মা’আরেফুল কোরআন-১৬ || সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৩০-৩৩ || বাকারাহ ৩০-৩৩ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৩০-৩৩


بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

 وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡهَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡهَا وَ یَسۡفِکُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِکَ وَ نُقَدِّسُ لَکَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۳۰
 وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ کُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِکَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ هٰۤؤُلَآءِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۳۱
قَالُوۡا سُبۡحٰنَکَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۳۲
قَالَ یٰۤاٰدَمُ اَنۡۢبِئۡهُمۡ بِاَسۡمَآئِهِمۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَنۡۢبَاَهُمۡ بِاَسۡمَآئِهِمۡ ۙ قَالَ اَلَمۡ اَقُلۡ لَّکُمۡ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ غَیۡبَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۙ وَ اَعۡلَمُ مَا تُبۡدُوۡنَ وَ مَا کُنۡتُمۡ تَکۡتُمُوۡنَ ﴿۳۳

সূরা আল-বাকারাহ ৩০-৩৩ নং আয়াতের অর্থ

(৩০) আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন : আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতারা বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে, যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে ? অথচ আমরা নিম্নত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে 'আমি জানি, যা তোমরা জান না। (৩১) আর আল্লাহ্ তা'আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বন্ধু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক। (৩২) তারা বলল, তুমি পবিত্র! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে তুমি আমাদের যা শিখিয়েছ (সে সব ছাড়া)। নিশ্চয় তুমিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হেকমতওয়ালা। (৩৩) তিনি বললেন, হে আদম! ফেরেশতাদেরকে বলে দাও এসবের নাম। তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত রয়েছি এবং সে সব বিষয়ও জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর ?


সূরা আল-বাকারাহ ৩০-৩৩নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

আর যখন আপনার পালনকর্তা ফেরেশতাদেরকে (প্রস্তাবিত বিষয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করতে বললেন যাতে বিশেষ তাৎপর্য ও মঙ্গল নিহিত ছিল, নতুবা পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থেকে তো আল্লাহ্ পাক সম্পূর্ণ পবিত্র। মোটকথা, আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাদেরকে) বললেন, অবশ্যই পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করব (অর্থাৎ, সে আমার এমন প্রতিনিধি হবে, যার উপর আমি শরীয়তের বিধিবিধান প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পণ করব)। ফেরেশতারা বলতে লাগলেন, আপনি কি এমন এক জাতি সৃষ্টি করবেন, যারা পৃথিবীতে শুধু কলহ-বিবাদ সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? পরন্তু আমরা নিরন্তর আপনার প্রশংসাস্তুতি ও পবিত্রতা বর্ণনা করে যাচ্ছি। (ফেরেশতাদের এ উক্তি প্রতিবাদছলে বা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং তাঁরা যে কোন উপায়ে একথা অবগত হয়েছিলেন যে, প্রস্তাবিত নব সৃষ্ট জাতি মাটির উপকরণে তৈরি হবে এবং তাদের মধ্যে সৎ-অসৎ উভয় শ্রেণীই থাকবে।

সুতরাং কেউ কেউ প্রতিনিধিত্বের মহান দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। তাই তাঁরা বিনীতভাবে নিবেদন করলেন, আমরা তো সবাই যে কোন দায়িত্ব পালনে সদাপ্রভূত। বস্তুত ফেরেশতাকুলে পাপী বলতে কেউ নেই। অনন্তর নতুন কর্মচারী বাড়ানোর অথবা নতুন জাতি সৃষ্টি করার কি প্রয়োজন-বিশেষত যেখানে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, প্রস্তাবিত এ নব জাতি আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করে আপনার অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে ? আমরা তো যে কোন খিদমতের জন্য প্রকৃত এবং আমাদের খিদমত পুরোপুরি আপনার মত ও মর্জি মোতাবেক হবে।) আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করলেন, তোমরা যা জান না আমি তা জানি। তিনি আদমকে (সৃষ্টি করার পর তাঁকে) যাবতীয় বস্তুর নামের জ্ঞান দান করেন। (অর্থাৎ সব বন্ধুর নাম, বৈশিষ্টাবলী ও লক্ষণাদি সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞান আদম [আ.]-কে দান করলেন। অতঃপর সেসব বস্তু ফেরেশতাদের সামনে পেশ করে বললেন, তবে তোমরা আমাকে এসব বস্তুর নাম (যাবতীয় নিদর্শনাদি ও গুণাবলীসহ) বলে দাও দেখি! যদি তোমরা (তোমাদের এ বক্তব্য যে, তোমরাই বিশ্ব-প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারবে) সত্য হয়ে থাক। ফেরেশতাগণ নিবেদন করলেন, আপনি অতি পবিত্র। (অর্থাৎ-এ অপবাদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত যে, আপনি আদম [আ.]-এর সামনে জ্ঞানরহস্য সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত করে দিয়েছেন, অথচ আমাদের সামনে তা গোপন রেখেছেন। কেননা, কোরআনের কোন আয়াত বা হাদীস সূত্রে প্রমাণ পাওয়া যায় না। যে, হযরত আদম [আ]-কে ফেরেশতাদের থেকে আলাদা করে উল্লিখিত বস্তুসামগ্রীর নাম ও গুণ বৈশিষ্ট্যের কোন শিক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট যে, সবার সামনে একই রকমের শিক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু হযরত আদম [আ.]-এর মধ্যে মজ্জাগতভাবে সে শিক্ষা গ্রহণের যোগ্যতা ছিল বলে তিনি তা আয়াত্ত করে নেন। অপরপক্ষে ফেরেশতাদের সে যোগ্যতা না থাকার দরুন তাঁরা তা গ্রহণ করতে সমর্থ হননি।) আপনার প্রদত্ত জ্ঞান ব্যতীত আমাদের অন্য কোন জ্ঞান নেই। আপনি মহাজ্ঞানী ও সর্বাধিক হেকমতের অধিকারী। (তাই তিনি যার জন্য যতটুকু জ্ঞানবুদ্ধি কল্যাণকর বলে মনে করেছেন, তাকে ততটুকুই দিয়েছেন। প্রতিনিধির উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ফেরেশতাগণ যে অক্ষম, আলোচ্য আয়াতে তাঁদের একথার স্বীকৃতি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। হযরত আদম [আ] যে যথার্থই এ বিশেষ জ্ঞান লাভের যোগ্য, পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাগণের সামনে সুস্পষ্টভাবে তা প্ৰকাশ করেছেন।) ইরশাদ করেনঃ হে আদম! তুমি তাদেরকে এসব বস্তুর নাম (সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যাদিসহ) বলে দাও। (যখন হযরত আদম [আ] এ সব কিছু ফেরেশতাদের সামনে সবিস্তারে বলে দিলেন, তখন তাঁরা বুঝে নিলেন যে, হযরত আদম [আ] এ বিদ্যায় বিশেষ দক্ষতা ও পারদর্শিতা অর্জন করেছেন।) অতঃপর (যখন হযরত আদম [আ] তাঁদেরকে এসব বস্তুর নাম বলে দিলেন,) তখন আল্লাহ্ পাক বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয়ই আমি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অদৃশ্য (বন্ধুর রহস্য সম্পর্কে) অবগত এবং তোমরা যা কিছু প্রকাশ কর বা অন্তরে গোপন রাখ তাও আমার জানা ?


আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

সূরা আল-বাকারাহ ৩০-৩৩নং আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক

পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে আল্লাহ্ পাকের বিশেষ ও সাধারণ অনুগ্রহরাজির বর্ণনা দিয়ে মানবকে অকৃতজ্ঞতা ও অবাধ্যতা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ আয়াত থেকে রুকুর শেষ পর্যন্ত দশটি আয়াতে এ সূত্র ধরেই হযরত আদম (আ)-এর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা, অনুগ্রহ দু'ধরনের :

(১) প্রকাশ্য বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। যথা- পানাহার, অর্থ-কড়ি, ঘর-বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি প্রভৃতি। 
(২) আভ্যন্তরীণ বা অতীন্দ্রিয়। যথা- মান-মর্যাদা, যশ-খ্যাতি, জ্ঞান-বুদ্ধি, আনন্দ-স্ফূর্তি প্রভৃতি । পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে ছিল বাহ্যিক ও প্রকাশ্য অনুগ্রহাদির বিবরণ। আলোচ্য এগারটি আয়াতে আভ্যন্তরীণ অনুগ্রহসমূহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ পাক বলেন, আমি তোমাদের আদি পিতা হযরত আদমকে জ্ঞান ও বিদ্যাবলে ধনী করেছি এবং ফেরেশতাদের দ্বারা সিজদা করিয়ে বিশেষ গৌরব ও অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছি। আর তোমাদেরকে তাঁরই বংশধর হওয়ার গৌরব দান করেছি।

এ আয়াতের সার-সংক্ষেপ এই মহান পরওয়ারদিগার আল্লাহ্ পাক যখন আদম (আ)-কে সৃষ্টি করেন এবং বিশ্বে তাঁর খেলাফত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা করেন, তখন এ সম্পর্কে ফেরেশতাদের পরীক্ষা নেয়ার জন্য তাঁর এ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতে ইঙ্গিত ছিল যে, তাঁরা যেন এ ব্যাপারে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেন। কাজেই ফেরেশতাগণ অভিমত প্রকাশ করলেন যে, মানব জাতির মাঝে এমনও অনেক লোক হবে, যারা শুধু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে। সুতরাং এদের উপর খেলাফত ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব অপর্ণের হেতু তাদের পুরোপুরি বোধগম্য নয়। এ দায়িত্ব পালনের জন্য ফেরেশতাগণই যোগ্যতম বলে মনে হয়। কেননা, পুণ্য ও সততা তাঁদের প্রকৃতিগত গুণ। তাঁদের দ্বারা পাপ ও অকল্যাণ সাধন আদৌ সম্ভব নয়- তাঁরা সদা অনুগত। এ জগতের শাসনকার্য পরিচালনা ও শৃঙ্খলা বিধানের কাজও হয়তো তারাই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন। তাঁদের এ ধারণা যে ভুল ও অমূলক তা আল্লাহ্ পাক শাসকোচিত ভঙ্গীতে বর্ণনা করে বলেন যে, বিশ্ব খেলাফতের প্রকৃতি ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তোমরা মোটেও ওয়াকেফহাল নও। তা কেবল আমিই পূর্ণভাবে পরিজ্ঞাত ।
অতঃপর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ফেরেশতাদের উপর হযরত আদম (আ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অনুপম মর্যাদার বর্ণনা দিয়ে দ্বিতীয় উত্তরটি দেয়া হয়েছে। ব্যক্ত করা হয়েছে যে, বিশ্ব খেলাফতের জন্য ভূপৃষ্ঠের অন্তর্গত সৃষ্ট বস্তুসমূহের নাম, গুণাগুণ, বিস্তারিত অবস্থা ও যাবতীয় লক্ষণাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। বস্তুত ফেরেশতাগণের এ যোগ্যতা ও গুণাবলী নেই।

আদম সৃষ্টি প্রসঙ্গে ফেরেশতাদের সাথে আলোচনার তাৎপর্য

একথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, ফেরেশতাদের সমাবেশে আল্লাহ্ পাকের এ ঘটনা প্রকাশ করার তাৎপর্য কি এবং এতে কি উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। তাঁদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ, না তাদেরকে এ সম্পর্কে নিছক অবহিত করা? না ফেরেশতাদের ভাষায় এ সম্পর্কে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করানো ?

