তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন - ৬ || আল বাকারার সংক্ষিপ্ত আলোচনা || মদীনায় হিজরতের কারণ ||






সূরা আল বাকারার সংক্ষিপ্ত আলোচনা

   
হিজরতের অব্যবহিত পর যে কয়টি সূরা নাযিল হয়, সূরা 'আল বাকারা' তার অন্যতম। এটি সমগ্র কোরআনের দীর্ঘতম সূরা। সবচাইতে বিশুদ্ধ অভিমত এই যে, এ সূরার আয়াতগুলো সব ধারাবাহিকভাবে নাযিল হয়নি এবং এ সূরাটি শেষ না হতেই অন্যান্য সূরার আয়াতসমূহ নাযিল হতে শুরু করে। এ সুরার কোনো কোনো আয়াত ও অন্যান্য মাদানী সূরার কোন কোন আয়াতের | নাযিল হওয়ার উপলক্ষ সন্ধান করতে গেলে জানা যায় যে, মদীনায় অবতীর্ণ দীর্ঘ সুরাগুলোর সব কয়টির বেলাতেই এ কথা প্রযোজ্য। এ সূরাগুলোর সকল আয়াত একত্রে এবং ধারাবাহিকভাবে নাযিল হয়নি। সাধারণত একটি সূরার প্রাথমিক কিছু আয়াত নাযিল হওয়ার পর তার বাকী আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার আগেই পরবর্তী সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলো নাযিল হওয়াকেই মাপকাঠি বলে ধরা হয় পুরো সূরা নাযিল হওয়াকে নয়। আলোচ্য সূরায় সূদ সংক্রান্ত যে | আয়াতগুলো রয়েছে তা নাযিল হয়েছে কোরআন নাযিলের শেষ পর্যায়ে। পক্ষান্তরে একই সূরার প্রথমাংশ হচ্ছে মদীনায় নাযিল হওয়া অংশের সূচনাকালের ।

পরে আলাদা ওহীর মাধ্যমে এই বিক্ষিপ্ত আয়াতগুলোকে সংশ্লিষ্ট সূরায় একত্রিত করা হয় এবং তাদের ধারা বিন্যাস করা হয়। হযরত ইবনে আব্বাসের বরাত দিয়ে তিরমিযী শরীফে একটা হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত ওসমান (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি 'আনফালের' মত ছোট সূরা ও 'তাওবার' মত বড় সুরাকে পরপর সাজালেন এবং উভয়ের মধ্যে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' লিখলেন না। উপরন্তু সূরা আনফালকে বড় বড় সাতটা সূরার মধ্যে স্থান দিলেন, এটা কিভাবে করলেন। হযরত ওসমান (রা.) বললেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সময় সময় এক সাথে একাধিক সূরা নাযিল হতো। এভাবে যখন কোন আয়াত নাযিল হতো তখন তিনি একজন লিখতে জানা লোককে ডেকে বলতেন, অমুক আয়াতটা অমুক অমুক বিষয়ে যে সূরায় আলোচিত হয়েছে তাতে সন্নিবেশিত করো। সূরা 'আনফাল' মদীনার জীবনের প্রথম দিকে এবং 'তওবা' শেষের দিকে নাযিল হয়। উভয়ের আলোচ্য বিষয় ছিলো অনেকটা একই রকমের। আমার মনে হয়েছিলো 'আনফাল' বুঝি 'তওবারই অংশ। কিন্তু রসূল (স.) 'আনফাল' তওবার' অংশ কিনা তা না বলেই এন্তেকাল করেন। এ জন্যে আমি উভয় সূরাকে পর পর বিন্যস্ত করেছি। কেবল 'বিসমিল্লাহ' লিখিনি এবং সূরাটি সাতটি বড় সূরার মধ্যে শামিল করেছি।

এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, প্রত্যেক সূরায় আয়াতসমূহের বিন্যাস ও সন্নিবেশ স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশক্রমেই সম্পন্ন হতো। বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কল্যাণমূলক কাজে রসূলুল্লাহ | সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই ছিলেন সবচেয়ে তৎপর। বিশেষত রমযানে যখন তিনি জিবরাইলের সাথে মিলিত হতেন তখনই তিনি কল্যাণের কাজে সবচেয়ে বেশী তৎপর ও সক্রিয় হয়ে উঠতেন। রমযানে প্রতি রাত্রেই জিবরাঈল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। রমযান মাসের শেষ পর্যন্তই এই প্রক্রিয়া চলতো। এই সময় রসূল তাঁর সামনে কোরআন পেশ করতেন। অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, এই সময় তিনি ও জিবরাইল পরস্পরে কোরআনের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করতেন। জিবরাঈলের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি কল্যাণধর্মী কাজে 'চলন্ত বাতাসের মত' সক্রিয় হয়ে উঠতেন। বস্তুত, এটা সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য যে, জিবরাঈল রসূলকে সমগ্র কোরআন পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাঁরা উভয়ে আয়াতগুলো সংশ্লিষ্ট সূরার মধ্যে সন্নিবেশিত ও সুবিন্যস্ত থাকা অবস্থায় কোরআন পড়েছেন।

এ জন্যেই যে ব্যক্তি কোরআনের ছায়াতলে জীবন যাপন করে অর্থাৎ কোরআনকে নিবিষ্টচিত্তে নিয়মিত অধ্যয়ন করে ও তার শিক্ষার প্রভাব আপন জীবনে প্রতিফলিত করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে সে কোরআনের প্রতিটি সূরার মধ্যে এক একটা অনন্য বৈশিষ্ট লক্ষ্য করে থাকে। সে অনুভব করে যেন প্রত্যেকটা সূরার একটা সজীব ও প্রাণবন্ত সত্তা রয়েছে যা হৃদয়ের লালন ও বিকাশে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন করে থাকে একজন যথার্থ জীবন্ত ও সুপরিচিত ব্যক্তির প্রাণবন্ত সত্তা। সে আরো লক্ষ্য করে যে, প্রত্যেকটা সুরার এক অথবা একাধিক আলোচ্য বিষয় রয়েছে যা একটা সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় বিষয়ের সাথে সংযুক্ত থাকে। তা ছাড়া প্রত্যেকটা সূরার এক একটা বিশেষ পটভূমি রয়েছে। সূরায় আলোচিত সব ক'টি বিষয় সেই পটভূমির আওতাধীন থাকে। অতপর কতিপয় সুনির্দিষ্ট দিক থেকে সেই বিষয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়। এক একটা ছন্দগত সুর ব্যঞ্জনাও প্রত্যেক সূরায় লক্ষ্যণীয়। বক্তব্যধারার পটভূমিতে তা যখন ভিন্ন খাতে মোড় নেয় তখন বুঝতে হবে যে, বিশেষ কোনো বক্তব্য উপলক্ষ্যেই তার পরিবর্তন ঘটেছে। কোরআনের সকল সুরারই এ এক সাধারণ বৈশিষ্ট। দীর্ঘ সূরাগুলোর কোনোটাতেই এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি-সূরা বাকারাতেও নয়।

