মা’আরেফুল কোরআন - ৩১ || সূরা আল-বাকারাহ ৮৯-৯৫নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮৯-৯৫



সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮৯

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ لَمَّا جَآءَهُمۡ کِتٰبٌ مِّنۡ عِنۡدِ اللّٰهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمۡ ۙ وَ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ یَسۡتَفۡتِحُوۡنَ عَلَی الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ۚۖ فَلَمَّا جَآءَهُمۡ مَّا عَرَفُوۡا کَفَرُوۡا بِهٖ ۫ فَلَعۡنَۃُ اللّٰهِ عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۸۹

সূরা আল-বাকারাহ ৮৯ নং আয়াতের অর্থ

(৮৯) যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব এসে পৌঁছাল, যা সে বিষয়ের সত্যায়ন করে, যা তাদের কাছে রয়েছে এবং তারা পূর্বে করত। অবশেষে যখন তাদের কাছে পৌঁছল যাকে তারা চিনে রেখেছিল, তখন তারা তা অস্বীকার করে বসল। অতএব, অস্বীকারকারীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত।

সূরা আল-বাকারাহ ৮৯ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

যখন তাদের কাছে এমন (একটি) গ্রন্থ এসে পৌছাল (অর্থাৎ কোরআন মজীদ) যা আল্লাহ পক্ষ থেকে এসেছে (এবং যা) ঐ গ্রন্থেরও সত্যায়ন করে যা (পূর্ব থেকেই) তাদের কাছে রয়েছে (অর্থাৎ তওরাত)।

অথচ এর পূর্বে স্বয়ং তারা কাফেরদের কাছে (অর্থাৎ আরবের মুশরিকদের কাছে) বলত যে, একজন পয়গম্বর আসবেন এবং তিনি একটি গ্রন্থ নিয়ে আসবেন। কিন্তু পরে যখন তা এল যা তারা চিনত, তখন তারা তা (পরিষ্কার) অস্বীকার করে বসল। অতএব, (এমন) অস্বীকারকারীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত (যারা শুধু পক্ষপাতিত্বের কারণে অস্বীকার করে)।

জ্ঞাতব্যঃ কোরআনকে তওরাতের ’মুসাদ্দিক’ (সত্যায়নকারী) বলা হয়েছে। এর কারণ এই যে, তওরাতে মুহাম্মদ (সা)-এর আবির্ভাব ও কোরআন অবতরণের যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল কোরআনের মাধ্যমেও সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং যারা তওরাতকে স্বীকার করে, তারা কিছুতেই কোরআন ও মুহাম্মদ (সা)-কে অস্বীকার করতে পারে না। তা করতে গেলে তওরাতকে অস্বীকার করতে হবে।

শুধু জানাকে ঈমান বলা যায় না

একটি প্রশ্ন ও তার উত্তরঃ এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, তারা যখন সত্যকে সত্য বলেই জানত, তখন তাদেরকে ঈমানদার বলাই উচিত। কাফের বলা হলো কেন?

এর উত্তর এই যে, শুধু জানাকে ঈমান বলা যায় না। শয়তানের সত্যজ্ঞান সবার চাইতে বেশি। তাই বলে সে ঈমানদার হয়ে যাবে কি ? জানা সত্ত্বেও অস্বীকার করার কারণে কুফরের তীব্রতাই বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তী আয়াতে তাদের শত্রুতাকে কুফরের কারণ বলে অভিহিত করা হয়েছে।


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৯০

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

بِئۡسَمَا اشۡتَرَوۡا بِهٖۤ اَنۡفُسَهُمۡ اَنۡ یَّکۡفُرُوۡا بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ بَغۡیًا اَنۡ یُّنَزِّلَ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ عَلٰی مَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِهٖ ۚ فَبَآءُوۡ بِغَضَبٍ عَلٰی غَضَبٍ ؕ وَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابٌ مُّهِیۡنٌ ﴿۹۰

সূরা আল-বাকারাহ ৯০ নং আয়াতের অর্থ

(৯০) যার বিনিময়ে তারা নিজেদের বিক্রি করেছে, তা খুবই মন্দ; যেহেতু তারা আল্লাহ যা নাবিল করেছেন, তা অস্বীকার করেছে এই হঠকারিতার দরুন যে, আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ নাযিল করেন। অতএব, তারা ক্রোধের উপর ক্রোধ অর্জন করেছে। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।

