মা’আরেফুল কোরআন - ৩৩ || সূরা আল-বাকারাহ ১০২-১০৩নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১০২-১০৩


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১০২-১০৩

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ اتَّبَعُوۡا مَا تَتۡلُوا الشَّیٰطِیۡنُ عَلٰی مُلۡکِ سُلَیۡمٰنَ ۚ وَ مَا کَفَرَ سُلَیۡمٰنُ وَ لٰکِنَّ الشَّیٰطِیۡنَ کَفَرُوۡا یُعَلِّمُوۡنَ النَّاسَ السِّحۡرَ ٭ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ عَلَی الۡمَلَکَیۡنِ بِبَابِلَ هَارُوۡتَ وَ مَارُوۡتَ ؕ وَ مَا یُعَلِّمٰنِ مِنۡ اَحَدٍ حَتّٰی یَقُوۡلَاۤ اِنَّمَا نَحۡنُ فِتۡنَۃٌ فَلَا تَکۡفُرۡ ؕ فَیَتَعَلَّمُوۡنَ مِنۡهُمَا مَا یُفَرِّقُوۡنَ بِهٖ بَیۡنَ الۡمَرۡءِ وَ زَوۡجِهٖ ؕ وَ مَا هُمۡ بِضَآرِّیۡنَ بِهٖ مِنۡ اَحَدٍ اِلَّا بِاِذۡنِ اللّٰهِ ؕ وَ یَتَعَلَّمُوۡنَ مَا یَضُرُّهُمۡ وَ لَا یَنۡفَعُهُمۡ ؕ وَ لَقَدۡ عَلِمُوۡا لَمَنِ اشۡتَرٰىهُ مَا لَهٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنۡ خَلَاقٍ ۟ؕ وَ لَبِئۡسَ مَا شَرَوۡا بِهٖۤ اَنۡفُسَهُمۡ ؕ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۰۲
وَ لَوۡ اَنَّهُمۡ اٰمَنُوۡا وَ اتَّقَوۡا لَمَثُوۡبَۃٌ مِّنۡ عِنۡدِ اللّٰهِ خَیۡرٌ ؕ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۰۳

সূরা আল-বাকারাহ ১০২-১০৩নং আয়াতের অর্থ

(১০২) তারা ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সুলায়মান কুফর করেনি; শয়তানরাই কৃষ্ণর করেছিল। তারা মানুষকে যাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। তারা উভয়েই একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না। অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন যাদু শিখত, যদ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহ্র আদেশ ছাড়া তদ্বারা কারো অনিষ্ট করতে পারত না। যা তাদের ক্ষতি করে এবং উপকার না করে, তারা তাই শিখে। তারা ভালরূপে জানে যে, যে কেউ যাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ- যদি তারা জানত। (১০৩) যদি তারা ঈমান আনত এবং আল্লাহভীরু হতো, তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত। যদি তারা জানত !

সূরা আল-বাকারাহ ১০২-১০৩ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

(ইহুদীরা এমন নির্বোধ যে) তারা (আল্লাহ্ প্রদত্ত কিতাবের অনুসরণ না করে,) ঐ শাস্ত্রের (অর্থাৎ যাদুর) অনুসরণ করল, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা চর্চা করত। (কতক নির্বোধ হযরত সুলায়মানকে যাদুকর মনে করত। তাদের এ ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন। কারণ, যাদু বিশ্বাসগতভাবে অথবা কার্যগতভাবে কুফর), সুলায়মান (কখনও) কুফর করেন নি। হ্যাঁ, শয়তানরা (অর্থাৎ দুষ্ট জ্বিনরা অবশ্য) কুফর (অর্থাৎ যাদু) করত। (নিজেরা তো করতই) তারা (অপরাপর) মানুষকেও যাদু শিক্ষা দিত। (সে যাদুই বংশ পরম্পরায় প্রচলিত রয়েছে এবং ইহুদীরা তা-ই শিক্ষা করে। এমনিভাবে তারা ঐ যাদুও অনুসরণ করে, যা বাবেল শহরে ‘হারূত’ ও ‘মারূত’- দুই ফেরেশতার প্রতি (বিশেষ উদ্দেশ্যে) অবতীর্ণ হয়েছিল। তারা উভয়ে (সে যাদু) কাউকে শিক্ষা দিত না, যতক্ষণ না (সাবধান করে আগেই) বলে দিত যে, আমাদের অস্তিত্বও মানুষের জন্য খোদায়ী পরীক্ষা (যে, কে আমাদের কাছ থেকে এ যাদু শিক্ষা করে বিপদে জড়িয়ে পড়ে, আর কে তা থেকে বেঁচে থাকে)। কাজেই তুমি (একথা জেনেও) কাফির হয়ো না (তাহলে বিপদে জড়িয়ে পড়বে)। অতঃপর তারা (কিছু লোক) তাদের (ফেরেশতাদ্বয়ের) কাছ থেকে এমন যাদু শিখত, যদ্দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিত। (এতে কারও এরূপ ধারণার বশবর্তী হয়ে ভীত হওয়া উচিত নয় যে, যাদুকররা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। কেননা, এটা নিশ্চিত যে, তারা আল্লাহর (ভাগ্য সম্পর্কিত) আদেশ ব্যতীত তদ্দ্বারা কারও (বিন্দু পরিমাণও) অনিষ্ট করতে পারত না। তারা (এহেন যাদু আয়ত্ত করে) যা তাদের ক্ষতি করে এবং যথার্থ উপকার করে না (সুতরাং যাদু অনুসরণ করে ইহুদীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে)। আর এটা শুধু আমারই কথা নয়; বরং তারা ভালরূপে জানে যে, যে লোক আল্লাহর গ্রন্থের বিনিময়ে যাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ অবশিষ্ট নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে (অর্থাৎ যাদু ও কুফর) তা খুবই মন্দ। যদি তারা (কুফর ও দুষ্কর্মের পরিবর্তে) ঈমান আনত এবং আল্লাহ্ত্তীরু হতো, তবে আল্লাহর কাছ থেকে (কুফর ও দুষ্কর্মের চাইতে হাজার গুণ) উত্তম প্রতিদান পেত। যদি তারা বুঝত।