সূরা বাকারায় বেশ কয়েকটি বিষয় আলোচিত হয়েছে, তবে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় বিষয় এসব কয়টি আলোচ্য বিষয়কেই সংযুক্ত করেছে। আলোচনার দু'টো প্রধান ধারা এই কেন্দ্রীয় বিষয়ের জন্যে গভীরভাবে সন্নিবেশিত ও সম্মিলিত হয়েছে। এই দু'টো প্রধান ধারার একটা হলো মদীনায় অবস্থিত ও প্রচলিত ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে বনী ইসরাঈলের বিরূপ দৃষ্টিভংগী, তার প্রতি তাদের বিরূপ সমালোচনা এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা ইসলামী সংগঠনের বিরুদ্ধাচরণ। সেই সাথে ইহুদী ও বর্ণচোরা মুসলমান তথা মোনাফেকদের মধ্যে এবং ইহুদী ও মোশরেকদের মধ্যে বিরাজমান সুগভীর ও গাঁটছড়াও এ ধারার আওতাভুক্ত। আলোচনার দ্বিতীয় ধারাটা ইসলামী সংগঠনের আবির্ভাবের সূচনাকালীন অবস্থা এবং মোমেনদেরকে পৃথিবীতে ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার গুরু দায়িত্ব পালনের যোগ্য করে গড়ে তোলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এর আগেই সূরা বাকারায় এ দায়িত্ব পালনে বনী ইসরাঈল তথা ইহুদী-খৃষ্টান জাতিদ্বয়ের ব্যর্থতা, এ ব্যাপারে তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে দেয়া অংগীকার ভংগ এবং আদি ও আসল তাওহীদের | নিশানবাহী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রকৃত ও যথার্থ বংশধর হওয়ার গৌরব ও অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। আর যে সব ভ্রান্ত কার্যকলাপের | জন্যে বনী ইসরাঈল এত বড় গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সেগুলো থেকে সংযত ও নিবৃত থাকার জন্যে মুসলিম জনগণকে সাবধান করা হয়েছে। এ দু'টো প্রধান ধারার সমন্বয়ে ও সংযোগেই গঠিত হয়েছে সূরা বাকারার কেন্দ্রীয় বক্তব্য। এই কেন্দ্রীয় বক্তব্যকে আবর্তন করেই সুরার অন্য সকল বিষয় আলোচিত হয়েছে। আগামীতে এসব বিষয়ের পূর্ণাংগ পর্যালোচনা করার সময় কথাটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

   

সূরা বাকারার উক্ত কেন্দ্রীয় বক্তব্যের সাথে তার আলোচ্য বিষয়গুলো এবং মদীনার প্রথম ইসলামী আন্দোলনের সাথে ইসলামী সংগঠনের জীবনধারা ও তার বাধা-বিপত্তিগুলো যে কতো গভীরভাবে সম্পৃক্ত ও কেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলার জন্যে আমি এ বাধাগুলোর ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয় মনে করি। কেননা শুরুতে এ বাধা-বিপত্তিগুলো মোকাবেলা করার পথনির্দেশ হিসেবেই এই সূরায় আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিলো। এই সংগে এ কথাও জানা দরকার যে, চিরদিনই ইসলামী আন্দোলনের কাফেলার এসব বাধা-বিঘ্ন মোকাবেলা করতে হয়েছে। হয়তো সময় সময় তার আকারে-আকৃতিতে কিছুটা পার্থক্য ঘটেছে। কিন্তু শত্রু মিত্র উভয়ের পক্ষ থেকে বাধা-বিঘ্ন আসা একটা অবধারিত ও চিরন্তন ব্যাপার। এ জন্যে কোরআনের এসব দিক নির্দেশনা ইসলামী আন্দোলনের শাশ্বত ও চিরন্তন সনদে পরিণত হয়েছে যা প্রত্যেক যুগের ও প্রত্যেক প্রকারের সমস্যা মোকাবেলায় সক্ষম। এসব বাধা-বিঘ্নকে কোরআন মুসলিম জাতির পথের দিশা হিসাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে যা দেখে সে তার দীর্ঘ ও বন্ধুর পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও শিক্ষা লাভ করতে পারে। এ পথে সে যত বিরোধ ও শত্রুতার সম্মুখীন হয়, তার বৈশিষ্ট বিচিত্র হলেও প্রকৃতি অভিন্ন। বস্তুত, কোরআনের প্রতিটি বাণীতে এই যে বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট পরিলক্ষিত হয় তা মূলত কোরআনের আলৌকিকত্বেরই আংশিক প্রতিফলন মাত্র।

