মা’আরেফুল কোরআন-৯ || সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াতঃ ১-৫ || ১-৫ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াতঃ ১-৫


بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

المن ذلِكَ الْكِتَبُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ ) الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَ مِمَّا رَزَقْنهُمْ يُنْفِقُونَ ) وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا اُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ في أُولَبِكَ عَلَى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُولَبِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ )

সূরা আল-বাকারাহ্, ১-৫ আয়াতের অর্থ

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ্র নামে শুরু করছি।
(১) আলিফ লাম মীম। (২) এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য; (৩) যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে (৪) এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের উপর, যা কিছু আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের উপর যা আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে! আর আখেরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে। (৫) তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।

সূরা বাকারাহ’র ১-৫ আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

এ কিতাব আল্লাহপ্রদত্ত (এতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। কোন অর্বাচীন যদি এ বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহের অবতারণা করে তাতে কিছু যায় আসে না। কেননা, কোন স্বতঃস্ফূর্ত সত্যের প্রতি কেউ সন্দেহের অবতারণা করলেও সে সত্য বিষয়ে কোন তারতম্য ঘটে না, বরং সত্য সত্যই থাকে।) যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে, এ কিভাব তাদের জন্য পথপ্রদর্শক। (অর্থাৎ যেসব বিষয় জ্ঞান ও পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির ঊর্ধ্বে সে সব বিষয়কে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে যারা সত্য বলে গ্রহণ করে) এবং নামায কায়েম করে (নামায কায়েম করার অর্থ হচ্ছে যে, নামায সময়মত এর শর্ত ও আরকান-আহকাম যথারীতি পালন করে আদায় করা) এবং আমি যা কিছু দান করেছি তা থেকে সৎপথে ব্যয় করে। আর ঐ সমস্ত লোক এমন যারা বিশ্বাস করে আপনার প্রতি অবতীর্ণ কিতাব এবং আপনার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে, (অর্থাৎ কোরআনের প্রতি তাদের যেরূপ ঈমান রয়েছে, তেমনি পূর্ববর্তী নবীগণের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবসমূহেও ঈমান রয়েছে। কোন বিষয় সত্য বলে জানার নাম ঈমান। আমল করা অন্য কথা। আল্লাহ্ তা'আলা পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করার পূর্বে যে সমস্ত আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সেগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করা ফরয এবং ঈমানের শর্ত। অর্থাৎ এরূপ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে, ঐ সমস্ত কিতাব আল্লাহ্ তা'আলা নাযিল করেছিলেন এবং সেসব কিতাবও সহীহ। স্বার্থান্বেষী লোকেরা ঐগুলোতে যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছে, সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস নয়। কিন্তু আমল করতে হবে কোরআন অনুযায়ী ; পূর্ববর্তী কিতাবগুলো মনসুখ বা রহিত বলে গণ্য হবে। (সেগুলো অনুযায়ী আমল করা জায়েয হবে না।) এবং তারা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। এই সমস্ত লোক আল্লাহ্র দেয়া সত্যপথের উপর রয়েছে এবং এই সমস্ত লোকই পরিপূর্ণ মাত্রায় সফলকাম। (এ সমস্ত লোক পার্থিব জীবনে সত্যপথের মত বড় নিয়ামতপ্রাপ্ত এবং পরকালেও তারা সকল প্রকার কামিয়াবী লাভ করবে।)


শব্দ বিশ্লেষণঃ ذٰلِکَ এ শব্দটি দূরবর্তী কোন বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। رَیۡبَ সন্দেহ । هُدًی হেদায়েত। مُتَّقِیۡنَ যাদের মধ্যে ধর্মভীরুতা বা তাকওয়া ও পরহ্যে- পারীর গুণাবলী বিদ্যমান, তাদেরকে মুত্তাকীন বলা হয়। তাক্কওয়া শব্দের অর্থ বিরত থাকা । এ স্থলে এর অর্থ হবেঃ আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা। অদৃশ্য। غَیۡبِ অর্থাৎ মানুষের দৃষ্টির অগোচরে এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতির ঊর্ধ্বে। یُقِیۡمُوۡنَ শব্দটি ‘আক্কমাত’ শব্দ হতে গঠিত; যার অর্থ হচ্ছে, কোন বন্ধুকে সোজা করা। নামায সোজা করার অর্থ হচ্ছে, একাগ্রচিত্তে আদায় করা। رَزَقۡنٰهُمۡ  শব্দটি رزق হতে উদ্ভূত। অর্থ জীবিকা নির্বাহের উপকরণ দান করা । یُنۡفِقُوۡنَ শব্দটি انفلق হতে উদ্ভূত। অর্থ ব্যয় করা। اٰخِرَۃِ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে শেষ বা পরে সংঘটিত হবে এমন সব বিষয়। এ স্থলে ইহকালের বিপরীত পরকাল। یُوۡقِنُوۡنَ শব্দটি   اٰیقلن হতে উদ্ভূত। ইয়াকীন অর্থ হচ্ছে--যাতে সন্দেহ-সংশয়ের কোন অবকাশ না থাকে। مُفۡلِحُوۡنَ শব্দটির পূর্ণ অর্থ সফলতা।


আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

হরফে মুকাত্তা'আতের বিশদ আলোচনা

অনেকগুলো সূরার প্রারম্ভে কতকগুলো বিচ্ছিন্ন বর্ণ দ্বারা গঠিত এক-একটা বাক্য উল্লেখিত হয়েছে। যথা-  المصا  لم   حم   এগুলোকে কোরআনের পরিভাষায় 'হরফে মুকাত্তা'আত' বলা হয়। এ অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথকভাবে সাকিন পড়া হয়। যথাঃ (আলিফ-লাম-মীম)।

কোন কোন তফসীরকারক এ হরফগুলোকে সংশ্লিষ্ট সূরার নাম বলে অভিহিত করেছেন । আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এগুলো আল্লাহ্র নামের তত্ত্ব বিশেষ।

অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী এবং ওলামার মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত মত হচ্ছে যে, হরফে মুকাত্তা'আতগুলো এমন রহস্যপূর্ণ যার মর্ম ও মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলাই জানেন। অন্য কাউকে এ বিষয়ে জ্ঞান দান করা হয়নি। হয়তো রাসূল (সা)-কে এগুলোর নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অবগত করানো হয়েছিল, কিন্তু উম্মতের মধ্যে এর প্রচার ও প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। ফলে এ শব্দসমূহের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য সম্পর্কে নবী করীম (সা) থেকে কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। ইমাম কুরতুবী এ মতবাদ গ্রহণ করেছেন। তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে--আমের, শা'বী সুফিয়ান সওরী এবং একদল মুহাদ্দিস বলেছেন যে, প্রত্যেক আসমানী কিতাবের এক-একটি বিশেষ ভেদ বা নিগূঢ় তত্ত্ব রয়েছে। আর 'হরফে মুকাত্তা'আত' পবিত্র কোরআনের সে নিগূঢ় তত্ত্ব ও ভেদ। যার অর্থ আল্লাহ্ তা'আলাই জানেন। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষে কোন বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়া বা মন্তব্য করা সমীচীন নয়। এগুলোর মধ্যে আমাদের জন্য মহা উপকার নিহিত রয়েছে। এগুলোতে বিশ্বাস করা ও এগুলোর তেলাওয়াত করা বিশেষ সওয়াবের কাজ। এর তেলাওয়াত আমাদের অজ্ঞাতসারেই আমাদের জন্য গোপনীয় বরকত পৌঁছাতে থাকে।

এ প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী আরো লিখেছেন : হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা), হযরত উমর (রা), হযরত উসমান গনী (রা), হযরত আলী (রা), হযরত ইবনে মসউদ (রা) প্রমুখ সাহাবী এ সম্বন্ধে অভিমত পোষণ করেন যে, এগুলো আল্লাহ্ তা'আলার রহস্যজনিত বিষয় এবং তাঁর পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ। এ বিশ্বাস রেখে এগুলোর তেলাওয়াত করতে হবে; কিন্তু এগুলোর রহস্য উদ্ধারের ব্যাপারে এবং তত্ত্ব সংগ্রহে আমাদের ব্যস্ত হওয়া উচিত হবে না ।

ইবনে কাসীরও কুরতুবীর বরাত দিয়ে এ মন্তব্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কোন কোন আলিম এ শব্দগুলোর যে অর্থ বর্ণনা করেছেন, সেগুলোকে ভুল প্রতিপন্ন করাও উচিত হবে না। কেননা, তাঁরা উপমাস্থলে এবং এগুলোকে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যেই এসব অর্থ বর্ণনা করেছেন। যেমন, ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚۖۛ فِیۡهِ সাধারণত ذٰلِکَ কোন দূরবর্তী বস্তুকে ইশারা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। الۡکِتٰبُ দ্বারা কোরআন মজীদকে বোঝানো হয়েছে। رَیۡبَ অর্থ সন্দেহ-সংশয় । আয়াতের অর্থ হচ্ছে--ইহা এমন এক কিতাব যাতে সন্দেহ-সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। ইহা বাহ্যত দূরবর্তী ইশারার স্কুল নয়। কারণ, এ ইশারা কোরআন শরীফের প্রতিই করা হয়েছে, যা মানুষের সামনেই রয়েছে। কিন্তু দূরবর্তী ইশারার শব্দ ব্যবহার করে একথাই বোঝানো হয়েছে যে, সূরাতুল-ফাতিহাতে যে সিরাতুল মুস্তাকীমের প্রার্থনা করা হয়েছিল, সমগ্র কোরআন শরীফ সে প্রার্থনারই প্রত্যুত্তর। ইহা সিরাতুল মুস্তাকীমের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও বটে। অর্থ হচ্ছে--আমি তোমাদের প্রার্থনা শুনেছি এবং হেদায়েতের উজ্জ্বল সূর্যসদৃশ পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছি। যে ব্যক্তি হেদায়েত লাভে ইচ্ছুক সে যেন এ কিতাব অধ্যয়ন ও অনুধাবন করে এবং তদনুযায়ী আমল করে।

