মা’আরেফুল কোরআন-২১ || সূরা আল-বাকারাহ, আয়াতঃ ৪৩-৪৬ || সূরা বাকারাহ ৪৩-৪৬ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৪৩-৪৬


بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
 وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ ارۡکَعُوۡا مَعَ الرّٰکِعِیۡنَ ﴿۴۳
اَتَاۡمُرُوۡنَ النَّاسَ بِالۡبِرِّ وَ تَنۡسَوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَتۡلُوۡنَ الۡکِتٰبَ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۴۴
 وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ ؕ وَ اِنَّهَا لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ ﴿ۙ۴۵
 الَّذِیۡنَ یَظُنُّوۡنَ اَنَّهُمۡ مُّلٰقُوۡا رَبِّهِمۡ وَ اَنَّهُمۡ اِلَیۡهِ رٰجِعُوۡنَ ﴿۴۶

সূরা আল-বাকারাহ ৪৩-৪৬নং আয়াতের অর্থ

(৪৩) আর নামায কায়েম কর, যাকাত দান কর এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে যারা অবনত হয়। (৪৪) তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর ? তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না ? (৪৫) ধৈর্যের সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব। (৪৬) যারা একথা খেয়াল করে যে, তাদের সম্মুখীন হতে হবে স্বীয় পরওয়ারদেগারের এবং তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।

সূরা আল-বাকারাহ ৪৩-৪৬নং আয়াতের তাফসীরের সার-সংক্ষেপ

আর তোমরা (মুসলমান হয়ে) নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত আদায় কর এবং বিনয়ীদের সাথে বিনয় প্রকাশ কর, (বনী-ইসরাঈলের পুরোহিতদের কোন কোন আত্মীয়-স্বজন ইসলাম গ্রহণ করেছিল। যখন এদের সাথে কথাবার্তা হত, তখন গোপনে এসব পুরোহিত তাদেরকে বলতো যে, মুহাম্মদ (সা) নিঃসন্দেহে সত্য রসূল। আমরা তো বিশেষ মঙ্গলের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমান হচ্ছি না। তোমরা কিন্তু ইসলাম ধর্ম ছেড়ো না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ পাক বলেন, একি মারাত্মক কথা যে,) তোমরা অপর লোককে সৎকাজ করতে আদেশ কর, অথচ নিজেদেরকে ভুলে বসেছো। বস্তুত তোমরা কিতাব পাঠ করতে থাক (অর্থাৎ তওরাতের বিভিন্ন স্থানে আমলহীন পুরোহিতদের নিন্দাবাদ পাঠ কর)। তোমরা কি এতটুকুও বুঝ না । এবং তোমরা সাহায্য কামনা কর (অর্থাৎ ধন-লিল্লা ও মর্যাদার মোহে পড়ে তোমাদের নিকট ঈমান আনা যদি কঠিন বোধ হয়, তবে সাহায্য প্রার্থনা কর) ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে। (অর্থাৎ ঈমান এনে ধৈর্য ও নামাযকে অবশ্য করণীয় হিসেবে গ্রহণ কর। তখন সম্পদের লিন্না ও মর্যাদার মোহ অন্তর থেকে সরে যাবে। এখন যদি কেউ বলে, ধৈর্য ও নামাযকে অবশ্যকরণীয়রূপে গ্রহণ করাও কঠিন কাজ, তবে শুনে নাও) এবং বিনয়ী ও বিনম্রগণ ব্যতীত অন্যদের পক্ষে এ নামায নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন কাজ। আর বিনয়ী তারাই, যারা মনে করে যে, নিঃসন্দেহে তারা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং নিশ্চয়ই তারা তাঁর নিকটে ফিরে যাবে (এবং সেখানে তাদের হিসাব-নিকাশও পেশ করতে হবে। এরূপ দ্বিবিধ ধারণা পোষণের ফলে আগ্রহ ও ভয় উভয়ই সঞ্চারিত হবে এবং এ দু'টি বস্তুই প্রতিটি আমলের প্রাণ)।