মদীনায় হিজরতের কারণ

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনায় হিজরত কোন অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক ঘটনা ছিলো না। সে জন্যে তাকে আগে থেকেই দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিলো এবং সে জন্যে উপযুক্ত প্রেক্ষাপটও তৈরী করা হয়েছিলো। হিজরতের ঘটনাটা একটা বিশেষ ধরনের পরিস্থিতির অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই দেখা দিয়েছিলো। ইসলামী আন্দোলনকে যে খাতে প্রবাহিত করার পরিকল্পনা আল্লাহ তায়ালা দিয়েছিলেন, তার জন্যে এটা ছিলো একটি অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ । রসূলের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক আবু তালেব এবং হযরত খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহার ইন্তেকালের পর মক্কার ইসলামী আন্দোলনের প্রতি কোরায়শদের আক্রোশ ও বিদ্বেষমূলক আচরণ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। এ আচরণ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিলো যে, মক্কায় ও তার আশেপাশে ইসলামী আন্দোলনের কাজ প্রায় বন্ধই করে দিতে হয়েছিলো। এর একমাত্র কারণ ছিলো কোরায়শদের প্রবল শত্রুতামূলক নীতি এবং যে কোনো উপায়ে এ দাওয়াতের কাজকে প্রতিরোধ করার সংকল্প । এর ফলে বাদবাকী আরবরা ইসলামী আন্দোলনকে এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করে। তারা অপেক্ষা করতে থাকে রসূলুল্লাহ (স.) ও তাঁর স্বজনদের এ লড়াই কোথায় গিয়ে পড়ায় তা দেখার জন্যে। কোরায়শদের এই প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো আবু লাহাব, আবু জেহেল ও আবু সুফিয়ানের মত রসূলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা। সে সময়কার আরব সমাজের গোত্রীয় পরিবেশে আত্মীয়তার বন্ধন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তার প্রচার করা আকীদা ও আদর্শকে আমল দিতে আরবদের উৎসাহ বোধ করার কোন কারণ ছিলো না। বিশেষত তাঁর এই আত্মীয়-স্বজনই ছিলো পবিত্র কাবা শরীফের খাদেম ও মোতাওয়াল্লী। বস্তুত, কাবা শরীফের খাদেম ও তত্ত্বাবধায়ক হওয়াটা তখনকার দিনে সমগ্র আরব উপদ্বীপে ধর্মীয় নেতৃত্বের সার্টিফিকেট বলেও বিবেচিত হতো ।

এসব কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দাওয়াতের কাজ পরিচালনার জন্যে মক্কা ছাড়া অন্য কোন ঘাঁটির সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। সে ঘাঁটি হওয়া চাই এমন পর্যায়ের যেখানে তাঁর আকীদা-বিশ্বাস সংরক্ষিত ও নিরাপদ হবে, অবাধ স্বাধীন ও নির্বিঘ্ন কাজের পরিবেশ থাকবে। সেখানে ইসলামী আন্দোলন মক্কার অচলাবস্থা থেকে মুক্ত হবে, দাওয়াতের কাজ অব্যাহত ও নিরবচ্ছিন্ন গতিতে চলতে পারবে এবং ইসলামে দীক্ষা গ্রহণকারীরা উৎপীড়ন ও অত্যাচার থেকে রেহাই পাবে।

