সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৭৫ || উহুদ যুদ্ধঃ তীরন্দাজদের ভয়ানক ভুলের জন্য মুসলিম বাহিনীর চরম খেসারত ||




উহুদ যুদ্ধঃ তীরন্দাজদের ভয়ানক ভুলের জন্য মুসলিম বাহিনীর চরম খেসারত

উহুদের যুদ্ধের ময়দানে ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে এবং মুসলিমগণের ক্ষুদ্র বাহিনী যুদ্ধে পূর্ণভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। অবশেষে মুশরিকদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তাদের সারিগুলো ডান, বাম, সম্মুখ ও পিছন দিক হতে ছত্রভঙ্গ হতে থাকে। মুসলিমরা মুশরিকদেরকে তরবারী দ্বারা এমনভাবে কর্তন করতে লাগলেন যে, তারা শিবির থেকেও পালিয়ে গেল এবং নিঃসন্দেহে তাদের পরাজয় ঘটে গেল। তীরন্দাযবাহিনী এতক্ষণ পর্বতমূলে অবস্থান গ্রহণ ক’রে নিজেদের কর্তব্য পালন করে আসছিলেন। কিন্তু আশাতীত এ জয়ের উল্লাসে তাঁরা আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তাঁদেরকে যে কোন অবস্থায় তাঁদের স্থান ত্যাগ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন তা তাঁরা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে গণীমত সংগ্রহের জন্য সমরক্ষেত্রের দিক ছুটে যেতে লাগলেন। ফলে যুদ্ধের চেহারা বদলে গেল। মুসলিমগণ ভীষণভাবে ক্ষতির স্বীকার হলেন, স্বয়ং নবী (ﷺ) আহত হলেন এমন কি তিনি শহীদ হতে হতে বেঁচে গেলেন!!
সিরাতুন নবী (সাঃ) ৭৫-তম পর্ব উহুদ যুদ্ধের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

উহুদে আল্লাহর সিংহ হামযাহ (রাঃ)-এর শাহাদত

হামযাহ (রাঃ)-এর ঘাতকের নাম ছিল ওয়াহশী ইবনু হারব। আমরা তার শাহাদতের ঘটনা ওয়াহশীর নিজের ভাষাতেই বর্ণনা করছি। সে বর্ণনা করেছে, ‘আমি জুবাইর ইবনু মুতইমের গোলাম ছিলাম। তার চাচা তুআইমাহ ইবনু আদী বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। যখন কুরাইশরা উহুদের যুদ্ধে বের হয় তখন জুবাইর ইবনু মুত‘ইম আমাকে বলে, ‘তুমি যদি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর চাচা হামযাহ (রাঃ)-কে আমার চাচার বিনিময়ে হত্যা কর তবে তোমাকে আযাদ করে দেয়া হবে।’ তার এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমিও লোকদের সাথে রওয়ানা হয়ে যাই। আমি ছিলাম একজন হাবশী লোক এবং হাবশীদের মতো বর্শা নিক্ষেপের কাজে আমি খুব পারদর্শী ছিলাম। আমার বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো খুবই কম। লোকদের মধ্যে যুদ্ধ যখন চরমে পৌঁছে তখন আমি বের হয়ে হামযাহ (রাঃ)-কে খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে আমি তাঁকে লোকদের মাঝে দেখতে পাই। তাঁকে ছায়া রং-এর উট বলে মনে হচ্ছিল। তিনি লোকদেরকে ছত্রভঙ্গ করে চলছিলেন।

