৰ্পণ করে দেন আর পিতা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে নিজের কলিজার টুকরাকে জবাই করতে উদ্যত হন—উভয়ের এই আচরণকে 'ইসলাম' শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।

فلما أَسْلَمَا وَنَتْهُ لِلْجَبِينِ (الصفت : ١٠٣)

“যখন তারা উভয়ই আত্মসমর্পণ (ইসলাম) করলেন এবং ইবরাহীম ইসমাঈলকে (যবেহ করার জন্য) উপুড় করে শোয়ালেন ...।" -(সূরা আস সাফফাত : ১০৩)

এই কারণেই ইসলামের প্রতিটি জিনিস আল্লাহরই জন্যে নির্ধারিত। নামায যদি আল্লাহর জন্যে না হয় তাহলে তা একটি অর্থহীন ওঠা-বসা ছাড়া আর কিছু নয় । রোযা যদি আল্লাহর জন্যে না হয় তাহলে তা হবে শুধু উপবাসের শামিল। যাকাত ও দান-খয়রাত যদি আল্লাহর জন্যে হয় তবে তা হবে আল্লাহর পথে ব্যয়, নচেৎ তা হবে শুধু অপব্যয় ও অপচয়। যুদ্ধ ও জিহাদ যদি খালেছ আল্লাহর পথে হয়, তবে তা হবে শ্রেষ্ঠতম ইবাদত, নচেৎ তা হবে শুধু ফেতনা- ফাসাদ আর নিছক রক্তপাত। এভাবে ইসলামের নির্দেশিত অন্যান্য কাজগুলো যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা হয়, তবে তা হবে সৎ ও প্রতিদানযোগ্য কাজ, নতুবা তা হবে নিষ্ফল ও অর্থহীন কাজ। আর যেগুলো ইসলাম নিষেধ করেছে, তাথেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে বিরত থাকলে তা হবে ফলপ্রসু, নতুবা তা হবে একেবারেই পন্ডশ্রম।

ইসলামী জীবন ব্যবস্থার এই প্রচণ্ড এককেন্দ্রিকতা ও একমুখিতা হচ্ছে ঐ লক্ষ্যবস্তুরই সৃষ্ট ফল। এই আকর্ষিক শক্তিই ইসলামী জীবন ব্যবস্থার যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে এক শক্তিশালী কেন্দ্রাভিমুখী প্রবণতার সৃষ্টি করেছে। বর্তমান যুগের প্রকৃতি-বিজ্ঞান অনুসারে আমাদের সৌর ব্যবস্থা যেমন মযবুত ও পূর্ণাঙ্গ, ঐ লক্ষ্যের বদৌলতে এই ব্যবস্থাটিও ঠিক সেরূপ মযবুত ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এই লক্ষ্যটি যদি না হতো, তাহলে দ্বীন ইসলামে এরূপ শৃংখলাও বজায় থাকতো না ।

