কাদিয়ানী ফিতনা বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান এক ও অভিন্ন (পর্ব - ২)
[কাদিয়ানী ফিতনা বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান এক ও অভিন্ন। সকল তরীকার মুসলিমগণই কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবী জানিয়ে আসছেন। এই বিষয়টি সাম্প্রতিক কালে আবারও খুব আলোচিত হচ্ছে। আমাদের মাঝে অনেকেই জানেন না, কাদিয়ানী কারা এবং তাদের আক্বিদা কিরূপ? আমরা এখানে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, উত্থান এবং তাদের বিশ্বাস ও আক্বিদা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইন শা আল্লাহ। প্রতি পর্ব মনোযোগ সহকারে পড়বেন এবং অন্যান্য মুসলিম ভাই বোনদের জন্য শেয়ার করবেন এই আশা রাখছি।]
মির্জা গোলাম আহমদের একেক সময় একেক দাবী
কোন কোন সময় মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারীরা মুসলমানদের বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্যে তার প্রথম যুগের লেখা বই পুস্তকের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে যে লেখাগুলোতে তিনি যে কোনভাবে নবী দাবী করাকে কুফরী বলা হয়েছে। কিন্তু গোলাম আহমদ স্বয়ং এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, সে মুজাদ্দিদ (নবায়নকারী), মুহাদ্দাছ (পূর্ব আলোচিত) মসীহে মাওউদ (প্রতিশ্রুত মসীহ বা ঈসা) এবং মাহদীর স্তর পার হয়ে ধাপে ধাপে উন্নতি করে নবীর পদ মর্যাদায় উপনীত হয়েছে। সে তার দাবীর যে ইতিহাস বর্ণনা করেছে, তা আমরা বিস্তারিতভাবে তারই ভাষায় বর্ণনা করছি। তাহলে পূর্বাপর লক্ষ্য রেখে তার মর্মার্থ পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে।
এক ব্যক্তি মির্জা গোলাম আহমদের নিকট প্রশ্ন রেখেছেন, "আপনার বিভিন্ন বর্ণনায় বৈপরীত্য দেখা যায়। কোথাও আপনি নিজেকে 'নবী নই' লিখেছেন, আবার কোথাও নিজেকে মসীহ (ঈসা আঃ) হতে সবদিক থেকে উত্তম" বলেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মির্জা গোলাম আহমদ তার 'হাকীকাতুল ওহী' নামক বইটিতে লিখেছে-
"এ বিষয়টি গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করে দেখো, এটা এমন ধরনের বৈপরীত্য, যেমন আমি "বারাহীনে আহমদিয়া” বইটিতে উল্লেখ করেছিলাম যে, মরিয়ম তনয় ঈসা আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। কিন্তু আমিই পরে লিখেছি যে, প্রতিশ্রুত মসীহ আমি স্বয়ং। এই বৈপরীত্যের কারণ এটাই যে, যদিও খোদা তা'আলা বারাহীনে আহমদীয়াতে আমার নাম রেখেছেন এবং একথাও এরশাদ করেছেন যে, তোমার