সূরা আল-বাকারাহ ৯০ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

(সে অবস্থা খুবই মন্দ,) যার প্রেক্ষিতে তারা (পরকালের শাস্তি থেকে) নিজেদের মুক্ত করতে চায়। (অবস্থাটি এই যে.) তারা কুফর (অস্বীকার) করে এমন বস্তুর প্রতি, যা আল্লাহ্, তা’আলা (একজন পয়গম্বরের উপর) নাযিল করেছেন (অর্থাৎ কোরআন)। এই অস্বীকারও শুধু এরূপ হঠকারিতার দরুন করা হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা (অর্থাৎ মুহাম্মদ [সা] -এর প্রতি কেন) অনুগ্রহ নাযিল করলেন ! (কুফরের উপর এ হিংসার কারণে) তারা ক্রোধের উপর ক্রোধ অর্জন করেছে। পরকালে এই কাফেরদের এমন শাস্তি দেওয়া হবে, যাতে কষ্ট (তো আছেই), অপমানও থাকবে।

এক ক্রোধ কুফরের কারণে এবং অপর হিংসার কারণে। এ জন্যই ক্রোধের উপর ক্রোধ বলা হয়েছে। শাস্তির সাথে ‘অপমানজনক’ শব্দ যোগ করে বলা হয়েছে যে, এ শাস্তি কাফেরদের জন্যই নির্দিষ্ট। কেননা, পাপী ঈমানদারকে যে শাস্তি দেওয়া হবে তা হবে তাকে পাপমুক্ত করার উদ্দেশ্যেই, অপমান করার উদ্দেশ্যে নয়। পরবর্তী আয়াতে তাদের যে উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা থেকে কুফর প্রমাণিত হয় এবং হিংসাও বোঝা যায়।


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৯১

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

 وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمۡ اٰمِنُوۡا بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ قَالُوۡا نُؤۡمِنُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ عَلَیۡنَا وَ یَکۡفُرُوۡنَ بِمَا وَرَآءَهٗ ٭ وَ هُوَ الۡحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَهُمۡ ؕ قُلۡ فَلِمَ تَقۡتُلُوۡنَ اَنۡۢبِیَآءَ اللّٰهِ مِنۡ قَبۡلُ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۹۱

সূরা আল-বাকারাহ ৯১ নং আয়াতের অর্থ

(৯১) যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন, তা মেনে নাও, তখন তারা বলে, আমরা মানি, যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। সেটি ছাড়া সবগুলোকে তারা অস্বীকার করে। অথচ এ গ্রন্থটি সত্য এবং সত্যায়ন করে ঐ গ্রন্থের, যা তাদের কাছে রয়েছে। বলে দিন, তবে তোমরা ইতিপূর্বে পয়গম্বরদের হত্যা করতে কেন- যদি তোমরা বিশ্বাসী ছিলে ?

সূরা আল-বাকারাহ ৯১ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

যখন তাদেরকে (ইহুদীদের) বলা হয়, তোমরা ঐসব গ্রন্থের প্রতি ঈমান আন, যা আল্লাহ্ তা’আলা (কয়েকজন পয়গম্বরের প্রতি) নাযিল করেছেন (সেগুলোর মধ্যে কোরআন অন্যতম)। তখন তারা বলে, আমরা (শুধু) সে গ্রন্থের প্রতিই ঈমান আনব, যা আমাদের প্রতি [হযরত মূসা (আ)-এর মাধ্যমে] নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ তওরাত)। সেটি ছাড়া (অবশিষ্ট) যত গ্রন্থ রয়েছে (যেমন, ইঞ্জীল ও কোরআন) তারা সেগুলোকে অস্বীকার করে। অথচ তওরাত ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থও (প্রকৃত) সত্য (এবং বাস্তব। তদুপরি ) সেগুলো সত্যায়নও করে ঐ গ্রন্থের, যা তাদের কাছে রয়েছে (অর্থাৎ তওরাত)। আপনি আরও বলে দিন, তবে ইতিপূর্বে তোমরা কেন আল্লাহর পয়গম্বরদের হত্যা করতে—যদি তোমরা তওরাতের প্রতি বিশ্বাসী ছিলে ?