একথা সুস্পষ্ট যে, কোন বিষয় বা সমস্যা সম্পর্কে পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা তখনই দেখা দেয়, যখন সমস্যার সমস্ত দিক কারো কাছে অস্পষ্ট থাকে, নিজস্ব অভিজ্ঞান ও জ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা না থাকে। আর তখনই কেবল অন্যান্য জ্ঞানী-গুণীর সাথে পরামর্শ করা হয়। অথবা পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সেখানেও হতে পারে, যেখানে অন্যান্য ব্যক্তি সমঅধিকার সম্পন্ন হয়। তাই তাদের অভিমত জ্ঞাত হওয়ার উদ্দেশ্যে পরামর্শ করা হয়। যেমনটি বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের সাধারণ পরিষদসমূহে প্রচলিত। কিন্তু একথা সুস্পষ্ট যে, এ দু'টোর কোনটাই এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মহান আল্লাহ্ গোটা বস্তুজগতের স্রষ্টা এবং প্রতিটি বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কে তাঁর পরিপূর্ণ জ্ঞান রয়েছে। তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সামনে প্রকাশ ও অপ্রকাশ্য, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সবকিছুই সমান। তাই তাঁর পক্ষে কারো সাথে পরামর্শ করার কি প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে ?

অনুরূপভাবে এখানে এমনও নয় যে, সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত যেখানে প্রত্যেক সদস্য সমঅধিকার সম্পন্ন বলে প্রত্যেকের পরামর্শ গ্রহণ করা আবশ্যক হতে পারে। কেননা, আল্লাহ্ পাকই সবকিছুর স্রষ্টা এবং মালিক। ফেরেশতা ও মানব-দানব সবই তাঁর সৃষ্টি এবং সবই তাঁর অধীনস্থ ও আয়ত্তাধীন। তাঁর কোন কাজ বা পদক্ষেপ সম্পর্কে কারো কোন প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই যে, এ কাজ কেন করা হলো বা কেন করা হলো না। لَا يُسْئَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْتَلُونَ আল্লাহ পাকের কাজ সম্পর্কে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই, কিন্তু অন্য সবাইকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

সার কথা, প্রকৃত প্রস্তাবে এখানে পরামর্শ গ্রহণ উদ্দেশ্যও নয় এবং এর কোন আবশ্যকতাও নেই। কিন্তু রূপ দেয়া হয়েছে পরামর্শ গ্রহণের যাতে মানুষ পরামশরীতি এবং তার প্রয়োজনীয়তার শিক্ষা লাভ করতে পারে। যেমন, কোরআন পাকে রসূলে করীম (সা)-কে বিভিন্ন কাজে ও ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অথচ তিনি ছিলেন ওহীর বাহক। তাঁর সব কাজকর্ম এবং তাঁর প্রতিটি অধ্যায় ও দিক ওহীর মাধ্যমেই বিশ্লেষণ করে দেওয়া হতো। কিন্তু তাঁর মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহণ রীতি প্রচলন করা এবং উম্মতকে তা শিক্ষা · দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাকেও পরামর্শ গ্রহণের তাকীদ দেওয়া হয়েছে।

কোরআনের ভাষার ইঙ্গিতে বোঝা যায়, আদম (আ)-কে সৃষ্টি করার পূর্বে ফেরেশতাদের ধারণা ছিল, আল্লাহ্ পাক তাদের চাইতে জ্ঞানী ও উত্তম কোন জাতি সৃষ্টি করবেন না।

তফসীরে ইবনে জরীরে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত এক রেওয়ায়েছে এর বিশদ বিবরণ রয়েছে। বলা হয়েছে যে, আদম সৃষ্টির পূর্বে, ফেরেশতাগণ নিজেদের মধ্যে এলাবলি করতেন যে, لن يخلق الله خلقا أكرم عليه منا ولا اعلم (আল্লাহ্ পাক আমাদের চাইতে অধিক মর্যাদাশীল ও জ্ঞানী কোন জাতি সৃষ্টি করবেন না।) কেবল আল্লাহ্ পাকের জ্ঞানই ছিল যে, এমন এক সৃষ্টি করতে হবে, যা সমগ্র সৃষ্টিজগতে সর্বোত্তম ও সর্বাধিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন হবে এবং যাকে তাঁর প্রতিনিধিত্বের গৌরবে ভূষিত করা হবে ।

এজন্য ফেরেশতাদের আসরে পৃথিবীতে আল্লাহ্ পাকের প্রতিনিধিরূপে হযরত আদমের সৃষ্টির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছিল, যাতে তারা এ সম্পর্কে তাদের অভিমত ব্যক্ত করতে পারে।
সুতরাং ফেরেশতাগণ নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনুসারে বিনীতভাবে তাঁদের অভিমত প্রকাশ করে নিবেদন করলেন --মহাপ্রভু, আপনি মর্ত্যলোকে যে জাতিকে আপনার প্রতিনিধিরূপে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন; তার মাঝে যদুকলহ সৃষ্টি, অকল্যাণ ও অহিত সাধনের উপকরণও তো বিদ্যমান। সে নিজেই যখন রক্তপাত ঘটাবে, তখন সে অপরকে কিভাবে সংশোধন করবে এবং বিশ্বে শান্তি-শৃঙ্খলাই বা কিভাবে বিধান করতে পারবে। পক্ষান্তরে আপনার ফেরেশতাকুলে দ্বন্দ্ব-কলহ ও অশান্তি সৃষ্টির কোন উপকরণ নেই। তারা যাবতীয় পাপ-পংকিলতা বিমুক্ত এবং সর্বক্ষণ আপনার গুণগান ও উপাসনা-আরাধনায় নিয়োজিত। দৃশ্যত তারাই এ খিদমত সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারবে।

মোটকথা, এর দ্বারা আল্লাহ্ পাকের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোন আপত্তি উত্থাপন করা হয়নি। কেননা, ফেরেশতাগণ এমন মন-মানসিকতা ও অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ যুক্ত ও পবিত্র। একথা জানাই তাদের উদ্দেশ্য যে, কোন্ হিকমত ও তাৎপর্যের ভিত্তিতে এবং কি কল্যাণ চিন্তায় এমন এক নিষ্কলুষ পূত-পবিত্র একান্ত অনুগত সম্প্রদায় বর্তমান থাকা সত্ত্বেও অপর এক পংকিল জাতি সৃষ্টি করে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে একাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হচ্ছে?

