কুরআনের গল্পঃ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জন্ম কাহিনী এবং হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পরিচয়







হযরত ইবরাহীম (আঃ)


তৌরাতে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর যে বংশ পরিচয় বর্ণিত রয়েছে তা হল ইবরাহীম (আঃ)-এর পিতা তারেখ তাঁর পিতা নাহুর তাঁর পিতা সরুজ তাঁর পিতা রাউ তাঁর পিতা ফালে তাঁর পিতা আবের তাঁর পিতা সালেহ তাঁর পিতা এরফেক তাঁর পিতা সামের তাঁর পিতা নূহ (আঃ)। এ হিসাবে হযরত ইবরাহীম (আঃ) সাম বিন নূহের বংশের অধঃস্তন দশম ব্যক্তি। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর পিতার নাম তারেখ এবং তার মাতার নাম শানী। কিন্তু পবিত্র কুরআনে তাঁর পিতার নাম আযর উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- 

وَ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهِیۡمُ لِاَبِیۡهِ اٰزَرَ اَتَتَّخِذُ اَصۡنَامًا اٰلِهَۃً ۚ اِنِّیۡۤ اَرٰىکَ وَ قَوۡمَکَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ

অর্থঃ আর (স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল, ‘তুমি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহরূপে গ্রহণ করছ? নিশ্চয় আমি তোমাকে তোমার কওমকে স্পষ্ট গোমরাহীতে দেখছি’। (সূরাঃ ৬/ আল-আন'আম, আয়াতঃ ৭৪)

   

হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জন্ম কাহিনী


যখন আরব অনারব কোথাও সাম তাঁর পিতা নূহ (আঃ)-এর বংশধরদের কেউই অবশিষ্ট ছিল না, তাদের বংশধরদের অনেকে তুফানে এবং অনেকে ফেরেশতাদের বিকট শব্দে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। তখন অনারব এলাকা থেকে অভিশপ্ত নমরূদের উত্থান ঘটে। নমরূদের ভাষা ছিল আরবী। অনেকে আবার নমরূদের বংশসূত্র এরূপ বর্ণনা করেছেন- কায়কাউস তার পিতা কায়কোবাদ তার পিতা মুনচেহের তার পিতা ফরীদুন তার পিতা আমশেদ, তবে নমরূদের এ বংশ নামা সঠিক নয়। সঠিক অভিমত হচ্ছে- তার নাম নমরূদ। সে ছিল অত্যন্ত প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন ও শান শওকতের অধিকারী। সে এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে শাম দেশ দখল করে। অতঃপর তুর্কিস্তান জয় করে ইয়াফেস ইবনে নুহের বংশধরদের স্বীয় অধীনস্থ করে। তুর্কিস্তানের পর সে ভারত আক্রমণ করে সেখানে বসাবাসরত নূহ (আঃ)-এর বংশধরদেরকে তার অধীনতা স্বীকারে বাধ্য করে। অতঃপর সে রোমও দখল করে। তৎকালীন পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র এলাকা সে দখল করে। এরপর সে বাবেলে বসবাস করতে থাকে। এ স্থানকেই কুফা বলা হয়।