আল্লাহর শপথ! আমি তাঁকে হত্যা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম এবং একটি বৃক্ষ অথবা একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে আমার নিকটে তাঁর আসার প্রতীক্ষা করছিলাম, ইতোমধ্যে সিবা’ ইবনু আবদিল উযযা আমার আগে গিয়ে তাঁর নিকট পৌঁছে যায়। তিনি তাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিয়ে বলেন, ‘ওরে লজ্জাস্থানের চামড়া কর্তনকারীর পুত্র, মজা দেখ।’ এ কথা বলেই তিনি এত জোরে তাকে তরবারীর আঘাত করেন যে, তার মাথা দেহচ্যুত হয়ে যায়।
এর সাথে সাথেই আমি বর্শা উঠিয়ে নেই এবং যখন তিনি আমার আওতার মধ্যে এসে পড়েন তখন আমি তাঁর দিকে ওটা ছুঁড়ে দেই এবং ওটা তাঁর নাভির নীচে লেগে যায় এবং পদদ্বয়ের মধ্যভাগ দিয়ে পার হয়ে যায়। তিনি আমার দিকে ধাওয়া করার ইচ্ছা করেন, কিন্তু অসমর্থ হন। আমি তাঁকে ঐ অবস্থায় ছেড়ে দেই। শেষ পর্যন্ত তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। এরপর আমি তাঁর মৃত দেহের নিকট গিয়ে বর্শা বের করে দেই এবং সৈন্যদের মধ্যে গিয়ে বসে পড়ি। (আমার কাজ সমাপ্ত হয়েছিল) তিনি ছাড়া আর কারো সাথে আমার কোন সম্বন্ধ ছিল না। আমি শুধু আযাদ হওয়ার জন্যেই তাঁকে হত্যা করেছিলাম। সুতরাং আমি মক্কায় ফিরে গেলে আমাকে আযাদ করে দেয়া হয়।[১]


যুদ্ধের প্রথম দিকে মুসলিমগণের উচ্চে অবস্থান

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সিংহ হামযাহ (রাঃ)-এর শাহাদতের ফলে মুসলিমগণের অপূরণীয় ক্ষতি হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধে মুসলিমগণেরই পাল্লা ভারী থাকে। আবূ বাকর (রাঃ), উমার (রাঃ), আলী (রাঃ), যুবাইর (রাঃ), মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ), ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ), সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ), সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ), সা‘দ ইবনু রাবী (রাঃ), নযর ইবনু আনাস (রাঃ), প্রভৃতি মহান ব্যক্তিবর্গ এমন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন যে, মুশরিকরা হতোদ্যম ও নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে এবং তাদের দেহের শক্তি হ্রাস পায়।


নববধূর আলিঙ্গন ছেড়ে তরবারীর ধারের উপর

এদিকে আর এক দৃশ্য চোখে পড়ে। উপর্যুক্ত আত্মত্যাগীদের মধ্যে আর একজন হচ্ছেন হানযালাতুল গাসীল (রাঃ), যিনি এক অদ্ভূত মাহাত্ম্য নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিন ঐ আবূ আমির রাহিবের পুত্র, যে পরবর্তী কালে ফাসিক নামে প্রসিদ্ধ হয় এবং যার বর্ণনা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। হানযালা (রাঃ) নব বিবাহিত ছিলেন। যখন যুদ্ধে গমনের জন্য ঘোষণা দেয়া হয় তখন তিনি নববধূকে আলিঙ্গন করছিলেন। যুদ্ধের ঘোষণা শোনা মাত্রই তিনি নববধূর বক্ষ ছেড়ে দিয়ে জিহাদের জন্যে বেরিয়ে পড়েন। যখন উহুদ প্রান্তরে ভীষণ যুদ্ধ চলছে তখন তিনি মুশরিকদের সারিগুলো ভেদ করে তাদের সেনাপতি আবূ সুফইয়ান পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন এবং তাকে প্রায় ধরাশায়ী করতেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর ভাগ্যেই শাহাদত লিখে রেখেছিলেন। তাই যেমনই তিনি আবূ সুফইয়ানকে লক্ষ্য করে তরবারী উঁচু করে ধরেছেন, তেমনই শাদ্দাদ ইবনু আউস তাঁকে দেখে ফেলে এবং তৎক্ষণাৎ তাঁকে আক্রমণ করে। ফলে তিনি নিজেই শহীদ হয়ে গেলেন।


তীরন্দাযদের কার্যকলাপ

জাবালে রুমতের উপর যে তীরন্দাযদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মোতায়েন করেছিলেন তাঁরাও যুদ্ধের গতি মুসলিমগণের অনুকূলে আনবার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মক্কার ঘোড়সওয়াররা খালিদ ইবনু ওয়ালীদের নেতৃত্বে এবং আবূ আমির ফাসিকের সহায়তায় মুসলিম সৈনিকদের বাম বাহু ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে তিন বার ভীষণ আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুসলিম তীরন্দাযগণ তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাদেরকে এমনভাবে ঘায়েল করে দেন যে তাদের তিনটি আক্রমণই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।[২]