এর উত্তর দান প্রসঙ্গে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন প্রথমত সংক্ষিপ্তভাবে বলেন- اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ (তোমরা যা জান না আমি তা জানি।) অর্থাৎ তোমরা খেলাফতে ইলাহীর নিগূঢ় তত্ত্ব এবং তার আনুষঙ্গিক প্রয়োজনাদি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল নও। তাই তোমরা মনে কর যে, কেবল এক নিষ্পাপ জাতিই সুষ্ঠুভাবে এ দায়িত্ব পালন ও এ কাজ সম্পন্ন করতে পারে। এর পুরো তত্ত্ব ও অন্তর্নিহিত রহস্য শুধু আমিই অবগত।

অতঃপর ফেরেশতাগণকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানদানের উদ্দেশ্যে এক বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সৃষ্ট জগতের সমগ্র বন্ধু-সামগ্রীর নাম, এদের গুণাগুণ ও লক্ষণাদি সম্পর্কিত জ্ঞান লাভের যোগ্যতা কেবল আদম সন্তানকেই দান করা হয়েছে। ফেরেশতার স্বভাব-প্রকৃতি মোটেও এর উপযোগী নয়। এসব কিছু আদম (আ)-কে শিখিয়ে ও বলে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, বিশ্বের উপকারী ও ক্ষতিকর দ্রব্যসামগ্রী এবং তার লক্ষণাদি ও বৈশিষ্ট্যাবলী, প্রত্যেক প্রাণী সম্প্রদায়ের স্বভাব-প্রকৃতি ও লক্ষণাবলী ---এ সবের জ্ঞান লাভের যোগ্যতা ফেরেশতাকুলের নেই। ফেরেশতারা কি বুঝবেন যে, ক্ষুধা কি জিনিস, পিপাসার যন্ত্রণা কেমন, মানসিক উত্তেজনা ও প্রেরণার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া কি, কোন্ বস্তুতে মাদকতার উৎপত্তি কেমন করে হয়, কোন্ ধরনের এবং কোন রাশির শরীরে সাপ ও বিষ্ণুর বিষের প্রতিক্রিয়া কি রকম হয়?
মোটকথা, সৃষ্টি জগতের বিভিন্ন বস্তুর নাম, গুণাগুণ ও লক্ষণাদির জ্ঞান ফেরেশতাদের স্বভাব-প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ শিক্ষা ও জ্ঞান শুধু আদমকেই দেয়া সম্ভব ছিল এবং তাঁকেই তা দেয়া হলো। কোরআন পাকের কোথাও সরাসরিভাবে বা আকার-ইঙ্গিতে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, হযরত আদম (আ)-কে ফেরেশতাদের থেকে পৃথক করে কোন নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে এ শিক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। সুতরাং এমন হতে পারে যে, শিক্ষাদান এবং তা গ্রহণের সুযোগ সবার জন্যে সমানভাবেই বিদ্যমান ছিল। এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার যোগ্যতা হযরত আদম (আ)-এর ছিল বলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তিনি এ শিক্ষা লাভ করে নেন। ফেরেশতাদের প্রকৃতিতে তা ছিল না বলে তাঁরা তা লাভ করতে সক্ষম হননি। এজন্যই এখানে শিক্ষাদানকে শুধু আদম (আ)-এর সাথে সম্পৃক্ত করে বলা হয়েছে: وَ عَلَّمَ اٰدَمَ (এবং আল্লাহ্ পাক হযরত আদমকে শিক্ষা প্রদান করেন) অবশ্য শিক্ষাদান ব্যবস্থা আদম (আ) ও ফেরেশতা উভয়ের জন্য সমভাবেই ছিল এবং উভয়ই এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আবার এমনও হতে পারে যে, বাহ্যিকভাবে শিক্ষাদানের কোন আয়োজনই করা হয়নি। বরং আদম (আ)-কে সৃষ্টির প্রারম্ভিক পর্যায়ে এসব দ্রব্য-সামগ্রীর জ্ঞান স্বভাবগতভাবেই নিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যেমন, সদ্যোজাত শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই মায়ের দুধ পান করতে এবং হাঁসের ছানা সাঁতার কাটতে জানে। এ ব্যাপারে কোন বাহ্যিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় না।

প্রশ্ন হতে পারে-আল্লাহ্ তো সব কিছুই করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি ফেরেশতাদের প্রকৃতি ও স্বভাব পাল্টিয়ে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার উন্মেষ ঘটিয়ে তাদেরকেও এসব কিছু শিখিয়ে নিতে পারতেন। তবে তা করলেন না কেন ? উত্তর এই যে, যদি ফেরেশতাদের স্বভাব-প্রকৃতি পরিবর্তন করে দেয়া হতো তবে ফেরেশতা আর ফেরেশতাই থাকতেন না, মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যেতেন। সুতরাং এ প্রশ্নের অর্থ পরোক্ষভাবে এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাদেরকে মানুষে রূপান্তর করছিলেন না কেন ?

সারকথা হযরত আদম (আ)-কে সৃষ্ট জগতের যাবতীয় বন্ধু-সামগ্রীর নাম এবং সেগুলোর গুণাগুণ ও লক্ষণাদির বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়েছিল, যা ফেরেশতাদের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে। অতঃপর সেসব বস্তু সামগ্রী ফেরেশতাদের সামনে পেশ করে বলা হলো, তোমাদের চাইতে অধিক জ্ঞানী ও উত্তম কোন জাতি সৃষ্টি হবে না বলে এবং বিশ্ব-খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্য মানব জাতির চাইতে তোমরাই যোগ্যতর বলে তোমাদের যে ধারণা এতে তোমরা যদি সত্যবাদী ও সঠিক হয়ে থাক, তবে সৃষ্ট জগতের যেসব বিষয়ের ওপর বিশ্ব-খলীফার শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে, যাবতীয় গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যাবলীসহ এগুলোর নাম বলে দাও দেখি।

এখানে এ তথ্য উদ্ঘাটিত হলো যে, শাসকের জন্য শাসিতের স্বভাব-প্রকৃতি গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায় তিনি তাদের ওপর ন্যায় ও ইনসাফের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন না। যে ব্যক্তি জানে না যে, ক্ষুধার কারণে কিভাবে কতটুকু কষ্ট ও যন্ত্রণা হয়, তার আদালতে যদি কাউকে অভুক্ত
রাখা সম্পর্কে কোন অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তবে সে এর কি মীমাংসা করবে এবং কিভাবে করবে ?