সূরা আল-বাকারাহ ১০২-১০৩ নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

উল্লিখিত আয়াতসমূহের তফসীর ও শানেনুযুল প্রসঙ্গে অনেক ইসরাঈলী রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়। সেসব রেওয়ায়েত পাঠ করে অনেক পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন দেখা যায়। হাকীমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানবী (র) সুস্পষ্ট ও সহজভঙ্গিতে এসব প্রশ্নের উত্তর দান করেছেন। তাঁর বর্ণনাকে যথেষ্ট মনে করে এখানে হুবহু উদ্ধৃত করে দিলাম।

(১) নির্বোধ ইহুদীরাই হযরত সুলায়মান (আ)-কে যাদুকর বলে আখ্যায়িত করত। তাই আল্লাহ্ তা’আলা আয়াতের মাঝখানে তাঁর নিষ্কলুষতাও প্রকাশ করে দিয়েছেন।

(২) বর্ণিত আয়াতসমূহে ইহুদীদের নিন্দা করাই উদ্দেশ্য। কারণ, তাদের মধ্যে যাদুবিদ্যার চর্চা ছিল। এসব আয়াত সম্পর্কে পরমাসুন্দরী যোহরার একটি মুখরোচক কাহিনীও সুবিদিত রয়েছে। কাহিনীটি কোন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা সমর্থিত নয়। শরীয়তের নীতিবিরুদ্ধ মনে করে অনেক আলেম কাহিনীটিকে নাকচ করে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ সদর্থে ব্যাখ্যা করা শরীয়ত-বিরুদ্ধ মনে না করে নাকচ করেন নি। বাস্তবে কাহিনীটি সত্য কি মিথ্যা, এখানে তা আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে এটা ঠিক যে, আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা কাহিনীর উপর নির্ভরশীল নয়।

(৩) সবকিছু জানা সত্ত্বেও ইহুদীরা আমল বা কাজ করত, ’ইল্‌ম’ বা জানার বিপরীত এবং এ ব্যাপারে তারা মোটেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিত না। তাই আয়াতে প্রথমে তাদের জানার সংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং পরিশেষে ’যদি তারা জানত’ বলে না জানার কথাও বলা হয়েছে। কারণ, যে জানার সাথে তদনুরূপ কাজ ও বিচক্ষণতা যুক্ত হয় না, তা না জানারই শামিল।

(8) ঠিক কখন, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত তথ্য জানা না থাকলেও এক সময়ে পৃথিবীতে বিশেষ করে বাবেল শহরে যাদুবিদ্যার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। যাদুর অত্যাশ্চর্য ক্রিয়া দেখে মূর্খ লোকদের মধ্যে যাদু ও পয়গম্বরগণের মো’জেযার স্বরূপ সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা দিতে থাকে। কেউ কেউ যাদুকরদেরও সজ্জন ও অনুসরণযোগ্য মনে করতে থাকে। আধুনিক যুগে মেস্‌মেরিজমের বেলায়ও তাই হচ্ছে। এই বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা’আলা বাবেল শহরে ’হারূত’ ও ’মারূত’ নামে দু’জন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তাদের কাজ ছিল যাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা—যাতে বিভ্রান্তি দূর হয় এবং যাদুর আমল ও যাদুকরদের অনুসরণ থেকে তারা বিরত থাকতে পারে। পয়গম্বরগণের নবুয়তকে যেমন মো’জেযা ও নিদর্শনাদি দ্বারা প্রমাণ করে দেওয়া হয়, তেমনি হারুত ও মারূত যে ফেরেশতা, তার উপর যুক্তি-প্রমাণ খাড়া করে দেওয়া হলো, যাতে তাদের নির্দেশাবলী জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