“আমরা শুধু তওরাতের প্রতিই ঈমান আনব, অন্যান্য গ্রন্থের প্রতি ঈমান আনব না”—ইহুদীদের এ উক্তি সুস্পষ্ট কুফর। সেই সাথে তাদের উক্তি ‘যা (তওরাত) আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে’—এ থেকে প্রতিহিংসা বোঝা যায়। এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে এই যে, অন্যান্য গ্রন্থ যেহেতু আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়নি, কাজেই আমরা সেগুলোর প্রতি ঈমান আনব না। আল্লাহ্ তা’আলা তিন পন্থায় তাদের এ উক্তি খণ্ডন করেছেনঃ

প্রথমত, অন্যান্য গ্রন্থের সত্যতা ও বাস্তবতা যখন অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত, তখন সেগুলো অস্বীকার করার কোন কারণ থাকতে পারে না। অবশ্য দলীলের মধ্যে কোন আপত্তি থাকলে তারা তা উপস্থিত করে তা দূর করে নিতে পারত। অহেতুক অস্বীকারের কোন অর্থ হয় না।

দ্বিতীয়ত, অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে একটি হচ্ছে কোরআন মজীদ, যা তওরাতেরও সত্যায়ন করে। সুতরাং কোরআন মজীদকে অস্বীকার করলে তওরাতের অস্বীকৃতিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত, সকল খোদায়ী গ্রন্থের মতেই পয়গম্বরদের হত্যা করা কুফর। তোমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা কয়েকজন পয়গম্বরকে হত্যা করেছে। অথচ তারা বিশেষভাবে তওরাতের শিক্ষাই প্রচার করতেন। তোমরা সেসব হত্যাকারীকেই নেতা ও পুরোহিত মনে করেছ। এভাবে কি তোমরা তওরাতের সাথেই কুফরি করনি ? সুতরাং তওরাতের প্রতি তোমাদের ঈমান আনার দাবি অসার প্রমাণিত হয়ে যায়। মোটকথা, কোন দিক দিয়েই তোমাদের কথা ও কাজ শুদ্ধ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

পরবর্তী আয়াতে আরও কতিপয় যুক্তি দ্বারা ইহুদীদের দাবি খণ্ডন করা হয়েছে।


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৯২

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

 وَ لَقَدۡ جَآءَکُمۡ مُّوۡسٰی بِالۡبَیِّنٰتِ ثُمَّ اتَّخَذۡتُمُ الۡعِجۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِهٖ وَ اَنۡتُمۡ ظٰلِمُوۡنَ ﴿۹۲

সূরা আল-বাকারাহ ৯২ নং আয়াতের অর্থ

(৯২) সুস্পষ্ট মো'জেযাসহ মূসা তোমাদের কাছে এসেছেন। এরপর তার অনুপস্থিতিতে তোমরা গোবস বানিয়েছ। বাস্তবিকই তোমরা অত্যাচারী।

সূরা আল-বাকারাহ ৯২ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

হযরত মূসা (আ) তোমাদের কাছে (তওহীদ ও রিসালতের) সুস্পষ্ট মো’জেযা (তথা যুক্তি-প্রমাণসহ) এসেছেন। (কিন্তু) এর পরেও তোমরা গোবৎসকে (উপাস্য) বানিয়েছ মূসা (আ)-এর অনুপস্থিতিতে (অর্থাৎ তাঁর তূর পর্বতে চলে যাওয়ার পর)। (এ উপাস্য নির্ধারণে) তোমরা অত্যাচারী ছিলে।

ঘটনাটি ঘটে তওরাত অবতরণের পূর্বে। তখন মূসা (আ)-এর নবুয়তের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য যেসব যুক্তি-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত ছিল, আয়াতে بَيِّنَاتٌ বলে সেগুলোকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন—লাঠি, জ্যোতির্ময় হাত, সাগর দ্বি-খণ্ডিত হওয়া ইত্যাদি।

ইহুদীদের দাবির খণ্ডনে আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমরা একদিকে ঈমানের দাবি কর, অন্যদিকে প্রকাশ্য শিরকে লিপ্ত হও। ফলে শুধু মূসা (আ)-কেই নয়, আল্লাহ্‌কেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে চলছ। কোরআন অবতরণের সময় হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর আমলে যেসব ইহুদী ছিল, তারা গোবৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করেনি সত্য। কিন্তু তারা নিজেদের পূর্ব-পুরুষদের সমর্থক ছিল। অতএব তারাও মোটামুটিভাবে এ আয়াতের লক্ষ্য।

