দুনিয়ার তুচ্ছতা ও অপকারিতা || দুনিয়ার লোভ থেকে সতর্কীকরণ ||




ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মদ আল-গাযযালী (রহঃ) ছিলেন একজন যুগস্রেষ্ট সাধক ও আলেম। ইসলামের খেদমতে তাঁর বয়ান এবং তাঁর লেখা কিতাবগুলোর মাঝে এমন একটি যাদুকরী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যা অন্য কারো লেখায় বা বয়ানে এতটা প্রভাব সৃষ্টি করে না। তাঁর লেখা কিতাবগুলো পড়ে অতি সহজেই প্রতিটি পাঠকের হৃদয় বিগলিত হয়ে উঠে। “দোযখ ও দোযখের ভয়াবহ শাস্তির বয়ান” শীর্ষক এই প্রবন্ধখানা ইমাম গাযযালীর লেখা “মুকাশাফাতুল কুলূব” বা “আত্মার আলোকমণি” কিতাবের অনুস্মরণে লেখা হয়েছে।




দুনিয়ার তুচ্ছতা ও অপকারিতা এবং দুনিয়া থেকে সতর্কীকরণ

দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী আর পরকালীন জীবন চিরস্থায়ী। চিরস্থায়ী জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করে পার্থিব জীবনের আমল-আখলাক ও কর্মকাণ্ডের ওপর। কাজেই মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনটা খুবই গুরুত্ববহ; ভালো-মন্দ যা কিছু অর্জন করতে হয় তা এ জীবনেই করতে হয়, মৃত্যুর পর কোনো কিছু করার শক্তি-সামর্থ্য আর থাকে না। দুনিয়ার মোহ মায়া এড়িয়ে যারা আখেরাতের চিন্তায় মশগুল থাকে তারাই সফলকাম হন।

দুনিয়ার লোভঃ সা'লাবাহ্ ইবনে হাতেব-এর কাহিনী

হযরত আবূ উমামাহ বাহেলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, সা'লাবাহ্ ইবনে হাতেব হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলোঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আপনি আল্লাহর কাছে দোআ করে দিন, যাতে আমি মালদার ধনী হয়ে যাই। তিনি বললেন, তাহলে কি তোমার কাছে আমার তরীকা পছন্দ নয়? তুমি কি আল্লাহর নবীর আদর্শের উপর থাকতে আগ্রহী নও? শুন। সেই পবিত্র সত্তার কসম, যার আয়ত্বাধীনে আমার জীবন- যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তাহলে এ পাহাড়সমূহ সোনা-রূপায় পরিণত হয়ে আমার সাথে সাথে ঘুরতো। কিন্তু এমন ধনী হওয়া পছন্দনীয় নয়। লোকটি বললো, যে পবিত্র সত্তা আপনাকে সত্য নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম, যদি আপনি দোআ করেন এবং আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে ধন-ঐশ্বর্য দান করেন, তবে আমি অবশ্যই প্রত্যেক হকদারকে তার হক ও প্রাপ্য পৌঁছিয়ে দিবো এবং আরও অন্যান্য নেক কাজ করবো। এতে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোআ করলেন : "আয় আল্লাহ্ । সা'লাবাহকে সম্পদ দান কর।” ফলে, তার ছাগল-ভেড়ায় কীড়ার মত অসাধারণ প্রবৃদ্ধি আরম্ভ হয়। এমনকি মদীনায় বসবাসের জায়গাটি যখন তার জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, তখন সে মদীনার বাইরে একটি প্রশস্ত উপত্যকা নিয়ে নেয়। এখানে আসার পর কেবল যোহর ও আসর এই দুই ওয়াক্তের নামায মদীনায় এসে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জামাতে আদায় করতো এবং (পূর্বের বিপরীত) অন্যান্য নামায সেখানেই পড়ে নিতো, যেখানে তার মালামাল ছিল।

