মা’আরেফুল কোরআন - ৩৪ || সূরা আল-বাকারাহ ১০৪-১০৭নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১০৪

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقُوۡلُوۡا رَاعِنَا وَ قُوۡلُوا انۡظُرۡنَا وَ اسۡمَعُوۡا ؕ وَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۱۰۴

সূরা আল-বাকারাহ ১০৪ নং আয়াতের অর্থ

(১০৪) হে মু'মিনগণ, তোমরা 'রারিনা' বলো না- 'উনযুরনা' বল এবং শুনতে থাক আর কাফিরদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।

সূরা আল-বাকারাহ ১০৪ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

[কোন কোন ইহুদী রসূলুল্লাহ (সা))-এর নিকট এসে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে তাঁকে ‘রায়িনা’ বলে সম্বোধন করত। হিব্রু ভাষায় এর অর্থ একটি বদদোয়া। তারা এ নিয়তেই তা বলত। কিন্তু আরবী ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে ’আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন।’ ফলে আরবী ভাষীরা তাদের এই দুরভিসন্ধি বুঝতে পারত না। ভাল অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে কোন কোন মুসলমানও রসূলুল্লাহ্ (সা)-কে এই শব্দে সম্বোধন করতেন। এতে দুষ্টরা আরও আশকারা পেতো। তারা পরস্পর বসে হাসাহাসি করত আর বলত, এতদিন আমরা গোপনেই তাকে মন্দ বলতাম। এখন এতে মুসলমানদেরও শরীক হওয়ার কারণে প্রকাশ্যে মন্দ বলার সুযোগ এসেছে। তাদের এই সুযোগ নষ্ট করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা’আলা নির্দেশ দিচ্ছেনঃ হে মু’মিনগণ, তোমরা ’রায়িনা’ (শব্দটি) বলো না। (এর পরিবর্তে ) ’উনযুরনা’ বলবে। (কেননা, আরবী ভাষায় ‘রায়িনা’ ও ’উনযুরনা’র অর্থ এক হলেও ’রায়িনা’ বললে ইহুদীরা দুষ্টুমির সুযোগ পায়। তাই একে বর্জন করে অন্য শব্দ ব্যবহার কর)। আর এ নির্দেশটি (ভালরূপে) শুনে নাও ( এবং স্মরণ রাখ)। কাফিরদের জন্যে তো বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছেই। (কারণ, ওরা ধূর্ততা সহকারে পয়গম্বরের প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে)।
আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, আপনার কোন জায়েয কাজ থেকে যদি অন্যরা নাজায়েয কাজের আশকারা পায়, তবে সে জায়েয কাজটিও আপানার পক্ষে জায়েয থাকবে না। উদাহরণত কোন আলিমের কোন কাজ দেখে যদি সাধারণ লোকেরা বিভ্রান্ত হয় এবং নাজায়েয কাজে লিপ্ত হয়, তবে সে আলিমের জন্য সে জায়েয কাজটিও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তবে শর্ত এই যে, সংশ্লিষ্ট কাজটি শরীয়তের দৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় হওয়া উচিত। কোরআন ও হাদীসে এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর একটি প্রমাণ ঐ হাদীস, যাতে রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, জাহেলিয়াত যুগে কোরাইশরা যখন কা’বাগৃহ পুননির্মাণ করে, তখন এতে কয়েকটি কাজই এমন করা হয়েছে, যা ইবরাহীম (আ) কর্তৃক রচিত ভিত্তির সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। আমার মন চায়, একে ভেঙে আবার ইবরাহীমী ভিত্তির অনুরূপ করে দেই। কিন্তু কা’বাগৃহ ভেঙে দিলে অজ্ঞ জনগণের বিভ্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই আমি স্বীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করছি না—এ বিধানটি সমস্ত ফেকাহবিদের কাছেই গ্রহণীয়। তবে হাম্বলী মযহাবের আলেমগণ এ ব্যাপারে অধিক সাবধানতা অবলম্বনের পক্ষপাতী।


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১০৫

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

مَا یَوَدُّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ اَهۡلِ الۡکِتٰبِ وَ لَا الۡمُشۡرِکِیۡنَ اَنۡ یُّنَزَّلَ عَلَیۡکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ یَخۡتَصُّ بِرَحۡمَتِهٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ ﴿۱۰۵