এতদসঙ্গে এ কথাও বলে দেওয়া হচ্ছে যে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কোন কালামে বা বক্তব্যে সন্দেহ ও সংশয় দু'কারণে হতে পারে। কারো বুদ্ধিমত্তার স্বল্পতার দরুন সন্দেহ উপস্থিত হতে পারে, যার উল্লেখ কয়েক আয়াত পরেই খোদ কোরআন শরীফে রয়েছে। যেমন, اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ - যদি তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ কর। (অতএব, বুদ্ধির স্বল্পতাহেতু কারো মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এরূপ বলা ন্যায়সঙ্গত যে, এ কিতাবে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই)।

هُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ -যারা আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করে—তাদের জন্য হেদায়েত। অর্থাৎ যে বিশেষ হেদায়েত পরকালের মুক্তির উপায়, তা কেবল মুত্তাকীদেরই প্রাপ্য। অবশ্য কোরআনের হেদায়েত মানবজাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমস্ত বিশ্বচরাচরের জন্য ব্যাপক। সুরাতুল- ফাতিহার তফসীরে বর্ণনা করা হয়েছে যে, হেদায়েতের তিনটি স্তর রয়েছে। এক. সমগ্র মানবজাতি, প্রাণিজগৎ তথা সমগ্র সৃষ্টির জন্যই ব্যাপৃত। দুই. মুসলমানদের জন্য খাস । তিন যারা আল্লাহ তা'আলার বিশেষ নৈকট্য লাভ করেছে, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত; তথাপি হেদায়েতের স্তরের কোন সীমারেখা নেই।

কোরআনের বিভিন্ন স্থানের কোথাও 'আম' বা সাধারণ এবং কোথাও বিশেষ হেদায়েতের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এখানে বিশেষ বা সুনির্দিষ্ট হেদায়েতের কথা বলা হয়েছে। এজন্যই হেদায়েতের সঙ্গে মুত্তাকীগণকে বিশেষভাবে যুক্ত করা হয়েছে বলেই এরূপ সংশয় প্রকাশ করা সমীচীন হবে না। হেদায়েতের বেশি প্রয়োজন তো ঐ সমস্ত লোকেরই ছিল, যারা মুত্তাকী নয়। কেননা, ইতিমধ্যে হেদায়েতের স্তর বিন্যাস করে এসব সংশয়ের অবসান করে দেওয়া হয়েছে। তাই এখন আর একথা বলা ঠিক নয় যে, কোরআন শুধু মুত্তাকীদের জন্যই হেদায়েত বা পথপ্রদর্শক, অন্যের জন্য নয় ।

মুত্তাকীগণের গুণাবলী

পরবর্তী দু'টি আয়াতে মুত্তাকীগণের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। যারা হেদায়েতপ্রাপ্ত, তাদের পথই হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকীম। যারা সরল-সঠিক পুণ্যপন্থা লাভ করতে চায়, তাদের উচিত ঐ দলে শরীক হয়ে তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা এবং ঐ সকল লোকের স্বভাব-চরিত্র, আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে স্বীয় জীবনের পাথেয়রূপে গ্রহণ করা। আর এজন্যই মুত্তাকীগণের বিশেষ গুণাবলীর সঙ্গে সঙ্গে এরশাদ হচ্ছেঃ

أولئِكَ عَلَى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِم وأولئكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ .

অর্থাৎ 'তারাই আল্লাহপ্রদত্ত সৎপথপ্রাপ্ত এবং তারাই পূর্ণ সফলকাম।' পূর্বোক্ত দু'টি আয়াত দ্বারা মুত্তাকীদের গুণাবলীর বর্ণনার মধ্যে ঈমানের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, এর মূলনীতিগুলো এবং তৎসঙ্গে সৎকর্মের মূলনীতিগুলোও স্থান পেয়েছে। তাই ঐ সমস্ত গুণের বিশ্লেষণ পরবর্তী
আয়াতে দেওয়া হয়েছে।

وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ

অর্থাৎ আল্লাহকে যারা ভয় করে, তারা এমন লোক যে, অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বীয় জীবিকা থেকে সৎপথে ব্যয় করে।