মুশরিকদের পরাজয়

কিছুক্ষণ ধরে এরূপ ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে এবং মুসলিমগণের ক্ষুদ্র বাহিনী যুদ্ধে পূর্ণভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। অবশেষে মুশরিকদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তাদের সারিগুলো ডান, বাম, সম্মুখ ও পিছন দিক হতে ছত্রভঙ্গ হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন তিন হাজার মুশরিককে সাতশ নয়, বরং ত্রিশ হাজার মুসলিমগণের সাথে মোকাবালা করতে হচ্ছে। আর এদিকে মুসলিমরা ঈমান, বিশ্বাস এবং বীরত্বের অত্যন্ত উঁচুমানের মনোবল নিয়ে তরবারী চালনা করছিলেন।

কুরাইশরা যখন মুসলিমগণের একাধিকবার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও অক্ষমতা অনুভব করল এবং তাদের মনোবল এমনভাবে ভেঙ্গে পড়ল যে, সওয়াবের হত্যার পর কারো সাহস হল না যে, যুদ্ধ চালু রাখার জন্যে তাদের ভূপতিত পতাকার নিকটবর্তী হয়ে ওটাকে উঁচু করে ধরে, তখন তারা পালিয়ে যাবার পন্থা অবলম্বন করল এবং মুসলিমগণের উপর হতে প্রতিশোধ গ্রহণের কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেল।

ইবনু ইসহাক্ব বলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণের উপর স্বীয় সাহায্য নাযিল করেন এবং তাঁদের সাথে কৃত ওয়াদা পুর্ণ করেন। মুসলিমরা মুশরিকদেরকে তরবারী দ্বারা এমনভাবে কর্তন করতে লাগলেন যে, তারা শিবির থেকেও পালিয়ে গেল এবং নিঃসন্দেহে তাদের পরাজয় ঘটে গেল।

আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর পিতা বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ আমি দেখি যে, হিন্দা বিনতু ‘উতবাহ এবং তার সঙ্গিনীদের পদনালী দেখা যাচ্ছে। তারা কাপড় উপরে উঠিয়ে নিয়ে পলায়ন করছে। তাদের গ্রেফতারীতে কম বেশী কোনই প্রতিবন্ধকতা ছিল না।[৩]
সহীহুল বুখারীতে বারা‘ ইবনু আ’যিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘মুশরিকদের সাথে আমাদের মোকাবালা হলে তাদের মধ্যে পলায়নের হিড়িক পড়ে যায়, এমনকি আমি নারীদেরকে দেখি যে, তারা পায়ের গোছা হতে কাপড় উঠিয়ে নিয়ে দ্রুত বেগে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পায়ের অলংকার দেখা যাচ্ছিল।’[৪]

আর এ সুযোগে মুসলিমরা মুশরিকদের উপর তরবারী চালাতে চালাতে ও তাদের পরিত্যক্ত মাল জমা করতে করতে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করছিলেন।’