অতঃপর এসব ছাগল-ভেড়ার আরও প্রবৃদ্ধি ঘটে, যার ফলে সে জায়গাটিতেও তার সংকুলান হয় না। সুতরাং মদীনা শহর থেকে আরও দূরে গিয়ে কোন একটি জায়গা নিয়ে নেয়। সেখান থেকে সে শুধু জুমুআর নামাযের জন্য মদীনায় আসতো এবং অন্যান্য পাঞ্জেগানা নামাযগুলো সেখানেই পড়ে নিতো। তারপর এসব মালামাল কীড়ার মত আরও প্রবৃদ্ধি পেয়ে গেল। এখন সে জায়গাও তাকে ছাড়তে হয় এবং মদীনা থেকে বহু দূরে সরে যায়। সেখানে জুমুআ থেকেও তাকে বঞ্চিত হতে হয়। জুমুআর দিন মদীনা থেকে জুমুআ পড়ে প্রত্যাবর্তনকারীদের নিকট কেবল জিজ্ঞাসাবাদ করে সেখানকার অবস্থা জেনে নিতো।
কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের কাছে সে লোকটির অবস্থা জানতে চাইলে তারা বললো যে, তার মালামাল এতো বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে, শহরের কাছাকাছি কোথাও তার সংকুলান হয় না। ফলে, বহু দুরে কোথাও গিয়ে বসবাস করছে। এখন আর তাকে দেখা যায় না। হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে বললেন, يَا وَيحَ ثَعْلَبَةَ অর্থাৎ, সালাবাহর প্রতি আফসুস! সা'লাবার প্রতি আফসুস! সা'লাবার প্রতি আফসুস। ঘটনাক্রমে সে সময়েই মুসলমানদের থেকে সদকা আদায় করা সংক্রান্ত এই আয়াত নাযিল হয়ঃ

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِ عَلَيْهِمْ اِنَّ صَلَاتَكَ سَكَن لَّهُمْ

“আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যদ্বারা আপনি তাদেরকে পাক-পবিত্র করে দেন এবং তাদের জন্য দোআ করুন; নিশ্চয় আপনার দোআ তাদের জন্য শাস্তির কারণ।” (তওবাহ : ১০৩)

আল্লাহ্ তা'আলা সদকার যথাযথ আইন নাযিল করলেন। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুহাইনা গোত্রের একজন এবং সুলাইম গোত্রের একজনকে মুসলমানদের নিকট থেকে সদকা আদায় করার জন্য পাঠালেন এবং দু'জনের নিকটেই সদ্‌কার লিখিত ফরমান দিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলে দিলেন: তোমরা সা'লাবাহর নিকট যাও। এছাড়া বনী সুলাইমের আরও এক লোকের কাছে যাওয়ার হুকুম করলেন, তাদের কাছ থেকে সদকা ওসূল করার নির্দেশ দিলেন।

তারা উভয়ে যখন সা'লাবাহর নিকট গিয়ে পৌঁছালেন এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লিখিত ফরমান দেখালেন, তখন সা'লাবাহ্ বলতে লাগলো, এ তো জিযিয়া কর হয়ে গেল, এ তো জিযিয়া কর হয়ে গেল, এ তো জিযিয়ার ন্যায়ই আরেকটা। তারপর বললো, এখন আপনারা যান, ফেরার পথে এখানে হয়ে যাবেন। অতঃপর তারা সুলাইম গোত্রের লোকটির নিকট গেলেন। লোকটি তাদের কথা এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফরমান শুনলো। তারপর নিজের পালিত পশু উট- বকরীসমূহের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ছিল, তা থেকে সকার নেসাব অনুযায়ী পশু নিয়ে স্বয়ং সে দুই ওসূলকারীর কাছে হাজির হলেন। তারা পশুগুলো দেখে বললেন, আপনার উপর এরূপ উৎকৃষ্ট পশু সদকায় দান করা ওয়াজিব নয় এবং আমরাও আপনার কাছ থেকে এগুলো নিতে পারি না। সুলাইমী লোকটি বারবার বিনয় করে বললেন, আমি নিজের খুশীতে এগুলো দিতে চাই, আপনারা কবুল করে নিন।
অতঃপর এ দুই ওসুলকারী আরও অন্যান্য মুসলমানদের সদকা আদায় করে সা'লাবার কাছে আসলেন এবং তার কাছে পুনরায় সদকা আদায়ের কথা বললেন তখন সে বললো, দাও দেখি সদকার আইনগুলো আমাকে দেখাও। তা দেখে সে পূর্বের কথাই বলতে লাগলো, এ তো এক রকম জিযিয়া কর-ই। যা হোক, এখন আপনারা যান, আমি চিন্তা-বিবেচনা করবো।