এ কাজে পয়গম্বরগণকে নিযুক্ত না করার কারণ এই যে, প্রথমত, এতে পয়গম্বর ও যাদুকরদের মধ্যে পার্থক্য ফুটিয়ে তোলা উদ্দেশ্য ছিল। এদিক দিয়ে তাঁরা যেন ছিলেন একটি পক্ষ । কাজেই উভয় পক্ষকে বাদ দিয়ে তৃতীয় পক্ষকে বিচারক নিযুক্ত করাই বিধেয়।

দ্বিতীয়ত, যাদুর বাক্যাবলী মুখে উচ্চারণ ও বর্ণনা ব্যতীত এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভবপর ছিল না। যদিও ‘কুফরের’ বর্ণনা কুফর নয়, এই স্বীকৃত নীতি অনুযায়ী পয়গম্বরগণ তা করতে পারতেন, তথাপি হেদায়েতের প্রতীক হওয়ার কারণে এ কাজে তাঁদের নিযুক্তি সমীচীন মনে করা হয়নি। একাজের জন্য ফেরেশতাই মনোনীত হন। কারণ, সৃষ্টিজগতে ফেরেশতাদের দ্বারা এমন কাজও নেওয়া হয় যা সামগ্রিক উপযোগিতার দিক দিয়ে ভাল কিন্তু অনিষ্টের কারণে স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে মন্দ। যেমন, কোন হিংস্র ও ইতর প্রাণীর লালন-পালন ও দেখাশোনা করা। সৃষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে এ কাজ সঠিক ও প্রশংসনীয়, কিন্তু জাগতিক কল্যাণমূলক আইনের দৃষ্টিতে অঠিক ও নিন্দনীয়। পক্ষান্তরে পয়গম্বরগণকে শুধু জাগতিক কল্যাণমূলক আইন তদারকের কাজেই নিযুক্ত করা হয়—যা সাধারণত ভাল কাজেই হয়ে থাকে। উপরোক্ত যাদুর উচ্চারণ ও বর্ণনা উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে জাগতিক কল্যাণমূলক কাজ হলেও যাদুর আমলে লিপ্ত হয়ে পড়ার (যেমন, বাস্তবে হয়েছে) ক্ষীণ সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে পয়গম্বরগণকে এ থেকে দূরে রাখাই পছন্দ করা হয়েছে।

মোটকথা, ফেরেশতাদ্বয় বাবেল শহরে কাজ আরম্ভ করে দিলেন। তারা যাদুর মূল ও শাখা-প্রশাখা বর্ণনা করে জনগণকে এ কুকর্ম থেকে আত্মরক্ষা ও যাদুকরদের ঘৃণা করার উপদেশ দিলেন। যেমন কোন আলিম যদি দেখেন যে, জনগণ মূর্খতাবশত কুফরী বাক্য বলে ফেলে, তবে তিনি প্রচলিত কুফরী বাক্যগুলোকে বক্তৃতায় অথবা লেখায় সন্নিবেশিত করে জনগণকে বলে দেবেন যে, এ বাক্যগুলো থেকে সাবধান থাকা দরকার ।

ফেরেশতাদ্বয়ের কাজ আরম্ভ করার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোক তাদের কাছে আসা-যাওয়া করতে থাকে। পরে যাতায়াতকারীরা অনুরোধ করতে থাকে যে, যাদুর মূল ও শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে আমাদেরকেও অবহিত করা হোক যাতে আমরা অজ্ঞতাবশত কোন বিশ্বাসগত অথবা কার্যগত অপকর্মে লিপ্ত হয়ে না পড়ি। তখন ফেরেশতাদ্বয় সাবধানতাবশত একথা বলে দিতেন,—দেখ আমাদের দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা বান্দার পরীক্ষাও নিতে চান যে, এগুলো শিক্ষা করে কে স্বীয় ধর্মের হেফাজত ও সংস্কার করে এবং কে এগুলো সম্পর্কে অবগত হয়ে নিজেই সে অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং স্বীয় দীন-ঈমান বরবাদ করে দেয়। দেখ, আমাদের উপদেশ এই যে, দুনিয়াতে যাদুবিদ্যা শিক্ষা করে সুনিয়তের উপরই কায়েম থেকো। এমন যেন না হয় যে, আত্মরক্ষার অজুহাতে আমাদের কাছ থেকে শিখে নিজেই অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড় এবং দীন-ঈমান বরবাদ করে বস।

তখন ফেরেশতাদ্বয় এর চাইতে বেশি আর কিই বা করতে পারতেন ? তাদের কথামত যারা ওয়াদা অঙ্গীকার করত, তারা তাদের সামনে যাদুর মূল ও শাখা-প্রশাখা বর্ণনা করে দিতেন। কারণ, এটাই ছিল তাদের কর্তব্য কাজ। এখন যদি কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে কাফির হয়ে যায়, সেজন্য তারা দায়ী হবেন কেন ? কেউ কেউ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে যাদুকে সৃষ্ট জীবের অনিষ্ট সাধনে নিয়োজিত করে, যা নিশ্চিতরূপেই একটি দুষ্কর্ম। যাদু ব্যবহারের কোন কোন প্রক্রিয়া কুফরপূর্ণও বটে। এভাবে যাদু প্রয়োগকারী কাফিরে পরিণত হয়।