এ থেকে আরও বোঝা যায় যে, যাদের পূর্ব-পুরুষরা মূসা (আ)-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে কুফর করেছে, তারা মুহাম্মদ (সা)-কে অস্বীকার করলে তা তেমন আশ্চর্যের বিষয় নয়।


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৯৩

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِیۡثَاقَکُمۡ وَ رَفَعۡنَا فَوۡقَکُمُ الطُّوۡرَ ؕ خُذُوۡا مَاۤ اٰتَیۡنٰکُمۡ بِقُوَّۃٍ وَّ اسۡمَعُوۡا ؕ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ عَصَیۡنَا ٭ وَ اُشۡرِبُوۡا فِیۡ قُلُوۡبِهِمُ الۡعِجۡلَ بِکُفۡرِهِمۡ ؕ قُلۡ بِئۡسَمَا یَاۡمُرُکُمۡ بِهٖۤ اِیۡمَانُکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۹۳

সূরা আল-বাকারাহ ৯৩ নং আয়াতের অর্থ

(৯৩) আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এবং তূর পর্বতকে তোমাদের উপর উঁচু করে ধরলাম যে, শক্ত করে ধর, আমি যা তোমাদের দিয়েছি আর শোন। তারা বলল, আমরা শুনেছি আর অমান্য করেছি। কৃষ্ণরের কারণে তাদের অন্তরে গোবৎস-প্রীতি পান করানো হয়েছিল। বলে দিন, তোমরা বিশ্বাসী হলে, তোমাদের সে বিশ্বাস মন্দ বিষয়াদি শিক্ষা দেয়।

সূরা আল-বাকারাহ ৯৩ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম এবং (এ প্রতিশ্রুতি নেওয়ার জন্য) তূর পর্বতকে তোমাদের (মাথার) ওপর উঁচু করে ধরেছিলাম, (তখন আদেশ করেছিলাম যে,) বিধান হিসাবে যা আমি তোমাদের দিয়েছি তা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ কর এবং (সেগুলোকে অন্তর দ্বারা) শোন। তখন তারা (ভয়ের আতিশয্যে মুখে বললঃ আমরা কবূল করলাম এবং শুনলাম (কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ স্বীকারোক্তিটি আন্তরিক ছিল না। তাই তারা যেন একথাও বলছিল যে,) আমাদের দ্বারা এসব পালন করা হবে না। তাদের (এহেন হীনমন্যতার কারণ ছিল এই যে, সাবেক কুফরের কারণে তাদের) অন্তরের (রন্ধ্রে রন্ধ্রে) গোবৎস-প্রীতি বদ্ধমূল হয়ে বসেছিল। (ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার পর এক সম্প্রদায়কে মূর্তিপূজায় লিপ্ত দেখে তারাও সাকার উপাস্যের পূজা বৈধ করার জন্য আবেদন করেছিল।) আপনি বলে দিন যে, তোমরা স্বকল্পিত ঈমানের পরিণতি দেখে নিয়েছ। বস্তুত এসবের পরিণতি মন্দ, তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান যা শিক্ষা দেয়—যদিও তোমরা তোমাদের ধারণামতে ঈমানদার হও (অর্থাৎ এটা প্রকৃতপক্ষে ঈমানই নয়)।

আয়াতে বর্ণিত কারণ ও ঘটনাসমূহের সারমর্ম এই যে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার পর তারা একটি কুফরী বাক্য উচ্চারণ করে। পরে মূসা (আ)-এর শাসানোর ফলে যদিও তওবা করে নেয়, কিন্তু তওবারও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। উচ্চস্তরের তওবার অভাবে তাদের অন্তরে কুফরের অন্ধকার কিছু অবশিষ্ট থেকে যায়। পরে সেটাই বেড়ে গিয়ে গোবৎস পূজার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোন কোন টীকাকারের বর্ণনা মতে, গোবৎস পূজা থেকে তওবা করতে গিয়ে তাদের কিছু লোককে মৃত্যুবরণ করতে হয় এবং কিছু লোক সম্ভবত এমনিতেই ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। এদের তওবাও সম্ভবত দুর্বল ছিল। এছাড়া যারা গোবৎস পূজায় জড়িত ছিল না, তারাও অন্তরে গোবৎস পূজারীদের প্রতি প্রয়োজনীয় ঘৃণা পোষণ করতে পারেনি। ফলে তাদের অন্তরে শিরকের প্রভাব কিছু না কিছু অবশিষ্ট ছিল। মোটকথা, তওবার দুর্বলতা ও শিরকের প্রতি প্রয়োজনীয় ঘৃণার অভাব— এতদুভয়ের প্রতিক্রিয়ায় তাদের অন্তরে ধর্মের প্রতি শৈথিল্য দানা বেঁধে উঠেছিল। এ কারণেই অঙ্গীকার নেওয়ার জন্য তূর পর্বতকে তাদের মাথার উপর ঝুলিয়ে রাখা দরকার হয়েছিল।