তিনঃ চিন্তা ও কর্মের একমুখিনতা – এই লক্ষ্যটি যেমন ইসলামের ধর্মীয় ব্যবস্থায় এককেন্দ্রিকতা, একমুখিনতা ও নিয়ম-শৃংখলার সৃষ্টি করেছে, তেমনি এই মানুষের চিন্তা ও কল্পনায়, ইচ্ছা ও মননে এবং আকীদা ও আচরণেও এক পরিপূর্ণ একমুখিনতা পয়দা করে দেয়। পরন্তু এই একমুখিনতার সাথে তার দৃষ্টিকে এমন এক উচ্চতম লক্ষ্য বিন্দু ও মহত্তম উদ্দেশ্যের প্রতি নিবন্ধ করে দেয়, যার চেয়ে বেশী উন্নত বা উচ্চ পর্যায়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতেই পারে না। শুধু স্বভাবগত কামনার পরিতৃপ্তি কিংবা প্রবৃত্তিগত স্বার্থ লাভ অথবা আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য পূরণই যে ব্যক্তির একমাত্র লক্ষ্য হবে, তার চিন্তা ও কর্মে কখনো একমুখিনতা আসতে পারে না। কারণ, বুদ্ধি ও মনোগত ক্রমবিকাশ এবং দৃষ্টি ও কর্মের প্রসারণের প্রত্যেক পর্যায়ে তার ভেতর নব নব কামনা ও বাসনার সৃষ্টি হবে এবং নতুন নতুন জিনিসকে সে নিজের অভীষ্ট ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করতে থাকবে। জ্ঞান ও বুদ্ধির কোন উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছে মানুষ এমন সব প্রকৃতিগত কামনা এবং আধ্যাত্মিক ও প্রবৃত্তিগত দাবীর ওপর অবিচল থাকে, যা এর পরবর্তী নিম্নতর পর্যায়ে তার পক্ষে দৃষ্টি আকর্ষণকারী ও কর্মপ্রেরণাদানকারী ছিল— এটা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। এভাবে এক উদ্দেশ্য থেকে অন্য উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত হতে হতেই মানুষের সমস্ত জীবন অতিক্রম হয়ে যাবে এবং তার চিন্তাধারায় পরিপূর্ণ একমুখিনতা সৃষ্টি করতে এবং তাঁর গোটা চিন্তা ও কর্মশক্তিকে নিয়োজিত করতে পারে, এমন কোন কেন্দ্ৰীয় ভাবধারাই তার মনের ভেতর বদ্ধমূল হতে পারে না। এ বৈশিষ্ট্য ইসলামী লক্ষ্যের ভেতরেই রয়েছে যে জ্ঞান ও বুদ্ধির যে কোন পর্যায়ে সে মানুষের একমাত্র জীবন লক্ষ্য হতে পারে এবং কোন উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেও তাকে বদলাবার কোন প্রয়োজন দেখা দেয় না। কারণ জ্ঞান ও বুদ্ধির যতো উচ্চ মার্গেরই আমরা কল্পনা করি না কেন, আল্লাহর সত্তা তার চেয়েও মহান ও উন্নত । এছাড়া অতি তুচ্ছতম পর্যায় থেকে অদ্ভুচ্ছ পর্যায় পর্যন্ত যে কোন লোকের সাথেই তার সম্পর্ক সমান। এ ব্যাপারে কোন পার্থক্য থেকে থাকলে তা শুধু আমাদের বুদ্ধি-জ্ঞান ও চেতনার পার্থক্যের দিক দিয়েই রয়েছে।

চার : খালেছ মানবীয় সমাজ সংগঠন – আবার এ লক্ষ্যটি যেমন এক ব্যক্তির জীবন লক্ষ্য হতে পারে, তেমনি একটি সমাজ, একটি জাতি বরং গোটা মানব জাতিরই লক্ষ্য হতে পারে। কারণ যে আত্মসর্বস্বতা এবং ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক স্বার্থপরতার স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে মানবতাকে বংশ-গোত্র-সম্প্রদায় এবং ব্যক্তি ও ব্যষ্টিতে বিভক্ত করে দেয়া এবং তাদের ভেতর পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিরোধ সৃষ্টি এবং শত্রুতা ও পরশ্রীকাতরতার মনোভাব জাগিয়ে দেয়া, এ লক্ষ্যের ভেতর তার কোন উপাদানই বর্তমান নেই এবং যে মহান সত্তার সাথে গোটা মানব জাতি তথা গোটা বিশ্বপ্রকৃতির সমান সম্পর্ক বিদ্যমান এবং যার প্রতি নিবিষ্ট হবার পর প্রতিটি দিক থেকে মানবীয় উদ্দেশ্যের ভেতর ঐক্য ও একত্বের সৃষ্টি হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে সাহায্য-সহায়তা ও সৌভ্রাত্বের ভাবধারা সৃষ্টি হয়, এ লক্ষ্যটি মানুষকে সেদিকে নিবিষ্ট করে দেয় । দুনিয়ায় যত বৈষয়িক উদ্দেশ্য রয়েছে, তার কোন একটিতে দু'জন মানুষও একে অপরের সত্যিকার সহায়ক হতে পারে না। ভাই-ভাই, পিতা-পুত্র এবং মাতা-কন্যার পক্ষেও এক বৈষয়িক উদ্দেশ্য একত্রিত হয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, এমনকি বৈরিতা ও শত্রুতা থেকে বেঁচে থাকা পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা খোদ রক্তের সম্পর্ককে ছিন্ন হতে দেখেছি। আমাদের চোখের সামনে ভাই ভাইর গলা পর্যন্ত কেটেছে। নিছক পার্থিব উদ্দেশ্যের জন্যে অতি নিকটতম প্রিয়জনেরা একে অপরের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দিয়েছে, এ রকম অসংখ্য দৃশ্য আমরা স্বচক্ষে দেখেছি এবং এখনো দেখছি। এসব কিছু হচ্ছে পার্থিব স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান আত্মসর্বস্বতা ও স্বার্থপরতার প্রত্যক্ষ ফল। কিন্তু আল্লাহর সত্তা হচ্ছে সকল পরিণতির শেষ পরিণতি, কোনরূপ দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা প্রতিরোধ-প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে এবং কেউ কারো স্বার্থে সংঘর্ষ না লাগিয়ে লক্ষ্য কোটি মানুষ একই সময় তার দিকে ছুটে যেতে পারে। বরঞ্চ এ যাত্রাপথের প্রত্যেক যাত্রীই আন্তরিকতার সাথে অন্য যাত্রীর সাহায্য করে, নিজের ওপর অন্যের আরামকে অগ্রাধিকার দেয় এবং অন্যের পরিশ্রমের তুলনায় নিজে বেশী পরিশ্রম করতে প্রস্তুত হয়। আরাম ও আয়েশের সাথে চলার চেয়ে আপন সহযাত্রীর বোঝা বহন করে, অন্যের খেদমত করে, হাঁপাতে হাঁপাতে, বিনয়ের সাথে ও সলজ্জভাবে লক্ষ্যস্থলে উপনীত হওয়া এবং আপন মালিকের অধিক হতে অধিক পরিমাণে সন্তুষ্টি অর্জন করাকে অনেক বেশী উত্তম মনে করে।