উপরোক্ত বিষয়টির উদাহরণ এভাবে দেওয়া যায়—ধরুন এক ব্যক্তি কুরআন হাদীস ও যুক্তি-তর্কে পারদর্শী পরহেযগার কোন আলেমের কাছে পৌঁছে বলল, হুযূর, আমাকে প্রাচীন অথবা আধুনিক দর্শন সম্পর্কে শিখিয়ে দিন, যাতে দর্শনে ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব আপত্তি বর্ণিত হয়েছে সে সম্পর্কে নিজেও অবগত হতে পারি এবং বিরোধীদের জওয়াব দিতে পারি। আলেম সাহেব মনে করলেন, লোকটি ধোঁকা দিয়ে দর্শন শিখে একে শরীয়তবিরোধী ভ্রান্ত বিশ্বাসকে জোরদার করার কাজেও ব্যবহার করতে পারে। তাই তিনি আগন্তুককে উপদেশ দিয়ে এরূপ না করতে বললেন। অতঃপর আগন্তুক যথাযথ ওয়াদা করা আলেম সাহেব তাকে দর্শন পড়িয়ে দিলেন। কিন্তু দর্শন শিক্ষা করার পর লোকটি যদি ইসলাম-বিরোধী বিশ্বাস ও মতবাদকেই বিশুদ্ধ ও নির্ভুল মনে করতে থাকে, তবে শিক্ষক আলেম সাহেবকে কোন পর্যায়ে দোষী সাব্যস্ত করা যায় কি ? তেমনিভাবে যাদু বলে দেওয়ার কারণে ফেরেশতাদ্বয়ও দোষী হতে পারেন না।

কর্তব্য সমাধা করার পর সম্ভবত ফেরেশতাদ্বয়কে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার আল্লাহ্ তা’আলাই জানেন। (বয়ানুল-কোরআন)

যাদুর স্বরূপ

অভিধানে ’সিহর’ শব্দের অর্থ এমন প্রতিক্রিয়া, যার কারণ প্রকাশ্য নয়।-(কামুস) কারণটি অর্থগতও হতে পারে। যেমন বিশেষ বিশেষ বাক্যের প্রতিক্রিয়া। আবার তা ইন্দ্রিয় বহির্ভূত বিষয়ের প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। যেমন, জ্বিন-পরী ও শয়তানের প্রতিক্রিয়া। অথবা মেসমেরিজমে কল্পনাশক্তির প্রতিক্রিয়াও হতে পারে, অথবা এমন ইন্দ্রিয় বহির্ভূত বিষয়ের প্রতিক্রিয়াও হতে পারে, যা দৃশ্য নয় যেমন দৃষ্টির অন্তরালে থেকে চুম্বকের প্রতিক্রিয়া লোহার জন্য অথবা অদৃশ্য ঔষধ-পত্রের প্রতিক্রিয়াও হতে পারে অথবা গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতিক্রিয়াও হতে পারে।

এ কারণেই যাদুর বহু প্রকারভেদ রয়েছে। কিন্তু সাধারণত পরিভাষায় যাদু বলতে এমন বিষয়কে বোঝায়, যাতে জ্বিন ও শয়তানের কারসাজি, কোন কোন শব্দ ও বাক্যের প্রভাব অথবা মেসমেরিজমে কল্পনাশক্তির প্রভাব। কারণ যুক্তি ও চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রাচীন ও আধুনিক দার্শনিকরাও স্বীকার করেন, অক্ষর ও শব্দাবলীর মধ্যেও বিশেষভাবে কিছু কার্যকারিতা রয়েছে। কোন বিশেষ অক্ষর অথবা শব্দকে বিশেষ সংখ্যায় পাঠ করলে অথবা লিপিবদ্ধ করলে বিশেষ বিশেষ প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। মানুষের চুল-নখ ইত্যাদি অথবা ব্যবহারের কাপড়ের সাথে অন্যান্য বস্তু-সামগ্রী একত্রিত করেও কিছু কার্যকারিতা হাসিল করা যায়; সাধারণ ভাষায় এগুলো টোনা-টোটকা (তন্ত্রমন্ত্র) নামে অভিহিত। এগুলোও যাদুর অন্তর্ভুক্ত।

কোরআন ও হাদীসের পরিভাষায় এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ডকে যাদু বলা হয়, যাতে শয়তানকে সন্তুষ্ট করে ওদের সাহায্য নেওয়া হয়। শয়তানদের সন্তুষ্ট করার বিভিন্ন পন্থা রয়েছে। কখনও এমন মন্ত্র পাঠ করা হয়, যাতে শিরক ও কুফরের বাক্যাবলী অথবা শয়তানের প্রশংসাসূচক চরণাবলী থাকে। আবার কখনও গ্রহ-নক্ষত্রের আরাধনা করা হয়। এতেও শয়তান সন্তুষ্ট হয়।