মোটকথা, এ ঘটনার দ্বারা আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাদের পূর্বেকার অমূলক ধারণার অপনোদন করে একথা প্রকাশ করে দিলেন যে, বিশ্ব খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্য নিষ্পাপ হওয়াই যোগ্যতার একমাত্র মানদণ্ড নয়, বরং দেখতে হবে, সে বস্তু জগত সম্পর্কে ওয়াকেফহাল কিনা এবং সেগুলোর ব্যবহার বিধি ও ফলশ্রুতি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখে কিনা। যদি তোমাদের এ ধারণা সঠিক হয়ে থাকে যে, তোমরা (ফেরেশতাগণ) এ খেদমতের জন্য যোগ্যতর তবে যাবতীয় বৈশিষ্ট্যসহ এসব বস্তুর নাম বলে দাও।

যেহেতু ফেরেশতাদের মতামত প্রকাশ কোন প্রতিবাদছলে বা অহংকার প্রদর্শনার্থ অথবা তাদের যোগ্যতার দাবি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছিল না, বরং তাদের অভিমতের অভিব্যক্তি ছিল একান্ত অনুগত কর্মচারীর ন্যায় এবং বিনীতভাবে নিজস্ব খেদমত পেশ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তাই তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন— 'মহান প্রভু, আপনি অতি পবিত্র । আপনি যতটুকু জ্ঞান আমাদের দিয়েছেন, তার অতিরিক্ত কিছুই আমাদের জানা নেই। যার মর্মার্থ হলো, নিজেদের পূর্ববর্তী ধারণা পরিত্যাগ করে একথা স্বীকার করে নেয়া যে, তাদের চাইতে অধিক প্রজ্ঞাবান উত্তম জাতিও রয়েছে এবং খেলাফতের জন্য তারাই যোগ্যতম ।

দ্বিতীয় প্রশ্ন- পৃথিবীতে পদার্পণ করে মানব জাতি যে পরস্পর রক্তারক্তি করবে এবং বিশৃঙ্খলা ঘটাবে ফেরেশতাগণ এ তথ্য কোথা থেকে, কিভাবে সংগ্রহ করলেন ? তাদের কি অদৃশ্য জ্ঞান ছিল ? না নিছক অনুমানের ওপর ভিত্তি করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন ? অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে এর উত্তর এই যে, স্বয়ং আল্লাহ্ পাকই তাদেরকে মানুষের বিভিন্ন অবস্থা এবং তার ভাবীকালের সম্ভাব্য কার্যকলাপ, আচার-ব্যবহার ও গতিবিধির স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত করে দিয়েছিলেন। যেমন, কোন কোন হাদীসে পাওয়া যায়, যখন আল্লাহ্ পাক বিশ্ব-খেলাফতের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে আদম সৃষ্টির বিবরণ ফেরেশতাদের সামনে প্রদান করলেন, তখন ফেরেশতাগণ কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে আল্লাহ্ পাকের নিকট ভাবী খলীফার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করায় স্বয়ং আল্লাহ্ পাকই তাদেরকে সবকিছু সবিস্তারে বলে দেন। ফেরেশতাগণ সবিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন, অশান্তি সৃষ্টি ও রক্তারক্তি করাই যে জাতির বৈশিষ্ট্য, তাকে কোন্ যুক্তি ও তাৎপর্যের ভিত্তিতে বিশ্ব খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত করা হলো ?
এর একটি উত্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত আদমের জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। আর বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাত ঘটাবে বলে তাঁর খেলাফতের যোগ্যতা প্রসঙ্গে যে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল, সংক্ষিপ্তাকারে এর উত্তর দেওয়া হয়েছে- إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ  (তোমরা যা জান না নিশ্চয়ই আমি তা জানি।) আয়াতের মাধ্যমে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, যে বিষয়কে তোমরা খিলাফতের যোগ্যতার পরিপন্থী বলে মনে করছ, প্রকৃত প্রস্তাবে সেটাই তার যোগ্যতার মূল উৎস ও প্রধান কারণ। কেননা, অশান্তি দূরীভূত করার উদ্দেশ্যেই বিশ্ব-খেলাফত প্রতিষ্ঠা একান্ত আবশ্যক। যেখানে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা থাকবে না, সেখানে প্রতিনিধি পাঠানোর কি প্রয়োজন ? মোটকথা, আল্লাহ পাক নিজের ইচ্ছানুসারে একদিকে যেমন নিষ্পাপ নিষ্কলুষ ফেরেশতা জাতি সৃষ্টি করেছেন, যাদের দ্বারা কোন পাপই সংঘটিত হতে পারে না, অপরদিকে তেমনি শয়তানকে সৃষ্টি করেছেন, যাদের কোন পুণ্য ও কল্যাণকর, কার্য সাধনের যোগ্যতাই নেই। অনুরূপভাবে এমন এক জাতি সৃষ্টি করাও আল্লাহ্ পাকের অভিপ্রায় ছিল, যার মধ্যে পাপ ও পূণ্য উভয়ের সমাবেশ ঘটবে এবং যার মাঝে মঙ্গল-অমঙ্গল উভয় প্রেরণাই বিদ্যমান থাকবে এবং মহান প্রভুর নৈকট্য লাভ ও সন্তুষ্টি বিধানের গৌরবে ভূষিত হবে ।