সূরা আল-বাকারাহ ১০৫ নং আয়াতের অর্থ

(১০৫) আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফির, তাদের মনঃপুত নয় যে, তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হোক। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষভাবে দ্বীর অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহ মহান অনুগ্রহদাতা।

সূরা আল-বাকারাহ ১০৫ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

পূর্ববর্তী আয়াতে রসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে ইহুদীদের আচরণ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে মুসলমানদের সাথে ইহুদীদের আচরণ সম্পর্কে বিবৃত হচ্ছে। কোন কোন ইহুদী কোন কোন মুসলমানকে বলত, আল্লাহর কসম আমরা অন্তর দ্বারা তোমাদের শুভেচ্ছা কামনা করি। তোমরা আমাদের চাইতে উত্তম ধর্মীয় বিধি-বিধান প্রাপ্ত হও—আমরা মনেপ্রাণে তাই আশা করি। এরূপ হলে আমরাও তা কবূল করব। কিন্তু ঘটনাচক্রে তোমাদের ধর্ম আমাদের ধর্মের চাইতে শ্রেষ্ঠ হতে পারেনি। আল্লাহ তা’আলা হিতাকাঙ্ক্ষার এই ভানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে বলেন, (মুশরিক হোক অথবা আহলে-কিতাব হোক) কাফিরদের (একটুও) মনঃপূত নয় যে, তোমরা পালনকর্তার পক্ষ থেকে কোন প্রকার শ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্ত হও। (তাদের এ হিংসায় কিছু আসে যায় না। কারণ) আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা বিশেষভাবে স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন । আর আল্লাহ হচ্ছেন মহান অনুগ্রহদাতা।
ইহুদীদের দাবি ছিল দু’টি (এক) ইহুদীবাদ ইসলামের চাইতে শ্রেষ্ঠ। (দুই) তারা মুসলমানদের শুভাকাঙ্ক্ষী। প্রথম দাবিটি তারা প্রমাণ করতে পারেনি। নিছক দাবিতে কিছু হয় না। এছাড়া দাবিটি নিরর্থকও বটে। কারণ, ’নাসিখ’ (যে রহিত করে) আগমন করলে ‘মনসূখ’ (যাকে রহিত করা হয়) বর্জনীয় হয়ে যায়। তা উত্তম ও অধমের পার্থক্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। এই উত্তরটি সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত, এ কারণে আয়াতে তা উল্লেখ করা হয়নি। আয়াতে শুধু দ্বিতীয় দাবিটি নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়বস্তুকে শক্তিশালী ও জোরদার করার উদ্দেশ্যে

আহলে-কিতাবদের সাথে মুশরিকদের উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ মুশরিকরা যেমন নিশ্চিতরূপেই তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী নয় তাদেরকেও তেমনি মনে করো।


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১০৬-১০৭

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

مَا نَنۡسَخۡ مِنۡ اٰیَۃٍ اَوۡ نُنۡسِهَا نَاۡتِ بِخَیۡرٍ مِّنۡهَاۤ اَوۡ مِثۡلِهَا ؕ اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰهَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۱۰۶
اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰهَ لَهٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ ﴿۱۰۷

সূরা আল-বাকারাহ ১০৬-১০৭ নং আয়াতের অর্থ

(১০৬) আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান? (১০৭) তুমি কি জান না যে, আল্লাহর জন্যই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য? আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই।