শয়তানের পছন্দনীয় কাজকর্ম করেও শয়তানকে সন্তুষ্ট করা যায়। উদাহরণত কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, তার রক্ত ব্যবহার করা, অপবিত্র অবস্থায় থাকা, পবিত্রতা বর্জন করা ইত্যাদি।

পরহেযগারী, পবিত্রতা, আল্লাহর যিকির পুণ্য কাজ, দুর্গন্ধ ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকা ইত্যাকার পছন্দনীয় কাজকর্ম অবলম্বন করে যেমন ফেরেশতাদের সাহায্য পাওয়া যায়, তেমনিভাবে শয়তানের পছন্দনীয় কথাবার্তা ও কাজকর্মের মাধ্যমে শয়তানের সাহায্য লাভ করা যায়। এ কারণেই যারা সর্বদা নোংরা ও অপবিত্র থাকে, আল্লাহর নাম মুখে উচ্চারণ করে না এবং অশ্লীল কাজকর্মে লিপ্ত থাকে, একমাত্র তারাই যাদুবিদ্যায় সফলতা অর্জন করে থাকে। হায়েয অবস্থায় রমণীরা এ কাজ করলে তা খুব কার্যকরী হয়। এ ছাড়া রূপক অর্থে ভেল্কিবাজি, টোটকা, হাতের সাফাই, মেসমেরিজম ইত্যাদিকেও যাদু বলা হয়। (রূহুল মা’আনী)

যাদুর প্রকারভেদ

ইমাম রাগেব ইস্পাহানী ‘মুফরাদাতুল-কোরআন’ নামক গ্রন্থে লিখেন, যাদু বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একপ্রকার নিছক নজরবন্দী ও কল্পনাপ্রসূত। বাস্তবতা বলতে এতে কিছুই নেই। উদাহরণত কোন কোন ভেল্কিবাজ হাতের সাফাই দ্বারা এমন কাজ করে ফেলে, যা সাধারণ লোক দেখতে সক্ষম হয় না। অথবা মেসমেরিজম তথা কল্পনাশক্তির মাধ্যমে কারও মস্তিষ্কে এমন প্রভাব সৃষ্টি করে যে, সে একটি অবাস্তব বস্তুকে চোখে দেখতে থাকে অথবা কানে শুনতে থাকে। মাঝে মাঝে শয়তানের প্রভাব দ্বারাও মন্ত্রমুগ্ধ ব্যক্তির মস্তিষ্কে ও দৃষ্টিশক্তিতে এমন প্রভাব সৃষ্টি করা যায়। তখন সে অবাস্তব বস্তুকে বাস্তব মনে করতে থাকে। এটা দ্বিতীয় প্রকার যাদু। কোরআন মজীদে বর্ণিত ফেরআউনের যাদুকরদের যাদু ছিল প্রথম প্রকারের। যেমন বলা হয়েছেঃ سَحِرُوْا اَعْيُنَ النَّاسِ -(তারা মানুষের দৃষ্টিশক্তিকে যাদু করল)। আরও বলা হয়েছেঃ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَى (তাদের যাদুর ফলে মূসার কল্পনায় ভাসতে লাগল যে, রশির সাপগুলো ইতস্তত ছুটোছুটি করছে)। এখানে يُخَيَّلُ (কল্পনায় ভাসতে লাগল) শব্দ দ্বারা বলা হয়েছে যে, যাদুকরদের নিক্ষিপ্ত রশি ও লাঠিগুলো প্রকৃতপক্ষে সাপও হয়নি এবং কোনরূপ ছুটোছুটিও করেনি; বরং হযরত মূসা (আ)-এর কল্পনাশক্তি প্রভাবান্বিত হয়ে সেগুলোকে ধাবমান সাপ বলে মনে করতে লাগল।

কোরআন মজীদে শয়তানের প্রভাবযুক্ত নজরবন্দি ও কল্পনাপ্রসূত দ্বিতীয় প্রকার যাদুর কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَى مَنْ تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ تَنَزَّلُ عَلَى كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ

অর্থাৎ —আমি তোমাদের বলি, কাদের উপর শয়তান অবতরণ করে, যতসব মিথ্যা অপবাদ রটনাকারী গোনাহ্গারের উপর শয়তান অবতরণ করে।

অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ

অর্থাৎ- বরং শয়তানরাই কুফরী করেছে, ওরা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত। 

