কাদিয়ানী ফিতনা বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান এক ও অভিন্ন (পর্ব - ৩)



[কাদিয়ানী ফিতনা বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান এক ও অভিন্ন। সকল তরীকার মুসলিমগণই কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবী জানিয়ে আসছেন। এই বিষয়টি সাম্প্রতিক কালে আবারও খুব আলোচিত হচ্ছে। আমাদের মাঝে অনেকেই জানেন না, কাদিয়ানী কারা এবং তাদের আক্বিদা কিরূপ? আমরা এখানে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, উত্থান এবং তাদের বিশ্বাস ও আক্বিদা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইন শা আল্লাহ। প্রতি পর্ব মনোযোগ সহকারে পড়বেন এবং অন্যান্য মুসলিম ভাই বোনদের জন্য শেয়ার করবেন এই আশা রাখছি।]




খতমে নবুওয়ত এবং জিল্লী ও বুরূযী নবুওয়তের অলীক দাবী

খতমে নবুওয়ত এ কোন প্রকারভেদ নেই

যদি একথা ধরে নেয়া হয় যে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী শরীয়তবাহী নবী হবার দাবী করেনি, বরং শরীয়তবিহীন নবী হওয়ার দাবীতে সীমিত থেকেছে, তথাপি আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি যে, খতমে নবুওয়তের আকীদায় এ ধরনের কোন পার্থক্য সৃষ্টি করা যে, অমুক ধরনের নবুওয়ত শেষ হলেও অমুক ধরনের নবুওয়ত এখনো বহাল রয়েছে। এটা সেই ধোঁকা ও প্রবঞ্চনারই অংশ, যে সম্পর্কে নবী করীম (সঃ) আমাদের হুঁশিয়ার করে গেছেন। মির্জা গোলাম আহমদ ও তার অনুসারীদের এই পার্থক্য বর্ণনার প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন উঠে যে, কুরআন শরীফের কোন আয়াতে বা নবী করিম (সঃ)-এর কোন হাদীসে এ কথা উল্লেখ হয়েছে যে, খতমে নবুওয়তের যে আকীদা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল শত সহস্র বার আলোচনা করেছেন তা শুধু শরীয়তবাহী নবীর বেলায় প্রযোজ্য, শরীয়তবিহীন নবুওয়ত তার আওতায় আসেনি! যদি নবী করীম (সঃ)-এর পর শরীয়তবিহীন ধারা অব্যাহত থাকতো তাহলে কুরআনের কোন আয়াত, রাসূলে আকরাম (সাঃ) -এর লাখ লাখ হাদীসের মাঝে কোন এক হাদীস বা সাহাবায়ে কেরামের অসংখ্য কথার মাঝে কোন একটি কথাও কেন এর স্বপক্ষে বর্ণিত হয়নি?

বরং আমরা দেখেছি এসব কিছুতে সুস্পষ্ট ভাষায় এটাই ঘোষণা করা হয়েছে যে, সব ধরনের নবুওয়তই শেষ হয়ে গেছে এবং নবী করীম (সঃ)-এর পর আর কোন ধরনের কোন নবী আসবে না। 'খতমে নবুওয়ত' সম্পর্কিত বহু শত হাদীসের মাঝে নিম্নোক্ত হাদীসগুলো লক্ষ্য করুন-

(১) রিসালাত এবং নবুওয়ত শেষ হয়ে গেছে। তাই, আমার পর আর কোন রাসূলও হবে না আর কোন নবীও হবেনা। (তিরমিজী, ২য় খণ্ড, ৫১ পৃষ্ঠা, স্বপ্ন অধ্যায়)

এ হাদীসটিতে দুটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। এক, হাদীসটিতে নবী ও রাসূলের ধারার সমাপ্তির সাথে সাথে নবুওয়ত ও রিসালতও সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দুই এখানে রাসূল এবং নবী দুটো শব্দই একত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। আর যেখানে এ দুটো শব্দ একত্রে ব্যবহার করা হয়, সেখানে রাসূল শব্দের অর্থ হয় নতুন শরীয়তের প্রবর্তক এবং আগে থেকে প্রচলিত শরীয়তের অনুসরণকারীকে বলা হয় নবী। সুতরাং এ হাদীসটিতে সুস্পষ্টভাবে শরীয়তবাহী বা শরীয়তবিহীন উভয় ধরনের নবীর আগমনকে সব সময়ের জন্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
       