সূরা আল-বাকারাহ ৪৩-৪৬নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

আয়াতসমূহের পূর্বাপর সম্পর্ক: বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ্ পাক তাঁর প্রদত্ত সুখ-সম্পদ ও অনুকম্পার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে ঈমান ও সৎকাজের প্রতি আহ্বান করেছেন। পূর্ববর্তী তিন আয়াতে ঈমান ও আকীদা সংক্রান্ত নির্দেশাবলী বর্ণিত হয়েছে। এখন আলোচ্য চার আয়াতে সৎকার্যাবলীর নির্দেশ রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমলের বর্ণনা রয়েছে। আয়াতসমূহের মূল বক্তব্য এই যে, যদি ধন-লিপ্সা ও যশ-খ্যাতির মোহে তোমাদের পক্ষে ঈমান আনা কঠিন বোধ হয়, তবে তার প্রতিবিধান এই যে, ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। এতে ধন-লিলা হ্রাস পাবে। কেননা ধন-সম্পদ মানবের কামনা-বাসনা ও ভোগ চরিতার্থ করার মাধ্যম বলেই তা তাদের নিকট এত প্রিয় ও কাম্য। যখন বল্গাহীনভাবে এ কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার অভিলাষ পরিত্যাগ করতে দৃঢ়সংকল্প হবে, তখন সম্পদ ও প্রাচুর্যের কোন আবশ্যকতাও থাকবে না এবং এর প্রতি কোন মোহ কিংবা আকর্ষণও এত প্রবল হবে না, যা নিজস্ব লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে একেবারে অন্ধ করে দেয়। আর নামায দ্বারা যশ-খ্যাতির মোহ হ্রাস পাবে। কারণ নামাযে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সব রকম বিনয় ও নম্রতাই বর্তমান। যখন সঠিক ও যথাযথভাবে নামায আদায় করার অভ্যাস গড়ে উঠবে, তখন যশ ও পদ-মর্যাদার মোহ এবং অহংকার ও আত্মম্ভরিতা হ্রাস পাবে। সম্পদের লালসা ও যশ-খ্যাতির মোহই ছিল অশান্তির প্রধান উৎস। যে কারণে ঈমান গ্রহণ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। যখন এ অশান্তির উপাদান হ্রাস পাবে, তখন ঈমান গ্রহণ করাও সহজতর হয়ে যাবে।
ধৈর্যধারণ করার জন্য কেবল অপ্রয়োজনীয় কামনা-বাসনাগুলোই পরিহার করতে হয়। কিন্তু নামাযের ক্ষেত্রে অনেকগুলো কাজও সম্পন্ন করতে হয় এবং বহু বৈধ কামনাও সাময়িকভাবে বর্জন করতে হয়। যেমন- পানাহার, কথাবার্তা, চলাফেরা এবং অন্য মানবীয় প্রয়োজনাদি, যেগুলো শরীয়তানুসারে বৈধ ও অনুমোদিত, সেগুলোও নামাযের সময় বর্জন করতে হয়। তাও নির্ধারিত সময়ে দিনরাতে পাঁচবার করতে হয়। এজন্য কিছু সংখ্যক নির্দিষ্ট কার্য সম্পন্ন করা এবং নির্ধারিত সময়ে যাবতীয় বৈধ ও অবৈধ বস্তু ধারণ করার নাম নামায ।

মানুষ অপ্রয়োজনীয় কামনাসমূহ বর্জন করতে সংকল্পবদ্ধ হলে কিছুদিন পর তার স্বাভাবিক চাহিদাও লোপ পেয়ে যায়। কোন প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতা থাকে না। কিন্তু নামাযের সময়সূচির অনুসরণ এবং তৎসম্পর্কিত যাবতীয় শর্ত যথাযথভাবে পালন এবং সব সময়ে প্রয়োজনীয় আশা-আকাঙ্খা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি মানব স্বভাবের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ও আয়াসসাধ্য। এজন্য এখানে সন্দেহের উদ্ভব হতে পারে যে, ঈমানকে সহজলব্ধ করার জন্য ধৈর্য ও নামাযরূপ ব্যবস্থাপত্রের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তার অনুশীলন কঠিন ব্যাপার, বিশেষ করে নামায সম্পর্কিত শর্তাবলী ও নিয়মাবলী পালন ও অনুসরণ করা। নামায সংক্রান্ত এসব জটিলতার প্রতিবিধান প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে, নিঃসন্দেহে নামায কঠিন ও আয়াসসাধ্য কাজ। কিন্তু যাদের অন্তঃকরণে বিনয় বিদ্যমান, তাদের পক্ষে এটা মোটেও কঠিন কাজ নয়। এতে নামাযকে সহজসাধ্য করার ব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে।

মোটকথা, নামায কঠিন বোধ হওয়ার কারণ সম্পর্কে চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, মানবমন কল্পনারাজ্যে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে অভ্যস্ত। আর মানুষের যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও মনেরই অনুসরণ করে। কাজেই যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মনেরই অনুসরণে মুক্তভাবে বিচরণ করতে প্রয়াসী । নামায এরূপ স্বাধীনতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। না বলা, না হাসা, না খাওয়া, না চলা প্রভৃতি নানাবিধ বাধ্যবাধকতার ফলে মন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং মনের অনুগত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও এ থেকে কষ্টবোধ করতে থাকে।

মোটের উপর নামাযের মধ্যে ক্লান্তি ও শ্রান্তিবোধের একমাত্র কারণ হচ্ছে মনের বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারার অবাধ বিচরণ। এর প্রতিবিধান মনের স্থিরতার দ্বারাই হতে পারে  خُشُوْعٌ  বা বিনয়ের অর্থ মূলত سكون قلب বা মনের স্থিরতা। কাজেই বিনয়কে নামায সহজসাধ্য হওয়ার কারণরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হবে : মনের স্থিরতা অর্থাৎ বিনয় কিভাবে লাভ করা যায়? একথা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত যে, যদি কোন ব্যক্তি তার অন্তরের বিচিত্র চিন্তাধারা ও নানাবিধ কল্পনাকে তার মন থেকে সরাসরি দূরীভূত করতে চায়, তবে এতে সফলতা লাভ করা প্রায় অসম্ভব, বরং এর প্রতিবিধান এই যে, মানব মন যেহেতু এক সময় বিভিন্ন দিকে ধাবিত হতে পারে না, সুতরাং যদি তাকে একটি মাত্র চিন্তায় মগ্ন ও নিয়োজিত করে দেওয়া যায়, তবে অন্যান্য চিন্তা ও কল্পনা আপনা থেকেই হৃদয় থেকে বেরিয়ে যাবে। এজন্য  خُشُوْعٌ বা বিনয়ের বর্ণনার পর এমন এক চিন্তার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে, যাতে নিমগ্ন থাকলে অন্যান্য চিন্তা ও কল্পনা প্রশমিত ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং এগুলো দমে যাওয়ার ফলে হৃদয়ের অস্থিরতা দূর হয়ে স্থিরতা জন্মাবে। স্থিরতার দরুন নামায অনায়াসলব্ধ হবে এবং নামাযের উপর স্থায়িত্ব লাভ সম্ভব হবে। আর নামাযের নিয়মানুবর্তিতার দরুন গর্ব-অহংকার ও যশ-খ্যাতির মোহও হ্রাস পাবে। তাছাড়া ঈমানের পথে যেসব বাধা-বিপত্তি রয়েছে তা দূরীভূত হয়ে পূর্ণ ঈমান লাভ সম্ভব হবে। কি চমৎকার সুবিন্যস্ত ও ধারাবাহিক চিকিৎসালয় !
এখন উল্লিখিত ভাব ও চিন্তার বর্ণনা এবং তা শিক্ষা প্রদান এভাবে করেছেন, আর বিনয়ী তারা যারা এ ধারণা পোষণ করে যে, তারা স্বীয় পালনকর্তার সাথে নিঃসন্দেহে সাক্ষাৎ করবে এবং সে সময় এ খেদমতের উত্তম ও যথোচিত পুরস্কার লাভ করবে। তাছাড়া এ ধারণাও পোষণ করে যে, তারা যখন স্বীয় পালনকর্তার নিকট ফিরে যাবে, তখন এর হিসাব-নিকাশও পেশ করতে হবে। এ দু'ধরনের চিন্তা দ্বারা رغبت ورهبت (আসক্তি ও ভীতি) সৃষ্টি হবে। যে কোন সচ্চিন্তায় নিমগ্ন থাকলে মন সৎকাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, বিশেষত সৎকাজে প্রস্তুত ও আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে رغبت ورهبت-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