ভারত, তুর্কিস্তান, রোমসহ পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের সমগ্র এলাকা থেকে তার জন্য কর, খাজনা, উপহারাদি আসত। এহেন প্রভাব-প্রতিপত্তি, ও শান শওকতের সাথে সে এক হাজার সাতশ' বছর পর্যন্ত রাজত্ব করে। সে নিতান্তই দাম্ভিক স্বভাবের ছিল। সে কখনো আকাশের দিকে তাকাত না । সে আল্লাহর নিকট কখনও নিজের কোন প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনা করত না। সে বলত আমি নিজেই খোদা। আকাশের খোদা আবার কে! যখন সে শকুনের ডানায় চড়ে আল্লাহকে তীর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বারোহণ করছিল, কেবল তখনই আসমানের প্রতি চোখ তুলে তাকিয়েছিল । আকাশের দিকে শকুনের পিঠে চড়ে যেতে যেতে সে বলছিল, যদি আকাশে কোন খোদা থেকে থাকে, তবে এ তীর নিক্ষেপে তাকে হত্যা করব। নমরূদ বাইরে কোথাও বের হলে নিজের সিংহাসনের চার পায়া চারটি হাতীর পৃষ্ঠের ওপর রেখে তাতে উপবেশন করত। তার সিংহাসনের পায়া রোমী রেশম দিয়ে আবৃত করে, মূল্যবান মতি আর হীরা জহরত দিয়ে সুসজ্জিত করা হত। স্বর্ণ সূত্র দিয়ে তাঁবুর রশি বানানো হত। সে সিংহাসনে উপবেশন করলে সিংহাসনের নিচে চারশ' কুরসী পাতা থাকত। এসব কুরসীতে দরবারী, আমীর ওমরাহ্ জাদুকর, জ্যোতিষ ও নিরাপত্তা কর্মীরা বসত। কথিত আছে, সপ্ত একলীমের রাজত্ব মাত্র চার জন লাভ করেছিল। চার জনের সমান রাজত্ব আর কেউই লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এ চার জনের দুজন ছিলেন মুসলমান আর দুজন ছিল কাফের। মুসলমান দু'জনের একজন হলেন হযরত সুলাইমান (আ) ও অপর জন হযরত যুলকারনাইন। আর কাফের দু'জনের একজন ছিল নমরূদ ইবনে কেনআন আর অপরজন ছিল বোখতে নসর । এ চার জনই কেবল পুরো সপ্ত একলীমের রাজত্ব লাভ করেছিল।

একদিন নমরূদ সিংহাসনে উপবিষ্ট। এ সময় সে সৈন্য সামন্ত, আমীর ওমরাহ পরিবেষ্টিত ছিল, জাদুকর জ্যোতিষী সবাই মাথা নুইয়ে চিন্তাযুক্ত অবস্থায় বসে আছে। অভিশপ্ত নমরূদ তাদেরকে জিজ্ঞেস করল- আজ তোমাদের হয়েছে কি? তোমরা এমন মন ভাঙ্গা ও চিন্তাযুক্ত হয়ে বসে আছ কেন। তারা বলল- আপনার কল্যাণ হোক। আজ আসমানে এমন আজব এক নক্ষত্র দেখা গেছে যা আর কখনও আমরা দেখিনি। এ নক্ষত্রটি আজই পূর্বাকাশে উদিত হয়েছে। নমরুদ বলল, সে নক্ষত্র কেমন। তারা বলল, একটি ছেলে পিতার ঔরস থেকে মাতৃগর্ভে স্থান নেয়ার আগাম সংকেত এ নক্ষত্রটি আর ছেলেটি দ্বারাই আপনার রাজত্ব ধ্বংস হবে। নমরূদ বলল, সে কখন পিতার ঔরষ থেকে মাতৃগর্ভে আসবে? জ্যোতিষরা বলল, আজ হতে তিন দিন তিন রাতের মধ্যেই মাতৃগর্ভে তার আগমন ঘটবে। একথা শুনে নমরুদ নির্দেশ জারি করল- অদ্য হতে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত কোন স্ত্রীলোক তার স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হতে পারবে না।