(২) নবী কারীম (সাঃ) তাঁর শেষ জীবনে অসিয়ত হিসেবে যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন তন্মধ্যে একটি হাদীস হচ্ছে-

“হে লোকেরা! নবুওয়তের সুসংবাদবাহী হিসেবে শুধুমাত্র 'সত্য স্বপ্ন' অবশিষ্ট রয়েছে, আর কিছু অবশিষ্ট নাই”। (মুসলিম, নাসাঈ ইত্যাদি) 

(৩) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সঃ) বলেছেন, “বনী ইসরাঈলের লোকদের শাসন পরিচালনা করতেন নবীগণ । তাই যখনই কোন নবী মৃত্যুবরণ করতেন, তখনই অপর এক নবী তাঁর দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন। কিন্তু লক্ষ্য করো, আমার পর কোন নবী হবেনা, তবে 'খলীফা' হবে। এবং তারা বিপুল সংখ্যক হবে। তখন উপস্থিত সাহাবীগণ আরজ করলেন, আপনি তাদের সম্পর্কে আমাদের কি হুকুম করেন? নবী করীম (সঃ) বললেন, "তোমরা একের পর এক তাঁদের বাইয়াতের হক যথাযথভাবে আদায় করো"। (বোখারী, ৯১ পৃষ্ঠা, ১ম শত, নবী অধ্যায়, মুসলিম, ১২৬ পৃষ্ঠা, ২য় খণ্ড, নেতৃত্ব অধ্যায়)।

এ হাদীসটিতে বনী ইসরাঈলের যে নবীদের কথা বলা হয়েছে তাঁরা কেউ নতুন শরীয়তবাহী ছিলেন না, বরং তাঁরা সবাই হযরত মুসা (আঃ)-এর নিয়ে আসা শরীয়তের অনুসারী ছিলেন। হাদীসটিতে বনী ইসরাঈলের নবীদের মত নবী না আসার কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ এটাই হলো যে, রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর পর শরীয়তবিহীন বনী ইসলাঈলের নবীদের মত নবীও আসবেনা। সেই সাথে নবীর পরিবর্তে 'খলিফার' আগমন ঘটবে, নবী করীম (সঃ) এ সংবাদ দিয়েছেন, কিন্তু কোন ধরনের ছায়া নবী বা উম্মতী নবীর আগমন সম্পর্কে সামান্য ইশারাও দেননি।

আশ্চর্যের ব্যাপার কাদিয়ানীদের বিশ্বাস অনুযায়ী দুনিয়ায় এমন একজন উচ্চ মর্যাদার নবীর আগমন ঘটবে যিনি বনী ইসরাঈলের সমস্ত নবী থেকে শ্রেষ্ঠ এবং যার মাঝে নবী করীম (সঃ)-এর সমস্ত শ্ৰেষ্ঠত্ব, সৌন্দর্য ও সমস্ত গুণাবলীর সমাবেশ ঘটবে; তাকে অস্বীকার এবং প্রত্যাখ্যান করলে কাফের, বিভ্রান্ত, দূর্ভাগা এবং আল্লাহর আজাবের পাত্র হতে হবে। অথচ আল্লাহ্ স্বয়ং এবং তাঁর রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কোন আয়াত বা হাদীসে তার অগ্রহন সম্পর্কে সামান্য কিছুও বলেননি; বরং বলেছেন, নবী করীম (সঃ)-এর পর আর কোন নবী আসবে না এবং যারা নবী দাবী করবে তারা হবে ধোঁকাবাজ ও মিথ্যুক। শুধু এটুকুই নয়, তাঁর বিদায়ের পর খলীফাদের আগমন ঘটবে সে কথাও সুস্পষ্টভাবে বলে গিয়েছেন, কিন্তু এমন ব্যক্তিত্বপূর্ণ বিশাল মর্যাদার অধিকারী উম্মতী নবীর আগমন সম্পর্কে সামান্য ইশারাও তিনি দেননি। তাহলে এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সঃ) এ উম্মতকে ইচ্ছাকৃতভাবে সব সময়ের জন্যে এক বিভ্রান্তির মাঝে ছেড়ে দিয়েছেন, যার ফলে তার সব ধরনের নবুওয়ত শেষ হয়ে গিয়েছে বলে বুঝাবে এবং আগত শরীয়তবিহীন নবীকে অস্বীকার করে কাফের, গোমরাহ ও অস্রাবের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। কোন লোক আল্লাহ্ ও তাঁর সম্পর্কে মুসলমান থাকাবস্থায় এ ধারনা করতে পারে কি?
       