আগমন সংবাদ খোদা এবং রাসুল (মুহাম্মদ দিয়েছিলেন, কিন্তু যেহেতু একদল মুসলমান এ বিশ্বাসে স্থির ছিলেন এবং আমারও এ বিশ্বাস ছিল যে, হযরত ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে অবতরণ করবেন, সেজন্যে আমি খোদা তা'আলার এই ওহীকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করতে চাইনি, বরং এই ওহীতে রূপক অর্থ গ্রহণ করেছি এবং আমার আকীদা-বিশ্বাসও তাই রেখেছি যা সাধারণ মুসলমানদের মাঝে ছিল এবং "বাবাহীন আহমদীয়াতে আমি সেটিকেই প্রকাশ করেছি।
কিন্তু পরবর্তীতে এ বিষয়ে ওহী আসতে থাকে বৃষ্টির মত। বলা হলো, মসীহ মাওউদ যিনি আসবেন বলে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তুমিই সেই ঈসা মসীহ। সেই সাথে শত শত নিদর্শন প্রকাশ পেল এবং আকাশ ও পৃথিবী এ উভয় সৃষ্টি আমার সত্যানে দাঁড়িয়ে গেল এবং খোদা তাআলার উজ্জ্বল নিদর্শন আমার মাঝে স্থান করে আমাকে মজবুতীর সাথে এ বিশ্বাসে নিয়ে এলো যে, শেষ যুগে পৃথিবীতে আগমনকারী ঈসা মসীহ আমিই স্বয়ং। তা না হলে আমার তো বিশ্বাস ভাই ছিল যা আমি 'বারাহীনে আহমাদিতে লিখেছি।
প্রথম প্রথম আমার আক্বীদা বা বিশ্বাস এটাই ছিল যে, আমার কি মরিয়ম তনয় ঈসার সাথে কোন তুলনা চলে? তিনি নবী এবং খোদার নৈকট্যপ্রাপ্ত সম্মানী ব্যক্তি। আর আমার যদি কোন শ্রেষ্ঠত্বের দিক প্রকাশ পেত, তাহলে আমি সেটাকে আংশিক শ্রেষ্ঠত্ব বলে মেনে নিতাম। কিন্তু পরবর্তীতে আমার উপর বৃষ্টি ধারার মত যে ওহী আসতে থাকে তা আমাকে এই আকীদার উপর স্থির থাকতে দেয়নি। আমাকে সুস্পষ্টভাবে নবীর খেতাব প্রদান করা হলো কিন্তু তা এভাবে যে একদিকে নবী এবং অন্যদিকে উম্মতী। আমি তার পবিত্র ওহীতে ঠিক তেমনিভাবে ঈমান রাখি যেমনিভাবে খোদাতাআলার সকল ওহীর উপর ঈমান রাখি যেগুলো পূর্বে নাজিল করা হয়েছে। আমি তো খোদাতাআলার ওহীর অনুসরণ করছি। যে পর্যন্ত আমার ওহী মারফত নতুন কোন জ্ঞানলাভ না হয়েছে আমি তাই বলে চলেছি যা প্রথম জীবনে বলে এসেছি। আর যখনই ওহী মারফত খোদার পক্ষ হতে নতুন কোন জ্ঞান লাভ করতে পেরেছি, তখন পূর্বের কথার বিপরীত বলেছি। (হাকীকাতুল ওজী, ১৪৯ ও ১৫০ পৃঃ)
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর এ উদ্ধৃতাংশ নিজ দাবীর স্বপক্ষে এতই সুস্পষ্ট যে, তাতে কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সামান্য প্রয়োজনও নেই। এ কথাগুলোর পর যদি কোন লোক তার সে সময়কার লেখা দেখায় যে সময় সে নবী দাবী করে নাই এবং তার ধারণা মত যখন সে নবী হওয়ার ঐশী জ্ঞান লাভ করেনি, তাহলে তাকে ধোকা ও প্রবঞ্চনা ব্যতীত আর কি বলা যেতে পারে?