তারেখ নামে নমরূদের এক বিশ্বস্ত দেহরক্ষী ছিল। কুরআনে যার নাম আযর বলা হয়েছে। সে এক হাতে প্রদীপ আরেক হাতে তরবারি ধরে সারা রাত নমরূদের মাথার কাছে পাহারারত থাকত। এটাই তার সর্বদার কাজ। যেদিন নমরূদ স্ত্রীদের তার স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, আল্লাহর ইচ্ছায় সেদিনই তারেখের মনে স্ত্রীসঙ্গ লাভের আকাঙ্ক্ষা তিব্রতর হয়ে উঠে। একইভাবে তারেখের স্ত্রীর মানসিক অবস্থাও একই হয়। কি করে আজকে স্বামীসঙ্গ লাভ করে পরিতৃপ্ত হবে সে ভাবনাই মনে মনে সে ভাবতে লাগল। এ অবস্থায় অর্ধরাত কেটে যায়। তার স্বামী সঙ্গ লাভের কামনাও চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। অগত্য সে চুপিসারে গৃহত্যাগ করে নমরূদের শাহী মহলের দরজায় উপনীত হয়। তারেখ পত্নী সেখানে পৌঁছে দেখল, দারোয়ান, সিপাই-সান্ত্রী সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই সে নির্বিঘ্নে নমরুদের খাস শয্যা কক্ষে প্রবেশে সমর্থ হয়। সেখানে স্বামীকে দেখতে পেল এক হাতে প্রদীপ আর এক হাতে তলোয়ার নিয়ে নমরূদের মাথার কাছে দণ্ডায়মান। চার চোখের মিলন হতেই তাদের জৈবিক তাড়না পূর্বাপেক্ষা প্রবল হয়। তারেখ স্ত্রীকে বলল, এখন কি পরামর্শ। আমার উভয় হাতই আটক। কি করা, এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ভাবনারত। এমন সময় আল্লাহর ইচ্ছায় এক পরীর আগমন ঘটে। সে তারেখের হস্তস্থিত প্রদীপ আর তরবারি স্বহস্তে ধারণ করে নমরূদের শিয়রে তারেখের মতই দাঁড়িয়ে যায়। এ সুযোগে স্বামী-স্ত্রী নমরূদের শিয়রের পাশেই রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এ রাতেই মহান আল্লাহর অপার মহিমায় হযরত ইবরাহীম (আ) পিতৃ ঔরস থেকে মাতৃগর্ভে আসেন। তারেখ স্বীয় পত্নীকে বলল, সাবধান। এ রহস্য যেন কেউ কখনও উদ্ঘাটন করতে না পারে। এখান থেকে বের হয়ে অত্যন্ত সন্তর্পনে বাড়িতে পৌঁছুবে। পথে যেন কারো দৃষ্টিতে না পড়। এটা একটা লজ্জারও ব্যাপার। তারেখের স্ত্রী নমরূদের রাজ মহল থেকে বের হয়ে অতি সতর্কতার সাথে গৃহে প্রত্যাবর্তন করল। একমাত্র আল্লাহই তাদের নমরূদের দৃষ্টি পড়তেই সে তার চেহারায় নূর চমকাতে দেখল। সে বলল, কি ব্যাপার তারেখ এ সংগোপনে মিলন ও গমনাগমন সম্পর্কে জানতেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারেখের প্রতি অদ্য তোমার মুখ মণ্ডলে অন্য দিনের চেয়েও নুরানী দেখতে পাচ্ছি যে! তারেখ ভাগ্য সুপ্রস হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করতে নিবেদন করল। সেখান থেকে নমরূদ সিংহাসনে আরোহন করলে পাদ্রী, গণক ঠাকুর ও জ্যোতিষদেরকে ডেকে বলল, এখন বল তোমাদের কথিত ছেলেটি মাতৃগর্ভে এসেছে কিনা। সবাই গনে পড়ে সমস্বরে বলে উঠল, জাহাপনা। কথিত ছেলেটি পিতৃ উরস থেকে মাতৃগর্ভে অবস্থান নিয়েছে। এরপর অভিশপ্ত নমরূদ আদেশ জারি করল, সন্তান জন্মের পর সবাই যেন আপন আপন পুত্র সস্তানকে হত্যা করে ফেলে। যখন মাতৃগর্ভে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নয় মাস কেটে যায়, তখন তাঁর মা নমরূদের ভয় এবং সন্তানের মহব্বতে অতি গোপনে ঘর থেকে বের হয়ে শহরের বাইরে ময়দানে এক গর্তে অবস্থান নেয়। এ গর্তেই হযরত ইবরাহীম (আঃ) ভূমিষ্ট হন। তিনি ভূমিষ্ট হওয়ার পর তাঁর নূরে গোটা গর্ত আলোকিত হয়ে পড়ে। এসময় ইবরাহীম (আঃ)-এর মা কাঁদতে লাগলেন- কেউ এ গর্তে এসে তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হত্যা করে না ফেলে। অগ্যতা ছেলেকে একখানা বস্ত্রে আবৃত করে গর্তে রেখেই ঘরে ফিরে আসেন। তৎক্ষণাত হযরত জিবরাঈল (আঃ) অবতরণ করে নবজাতকের দু হাতের দুটি আঙ্গুল তার মুখে পুরে দেন। আল্লাহর অসীম কুদরতে মুখে পুরে দেয়া নবজাতকের আঙ্গুল দুটির একটি থেকে দুধ এবং অন্যটি থেকে মুধ নির্গত হতে শুরু করে। ইবরাহীম (আঃ) এ দুধ-মধু পান করেই পরিতৃপ্ত হতেন। আর কিছুর অভাব বোধ করতেন না। প্রতি সপ্তাহেই ইবরাহীম (আঃ)-এর মাতা একবার গর্তে যেতেন এবং পুত্রের লালিত পালিত হবার অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়ে তথা হতে ঘরে ফিরে আসতেন। মা যখন চলে আসত অদৃশ্য থেকে একটি পাথর এসে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিত। এভাবে সাত বছর গত হয়। হযরত ইবরাহীম (আঃ) অন্ধকার গর্তেই আল্লাহর অসীম কুদরতে লালিত পালিত হয়ে থাকেন।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কর্তৃক আল্লাহকে চেনার কাহিনী