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৯৪-৯৫

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

قُلۡ اِنۡ کَانَتۡ لَکُمُ الدَّارُ الۡاٰخِرَۃُ عِنۡدَ اللّٰهِ خَالِصَۃً مِّنۡ دُوۡنِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الۡمَوۡتَ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۹۴
وَ لَنۡ یَّتَمَنَّوۡهُ اَبَدًۢا بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡهِمۡ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌۢ بِالظّٰلِمِیۡنَ ﴿۹۵

সূরা আল-বাকারাহ ৯৪-৯৫ নং আয়াতের অর্থ

(৯৪) বলে দিন, যদি আখিরাতের বাসস্থান আল্লাহ্র কাছে একমাত্র তোমাদের জন্যই বরাদ্দ হয়ে থাকে- অন্য লোকদের বাদ দিয়ে, তবে মৃত্যু কামনা কর, যদি সত্যবাদী হয়ে থাকে। (৯৫) কস্মিনকালেও তারা মৃত্যু কামনা করবে না ঐসব গোনাহর কারণে, যা তাদের হাত পাঠিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ্ গোনাহগারদের সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছেন।

সূরা আল-বাকারাহ ৯৪-৯৫ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

(কতক ইহুদীর দাবি ছিল যে, পরকালের নেয়ামতসমূহ একমাত্র তাদেরই প্রাপ্য। এ দাবির খণ্ডনে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন) আপনি (তাদেরকে) বলে দিন, (তোমাদের কথামত) পরকাল যদি সবাইকে বাদ দিয়ে, একমাত্র তোমাদের জন্যই সুখকর হয়, তবে তোমরা (এর সত্যতা প্রমাণের জন্য) মৃত্যু কামনা করে দেখাও, যদি তোমরা (এ দাবিতে) সত্যবাদী হয়ে থাক। (এতদসঙ্গে আমি আরও বলে দিচ্ছি যে,) তারা কস্মিনকালেও মৃত্যু কামনা করবে না—ঐসব (কুফর) কাজ-কর্মের (শাস্তির ভয়ের) কারণে, যা তারা স্বহস্তে অর্জন করে পাঠিয়েছে। আল্লাহ্ সম্যক অবগত রয়েছেন এহেন জালিমদের (অবস্থা) সম্পর্কে (মোকদ্দমার তারিখ আসতেই অভিযোগনামা পাঠ করে শুনিয়ে শাস্তির নির্দেশ জারি করা হবে)।

কোরআনের আরও কতিপয় আয়াত থেকে তাদের উপরোক্ত দাবির কথা জানা যায় যেমন-

وَقَالُوا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ إِلَّا أَيَّامًا مَعْدُودَةً

(তারা বলে, দোযখের আগুন আমাদের স্পর্শ করবে না—তবে অল্প কয়েকদিন মাত্র।)

وَقَالُوا لَنْ يَدْخُلَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ كَانَ هُودًا أَوْ نَصَارَى

(তারা বলে, একমাত্র যারা ইহুদী অথবা নাসারা, তারাই বেহেশতে প্রবেশ করবে অন্য কেউ নয়।)

وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ 

(ইহুদী ও খৃস্টানরা বলে, আমরাই আল্লাহর সন্তান ও প্রিয়জন।)

এসব দাবির সারমর্ম এই যে, আমরা সত্য ধর্মের অনুসারী। কাজেই আখিরাতে আমাদের মুক্তি অবধারিত। আমাদের মধ্যে যারা তওবা করেছে অথবা গতায়ু হয়ে গেছে, প্রাথমিক পর্যায়েই জান্নাতে প্রবেশাধিকার পাবে। আর যারা গোনাহ্গার, তারা অল্প কয়েকদিন সাজা ভোগ করেই মুক্তি পাবে। পক্ষান্তরে যারা অনুগত, তারা সন্তান ও স্বজনের মতই প্রিয়পাত্র ও নৈকট্যশীল হবে।