صَلوة - أقِيمُوا الصَّلوةَ এর শাব্দিক অর্থ-প্রার্থনা বা দোয়া। শরীয়তের পরিভাষায় সেই বিশেষ ইবাদত, যাকে নামায বলা হয়। কোরআন করীমে যতবার নামাযের তাকীদ দেওয়া হয়েছে-সাধারণত اقامت শব্দের মাধ্যমেই দেওয়া হয়েছে। নামায পড়ার কথা শুধু দু'এক জায়গায় বলা হয়েছে। এজন্য اقامت صلوة (নামায প্রতিষ্ঠা)-এর মর্ম অনুধাবন করা উচিত اقامت -এর শাব্দিক অর্থ সোজা করা, স্থায়ী রাখা। সাধারণত যে সব খুঁটি, দেওয়াল বা গাছ প্রভৃতির আশ্রয়ে সোজাভাবে দাঁড়ানো থাকে, সেগুলো স্থায়ী থাকা এবং পড়ে যাওয়ার আশংকা কম থাকে। এজন্য اقامت স্থায়ী ও স্থিতিশীলকরণ অর্থেও ব্যবহৃত হয় ।

কোরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় اقامت صلوة অর্থ-নির্ধারিত সময় অনুসারে যাবতীয় শর্ত ও নিয়ম রক্ষা করে নামায আদায় করা। শুধু নামায পড়াকে اقامت صلوة বলা হয় না । নামাযের যত গুণাবলী, ফলাফল, লাভ ও বরকতের কথা কোরআন-হাদীসে বর্ণনা করা اقامت صلوة (নামায প্রতিষ্ঠা)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন, কোরআন করীমে আছে- إِنَّ الصَّلوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ (নিশ্চয়ই নামায মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।)

নামাযের এ ফল ও ক্রিয়ার তখনই প্রকাশ ঘটবে, যখন নামায উপরে বর্ণিত অর্থে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এজন্য অনেক নামাযীকে অশ্লীল ও ন্যক্কারজনক কাজে জড়িত দেখে এ আয়াতের মর্ম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ঠিক হবে না। কেননা, তারা নামায পড়েছে বটে কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেনি। أتُوا الزَّكَوةَ আভিধানিকভাবে যাকাতের অর্থ দু'রকম-পবিত্র করা ও বর্ধিত হওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় সম্পদের সে অংশকে যাকাত বলা হয়, যা শরীয়তের নির্দেশানুসারে সম্পদ থেকে বের করা হয় এবং শরীয়ত মোতাবেক খরচ করা হয়।

যদিও এখানে সমসাময়িক বনী-ইসরাঈলদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু তাতে একথা প্রমাণিত হয় না যে, নামায ও যাকাত ইসলাম-পূর্ববর্তী বনী ইসরাঈলদের উপরই ফরয ছিল। কিন্তু সূরা মায়েদার আয়াত-

وَلَقَدْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَيْ عَشَرَ نَقِيبًاوقَالَ اللَّهُ إِنِّي مَعَكُمْ لَئِنْ أَقَمْتُمُ الصَّلوةَ وَأَتَيْتُمُ الزَّكوة .

(নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক বনী-ইসরাঈল থেকে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন এবং আমি তাদের মধ্য থেকে বারজন দলপতি মনোনীত করে প্রেরণ করলাম। আর আল্লাহ্ পাক বললেন, যদি তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত আদায় কর, তবে নিশ্চয়ই আমার সাহায্য তোমাদের সাথে থাকবে।) এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বনী-ইসরাঈলের উপর নামায ও যাকাত ফরয ছিল। অবশ্য তার রূপ ও প্রকৃতি ছিল ভিন্ন।

رَكُوعَ  - وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ রুকুর শাব্দিক অর্থ ঝোঁকা বা প্রণত হওয়া। এ অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে এ শব্দ সিজদার স্থলেও ব্যবহৃত হয়। কেননা, সেটাও ঝোঁকারই সর্বশেষ স্তর। কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় ঐ বিশেষ ঝোঁকাকে রুকু বলা হয়, যা নামাযের মধ্যে প্রচলিত। আয়াতের অর্থ এই 'রুকুকারিগণের সাথে রুকু কর।' এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, নামাযের সমগ্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে রুকূকে বিশেষভাবে কেন উল্লেখ করা হলো? উত্তর এই যে, এখানে নামাযের একটি অংশ উল্লেখ করে গোটা নামাযকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন কোরআন মজীদের এক জায়গায় قُرْآنَ الْفَجْر (ফজর নামাযের কোরআন পাঠ) বলে সম্পূর্ণ ফজরের নামাযকে বোঝানো হয়েছে। তাছাড়া হাদীসের কোন কোন রেওয়ায়েতে 'সিজদা' শব্দ ব্যবহার করে পূর্ণ এক রাকা'আত বা গোটা নামাযকেই বোঝানো হয়েছে। সুতরাং এর মর্ম এই যে, নামাযীদের সাথে নামায পড়। কিন্তু এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, নামাযের অন্যান্য অংশের মধ্যে বিশেষভাবে রুকুর উল্লেখের তাৎপর্য কি?