আরবী ব্যাকরণের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীও জানে যে, আমার পর কোন নবী আসবে না' এ হাদীসটির মূল আরবী কথাটি কালেমা তায়্যেবার প্রথমাংশের সাদৃশ্য অতএব কেউ যদি হাদীসটিতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা বৈধ মনে করে, তাহলে তার নিকট কালেমার প্রথমাংশের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বৈধ হবে। তাই, হদীসটির ব্যাখ্যা বর্ণনা করে যদি সে বলে, শরীয়তসহ কোন নবীর অগ্রহন যদিও ঘটবেনা, কিন্তু ছায়ারূপে উম্মতী হয়েও শরীয়তবিহীন হয়ে নদী হতে পারে। তাহলে কালেমার প্রথমাংশের ব্যাখ্যা স্বরূপ কেউ এ কথাও বলতে পারবে যে, সকল ক্ষমতার অধিকারী বিশ্ব নিয়ন্তা খোদা তো একজনই, কিন্তু ছোট ছোট দায়িত্বপ্রাপ্ত ও মূল খোদার ছায়ারূণী আরো অনেক খোদা হতে পারে যারা ইবাদত পাওয়ার যোগ্য হবে তাহলে তাওহীদের কিছু অবশিষ্ট রইল কি? পৃথিবীর, মুশরিক জাতিগুলের আকীদা-বিশ্বাসের সাথে ইসলামের কোন পার্থক্য থাকবে কি? ছোট ছোট খোলার অস্তিত্ব মেনে নিলে ইসলামের প্রথম মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস তাওহীদ যদি বিলীন হয়ে যায়, তাহলে শরীয়ত বিহীন ছায়া নবী ও উম্মতী নবীর অস্তিত্ব স্বীকার করার দ্বারা ইসলামের দ্বিতীয় মৌলিক আক্বীদা অর্থাৎ 'খতমে নবুওয়ত' কি নিঃশেষ হয়ে যাবে না? 

এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো হযরত ঈসা মসীহ (আঃ) বেঁচে রয়েছেন এবং তিনি পুনরায় পৃথিবীতে আসবেন এ আকীদার সাথে 'খতমে নবুওয়ত আকীদার কোন বৈপরীত্য নেই। কেননা, খতমে নবুওয়ত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসগুলো পড়ে শুনে একজন সাধারণ মুসলমানও তাই বুঝবে হা উম্মতের সবাই এক মত হয়ে বুঝেছেন ও সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন তা হলো, নবী করীম (সঃ)-এর পর কোন নবীর ন হ করীম (সঃ) 'খাতামুন নবীঈ' বা শেষ নবী বলার অর্থ কেউ এটা মনে করেনা যে, তাঁর পূর্বের সব নদীর নদী হিসেবে যে মর্যাদা তা লোপ পেয়েছে বা তাঁরা সবাই মারা গেছেন। যেমন কেউ নিজেকে 'খাতামুল আওলাদ' বা শেষ সন্তান বললে এ অর্থ কেউ করবেনা যে, তার পূর্বের সন্তানরা কেউ আর এখন সন্তান নয় বা তারা সবাই মারা গেছে। বরং এটা বুঝবে যে, তারপর আর কোন জন মেয়াদি। তেমনি নবী করীম (স) নিজেকে খাতামুন নবী বা শেষ নবী বলার কারণে পূর্বের নরীদের মর্যাদা বিলোপ বা মৃত্যুবরণের অর্থ খুব বে না, বরং এর অর্থ হবে, তাঁর পর আর কোন নদীর হবে না।

গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে 'খাতামুল আওলাদ' শব্দের সেই অর্থই গ্রহণ করেছে যা সবার কাছে গৃহীত ও পরিচিত। সে লিখছে, "অতএব, এটাই হলো যে, যার মাঝে মানবিক সকল গুণাবদীর পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে সে হবে 'খাতামুল আওলাদ'; অর্থাৎ তার মৃত্যুর পর এমন পূর্ণতার অধিকারী কোন লোক মায়ের গর্ভ থেকে বের হবে না। -(তিরয়াকুল কুলুব ২৯৭ পৃষ্টা, ৩য় সংস্করণ, ১৯৩৮) 

এ বিষয়টিকে আরো স্পষ্টভাবে বুঝানোর জন্যে সে লিখেছে "আমার পর আমার পিতামাতার আর কোন সন্তান হয়নি। অতএব আমিই ছিলাম তাদের 'খাতামুল আওলাদ'।
       
তাহলে স্বয়ং মির্জা গোলাম আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী 'খাতামুন নাবীঈন'-এর অর্থ হবে, নবী করীম (সঃ)-এর মৃত্যুর পর আর কোন নবী মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিবে না। খতমে নবুওয়তের আকীদার সাথে ঈসা (আঃ)-এর পৃথিবীতে আগমনের কোন রকমের বৈপরীত্য আছে কি? মোটেই বৈপরীতা নেই, কেননা ঈসা (আঃ) তখন মায়ের প থেকে বের হলেন না। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে, তাঁর মর্যাদা শেষ হয়ে গেছে বা তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন? কখনোই নয়। অথচ, গোলাম আহমদ 'খাতামুন নাবীঈন' বলে ঈসা (আঃ)-কে মৃত প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়েছে।

জিল্লী ও বুরূযী নবুওয়তের অলীক দাবী

গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারীগণ কখনো আবার এ কথা বলে যে, মির্জা গোলাম আহমদের নবুওয়ত জিল্লী বা ছায়ারূপ ছিল এবং তার নবুওয়ত বুকমী তথা প্রকাশিত নবুওয়ত ছিল। এ ধরনের নবুওয়ত নবী করীম (সঃ)-এর নবুওয়তের প্রতিবিম্ব সদৃশ। তাই, এ ধরনের নবুওয়তে 'খতমে নবুওয়ত আকীদায় কোন চিড় বা ফাটল ধরানো হয়নি। কেননা, কোন কিছুর ছায়া বা প্রতিবিম্ব মূল বিষয় হয় না। কিন্তু বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম বলেন, এ ধরনের নবুওয়ত মূল নবুওয়তে আক্বীদা রাখার চাইতেও অনেক বেশী কুফরী এবং বিপজ্জনক ধ্যান
ধারনা। কারণঃ

(১) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের এক সাধারণ ছাত্রও জানে ছায়ারূপ এবং বুক বা প্রকাশরূপ-এ দুটি ধারনাই সম্পূর্ণ হিন্দু ধর্মীয় ধ্যান-ধারনা। ইসলামে এই ধরনের কোন ধারনা পোষণ করার ন্যূনতম অবকাশ নেই।
(২) জি এবং বী নবুওয়তের যে ব্যাখ্যা মির্জা গোলাম আহমদ স্বয়ং বর্ণনা করেছে তাতে এমন নবী অতীতের সকল নদীর চাইতে শ্রেষ্ঠ ও উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন নবী হবেন। কেননা, সে হবে শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রতিচ্ছবি বা পুনর্জন লাভকারী স্বত্তা। এ হিসেবেই মির্জা গোলাম আহমদ বেশ ক'বারই যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথে এই ঘোষণা দিয়েছে যে, সে-ই নবী করীম (সঃ)। নিম্নের উদ্ধৃতিগুলো লক্ষ্য করুন।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url