আলোচ্য আয়াতে মুত্তাকীদের তিনটি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা, নামায প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বীয় জীবিকা হতে সৎপথে ব্যয় করা। উপরিউক্ত আলোচনার মধ্যে বেশ কতকগুলো জরুরী বিষয় সংযুক্ত হয়েছে। সেগুলোর কিছুটা বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

প্রথম বিষয়: 

ঈমানের সংজ্ঞা

ঈমানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে দু'টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ ঈমান এবং গায়েব। শব্দ দু'টির অর্থ যথাযথভাবে অনুধাবন করলেই ঈমানের পুরোপুরি তাৎপর্য ও সংজ্ঞা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হবে।

ঈমান' শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কারো কথাকে তার বিশ্বস্ততার নিরিখে মনে-প্রাণে মেনে নেওয়া। এজন্যই অনুভূতিগ্রাহ্য ও দৃশ্যমান কোন বস্তুতে কারো কথায় বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয় যে, কোন ব্যক্তি যদি এক টুকরা সাদা কাপড়কে সাদা এবং এক টুকরা কালো কাপড়কে কালো বলে এবং আর এক ব্যক্তি তার কথা সত্য বলে মেনে নেয়, তাহলে একে ঈমান বলা যায় না। এতে বক্তার কোন প্রভাব বা দখল নেই। অপরদিকে রাসূল (সা)-এর কোন সংবাদ কেবল রাসূলের উপর বিশ্বাসবশত মেনে নেওয়াকে শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান বলে। غَیۡبِ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে এমন সব বস্তু, যা বাহ্যিকভাবে মানবকুলের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে এবং যা মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারে না, চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না, কান দ্বারা শুনতে পায় না, নাসিকা দ্বারা ঘ্রাণ নিতে পারে না, জিহ্বা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না, হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারে না—ফলে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভও করতে পারে না।

কোরআন শরীফে غَیۡبِ শব্দ দ্বারা সে সমস্ত বিষয়কেই বোঝানো হয়েছে যার সংবাদ রাসূল (সা) দিয়েছেন এবং মানুষ নিজের বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যার জ্ঞান লাভে সম্পূর্ণ অক্ষম ।

غَیۡبِ শব্দ দ্বারা ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তা, সিফাত বা গুণাবলী এবং তকদীর সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, বেহেশত, দোযখের অবস্থা, কিয়ামত এবং কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাসমূহ, ফেরেশতাকূল, সমস্ত আসমানী কিতাব, পূর্ববর্তী সকল নবী ও রাসূলগণের বিস্তারিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত যা সূরা বাকারাহর শেষে  اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ আয়াতে দেওয়া হয়েছে। এখানে ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এবং শেষ আয়াতে ঈমানের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন ঈমান বিল গায়েব বা অদৃশ্যে বিশ্বাসের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, রাসুলুল্লাহ (সা) যে হেদায়েত এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, তা আন্তরিকভাবে মেনে নেওয়া। তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, তা রাসূল (সা)-এর শিক্ষা হিসেবে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে। আহলে-ইসলামের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ঈমানের এ সংজ্ঞাই দিয়েছেন। 'আকায়েদ-তাহাবী' ও 'আকায়েদে নসফী'-তে এ সংজ্ঞা মেনে নেওয়াকেই ঈমান বলে অভিহিত করা হয়েছে। এতে এ কথাও বোঝা যায় যে, জানার নাম ঈমান নয়। কেননা, খোদ ইবলীস এবং অনেক কাফেরও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নবুওত যে সত্য তা আন্তরিকভাবে জানত, কিন্তু না-মানার কারণে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।

দ্বিতীয় বিষয়: 

ইকামতে সালাত

 ইকামত বা প্রতিষ্ঠা অর্থ শুধু নামায আদায় করা নয়, বরং নামাযের সকল দিক দিয়ে ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হয়। ‘ইকামত' অর্থ নামাযের সকল ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, এতে সব সময় সুদৃঢ় থাকা এবং এর ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করা সবই বোঝায়। ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল প্রভৃতি সকল নামাযের জন্য একই শর্ত। এক কথায় নামাযে অভ্যস্ত হওয়া ও তা শরীয়তের নিয়ম মত আদায় করা এবং এর সকল নিয়ম-পদ্ধতি যথার্থভাবে পালন করাই ইকামতে সালাত

তৃতীয় বিষয়:

আল্লাহর পথে ব্যয়

আল্লাহর পথে ব্যয় অর্থ এখানে ফরয যাকাত, ওয়াজিব সদকা এবং নফল দান-খয়রাত প্রভৃতি, যা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করা হয় সে সব কিছুই বোঝানো হয়েছে। কোরআনে সাধারণত 'ইনফাক' শব্দ নফল দান-খয়রাতের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে ফরয যাকাত উদ্দেশ্য সেসব স্থানে ‘জাকাত’ শব্দই আনা হয়েছে।

مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ -এ সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, আল্লাহর রাস্তায় তথা সৎপথে অর্থ ব্যয় করার একটা প্রবল আকাঙ্ক্ষা প্রত্যেক সৎ মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে জাগ্রত করাই এ আয়াতের উদ্দেশ্য। একজন সুস্থ বিবেক-সম্পন্ন ব্যক্তি চিন্তা করবে যে, আমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে, তা সবই তো আল্লাহর দান ও আমানত। যদি আমরা সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁর পথে ব্যয় করি, তবেই মাত্র এ নিয়ামতের হক আদায় হবে। পরন্তু এটা আমাদের পক্ষ থেকে কোন এহসান হবে না ।

তবে এ আয়াতে مِمَّا শব্দ যোগ করে একথা বোঝানো হয়েছে যে, যে ধন-সম্পদ আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, তা সবই ব্যয় করতে হবে এমন নয়; বরং কিয়দংশ ব্যয় করার কথাই বলা হয়েছে।

মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে অদৃশ্যে বিশ্বাস, এরপর নামায প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানের গুরুত্ব সকলের জানা যে, ঈমানই প্রকৃত ভিত্তি এবং সকল 'আমল কবুল হওয়া ঈমানের উপরই নির্ভরশীল। কিন্তু যখনই ঈমানের সাথে 'আমলের কথা বলা হয়, তখন সেগুলোর তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হতে থাকে । কিন্তু এস্থলে শুধু নামায এবং অর্থ ব্যয় পর্যন্ত 'আমলকে সীমাবদ্ধ রাখার কারণ কি? এর উত্তর হচ্ছে এই যে, যত রকমের 'আমল রয়েছে তা ফরযই হোক অথবা ওয়াজিব, সবই হয় মানুষের দেহের সাথে অথবা ধন-দৌলতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ইবাদতে-বদনী বা দৈহিক ইবাদতের মধ্যে নামায সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই এস্থলে নামাযের বর্ণনার মধ্যে এবং যেহেতু আর্থিক ইবাদত সবই 'ইনফাক' শব্দের অন্তর্ভুক্ত, সুতরাং এ উভয় প্রকার ইবাদতের বর্ণনার মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে যাবতীয় ইবাদতের বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পূর্ণ আয়াতের অর্থ হচ্ছে : তারাই মুত্তাকী যাদের ঈমান পূর্ণাঙ্গ এবং 'আমলও পূর্ণাঙ্গ'। ঈমান এবং 'আমল এ দু'য়ের সমন্বয়েই ইসলাম । এ আয়াতে ঈমানের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দেওয়ার সাথে সাথে ইসলামের বিষয়বস্তুর প্রতিও ইশারা করা হয়েছে। তাই ঈমান ও ইসলামের পার্থক্যের আলোচনাও এস্থলে করতে হয়।

ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য

অভিধানে কোন বস্তুতে আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন ঈমান এবং কারো অনুগত ও তাঁবেদার হওয়াকে ইসলাম বলে। ঈমানের স্থান অন্তর, ইসলামের স্থানও অন্তরই এবং তৎসহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কিন্তু শরীয়তে ঈমান ব্যতীত ইসলাম এবং ইসলাম ব্যতীত ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল (সা)-এর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এ বিশ্বাসের মৌলিক স্বীকৃতির সাথে সাথে কর্মের দ্বারা আনুগত্য ও তাঁবেদারী প্রকাশ করা না হয় ।

মোটকথা, আভিধানিক অর্থে ঈমান ও ইসলাম স্বতন্ত্র অর্থবোধক বিষয়বস্তুর অন্তর্গত। অর্থগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোরআন-হাদীসে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্যের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু শরীয়ত ঈমানবিহীন ইসলাম এবং ইসলামবিহীন ঈমান অনুমোদন করে না।

প্রকাশ্য আনুগত্যের সাথে যদি অন্তরের বিশ্বাস না থাকে, তবে কোরআনের ভাষায় একে 'নেফাক' বলে। নেফাককে কুফর হতেও বড় অন্যায় সাব্যস্ত করা হয়েছে।

إِنَّ الْمُنْفِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ .

অর্থাৎ 'মুনাফিকদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তর। অনুরূপভাবে আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে যদি মৌখিক স্বীকৃতি এবং আনুগত্য না থাকে, কোরআনের ভাষায় একেও কুফরী বলা হয়। যথা-

يَعْرِفُونَهُمْ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءهُمْ .

অর্থাৎ কাফেরগণ রাসূল (সা) এবং তাঁর নবুওতের যথার্থতা সম্পর্কে এমন সুস্পষ্টভাবে জানে, যেমন জানে তাদের নিজ নিজ সন্তানদেরকে । অন্যত্র এরশাদ হয়েছে-

وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعَلُوا

অর্থাৎ তারা আমার নিদর্শন বা আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে। অথচ তাদের অন্তরে এর পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। তাদের এ আচরণ কেবল অন্যায় ও অহংকারপ্রসূত।

আমার শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ হযরত আল্লামা মুহাম্মদ আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (র) এ বিষয়টি নিম্নরূপভাবে ব্যাখ্যা করতেন: “ঈমান ও ইসলামের ক্ষেত্র এক, কিন্তু আরম্ভ ও শেষের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান অর্থাৎ ঈমান যেমন অন্তর থেকে আরম্ভ হয় এবং প্রকাশ 'আমলে পৌঁছে পূর্ণতা লাভ করে, তদ্রূপ ইসলামও প্রকাশ্য 'আমল থেকে আরম্ভ হয় এবং অন্তরে পৌঁছে পূর্ণতা লাভ করে। অন্তরের বিশ্বাস প্রকাশ্য 'আমল পর্যন্ত না পৌঁছালে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। অনুরূপভাবে প্রকাশ্য আনুগত্য ও তাঁবেদারী আন্তরিক বিশ্বাসে না পৌঁছালে সে ইসলাম গ্রহণযোগ্য হয় না।” ইমাম গাযালী এবং ইমাম সুবকীও এ মত পোষণ করেছেন। ইমাম ইবনে হুমাম 'মুসামেরা' নামক গ্রন্থে এ অভিমতকে সকল আহলে হক-এর অভিমত বলে উল্লেখ করেছেন।

وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يوقنون

অর্থাৎ মুত্তাকীগণ এমন লোক যারা আপনার নিকট প্রেরিত গ্রন্থে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আপনার পূর্ববর্তী রাসূলগণের প্রতি প্রেরিত গ্রন্থসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে আর পরকালের প্রতিও দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।

এ আয়াতে মুত্তাকীদের এমন আরো কতিপয় গুণের বর্ণনা রয়েছে, যাতে ঈমান বিল্‌ গায়েব এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসের প্রসঙ্গটা আরো একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মসউদ ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এ আয়াতের তফসীরে বলেছেন যে, রাসূল (সা)-এর যমানায় মু'মিন ও মুত্তাকী শ্রেণীর লোক বিদ্যমান ছিলেন; একশ্রেণী হলো তাঁরা, যাঁরা প্রথমে মুশরিক ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন ; অন্য শ্রেণী হলো তাঁরা, যাঁরা প্রথমে আহলে কিতাব ইহুদী-নাসারা ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এখানে পূর্ববর্তী আয়াতে প্রথম শ্রেণীর বর্ণনা ছিল। আর এ আয়াতে দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাই এ আয়াত কোরআনের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে বিশ্বাস করার কথাও বলা হয়েছে। হাদীসের বর্ণনানুযায়ী এ দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা যাঁরা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কোন না কোন আসমানী কিতাবের অনুসারী ছিলেন, তাঁরা দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী ছিলেন। প্রথমত কোরআনের প্রতি ঈমান এবং 'আমলের জন্য, দ্বিতীয়ত পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনার জন্য। তবে পার্থক্য এই যে, সেগুলো সম্পর্কে বিশ্বাসের বিষয় হবে এই যে, কোরআনের পূর্বে আল্লাহ তা'আলা যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সেগুলো সত্য ও হক এবং সে যুগে এর উপর আমল করা ওয়াজিব ছিল । আর এ যুগে কোরআন অবতীর্ণ হবার পর যেহেতু অন্যান্য আসমানী কিতাবের হুকুম-আহকাম এবং পূর্ববর্তী শরীয়তসমূহ মনসূখ হয়েছে, তাই এখন আমল একমাত্র কোরআনের আদেশানুযায়ীই হবে।

খতমে নবুওত সম্পর্কিত মাসআলার একটি দলীল

এ আয়াতের বর্ণনা রীতিতে একটা মৌলিক বিষয়ের মীমাংসাও প্রসঙ্গক্রমে বলে দেওয়া হয়েছে। তা হচ্ছে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামই শেষ নবী এবং তাঁর নিকট প্রেরিত ওহীই শেষ ওহী। কেননা, কোরআনের পরে যদি আরো কোন আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তবে পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর প্রতি যেভাবে ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনার কথাও একইভাবে বলা হতো; বরং এর প্রয়োজনই ছিল বেশি। কেননা, তাওরাত, ইনজীলসহ বিভিন্ন আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান তো পূর্ব থেকেই বর্তমান ছিল এবং এগুলো সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগতও ছিল। তাই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পরেও যদি ওহী ও নবুওতের কিতাবসমূহ এবং নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টির ন্যায় পরবর্তী কিতাব ও নবী-রাসুলের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টিরও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন হতো, যাতে পরবর্তী লোকেরা এ সম্পর্কে বিভ্রান্তির কবল থেকে নিরাপদ থাকতে পারে।