একদিন হযরত ইবরাহীম (আঃ) মাকে জিজ্ঞেস করলেন ওগো মা! আমার আপনার স্রষ্টা, পালনকর্তা কে? মা বললেন, আমার খোদা তো তোমার পিতা। সে আমাকে আহার ও পরিধেয় বস্ত্র দেয়। ইবরাহীম (আঃ) এবার জিজ্ঞেস করলেন, তার খোদা কে? মা বললেন, তার খোদা হচ্ছে তারকারাজী। এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাদের স্রষ্টা ও পালনকর্তা কে? এ জবাবে মা নিরুত্তর এবং লজ্জিত হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর স্বামী তারেখের নিকট এসব কথোপকথনের অর্থ ব্যক্ত করেন। বৃত্তান্ত শুনে তারেখ বলল, নিঃসন্দেহে এ ছেলে বাদশাহ নমরূদের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। এ ব্যাপারে কি করা যায় তারেখ তাই ভাবছিল। এক রাতে ইবরাহীম (আঃ) গর্ত থেকে বাইরে এসে গগনের প্রতি দৃষ্টি দিতেই অগণিত নক্ষত্ররাজি দেখে বললেন, আমার পিতা-মাতা এ নক্ষত্ররাজিকেই স্রষ্টাও পালনকর্তা বলেন। বর্ণিত ঘটনাই পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ ইরশাদ করেন-

فَلَمَّا جَنَّ عَلَیۡهِ الَّیۡلُ رَاٰ کَوۡکَبًا ۚ قَالَ هٰذَا رَبِّیۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَفَلَ قَالَ لَاۤ اُحِبُّ الۡاٰفِلِیۡنَ ﴿۷۶

অর্থঃ অতঃপর যখন রাতের আঁধার অবতীর্ণ হয় তখন তিনি একটি নক্ষত্র দেখে বললেন, এটিই আমার রব: যখন সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন তিনি বললেন, অস্তায়মান সত্তার প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। (সূরাঃ ৬/ আল-আন'আম, আয়াতঃ ৭৬)

অতঃপর যখন চন্দ্র উদিত হল তখন তিনি বললেন, এটিই আমার রব। কুরআনের বর্ণনা- 

فَلَمَّا رَاَ الۡقَمَرَ بَازِغًا قَالَ هٰذَا رَبِّیۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَفَلَ قَالَ لَئِنۡ لَّمۡ یَهۡدِنِیۡ رَبِّیۡ لَاَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡقَوۡمِ الضَّآلِّیۡنَ ﴿۷۷