তারা মদীনায় ফিরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হলেন। তিনি তাদেরকে দেখেই তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করার পূর্বেই আবার সে বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করলেন, যা পূর্বে বলেছিলেন। يا ويح ثعلبة يا ويحَ ثَعْلَبَةَ يَا وَيحَ ثعلبة (অর্থাৎ- সালাবার প্রতি আফসুস) তারপর সুলাইমীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে দোআ করলেন। অতঃপর তাঁরা দু'জন সা'লাবাহ্ ও সুলাইমী সম্পর্কিত আচার-আচরণ বিস্তারিত শুনালেন। 'তখন সা'লাবাহ্ সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়:

 وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ عٰهَدَ اللّٰهَ لَئِنۡ اٰتٰىنَا مِنۡ فَضۡلِهٖ لَنَصَّدَّقَنَّ وَ لَنَکُوۡنَنَّ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۷۵
 فَلَمَّاۤ اٰتٰهُمۡ مِّنۡ فَضۡلِهٖ بَخِلُوۡا بِهٖ وَ تَوَلَّوۡا وَّ هُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿۷۶
 فَلَمَّاۤ اٰتٰهُمۡ مِّنۡ فَضۡلِهٖ بَخِلُوۡا بِهٖ وَ تَوَلَّوۡا وَّ هُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿۷۶

অর্থাৎ, তাদের মধ্যে কোন কোন লোক এমনও রয়েছে, যারা আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিল যে, আল্লাহ্ যদি তাদের ধন-সম্পদ দান করেন, তবে তারা দান-খয়রাত করবে এবং উম্মতের সৎকর্মশীলদের (মত সমস্ত হকদার, আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-মিসকীনদের প্রাপ্য আদায় করে তাদের) অন্তর্ভুক্ত হবে। অতঃপর যখন আল্লাহ্ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে সম্পদ দান করলেন তখন কার্পণ্য করতে লাগলো এবং আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্যে বিমুখ হয়ে গেল। তারপর এরই পরিণতিতে তাদের অন্তরে মুনাফেকী স্থান করে নিয়েছে, সেদিন পর্যন্ত যেদিন তারা তাঁর সাথে গিয়ে মিলবে। তা এ জন্য যে, তারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা লংঘন করেছিল এবং এ জন্যে যে, তারা মিথ্যা কথা বলতো। (সূরা তওবাহ্, আয়াত : ৭৫,৭৬, ৭৭ ) এ আয়াত যখন নাযিল হয়, তখন সালাবার কতিপয় আত্মীয় আপনজনও সে মজলিসে উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্য হতে একজন সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা হয়ে সা'লাবার কাছে গিয়ে পৌঁছলো এবং তাকে ভর্ৎসনা করে বললো, তোমার সম্পর্কে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়ে গেছে। এ কথা শুনে সালাবাহ্ উদ্বিগ্ন হয়ে গেল এবং তৎক্ষণাৎ হাজির হয়ে আবেদন করলো, হুযূর। আমার সদকা কবুল করুন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে তোমার সদকা কবুল করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এ কথা শুনে সে নিজের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করতে লাগলো।
হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা তো তোমার নিজেরই কৃতকর্ম। আমি তোমাকে হুকুম করেছিলাম; তুমি তা মান্য কর নাই । এখন আর তোমার সদকা কবুল হতে পারে না। তখন সালাবাহ্ অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেল এবং এর কিছুদিন পরই রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে যায়। অতঃপর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাযিঃ) খলীফা হলে সা'লাবাহ্ তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে সদকা কবুল করার আবেদন জানালো। সিদ্দীকে আকবর (রাযিঃ) উত্তর দিলেন, যে ক্ষেত্রে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবুল করেন নাই, আমি কেমন করে কবুল করবো ।