মির্জা গোলাম আহমদের সর্বশেষ আকীদা-বিশ্বাস
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর সর্বশেষ আকীদা, যে আক্বীদার উপর তার মৃত্যু হয়েছে তা এটাই ছিল যে, সে নবী। তাই সে তার সর্বশেষ লেখা চিঠি, যা ঠিক তার মৃত্যুর দিনটিতে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে লিখেছে-
“আমি খোদা তা’আলার আদেশ অনুযায়ী একজন নবী। যদি আমি তা অস্বীকার করি তাহলে আমার গোনাহ হবে। আর খোদা যখন আমার নাম 'নবী' রেখেছেন তখন আমি তা কিভাবে অস্বীকার করতে পারি? আমি দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়া পর্যন্তই এ বিশ্বাসে স্থির থাকবো”। - হাকীকাতুন নবুওয়ত, পৃঃ ২৭১, রাওয়ালপিডি আলোচনা, পৃঃ ১৩৬)
এই চিঠিটি লেখা হয়েছে ১৯০৮ সনের ২৩শে মে এবং ২৬শে মে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সেদিনই গোলাম আহমদের মৃত্যু ঘটে।
শরীয়তবিহীন নবীর কাহিনী
কখনো কখনো কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, গোলাম আহমদ শরীয়তবিহীন নবুওয়তের দাবী করেছেন আর শরীয়তবিহীন নবুওয়তের দাবী করা খতমে নবুওয়তের পরিপন্থী নয়। কিন্তু তাদের কাদিয়ানী ফিতনা ও মুসলিম মিল্লাতের অবস্থান অন্যান্য অপব্যাখ্যার ন্যায় এই অপব্যাখ্যারও সকল কথা ভুল অসত্য। প্রথমত একথাই ঠিক নয় যে, মির্জা গোলাম আহমদ শুধুমাত্র শরীয়তবিহীন নবী হওয়ার দাবী করেছে।
গোলাম আহমদের শরীয়তসহ নবী হওয়ার দাবী
বাস্তব অবস্থা হলো এই উত্তরোত্তর দাবী করতে করতে মির্জা গোলাম আহমদ এক পর্যায়ে শরীয়তবিহীন নবী হওয়ার দাবীকেও অতিক্রম করে। সুস্পষ্ট ভাষায় নিজের কাছে আগত 'ওহী' এবং 'নবুওয়ত'কে 'শরীয়তযুক্ত' বলে ঘোষণা দেয়। সে জন্যেই তার অনুসারীদের মাঝে জহীরুদ্দীন আরোগীর উপদলটি তাকে প্রকাশ্যভাবে শরীয়তযুক্ত বলে স্বীকার করে। এ ব্যাপারে মির্জা গোলাম আহমদের বেশ কিছু উদ্ধৃতি রয়েছে।
'আরবাঈন' নামক পুস্তকে সে লিখেছে, এছাড়া একথাটাও বুঝো যে, শরীয়ত কাকে বলে? যিনি তার নিকট প্রেরিত ওহীর দ্বারা কিছু আদেশ ও নিষেধ প্রকাশ করেন এবং নিজ উম্মতের জন্যে এক সুনির্দিষ্ট আইনমালা নির্ধারণ করেন তিনিই শরীয়তবাহী' হন। তাহলে এই সংজ্ঞার আলোকে আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা নিশ্চয় অপরাধী। কেননা, আমার ওহীতে আদেশও রয়েছে, নিষেধও রয়েছে, যেমন, আমার নিকট প্রেরিত আল্লাহর এই বাণীঃ
আপনি মুমেনদের উদ্দেশ্যে বলুন, তারা যেন নিজেদের চোখ নামিয়ে রাখে এবং নিজ লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্যে অধিক পবিত্র বিধান, এটি 'বারাহীনে আহমদীয়া'তে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এতে আদেশও রয়েছে এবং নিষেধও রয়েছে। আর এ ওহীতে তেইশ বছরের নবী জীবনও অতিক্রান্ত হয়েছে। এভাবেই আজ পর্যন্ত আমার কাছে যে ওহী আসছে তাতে আদেশও রয়েছে, নিষেধও রয়েছে। আর যদি বলো যে, শরীয়ত দ্বারা ঐ শরীয়ত উদ্দেশ্য যার মাঝে নতুন বিধি বিধান থাকবে, তা তো ঠিক নয়। কেননা, আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ
"নিশ্চয় এ বিষয়টি পূর্ববর্তী গ্রন্থ ইবরাহীম ও মুসার নিকট প্রেরিত গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে'। অর্থাৎ কুরআনী শিক্ষা তাওরাতেও বিদ্যমান। আর যদি একথা বলো যে, শরীয়ত হচ্ছে তা যাতে আদেশ-নিষেধের পূর্ণ বিবরণ রয়েছে তাহলে তার সঠিক নয়। কেননা, যদি তাওরাত বা কুরআনে পূর্ণভাবে আদেশ-নিষেধের বিবরণ দেওয়া থাকতো, তাহলে তো ইজতিহাদ বা গবেষণার সুযোগ থাকতো না মোটেই"। - (আরবাঈন, ৪ খন্ড, ৭ পৃঃ ৪র্থ মুদ্রন)
উল্লেখিত উদ্ধৃতিতে মির্জা গোলাম আহমদ সুস্পষ্ট ভাষায় নিজের নিকট আগত 'ওহীকে' শরীয়তযুক্ত ওহী বলে দাবী করেছে। এছাড়া 'দাফেউল বালা' নামক গ্রন্থে সে লিখেছে 'খোদা তা’আলা এই উম্মতের মধ্য থেকেই মসীহ মাওউদ (প্রত্যাশিত মসীহ)-কে পাঠিয়েছেন, যে পূর্বতন মসীহ (ঈসা আঃ) থেকে সর্ব দিক থেকেই অগ্রগামী। তিনি এই মসীহের নাম রেখেছেন গোলাম আহমদ। (দাফেউল বালা, ১০ পৃষ্ঠা, (১৯০২)
আমরা জানি যে, ঈসা (আঃ) ছিলেন শরীয়তবাহী নবী। তাই যে ব্যক্তি সর্বদিক থেকে তাঁর চাইতে অগ্রগামী হবে সে কি শরীয়তবাহী নবী হবে না? তাই একথা বলা মোটেই ঠিক হবে না যে, মির্জা গোলাম আহমদ কখনো শরীয়তবাহী নবী হওয়ার দাবী করেনি।
এ ছাড়া কাদিয়ানী সম্প্রদায় কার্যতঃ তাকে শরীয়তবাহী' নবী বলেই গণ্য করে। তারা গোলাম আহমদের প্রতিটি শিক্ষা ও হুকুমকে 'অবশ্য পালনীয়' হিসাবে মেনে চলে, তা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসগ্রামের শরীয়তের বিপরীত ও বিরোধী হলেও। যেমন মির্জা গোলাম আহমদ 'আরবাঈন' নামক পুস্তকের ৪র্থ খন্ডের ১৫ পৃষ্ঠায় টীকাতে লিখেছে- জিহাদ অর্থাৎ ধর্মীয় লড়াইয়ের তীব্রতা ক্রমে ক্রমেই খোদা তাআলা কমিয়ে এনেছেন। মুসা(আঃ)- এর যুগে জিহাদের এতটুকু তীব্রতা ছিল যে, ঈমান আনা নিহত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারতো না। দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও হত্যা করা হতো। পরবর্তীতে আমাদের নবী(সঃ)- এর যুগে শিশু, বৃদ্ধ এবং মহিলাদের হত্যা করা হারাম করে দেওয়া হয়েছে। আর কোন কোন জাতির জন্যে ঈমানের পরিবর্তে শুধু 'লিথিয়া' প্রদান করে শাস্তি থেকে রেহাই দেয়ার ব্যবস্থা মেনে নেয়া হয়েছে। এখন মসীহে মাওউদের সময় সম্পূর্ণভাবে জিহাদের হুকুম স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। (আরবাঈন, ৪র্থ খন্ড, ১৫ পৃষ্ঠা, ১ম মুদ্রণ, ১৯১০)।
অথচ নবী করীম (সাঃ)-এর পক্ষ হতে সুস্পষ্ট এবং প্রকাশ্য ঘোষণা রয়েছে যে, জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। আবু দাউদ ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারীরা নবী করীম(সাঃ) -এর এ সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য আদেশকে বর্জন করে গোলাম আহমদের আদেশের অনুসরণ করে। এভাবে শরীয়তে মুহাম্মদীতে জিহাদ, খুমুস, ফাই, জিজিয়া এবং গনিমতের যে সকল বিধি বিধান রয়েছে যা হাদীস এবং ফিকহের কিতাবগুলোতে শত শত পৃষ্ঠা ব্যাপী আলোচিত ও বর্ণিত হয়েছে, তারা গোলাম আহমদের উপরোক্ত কথার ভিত্তিতে এ সকল বিধান বদলানো এবং রহিত করার পক্ষপাতি। এরপরও গোলাম আহমদকে শরীয়তবাহী নবী না বলার কোন সুযোগ রয়েছে কি?
**************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.