তৃতীয় প্রকার যাদু হচ্ছে যাদুর মাধ্যমে বস্তুর সত্তা পরিবর্তন করে দেওয়া। যেমন, কোন মানুষ অথবা প্রাণীকে পাথর অথবা অন্য প্রাণী বানিয়ে দেওয়া। ইমাম রাগেব ইস্পাহানী, আবূ বকর জাসসাস প্রমুখ পণ্ডিত এই প্রকার যাদুর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন, যাদুর মাধ্যমে বস্তুর মূল সত্তা পরিবর্তন করা যায় না। বরং যাদুর প্রভাব নজর ও কল্পনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। মুতাযিলা সম্প্রদায়ও একথাই বলে। কিন্তু সাধারণ আলেমগণের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, বস্তুর সত্তা পরিবর্তন যুক্তি ও শরীয়তের দিক দিয়ে অসম্ভব নয়। উদাহরণত মানব দেহকে পাথরে পরিণত করা যেতে পারে।

কোরআন মজীদে ফেরআউনী যাদুকরদের যাদুকে কল্পনাপ্রসূত বলে আখ্যায়িত করা অর্থ এই নয় যে, সমস্ত যাদুই কাল্পনিক হবে কল্পনার ঊর্ধ্বে যাদু হবে না। যাদুর মাধ্যমে বস্তুর সত্তা পরিবর্তন করা সম্ভব--এ দাবির সমর্থনে কেউ কেউ কা’ব আহবার বর্ণিত একটি হাদীস পেশ করেন। হাদীসটি ’মুয়াত্তা ইমাম মালেক’ গ্রন্থে কা’কা’ ইবনে হাকীমের রেওয়ায়েতক্রমে এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ

لَوْلاَ كَلِمَاتٌ أَقُولُهُنَّ لَجَعَلَتْنِي يَهُودُ حِمَارًا

“আমি কিছুসংখ্যক বাক্য নিয়মিত পাঠ করি। এগুলো না হলে ইহুদীরা আমাকে গাধা বানিয়ে ছাড়ত।”

‘গাধা বানানো’ শব্দটি রূপক অর্থে ’বোকা’ বানানোর অর্থেও হতে পারে। কিন্তু প্রয়োজন ব্যতিরেকে প্রকৃত অর্থ বাদ দিয়ে রূপক অর্থ নেওয়া ঠিক নয়। তাই হাদীসের প্রকৃত অর্থ এই যে, ’বাক্যগুলো নিয়মিত পাঠ না করলে ইহুদী যাদুকররা আমাকে গাধা বানিয়ে দিত।’

এতদ্বারা দু’টি বিষয় প্রমাণিত হলোঃ (এক) যাদু দ্বারা মানুষকে গাধা বানানোও সম্ভব। (দুই) তিনি যে কতকগুলো বাক্য নিয়মিত পাঠ করতেন, সেগুলোর প্রভাবে তিনি নিম্নোদ্ধৃত বাক্যগুলো উল্লেখ করেনঃ

أَعُوذُ بِوَجْهِ اللَّهِ الْعَظِيمِ ، الَّذِي لَيْسَ شَيْءٌ أَعْظَمَ مِنْهُ ، وَبِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ الَّتِي لَا يُجَاوِزُهُنَّ بَرٌّ وَلَا فَاجِرٌ ، وَبِأَسْمَاءِ اللَّهِ الْحُسْنَى كُلِّهَا مَا عَلِمْتُ مِنْهَا وَمَا لَمْ أَعْلَمْ ، مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ وَبَرَأَ وَذَرَءَ

অর্থাৎ (আমি মহান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করি, যাঁর চাইতে মহান কেউ নেই। আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালামের আশ্রয় গ্রহণ করি, যা কোন পুণ্যবান কিংবা পাপাচারী অতিক্রম করতে পারে না। আমি আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের আশ্রয় গ্রহণ করি, যেগুলি আমি জানি বা জানি না; প্রত্যেক ঐ বস্তুর অনিষ্ট থেকে যা আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন, অস্তিত্ব দিয়েছেন এবং বিস্তৃত করেছেন।

মোটকথা, যাদুর উল্লিখিত তিনটি প্রকারই বাস্তবে সম্ভব।

যাদু ও মো’জেযার পার্থক্য

পয়গম্বরগণের মো’জেযা ও ওলীদের কারামাত দ্বারা যেমন অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ পায়, যাদুর মাধ্যমেও বাহ্যত তেমনি প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। ফলে মূর্খেরা বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে যাদুকরদেরকেও সম্মানিত ও মাননীয় মনে করতে থাকে। এ কারণে এতদুভয়ের পার্থক্য বর্ণনা করা দরকার।