আমার বিবেচনায় এটাই ছিলো হিজরতের প্রথম ও প্রধান কারণ।

ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার ঘাঁটি হিসেবে মদীনাকে বেছে নেয়ার আগে আরো কয়েক | জায়গায় হিজরত করা হয়েছিলো। হিজরত করা হয়েছিলো আবিসিনিয়ায়, সেখানে প্রাথমিক যুগের বিপুলসংখ্যক মুসলমান হিজরত করেন। এই হিজরতকে কেউ কেউ নিছক জান বাঁচানোর হিজরত বলে আখ্যায়িত করে থাকেন; কিন্তু এ অভিমতের সপক্ষে কোন বলিষ্ঠ যুক্তি নেই । এটা যদি সত্য হতো তাহলে মুসলমানদের ভেতরে যারা সবচেয়ে বেশী দুর্বল, সহায় সম্বলহীন ও প্রতিপত্তিহীন, তারাই কেবল হিজরত করতেন। কিন্তু বাস্তব ব্যাপার ছিলো এর বিপরীত। সমাজের দুর্বলতম শ্রেণী দাসদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিলেন এবং যাদের ওপর সবচেয়ে বেশী নিপীড়ন নির্যাতন চলছিলো তাঁদের কেউ এ হিজরতে অংশগ্রহণ করেননি। বরং ওপর তলার অভিজাত লোকেরাই এই হিজরতে অংশ নেন। অথচ একটা গোত্র প্রধান সমাজে তাঁদের আভিজাত্য তাদেরকে অত্যাচার ও উৎপীড়ন থেকে অনেকাংশেই রেহাই দিতে সক্ষম ছিলো। মোহাজেরদের অধিকাংশই ছিলো কোরায়শ বংশীয়। তাদের মধ্যে ছিলেন আবু তালেবের পুত্র জাফর। আবু তালেব ও তার সাথে বনু হাশেমের তরুণরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাফেরদের অত্যচার থেকে রক্ষা করতো। যোবায়ের ইবনুল আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আওফ, আবু সালামা মাখযুমী ও ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা.)ও ছিলেন আবিসিনিয়ার মোহাজেরদের অন্যতম। কিছু সংখ্যক মহিলাও হিজরত করেছিলেন। তারাও মক্কার অভিজাত পরিবারের সদস্যা ছিলেন, যার জন্যে তাদের কখনো অত্যাচারের শিকার হতে হতো না। সম্ভবত এসব মহিলার হিজরতের পেছনে অন্য কিছু কারণও ছিলো। হয়তো বা কোরায়শদের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর অভ্যন্তরে চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করাই ছিলো এর উদ্দেশ্য। যে সময় কোরায়শ বংশের সঙ্ক্রান্ত সন্তানরা নিজ নিজ আকীদা-বিশ্বাসকে রক্ষা করার জন্যে এবং জাহেলিয়াত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সকল আত্মীয়তার বন্ধনকে অগ্রাহ্য করে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলো, সে সময় মহিলাদের এ হিজরত গোত্রীয় পরিমণ্ডলে সমগ্র কোরায়শ আভিজাত্যকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিচ্ছিলো । বিশেষত হিজরতকারিনীদের মধ্যে যখন সে নতুন আকীদা-বিশ্বাসের ও তার আহ্বায়কের উগ্র বিরুদ্ধবাদী ও জাহেলিয়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবার মত মহিলাও ছিলেন। কিন্তু এ ধরনের কারণ থাকলেও তাতে কিছু আসে যায় না। এ সত্তেও আবিসিনিয়ার হিজরত ইসলামী আন্দোলনের জন্যে একটা স্বাধীন অথবা নিদেনপক্ষে একটা নিরাপদ ঘাঁটি সন্ধানের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বিশেষত আবিসিনিয়ার শাসক নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে যেসব বিবরণ পাওয়া যায় তা যদি এই সিদ্ধান্তের সাথে যুক্ত করা হয় তাহলে ব্যাপারটা আরো | স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য নাজ্জাশী তার সেই ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে সক্ষম হননি শুধুমাত্র প্রজা বিদ্রোহের আশংকায়। বিশুদ্ধ হাদীসসমূহে এ কথা উল্লিখিত হয়েছে।