উত্তর এই যে, ইহুদীদের নামাযে সিজদাসহ অন্যান্য সব অঙ্গই ছিল, কিন্তু রুকূ ছিল না । রুকু মুসলমানদের নামাযের বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম। এজন্য رَاكِعِينَ শব্দ দ্বারা উম্মতে মুহাম্মদীর নামাযিগণকে বোঝানো হবে, যাতে রুকুও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তখন আয়াতের অর্থ হবে এই যে, তোমরাও উম্মতে মুহাম্মদীর নামাযীদের সাথে নামায আদায় কর। অর্থাৎ, প্রথম ঈমান গ্রহণ কর, পরে জামাতের সাথে নামায আদায় কর ।

নামাযের জামাত সম্পর্কিত নির্দেশাবলী

নামাযের হুকুম এবং তা ফরয হওয়া তো أقِيمُوا الصَّلوةَ শব্দের দ্বারা বোঝা গেল। এখানে مَعَ الرَّاكِعِينَ (রুকুকারীদের সাথে) শব্দের দ্বারা নামায জামাতের সাথে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ হুকুমটি কোন্ ধরনের? এ ব্যাপারে উলামা ও ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সাহাবা, তাবেয়ীন এবং ফুকাহাদের মধ্যে একদল জামাতকে ওয়াজিব বলেছেন এবং তা পরিত্যাগ করাকে কঠিন পাপ বলে অভিহিত করেছেন। কোন কোন সাহাবী তো শরীয়তসম্মত ওযর ব্যতীত জামাতহীন নামায জায়েয নয় বলেই মন্তব্য করেছেন। যারা জামাত ওয়াজিব হওয়ার প্রবক্তা এ আয়াতটি তাদের দলীল। এতদ্ভিন্ন কতক হাদীস দ্বারা জামাত ওয়াজিব বলে বোঝা যায়। যেমন- لاصلوة لجار المسجد الا في المسجد (মসজিদের প্রতিবেশিগণের নামায মসজিদ ভিন্ন কোথাও জায়েয নয়) আর মসজিদের নামায অর্থ যে জামাতের নামায এটা সুস্পষ্ট। সুতরাং শব্দগতভাবে হাদীসের অর্থ এই যে, মসজিদের নিকটস্থ অধিবাসীদের নামায জামাত ব্যতীত জায়েয নয়। মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, একজন অন্ধ সাহাবী হুযূর (সা)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, আমাকে মসজিদে পৌঁছাতে এবং সেখান থেকে নিয়ে যেতে পারে-আমার সাথে এমন লোক নেই। যদি আপনি অনুমতি দেন, তবে ঘরে বসেই নামায পড়বো। হুযুর (সা) প্রথমে তাকে অনুমতি দিলেন, কিন্তু রওয়ানা হওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাড়ী থেকে আযান শোনা যায় কি ? সাহাবী (রা) আরয করলেন, আযান তো অবশ্যই শুনতে পাই। হুযূর (সা) বললেন, তাহলে তোমারতো শরীক হওয়া উচিত। অন্য রেওয়ায়েতে আছে- তিনি বললেন, তাহলে তোমাদের জন্য অন্য কোন সুযোগ বা অবকাশ দেখতে পাচ্ছি না ।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযূর (সা) এরশাদ করেছেন: من سمع النداء فلم يجب فلا صلواة الا من عذر (কোন ব্যক্তি আযান শোনার পর শরীয়তসম্মত ওযর ব্যতীত যদি জামাতে উপস্থিত না হয়, তবে তার নামায হবে না)। এসব হাদীসের ভিত্তিতে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মসউদ, আবু মূসা আশ'আরী (রা) প্রমুখ সাহাবী ফতওয়া দিয়েছেন, যে ব্যক্তি মসজিদের এত নিকটে থাকে, যেখান থেকে আযানের আওয়াজ শোনা যায়, শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া সে যদি জামাতে শরীক না হয়, তবে তার নামায আদায় হবে না। (আওয়াজ শোনার অর্থ-মধ্যম ধরনের স্বরের অধিকারী লোকের আওয়াজ যেখানে পৌঁছাতে পারে। যন্ত্র বর্ধিত আওয়াজ বা অসাধারণ উঁচু আওয়াজ ধর্তব্য নয়।)

