তাফসীরে ইবনে কাসীর - ৯ || সুরা ফাতিহা - ৯ || সিরাতাল মুস্তাকিমের পথটি কেমন হবে ||





সুরা ফাতিহার তাফসীর - ৯



صِرٰطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ 
৬। তাদের পথ, যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন;

غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ 
৭। তাদের পথে নয় যাদের প্রতি আপনার গযব বর্ষিত হয়েছে,

وَلَا الضَّآلِّينَ
 তাদের পথেও নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

সিরাতাল মুস্তাকিমের পথটি কেমন হবে


এর বর্ণনা পূর্বেই গত হয়েছে যে, বান্দার এ কথার উপর মহান আল্লাহ বলেন, 'এটা আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দার জন্য ঐ সব কিছুই রয়েছে যা সে চাবে। এ আয়াতটি সীরাতে মুস্তাকীমের তাফসীর এবং ব্যাকারণবিদ বা নাহ্বীদের নিকট এটা 'সীরাতে মুস্তাকীম' হতে বদল হয়েছে এবং আতফ বায়ানও হতে পারে। আল্লাহ তা'আলাই এ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন। আর যারা আল্লাহর পুরস্কার লাভ করেছে তাদের বর্ণনা সূরা নিসার মধ্যে এসেছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَمَنْ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ الرَّسُوْلَ فَاُولٰٓىِٕكَ مَعَ الَّذِیْنَ اَنْعَمَ اللّٰهُ عَلَیْهِمْ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَ الصِّدِّیْقِیْنَ وَالشُّهَدَآءِ وَ الصّٰلِحِیْنَ١ۚ وَ حَسُنَ اُولٰٓىِٕكَ رَفِیْقًاؕ۝۶۹ ذٰلِكَ الْفَضْلُ مِنَ اللّٰهِ١ؕ وَ كَفٰى بِاللّٰهِ عَلِیْمًا

আর যে কেহ আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হয়, তারা ঐ ব্যক্তিদের সঙ্গী হবে যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন; অর্থাৎ নবীগণ, সত্য সাধকগণ, শহীদগণ ও সৎ কর্মশীলগণ; এবং এরাই সর্বোত্তম সঙ্গী। এটাই আল্লাহর অনুগ্রহ এবং আল্লাহর জ্ঞানই যথেষ্ট। (সূরা নিসা, ৪:৬৯-৭০)
আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, এ আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে : 'হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ঐ সব মালাক/ফেরেশতা, নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎলোকের পথে পরিচালিত করুন যাদেরকে আপনি আপনার আনুগত্য ও ইবাদতের কারণে পুরস্কৃত করেছেন।'

বলা হচ্ছে : 'হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সরল সোজা পথ প্রদর্শন করুন, ঐ সব লোকের পথ যাদেরকে আপনি পুরস্কৃত করেছেন, যারা হিদায়াত বা সুপথ প্রাপ্ত এবং অটল অবিচল ছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগত ছিলেন। যারা আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী ও নিষিদ্ধ কাজ হতে দূরে-বহুদূরে অবস্থানকারী ছিলেন। আর ঐ সব লোকের পথ হতে রক্ষা করুন যাদের উপর আপনার ধূমায়িত ক্রোধ ও অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে, যারা সত্যকে জেনে শুনেও তা থেকে দূরে সরে গেছে এবং পথভ্রষ্ট লোকদের পথ হতেও আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখুন যাদের সঠিক পথ সম্পর্কে কোন ধারণা ও জ্ঞানই নেই, যারা পথভ্রষ্ট হয়ে লক্ষ্যহীনভাবে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়ায় এবং তাদেরকে সরল, সঠিক সাওয়াবের পথ দেখানো হয়না ।


ঈমানদারদের পন্থা তো এটাই যে, সত্যের জ্ঞানও থাকতে হবে এবং তার আমলও থাকতে হবে। ইয়াহুদীদের আমল নেই এবং খৃষ্টানদের জ্ঞান নেই। এ জন্যই ইয়াহুদীরা অভিশপ্ত হল এবং খৃষ্টানরা হল পথভ্রষ্ট। কেননা জেনে শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে আমল পরিত্যাগ করা লা'নত বা অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

مَنْ لَّعَنَهُ اللّٰهُ وَ غَضِبَ عَلَیْهِ

যাদেরকে (ইয়াহুদীদেরকে) আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন এবং যাদের প্রতি গযব নাযিল করেছেন। (সূরা মায়িদাহ, ৫ : ৬০)

খৃষ্টানরা যদিও একটা জিনিসের ইচ্ছা করে, কিন্তু তার সঠিক পথ তারা পায়না। কেননা তাদের কর্মপন্থা ভুল এবং তারা সত্যের অনুসরণ হতে দূরে সরে পড়েছে। অভিশাপ ও পথভ্রষ্টতা এই দুই দলের তো রয়েছেই, কিন্তু ইয়াহুদীরা অভিশাপের অংশে একধাপ এগিয়ে রয়েছে। যেমন কুরআন কারীমে রয়েছেঃ

قَدْ ضَلُّوْا مِنْ قَبْلُ وَ اَضَلُّوْا كَثِیْرًا وَّ ضَلُّوْا عَنْ سَوَآءِ السَّبِیْلِ

যারা (খৃষ্টানরা) অতীতে নিজেরা ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে এবং অন্যান্যদেরকেও ভ্রান্তিতে নিক্ষেপ করেছে। (সূরা মায়িদাহ, ৫ : ৭৭)