বস্তুত, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও মৌলিক সীমারেখার বৈষম্যকে নিশ্চিহ্ন করে এক বিশ্বব্যাপী জাতীয়তার রূপায়ণ এবং আন্তর্জাতিক মানব সংঘের সংগঠনের জন্যে যে কেন্দ্রীয় ভাবধারার প্রয়োজন, তা এ লক্ষ্যের ভেতরেই পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান রয়েছে। এ ধরনের বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতির জন্যে এর চেয়ে উত্তম আর কোন লক্ষ্যই হতে পারে না। কারণ তা এক দিকে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে একেবারে বিলুপ্তও করে দেয় না, আবার অন্য দিকে ব্যক্তিত্বের সকল বিকেন্দ্রিক প্রবণতাকে নিশ্চিহ্ন করে এক খালেছ মানবীয় সমাজে তাকে সন্নিবেশিত করে দেয়।

পাঁচঃ  গৌণভাবে সকল উদ্দেশ্যের সফলতা – এ লক্ষ্যের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য এই যে, দুনিয়ায় ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক দিক দিয়ে মানুষের যতো উদ্দেশ্য হতে পারে, এর নিরূপণের সাথে সাথে তা সবই গৌণভাবে হাসিল হয়ে যায় । এজন্যে ঐগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে অভীষ্ট বানাবার কোন প্রয়োজন হয় না। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সাথে সাথে যে জিনিসগুলো অনিবার্যভাবে হাসিল হয়ে থাকে, কুরআন মজীদ এক একটি করে তার সবই উল্লেখ করেছে।
পার্থিব জীবনে মানুষের সবচেয়ে বড়ো কামনা হচ্ছে শান্তি, নিরাপত্তা, নিশ্চিন্ততা ও মানসিক প্রশাস্তি। কুরআন বলে যে, আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট হও ও তাঁর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করো, এ জিনিসটি তোমরা আপনা আপনিই লাভ করবে ।

بَلَى ، مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِنْدَ رَبِّهِ ، وَلَا خَوْفٌ . من
وَ
عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (البقرة : ۱۱۲)

“হাঁ যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করেছে এবং সে সৎকর্মশীল হয়েছে, তার পুরস্কার রয়েছে তার পরোয়ারদেগারের কাছে; এমনি লোকদের জন্যে কোন ভয়ের কারণ নেই আর এরা কখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হয় না।”-(সূরা আল বাকারা : ১১২)

الا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ (الرعد : ۲۸)

“জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই আত্মার প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা লাভ হয়ে থাকে।”-(সূরা আর রাদ : ২৮)