কতিপয় শাব্দিক ত্রুটি ছাড়া এসব দাবি সত্য ধর্মের অনুসারী হলে সঠিক ও নির্ভুল। কিন্তু ধর্ম রহিত হয়ে যাওয়ার কারণে ইহুদীরা সত্য ধর্মের অনুসারী ছিল না। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শব্দ ও পন্থায় তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। এখানে একটি বিশেষ পন্থা বর্ণিত হয়েছে। তা এই যে, সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আলোচনা ও যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে মীমাংসায় আসতে না চাইলে, অলৌকিক পন্থা অর্থাৎ মু’জিযার মাধ্যমে মীমাংসা হওয়াই উচিত। এতে বেশি জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন নেই- শুধু মুখে কথা বলাই যথেষ্ট। কিন্তু আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি, তোমরা মুখেও “আমরা মৃত্যু কামনা করি” বলে বলতে পারবে না।

এ ভবিষ্যদ্বাণীর পর আমি বলছি, যদি তোমরা তোমাদের দাবিতে সত্য হয়ে থাক, তবে বলে দাও। না বললে তোমরা যে মিথ্যাবাদী তা প্রমাণিত হয়ে যাবে।

ইহুদীরা দিবালোকের মত স্পষ্টভাবে জানত যে, তারা মিথ্যা ও কুফরের অনুসারী এবং রসূলুল্লাহ্ (সা) ও মু’মিনগণ সত্যধর্মের অনুসারী। এ কারণে তাদের মনে এমন আতঙ্ক দেখা দিল যে, জিহ্বাও আন্দোলিত হলো না। অথবা তাদের ভয় হলো যে, এ বাক্য মুখে উচ্চারণ করতেই মৃত্যুমুখে পতিত হতে হবে। এরপর সোজা জাহান্নাম। এরূপ না হলে রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে তাদের শত্রুতার পরিপ্রেক্ষিতে আনন্দে গদগদ হয়ে মৃত্যু কামনার বাক্য মুখে উচ্চারণ করাই ছিল তাদের পক্ষে স্বাভাবিক।

ইসলাম যে সত্য ধর্ম তার প্রমাণ

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম যে সত্য ধর্ম, তা প্রমাণ করার জন্য এ ঘটনাটি যথেষ্ট। এখানে আরও দু’টি বিষয় উল্লেখযোগ্যঃ

প্রথমত, নবী করীম (সা)-এর আমলে বিদ্যমান ইহুদীদের সঙ্গে উপরোক্ত যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল—যাঁরা তাঁকে নবী হিসাবে চেনার পরেও শত্রুতা ও হঠকারিতাবশত অস্বীকার করেছিল, সকল যুগের ইহুদীদের সঙ্গে নয়।

দ্বিতীয়ত, এখানে এরূপ সন্দেহ করা ঠিক নয় যে, মন ও জিহবা উভয়ের দ্বারাই কামনা হতে পারে । ইহুদীরা সম্ভবত মনে মনে মৃত্যুর কামনা করেছে। উত্তর এই যে, প্রথমত, আল্লাহর উক্তি وَلَنْ يَتَمَنَّوْه (কস্মিনকালেও তারা মৃত্যু কামনা করবে না) এ সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিচ্ছে । দ্বিতীয়ত, তারা মনে মনে মৃত্যু কামনা করে থাকলে তা অবশ্যই মুখেও প্রকাশ করত । কারণ, এতে তাদেরই জয় হতো এবং নবী করীম (সা)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার একটা সুযোগ পেয়ে যেত।

এরূপ সন্দেহও অমূলক যে, বোধ হয় তারা কামনা করেছে; কিন্তু তার প্রচার হয়নি। কারণ, সর্বযুগেই ইসলামের শত্রু ও সমালোচকদের সংখ্যা ইসলামের মিত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সংখ্যার চাইতে বেশি ছিল। এরূপ কোন ঘটনা ঘটে থাকলে তারা কি একে ফলাও করে প্রচার করত না যে, দেখ, তোমাদের নির্ধারিত সত্যের মাপকাঠিতেও আমরা পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয়েছি।



**************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url