এ কথার সমর্থনে বহু হাদীস ও বর্ণনা পেশ করা যেতে পারে। মুসনাদ আহমাদে আছে যে, আদী ইবন আবী হাতিম (রাঃ) বলেছেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেনাবাহিনী একদা আমার ফুফুকে এবং কতকগুলো লোককে বন্দী করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হাযির করেন। আমার ফুফু তখন বলেন : 'আমাকে দেখা-শোনা করার লোক দূরে সরে রয়েছে এবং আমি একজন অধিক বয়স্কা অচলা বৃদ্ধা। আমি কোন খিদমাতের যোগ্য নই। সুতরাং দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন। আল্লাহ আপনার উপরও দয়া করবেন।' রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন : 'যে তোমার খবরাখবর নিয়ে থাকে সে ব্যক্তিটি কে?” তিনি বললেন : 'আদী ইবন আবী হাতিম।' রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : 'সে কি ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে এদিক ওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে?' অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিনা শর্তে মুক্তি দেন। তারপর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসেন তখন তাঁর সাথে আর একটি লোক ছিলেন। খুব সম্ভব তিনি আলীই (রাঃ) ছিলেন। তিনি আমার ফুফুকে বললেন : 'যাও, তাঁর কাছে গিয়ে সাওয়ারীর প্রার্থনা কর।' আমার ফুফু তার কাছে প্রার্থনা জানালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে তা মঞ্জুর করেন এবং তিনি সাওয়ারী পেয়ে যান। তিনি ওখান হতে মুক্তি লাভ করে সোজা আমার নিকট চলে আসেন এবং বলেন : 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দানশীলতা তোমার পিতা হাতিমকেও ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর কাছে একবার কেহ গেলে আর শূন্য হাতে ফিরে আসেনা।' এ কথা শুনে আমিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু *আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাযির হই। আমি দেখি যে, ছোট ছেলে ও বৃদ্ধা স্ত্রীলোকেরা তাঁর কাছে অবাধে যাতায়াত করছে এবং তিনি তাদের সাথে অকুণ্ঠচিত্তে অকৃত্রিমভাবে আলাপ আলোচনা করছেন। এ দেখে আমার বিশ্বাস হল যে, তিনি কাইসার ও কিসরার মত বিশাল রাজত্ব ও সম্মানের অভিলাষী নন। তিনি আমাকে দেখে বলেন : 'আদী! 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' বলা হতে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? আল্লাহ ছাড়া অন্য কেহ উপাসনার যোগ্য আছে কি? 'আল্লাহু আকবার' বলা হতে এখন তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ কেন? মহাসম্মানিত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা থেকে বড় আর কেহ আছে কি?' (তাঁর এই কথাগুলি এবং তাঁর সরলতা ও অকৃত্রিমতা আমার উপর এমনভাবে দাগ কাটলো ও ক্রিয়াশীল হল যে) তৎক্ষণাত আমি ইসলাম কবূল করলাম এবং দেখতে পেলাম যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখমন্ডল আনন্দে রক্তিমাভ বর্ণ ধারণ করেছে। তিনি বললেনঃ


'যারা (আল্লাহর) ক্রোধ অর্জন করেছে তারা হল ইয়াহুদী এবং যারা ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে তারা হল খৃষ্টান।' এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযীও (রহঃ) বর্ণনা করেছেন এবং তিনি একে হাসান গারীব বলেছেন। (আহমাদ ৪/৩৭৮, তিরমিযী ৮/২৮৯)

مَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ দ্বারা ইয়াহুদকে বুঝানো হয়েছে এবং ضالون দ্বারা খৃষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে।' আরও একটি হাদীসে আছে যে, আদীর (রাঃ) প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই তাফসীরই করেছিলেন। এ হাদীসের অনেক সনদ আছে এবং বিভিন্ন শব্দে সে সব বর্ণিত হয়েছে।

ইতিহাসের পুস্তকসমূহে বর্ণিত আছে যে, যায়িদ ইবন আমর ইবন নুফায়িল যখন খাঁটি ধর্মের অনুসন্ধানে স্বীয় বন্ধুবান্ধব ও সাথী-সঙ্গীসহ বেরিয়ে পড়েন এবং এদিক ওদিক বিচরণের পর শেষে সিরিয়ায় এলেন। তখন ইয়াহুদীরা তাঁদেরকে বলল : 'আল্লাহর অভিশাপের কিছু অংশ না নেয়া পর্যন্ত আপনারা আমাদের ধর্মে আসতেই পারবেননা।' তাঁরা উত্তরে বললেন : 'তা হতে বাঁচার উদ্দেশেই তো আমরা সত্য ধর্মের অনুসন্ধানে বের হয়েছি, কাজেই কিরূপে তা গ্রহণ করতে পারি?' তাঁরা খৃষ্টানদের সাথে সাক্ষাৎ করলে তারা বলল : 'আল্লাহ তা'আলার লা'নত ও অসন্তুষ্টির কিছু অংশ না নেয়া পর্যন্ত আপনারা আমাদের ধর্মেও আসতে পারবেন না।'


তাঁরা বললেনঃ 'আমরা এটাও করতে পারিনা।' তারপর যায়িদ ইবন আমর ইবন নুফাইল স্বাভাবিক ধর্মের উপরই রয়ে গেলেন। তিনি মূর্তি পূজা ও স্বগোত্রীয় ধর্মত্যাগ করলেন, কিন্তু ইয়াহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম কোনক্রমেই গ্রহণ করলেননা। তবে তাঁর সঙ্গী সাথীরা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করল, কেননা ইয়াহুদীদের ধর্মের সঙ্গে এর অনেক মিল ছিল। যায়িদের ধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন অরাকা ইবন নাওফিল। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওতের যুগ পেয়েছিলেন এবং আল্লাহর হিদায়াত তাঁকে সুপথ প্রদর্শন করেছিল। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান এনেছিলেন ও সেই সময় পর্যন্ত যে ওয়াহী অবতীর্ণ হয়েছিল তিনি তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হউন।





*************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url