মা’আরেফুল কোরআন-৭ || সূরা আল-ফাতিহার তাফসীর || আল্লাহর কিতাবের শিক্ষা এবং সরল পথ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

আল্লাহর কিতাবের শিক্ষা এবং সরল পথ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা

এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। আর এ ব্যাপারে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে জ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে যায়। তা হচ্ছে, সিরাতে মুস্তাকীম নির্ধারণ করার জন্য বস্তুত সিরাতে রাসূল, সিরাতে কোরআন বলে দেওয়াই তো যথেষ্ট ছিল। উপরোক্ত দু'টি পথ চিহ্নিত করা যেমন সংক্ষিপ্ত ছিল, তেমনি ছিল সুস্পষ্ট। কেননা সমগ্র কোরআনই তো সিরাতে মুস্তাকীমের বিস্তারিত বর্ণনা। অপরদিকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সমগ্র শিক্ষা হচ্ছে কোরআনেরই বিস্তারিত বর্ণনা। অথচ আলোচ্য এ ছোট্ট সূরাটির দু'টি আয়াতে সহজ এবং স্বচ্ছ দু'টি পন্থা বাদ দিয়ে প্রথম ইতিবাচক এবং পরে নেতিবাচক পদ্ধতিতে সিরাতে মুস্তাকীম চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছেন- যদি সিরাতে মুস্তাকীম চাও, তবে এ সমস্ত লোককে তালাশ করে তাদের পথ অবলম্বন কর। কেননা, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এ দুনিয়াতে চিরকাল অবস্থান করবেন না। তাঁর পরে আর কোন নবী বা রসুলেরও আগমন হবে না। তাই তাঁদের মধ্যে নবীগণ ছাড়াও সিদ্দীক, শহীদান ও সালেহীনকেও অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, কিয়ামত পর্যন্ত এঁদের অস্তিত্ব দুনিয়াতে থাকবে।

ফলকথা এই যে, সরল পথ অনুসন্ধানের জন্য আল্লাহ তা'আলা কিছু সংখ্যক মানুষের সন্ধান দিয়েছেন ; কোন পুস্তকের হাওয়ালা দেননি। এক হাদীসে রসূলুল্লাহ (সা) যখন সাহাবীগণকে জানিয়েছেন যে, আমার উম্মতও পূর্ববর্তী উম্মতগণের ন্যায় সত্তুরটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। তন্মধ্যে মাত্র একটি দলই সরল পথে থাকবে। তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সেটি কোন্ দল ? প্রত্যুত্তরে তিনি যা বলেছিলেন, তাতেও তিনি কিছু লোকের সন্ধান দিয়েছেন। এরশাদ করেছেন: আমি এবং আমার সাহাবীগণ যে পথে রয়েছি সে পথই সত্য ও ন্যায়ের পথ। বিশেষ ধরনের এ বর্ণনা পদ্ধতিতে হয়তো সে দিকে ইশারা করা হয়েছে যে, মানুষের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা-দীক্ষা কেবল কিতাব ও বর্ণনা দ্বারা সম্ভব হয় না, বরং দক্ষ ব্যক্তিগণের সাহচর্য ও সংস্রবের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে। বাস্তবপক্ষে মানুষের শিক্ষক এবং অভিভাবক মানুষই হতে পারে। কেবল কিতাব বা পুস্তক শিক্ষক ও অভিভাবক হতে পারে না ।
এ এমনই এক বাস্তব সত্য যে, দুনিয়ার যাবতীয় কাজকর্মেও এর নিদর্শন বিদ্যমান। শুধু পুঁথিগত বিদ্যার দ্বারা কেউ না পারে কাপড় সেলাই করতে, না পারে আহার করতে। শুধু ডাক্তারী বইপত্র পাঠ করে কেউ ডাক্তার হতে পারে না। ইঞ্জিনিয়ারিং বইপত্র পাঠ করে কেউ ইঞ্জিনিয়ারও হতে পারে না। অনুরূপভাবে শুধু কোরআন-হাদীস পাঠ করাই কোন মানুষের পরিপূর্ণ তা'লীম ও তরবিয়তের জন্য যথার্থ হতে পারে না। যে পর্যন্ত কোন বিজ্ঞ লোকের নিকট বাস্তবভাবে শিক্ষা গ্রহণ না করে, সে পর্যন্ত দীনের তা'লীম অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কোরআন ও হাদীসের ব্যাপারে অনেকেই এ ভুল ধারণা পোষণ করে যে, কোরআনের অর্থ ও তফসীর পাঠ করে কোরআন ও হাদীস সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়। এটা সম্পূর্ণ প্রকৃতি বিরুদ্ধ ধারণা। কেননা, যদি কিতাব এ ব্যাপারে যথেষ্ট হতো তবে নবী ও রাসুল প্রেরণের প্রয়োজন হতো না। কিভাবের সাথে রাসূলকে শিক্ষকরূপে পাঠানো হয়েছে।

আর সরল পথ নির্ধারণের ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক স্বীয় মকবুল বান্দাদের তালিকা প্রদানও এর প্রমাণ যে, শুধু কিতাবের পাঠই পূর্ণ তা'লীম ও তরবিয়তের জন্য যথেষ্ট নয় ; বরং কোন কোন বিজ্ঞ লোকের নিকট এর শিক্ষালাভ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

