রাহে আমল - ২৫ || সহযাত্রীর অধিকার || রোগীর দেখাশুনা ও পরিচর্যা ||





সফরের সহযাত্রীর অধিকার

কোন জাতির সরদার তাদের সেবক হয়ে থাকে

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَيِّدٌالْقَوْمِ خَادِمُهُمْ فَمَنْ سَبَقَهُمْ بِخِدْمَةٍ لَّمْ يَسْبِقُوهُ بِعَمَـ

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: কোন জাতি বা দলের সরদার তাদের সেবক হয়ে থাকে। সুতরাং যে ব্যক্তি মানুষের সেবা ও উপকারে অগ্রণী হয়, একমাত্র আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করা ছাড়া আর কোন কাজ দ্বারা কেউ তার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না।

ব্যাখ্যা : যে ব্যক্তি কোন দলের সাথে সফর করে, তার কর্তব্য এই যে, সে যেন ঐ দলের সেবা করে, তাদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখে এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাদের সুখ ও সাচ্ছন্দের ব্যবস্থা করে। এই সেবার জন্য সে অনেক সওয়াব পাবে। এর চেয়ে বেশী সওয়াব যদি কোন কিছুতে থেকে থাকে তবে তা একমাত্র আল্লাহর পথে লড়াই করে শহীদ হওয়াতেই রয়েছে।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাহনে সহযাত্রীর অধিকার

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ فِي سَفَرٍ إِنْجَاءَهُ رَجُلٌ عَلَى رَاحِلَةٍ فَجَعَلَ يَصْرِفُ وَجْهَهُ يَمِينًا وَشِمَالاً فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ كَانَ مَعَهُ فَضْلُ ظَهْرٍ فَلْيَعُدْ بِهِ عَلَى مَنْ لَّا ظَهْرَ لَهُ وَمَنْ كَانَ فَضْلُ زَادٍ فَلْيَعُدْ بِهِ عَلَى مَنْ لَّا زَادَ لَهُ، قَالَ فَذَكَرَ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ حَتَّى رَأَيْنَا أَنَّهُ لَاحَقِّ لِأَحَدٍمِّنَّا فِي الْفَضْلِ - (مسلم)

আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন : একবার আমরা যখন সফরে ছিলাম, তখন উষ্ট্রীর ওপর আরোহণকারী এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এল এবং এসেই ডানে বামে তাকাতে লাগলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : যার কাছে নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাহন আছে, তার কর্তব্য অতিরিক্ত বাহন সেই ব্যক্তিকে দেয়া, যার বাহন নেই। আর যার কাছে অতিরিক্ত খাবার আছে, তার কর্তব্য যার খাবার নেই, তাকে সেই খাবার দেয়া। আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূল (সা) এভাবে এক এক করে বহু রকমের সামগ্রীর উল্লেখ করলেন, যা দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে জিনিসই আমাদের কাছে থাকুক, তাতে আমাদের কোন অধিকার নেই। (মুসলিম)

আগন্তুক ডানে বামে তাকাচ্ছিল এ জন্য যে, আসলে তার কোন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব ছিল এবং কেউ তাকে সাহায্য করুক- এটা কামনা করছিল।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রী শয়তানের

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَكُونُ إِبِلٌ وبُيُوتُ لِلشَّيْطِيْنِ، فَأَمَّا اَبِلُ الشَّيْطِيْنِ فَقَدْ رَأَيْتُهَا يَخْرُجُ أَحَدُكُمْ بِنَجِيبَاتٍ مَعَهُ قَدْ أَسْمَنَهَا فَلَا يَعْلُو بَعِيْرًا مِنْهَا وَيَمُرُّ بِأَخِيهِ قَدِ انْقَطَعَ بِهِ فَلَا يَحْمِلُهُ وَأَمَّا بيوت الشَّيطِينِ فَلَمْ أَرَهَا ـ (ابوداؤد، سعید بنابیهند عن أبي هريرة

