তাফসীরে ইবনে কাসীর - ৮ || সুরা ফাতিহা-৮ || হিদায়াত শব্দের বিশ্লেষণ || সিরাতাল মুস্তাকীম এর বিশ্লেষণ ||





সুরা ফাতিহার তাফসীর - ৮


اهْدِنَا الصِّرٰطَ الْمُسْتَقِيمَ
৫। আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন ।

প্রশংসামূলক বাক্য আগে উল্লেখ করার কারণ


যেহেতু বান্দা প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করেছে এবং তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করেছে, সেহেতু এখন তার কর্তব্য হবে স্বীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা। যেমন পূর্বেই হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন : 'অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা যা চাবে তা সে পাবে।'
একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ এর মধ্যে কি পরিমাণ সূক্ষ্মতা ও প্রকৃষ্টতা রয়েছে! প্রথমে বিশ্বপ্রভুর যথোপযুক্ত প্রশংসা ও গুণগান, অতঃপর নিজের ও মুসলিম ভাইদের প্রয়োজন পূরণের জন্য আকুল প্রার্থনা। প্রার্থিত বস্তু লাভের এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা। এ উত্তম পন্থা নিজে পছন্দ করেই মহান আল্লাহ এ পন্থা স্বীয় বান্দাদের বাতলে দিলেন। কখনও কখনও প্রার্থনার সময় প্রার্থী স্বীয় অবস্থা ও প্রয়োজন প্রকাশ করে থাকে। যেমন মূসা (আঃ) বলেছিলেনঃ

رَبِّ اِنِّیْ لِمَاۤ اَنْزَلْتَ اِلَیَّ مِنْ خَیْرٍ فَقِیْرٌ

হে আমার রাব্ব! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবেন আমি তার কাঙ্গাল। (সূরা কাসাস, ২৮ ঃ ২৪) ইউনুস (আঃ) দু'আ করার সময় বলেছিলেনঃ

لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ١ۖۗ اِنِّیْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِیْنَ

আপনি ছাড়া কোন মা'বূদ নেই; আপনি পবিত্র, মহান; আমি তো সীমা লংঘনকারী। (সূরা আম্বিয়া, ২১:৮৭) কোন কোন প্রার্থনায় প্রার্থী শুধুমাত্র প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেই নীরব থাকে।

হিদায়াত শব্দের বিশ্লেষণ


এখানে হিদায়াতের অর্থ ইরশাদ ও তাওফীক অর্থাৎ সুপথ প্রদর্শন ও সক্ষমতা প্রদান। ' অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

وَ هَدَیْنٰهُ النَّجْدَیْنِ

এবং আমি তাদেরকে দু’টি পথ দেখিয়েছি। (৯০ নং সূরাহ্ বালাদ, আয়াত নং ১০) কখনো ‘হিদায়াত’ শব্দটি إِلَى-এর সাথে বা مُتَعَدِّىْ সকর্মক ক্রিয়া হয়ে থাকে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ

اِجْتَبٰىهُ وَ هَدٰىهُ اِلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ

মহান আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছিলেন এবং তাকে পরিচালিত করেছিলেন সরল সঠিক পথে। (১৬ নং সূরাহ্ নাহল, আয়াত নং ১২১) অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ

فَاهْدُوْهُمْ اِلٰى صِرَاطِ الْجَحِیْمِ

তাদেরকে ত্বারিত করো জাহান্নামের পথে। (৩৭ নং সূরাহ্ সাফফাত, আয়াত নং ২৩) এখানে হিদায়াতের অর্থ পথপ্রদর্শন ও রাস্তা বাতলে দেয়া। এরূপ ঘোষণা রয়েছেঃ

وَ اِنَّكَ لَتَهْدِیْۤ اِلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ

তুমি তো প্রদর্শন করো শুধু সরল পথ। (৪২ নং সূরাহ্ শুরা, আয়াত নং ৫২)

জ্বিন বা দানবের কথা কুর’আন মাজীদে রয়েছেঃ

الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْ هَدٰىنَا لِهٰذَا

যাবতীয় প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে পথপ্রদর্শন করেছেন। (৭ নং সূরাহ্ আ‘রাফ, আয়াত নং ৪৩) অর্থাৎ অনুগ্রহ পূর্বক সৎপথে পরিচালিত হওয়ার তাওফীক দান করেছেন।

সিরাতাল মুস্তাকীম এর বিশ্লেষণ


صِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ এর কয়েকটি অর্থ আছে। ইমাম আবূ জা'ফর ইবন তাবারী বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে সুস্পষ্ট, সরল ও পরিষ্কার রাস্তা যার কোন জায়গা বা কোন অংশই বাঁকা নয়। এ বিষয়ে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ একমত যে, সিরাতাল মুস্তাকীম হল ঐ সরল-সঠিক পথ যার কোন শাখা-প্রশাখা নেই। উদাহরণ স্বরূপ, জারীর ইব্‌ন আতীয়া আল-খাতাফীর একটি কবিতা উল্লেখ করা যেতে পারে : বিশ্বাসীদের নেতা রয়েছেন সেই পথে যা সব সময়েই সরল-সঠিক এবং অন্যান্য পথে রয়েছে বক্রতা। তাবারী (রহঃ) বলেছেন, এ বিষয়ে অনেক উদাহরণ রয়েছে। অতঃপর তিনি বলেন : আরাবরা সিরাত শব্দটি বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে ব্যবহার করে থাকে, তা সৎ কাজের জন্য হোক অথবা অসৎ কাজের জন্য হোক । কিন্তু সৎ ব্যক্তির জন্য সঠিক এবং অসৎ ব্যক্তির বেলায় বক্র শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। কুরআনে যে সরল-সঠিক পথের কথা বলা হয়েছে তা হল ইসলাম। (তাবারী ১/১৭০)