হযরত আবূ বকর (রাযিঃ)-এর ওফাতের পর সা'লাবাহ্ হযরত উমর ফারুক (রাযিঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আবেদন জানালো। তিনিও সেই একই উত্তর দিলেন, যা হযরত আবূ বকর (রাযিঃ) দিয়েছিলেন। এরপর হযরত উসমান (রাযিঃ)-এর খেলাফত আমলেও সে নিবেদন করে। কিন্তু তিনিও অস্বীকার করেন। হযরত উসমান (রাযিঃ)-এর খেলাফতকালেই সা'লাবাহর মৃত্যু হয়।

দুনিয়ার লোভ সম্পর্কে ঈসার (আঃ) আমলের একটি গল্প

ইমাম জরীর (রহঃ) লাইস থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা এক ব্যক্তি হযরত ঈসা (আঃ)-এর সঙ্গ অবলম্বন করে তার সাথে সাথে পথ চলতে লাগলো। সে আরজ করলো, আমি আপনার সাহচর্যেই থাকবো। দু'জন পথ চলতে চলতে সমুদ্রের তীরে পৌঁছে খানা খেতে আরম্ভ করলেন। তাদের নিকট তিনটি রুটি ছিল। দুটি খেলেন আর একটি অবশিষ্ট রয়ে গেল। হযরত ঈসা (আঃ) পানি পান করার জন্য সমুদ্রের কিনারে গেলেন। কিন্তু এসে দেখেন যে, অবশিষ্ট রুটিটি নাই। তিনি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, রুটিটি কে নিলো? সে উত্তর করলো, আমি জানি না। হযরত ঈসা (আঃ) সাথীকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে লাগলেন। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে দেখতে পেলেন একটি হরিণী তার দু'টি বাচ্চা নিয়ে বিচরণ করছে। তিনি একটি বাচ্চাকে ডাকলেন। তৎক্ষণাৎ সে এসে উপস্থিত হলো। সেটিকে জবাই করে ভাজা করে তা থেকে তারা উভয়ে খেলেন। অতঃপর হযরত ঈসা (আঃ) বললেন : “আল্লাহর হুকুমে যিন্দা হয়ে যাও।" তৎক্ষণাৎ বাচ্চাটি উঠে দৌড়ে চলে গেল। হযরত ঈসা (আঃ) লোকটিকে বললেন, আমি قم باذن الله তোমাকে ঐ পবিত্র সত্তার কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, যার কুদরতে তোমাকে এ মু'জেযা দেখিয়েছি, তুমি বল—রুটিটি কে নিয়েছে? সে বললো, আমি জানি না।

অতঃপর তারা আরও অগ্রসর হয়ে একটি নদীর তীরে পৌঁছলেন। হযরত ঈসা (আঃ) লোকটির একটি হাত আকড়িয়ে ধরে নিলেন এবং নির্দ্বিধায় পানির উপর দিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। এবারও তিনি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, যে পবিত্র সত্তার কুদরতে আমি তোমাকে এ মুজেযা দেখালাম তার কসম দিয়ে বলছি, তুমি সত্য করে বল—সে রুটিটি কে নিয়েছে। লোকটি বললো, আমি জানি না।
অতঃপর তারা আরও অগ্রসর হলেন এবং একটি জঙ্গলে পৌঁছে বসে পড়লেন। হযরত ঈসা (আঃ) একটি মাটির ঢেলা হাতে নিয়ে বললেন, সোনা হয়ে যাও। তৎক্ষণাৎ সেটা সোনা হয়ে গেল। এটাকে হযরত ঈসা (আঃ) তিন ভাগে ভাগ করলেন এবং বললেন, এক ভাগ আমার, এক ভাগ তোমার এবং অবশিষ্ট ভাগটি যে রুটি নিয়েছে তার। এ কথা শুনে লোকটি বললো, (হুযুর!) রুটি আমি নিয়েছি। হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, এসব স্বর্ণই তোমাকে দিয়ে দিলাম। অতঃপর তিনি লোকটির নিকট থেকে পৃথক হয়ে গেলেন।