ভাষার স্রষ্টা আল্লাহ পাক স্বয়ং

আদম (আ)-এর এ বর্ণনায় বন্ধু-সামগ্রীর নাম শিক্ষা দানের ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভাষা শব্দাবলীর মূল প্রণেতা ও স্রষ্টা স্বয়ং আল্লাহ্ পাক । অতঃপর সৃষ্টির নানা রকম ব্যবহারের ফলে তা বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে এবং বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব হয়েছে। ইমাম আশআরী (র) এ আয়াতেই প্রমাণ করেছেন যে, আল্লাহ্ পাকই ভাষার প্রণেতা।

ফেরেশতাদের ওপর আদমের শ্রেষ্ঠত্ব

এ ঘটনার ক্ষেত্রে কোরআনে হাকীমে ব্যবহৃত এসব বিশুদ্ধ তাৎপর্যপূর্ণ শব্দসমষ্টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, যখন ফেরেশতাদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, এসব বন্ধু-সামগ্রীর নাম বলে দাও, তখন اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আমাকে বলে দাও। আবার যখন হযরত আদম (আ)-কে একই বিষয় সম্পর্কে সম্বোধন করা হয়েছে, তখন اَنۡۢبِئۡهُمۡ (হে আদম তাদেরকে বলে দাও।) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আদম (আ)-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, ফেরেশতাদেরকে এসব বস্তুর নাম বলে দাও। প্রকাশভঙ্গীর এ পার্থক্যের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, এখানে হযরত আদম (আ)-কে শিক্ষকের এবং ফেরেশতাদেরকে শিক্ষার্থীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যেখানে হযরত আদম (আ)-এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বকে বিশেষ ভঙ্গীতে প্রকাশ করা হয়েছে।
এ ঘটনা থেকে এ কথাও বোঝা গেল যে, ফেরেশতাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রেও হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে। কেননা, যেসব বস্তুর জ্ঞান তাদের ছিল না, আদম (আ)-এর মাধ্যমে তাদেরকে কোন না কোন পর্যায়ে সংক্ষিপ্তভাবে সেসব বস্তুর জ্ঞানদান করা হয়েছে।

পৃথিবীর খেলাফত

এ সব আয়াতের দ্বারা জানা গেল যে, রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা এবং সেখানে আল্লাহ্ পাকের বিধি-বিধান প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে তাঁর পক্ষ থেকে কাউকে তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। এর দ্বারা রাষ্ট্রীয় বিধানের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সন্ধান পাওয়া যায়। তা হলো এই যে, গোটা বস্তুজগত ও নিখিল বিশ্বের সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্ পাকেরই জন্য। কোরআন মজীদের বহু আয়াত একথা প্রমাণ করে। যেমন- اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰ (বিধান দানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ্ পাক।) لَهُۥ مُلْكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ  (নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের যাবতীয় কর্তৃত্ব তাঁরই।) اَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ (জেনে রেখো, তিনিই সৃষ্টিকর্তা ও বিধান দাতা।) প্রভৃতি আয়াত। পৃথিবীর শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে যুগে যুগে প্রতিনিধিবৃন্দের আগমন ঘটেছে। তাঁরা আল্লাহ্ পাকের অনুমতিক্রমে পৃথিবীর শাসনকার্য পরিচালনা এবং মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা ও দায়িত্বভার গ্রহণ করে আল্লাহর বিধান প্রবর্তন করেছেন। খলীফার এ নিযুক্তি সরাসরি স্বয়ং আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে হয়। এক্ষেত্রে কারো চেষ্টা-তদ্‌বীর ও শ্রম-সাধনার কোন দখল নেই। এজন্যই গোটা উম্মতের সর্বসম্মত আকীদা বা বিশ্বাস রয়েছে যে, নবুয়ত লাভ চেষ্টা-তদ্‌বীরলব্ধ কোন বিষয় নয়, বরং আল্লাহ্ পাকই নিজস্ব ইচ্ছা ও বিবেচনা অনুসারে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে এ কাজের জন্য বেছে নিয়ে তাঁদেরকে নবী-রসূল বা খলীফা নিযুক্ত করে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। কোরআনে হাকীমের বিভিন্ন জায়গায় এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে - ٱللَّهُ يَصْطَفِى مِنَ ٱلْمَلَٰٓئِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ ٱلنَّاسِ (আল্লাহ্ পাক ফেরেশতা ও মানুষের মধ্য থেকে আপন রাসুল বেছে নেন।) اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ  (কাকে রিসালতের মর্যাদায় ভূষিত করবেন, আল্লাহ্ পাকই ভাল জানেন।)

এসব খলীফা সরাসরি আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে যাবতীয় নির্দেশ ও বিধানমালা প্রাপ্ত হয়ে বিশ্বে তা প্রবর্তন করেন। আল্লাহ্র খেলাফতের এ ধারা আদম (আ) থেকে আরম্ভ করে আখেরী নবী হুরে পাক (সা) পর্যন্ত একই পদ্ধতিতে চলে এসেছে। নবীকুল শিরমণি হুযুরে পাক (সা) বিশেষ গুণাবলী ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসহ সর্বশেষ খলীফারূপে দুনিয়ার বুকে শরীফ আনেন। তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, পূর্ববর্তী নবীগণ বিশেষ সম্প্রদায় বা অঞ্চল বিশেষের জন্য প্রেরিত হতেন। তাঁদের খেলাফতের পরিধি ও শাসনক্ষমতা সেসব নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ও অঞ্চলসমূহের মধ্যেই গণ্ডিভূত থাকত। হযরত ইবরাহীম (আ) এক সম্প্রদায়ের প্রতি, হযরত লূত (আ) অপর এক সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। হযরত মূসা ও ঈসা (আ) ও এঁদের 'মধ্যবর্তী নবীগণ বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হন।

বিশ্বের সর্বশেষ খলীফা হুযুরে পাক (সা) ও তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলী

নবী করীম (সা) গোটা বিশ্ব ও মানব-দানব, তথা গোটা সৃষ্ট জগতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর ক্ষমতা ও অধিকার সারা বিশ্বের উভয় জাতির উপর পরিব্যাপ্ত ছিল। কোরআন পাক নিম্নোক্ত আয়াতে তাঁর নবুয়তকে বিশ্বব্যাপী বলে ঘোষণা করেছেন-

قُلْ يَأَيُّهَا النَّاسَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ 

(আপনি ঘোষণা করে দিন, হে মানব সম্প্রদায়। আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহ্ পাকের রসূল। আর আল্লাহ্ পাক হলেন সেই মহান সত্তা, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল যার কর্তৃত্বাধীন।) সহীহ্ মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, হুজুর (সা) ইরশাদ করেছেন, ছ'টি ক্ষেত্রে আল্লাহ্ পাক আমাকে অন্য নবীগণের ওপর বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
১. আমাকে সমগ্র বিশ্বের নবী ও রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন ।

২. পূর্ববর্তী নবীগণের খেলাফত যেমন বিশেষ সম্প্রদায় ও অঞ্চলের মধ্যে সীমাবন্ধ ছিল, তেমনি ছিল এক নির্দিষ্ট যুগের জন্য। পরবর্তী নবী বা রসূলের আবির্ভাবের সাথে সাথে পূর্ববর্তী নবীর খেলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটত এবং পরবর্তী নবীর খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হতো। আমাদের রাসূল (সা)-কে আল্লাহ্ পাক খাতামুল আম্বিয়ারূপে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং তাঁর খেলাফত কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।

৩. পূর্ববর্তী নবীগণের শিক্ষা-দীক্ষা এবং তাঁদের প্রবর্তিত শরীয়ত ও বিধানমালা কিছুকাল পর্যন্ত সংরক্ষিত ও কার্যকরী থাকত। ধীরে ধীরে নানাবিধ পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ফলে তা প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে উপনীত হতো। ফলে সে সময়ে অন্য রাসূল বা নবী প্রেরণ করা হতো।

আমাদের রসূলের বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁর প্রবর্তিত বিধান ও শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত ও অপরিবর্তিত থাকবে। তাঁর ওপর অবতারিত কোরআন মজীদের (শব্দ ও অর্থ) সব কিছু হেফাজত ও সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ্ পাক গ্রহণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ .

(নিশ্চয় আমিই কোরআন নাযিল করেছি এবং নিঃসন্দেহে আমি তার রক্ষণাবেক্ষণকারী।)
অনুরূপভাবে হুযুর পাক (সা)-এর শিক্ষা-দীক্ষা ও বাণীমালার সমষ্টি হাদীসশাস্ত্রের সংরক্ষণের জন্যও আল্লাহ্ পাক এক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তিনি উম্মতের মাঝে কিয়ামত পর্যন্ত এমন একটি দল বর্তমান রাখবেন, যারা তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা-দীক্ষা ও বাণীমালাকে প্রাণের চাইতে অধিক প্রিয় বলে মনে করবে। তারা তাঁর পরিত্যক্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার, আদর্শ ও শরীয়তী নির্দেশাবলী সঠিকভাবে মানুষের দ্বারে পৌঁছাতে থাকবে। কোন শক্তি বা ব্যক্তি এদলকে বিনষ্ট ও স্তব্ধ করতে পারবে না। তাদের প্রতি আল্লাহ্ পাকের বিশেষ অদৃশ্য মদদ থাকবে।

সারকথা, পূর্ববর্তী নবীগণের গ্রন্থসমূহ ক্রমাগত পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং বিভিন্নভাবে অহেতুক হস্তক্ষেপের ফলে পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেত অথবা ভুল-ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ অবস্থায় টিকে থাকত। কিন্তু হয়ূর (সা)-এর ওপর নাযিলকৃত কোরআন এবং তাঁর বাণীর সমষ্টি হাদীস সব কিছুই সম্পূর্ণ ও যথাযথভাবে অবিকৃত ও অক্ষত অবস্থায় কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এজন্যই এ বিশ্বে তাঁর পরবর্তী সময়ে কিয়ামত পর্যন্ত না কোন নবী রাসূলের প্রয়োজন আছে, না আল্লাহ্ পাকের প্রতিনিধি আগমনের অবকাশ আছে।

পূর্ববর্তী নবীগণের খিলাফত একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ সময়কাল পর্যন্ত বহাল থাকত। প্রত্যেক নবী-রাসূলের অন্তর্ধানের পর পরবর্তী নবী (খলীফা) আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে নির্ধারিত হতেন এবং খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করতেন।

কিন্তু হুযূর (সা)-এর খিলাফতকাল কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত মূলত তিনিই বিশ্বে আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি। তাঁর তিরোধানের পর যে ব্যক্তি প্রতিনিধি পদে অভিষিক্ত হবেন, তিনি রাসূলের খলীফা বা প্রতিনিধি বলে বিবেচিত হবেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে ছয়ূর (সা) ইরশাদ করেছেন-

كَانَتْ بَنُوا إِسْرَائِيلَ تَسَوْسَهُمُ الأَنْبَيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٍّ خَلَقَهُ نَبِيٍّ وَإِنَّهُ لانبِي بَعْدِي وَسَيَكُونُ خُلَفَاهُ فَيَكْثُرُونَ

(অর্থাৎ বনী-ইসরাঈলের নবীগণই রাজত্ব ও শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এক নবীর তিরোধানের পর অপর নবীর আগমন হতো। আর জেনে রেখো, আমার পরে কোন নবী-রসূল আসবে না। অবশ্য খলীফাগণের আবির্ভাব ঘটবে এবং তাদের সংখ্যা হবে অনেক।)