কিন্তু কোরআনের যেসব জায়গায় ঈমানের উল্লেখ রয়েছে, সেখানেই পূর্ববর্তী নবীগণের এবং তাঁদের প্রতি প্রেরিত কিতাবসমূহেরও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোথাও পরবর্তী কোন কিতাবের উল্লেখ নেই। কোরআন মজীদে এ বিষয়ে অনুণ্য পঞ্চাশটি স্থানে উল্লেখ রয়েছে। সর্বত্রই হযরত (সা)-এর পূর্ববর্তী নবী ও ওহীর কথা বলা হলেও কোন একটি আয়াতে পরবর্তী কোন ওহীর উল্লেখ তো দূরের কথা, কোন ইশারা-ইঙ্গিতও দেখতে পাওয়া যায় না ।
যথাঃ 
(সূরা নাহল ) - وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ
(সূরা মু'মিন) - وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا رُسُلًا مِّنۡ قَبۡلِکَ
(সূরা রূম) - وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ رُسُلًا
(সূরা নিসা) - وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ رُسُلاً 
(সূরা যুমার) -  وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ

এ আয়াতগুলোতে এবং অনুরূপ আরো অন্যান্য আয়াতে যেখানেই নবী-রাসূল, ওহী ও কিতাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সর্বত্রই مِنۡ قَبۡلِکَ এবং مِن قَبْلُ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও مِنْ بَعْدُ শব্দের ইশারা পর্যন্ত নেই। যদি কোরআনের অন্য আয়াতে খতমে নবুওত এবং ওহীর ধারাবাহিকতা পরিসমাপ্তির উল্লেখ নাও থাকত, তবুও পবিত্র কোরআনের এ বর্ণনাভঙ্গিই বিষয়টির সুষ্ঠু মীমাংসার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

আখেরাতের প্রতি ঈমান

এ আয়াতে মুত্তাকীগণের দ্বিতীয় গুণ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা আখেরাতে বিশ্বাস রাখে। এখানে আখেরাত বলতে পরকালের সে আবাসস্থলের কথা বোঝানো হয়েছে, যাকে কোরআন পাকে 'দারুল-কারার', 'দারুল-হায়াওয়ান' এবং 'ওরুবা' নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। সমগ্র কোরআন তার আলোচনা ও তার ভয়াবহতার বর্ণনায় পরিপূর্ণ ।

আখেরাতের প্রতি ঈমান একটি বৈপ্লবিক বিশ্বাস

আখেরাতের প্রতি ঈমান প্রসঙ্গটি বিল-গায়েব-এর আলোচনায় কিছুটা বর্ণিত হয়েছে। পুনরায় এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে এ জন্য যে, যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনা জরুরী সেগুলোর মধ্যে এ বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ঈমান অনুযায়ী আমল করার প্রকৃত প্রেরণা এখান থেকেই সৃষ্টি হয়ে থাকে।

ইসলামী আকায়েদগুলোর মধ্যে আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা একটা বৈপ্লবিক বিশ্বাস, যা দুনিয়ার কায়া পরিবর্তন করে দিয়েছে। এ বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়েই ওহীর অনুসারিগণ প্রথমে নৈতিকতা ও কর্মে এবং পরবর্তীতে ব্যক্তিগত, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত দুনিয়ার অন্য সকল জাতির মোকাবিলায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আসনে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়েছে। পরন্তু তওহীদ ও রেসালতের ন্যায় এ আকীদাও সমস্ত নবী-রাসূলের শিক্ষা ও সর্বপ্রকার ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেই সর্বসম্মত বিশ্বাসরূপে চলে আসছে। যেসব লোক দুনিয়ার জীবন এবং পার্থিব ভোগ-বিলাসকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে গণ্য করে, জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যেসব তিক্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সে তিক্ততাকেই সর্বাপেক্ষা কষ্ট বলে মনে করে, আখেরাতের জীবন, সেখানকার হিসাব-নিকাশ, শান্তি ও পুরস্কার প্রভৃতি সম্পর্কে যাদের আস্থা নেই, তারা যখন সত্য-মিথ্যা কিংবা হালাল-হারামের মধ্যে পার্থক্য করাকে তাদের জীবনের সহজ-স্বাচ্ছন্দ্যের পথে বাধা রূপে দেখতে পায়, তখন সামান্য একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে সকল মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করে না। এমতাবস্থায় এ সমস্ত লোককে যে কোন দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখার মত আর কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যা কিছু অন্যায়, অসুন্দর বা সামাজিক জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলার পক্ষে ক্ষতিকর, সে সব অনাচার কার্যকরভাবে উৎখাত করার কোন শক্তি সে আইনেরও নেই—এ কথা পরীক্ষিত সত্য। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কোন দুরাচারের চরিত্র শুদ্ধি ঘটানোও সম্ভবপর হয় না। অপরাধ যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, আইনের শাস্তি সাধারণত তাদের ধাঁত-সওয়া হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর তাদের মধ্যে শাস্তিকে ভয় করার মত অনুভূতিও থাকে না। অপরপক্ষে, আইনের শাস্তিকে যারা ভয় করে, তাদের সে ভয়ের আওতাও শুধু ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে, যতটুকুতে ধরা পড়ার ভয় বিদ্যমান। কিন্তু গোপনে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেখানে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না, সেরূপ পরিবেশে এ সমস্ত লোকের পক্ষেও যে কোন গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়ার পথে কোন বাধাই থাকে না।