লোকটি জঙ্গল থেকে এখনও বের হয় নাই; এমন সময় দুজন দস্যু এসে হাজির হলো এবং তার কাছে মূল্যবান সম্পদ পেয়ে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। তখন লোকটি বললো, আমাকে হত্যা করো না, এই স্বর্ণ আমরা তিনজনেই সমানভাবে ভাগ করে নিলাম; আমাদের মধ্য হতে একজনকে বাজারে পাঠাও, খাদ্য খরিদ করে আনবে, আমরা এখন সকলেই খাবো। তারা একজনকে খাদ্যের জন্য বাজারে পাঠালো। বাজারে প্রেরিত লোকটি মনে মনে চিন্তা করলো- আমি এই স্বর্ণ ভাগাভাগি হতে দেই কেন ? খাদ্যের মধ্যে তাদের অজান্তে বিষ মিশিয়ে দেই; এতে তারা দুজন খানা খেয়েই বিষক্রিয়ায় মারা যাবে আর সম্পূর্ণ স্বর্ণ একা আমিই নিয়ে নিবো। এই চিন্তা করে সে খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে তা নিয়ে উপস্থিত হলো। ওদিকে যে দু'জন জঙ্গলে রয়ে গিয়েছিল, তারা চিন্তা করলো— আমরা সেই লোককে স্বর্ণের এক তৃতীয়াংশ কেন দেই; বরং সে এলেই তাকে আমরা হত্যা করবো এবং আমরা দু'জনেই স্বর্ণ ভাগ করে নিয়ে নিবো। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, যেই চিন্তা সেই কাজ—লোকটি বাজার থেকে আসলে তাকে তারা হত্যা করে ফেললো এবং খাদ্য খেয়ে নিলো। ফলে, খাদ্যের সাথে মিশ্রিত বিষক্রিয়ায় এরা দুজনও মারা গেল। এখন শুধু স্বর্ণ এবং পার্শ্বে তিনটি লাশ খালি জঙ্গলে পড়ে রইল। হযরত ঈসা (আঃ) ফেরার পথে এদিক দিয়ে আসছিলেন, তখন তিনি তার সঙ্গীদেরকে বললেন- এরই নাম দুনিয়া সতর্ক থেকো, সাবধানে চলো।

একদা বাদশাহ্ যুল-কারনাইন এক সম্প্রদায়ের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে থামলেন। তাদের অবস্থা ছিল- মানুষের জন্য উপাদেয় উপকরণ বলতে যা আছে, তা কিছুই তাদের কাছে ছিল না। এরা প্রচুর পরিমাণে কবর খুঁড়ে রেখেছিল। ভোর হতেই কবরের পার্শ্বে গিয়ে উপস্থিত হতো। সেগুলোর দেখা-শুনা করতো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতো। নামায পড়তো। চতুষ্পদ জন্তুর মত সবুজ-তাজা ঘাস ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করতো। এসব তরুলতার উপরই তারা সম্পূর্ণ জীবিকা নির্বাহ করতো।