তীরন্দাযদের ভয়ানক ভুল

তীরন্দাযবাহিনী এতক্ষণ পর্বতমূলে অবস্থান গ্রহণ ক’রে নিজেদের কর্তব্য পালন করে আসছিলেন। কিন্তু এ আশাতীত জয়ের উল্লাসে এখন তাঁরা আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তাঁদেরকে যে কোন অবস্থায় তাঁদের স্থান ত্যাগ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন তা তাঁরা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে গণীমত সংগ্রহের জন্য সমরক্ষেত্রের দিক ছুটে যেতে লাগলেন। সে জন্য যুদ্ধের চেহারা বদলে গেল। মুসলিমগণ ভীষণভাবে ক্ষতির স্বীকার হলেন, স্বয়ং নাবী (ﷺ) শহীদ হতে বেঁচে গেলেন!! আর এ কারণেই মুসলিম ভীতি যেটা বদর যুদ্ধের পরিণামে মুশরিকদের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছিল সেটা অনেকটা দূরভীত হতে লাগল। তার মূল কারণ হচ্ছে দুনিয়া প্রীতি, গণীমতের মালের লোভ। সুতরাং সে সময় তারা এক অপরকে বলছিল, গণীমত.......! গণীমত.......! তোমাদের সঙ্গীগণ জিতে গেছেন........ আর অপেক্ষা কিসের? তাঁদের নায়ক আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাঃ) তাঁদেরকে নিবারিত করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। তিনি তাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কঠোর নিষেধের কথা স্মরণ করে দিলেন। কিন্তু তাঁর অধীনস্থ সৈনিকগণ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলতে লাগলেন, ‘এখন আমাদের সম্পূর্ণ জয় হয়েছে, সুতরাং এখন আর এখানে বসে থাকব কিসের জন্য?’[৫] এ কথা বলে তাঁদের অধিকাংশ সৈনিকই স্থান ত্যাগ করে ময়দানের দিকে ছুটে গেলেন। আব্দুল্লাহ (রাঃ) মাত্র নয়জন লোককে নিয়ে ঐ স্থানে বসে রইলেন। যারা নিজ দায়িত্ব পালনে অটল থাকলেন যে, হয় তাঁদের প্রস্থানের অনুমতি দেওয়া হবে অন্যথা তাঁরা আমৃত্যু সেখানে অবস্থান করবেন।


মুসলিম সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদের কৌশল নির্ধারণ

এরূপ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কঠোর আদেশ এবং সেনাপতির নিষেধ অমান্য করার ফলও ফলতে শুরু হল। আরবের বিখ্যাত বীর এবং রণকুশলী সেনাপতি খালিদ ইবনু ওয়ালীদ ঘোড়সওয়ার সেনাদল নিয়ে চারদিকে চক্রাকারে সুযোগের সন্ধান করে বেড়াচ্ছিল। সে আর কালবিলম্ব না করে সেই অরক্ষিত পথের দিকে নক্ষত্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল এবং দেখতে দেখতে পশ্চাদদিক দিয়ে মুসলিমগণের মাথার উপর এসে উপস্থিত হ’ল। শ্রেষ্ঠবীর আব্দুল্লাহ তাঁর সহচর কয়েকজনকে নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশ পালন করে চললেন। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে তাঁরা সবাই শাহাদত বরণ করলেন। এদিকে মুসলিম সৈন্যরা নির্ভাবনায় গণীমতের মাল সংগ্রহ করতে ব্যাপৃত আছেন। এমন সময় প্রথমে খালিদের ঘোড়সওয়ার সেনাদল এবং তার পর অন্যান্য ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক সেনাদল অতর্কিত অবস্থায় তাদেরকে ভীষণভাবে আক্রমণ করল এবং সতর্ক হবার আগেই বহু মুসলিমকে কুরাইশদের হাতে নিহত হতে হল। কুরাইশদের জাতীয় পতাকা এতক্ষণ মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল। খালিদের এ আক্রমণ এবং মুসলিমগণের উপস্থিত সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে আমরাহ বিনতু আলকামা নামে জনৈকা কুরাইশ বীরাঙ্গনা আবার তা তুলে ধরল। সম্পূর্ণ পরাজয়ের পর ভূলুণ্ঠিত জাতীয় পতাকাকে পুনরায় যুদ্ধ ক্ষেত্রে উড্ডীয়মান হতে দেখে ছুটে বিক্ষিপ্ত ও পলায়নপর কুরাইশ সৈন্যগণ আবার সেই পতাকার দিকে ছুটে আসল এবং তারা আবার দলবদ্ধভাবে মুসলিমগণকে আক্রমণ করল। এবার মুসলিমরা অগ্রপশ্চাৎ দু’ দিক হতে আক্রান্ত হয়ে যাঁতার মধ্যস্থলে পড়লে যে অবস্থা হয় তাই হল।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিপদসংকুল ফায়সালা এবং বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাত্র নয়জন[৬] সাহাবীসহ পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন[৭] এবং মুসলিমগণের শৌর্যবীর্য ও মুশরিকদের শোচনীয় অবস্থার দৃশ্য অবলোকন করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ খালিদ ইবনু ওয়ালীদের ঘোড়সওয়ার সৈন্যগণ তাঁর দৃষ্টি গোচর হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে দু’টি পথ ছিল। আর তা হচ্ছে, হয় তিনি তাঁর নয় জন সহচরসহ দ্রুত গতিতে পলায়ন করে কোন এক সুরক্ষিত স্থানে চলে যেতেন এবং স্বীয় সেনা বাহিনীকে যারা ভিড়ের মধ্যে পড়ে যেতে চাচ্ছিলেন, তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতেন, নয়তো নিজের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে স্বীয় সাহাবীদেরকে ডাক দিতেন এবং এক নির্ভরযোগ্য সংখ্যক সাহাবাকে নিজের কাছে একত্রিত করে তাদের মাধ্যমে অবরোধ ভেঙ্গে দিয়ে নিজের সেনাবাহিনীর জন্যে উহুদ পাহাড়ের উপরিভাগের দিকে চলে যাওয়ার পথ করে দিতেন। এ চরম সংকটময় মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তুলনাবিহীন বীরত্ব প্রকাশিত হয়েছে। কেননা তিনি নিজের জীবন রক্ষা করে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নিজের জীবনকে বিপদের মুখে নিক্ষেপ করে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর জীবন রক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