দুনিয়ার জীবনে মানুষ দ্বিতীয় যে জিনিসটি লাভ করতে চায়, তা হচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্য, অর্থাৎ দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগমুক্ত জীবন। কুরআন বলে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলে, তাঁর গযব থেকে বেঁচে থাকলে এবং তাঁর জন্যে পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতা অবলম্বন করলে এ বস্তুটিও স্বাভাবিকভাবে হাসিল হয়ে যায়।

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى امَنُوا وَالتَّقَوُا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكت مِّنَ السَّمَاءِ

“এ বস্তিগুলোর লোকেরা যদি ঈমান আনতো, পরহেযগারী অবলম্বন করতো তাহলে আমরা তাদের জন্যে আসমান ও জমিন থেকে বরকতের দরজা খুলে দিতাম।”-(সূরা আল আরাফ : ৯৬)

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مَنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنثى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيوةً طَيِّبَةً ،
وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَه (النحل : ٩٧)

“যে ব্যক্তি নেক কাজ করলো মু'মিন অবস্থায় – সে পুরুষ হোক আর নারী – আমরা তাকে অবশ্যই স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করাবো। এমন লোকদেরকে আমরা নিশ্চিতরূপে তাদের আমলের চেয়ে অনেক বেশী উত্তম প্রতিফল দান করবো।” -(সূরা আন নাহল : ১৭)

তৃতীয় যে জিনিসটি মানুষের সবচেয়ে বেশী কাম্য ও অভিপ্রেত তা হচ্ছে রাষ্ট্র ও শাসন ক্ষমতা এবং আধিপত্য ও উচ্চমর্যাদা। কুরআন বলে যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি নিবেদিত চিত্ত হও, এ সম্পদটি নিজেই তোমাদের পায়ের ওপর এসে পড়বে।

وَمَنْ يُتَوَلُ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَه

“যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং ঈমানদার লোকদের বন্ধু হয়েছে, (সে আল্লাহর দলে যোগদান করেছে), আর আল্লাহর দল অবশ্যই বিজয়ী হবে।”-(সূরা আল মায়েদা : ৫৬)

ولَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزبورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ

“আমরা জবুরে উপদেশ ও নছিহতের পর একথা লিখে দিয়েছি যে, আমাদের নেক বান্দাগণই হবে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী ।

وعد الله الذينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمْكِنَنَّ لَهُمْ بَيْنَهُمُ الَّذِي
ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدَلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِم أمنا ، ( النور : ٥٥)

“তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে খেলাফত দান করবেন, তাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে তিনি যেভাবে খলিফা বানিয়েছিলেন। আর তিনি তাদের জন্যে যে দ্বীনকে পসন্দ করেছেন তাকে অবশ্যই তিনি স্থিতি দান করবেন এবং তাদের ভীতিজনক অবস্থার পর শাস্তি প্রদান করবেন।"-(সূরা আন নূর : ৫৫)

অনুরূপভাবে পরকালীন জীবনে মুক্তি মানুষের একান্ত কাম্য। এ সম্পর্কেও কুরআন বলে যে, এ শুধু আল্লাহর সন্তোষ লাভেরই ফলমাত্র :

بايْتُهَا النَّ: ارجع إلى رَبِّكَ رَاضِيَة مُرضية
فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي (الفجر : ٢٧-٣٠)

“হে নিশ্চিন্ত নফস, আপন প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করো, এমন অবস্থায় যেন তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট ; অতপর (আল্লাহ বলবেন যে,) তুমি আমার বান্দাদের মধ্যে শামিল এবং আমার বেহেশতে দাখিল হয়ে যাও।” (সূরা আল ফজর : ২৭-৩০)