বলা বাহুল্য, প্রকৃত সত্তার দিক দিয়ে এবং বাহ্যিক প্রতিক্রিয়ার দিক দিয়ে এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সত্তার পার্থক্য এই যে, যাদুর প্রভাবে সৃষ্ট ঘটনাবলীও কারণের আওতা বহির্ভূত নয় । পার্থক্য শুধু কারণটি দৃশ্য কিংবা অদৃশ্য হওয়ার মধ্যে। যেখানে কারণ দৃশ্যমান, সেখানে ঘটনাকে কারণের সাথে সম্পৃক্ত করে দেওয়া হয় এবং ঘটনাকে মোটেও বিস্ময়কর মনে করা হয় না। কিন্তু যেখানে কারণ অদৃশ্য, সেখানেই ঘটনাকে অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক মনে করা হয়। সাধারণ লোক ‘কারণ’ না জানার দরুন এ ধরনের ঘটনাকে অলৌকিক মনে করতে থাকে। অথচ বাস্তবে তা অন্যান্য অলৌকিক ঘটনারই মতো। কোন দূরদেশ থেকে আজকের লেখা পত্র হঠাৎ সামনে পড়লে দর্শকমাত্রই সেটাকে অলৌকিক বলে আখ্যায়িত করবে। অথচ জ্বিন ও শয়তানরা এ জাতীয় কাজের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়েছে। মোটকথা এই যে, যাদুর প্রভাবে দৃষ্ট ঘটনাবলীও প্রাকৃতিক কারণের অধীন। তবে কারণ অদৃশ্য হওয়ার দরুন মানুষ অলৌকিকতার বিভ্রান্তিতে পতিত হয়।

মো’জেযার অবস্থা এর বিপরীত। মোজেযা প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহ্ তা’আলার কাজ। এতে প্রাকৃতিক কারণের কোন হাত নেই। ইবরাহীম (আ)-এর জন্য নমরূদের জ্বালানো আগুনকে আল্লাহ্ তা’আলাই আদেশ করেছিলেন, ’ইবরাহীমের জন্য সুশীতল হয়ে যাও। কিন্তু এতটুকু শীতল নয় যে, ইবরাহীম কষ্ট অনুভব করে।’ আল্লাহর এই আদেশের ফলে অগ্নি শীতল হয়ে যায়।

ইদানিং কোন কোন লোক শরীরে ভেষজ প্রয়োগ করে আগুনের ভেতর চলে যায়। এটা মো’জেযা নয় ; বরং ভেষজের ক্রিয়া। তবে ভেষজটি অদৃশ্য, তাই মানুষ একে অলৌকিক বলে ধোঁকা খায় ।

স্বয়ং কোরআনের বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, মো’জেযা সরাসরি আল্লাহর কাজ। বলা হয়েছেঃ

وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى

অর্থাৎ আপনি যে একমুষ্টি কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তা আপনি নিক্ষেপ করেন নি; আল্লাহ্ নিক্ষেপ করেছিলেন। অর্থাৎ, এক মুষ্টি কঙ্কর যে সমবেত সবার চোখে পৌঁছে গেল, এতে আপনার কোন হাত ছিল না। এটা ছিল একান্তভাবেই আল্লাহর কাজ। এই মো’জেযাটি বদর যুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল। রসূলুল্লাহ্ (সা) এক মুষ্টি কঙ্কর কাফের বাহিনীর প্রতি নিক্ষেপ করেছিলেন যা সবার চোখেই পড়েছিল।

মো’জেযা প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াই সরাসরি আল্লাহর কাজ আর যাদু অদৃশ্য প্রাকৃতিক কারণের প্রভাব। এ পার্থক্যটিই মো’জেযা ও যাদুর স্বরূপ বোঝার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, সাধারণ লোক এই পার্থক্যটি কিভাবে বুঝবে? কারণ, বাহ্যিক রূপ উভয়েরই এক। এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, সাধারণ লোকদের বোঝার জন্যও আল্লাহ্ তা’আলা কয়েকটি পার্থক্য প্রকাশ করেছেন।

প্রথমত, মো’জেযা ও কারামত এমন ব্যক্তিবর্গের দ্বারা প্রকাশ পায়, যাদের আল্লাহভীতি, পবিত্রতা, চরিত্র ও কাজকর্ম সবার দৃষ্টির সামনে থাকে। পক্ষান্তরে যাদু তারাই প্রদর্শন করে, যারা নোংরা, অপবিত্র এবং আল্লাহর যিকর থেকে দূরে থাকে। এসব বিষয় চোখে দেখে প্রত্যেকেই মো’জেযা ও যাদুর পার্থক্য বোঝতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আল্লাহর চিরাচরিত রীতি এই যে, যে ব্যক্তি মো’জেযা ও নবুয়ত দাবি করে যাদু করতে চায়, তার যাদু প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। হ্যাঁ, নবুয়তের দাবি ছাড়া যাদু করলে তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

পয়গম্বরগণের উপর যাদু ক্রিয়া করে কি না? এ প্রশ্নের উত্তর হবে হ্যাঁ-বাচক। কারণ, পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, যাদু প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক কারণের প্রভাব। পয়গম্বরগণ প্রাকৃতিক কারণের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হতেন। এটা নবুয়তের মর্যাদার পরিপন্থী নয়। সবাই জানেন, বাহ্যিক কারণ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পয়গম্বরগণ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হতেন, রোগাক্রান্ত হতেন এবং আরোগ্য লাভ করতেন। তেমনিভাবে যাদুর অদৃশ্য কারণ দ্বারাও তারা প্রভাবান্বিত হতে পারেন এবং এটা নবুয়তের পরিপন্থী নয়। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, ইহুদীরা রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর যাদু করেছিল এবং সে যাদুর কিছু প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ পেয়েছিল। ওহীর মাধ্যমে তা জানা সম্ভব হয়েছিল এবং যাদুর প্রভাব দূরও করা হয়েছিল। মূসা (সা)-এর যাদুর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়া কোরআনেই উল্লিখিত রয়েছেঃ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَى এবং فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُوسَى যাদুর কারণেই মূসা (সা)-এর মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল।