অনুরূপভাবে রসূলের তায়েফ গমনও ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার একটা স্বাধীন অথবা কমপক্ষে একটা নিরাপদ ঘাঁটি সন্ধানের উদ্দেশ্যেই সংঘটিত হয়েছিলো বলে মনে হয়। তাঁর এই চেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি। কেননা বনু ছকীফের নেতারা তাঁকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো। তারা তাদের ভেতরকার নির্বোধ লোকজন ও বালকদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় এবং তাঁর প্রতি পাথর ছুঁড়তে বলে দেয়। পাথর মেরে মেরে তারা রসূলুল্লাহর পবিত্র পা দু'খানাকে আহত ও রক্তাক্ত করে দেয়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবস্থা বেগতিক দেখে উত্থা ও শায়বা ইবনে রাবিয়ার ফলের বাগানে আশ্রয় নেন। সেখানে আশ্রয় নেবার পূর্ব পর্যন্ত তারা পাথর ছোঁড়া থেকে ক্ষান্ত হয়নি। সেই সময় তার মুখ দিয়ে এই গভীর মিনতিপূর্ণ দোয়া নিৰ্গত হয়,

"হে আল্লাহ! আমি নিজের দুর্বলতা, কৌশলের অপ্রতুলতা ও মানুষের সামনে নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছি। হে শ্রেষ্ঠ দয়ালু! তুমি দুর্বলদের মালিক, তুমি আমারও মালিক। ভূমি কার কাছে আমাকে সঁপে দিচ্ছো? তুমি কি কোনো শত্রুর কাছে আমাকে সঁপে দিচ্ছ যাকে আমার অভিভাবক করে দিয়েছো, অথবা আমাকে আক্রমণকারী কোনো অনাত্মীয়ের কাছে সঁপেছো? আমার ওপর যদি তোমার রাগ না থাকে তাহলে আমি কোনো কিছুরই পরোয়া করি না । তবে তোমার পক্ষ থেকে সর্বাংগীন সুস্থতা আমার জন্যে শ্রেয়। তোমার স্বীয় জ্যোতিতে সকল অন্ধকার আলোকিত হয় এবং যার বদৌলতে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল সমস্যা সমাধান হয়, সেই জ্যোতির আশ্রয় প্রার্থনা করি, যেনো তুমি আমার ওপর তোমার ক্রোধ ও অভিসম্পাত না পাঠাও। তুমি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমার শরণাপন্ন থাকবো। বস্তুত, তুমি ক্ষমতা না দিলে কারো কোনো কাজের ক্ষমতা হয় না।

এরপর আল্লাহ তায়ালা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর আন্দোলনের জন্যে অকল্পনীয়ভাবে অগ্রগতির পথ উন্মুক্ত করে দেন। ফলে প্রথম আকাবা ও দ্বিতীয় আকাবার শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এ দু'টো ঘটনার সাথে আমাদের আলোচ্য সূরার ভূমিকার বিষয়বস্তু ও মদীনায় ইসলামী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান ।

আকাবার শপথের ঘটনা সংক্ষেপে এরূপ, মদীনায় হিজরতের প্রাক্কালে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জের সময় মদীনার খাযরাজ গোত্রীয় একদল লোকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে তিনি সেই হচ্ছে আগমনকারীদের সামনে নিজেকে ও নিজের দাওয়াতকে তুলে ধরেন এবং আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পেশ করার কাজে তিনি তাদের কাছে কিছু সহযোগী ও সমর্থক চান। ইতিপূর্বে আওস ও খাযরাজ গোত্রীয় মদীনাবাসী ও তাদের প্রতিবেশী ইহুদীদের কাছে প্রায়ই শুনতো যে, একজন নবী আসার সময় সমাগত প্রায়। ইহুদীরা সেই নবীর দোহাই দিয়ে আরবদের ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতো। সেই নবী এলে আরবরা যাতে ইহুদীদের কথামত চলে সে জন্যে তাদেরকে অনুরোধ করতো। খাযরাজ প্রতিনিধিদল যখন হযরতের দাওয়াত শুনলো তখন তারা পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলো, “আল্লাহর শপথ! এই সেই নবী যার কথা ইহুদীরা আমাদেরকে বলেছিলো। অতএব, এসো আমরা ইহুদীদের আগেই তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করি। এই বলে তারা রসূলের দাওয়াত গ্রহণ করলো। তারপর বললো, আমরা আমাদের গোত্রকে রেখে এসেছি। অথচ পারস্পরিক শত্রুতা ও দাংগা-ফাসাদে আমাদের গোত্রের জুড়ি নেই। আশা করি আল্লাহ তায়ালা শীঘ্রই আপনাকে তাদের সাথে মিলিত করবেন। এরপর যখন তারা নিজ গোত্রের কাছে ফিরে গেলো, তাদের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। লোকেরা সব শুনে খুশী হলো এবং তারা যে কাজ করে এসেছে তার প্রতি সমর্থন জানালো।