বোঝা গেল, মানুষের প্রকৃত মুক্তি এবং কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য দু'টি উপাদানের প্রয়োজন। প্রথম, আল্লাহ্র কিতাব যাতে মানবজীবনের সকল দিকের পথনির্দেশ রয়েছে এবং অপরটি হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় বান্দা বা আল্লাহ-ওয়ালাগণ। তাঁদের কাছ থেকে ফায়দা হাসিল করার মাপকাঠি হচ্ছে এই যে, আল্লাহর কিতাবের নিরিখে তাঁদেরকে পরীক্ষা করতে হবে। এ পরীক্ষায় যারা টিকবে না তারা আল্লাহ্র প্রিয়পাত্র নয় বলেই যারা সঠিক অর্থে আল্লাহ্র প্রিয়পাত্র স্থির হয়, তাঁদের নিকট আল্লাহর কিতাবের শিক্ষা লাভ করে তৎপ্রতি আমল করতে হবে।

মতানৈক্যের কারণ : একশ্রেণীর লোক শুধু আল্লাহ্র কিতাবকে গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহ্র পিয়পাত্রগণ থেকে দূরে সরে গিয়েছে; তাঁদের তফসীর ও শিক্ষাকে কোন গুরুত্বই দেয়নি। আবার কিছু লোক আল্লাহ্র প্রিয়পাত্রগণকেই সত্যের মাপকাঠি স্থির করে আল্লাহ্র কিতাব থেকে দূরে সরে পড়েছে। বলা বাহুল্য, এই দুই পথের পরিণতিই গোমরাহী।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
সূরাতুল ফাতিহাতে প্রথমে আল্লাহ্ তা'আলার প্রশংসা ও তা'রীফ রয়েছে। অতঃপর তাঁর ইবাদতের উল্লেখ রয়েছে। এতদসঙ্গে এ কথারও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমরা তাঁকে ব্যতীত অন্য কাউকেও অভাব পূরণকারী মনে করি না। প্রকারান্তরে এটি আল্লাহ্র সাথে মানুষের একটা শপথ বিশেষ। অতঃপর রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা, যাতে মানুষের সর্বপ্রকার প্রয়োজন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এতে কতিপয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাও সন্নিবেশিত হয়েছে। 

প্রাসঙ্গিক কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছে :

দোয়া করার পদ্ধতি

 এ সূরায় একটা বিশেষ ধরনের বর্ণনারীতির মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, যখন আল্লাহ্র নিকট কোন দোয়া বা কোন আকুতি পেশ করতে হয়, তখন প্রথমে তাঁর তা'রীফ কর, তাঁর দেয়া সীমাহীন নিয়ামতের স্বীকৃতি দাও। অতঃপর একমাত্র তিনি ছাড়া অন্য কাউকেও দাতা ও অভাব পূরণকারী মনে করো না কিংবা অন্য কাউকেই ইবাদতের যোগ্য বলে স্বীকার করো না। অতঃপর স্বীয় উদ্দেশ্যের জন্য আরজী পেশ কর। এ নিয়মে যে দোয়া করা হয়, তা কবূল হওয়ার ব্যাপারে বিশেষ আশা করা যায়। দোয়া করতেও এমন ব্যাপক পদ্ধতি অবলম্বন কর, যাতে মানুষের সকল মকসুদ তার অন্তর্ভুক্ত থাকে। যথা, সরল পথ লাভ করা এবং দুনিয়ার যাবতীয় কাজে সরল-সঠিক পথ পাওয়া, যাতে কোথাও কোন ক্ষতি বা পদস্খলনের আশংকা না থাকে। মোটকথা, এ স্থলে আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ হতে তাঁর তা'রীফ প্রশংসা করার প্রকৃত উদ্দেশ্যই হলো মানবকুলকে শিক্ষা দেওয়া ।

আল্লাহর তা'রীফ বা প্রশংসা করা মানুষের মৌলিক দায়িত্ব

আল্লাহর তা'রীফ বা প্রশংসা করা মানুষের মৌলিক দায়িত্ব এ সূরার প্রথম বাক্যে আল্লাহ্ তা'রীফ বা প্রশংসা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা'রীফ বা প্রশংসা সাধারণত কোন গুণের বা প্রতিদানের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে কোন গুণের বা প্রতিদানের উল্লেখ নেই ।

এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহর নিয়ামত অগণিত। কোন মানুষ এর পরিমাপ করতে পারে না। কোরআনে এরশাদ হয়েছে- وَ اِنۡ تَعُدُّوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ لَا تُحۡصُوۡهَا অর্থাৎ যদি তোমরা আল্লাহ্ নিয়ামতের গণনা করতে চাও, তবে তা পারবে না। মানুষ যদি সারা বিশ্ব হতে মুখ ফিরিয়ে শুধু নিজের অস্তিত্বের প্রতিই দৃষ্টি নিবন্ধ করে, তবে বুঝতে পারবে যে, তার শরীরই এমন একটি ক্ষুদ্র জগত, যাতে বৃহৎ জগতের সকল নিদর্শন বিদ্যমান। তার শরীর যমীন তুল্য। কেশরাজি উদ্ভিদ তুল্য। তার হাড়গুলো পাহাড়ের মত এবং শিরা-উপশিরা যাতে রক্ত চলাচল করে, সেগুলো নদী-নালা বা সমুদ্রের নমুনা। দু'টি বস্তুর সংমিশ্রণে মানুষের অস্তিত্ব। একটি শরীর ও অপরটি আত্মা। এ কথাও স্বীকৃত যে, মানবদেহে আত্মা সর্বাপেক্ষা উত্তম অংশ আর তার শরীর হচ্ছে আত্মার অনুগত এবং অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট মানের অধিকারী। এ নিকৃষ্ট অংশের পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী চিকিৎসকগণ বলেছেন যে, মানবদেহে আল্লাহ তা'আলা পাঁচ হাজার প্রকার উপাদান রেখেছেন। এতে তিন শতেরও অধিক জোড়া রয়েছে। প্রত্যেকটি জোড়া আল্লাহর কুদরতে এমন সুন্দর ও মজবুতভাবে দেওয়া হয়েছে যে, সর্বদা নড়াচড়া করা সত্ত্বেও তার মধ্যে কোন পরিবর্তন হয় না এবং কোন প্রকার মেরামতেরও প্রয়োজন হয় না। সাধারণ মানুষের বয়স ষাট-সত্তর বছর হয়ে থাকে। এ দীর্ঘ সময় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সর্বদা নড়াচড়া করছে, অথচ এর মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেছেন-  نَحْنُ خَلَقْنَاهُمْ وَشَدَدْنَا أَسْرَهُمْ  অর্থাৎ “আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমিই তাদের জোড়াগুলোকে মজবুত করেছি।” এ কুদরতী মজবুতির পরিণাম হয়েছে এই যে, সাধারণভাবে উহা অত্যন্ত নরম ও নড়বড়ে অথচ এ নড়বড়ে জোড়া সত্তুর বছর বা এর চাইতেও অধিক সময় পর্যন্ত কর্মরত থাকে। মানুষের অঙ্গগুলোর মধ্যে শুধু চক্ষুর কথাই ধরুন, এতে আল্লাহ তা'আলার অসাধারণ হেকমত প্রকাশিত হয়েছে, সারাজীবন সাধনা করেও এ রহস্যটুকু উদ্ধার করা সম্ভব নয়।

এই চোখের এক পলকের কার্যক্রম লক্ষ্য করলে বুঝতে পারা যাবে যে, এর এক মিনিটের কার্যক্রমে আল্লাহ তা'আলার কত নিয়ামত যে কাজ করছে, তা ভেবে অবাক হতে হয়। কেননা চক্ষু খুলে এর দ্বারা কত বস্তুকে সে দেখছে। এতে যেভাবে চক্ষুর ভেতরের শক্তি কাজ করছে, অনুরূপভাবে বহির্জগতের সৃষ্টিরাজিও এতে বিশেষ অংশ নিচ্ছে। সূর্যের কিরণ না থাকলে চোখের দৃষ্টিশক্তি কোন কাজ করতে পারে না। সূর্যের জন্য আকাশের প্রয়োজন হয় । মানুষের দেখার জন্য এবং চক্ষু দ্বারা কাজ করার জন্য আহার্য ও বায়ুর প্রয়োজন হয়। এতে বোঝা যায়, চোখের এক পলকের দৃষ্টির জন্য বিশ্বের সকল শক্তি ব্যবহৃত হয়। এ তো একবারের দৃষ্টি। এখন দিনে কতবার দেখে এবং জীবনে কতবার দেখে তা হিসাব করা মানুষের শক্তির ঊর্ধ্বে । এমনিভাবে কান, জিহবা, হাত ও পায়ের যত কাজ আছে তাতে সমগ্র জগতের শক্তি যুক্ত হয়ে কার্য সমাধা হয়। এ তো সে মহা দান যা প্রতিটি জীবিত মানুষ ভোগ করে। এতে রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্রের কোন পার্থক্য নেই। তাছাড়া আল্লাহ্ তা'আলার অসংখ্য নিয়ামত এমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে যা প্রতিটি প্রাণী ভোগ করেও উপকৃত হয়। আকাশ-যমীন এবং এ দু'টির মধ্যে সৃষ্ট সকল বস্তু যথা চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, বায়ু প্রভৃতি প্রতিটি প্রাণীই উপভোগ করে ।

এরপর আল্লাহর বিশেষ দান, যা মানুষের হেকমতের তাগিদে কম-বেশি দেওয়া হয়েছে, ধন-সম্পদ, মান-সম্মান, আরাম-আয়েশ সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যদিও একথা অত্যন্ত মৌলিক যে, সাধারণ নিয়ামত যা সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সমভাবে উপভোগ্য ; যথা-আকাশ, বাতাস, জমি এবং বিরাট এ প্রকৃতি, এ সমস্ত নিয়ামত বিশেষ নিয়ামতের (যথা ধন-সম্পদ) তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম । অথচ এসব নিয়ামত সকল মানুষের মধ্যে সমভাবে পরিব্যাপ্ত বলে, এত বড় নিয়ামতের প্রতি মানুষ দৃষ্টিপাত করে না। ভাবে, কি নিয়ামত! বরং আশপাশের সামান্য বস্তু যথা: আহার্য, পানীয়, বসবাসের নির্ধারিত স্থান, বাড়ি-ঘর প্রভৃতির প্রতিই তাদের দৃষ্টি সাধারণত সীমাবদ্ধ থাকে।