শরীয়তে যাদু সম্পর্কিত বিধি-বিধান

পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে, কোরআন ও হাদীসের পরিভাষায় যাদু এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড, যাতে কুফর, শিরক এবং পাপাচার অবলম্বন করে জ্বিন ও শয়তানকে সন্তুষ্ট করা হয় এবং ওদের সাহায্য নেওয়া হয়। কোরআনে বর্ণিত বাবেল শহরে যাদু ছিল তাই।-(জাসসাস) এ যাদুকেই কোরআন কুফর বলে অভিহিত করেছে। আবূ মনসুর (র) বলেন, বিশুদ্ধ অভিমত এই যে, যাদুর সকল প্রকারই কুফর নয়; বরং যাতে ঈমানের বিপরীত কথাবার্তা এবং কাজকর্ম অবলম্বন করা হয়, তা-ই কুফর।-(রূহুল মা’আনী)

শয়তানকে অভিসম্পাত করা এবং শয়তানের বিরোধিতা করার নির্দেশ কোরআনে বারবার উল্লিখিত হয়েছে। এর বিপরীতে শয়তানের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং ওকে সন্তুষ্ট করার চিন্তা করা কঠিন গোনাহর কাজ। তদুপরি শয়তান তখনই সন্তুষ্ট হবে, যখন মানুষ ঈমান বিধ্বংসী কুফর ও শিরকে অথবা পাপাচারে লিপ্ত হবে এবং আল্লাহ্ ও ফেরেশতাদের পছন্দের বিপরীতে নোংরা ও অপবিত্র থাকবে। যাদুর সাহায্যে অনর্থক কারও ক্ষতি করলে তা হয় অধিকতর গোনাহ্ ।

মোটকথা, কোরআন ও হাদীসে যাকে যাদু বলা হয়েছে, তা বিশ্বাসগত কুফর অথবা অন্তত কার্যগত কুফর থেকে মুক্ত নয়। শয়তানকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কিছু শিরক ও কুফরী বাক্য বললে অথবা পন্থা অবলম্বন করলে, তা হবে প্রকৃত বিশ্বাসগত কুফর। পক্ষান্তরে এসব থেকে আত্মরক্ষা করে অপরাপর গোনাহ্ অবলম্বন করা হলে, তা কার্যগত কুফর থেকে মুক্ত হবে না। কোরআন মজীদের আয়াতসমূহে এ কারণেই যাদুকে কুফর বলা হয়েছে।

মোটকথা, শিরক ও কুফরযুক্ত যাদু যে কুফর, সে বিষয়ে ’ইজমা’ রয়েছে। যেমন, শয়তানের সাহায্য লওয়া, গ্রহ ও নক্ষত্রের প্রভাব স্বতন্ত্রভাবে স্বীকার করা, যাদুকে মো’জেযা আখ্যা দিয়ে নবুয়ত দাবি করা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে গোনাহযুক্ত যাদু কবীরা গোনাহ।

 বিশ্বাসগত অথবা কার্যগত কুফর থেকে মুক্ত নয়-এমন যাদু শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া এবং তার আমল করা হারাম। তবে মুসলমানদের ক্ষতি দূর করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজন অনুপাতে যাদু শিক্ষা করা কোন কোন ফিকাহ্‌বিদের মতে জায়েয। 

 কোরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় যেগুলোকে যাদু বলা হয়, সেগুলো ছাড়া অন্যান্য যাদুর মধ্যেও কুফর ও শিরক অবলম্বন করা হলে তাও হারাম।

 তাবীজ-গণ্ডায় জ্বিন ও শয়তানের সাহায্য নেওয়া হলে তাও যাদুর মতই হারাম। যদি অস্পষ্টতার কারণে বাক্যাবলীর অর্থ জানা না যায় এবং যেসব শব্দ দ্বারা শয়তানের সাহায্য লওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে তাও হারাম।

অনুমোদিত ও জায়েয বিষয়াদির সাহায্যে হলে এবং তা অবৈধ উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার না করার শর্তে জায়েয।

কোরআন ও হাদীসের বাক্যাবলীর সাহায্যে হলেও যদি তা অবৈধ উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করা হয়, তবে জায়েয নয়। উদাহরণত কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তাবিজ করা অথবা ওযীফা পাঠ করা। এহেন ওযীফা আল্লাহর নাম ও কোরআনের আয়াত সম্বলিত হলেও তা হারাম। (কাযী খান ও শামী)



************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url