মুসনাদ আহমাদে একটি হাদীসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
'আল্লাহ তা'আলা صِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ এর একটা দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। তা এই যে, সীরাতে মুস্তাকীমের দুই দিকে দু'টি প্রাচীর রয়েছে। তাতে কয়েকটি খোলা দরজা আছে। দরজাগুলির উপর পর্দা লটকানো রয়েছে। সীরাতে মুস্তাকীমের প্রবেশ দ্বারে সব সময়ের জন্য একজন আহ্বানকারী নিযুক্ত রয়েছে। সে বলছে: 'হে জনমণ্ডলী! তোমরা সবাই এই সোজা পথ ধরে চলে যাও, আঁকা বাঁকা পথে যেওনা।' ঐ রাস্তার উপরে একজন আহ্বানকারী রয়েছে। যে কেহ এ দরজাগুলির কোন একটি খুলতে চাচ্ছে সে বলছে : সাবধান, তা খুলনা, যদি খুলে ফেল তাহলে সোজা পথ থেকে সরে পড়বে।' সীরাতে মুস্তাকীম হচ্ছে ইসলাম, প্রাচীরগুলি আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ, প্রবেশ দ্বারে আহ্বানকারী হচ্ছে কুরআন কারীম এবং রাস্তার উপরের আহ্বানকারী হচ্ছে আল্লাহর ভয় যা প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে উপদেষ্টা রূপে অবস্থান করে থাকে।' (আহমাদ ৪/১৮২) এ হাদীসটি মুসনাদ ইবন আবী হাতিম, তাফসীর ইব্‌ন জারীর, জামে' তিরমিযী এবং সুনান নাসাঈতেও রয়েছে এবং এর ইসনাদ হাসান সহীহ। আল্লাহই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন। মুজাহিদ (রহঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে 'হক বা সত্য'। তাঁর এ কথাটিই সবচেয়ে ব্যাপক এবং এসব কথার মধ্যে পারস্পরিক কোন বিরোধ নেই।

মু'মিনরাই হিদায়াতের আবেদন জানায়


যদি প্রশ্ন করা হয় যে, মু'মিনের তো পূর্বেই আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত লাভ হয়ে গেছে, সুতরাং সালাতে বা বাইরে হিদায়াত চাওয়ার আর প্রয়োজন কি? তাহলে সেই প্রশ্নের উত্তর এই যে, এতে উদ্দেশ্য হচ্ছে হিদায়াতের উপর সদা প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক চাওয়া। কেননা বান্দা প্রতিটি মুহুর্তে ও সর্বাবস্থায় প্রতিনিয়তই আল্লাহ তা'আলার প্রতি আশাবাদী ও মুখাপেক্ষী। সে নিজে স্বীয় জীবনের লাভ ক্ষতির মালিক নয়। বরং নিশিদিন সে আল্লাহরই প্রত্যাশী ও মুখাপেক্ষী। এ জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা তাকে শিখিয়েছেন যে, সে যেন সর্বদা হিদায়াত প্রার্থনা করে এবং তার উপর সদা প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক চাইতে থাকে। ভাগ্যবান সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তাঁর দরজায় ভিক্ষুক করে নিয়েছেন। সে আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে তার আকুল প্রার্থনা মঞ্জুর করার গুরু দায়িত্ব স্কন্ধে নিয়েছেন। বিশেষ করে অসহায় ও মুহতাজ ব্যক্তি যখন দিনরাত আল্লাহকে ডাকতে থাকে এবং প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনা জানায়, আল্লাহ তখন তার সেই আকুল প্রার্থনা কবুলের জিম্মাদার হয়ে যান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা কুরআন মাজীদে বলেনঃ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اٰمِنُوْا بِاللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ الْكِتٰبِ الَّذِیْ نَزَّلَ عَلٰى رَسُوْلِهٖ وَ الْكِتٰبِ الَّذِیْۤ اَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ

হে মু'মিনগণ! তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি এবং এই কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং ঐ কিতাবের প্রতি যা পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছিল। (সূরা নিসা, ৪ : ১৩৬) এ আয়াতে ঈমানদারগণকে ঈমান আনার নির্দেশ দেয়া এমনই, যেমন হিদায়াত প্রাপ্তগণকে হিদায়াত চাওয়ার নির্দেশ দেয়া। এই দুই স্থানেই উদ্দেশ্য হচ্ছে তার উপরে অটল, অনড় ও দ্বিধাহীনচিত্তে স্থির থাকা। আর এমন কার্যাবলী সদা সম্পাদন করা যা উদ্দেশ্য লাভে সহায়তা করে। দেখুন মহান আল্লাহ তাঁর ঈমানদার বান্দাগণকে নিম্নের এ প্রার্থনা করারও নির্দেশ দিচ্ছেনঃ

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً١ۚ اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ

হে আমাদের রাব্ব! আমাদেরকে পথ প্রদর্শনের পর আমাদের অন্তরসমূহ বক করবেননা এবং আমাদেরকে আপনার নিকট হতে করুণা প্রদান করুন, নিশ্চয়ই আপনি প্রভূত প্রদানকারী। (সূরা আলে ইমরান, ৩ : ৮)


সুতরাং اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ এর অর্থ দাঁড়ালো: 'হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল ও সোজা পথের উপর অটল ও স্থির রাখুন এবং তা হতে আমাদেরকে দূরে অপসারিত করবেন না।'





**************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url