সূরা আল-বাকারাহ ১০৬-১০৭ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

(কেবলা পরিবর্তনের ঘটনা সংঘটিত হলে ইহুদীরা তিরস্কার করতে থাকে এবং কোন কোন বিধান রহিত করার কারণে মুশরিকরাও মুসলমানদের প্রতি বিদ্রূপবান বর্ষণ করতে শুরু করে। আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের তিরস্কার ও আপত্তির জওয়াব দিয়েছেন।) আমি কোন আয়াতের বিধান রহিত করে দিলে (যদিও কোরআনে অথবা স্মৃতিতে সে আয়াত অবশিষ্ট থাকে) অথবা (আয়াতটিকেই স্মৃতি থেকে) বিস্মৃত করিয়ে দিলে (তা কোন আপত্তির বিষয় নয়। কারণ যুক্তিসঙ্গত কারণেই তা করা হয়। সেমতে) তদপেক্ষা উত্তম আয়াত বা তার সমপর্যায়ের আয়াত (তদস্থলে আনয়ন করি। হে আপত্তিকারিগণ) তোমরা কি জান যে, আল্লাহ্ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান? (এমন ক্ষমতাবানের পক্ষে উপযোগিতার প্রতি লক্ষ্য রাখা কঠিন ?) তোমরা কি জান না যে, নভোমণ্ডলে একমাত্র তাঁরই রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত (এহেন বিরাট রাজত্বে যখন তাঁর কোন অংশীদার নেই, তখন উপযোগিতার প্রতি লক্ষ্য করে ভিন্ন নির্দেশ দিলে তাকে কে বাধা দিতে পারে? মোটকথা, ভিন্ন নির্দেশ দান এবং প্রস্তাব ও তা কার্যকরী করার ব্যাপারে তাঁর প্রতিবন্ধক কেউ নেই ।) আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই। (তিনি যখন বন্ধু, তখন বিধি-বিধানে অবশ্যই উপযোগিতার প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। আর তিনি সাহায্যকারী, তখন বিধান পালন করার সময় শত্রুদের আগমন থেকেও তোমাদের হেফাযত করবেন। তবে বৃহত্তর পারলৌকিক কল্যাণের লক্ষ্যে বাহ্যত তোমাদের উপর শত্রুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে তা ভিন্ন কথা।


সূরা আল-বাকারাহ ১০৬-১০৭ নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا -এই আয়াতে কোরআনী আয়াত রহিত হওয়ার সম্ভাব্য সকল প্রকারই সন্নিবেশিত রয়েছে। অভিধানে ’নসখ’ শব্দের অর্থ দূর করা, লেখা। সমস্ত মুসলিম টীকাকার এ বিষয়ে একমত যে, আয়াতে ’নসখ’ শব্দ দ্বারা বিধি-বিধান দূর করা অর্থাৎ রহিত করা বোঝানো হয়েছে। এ কারণেই হাদীস ও কোরআনের পরিভাষায় এক বিধানের স্কুলে অন্য বিধান প্রবর্তন করাকে ’নসখ’ বলা হয়। অন্য বিধানটি’ কোন বিধানের বিলুপ্ত ঘোষণাও হতে পারে, আবার এক বিধানের পরিবর্তে অপর বিধান বলে দেওয়াও হতে পারে।

আল্লাহর বিধানে নসখের স্বরূপ

জগতের রাষ্ট্র ও আইন-আদালতে এক নির্দেশকে রহিত করে অন্য নির্দেশ জারি করার ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত। রচিত আইনে ’নসখ’ বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। (১) ভুল ধারণার উপর নির্ভর করে প্রথমে যদি কোন আইন প্রবর্তন করা হয়, তবে পরে বিষয়টির প্রকৃত স্বরূপ উদঘটিত হলে পূর্বেকার আইন পরিবর্তন করা হয়। (২) ভবিষ্যৎ অবস্থার গতি-প্রকৃতি জানা না থাকার কারণে কোন কোন সাময়িক আইন জারি করা হয়। পরে অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে সে আইনও পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু এ ধরনের নসখ আল্লাহর আইন হতে পারে বলে ধারণা করা যায় না।
তৃতীয় প্রকার ’নসখ’ এরূপঃ আইন-রচয়িতা আগেই জানে যে, অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং তখন এই আইন আর উপযোগী থাকবে না; অন্য আইন জারি করতে হবে। এরূপ জানার পর সাময়িকভাবে এই আইন জারি করে দেন, পরে পূর্বজ্ঞান অনুযায়ী যখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তখন পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনও পরিবর্তন করেন। উদাহরণত রোগীর বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দেন। তিনি জানেন যে, এই ওষুধ দু’দিন সেবন করার পর রোগীর অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং তখন অন্য ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে। অবস্থার এহেন পরিবর্তন জানার ফলেই চিকিৎসক প্রথম দিন এক ওষুধ এবং পরে অন্য ওষুধ দেন।

অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রথম দিনেই পরিবর্তনসহ চিকিৎসার পূর্ণ প্রোগ্রাম কাগজে লিখে দিতে পারে যে, দু’দিন এই ওষুধ, তিন দিন অন্য ওষুধ এবং এক সপ্তাহ পর অমুক ওষুধ সেব্য। কিন্তু এরূপ করা হলে রোগীর পক্ষে জটিলতার সম্মুখীন হওয়ার আশংকা থাকে এবং এতেও ভুল বোঝাবুঝির কারণে ত্রুটিরও আশংকা থাকে। তাই ডাক্তার প্রথম দিনেই পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেন না।

আল্লাহর আইনে এবং আসমানী গ্রন্থসমূহে শুধু তৃতীয় প্রকার নসখই হতে পারে এবং হয়ে থাকে । প্রতিটি নবুয়ত ও প্রতিটি আসমানী গ্রন্থ পূর্ববর্তী নবুয়ত ও আসমানী গ্রন্থের বিধান নসখ তথা রহিত করে নতুন বিধান জারি করেছে। এমনিভাবে একই নবুয়ত ও শরীয়তে এমন রয়েছে যে, এক বিধান কিছু দিন প্রচলিত থাকার পর খোদায়ী হেকমত অনুযায়ী সেটি পরিবর্তন করে তদস্থলে অন্য বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। সহীহ্ মুসলিমের হাদীসে আছেঃ

لَمْ تَكُنْ نُبُوَّةٌ قَطُّ إِلَّا تَنَاسَخَتْ

অর্থাৎ এমন নবুয়ত কখনও ছিল না, যাতে নখ ও পরিবর্তন করা হয়নি।—(কুরতুবী) 

নসখ বিষয়ে মূর্খজনোচিত আপত্তি

কিছুসংখ্যক মূর্খ ইহুদী অজ্ঞতাবশত খোদায়ী বিধানে নসখকে সঠিক অর্থে বুঝতে পারেনি। তারা খোদায়ী নসখকে জাগতিক আইনের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকার নসখের অনুরূপ ধরে নিয়ে নবী করীম (সা)-এর প্রতি ভর্ৎসনার বাণ নিক্ষেপ করতে থাকে। এর উত্তরেই আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। (ইবনে কাসীর)

মুসলমানদের মধ্যে মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক আলেম সম্ভবত উপরোক্ত বিরোধীদের ভর্ৎসনা থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই বলেছেন যে, খোদায়ী বিধানে নসখের সম্ভাবনা অবশ্যই আছে- এতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই, কিন্তু সমগ্র কোরআনে বাস্তবে কোন নসখ হয়নি। কোন আয়াত নাসেখও নয়, মনসূখও নয়। আবু মুসলিম ইস্পাহানীকে এই মতবাদের প্রবক্তা বলা হয় । আলেম সম্প্রদায় যুগে যুগে তাঁর মতবাদ খণ্ডন করেছেন। তফসীরে রূহুল-মা’আনীতে বলা হয়েছেঃ

واتفقت أهل الشرائع على جواز النسخ ووقوعه و خالفت اليهود غير العيسوية في جوازه وقـالـوا يمتنع عقلا وابو مسلم الأصفهاني في وقوعه فقال أنه وإن جاز عقلا لكنه لم يقع 

(নসখের সম্ভাব্যতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে সকল ধর্মাবলম্বীই একমত। তবে খৃস্টান সম্প্রদায় বর্তীত সকল ইহুদী এর সম্ভাব্যতাকে অস্বীকার করেছে। আবূ মুসলিম ইস্পাহানী এর বাস্তবতা অস্বীকার করে বলেছেন যে, খোদায়ী বিধানে নখ সম্ভব; কিন্তু বাস্তবে কোথাও নখ হয়নি) ইমাম কুরতুবী স্বীয় তফসীরে বলেনঃ

مَعْرِفَةُ هَذَا الْبَابِ أَكِيدَةٌ وَفَائِدَتُهُ عَظِيمَةٌ، لَا يَسْتَغْنِي عَنْ مَعْرِفَتِهِ الْعُلَمَاءُ، وَلَا يُنْكِرُهُ إِلَّا الْجَهَلَةُ الْأَغْبِيَاءُ

(নসখ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা খুবই জরুরী এবং এর উপকারিতা অনেক। আলিমগণ একে উপেক্ষা করতে পারেন না। একমাত্র মূর্খ ও নির্বোধ ছাড়া কেউ নস্থ অস্বীকার করতে পারে না।)