মোটকথা, সৃষ্টিকর্তা মানবজাতির জীবন-ধারণ এবং দুনিয়ার জীবনে বেঁচে থাকার সুবিধার্থে যে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন, তার অতি অল্পই এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের পক্ষে দুনিয়ার জীবনে চোখ মেলেই মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই মহান দাতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকা ছিল স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য যে, মানব-জীবনের সে চাহিদার প্রেক্ষিতে কোরআনের সর্বপ্রথম সূরার সর্বপ্রথম বাক্যে الْحَمْدُ ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেই মহান সত্তার তা'রীফ বা প্রশংসাকে ইবাদতের শীর্ষস্থানে রাখা হয়েছে।

রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর কোন নিয়ামত কোন বান্দাকে দান করার পর যখন সে الْحَمْدُ لله বলে তখন বুঝতে হবে, যা সে পেয়েছে, এই শব্দ তার চেয়ে অনেক উত্তম। (কুরতুবী)

অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি যদি বিশ্ব-চরাচরের সকল নিয়ামত লাভ করে এবং সেজন্য সে আলহামদুলিল্লাহ্ বলে তবে বুঝতে হবে যে, সারা বিশ্বের নিয়ামতসমূহ অপেক্ষা তার الْحَمْدُ لله বলা অতি উত্তম। (কুরতুবী)

কোন কোন আলিমের মন্তব্য উদ্ধৃত করে কুরতুবী লিখেছেন যে, মুখে الْحَمْدُ لله বলা একটি নিয়ামত এবং এ নিয়ামত সারা বিশ্বের সকল নিয়ামত অপেক্ষা উত্তম। সহীহ্ হাদীসে আছে যে, الْحَمْدُ لله পরকালের তৌলদণ্ডের অর্ধেক পরিপূর্ণ করবে ।

হযরত শকীক ইবনে ইবরাহীম الْحَمْدُ -এর ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যখন আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের কোন নিয়ামত দান করেন, তখন প্রথমে দাতাকে চেন এবং পরে তিনি যা দান করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাক। আর তাঁর দেয়া শক্তি ও ক্ষমতা তোমাদের শরীরে যতক্ষণ থাকে, তত্‌ক্ষণ পর্যন্ত তাঁর অবাধ্যতার কাছেও যেও না।

 দ্বিতীয় শব্দ الله এর সাথে لام বর্ণটি যুক্ত। যাকে আরবী ভাষার নিয়ম অনুযায়ী খাস لام বলা হয়। যা কোন আদেশ বা গুণের বিশেষত্ব বোঝায়। এখানে অর্থ হচ্ছে যে, শুধু তারীফ বা প্রশংসাই মানবের কর্তব্য নয়। বরং এ তারীফ বা প্রশংসা তাঁর অস্তিত্বের সাথে সংযুক্ত। বাস্তবিক পক্ষে তিনি ব্যতীত এ জগতে অন্য কেউ তা'রীফ বা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য নয়। এর বিস্তারিত বর্ণনা পূর্বে করা হয়েছে। এতদসঙ্গে এও তাঁর নিয়ামত যে, মানুষকে চরিত্র গঠন শিক্ষাদানের জন্য এ আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, আমার নিয়ামতসমূহ যে সকল মাধ্যম অতিক্রম করে আসে, সেগুলোরও শুকরিয়া আদায় করতে হবে। আর যে ব্যক্তি এহসানকারীর শোকর আদায় করে না, সে বাস্তবপক্ষে আল্লাহ্ তা'আলারও শোকর করে না ।

কোন মানুষের জন্যই নিজের প্রশংসা জায়েয নয়ঃ কোন মানুষের জন্য নিজের তা'রীফ বা প্রশংসা করা জায়েয নয়। কোরআনে এরশাদ হয়েছে: فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى অর্থাৎ তোমরা আত্ম-প্রশংসা বা পবিত্রতার দাবি করো না, আল্লাহ্ই ভাল জানেন, কে মুত্তাকী। কেননা, মানুষের পক্ষে তা'রীফ বা প্রশংসার যোগ্য হওয়া তার তাকওয়া-পরহেযগারীর উপর নির্ভরশীল। কার পরহেযগারী কোন্ স্তরের তা আল্লাহ্ই ভাল জানেন। প্রশ্ন ওঠে যে, আল্লাহ্ তা'আলা তো তাঁর প্রশংসা নিজেই করেছেন। উত্তর হচ্ছে এই, আল্লাহ্র প্রশংসা বা তা'রীফ কিভাবে করতে হবে সে পদ্ধতি উদ্ভাবন করার যোগ্যতা মানুষের নেই। পরন্তু আল্লাহ তা'আলার উপযোগী তা'রীফ বা প্রশংসা করাও মানুষের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন : لا أحصى ثناء عليه আমি আপনার উপযোগী তা'রীফ বা প্রশংসা করতে পারি না। এ জন্যই আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর তা'রীফ বা প্রশংসা পদ্ধতি মানুষকে নিজের তরফ থেকে শিক্ষা দিয়েছেন ।