তাই তো তিনি খালিদ ইবনু ওয়ালীদের ঘোড়সওয়ার সৈন্যদেরকে দেখা মাত্রই উচ্চেঃস্বরে স্বীয় সাহাবীদেরকে ডাক দেন, ‘ওরে আল্লাহর বান্দারা এদিকে..........।’ অথচ তিনি জানতেন যে, তাঁর ঐ শব্দ মুসলিমগণের পূর্বে মুশরিকদেরই কানে পৌঁছবে। আর হলোও তাই। যেমন দেখা গেল যে, তাঁর ঐ আওয়াজ শুনে মুশরিকরা অবগত হল যে, এ মুহূর্তে তাঁর অবস্থান কোথায় রয়েছে। যার ফলে তাদের একটি বাহিনী মুসলিমগণের পূর্বেই তাঁর নিকটে এসে পড়ে এবং বাকী ঘোড়সওয়াররা দ্রুততার সাথে মুসলিমগণকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। এখন দুটি ভিড়ের বিস্তারিত বিবরণ পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করছি।


মুসলিমগণের মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ততা

যখন মুসলিমরা ভিড়ের মধ্যে এসে পড়েন তখন একটি দল তো জ্ঞানই হারিয়ে ফেলে। তাদের শুধু নিজেদের জীবনের চিন্তা ছিল। সুতরাং তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে দিয়ে পলায়নের পথ ধরল। পিছনে কী ঘটছে তার কোন খবরই তাদের ছিল না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো পালিয়ে গিয়ে মদীনায় ঢুকে পড়ে এবং কিছু লোক পাহাড়ের উপর উঠে পড়ে। আর একটি দল পিছনে ফিরল তারা মুশরিকদের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়। একে অপরকে চিনতে অসমর্থ হয়। এর ফলে মুসলিমগণেরই হাতে কোন কোন মুসলিম নিহত হয়। যেমন সহীহুল বুখারীতে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, উহুদ যুদ্ধের দিন (প্রথমে) মুশরিকরা পরাজিত হয়। এরপর ইবলীস (সাধারণভাবে) ডাক দিয়ে বলে, ‘ওরে আল্লাহর বান্দারা পিছনে (অর্থাৎ পিছন দিক হতে আক্রমণ কর)।’ তার এ কথায় সামনের সারির সৈন্যরা পিছন দিকে ফিরে আসে এবং পিছনের সারির সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হুযাইফা (রাঃ) দেখেন যে, তাঁর পিতা ইয়ামানের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। তিনি তখন বলে ওঠেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! ইনি যে আমার পিতা।’ কিন্তু আল্লাহর শপথ! (মুসলিম) সৈন্যগণ আক্রমণ হতে বিরত হলেন না। শেষ পর্যন্ত আমার পিতা নিহতই হয়ে গেলেন। হুযাইফা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ আপনাদেরকে ক্ষমা করুন।’ উরওয়া (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! হুযাইফা (রাঃ)-এর মধ্যে সদা-সর্বদা কল্যাণ বিরাজমান ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহ তা‘আলার সাথে মিলিত হন।’[৮]
মোট কথা, এ দলের সারিতে কঠিন বিক্ষিপ্ততা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। বহু লোক চিন্তান্বিত ও পেরেশান ছিলেন। তাঁরা কোন্ দিকে যাবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় কোন ঘোষণাকারীর ঘোষণা শোনা গেল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন। এ ঘোষণা শুনে তারা জ্ঞান হারা হয়ে গেলেন। অধিকাংশ লোকেরই সাহস ও উদ্যম নষ্ট হয়ে গেল। কেউ কেউ যুদ্ধ বন্ধ করে দিল এবং দুঃখিত হয়ে অস্ত্র শস্ত্র ফেলে দিয়ে কেউ কেউ এ চিন্তাও করল যে, মুনাফিক্বদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই-এর সাথে মিলিত হয়ে তাকে বলা হোক যে, সে যেন আবূ সুফইয়ানের নিকট তাদের জন্যে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে।