এসব রেওয়ায়েত জামাত ওয়াজিব হওয়ার প্রবক্তাগণের স্বপক্ষে দলীল। কিন্তু অধিকাংশ উলামা, ফুকাহা, সাহাবা ও তাবেঈনের মতে জামাত হল সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ । কিন্তু ফজরের সুন্নতের ন্যায় সর্বাধিক তাকীদপূর্ণ সুন্নত। ওয়াজিবের একেবারে নিকটবর্তী। কোরআন করীমে বর্ণিত,  وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ (এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর) اَمْرٌ (নির্দেশ)-কে এসব বিশেষজ্ঞগণ আয়াত ও রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে তাকীদ বলে সাব্যস্ত করেছেন। আর বাহ্যিকভাবে যেসব হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে, মসজিদের নিকটে বসবাসকারীদের নামায জামাত ব্যতীত আদায় হয় না- তার অর্থ এই বলে প্রকাশ করেছেন যে, এ নামায পরিপূর্ণ গ্রহণযোগ্য নয়। এ সম্পর্কে মুসলিম শরীফে বর্ণিত হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মসউদ (রা)-এর রেওয়ায়েতই যথেষ্ট। সেখানে একদিকে যেমন জামাতের তাকীদ, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার বর্ণনা রয়েছে, সাথে সাথে এর মর্যাদার ও স্তরের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তা 'সুনানে হুদা'র পর্যায়ভুক্ত, যাকে ফকীহগণ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং কেউ যদি রোগ-ব্যাধি প্রভৃতি কোন শরীয়তস্বীকৃত কারণ ছাড়া জামাতে শরীক না হয়ে একাকী নামায পড়ে নেয়, তবে তার নামায হয়ে যাবে, কিন্তু সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ছেড়ে দেওয়ার দরুন সে শাস্তিযোগ্য হবে। অথচ যদি জামাত ছেড়ে দেওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করে নেয়, তবে মস্ত বড় পাপী হবে। বিশেষত যখন এমন অবস্থা হয় যে, মানুষ ঘরে বসে নামায পড়ে মসজিদ বিরাণ হতে থাকে, তখন এরা সবাই শরীয়তানুযায়ী শান্তিযোগ্য হবে। কাজী আয়ায (র) বলেছেন যে, এসব লোককে বোঝানোর পরেও যদি ফিরে না আসে, তবে এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হবে।

আমলহীন উপদেশ প্রদানকারীর নিন্দা

أتَأْمُرُونَ النَّاسِ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَأَنْفُسَكُمْ (তোমরা অন্যকে সৎকাজের নির্দেশ দাও অথচ নিজেদেরকে ভুলে বস)। এ আয়াতে ইহুদী আলেমদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে তাদেরকে ভর্ৎসনা করা হচ্ছে যে, তারা তো নিজেদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে মুহাম্মদ (সা)-এর অনুসরণ করতে এবং ইসলামের উপর স্থির থাকতে নির্দেশ দেয়। ( এ থেকে বোঝা যায় ইহুদী আলেমগণ দীন ইসলামকে নিশ্চিতভাবে সত্য বলে মনে করত)। নিজেরা প্রবৃত্তির কামনার দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত ছিল যে, ইসলাম গ্রহণ করতে কখনো প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু যারাই অপরকে পুণ্য ও মঙ্গলের প্রেরণা দেয়, অথচ নিজের ক্ষেত্রে তা কার্যে পরিণত করে না, প্রকৃত প্রস্তাবে তারা সবাই ভর্ৎসনা ও নিন্দাবাদের অন্তর্ভুক্ত। এ শ্রেণীর লোকদের সম্পর্কে হাদীসে করুণ পরিণতি ও ভয়ংকর শাস্তির প্রতিশ্রুতি রয়েছে। হযরত আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, হুযূর (সা) এরশাদ করেন, মি'রাজের রাতে আমি এমন কিছু সংখ্যক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম যাদের জিহবা ও ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল। আমি জিবরাঈল (আ)-কে জিজ্ঞেস করলাম-এরা কারা? জিবরাঈল বললেন-এরা আপনার উম্মতের পার্থিব স্বার্থপূজারী উপদেশদানকারী, যারা অপরকে তো সৎকাজের নির্দেশ দিত, কিন্তু নিজের খবর রাখতো না। (কুরতুবী)

নবী করীম (সা) এরশাদ করেছেন, কতিপয় জান্নাতবাসী কতক নরকবাসীকে অগ্নিদগ্ধ হতে দেখে জিজেস করলেন যে, তোমরা কিভাবে দোযখে প্রবেশ করলে অথচ আল্লাহ্র কসম, আমরা তো সেসব সৎকাজের দৌলতেই জান্নাত লাভ করেছি, যা তোমাদের কাছে শিখেছিলাম। দোযখবাসীরা বলবে, আমরা মুখে অবশ্য বলতাম কিন্তু নিজে তা কাজে পরিণত করতাম না ।

পাপী ওয়ায়েজের উপদেশ প্রদান

উল্লেখিত বর্ণনা থেকে একথা যেন বোঝা না হয় যে, কোন আমলহীন বিরুদ্ধাচারীর পক্ষে অপরকে উপদেশ দান করা জায়েয নয় এবং কোন ব্যক্তি যদি কোন পাপে লিপ্ত থাকে, তবে সে অপরকে উক্ত পাপ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে পারে না। কারণ, সৎকাজের জন্য ভিন্ন নেকী ও সৎকাজের প্রচার-প্রসারের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র নেকী। আর এটা সুস্পষ্ট যে, এক নেকী পরিহার করলে অপর নেকীও পরিহার করতে হবে এমন কোন কথা নেই, যেমন, কোন ব্যক্তি নামায না পড়লে অপরকেও নামায পড়তে বলতে পারবে না, এমন কোন কথা নয়। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি নামায না পড়লে রোযাও রাখতে পারবে না, এমন কোন কথা নেই। তেমনিভাবে কোন অবৈধ কাজে লিপ্ত হওয়া ভিন্ন পাপ এবং নিজের অধীনস্থ লোকদেরকে ঐ অবৈধ কাজ থেকে বারণ না করা পৃথক পাপ। একটি পাপ করেছে বলে অপর পাপও করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই ।