   

পরবর্তী বছর আওস ও খাযরাজের একটা দল হজ্জ করতে মক্কা গমন করলো এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলাম গ্রহণ করলো। রসূল (স.) তাদের সাথে ইসলাম শিক্ষা দিতে পারে এমন একজন লোকও সেখানে পাঠিয়ে দিলেন।

এর পরবর্তী বছর আবার আওস ও খাযরাজের একটা বিরাট প্রতিনিধি দল হজ্জ করতে মক্কায় যায় এবং তারাও তাদেরকে শপথ গ্রহণ করাতে অনুরোধ করে। রসূলের চাচা হযরত আব্বাসের উপস্থিতিতে শপথ অনুষ্ঠিত হয় এবং তারা নিজেদের জান ও মাল যেভাবে রক্ষা করে তেমনিভাবে রসূলের জানমাল রক্ষা করবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। এ ঘটনাকে ইতিহাসে আকাবার দ্বিতীয় ও বৃহৎ শপথ অনুষ্ঠান বলে অভিহিত করা যায়। এ শপথ অনুষ্ঠান সম্পর্কে হাদীসে মোহাম্মদ ইবনে কা'ব আল কারজীর বরাতে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শপথ গ্রহণের রাতে বলেন, আপনি শপথ গ্রহণকারীদের কাছ থেকে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ও নিজের সম্পর্কে যেমন খুশী অংগীকার গ্রহণ করুন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তোমাদের কাছ থেকে এ প্রতিজ্ঞা নিচ্ছি যে তোমরা একমাত্র আল্লাহর এবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আমার সম্পর্কে এ প্রতিজ্ঞা নিচ্ছি যে, তোমরা নিজেদের জানমাল রক্ষার জন্যে যেসব জিনিস প্রতিরোধ করে থাকো, আমার জান মাল রক্ষার জন্যেও সেসব জিনিস প্রতিরোধ করবে। আবদুল্লাহ বললেন, 'আমরা এই প্রতিজ্ঞা করলে এর বিনিময়ে কি ফল পাবো? রসুল (স.) বললেন, বেহেশত, তখনই সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, ব্যবসা লাভজনক হয়েছে। এ থেকে আমরা পিছু হটবো না কাউকে পিছু হটতেও বলবো না।

এভাবে তারা দৃঢ়তার সাথে ইসলামী আন্দোলনের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেই থেকে মদীনায় ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটতে আরম্ভ করে। মদীনায় তখন এমন একটা পরিবার রইলো না যেখানে ইসলাম প্রবেশ করেনি। মক্কার মুসলমানরাও এরপর থেকে নিজেদের আকীদা ও ঈমান ছাড়া অন্য সব কিছু ফেলে মদীনায় যেতে লাগলো। সেখানে তাদের যেসব ভাই আগে থেকে বসবাস করছিলো এবং ঈমান এনেছিলো তাদের কাছ থেকে তারা এমন ত্যাগ, কোরবানী ও সৌভ্রাতৃত্ব লাভ করলো যার নদির মানবতার ইতিহাসে দুর্লভ। অতপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দীককে সংগে নিয়ে হিজরত করলেন। সেখানে তিনি তার সেই নিরাপদ স্বাধীন ও শক্তিশালী ঘাঁটিটি পেলেন, যার জন্যে তিনি ইতিপূর্বে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে ছিলেন। এ ঘাঁটিতে রসূলের হিজরতের প্রথম দিন থেকেই ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত হল।





****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url