'রব' আল্লাহর এক বিশেষ নাম, অন্য কাউকে এ নামে সম্বোধন জায়েয নয়ঃ কোন বস্তুর মালিক, পালনকর্তা এবং সর্ববিষয়ে সে বস্তুর পূর্ণতা বিধানের একচ্ছত্র অধিকারী কোন সত্তার প্রতিই কেবল 'রব' শব্দ প্রয়োগ করা যেতে পারে। আর এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সমগ্র সৃষ্টিজগতের এরূপ মালিক ও পালনকর্তা একমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। এ কারণেই এ শব্দ একমাত্র আল্লাহ তা'আলার নামের সাথেই ব্যবহৃত হতে পারে এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে 'রব' বলা জায়েয নয়। সহীহ্ মুসলিম শরীফের হাদীসে এ ব্যাপারে নিষেধবাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে যে, কোন গোলাম বা কর্মচারী যেন তার মালিককে 'রব' শব্দ দ্বারা সম্বোধন না করে। অবশ্য বিশেষ কোন বস্তুর মালিকানা বোঝানোর অর্থে এ শব্দের প্রয়োগ চলতে পারে। যথা, রাব্বুল-বাইত, বাড়ির মালিক ইত্যাদি। (কুরতুবী)

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ -এর অর্থ মুফাসসিরকুল শিরোমণি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, আমরা তোমারই ইবাদত করি, তুমি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করি না। আর তোমারই সাহায্য চাই, তুমি ব্যতীত অন্য কারো সাহায্য চাই না। (ইবনে জরীর, ইবনে আবি হাতেম)

সলফে-সালেহীনদের কেউ কেউ বলেছেন যে, সূরা আল-ফাতিহা সমগ্র কোরআনের সারমর্ম এবং إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ  তার সমগ্র সূরা আল-ফাতিহার সারমর্ম। কেননা, এর প্রথম বাক্যে রয়েছে শিরক থেকে মুক্তির ঘোষণা এবং দ্বিতীয় বাক্যে তার পরিপূর্ণ শক্তি ও কুদরতের স্বীকৃতি। মানুষ দুর্বল, আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন কিছুই সে করতে পারে না । তাই সকল ব্যাপারে আল্লাহ্র উপর একান্তভাবে নির্ভর করা ব্যতীত তার গত্যন্তর নেই। এ উপদেশ কোরআনের স্থানে স্থানে দেওয়া হয়েছে। যথাঃ

. قُلْ هُوَ الرَّحْمَنُ أَمَنَّا بِهِ وَعَلَيْهِ تَوَكَّلْنَا (ملك)
المَشْرِقِ وَالْمَغْرِب لا إِلهَ إِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيلاً (مزمل)

এ আয়াতগুলোর সারমর্ম হচ্ছে যে, মু'মিন স্বীয় আমল বা নিজের যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না, আবার অন্য কারো সাহায্যের উপরও নয়। বরং একমাত্র আল্লাহর সাহায্যের উপরই তাকে পূর্ণ ভরসা করতে হবে। 

আকায়েদের দু'টি মাসআলা

এতে আকায়েদের দু'টি মাসআলারও মীমাংসা হয়ে গেছে। যথা :
প্রথম মাসআলাঃ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত জায়েয নয়, তাঁর ইবাদতে অন্য কাউকে অংশীদার করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ঃ ইতিপূর্বে ইবাদতের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, কোন সত্তার অসীমতা, মহত্ত্ব এবং তাঁর প্রতি ভালবাসার ভিত্তিতে, তাঁর সামনে অশেষ কাকুতি-মিনতি পেশ করার নাম ইবাদত। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো সাথে অনুরূপ আচরণ করাই শির্ক। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, মূর্তিপূজার মত প্রতীকপূজা বা পাথরের মূর্তিকে খোদায়ী শক্তির আধার মনে করা বা কারো প্রতি সম্ভ্রম বা ভালবাসা এ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া, যা আল্লাহর জন্য করা হয়, তাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কোরআনে ইহুদী ও নাসারাদের অনুসৃত শিরকের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُونِ اللَّهِ.

অর্থাৎ, তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের সাধু-সন্ন্যাসীদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। আদী ইবনে হাতেম খৃস্টধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হবার পর এ আয়াত সম্বন্ধে রাসূল (সা)-কে প্রশ্ন করেছিলেন যে, আমরা তো আমাদের পুরোহিতদের ইবাদত করিনি, কোরআন আমাদের প্রতি কিভাবে এ অপবাদ দিয়েছে? প্রত্যুত্তরে রাসূল (সা) এরশাদ করেছিলেন : “পুরোহিত আলিমগণ এমন অনেক বস্তুকে কি হারাম বলেনি, যেগুলোকে আল্লাহ্ হালাল করেছেন এবং এমন অনেক বস্তুকে হালাল বলেনি, যেগুলোকে আল্লাহ হারাম বলেছেন। আদী ইবনে হাতেম স্বীকার করেছিলেন যে, তা অবশ্য করেছেন। তখন রাসূল (সা) বলেছিলেন যে, এ তো প্রকারান্তরে তাদের ইবাদতই হলো।"

এতে বোঝা যাচ্ছে যে, কোন বস্তুকে হালাল বা হারাম ঘোষণা করা একমাত্র আল্লাহ্রই কাজ। যে ব্যক্তি এ কাজে অন্যকে অংশীদার করে, হালাল ও হারাম জানা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ ‘ব্যতীত অন্য কারো কথাকে অবশ্যকরণীয় মনে করে, তবে প্রকারান্তরে সে তার ইবাদতই করে এবং শিরকে পতিত হয়। সাধারণ মুসলমান যারা কোরআন-হাদীস সরাসরি বুঝতে পারে না, শরীয়তের হুকুম-আহ্কাম নির্ধারণের যোগ্যতা রাখে না; এজন্য কোন ইমাম, মুজতাহিদ, আলিম বা মুফতীর কথার উপর বিশ্বাস রেখে কাজ করে; তাদের সাথে এ আয়াতের মর্মের কোন সম্পর্ক নেই। কেননা, প্রকৃতপক্ষে তারা কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক আমল করে ; আল্লাহর নিয়ম-বিধানেরই অনুকরণ করে, আলিমগণের নিকট থেকে তারা আল্লাহ্র কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহর ব্যাখ্যা গ্রহণ করে মাত্র। কোরআনই তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে:

فَاسْتَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ .

অর্থাৎ “যদি আল্লাহ্র আদেশ তোমাদের জানা না থাকে, তবে আলিমদের নিকট জেনে নাও।”

হালাল-হারাম নির্ধারণের ব্যাপারে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য যে কাউকেই অংশীদার করা শির্ক। অনুরূপভাবে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো নামে মানত করাও শিরক। প্রয়োজন মেটানো বা বিপদ মুক্তির জন্য আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো কাছে দোয়া করাও শির্ক। কেননা, হাদীসে দোয়াকে ইবাদতরূপে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই যে সকল কার্যকলাপে শিরকের নিদর্শন রয়েছে, সে সব কাজ করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আদী ইবনে হাতেম বলেন- ইসলাম কবুল করার পর আমি আমার গলায় ক্রুশ পরিহিত অবস্থায় রাসূল (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়েছিলাম। এটা দেখে হুযূর (সা) আদেশ করলেন, এ মূর্তিটা গলা হতে ফেলে দাও। আদী ইবনে হাতেম যদিও ক্রুশ সম্পর্কে তখন নাসারাদের ধারণা পোষণ করতেন না, এতদসত্ত্বেও প্রকাশ্যভাবে শিরকের নিদর্শন থেকে বেঁচে থাকা অত্যাবশ্যকীয় বলে রাসূল (সা) তাঁকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন।

আফসোসের বিষয় ! আজকাল হাজার হাজার মুসলমান খৃস্টানদের ধর্মীয় নিদর্শন ক্রুশ-এর বিকল্প নেকটাই সগৌরবে গলায় লাগিয়ে প্রকাশ্য শিরকীতে লিপ্ত হচ্ছে। এমনিভাবে কারো প্রতি রুকু বা সিজদা করা, বায়তুল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর তওয়াফ করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। এসব থেকে বেঁচে থাকার স্বীকারোক্তি এবং আনুগত্যের অঙ্গীকারই إِيَّاكَ نَعْبُدُ এ-তে করা হয়েছে।

দ্বিতীয় মাসআলা: কারো সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ। কেননা, বৈষয়িক সাহায্য তো একজন অপরজনের কাছ থেকে সব সময়ই নিয়ে থাকে। এ ছাড়া দুনিয়ার কাজ-কারবার চলতেই পারে না যথা—প্রস্তুতকারক, দিন-মজুর, নির্মাতা, কর্মকার, কুম্ভকার প্রভৃতি সকল শ্রেণীর কারিগরই অন্যের সাহায্যে নিয়োজিত, অন্যের খেদমতে সর্বদা ব্যস্ত এবং প্রত্যেকেই তাদের সাহায্যপ্রার্থী ও সাহায্য গ্রহণে বাধ্য। এরূপ সাহায্য নেওয়া কোন ধর্মমতেই বা কোন শরীয়তেই নিষেধ নয়। কারণ, এ সাহায্যের সাথে আল্লাহ্ তা'আলার নিকট প্রার্থিত সাহায্য কোন অবস্থাতেই সম্পৃক্ত নয়, অনুরূপভাবে কোন নবী বা ওলীর বরাত দিয়েও আল্লাহ তা'আলার সাহায্য প্রার্থনা করা কোরআনের নির্দেশ ও হাদীসের বর্ণনায় বৈধ প্রমাণিত হয়েছে। এরূপ সাহায্য প্রার্থনাও আল্লাহর সম্পর্কযুক্ত সাহায্য প্রার্থনার অন্তর্ভুক্ত নয়, যা কোরআন ও হাদীসে শিরকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আল্লাহর নিকট বিশেষভাবে প্রার্থিত সাহায্য দু'প্রকার

এক. আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ফেরেশতা, কোন নবী, কোন ওলী বা কোন মানুষকে একক ক্ষমতাশালী বা একক ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মনে করে তাদের নিকট কিছু চাওয়া ইহা প্রকাশ্য কুফরী। একে কাফের-মুশরিকরাও কুফরী বলে মনে করে। তারা নিজেদের দেবীদেরকেও আল্লাহর ন্যায় সর্বশক্তিমান একক ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মনে করে না।

দুই. সাহায্য প্রার্থনার যে পন্থা কাফেরগণ করে থাকে, কোরআন তাকে বাতিল ও শিরক বলে ঘোষণা করেছে। তা হচ্ছে কোন ফেরেশতা, নবী, ওলী বা দেবদেবী সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করা যে, প্রকৃত শক্তি ও ইচ্ছার মালিক তো আল্লাহ্ তা'আলাই, তবে তিনি তাঁর কুদরতে সে ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তির কিছু অংশ অমুককে দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমতা দান করেছেন এবং সে ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন। কোরআনের وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, এরূপ সাহায্য আমরা আল্লাহ্ তা'আলা ব্যতীত অন্য কারো নিকট চাইতে পারি না ।