(৫) তাঁর পরে আল্লাহ্ পাক তাঁর উম্মত সমষ্টিকে এমন মর্যাদা দান করবেন, যা পূর্ববর্তী নবীগণকে দেওয়া হতো অর্থাৎ সমস্ত উন্নতকে নিষ্পাপ নির্দোষ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, তাঁর উম্মত কখনো বিপথ ও ভ্রান্ত নীতির উপর একত্রিত হবে না। গোটা উম্মত যে বিষয়ের উপর ঐকমত্য পোষণ করবে, তা আল্লাহর বিধান ও সিদ্ধান্তেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হবে। এজন্যও আল্লাহ্র কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহর পর মুসলিম উম্মতের সম্মিলিত মতকে শরীয়তে দলীলের তৃতীয় ভিত্তি বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- لَنْ يَجْتَمَعَ أُمَّتِي عَلَى الضَّلالَة বাংলা একালে (আমার উন্নত কখনও ভ্রান্ত নীতির ওপর একত্রিত হবে না।) এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ সে হাদীসেও পাওয়া যায়, যাতে ইরশাদ হয়েছে । আমার উম্মতের মধ্যে একদল সর্বদা সত্যের ওপর অটল থাকবে। দুনিয়ার যত পটপরিবর্তনই হোক, সত্য যতই নিষ্প্রভ ও দুর্বল হয়ে পড়ুক, কিন্তু আল্লাহর পথে সর্বতোভাবে নিবেদিত উম্মতের একদল সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পোষকতা করতেই থাকবে। এতে এ কথাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সমগ্র উম্মত কখনো অসত্য ও ভ্রান্তির ওপর একত্রিত হবে না। আর যখন উম্মতের সমষ্টিকে নিষ্পাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তখন রাসূলের খলীফা নির্বাচনের ক্ষমতাও সমষ্টিগতভাবে উম্মতের ওপরে ন্যস্ত করা হয়েছে। হুযূরে পাক (সা)-এর পরবর্তীকালে বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব, রাষ্ট্রপরিচলনা ও আইন-শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্বে সমাসীন করার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। উম্মত যাকে খিলাফতের জন্য নির্বাচিত করবে, তিনি রাসূলের খলীফা হিসেবে দেশের আইন-শৃংখলা বিধানের জন্য এককভাবে দায়ী থাকবেন। আর সমগ্র বিশ্বের খলীফা মাত্র একজনই হতে পারেন।

খোলাফায়ে রাশেদীনের শেষ যুগ পর্যন্ত খিলাফতের এ ধারা সঠিক নিয়মে অভ্রান্ত নীতির ওপর চলে আসছিল। এ কারণেই তাঁদের সিদ্ধান্তসমূহ কেবল ধর্মীয় ও সাময়িক সিদ্ধান্তের মর্যাদাই রাখে না, বরং তা এক সুদৃঢ় ও অভ্রান্ত সনদ এবং উম্মতের জন্য এক মৌলিক বিধান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ সম্পর্কে হুযূর (সা) ইরশাদ করেছেন- 

عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ

(তোমরা আমার ও খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন যাপন পদ্ধতি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ কর। )

খেলাফতে রাশেদার পরবর্তী অবস্থা

খোলাফায়ে রাশেদীনের (ন্যায়নিষ্ঠ খলীফা চতুষ্টয় পরবর্তীকালে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও দুর্বলতার সুযোগে উম্মতের মধ্যে অনৈক্য ও মতভেদের সূচনা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন আমীর তথা গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। তাঁদের মধ্যে কেউই খলীফার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না। তাঁদেরকে বড়জোর কোন অঞ্চল ও সম্প্রদায়বিশেষের আমীর (শাসক) বলা যেতে পারে। এরূপভাবে যখন কোন এক ব্যক্তির নেতৃত্বে মুসলিম জগতের ঐক্য ও সংহতি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল এবং প্রতিটি দেশ ও সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক পৃথক আমীর নিযুক্তির প্রথা প্রচলিত হলো, তখন মুসলমানগণ ইসলামী নীতি অনুসারে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সমর্থনপুষ্ট ও সম্মতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আমীর নিযুক্ত করতে আরম্ভ করেন, যার সমর্থনে কোরআনের আয়াত وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ  (পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে তাদের সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।) পেশ করা যেতে পারে।

পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও ইসলামী শূরা (পরামর্শ) নীতির পার্থক্য

বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আইন পরিষদগুলো এই কর্মপদ্ধতিরই এক নমুনা। পার্থক্য শুধু এই যে, গণতান্ত্রিক দেশের আইন পরিষদগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে থাকে। নিছক নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে ভাল-মন্দ, কল্যাণজনক বিধান প্রণয়নের ক্ষমতাই এর রয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলামী আইন পরিষদ (মজলিসে শূরা), তার সদস্যমণ্ডলী এবং নির্বাচিত আমীর সবাই সে মৌলিক আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন, যা তাঁরা আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে রসূলের মাধ্যমে লাভ করেছেন। এ পরিষদ বা মজলিসে শূরার সদস্যপদ লাভের জন্য কিছু শর্তাবলী রয়েছে এবং এ পরিষদ যাকে নির্বাচিত করবে, তার জন্যও কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাদের আইন প্রণয়নের কাজও কোরআন ও সুন্নাহ্ বর্ণিত নীতিমালা আওতাধীনে সম্পন্ন করতে হবে। এর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তাদের নেই।

সারকথা, আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাদেরকে সম্বোধন করে যে ইরশাদ করেছেন, “আমি বিশ্বের বুকে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করব"-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের কতকগুলো মৌলিক ধারার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সেগুলো এই-

(১) নিখিল বিশ্বের সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহ্ ।

(২) পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান ও নির্দেশাবলী প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের জন্য তাঁর রাসূলই হবেন তাঁর প্রতিনিধি বা খলীফা। আনুষঙ্গিকভাবে একথাও পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আল্লাহর খেলাফতের ধারা যখন হুযুরে পাক (সা)-এর পরেই সমাপ্ত হয়ে গেছে, সুতরাং হুযূরের ওফাতের পর বর্তমান খলীফাই রাসূলের খেলাফতের ধারার স্থলাভিষিক্ত হবেন এবং তিনি গোটা মিল্লাতের ভোট ও মতামতের মাধ্যমেই মনোনীত হবেন।






***************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url