প্রকারান্তরে আখেরাতের প্রতি ঈমানই এমন এক কার্যকর নিয়ন্ত্রণবিধি, যা মানুষকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বত্রই যে কোন গর্হিত আচরণ থেকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে বিরত রাখে। তার অন্তরে এমন এক প্রত্যয়ের অম্লান শিখা অবিরাম সমুজ্জ্বল করে দেয় যে, আমি প্রকাশ্যেই থাকি আর গভীর নির্জনেই থাকি, রাজপথে থাকি কিংবা কোন বন্ধ ঘরে লুকিয়েই থাকি, মুখে বা ভাব-ভঙ্গিতে প্রকাশ করি আর নাই করি—আমার সকল আচরণ, আমার সকল অভিব্যক্তি, এমনকি অন্তরে লুক্কায়িত প্রতিটি আকাঙ্ক্ষা পর্যন্ত বিরাজমান এক মহাসত্তার সম্মুখে রয়েছে। তাঁর সদাজাগ্রত দৃষ্টির সম্মুখে কোন কিছুই আড়াল করার সাধ্য আমার নেই। আমার সত্তার সঙ্গে মিলে রয়েছে এমন সব প্রহরী, যাঁরা আমার প্রতিটি আচরণ এবং অভিব্যক্তি প্রতিমুহূর্তেই লিপিবদ্ধ করছেন।

উপরিউক্ত বিশ্বাসের মাধ্যমেই প্রাথমিক যুগে এমন মহত্তম চরিত্রের অগণিত লোক সৃষ্টি হয়েছিলেন, যাঁদের চেহারা, যাদের চাল-চলন এবং আচার-আচরণ দেখেই লোক ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়ত।

এখন লক্ষণীয় আর একটি বিষয় হচ্ছে, আয়াতের শেষে یُؤۡمِنُوۡنَ শব্দ ব্যবহার না করে یُوۡقِنُوۡنَ ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা, বিশ্বাসের বিপরীতে 'অবিশ্বাস এবং ইয়াকীনের বিপরীতে সন্দেহ-সংশয়। এ শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হলেই শুধু উদ্দেশ্য সফল হয় না; বরং এমন দৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে, যে প্রত্যয় স্বচক্ষে দেখা কোন বন্ধু সম্পর্কে হয়ে থাকে ।

মুত্তাকীদের এই গুণ পরকালে আল্লাহ তা'আলার সম্মুখে উপস্থিত এবং হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান—সব কিছুরই একটি পরিপূর্ণ নকশা তার সামনে দৃশ্যমান করে রাখবে। যে ব্যক্তি অন্যের হক নষ্ট করার জন্য মিথ্যা মামলা করে বা মিথ্যা সাক্ষী দেয়, আল্লাহর আদেশের বিপরীত পথে হারাম ধন-দৌলত উপার্জন করে এবং দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য সফল করার জন্য শরীয়ত বিরোধী কাজ করে, সে ব্যক্তি পরকালে বিশ্বাসী হয়ে প্রকাশ্যে ঈমানের কথা যদি স্বীকার করে এবং শরীয়তের বিচারে তাকে মু'মিনও বলা হয় কিন্তু কোরআন যে ইয়াকীনের কথা ঘোষণা করেছে, এমন লোকের মধ্যে সে ইয়াকীন থাকতে পারে না। আর সে কোরআনী ইয়ার্কীনই মানবজীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিতে পারে আর এর পরিণামেই মুত্তাকীগণকে হেদায়েত এবং সফলতার সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যা সূরা বাক্বারাহর পঞ্চম আয়াতে বলা হয়েছে:

أو لَيْكَ عَلَى هُدًى مِّنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ .

অর্থাৎ, তারাই সরল-সঠিক পথের পথিক, যা তাদের পালনকর্তার পক্ষ হতে দান করা হয়েছে আর তারাই সম্পূর্ণ সফলকাম হয়েছে।





*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url