বাদশাহ্ যুল-কারনাইন তাদের শাসন পরিচালকের নিকট লোক পাঠিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার জন্য সংবাদ দিলেন। কিন্তু সে জওয়াব দিল, তাকে আমার কোন প্রয়োজন নাই, বরং তার যদি আমার নিকট কোন প্রয়োজন থাকে, তবে তিনিই আমার কাছে আসুন। যুল-কারনাইন এ উত্তর পেয়ে বললেন, সে ঠিকই বলেছে। অতঃপর তিনি নিজেই শাসনকর্তার নিকট গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আমি আপনাকে সংবাদ দেওয়ার পর আপনি উপস্থিত না হওয়াতে আমি নিজেই হাজির হলাম। সে বললো, আমার কোন প্রয়োজন থাকলে অবশ্যই আমি হাজির হতাম। যুল-কারনাইন জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার আপনাদেরকে অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় ব্যতিক্রমী দেখি? শাসনকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার এ কথার অর্থ কি? তিনি বললেন, অর্থাৎ দুনিয়ার সাথে কিছুমাত্র সম্পর্কও আপনাদের দেখছি না, আপনারা সোনা-রূপা প্রভৃতি কিছুই জমা করেন নাই, যদ্‌দ্বারা উপকৃত হবেন? শাসনকর্তা বলতে লাগলেন, আমরা এসবকে ঘৃণা করি। কারণ, দেখা গেছে, যাদের হাতেই সম্পদ হয়েছে, তারাই দুনিয়া এবং দুনিয়ার সম্পদের মোহে মত্ত হয়ে গেছে। ফলে, এতোদপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সম্পদ থেকে তারা বঞ্চিত রয়ে গেছে। যুল-কারনাইন জিজ্ঞাসা করলেন, এর কি কারণ যে, আপনারা কবর খুঁড়ে রেখেছেন, ভোর-সকালে এসে সেগুলোর দেখা- শুনা করেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন? শাসনকর্তা বললেন, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যখন আমরা এসব কবর এবং আমাদের পার্থিব আশা-আকাংখার প্রতি দৃষ্টি করবো তখন এসব কবর আমাদেরকে দুনিয়ার আশা-আকাংখা ও লোভ-লালসা থেকে বিরত রাখবে।

যুল-কারনাইন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা তরুলতা খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন; এছাড়া আহারের যোগ্য আর কিছু আপনাদের নিকট দেখি না, আপনারা কি চতুষ্পদ জন্তু পালন করে সেগুলোর দুধ পান করে জীবন কাটাতে পারেন না? তাছাড়া এসব জন্তুকে আপনারা সওয়ারীর কাজেও ব্যবহার করতে পারেন। শাসনকর্তা বললেন, আমরা আমাদের উদরকে জীব- জানোয়ারের কবর বানাতে পছন্দ করি না। আমাদের অভিজ্ঞতা যে, যমীনের উদ্ভিদ আহার করেই আমরা তৃপ্ত হয়ে যাই। বস্তুতঃ আদম-সন্তানের জন্য অতি সাধারণ ও মামুলী খাদ্যই যথেষ্ট ; গলধঃকরণের পর যে কোন ধরনের খাদ্যের স্বাদ আর বাকী থাকে না। এ কথা বলার পর শাসনকর্তা যুল-কারনাইনের পশ্চাৎ থেকে হাত বাড়িয়ে একটি মৃতদেহের ধ্বংসাবশেষ মাথার খুলি উঠিয়ে তাকে বললেন, আপনি কি জানেন—এ লোকটি কে? তিনি অজ্ঞতা ব্যক্ত করে লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে শাসনকর্তা বললেন, সে এ পৃথিবীর একজন বাদশাহ। বহু ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী ছিল সে। কিন্তু জুলুম-অত্যাচার, অন্যায়-অনাচার, খেয়ানত ও অবাধ্যতার সীমা অতিক্রম করার পর সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আজকে তার ধ্বংসাবশেষের অবস্থা এই। বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা'আলা তার সমস্ত কৃতকর্ম লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন; পরকালের সেই বিচার দিনে তার শাস্তি হবে। অতঃপর আরেকটি মাথার খুলি উঠিয়ে শাসনকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি জানেন ইনি কে? যুল-কারনাইন অজ্ঞতা প্রকাশ করে পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, ইনিও একজন বাদশাহ, পূর্বের জালেম বাদশাহর পর আল্লাহ তা'আলা তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু তিনি পূর্বের বাদশাহর বিপরীত জুলুম- অত্যাচার ও অন্যায়-অনাচার থেকে দূরে রয়েছেন। রাজ্যে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আল্লাহর সম্মুখে বিনয় ও নিষ্ঠা অবলম্বন করেছেন।