কিছুক্ষণ পর ঐ লোকদের পাশ দিয়ে আনাস ইবনু নাযর (রাঃ) গমন করেন। তিনি দেখেন যে, তারা হাতের উপর হাত ধরে পড়ে আছে। তাদেরকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কিসের অপেক্ষা করছ?’ তাঁরা উত্তরে বলল, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিহত হয়েছেন।’ তাদের এ কথা শুনে আনাস ইবনু নাযর (রাঃ) তাদেরকে বললেন, ‘তাহলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যুর পর তোমরা জীবিত থেকে কী করবে? উঠো, যার উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবন দিয়েছেন তার উপর তোমরাও জীবন দিয়ে দাও।’ এরপর তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! ঐ লোকগুলো অর্থাৎ মুসলিমরা যা কিছু করেছে সে জন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আর ওরা অর্থাৎ মুশরিকরা যা কিছু করেছে তার সাথে আমার সম্পর্কচ্ছেদ করছি।’ এ কথা বলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হলেন। সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর সাথে দেখা হলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হে আবূ উমার (রাঃ)! কোথায় যাচ্ছেন?’ আনাস (রাঃ) উত্তরে বলেন, ‘জান্নাতের সুগন্ধি সম্পর্কে আর কী বলব! হে সা‘দ (রাঃ)! আমি ওর সুগন্ধ অনুভব করছি।’ এরপর তিনি সামনের দিকে গেলেন এবং মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। যুদ্ধ শেষে তাঁকে চেনা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাঁর ভগ্নী শুধু তাঁর আঙ্গুলগুলোর পোর দেখে তাঁকে চিনতে পারেন। তাঁকে বর্শা, তরবারী এবং তীরের আশিটিরও বেশী আঘাত লেগেছিল।[৯]

অনুরূপ সাবিত ইবনু দাহ্দাহ (রাঃ) স্বীয় কওমকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়ে থাকেন তবে জেনে রেখ যে, আল্লাহ জীবিত রয়েছেন। তিনি মরতে পারেন না। তোমরা তোমাদের দ্বীনের জন্যে যুদ্ধ করে যাও। আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য ও বিজয় দান করবেন।’ তার এ কথা শুনে আনসারের একটি দল উঠে পড়েন এবং সা’বিত (রাঃ) তাদের সহায়তায় খালিদের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর উপর হামলা করেন এবং যুদ্ধ করতে করতে খালিদের বর্শার আঘাতে শহীদ হয়ে যান। তার মতো তার সঙ্গীরাও যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত লাভ করেন।’[১০]

একজন মুহাজির সাহাবী একজন আনসারী সাহাবীর পাশ দিয়ে গমন করেন। যিনি রক্ত রঞ্জিত ছিলেন। মুহাজির তাঁকে বলেন, ‘হে অমুক ভাই! আপনি তো অবগত হয়েছেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন।’ তখন ঐ আনসারী বললেন, ‘যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়ে থাকেন তবে জেনে রাখুন যে, তিনি আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। এখন আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে ঐ দ্বীনের হিফাযতের জন্যে যুদ্ধ করা।’[১১]