কুরতুবী এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা)-এর একটি ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন। একবার তিনি মসজিদে এসে এক ব্যক্তিকে ওয়াজে রত দেখতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, লোকটি কি করছে ? উত্তর হলো, সে ওয়াজ-নসীহত করছে। হযরত আলী (রা) বললেন- না, সে ওয়াজ করছে না, বরং সে বলতে চায় যে, আমি অমুকের পুত্র অমুক। আমাকে চিনে নাও। অতঃপর লোকটিকে ডেকে তিনি বললেন, তুমি কি কোরআন ও হাদীসের নাসেখ ও মনসূখ বিধানসমূহ জান ? লোকটি বলল, না আমার জানা নেই। হযরত আলী (রা) বললেন, তাহলে আমাদের মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাও। ভবিষ্যতে এখানে আর ওয়াজ করো না।

কোরআন ও হাদীসে নসখের অস্তিত্ব ও বাস্তবতা সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের উক্তি এত বেশি যে, সেগুলো উদ্ধৃত করা সহজ নয়। তফসীরে ইবনে কাসীর, ইবনে জরীর, দুররে-মনসূর প্রভৃতি গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিশুদ্ধ সনদ সহকারে বহু রেওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে দুর্বল রেওয়ায়েতের তো গণনাই নেই।

এ কারণেই প্রশ্নটি ইজমায়ী তথা সর্বসম্মত। শুধু আবূ মুসলিম ইস্পাহানী ও কতিপয় মু’তাযিলী এ প্রসঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তফসীরে-কবীর গ্রন্থে ইমাম রাযী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাদের মতামত খণ্ডন করেছেন।

নসখের অর্থে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিভাষায় পার্থক্য

নসখের পারিভাষিক অর্থ বিধান পরিবর্তন করা। এ পরিবর্তন একটি বিধানকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে তদস্থলে অন্য বিধান রাখার মাধ্যমেও হতে পারে। যেমন বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কা’বা শরীফকে কেবলা বানিয়ে দেওয়া। এমনিভাবে কোন শর্তহীন ও ব্যাপক বিধানে কোন শর্ত যুক্ত করে দেওয়াও এক প্রকার পরিবর্তন। পূর্ববর্তী আলেম সম্প্রদায় নসখকে এই ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের মতে কোন বিধানের সম্পূর্ণ পরিবর্তন, আংশিক পরিবর্তন, শর্ত যুক্তকরণ অথবা ব্যতিক্রম বর্ণনা ইত্যাদি সবই নসখের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই তাঁদের মতে কোরআনে মনসূখ আয়াতের সংখ্যা পাঁচশ যেখানে পরিবর্তনের পূর্বের বিধান ও পরের বিধানের মধ্যে সামঞ্জস্য বর্ণনা করা কিছুতেই সম্ভব হয় না, পরবর্তী আলেমগণ শুধু সেখানেই নসখ হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। এই অভিমত মেনে নিলে স্বভাবতই মনসূখ আয়াতের সংখ্যা বিপুল হারে হ্রাস পাবে। এরই অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ আলেমদের বর্ণিত পাঁচ শ মনসূখ আয়াতের স্থলে পরবর্তী আলেম আল্লামা সুয়ুতী মাত্র বিশটি আয়াতকে মনসূখ প্রতিপন্ন করেছেন। তারপর হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র) এগুলোর মধ্যেও সামঞ্জস্য বর্ণনা করে মাত্র পাঁচটি আয়াতকে মনসূখ বলেছেন। এ প্রচেষ্টা এদিক দিয়ে সঙ্গত যে, পরিবর্তন না হওয়াই বিধানের পক্ষে স্বাভাবিক। কাজেই যেখানে আয়াতকে কার্যকরী রাখার পক্ষে কোন ব্যাখ্যা সম্ভব হয়, সেখানে বিনা প্রয়োজনে নসখ স্বীকার করা ঠিক নয়।

কিন্তু এই সংখ্যা হ্রাসের অর্থ এই নয় যে, নসখের ব্যাপারটি ইসলাম অথবা কোরআনের মধ্যে একটা ত্রুটিপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিদ্যমান ছিল- যা মোচনের চেষ্টা চৌদ্দ শ’ বছর যাবত চলছে। অবশেষে শাহ্ ওয়ালীউল্লাহর প্রচেষ্টায় সে দোষ হ্রাস পেতে পেতে পাঁচ-এ এসে দাঁড়িয়েছে। এরপরও কোন আধুনিক চিন্তাবিদের অপেক্ষা করা হচ্ছে-যিনি এসে এই পঁচটিকেও বিলুপ্ত করে একেবারে শূন্যের কোটায় পৌঁছে দেবেন।