পরিশেষে তিনিও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং আজকে তারও অস্তিত্বের অবস্থা এই, যা আপনি অবলোকন করছেন। কিন্তু তাঁর আমলনামাও আল্লাহর নিকট লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত রয়েছে। আখেরাতে তিনি আল্লাহর কাছে পুরস্কারপ্রাপ্ত হবেন।

অতঃপর বাদশাহ-যুল-কারনাইনের মাথার খুলির দিকে দৃষ্টি করে শাসনকর্তা বললেন, আপনার এ খুলির অবস্থাও উক্ত খুলিদ্বয়ের যে কোন একটির ন্যায় হবে। আপনি নিজেই চিন্তা করে দেখুন—কোন্ অবস্থার অনুকূলে আপনি জীবন পরিচালনা করে যাচ্ছেন। যুল-কারনাইন বললেন, হে শাসনকর্তা! আপনি কি আমার সাথীত্ব গ্রহণ করতে সম্মত আছেন? আপনাকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করে নিবো। আপনি আমার ওজীর ও পরামর্শদাতা হবেন। আল্লাহ তা'আলা আমাকে যা কিছু দিয়েছেন, তাতে আপনাকে শরীক করে নিচ্ছি। তিনি বললেন, আপনার এবং আমার একই অবস্থানে একত্রিত হওয়া ঠিক নয়, বরং এহেন সহঅবস্থান অবলম্বন করা আমাদের উভয়ের মধ্যে কারও পক্ষে সম্ভব হবে না। যুল-কারনাইন কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে তিনি বললেন, এর কারণ হচ্ছে, মানুষ আপনার শত্রু এবং আমার বন্ধু। যুল-কারনাইন বললেন, এর কারণ? তিনি বললেন, আপনার ধন-ঐশ্বর্যের কারণে তারা আপনার শত্রুতে পরিণত হয়েছে। আর আমি এসব কিছু পরিত্যাগ করেছি, কাজেই আমার শত্রু কেউ নাই। যুল- কারনাইন এতদশ্রবণে অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হলেন এবং অন্তরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি নিয়ে আপন গন্তব্যের পথে বিদায় নেন।
জনৈক কবি চমৎকার বলেছেন:

يَا مَنْ تَمَتَّعَ بِالدُّنْيَا وَزِينَتِهَا
ولَا تَنَاهُ عَنِ اللَّذَّاتِ عَيْنَاهُ

ওহে, যে দুনিয়ার চাকচিক্য ও ভোগ-বিলাসে মত্ত রয়েছ, এমনকি এই ভোগমত্ততার কারণে রাতের নিদ্রা পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়েছ-

شَغَلْت نَفْسَكَ فِيمَا لَيْسَ تُدْرِكُهُ
تَقولُ لِلَّهِ مَاذَا حِينَ تَلْقَاهُ

প্রবৃত্তির তাড়নায় তুমি এমন এক বস্তুর পিছনে পড়ে রয়েছ যা কোনদিন পাবে না। উপরন্তু যেদিন তুমি আল্লাহর সম্মুখীন হবে, সেদিন আল্লাহর কাছে তোমার কি জবাবদিহি হবে?

মাহমুদ বাহেলী (রহঃ) আবৃত্তি করেছেনঃ

الا إِنَّمَا الدُّنْيَا عَلَى الْمَرْءِ فِتْنَةٌ
على كُلِّ حَالٍ اقْبَلَتْ أَو تَوَلَّتْ

“জেনে রাখ, এ দুনিয়া হাসিল হোক আর না হোক সর্বাবস্থায়ই সে মানুষের জন্য ফেতনা ও পরীক্ষা।"

فَإِن أَقْبَلَتْ فَاسْتَقْبِلِ الشَّكَرَ دَائِماً
وَمَهُمَا تَوَلَّتْ فَاصْطَبِرْ وَتَثَبَّتْ

“কাজেই দুনিয়া যদি তোমার অনুকূলে আসে, তাহলে তুমি সর্বদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আর যদি প্রতিকূল হয়, তবে ধৈর্য ধারণ কর এবং দৃঢ় থাক।”



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url