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: কিছু উট ও কিছু ঘরবাড়ী শয়তানের হয়ে থাকে। শয়তানের উঠ তো আমি দেখেছি। তোমাদের কেউ বহু সংখ্যক মোটাতাজা ও নাদুস নুদুস উট নিয়ে পথে বের হয়। সেই সব উটের একটিতেও সে নিজেও আরোহণ করে না, আবার তার যে ভাই এর কোন বাহন নেই, তার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকেও তাতে আরোহণ করায় না। (এই সব উট হলো শয়তানের উট।) তবে শয়তানের বাড়ী আমি দেখিনি । (আবু দাউদ)

শয়তানের বাড়ী দ্বারা রাসূল (সা) সেই সব বাড়ীকে বুঝিয়েছেন, যা লোকেরা নিছক ধন সম্পদের বড়াই প্রদর্শনের জন্য নির্মাণ করে থাকে। সেগুলোতে নিজেও বাস করে না অন্য কোন বাড়ীঘর বিহীন লোককেও বাস করতে দেয় না। এ ধরনের ঐশ্বর্যের প্রদর্শনী ইসলাম পছন্দ করে না। রাসূল (সা) এ ধরনের লোক দেখানো বাড়ীঘর দেখেননি। কেননা সে যুগে এ ধরনের প্রদর্শনী মনোভাবের অধিকারী লোক ছিল না। তবে পরবর্তীকালে এ ধরনের বাড়ীঘর নির্মিত হয়েছে এবং আমাদের পূর্ব পুরুষরা তা দেখেছেন। আমরাও আমাদের যুগের ধনাঢ্য পুঁজিপতি মুসলমানদের এ ধরনের প্রদর্শনীমূলক অট্টালিকা দেখতে পাচ্ছি।

মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ

 عَنْ مُعَادٍ قَالَ غَزَونَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَضَيِّقَ النَّاسُ الْمُنَازِلَ وَقَطَعُوا الطَّرِيقَ فَبَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُنَادِيًا يُنَادِي فِي النَّاسِ أَنَّمَنْ ضَيَّقَ مَنْزِلاً أَوْ قَطَعَ الطَّرِيقَ فَلَا جِهَادَلة - (ابوداؤد)

হযরত মুয়ায (রা) বলেন : আমরা রাসূল (সা)-এর সাথে কোন এক যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমাদের সাথীরা এমন গাদাগাদি করে অবস্থান করতে লাগলো যে, চলাচলের রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেল। রাসূল (সা) একজন ঘোষণাকারী পাঠিয়ে ঘোষণা করিয়ে দিলেন যে, যে ব্যক্তি অবস্থান স্থলকে সংকীর্ণ করে দেবে বা চলাচলের পথ বন্ধ করে দেবে, সে জেহাদের সওয়াব পাবে না ।

এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, মুসলিম মুজাহিদগণ এমনভাবে অবস্থান করছিলো যে, পথিকদের চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ জন্যই এরূপ ঘোষনা জারী করান। যারা কোন সৎ কাজের উদ্দেশ্যে সফরে বের হবে, তাদের উচিত পথিমধ্যে কোথাও যাত্রাবিরতি করতে হলে যেন বেশী ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান না করে, বরং কেবল প্রয়োজনীয় পরিমাণ জায়গা ব্যবহার করে। অন্য সফর সংগীদের স্থান সংকুলান হয় না বা যাতায়াত ও চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয় এমনভাবে অবস্থান করা ঠিক নয়।


রোগীর দেখাশুনা ও পরিচর্যা

রোগীর সেবা ও পরিচর্যার গুরুত্ব

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا ابْنَ أَدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تعْدُنِي قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُودُكَ وَانْتَ رَبِّ الْعَلَمِينَ ؟ قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِي فَلَانًا مَّرِضَ فَلَمْ تَعُدُهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْعُدتَهُ لَوَجَدْتَنِي عِنْدَه. (مسلم، ابو هريرة)