যদি প্রত্যেক মানুষ নিজে পাপী বলে সৎকাজের নির্দেশ দান ও অসৎ কাজ থেকে বাধাদান করা ছেড়ে দেয় এবং বলে যে, যখন নিষ্পাপ হতে পারবে, তখনই অপরকে উপদেশ দেবে, তাহলে ফল দাঁড়াবে এই যে, কোন তাবলীগকারীই অবশিষ্ট থাকবে না। কেননা, এমন কে আছে, যে পরিপূর্ণ নিষ্পাপ ? হযরত হাসান (রা) এরশাদ করেছেন-শয়তান তো তা-ই চায় যে, মানুষ এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে তাবলীগের দায়িত্ব পালন না করে বসে থাক ।

মূল কথা এই যে, أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ (তোমরা কি অপরকে সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং নিজেদেরকে তুলে বস ?) আয়াতের অর্থ এই যে, উপদেশ দানকারী (ওয়ায়েজকে) আমলহীন থাকা উচিত নয়। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ওয়ায়েজ কিংবা ওয়ায়েজ নয়—এমন কারো পক্ষেই যখন আমলহীন থাকা জায়েয নয়, তাহলে এখানে বিশেষভাবে ওয়ায়েজের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা কি ? উত্তর এই যে, বিষয়টি উভয়ের জন্য নাজায়েয, কিন্তু ওয়ায়েজ বহির্ভূতদের তুলনায় ওয়ায়েজের অপরাধ অধিক মারাত্মক। কেননা, ওয়ায়েজ অপরাধকে অপরাধ মনে করে জেনে শুনে করছে। তার পক্ষে এ ওযর গ্রহণযোগ্য নয় যে, এটা যে অপরাধ তা আমার জানা ছিল না। অপরপক্ষে ওয়ায়েজ বহির্ভূত মূর্খদের অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। এছাড়া ওয়ায়েজ ও আলেম যদি কোন অপরাধ করে তবে তা হয় ধর্মের সাথে এক প্রকারের পরিহাস। হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, হুযূর (সা) এরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ পাক অশিক্ষিত লোকদেরকে যত ক্ষমা করবেন, শিক্ষিতদেরকে তত ক্ষমা করবেন না।

দু'টি মানসিক ব্যাধি ও তার প্রতিকার

সম্পদ-প্রীতির ও যশ-খ্যাতির মোহ এমন ধরনের দু'টি মানসিক ব্যাধি, যদ্দরুন ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনই নিষ্প্রভ ও অসার হয়ে পড়ে। গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, মানবেতিহাসে এযাবৎ যতগুলো মানবতা বিধ্বংসী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং যত বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি বিস্তার লাভ করেছে, সেগুলোর উৎপত্তিই হয়েছিল উল্লেখিত এ দু'টি ব্যাধি থেকে। 

সম্পদ প্রাপ্তির পরিণতি ও ফলাফল

(১) অর্থ গৃধুতা ও কৃপণতার অন্যতম জাতীয় ক্ষতির দিক হল এই যে, তার সম্পদ জাতির কোন উপকারে আসে না । দ্বিতীয় ক্ষতিটি তার ব্যক্তিগত। এ প্রকৃতির লোককে সমাজে কখনও সুনজরে দেখা হয় না ।

(২) স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা ও তার সম্পদ লিপ্সা পূরণার্থে জিনিসে ভেজাল মেশানো, মাপে কম দেওয়া, মজুদদারী, মুনাফাখোরী, প্রবঞ্চনা-প্রতারণা প্রভৃতি ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন তার মজ্জাগত হয়ে যায় । স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে সে অপরের রক্ত নিংড়ে নিতে চায়। পরিশেষে পুঁজিপতি ও মজুরদের পারস্পরিক বিবাদের উৎপত্তি হয়।

(৩) এমন লোক যত সম্পদই লাভ করুক, কিন্তু আরো অধিক উপার্জনের চিন্তা তাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে, অবকাশ ও অবসর বিনোদনের সময়েও তার একই ভাবনা থাকে যে, কিভাবে তার পুঁজি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে যে সম্পদ তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে পরিণত হতে পারত তা পরিণামে তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

(৪) সত্য কথা যত উজ্জ্বল হয়েই সামনে উদ্ভাসিত হোক না কেন, তার এমন কোন কথা মনে নেওয়ার সৎসাহস থাকে না, যাকে সে তার উদ্দেশ্য সাধন ও সম্পদ লাভের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করে। এসব বিষয় পরিশেষে গোটা সমাজের শান্তি বিনষ্ট করে ।

গভীরভাবে চিন্তা করলে যশ-খ্যাতির মোহের অবস্থাও প্রায় একই রকম বলে পরিলক্ষিত হবে। এর ফলশ্রুতিস্বরূপ অহংকার, স্বার্থান্বেষী, অধিকার হরণ, ক্ষমতা লিপ্সা এবং এর পরিণতিতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও অনুরূপ আরো অগণিত মানবেতর সমাজবিরোধী ও নৈতিকতা বিবর্জিত দাঙ্গা-হাঙ্গামার উৎপত্তি ঘটে, যা পরিণামে গোটা বিশ্বকে নরকে পরিণত করে দেয়। এই উভয় ব্যাধির প্রতিকার কুরআন পাক এভাবে উপস্থাপন করেছে-বলা হয়েছে: وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ (তোমরা নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।) অর্থাৎ ধৈর্যধারণ করে ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে বশীভূত করে ফেলে। তাতে সম্পদপ্রীতি হ্রাস পাবে। কেননা, সম্পদ বিভিন্ন আস্বাদ ও কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার মাধ্যম বলেই ধন-প্রেমের উদ্ভব হয়। যখন এসব আস্বাদ ও কামনা-বাসনার অন্ধ অনুসরণ পরিহার করতে দৃঢ়সংকল্প হবে, তখন প্রাথমিক অবস্থার খানিকটা কষ্টবোধ হলেও ধীরে ধীরে এসব কামনা যথোচিত ও ন্যায়সঙ্গত পর্যায়ে নেমে আসবে এবং ন্যায় ও মধ্যম পন্থা তোমাদের স্বভাব ও অভ্যাসে পরিণত হবে। তখন আর সম্পদের প্রাচুর্যের কোন আবশ্যকতা থাকবে না। সম্পদের মোহও এত প্রবল হবে না যে, নিজস্ব লাভ-ক্ষতির বিবেচনা ও নেশা তোমাকে অন্ধ করে দেবে।