সাহায্য-সহায়তা সম্পর্কিত এ ধারণা মু’মিন ও কাফের এবং ইসলাম ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। কোরআন একে হারাম ও শিরক ঘোষণা করেছে এবং কাফেরগণ একে সমর্থন করে এ অনুযায়ী আমল করছে। এ ব্যাপারে যেখানে সংশয়ের উদ্ভব হয় তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তাঁর কোন কোন ফেরেশতার উপর পার্থিব ব্যবস্থা পরিচালনার অনেক দায়িত্ব অর্পণ করেছেন বলে বর্ণনা রয়েছে। এরূপ ধারণা সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র নয় যে, ফেরেশতাগণকে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনে আল্লাহ্ নিজেই তা ক্ষমতা দিয়েছেন, তদনুরূপ নবীগণকেও এমন কিছু কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছেন যা অন্য মানুষের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে ; যথাঃ মু’জিযা। অনুরূপ আওলিয়াগণকেও এমন কিছু কাজের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা সাধারণ মানুষ করতে পারে না। যেমন কারামত । সুতরাং স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে এরূপ ধারণায় পতিত হওয়া বিচিত্র নয় যে, আল্লাহ তা’আলা স্বীয় ক্ষমতার কিয়দংশ যদি তাঁদের মধ্যে না-ই দিতেন, তবে তাঁদের দ্বারা এমন সব কাজ কি করে হয়ে থাকে। এতে নবী ও ওলীগণের প্রতি কর্মে স্বাধীন হওয়ার বিশ্বাস জন্মে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বরং মু’জিযা এবং কারামত একমাত্র আল্লাহরই কাজ। এর প্রকাশ নবী ও ওলীগণের মাধ্যমে করে থাকেন শুধু তাঁর হেকমত ও রহস্য বোঝাবার জন্য। নবী ও ওলীগণের পক্ষে সরাসরি এসব কাজ করার ক্ষমতা নেই। এ সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যথা, এরশাদ হয়েছেঃ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى  বদরের যুদ্ধে রাসূল (সা) শত্রু সৈন্যদের প্রতি একমুষ্টি কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন এবং সে কঙ্কর সকল শত্রু সৈন্যের চোখে গিয়ে পড়েছিল। সে মু’জিযা সম্পর্কে এ আয়াতে বলা হয়েছে যে,- “হে মুহাম্মদ (সা)! এ কঙ্কর আপনি নিক্ষেপ করেন নি, বরং আল্লাহ্ তা’আলাই নিক্ষেপ করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, নবীগণের মাধ্যমে মু’জিযারূপে যেসব অস্বাভাবিক কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো ছিল আল্লাহরই কাজ। অনুরূপ, হযরত নূহ (আ)-কে তাঁর জাতি বলেছিল যে, আপনি যদি সত্য নবী হয়ে থাকেন, তবে যে শাস্তি সম্পর্কে আমাদের ভীতি প্রদর্শন করছেন, তা এনে দেখান। তখন তিনি বলেছিলেনঃ إِنَّمَا يَأْتِيكُمْ بِهِ اللَّهُ মু’জিযারূপে আসমানী বালা নিয়ে আসা আমার ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন তবে আসবে, তখন তোমরা তা থেকে পালাতে পারবে না। সূরা ইবরাহীমে নবী ও রাসূলগণের এক দলের কথা উল্লেখিত হয়েছে। তাঁরা বলেছেনঃ وَمَا كَانَ لَنَا أَنْ نَأْتِيَكُمْ بِسُلْطَانٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ  অর্থাৎ—“কোন মু’জিযা দেখানো আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কিছুই হতে পারে না।” তাই কোন নবী বা ওলী কোন মু’জিযা বা কারামত যখন ইচ্ছা বা যা ইচ্ছা দেখাবেন, এমন ক্ষমতা তাদের কাউকেই দেওয়া হয়নি।

রাসূল ও নবীগণকে মুশরিকরা কত রকমের মু'জিযা দেখাতে বলেছে, কিন্তু যেগুলোতে আল্লাহর ইচ্ছা হয়েছে সেগুলোই প্রকাশ পেয়েছে। আর যেগুলোতে আল্লাহর ইচ্ছা হয়নি, সেগুলো প্রকাশ পায়নি। কোরআনের সর্বত্র এ সম্পর্কিত তথ্য বিদ্যমান।

একটি স্কুল উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি উপলব্ধি করা সহজ হবে। যেমন, ঘরে বসে আমরা যে বাল্বের আলো ও বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস পাই, সে বাল্ব ও পাখা এই আলো ও হাওয়া প্রদানের ব্যাপারে নিজস্বভাবে কখনও ক্ষমতার অধিকারী নয়। প্রকৃতপক্ষে তার সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ-কেন্দ্রের সাথে এগুলোর যে সম্পর্ক স্থাপিত, আলো এবং বাতাস প্রদান একান্তভাবে সে সংযোগের উপর নির্ভরশীল। এক মুহূর্তের জন্যও যদি এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় তবে না বাল্ব আপনাকে আলো দিতে পারবে, না পাখা বাতাস দিতে সক্ষম হবে। কেননা এ আলো বাল্বের নয়; বরং বিদ্যুতের, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হতে বাল্ব ও পাখার মধ্যে পৌঁছে থাকে। নবী, রাসূল, আউলিয়া ও ফেরেশতাগণ প্রত্যেকেই প্রতিটি কাজের জন্য প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ্ তা'আলার মুখাপেক্ষী। তাঁর ইচ্ছায়ই বাল্ব ও পাখার মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ন্যায় নবী ও আউলিয়াগণের মাধ্যমে মু'জিযা ও কারামতরূপে আল্লাহর ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়।