এ থেকে জানা গেলো যে, অন্যান্যরা যতো জিনিসকে কাম্য ও অভীষ্ট বলে ঘোষণা করেছে, ইসলাম সে সবের প্রতি দৃকপাত পর্যন্ত করেনি, বরং যে বস্তুটি অর্জনের ফলে এসব জিনিস আপনা-আপনি হাসিল হয়ে যায়, ইসলাম সেটিকেই তার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নিয়েছে। অন্যান্যরা যেসব জিনিসকে নিজেদের লক্ষ্য বলে অভিহিত করে, সেগুলোর অন্বেষণে মুসলমান তার অন্তকরণকে এক মুহূর্তের জন্যেও লিপ্ত করবে, তার দৃষ্টিতে তা এতটুকু উপযোগীও নয়। তার সামনে তো ঐ সকল লক্ষ্য এবং সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুর চেয়ে উন্নত ও সুউচ্চ এক মহান লক্ষ্য রয়েছে। সে ভালো করেই জানে যে, এ উচ্চতম লক্ষ্যে যখন সে উপনীত হবে, তখন এর অধীনস্থ প্রতিটি জিনিস আপনা-আপনিই সে পেয়ে যাবে। ইমারতের সবচেয়ে উপরের তলায় আরোহণ করলে মধ্যবর্তী তলাগুলো যেমন আরোহণকারীর পায়ের নীচে থাকে, মুসলমান তার লক্ষ্যে পৌঁছে ঠিক সেরূপ অবস্থাই দেখতে পায় ।
.
ছয়ঃ   তাকওয়া ও সৎকর্মশীলতার সর্বোত্তম প্রেরণা – এ লক্ষ্যটির আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ইসলাম পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতার যে উন্নত মান প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তার জন্যে ন্যায় ও অন্যায়ের যে বিধি-নিষেধ পেশ করেছে, মানুষকে তা পালন করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করার নিমিত্ত এ লক্ষ্যটিই একমাত্র মার্জিত ও পবিত্র লক্ষ্য হতে পারে।

দুনিয়ায় সৎকাজ যে শুধু সৎকাজ বলেই করা উচিত আর দুষ্কৃতিকে কেবল দুষ্কৃতির কারণেই বর্জন করা উচিত— এমন কথা বলার মতো লোকের কোন অভাব নেই। কিন্তু এ ধরনের কথা যারা বলেন, এর প্রকৃত তাৎপর্যটা পর্যন্ত তাদের জানা নেই। নিছক সৎকাজের খাতিরে সৎকাজ করার মানে হচ্ছে এই যে, সৎকাজের সাথে কোন কল্যাণ ও উপকারিতার সম্পর্ক নেই; সৎকাজ সৎকাজই, আর এ কারণেই তা মানুষের অভীষ্টও হতে পারে। অনুরূপভাবে শুধু দুষ্কৃতির জন্যেই দুষ্কৃতি থেকে বিরত থাকার অর্থ হচ্ছে এই যে, সমস্ত ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দুষ্কৃতি তার নিজস্ব চরিত্রেই দুষ্কৃতি, যেনো তার চরিত্রটাই মানুষের পক্ষে বর্জনীয় হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ায় মানুষের জন্যে এমন নির্ভেজাল সৎকাজের কোন অস্তিত্ব নেই, যা মানুষের ব্যক্তি সত্তার প্রতি আরোপিত হবার উপযোগী সকল ফায়দা ও কল্যাণ থেকে মুক্ত। আর না এমন খালেছ দুস্কৃতির অস্তিত্ব আছে, যা মানুষের ব্যক্তি সত্তাকে প্রভাবিত করার মতো অনিষ্টকারিতা থেকে শূন্য। বরং সত্য কথা এই যে, লাভ ও ক্ষতি তথা উপকারিতা ও অনিষ্টকারিতার অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মনে সৎকাজ ও দুষ্কৃতির ধারণা পয়দা হয়েছে। যে কাজ দ্বারা মানুষের প্রকৃতই কোন উপকার হয়, দৃশ্যত তার ভিতরে কিছু অপকারিতা থাকলেও, মানুষ তাকেই সৎকাজ বলে অভিহিত করে। আবার যে কাজ দ্বারা তার যথার্থই কোন ক্ষতি সাধিত হয়, বাহ্যদৃষ্টিতে তার ভেতর কিছু উপকারিতা থাকলেও, মানুষ তাকেই দুষ্কৃতি বলে আখ্যায়িত করে। কোন কাজকে যদি লাভ ও ক্ষতির বিশেষণ থেকে মুক্ত করে নেয়া হয় এবং কাজটি শুধু একটি ক্রিয়াই থেকে যায়, তবে আমরা তাকে সৎকাজ বা দুষ্কৃতি এর কোনটাই আখ্যা দিতে পারি না। একথা নিসন্দেহ যে, সৎকাজের অভ্যাস দৃঢ়তর হওয়া এবং উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে উপনীত হবার পর মানুষের পক্ষে লাভ ও ক্ষতির ধারণা থেকে মুক্ত হয়েও নিছক সৎকাজের খাতিরে সৎকাজ করা এবং দুষ্কৃতির জন্যেই দুষ্কৃতি থেকে বিরত থাকা সম্ভবপর। কিন্তু প্রথমত এটা শুধু কল্যাণ ও অকল্যাণের উৎস সম্পর্কে বিস্তৃতি মাত্র, উৎসের অপসারণ নয় ; দ্বিতীয়ত এটা শুধু দার্শনিকদের কল্পনার স্বর্গারোহণ মাত্র, কার্যত বড়ো বড়ো বিজ্ঞানীরও এ পর্যন্ত পৌছার সৌভাগ্য হয়নি। কাজেই সাধারণ লোকেরা নিছক সৎকাজ অবলম্বন ও দুষ্কৃতি পরিহারকে কিভাবে আপন লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।