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন কেয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ওহে আদম সন্তান, আমি রোগাক্রান্ত ছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে যাওনি । সে বলবে, হে আমার প্রভু, আপনি তো সারা বিশ্বের প্রতিপালক, আপনি কিভাবে রোগাক্রান্ত হলেন এবং আপনাকে কিভাবে দেখতে যাব? আল্লাহ বলবেন: তুমি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা রোগাক্রান্ত ছিল, কিন্তু তুমি তাকে দেখতে যাওনি। যদি তাকে দেখতে যেতে, তবে আমাকে তার কাছেই পেতে ।

রোগীকে দেখতে যাওয়ার অর্থ শুধু তার কাছে চলে যাওয়া ও কেমন আছে জিজ্ঞেস করা নয়। বরং রোগীর যথার্থ তদারকী এই যে, সে দরিদ্র হলে তার ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করা দরকার। আর দরিদ্র না হলেও হতে পারে যে, তার সময়মত ওষুধ এনে দেয়া ও খাওয়ানোর লোক নেই। সে ক্ষেত্রে তার ওষুধ পথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের ব্যবস্থা করাই হলো তার যথার্থ সেবা, পরিচর্যা তদারকী।

রোগীর খোঁজ খবর নেয়ার আদেশ

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عُودُوا الْمَرِيضَ وَاطْعِمُوا الْجَائِعَ وَفكُوا الْعَانِي. (بخاري، ابو موسى)

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন তোমরা রোগীর খোঁজ খবর নাও, ক্ষুধার্তকে খানা খাওয়াও এবং বন্দীর মুক্তির ব্যবস্থা কর । (বোখারী)

রোগীকে ইসলামের দাওয়াত দেয়াও পরিচর্যার অংশ

 كَانَ غُلَامٌ يَهُودِى يَخْدِمُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ وَسَلَّمَ فَمَرِضَ فَأَتَاهُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعُودُهُ، فَقَعَدَ عِنْدَ رَأْسِهِ فَقَالَ أَسْلِمُ، فَنَظَرَ إِلَى أَبِيْهِ وَهُوَ عِنْدَهُ فَقَالَ اَطِعْ اَبَا الْقَاسِمِ فَأَسْلَمَ، فَخَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَقُولُ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْقَذَهُ

রাসূল (সা)-এর একজন ইহুদী ভৃত্য ছিল, যে রাসূল-এর সেবা করতো। সে রোগাক্রান্ত হলে রাসূল (সা) তাকে দেখতে গেলেন। তিনি তার মাথার কাছে বসলেন ও তাকে বললেন : তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। ভৃত্যটির বাবা তার কাছেই ছিল। সে তার বাবার দিকে তাকালো। বাবা তাকে বললো- তুমি আবুল কাসেমের (রাসূলুল্লাহর) আদেশ মান্য কর। সে তৎক্ষণাত ইসলাম গ্রহণ করলো। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) তার কাছ থেকে একথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন যে, আল্লাহর শোকর, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করলেন। (বোখারী)

রাসূল (সা)-এর পবিত্র ও নিখুঁত স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে শত্রু ও বন্ধু সবাই ওয়াকিফহাল ছিল। সকল ইহুদী রাসূল (সা)-এর শত্রু ছিল না। এই ইহুদীর রাসূল (সা)-এর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তাই সে নিজের ছেলেকে তাঁর ভৃত্য হিসাবে কাজ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

রোগীর পরিচর্যার পদ্ধতি

قَالَ ابْنُ عَبَّاسِ مِنَ السُّنَّةِ تَخْفِيفُ الْجُلُوسِ وَقُلَّةُ الصَّخَبِ فِي الْعِبَادَةِ عِنْدَ الْمَرِيضِ - (مشكوة)

ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন: রোগীর পরিচর্যার ক্ষেত্রে বেশী শব্দ না করা ও অল্প সময় অবস্থান সুন্নাত। (মেশকাত)

এ আদেশ সর্ব সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু রোগী যদি অন্তরংগ বন্ধু বা প্রিয়জন হয় এবং তার কাছে বেশীক্ষণ অবস্থান করা রোগী পছন্দ করবে বলে বুঝা যায়, তাহলে বেশীক্ষণ অবস্থান করতে পারে ।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url