এই উদাহরণে এ কথাও বোঝা গেল যে, মু'জিযা ও কারামত প্রতিফলনে নবী-রাসূল ও ওলীগণের কোন একচ্ছত্র ক্ষমতা নেই। তবে তাঁরা যে একেবারেই ক্ষমতাহীন তাও নয়। যেমনিভাবে বাল্ব ও পাখা ব্যতীত আলো ও বাতাস পাওয়া অসম্ভব, তেমনিভাবে মু'জিযা ও কারামত প্রকাশের ব্যাপারে নবী ও ওলীগণের মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, সমস্ত ফিটিং সংযোজন ঠিক হওয়া সত্ত্বেও বাল্ব এবং পাখা ব্যতীত আলো-বাতাস পাওয়া অসম্ভব, কিন্তু মু'জিযা ও কারামতের ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা সব কিছুই করতে পারেন। তবে সাধারণত তিনি নবী-রাসূল ও ওলীগণের মাধ্যম ব্যতীত তা করেন না। কারণ তাতে এগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না ।

তাই এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, সব কিছুই একমাত্র আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে এবং এতদসঙ্গে নবী-রাসূল ও ওলী-আউলিয়াগণের গুরুত্বের বিশেষভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। এ বিশ্বাস এবং স্বীকৃতি ব্যতীত আল্লাহ্র সন্তুষ্টি এবং তাঁর বিধানের অনুসরণ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। যেভাবে কোন ব্যক্তি বাল্ব ও পাখার গুরুত্ব অনুধাবন না করে একে নষ্ট করে দিয়ে আলো-বাতাস পাওয়ার আশা করতে পারে না, তেমনি নবী-রাসূল ওলী-আউলিয়াগণের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি ব্যতীত আল্লাহ্র সন্তুষ্টি আশা করা যায় না ।

সাহায্য প্রার্থনা ও ওসীলা তালাশ করা এবং তা গ্রহণ করার প্রশ্নে নানা প্রকার প্রশ্ন ও সংশয়ের উৎপত্তি হতে দেখা যায়। আশা করা যায় যে, উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা সে সংশয় ও সন্দেহের নিরসন হবে।

নবী-রাসূল এবং ওলীগণকে ওসীলা বানানো সম্পূর্ণ জায়েয বা একেবারেই না-জায়েয বলা সঙ্গত নয়। বরং উপরের আলোচনার ভিত্তিতে এতটুকু বলা যায় যে, যদি কেউ তাঁদেরকে বাস্তব ক্ষমতাবান, স্বীয় শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং হাজত পূরণের অধিকারী মনে করে, তবে তা হারাম এবং শির্ক হবে। কিন্তু যদি তাঁদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি আহরণের মাধ্যম জ্ঞান করে তাঁদের ওসীলা গ্রহণ করা হয়, তবে এটা সম্পূর্ণ বৈধ হবে। কিন্তু এ প্রশ্নে সাধারণত বাড়াবাড়ি
করতে দেখা যায়।

সিরাতে মুস্তাকীমের হেদায়েতই দীন দুনিয়ার সাফল্যের চাবিকাঠি

আলোচ্য তফসীরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা যে দোয়াকে সর্বক্ষণ সকল লোকের সকল কাজের জন্য নির্ধারণ করেছেন তা হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকীমের হেদায়েতপ্রাপ্তির দোয়া। এমনিভাবে আখিরাতের মুক্তি যেমন সে সরল পথে রয়েছে যা মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে, অনুরূপভাবে দুনিয়ার যাবতীয় কাজের উন্নতি-অগ্রগতিও সিরাতুল মুস্তাকীম বা সরল পথের মধ্যে নিহিত। যে সমস্ত পন্থা অবলম্বন করলে উদ্দেশ্য সফল হয়, তাতে পূর্ণ সফলতাও অনিবার্যভাবেই হয়ে থাকে।

   والله أسأل الصواب والسداد وبيده المبداء والمعاد 

যে সব কাজে মানুষ সফলতা লাভ করতে পারে না, তাতে গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, সে কাজের ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতিতে নিশ্চয়ই কোন ভুল হয়েছে।

সারকথা, সরল পথের হেদায়েত কেবল পরকাল বা দীনী জীবনের সাফল্যের জন্যই নির্দিষ্ট নয়, বরং দুনিয়ার সকল কাজের সফলতাও এরই উপর নির্ভরশীল। এজন্যই প্রত্যেক মু'মিনের এ দোয়া তসবীহস্বরূপ সর্বদা স্মরণ রাখা কর্তব্য। তবে মনোযোগ সহকারে স্মরণ রাখতে ও দোয়া করতে হবে; শুধু শব্দের উচ্চারণ যথেষ্ট নয়।
   والله الموفق والمعين .





*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url