এ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, সৎকাজ ও দুষ্কৃতির ধারণাকে লাড ও ক্ষতির ধারণা থেকে পৃথক করা যেতে পারে না। সৎকাজের ভেতরে যতক্ষণ না কোন কল্যাণকারিতা নিহিত থাকবে, ততক্ষণ তা মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হতে পারে না। ঠিক তেমনিভাবে দুষ্কৃতির ভেতরে কোন অনিষ্টকারিতা প্রচ্ছন্ন না থাকলে তাকে বর্জনীয় বলে আখ্যা দেয়া যেতে পারে না। এবার যদি আমরা পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতাকে স্বার্থপরতার তুচ্ছ পর্যায় থেকে স্বার্থহীনতা ও ঐকান্তিকতার উচ্চপর্যায়ে উন্নীত করা এবং তাকে এক নির্বিশেষ ও সার্বজনীন নৈতিক বিধানের ভিত্তি বলে অভিহিত করতে চাই, তাহলে তার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে এই যে, লাভ ও ক্ষতির এমন একটি মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা হবে বস্তুসর্বস্বতা ও স্বার্থপরতার চেয়ে উন্নততর ; যার ভিত্তিতে সর্ববিধ বৈষয়িক ও মানবিক ক্ষতি দ্বারা পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও একটি সৎকাজ মানুষের চোখে শুধু কল্যাণময় বলেই প্রতিভাত হবে এবং সবদিক দিয়ে মঙ্গলময় হওয়া সত্ত্বেও একটি পাপ কাজকে শুধু ক্ষতিকারক বলেই মনে হবে। ইসলাম এ পন্থাটিই অবলম্বন করেছে। সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন না অর্জনকে লাভ ও ক্ষতির একমাত্র মানদণ্ড বলে ঘোষণা করেছে। এ মানদণ্ড বৈষয়িক স্বার্থপরতামূলক পংকিলতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। এ মানদণ্ড অনুযায়ী একজন সৎকর্মশীল মানুষ আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্যে নিজের জান, মাল, সন্তানাদি, সুনাম, সুখ্যাতি ইত্যদি কুরবান করেও এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, সে লাভবান হয়েছে। আবার একজন দুষ্কৃতিপরায়ণ মানুষ আল্লাহর গযব ডেকে আনার পর দুনিয়ার সকল বৈষয়িক ও স্বার্থপরতামূলক ফায়দা হাসিল করেও এ ভয় পোষণ করে যে, সে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। এ জিনিসটাই মানুষকে পার্থিব লাভ ও ক্ষতির প্রতি বেপরোয়া করে নিঃস্বার্থচিত্তে পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতা অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করে।

এ পর্যন্ত দু'টি বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথম এই যে, ইসলাম কোন্ জিনিসটাকে জীবনের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয় এই যে, কি কি কারণে তা একটি উত্তম লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। এবার এ প্রশ্নের তৃতীয় দিকের প্রতি আমাদের আলোকপাত করতে হবে। আর তাহলো এই যে, ইসলামী সংস্কৃতিকে একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতির রূপদানে এ লক্ষ্যটির ভূমিকা কি এবং এ সংস্কৃতিকে সে কোন্ বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছে ?



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url