নসখ প্রশ্নের গবেষণায় এই পথ অবলম্বন করা ইসলাম ও কোরআনের সঠিক খেদমত নয় । এই পথ অবলম্বন করে সাহাবী, তাবেয়ী তথা চৌদ্দশ’ বছরের (পূর্ববর্তী ও পরবর্তী) আলেমগণের রচনা ও গবেষণাকে ধুয়েমুছে ফেলা সম্ভব নয়। এতে করে বিরোধীদের সমালোচনা বন্ধ হবে না। লাভের মধ্যে শুধু আধুনিক যুগের ধর্মদ্রোহীদের হাতে একটি অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। তারা একথা বলার সুযোগ পাবে যে, চৌদ্দ শ’ বছর যাবত আলেমরা যা বলছেন, পরিশেষে তা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে –(মা’আযাল্লাহ্)। এ পথ উন্মুক্ত হয়ে গেলে কোরআন ও শরীয়তের উপর থেকে আস্থা উঠে যাবে। কারণ আজকের গবেষণা যে আগামীকাল ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে না, এরই বা নিশ্চয়তা কোথায় ?

আমি বর্তমান যুগের কোন কোন আলেমের লেখা পাঠ করেছি। তারা مَا نَنْسَخْ আয়াতটিকে متضمن معنى شرط হওয়ার কারণে قضيه فرضيه সাব্যস্ত করেছেন । যেমন, لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ এবং لَوْ كَانَ لِلرَّحْمَنِ وَلَدٌ অতঃপর আয়াত দ্বারা তারা শুধু নসখের সম্ভাবনা প্রমাণিত করার প্রয়াস পেয়েছেন এবং নসখের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন। অথচ متضمن معنى شرط এবং قضيه شرطيه بخرف لو এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক। বলা বাহুল্য, এটা আবূ মুসলিম ইস্পাহানী এবং মু’তাযিলা সম্প্রদায়েরই যুক্তি।

অথচ সাহাবী ও তাবেয়ীগণের তফসীর এবং সমগ্র মুসলিম সমাজের অনুবাদ দেখার পর উপরোক্ত ব্যাখ্যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সাহাবায়ে কেরাম উপরোক্ত আয়াত দ্বারা নসখের বাস্তবতা প্রমাণ করে এ সম্পর্কিত একাধিক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। (ইবনে কাসীর, ইবনে জরীর প্রভৃতি)

এ কারণেই পূর্ববর্তী মুসলিম মনীষিগণের মধ্যে কেউ নসখের বাস্তবতাকে শর্তহীনভাবে অস্বীকার করেন নি। স্বয়ং হযরত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ (র) সামঞ্জস্য বর্ণনা করে সংখ্যা হ্রাস করেছেন বটে ; কিন্তু নসখের বাস্তবতাকে শর্তহীনভাবে অস্বীকার করেন নি। তাঁর পরবর্তী যমানায়ও দেওবন্দের প্রখ্যাত আলেমগণের সবাই একবাক্যে নসখের বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তাঁদের কারও কারও সম্পূর্ণ অথবা আংশিক তফসীরও বিদ্যমান রয়েছে الله سبحانه وتعالى أعلم  أَوْ نُنْسِهَا

প্রসিদ্ধ কেরাআত অনুযায়ী এর উৎপত্তি اِنْسَاءٌ ও نِسْيَانٌ ধাতু থেকে । উদ্দেশ্য এই যে, কখনও রসূলুল্লাহ (সা) ও সমস্ত সাহাবীর মন থেকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত করিয়ে নসখ করা হয়। এর সমর্থনে টীকাকারগণ একাধিক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ভবিষ্যতে যাতে আয়াতটির উপর আমল করা না হয়, সে উদ্দেশ্যেই এরূপ বিস্মৃত করিয়ে দেওয়া হয়েছে। নসখের অবশিষ্ট বিধান উসূলে ফেকাহ্ গ্রন্থসমূহে দেখা যেতে পারে।




*************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url