আর নামায দ্বারা যশ-খ্যাতির আকর্ষণও দমে যাবে। কেননা নামাযের মধ্যে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সব ধরনের বিনয় ও নম্রতাই বিদ্যমান। যখন যথানিয়মে ও যথাযথভাবে নামায আদায় করার অভ্যাস গড়ে উঠবে, তখন সর্বক্ষণ আল্লাহ পাকের সামনে নিজের অক্ষমতা ও ক্ষুদ্রতার ধারণা বিরাজ করতে থাকবে। ফলে অহংকার, আত্মম্ভরিতা ও মান-মর্যাদার মোহ হ্রাস পাবে।

বিনয়ের নিগূঢ় তত্ত্ব

إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ (কিন্তু বিনয়ীদের পক্ষে মোটেও কঠিন নয়।) কুরআন ও সুন্নাহ যেখান خُشُوْعٌ বা বিনয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদানের বর্ণনা রয়েছে, সেখানে এর অর্থ অক্ষমতা ও অপারগতাজনিত সেই মানসিক অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ পাকের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও দীনতার অনুভূতি থেকে সৃষ্টি। এর ফলে ইবাদত-উপাসনা সহজতর হয়ে যায়। কখনও এর লক্ষণাদি দেহেও প্রকাশ পেতে থাকে। তখন এ শিষ্টাচার-সম্পন্ন বিনম্র ও কোমলমন বলে পরিদৃষ্ট হয়। যদি হৃদয়ে আল্লাহ্-ভীতি ও নম্রতা না থাকে, তবে মানুষ বাহ্যিকভাবে যতই শিষ্টাচারের অধিকারী ও বিনম্র হোক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে সে বিনয়ের অধিকারী হয় না। বিনয়ের লক্ষণাদি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করাও পছন্দনীয় ও বাঞ্ছনীয় নয়।

হযরত উমর (রা) একবার এক যুবককে নতশিরে বসে থাকতে দেখে বললেন, 'মাথা ওঠাও, বিনয় হৃদয়ে অবস্থান কর।'

হযরত ইব্রাহীম নখয়ী (র) বলেন, মোটা কাপড় পরা, মোট খাওয়া এবং মাথা নত করে থাকার নামই বিনয় নয় ।

خُشُوْعٌ বা বিনয় অর্থ حق বা অধিকারের ক্ষেত্রে ইতর-ভদ্র নির্বিশেষে সবার সঙ্গে একই রকম ব্যবহার করা এবং আল্লাহ্ পাক তোমার উপর যা ফরয করে দিয়েছেন, তা পালন করতে গিয়ে হৃদয়কে শুধু তারই জন্য নির্দিষ্ট ও কেন্দ্রীভূত করে নেওয়া ।

সারকথা-ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম উপায়ে বিনয়ীদের রূপ ধারণ করা শয়তান ও প্রবৃত্তির প্রতারণামাত্র। আর তা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। অবশ্য যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তবে তা ক্ষমার্হ ।

জ্ঞাতব্যঃ خُشُوْعٌ -এর সাথে সাথে অপর একটি শব্দ خُضوْعٌ ও ব্যবহৃত হয়। কোরআন করীমের বিভিন্ন জায়গায়ও তা রয়েছে। এ শব্দ দু’টি প্রায় সমার্থক। কিন্তু خُشُوْعٌ শব্দ মূলত কণ্ঠ ও দৃষ্টির নিম্নমুখিতা ও বিনয় প্রকাশার্থ ব্যবহৃত হয় যখন তা কৃত্রিম হবে না, বরং অন্তরের ভীতি ও নম্রতার ফলস্বরূপ হবে। কোরআন করীমে আছে خَشَعَت الْأَصْوَات (শব্দ নীচু হয়ে গেল।) এবং خُضوْعٌ - শব্দে দৈহিক ও বাহ্যিক বিনয় ও ক্ষুদ্রতাকে বোঝায়। কোরআন করীমে আছে فَظَلَّتْ أَعْنَاقُهُمْ لَهَا خَاضِعِينَ (অতঃপর তাদের কাঁধ তার সামনে ঝুঁকিয়ে দিল।)