এরূপ সাহস ও উদ্যম বৃদ্ধিকারী কথায় মুসলিম সৈন্যদের উদ্যম বহাল হয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞান ও চেতনা জাগ্রত হয়। সুতরাং তাঁরা তখন অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দেয়া অথবা ইবনু উবাই এর সাথে মিলিত হয়ে নিরাপত্তা প্রার্থনার চিন্তার পরিবর্তে অস্ত্রশস্ত্র উঠিয়ে নেন এবং মুশরিকদের সাথে মোকাবালা করে তাঁদের অবরোধ ভেঙ্গে দেন ও তাঁদের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে নেয়ার চেষ্টায় রত হয়ে যান।
এ সময়েই তাঁরা এটাও অবগত হন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিহত হওয়ার সংবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এর ফলে তাঁদের শক্তি আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তাঁদের উদ্যম ও উদ্দীপনায় নাবীনতা এসে যায়। সুতরাং তারা এক কঠিন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অবরোধ ভেঙ্গে দিয়ে ভিড় হতে বের হতে এবং এক মজবুত কেন্দ্রের চতুর্দিকে একত্রিত হতে সফলকাম হন।

মুসলিম সেনাবাহিনীর তৃতীয় একটি দলের লোক ছিলেন তারা, যারা শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্পর্কেই চিন্তা করছিলেন। এরা এ ব্যবস্থাপনার কথা অবহিত হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে ফিরে আসেন। এদের মধ্যে অগ্রভাগে ছিলেন আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ), উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এবং আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ) প্রভৃতি মহান ব্যক্তিবর্গ। এরা যোদ্ধাদের প্রথম সারিতেও সকলের অগ্রগামী ছিলেন। কিন্তু যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর মহান ব্যক্তিত্বের জন্যে বিপদের আশংকা দেখা দিল, তখন তাঁর হিফাযত ও প্রতিরোধকারীদের মধ্যেও তাঁরা সকলের অগ্রগামী হন।

তথ্যসূত্রঃ
[১] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬৯-৭২ পৃ.। সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮৩ পৃ.। ওয়াহশী ত্বায়িফের যুদ্ধের পর ইসলাম গ্রহণ করে এবং আবূ বকর (রাঃ)-এর খিলাফত কালে তার ঐ বর্শা দিয়েই ইয়ামামার যুদ্ধে মুসাইলামা কায্যাবকে (মিথ্যুককে) হত্যা করে। রোমকদের বিরুদ্ধে ইয়ারমুকের যুদ্ধেও সে শরীক হয়।
[২] ফাতহুল বারি ৭ম খন্ড ৩৪৬ পৃঃ।
[৩] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৭৭ পৃঃ।
[৪] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৯ পৃঃ।
[৫] এ কথা সহীহুল বুখারীতে বারা’ ইবনু আযের কর্তৃক বর্ণিত আছে ১/৪২৬ পৃঃ।
[৬] সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ডের ১০৭ পৃঃ। বর্ণিত হয়েছে যে, উহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শুধুমাত্র ৭ জন আনসার ও ২ জন কুরাইশী সাহাবীর মাঝে রয়ে গিয়েছিলেন।
[৭] এর দলীল আললাহ পাকের এ এরশাদ {وَالرَّسُولُ يَدْعُوكُمْ فِي أُخْرَاكُمْ } (১৫৩) سورة آل عمران ‘এবং রাসূল (সাঃ) তোমাদেরকে তোমাদের পিছন হতে আহবান করছিলেন।’’
[৮] সহীহুল বুখারী ১/৫৩৯, ২/৫৮১ ফাতহুলবারী ৭/৩৫১, ৩৬২, ৩৬৩ পৃঃ, বুখারী ছাড়া অন্য বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর দীয়াত দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু হুযায়ফা (রাঃ) বলেন যে, আমি তাঁর দীয়াত মুসলিম জাতিকে সদকা করে দিলাম। এ কারণে নাবী (সাঃ)-এর নিকটে হুযায়ফা (রাঃ)-এর মঙ্গল বৃদ্ধি পায়। মুখতাসারুস সীরাহ, শায়খ আব্দুল্লাহ ২৪৬ পৃঃ।
[৯] যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯৩ ও ৯৬ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৯ পৃঃ।
[১০] আস্সীরাতুল হালাবিয়াহ ২য় খন্ড ২২ পৃঃ।
[১১] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ৯৬ পৃঃ।




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url