নামাযে বিনয়ের ফেকাগত মর্যাদা

নামাযে خُشُوْعٌ বিনয়ের তাকীদ বারবার এসেছে। এরশাদ হয়েছেঃ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي (আমার স্মরণে নামায প্রতিষ্ঠা কর) এবং একথা স্পষ্ট যে, غَفَلَتْ (অমনোযোগিতা) স্মরণের পরিপন্থী। যে ব্যক্তি আল্লাহ থেকে غافل (অমনোযোগী) সে আল্লাহকে স্মরণ করার দায়িত্ব পালন করতে সমর্থ নয়। এক আয়াতে এরশাদ হয়েছেঃ وَلَا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ (এবং অমনোযোগীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)।  রাসূলুল্লাহ (সা) এরশাদ করেছেনঃ নামায বিনয় ও ক্ষুদ্রতা প্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। অন্য কথায়, অন্তরে বিনয় ও ক্ষুদ্রতা-বোধ না থাকলে তা নামাযই নয়। অপর এক হাদীসে আছে যার নামায তাকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত না রাখে, সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আর গাফেল বা অমনোযোগীর নামায তাকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এ থেকে বোঝা গেল, যে লোক অন্যমনস্ক হয়ে নামায পড়ে, সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ইমাম গাযালী (র) উল্লিখিত আয়াত ও রেওয়ায়েতসমূহ এবং অন্য উদ্ধৃতি দিয়ে এরশাদ করেছেন, এগুলোর দ্বারা বোঝা যায় যে, خُشُوْعٌ বা বিনয় নামাযের শর্ত এবং নামাযের বিশুদ্ধতা এরই উপর নির্ভরশীল। হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রা), সুফিয়ান সওরী ও হাসান বসরী (র) প্রমুখের অভিমত এই যে, খুশু ও বিনয় ব্যতীত নামায আদায় হয় না, বরং তা ভঙ্গ হয়ে যায়।

 কিন্তু ইমাম চতুষ্টয় ও অধিকাংশ ফকীহর মতে খুশু নামাযের শর্ত না হলেও তারা একে নামাযের রূহ বা আত্মা বলে মন্তব্য করে এ শর্ত আরোপ করেছেন যে, তাকবীরে তাহরীমার সময় বিনয়সহ মনের একাগ্রতা বজায় রেখে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামযের নিয়ত করতে হবে। পরে যদি খুশু (خُشُوْعٌ) বিদ্যমান না থাকে তবে যদিও সে নামাযের অতটুকু অংশের সওয়াব লাভ করবে না, যে অংশে খুশু উপস্থিত ছিল না, তবে ফেকাহ্ অনুযায়ী তাকে নামায পরিত্যাগকারীও বলা চলবে না এবং নামায পরিত্যাগকারীর উপর যে শাস্তি প্রযোজ্য, তার জন্য সে শাস্তি বিধানও করা যাবে না। কারণ ফকীহগণ মানসিক ও আভ্যন্তরীণ অবস্থাদি বিবেচনা করে হুকুম প্রয়োগ করেন না, বরং তারা নিছক বাহ্যিক কার্যাবলীর ভিত্তিতে হুকুম বর্ণনা করেন। কোন কাজের সাওয়াব পরকালে পাবে কি পাবে না একথা ফেকাহ্ শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়ই নয়। সুতরাং যেহেতু অভ্যন্তরীণ অবস্থার ভিত্তিতে হুকুম প্রয়োগ করা তাঁদের আলোচনাবহির্ভূত এবং খুশু (বিনয়) একটি আভ্যন্তরীণ অবস্থা। সুতরাং তাঁরা খুশুকে সম্পূর্ণ নামাযের শর্ত নির্ধারণ করেন নি, বরং খুশুর ন্যূনতম পর্যায়কে শর্ত সাব্যস্ত করেছেন। আর তা হল এই যে, কমপক্ষে তাকবীরে তাহরীমার সময় তা যেন বিদ্যমান থাকে।

খুশুকে গোটা নামাযে শর্ত নির্ধারণ না করার দ্বিতীয় কারণ এই যে, কুরআন করীমের অন্যান্য আয়াতে শরীয়তী বিধান প্রয়োগের সুস্পষ্ট নীতি বাতলে দেওয়া হয়েছে যে, মানুষের জন্য এমন কোন কাজ ফরয করা হয়নি, যা তার ক্ষমতা ও সাধ্যের অতীত। পুরো নামাযে খুশু বজায় রাখা কিছু সংখ্যক বিশেষ ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং সাধ্যাতীত দায়িত্ব আরোপ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য পুরো নামাযের স্থলে কেবল নামাযের প্রারম্ভিক স্তরে খুশুকে শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।

খুশুহীন নামাযও সম্পূর্ণ নিরর্থক নয়

সবশেষে ‘খুশু’র এ অসাধারণ গুরুত্ব সত্ত্বেও মহান পরওয়ারদিগারের দরবারে আমাদের এই কামনা যেন অন্যমনস্ক ও গাফেল নামাযীও সম্পূর্ণভাবে নামায পরিত্যাগকারীর পর্যায়ভুক্ত না হয়। কেননা যে অবস্থায়ই হোক, সে অন্তর ফরয আদায়ের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সামান্য সময়ের জন্য হলেও অন্তরকে যাবতীয় আকর্ষণ থেকে মুক্ত করে আল্লাহর প্রতি নিয়োজিত করেছে। কেননা, কমপক্ষে নিয়তের সময় শুধু সে আল্লাহ্ পাকেরই ধ্যানে নিমগ্ন ছিল। এ ধরনের নামাযে অন্তত এতটুকু উপকার অবশ্যই হবে যে, তাদের নাম অবাধ্য ও বেনামাযীদের তালিকা-বহির্ভূত থাকবে।

কিন্তু তা নাহলে অন্যমনস্কদের অবস্থা পরিত্যাগকারীদের চাইতেও করুণ ও নিকৃষ্ট হয়ে যেতে পারে। কেননা, যে গোলাম প্রভুর খেদমতে উপস্থিত থেকেও তার প্রতি অমনোযোগী থাকে এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলে, তার অবস্থা যে গোলাম আদৌ খেদমতে হাযির হয় না তার চাইতে অধিক ভয়াবহ ও মারাত্মক।

সারকথা, এটা আশা ও নিরাশার ব্যাপার ; এতে শাস্তির আশঙ্কাও রয়েছে, পুরস্কারের আশাও রয়েছে।




***********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url