অর্থঃ অতঃপর যখন দীপ্তিমান চন্দ্র দেখতে পেলেন তখন বললেন, এটিই আমার রব। সেটি অদৃশ্য হয়ে গেলে তিনি বললেন, আমার রব যদি আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন তাহলে আমি পথ হারা-ই থেকে যাব। (সূরাঃ ৬/ আল-আন'আম, আয়াতঃ ৭৭)

অতঃপর যখন উজ্জল সূর্য দেখতে পেলেন, তখন বললেন, এটিই আমার রব এবং সবচেয়ে বড়। কুরআনের বর্ণনা-

فَلَمَّا رَاَ الشَّمۡسَ بَازِغَۃً قَالَ هٰذَا رَبِّیۡ هٰذَاۤ اَکۡبَرُ ۚ فَلَمَّاۤ اَفَلَتۡ قَالَ یٰقَوۡمِ اِنِّیۡ بَرِیۡٓءٌ مِّمَّا تُشۡرِکُوۡنَ ﴿۷۸  اِنِّیۡ وَجَّهۡتُ وَجۡهِیَ لِلَّذِیۡ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ حَنِیۡفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ ﴿ۚ۷۹

অর্থঃ অতঃপর যখন তিনি উজ্জল সূর্য দেখলেন, তখন বললেন, এটি আমার রব, এটিই সর্ববৃহৎ। সূর্য যখন অস্ত গেল তখন বলেন, হে আমার জাতি! তোমরা যাদেরকে রবের শরীক করছ, আমি তা হতে মুক্ত পবিত্র। আমি আমার চেহারা সেই সত্তার প্রতি ফিরাচ্ছি যিনি আসমান জমিনের একক স্রষ্টা, আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সূরাঃ ৬/ আল-আন'আম, আয়াতঃ ৭৮-৭৯)

ইবরাহীম (আঃ) বাল্যকালেই দেখেছেন, তাঁর স্বগোত্রীয় লোকেরা আসমান যমীনের স্রষ্টাকে আল্লাহ্ বা রব বলে না। নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাদের কেউ দেব মূর্তির, কেউ তারকারাজির, আবার কেউ বা চন্দ্র-সূর্যের উপাসনা করে। তিনিও কোন এক সত্তাকে রব সাব্যস্ত করতে মনস্থ করেন। দেব মূর্তিসমূহের প্রতি তো তিনি পূর্ব হতেই বিমুখ ছিলেন। অতএব একটি নক্ষত্রকে নিজের রব সাব্যস্ত করেন, কিন্তু নক্ষত্র যখন অদৃশ্য হয় তখন বুঝলেন, এটি সর্বদা এক অবস্থায় থাকে না। সুতরাং আরো কোন সত্তা রয়েছেন যিনি এদের পরিচালক ! লুক্কায়িত নক্ষত্র যদি রবই হত তবে সেটি উন্নত অবস্থা হতে নিম্নাবস্থায় আসত না। তাই এটি রব হতে পরে না। অতঃপর যখন চন্দ্র-সূর্য দেখলেন তখনও উভয়কে রব ঠিক করে দেখতে পেলেন, উভয়ই অস্তায়মান। সুতরাং তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে অস্তায়মান সত্তা কখনও রব হতে পারে না। ফলে তিনি সব কিছু পরিত্যাগ করে এমন সত্তাকে রব হিসাবে গ্রহণ করেন যাঁকে সবাই মানে, স্বীকার করে। আর পরিপক্ক বিবেক বুদ্ধির দাবীও হচ্ছে এমন সত্তাকে রব হিসেবে গ্রহণ করা, যে সত্তা থেকে সকলেরই কার্যোদ্ধার হয় এবং যিনি সর্বোপরি শক্তিশালী, ক্ষমতাবান।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মূর্তি ভাঙ্গার কাহিনী

পিতা আযর হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে বলেছিল, হে বৎস! নমরূদ ব্যতীত আমাদের অন্য কোন খোদা নেই। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ভূমণ্ডলও নভোমণ্ডলের স্রষ্টা রব এক একক লা শারীক সত্তা। এবার আযর ইবরাহীম (আঃ)-কে বলেন-

 قَالُوۡۤا اَجِئۡتَنَا بِالۡحَقِّ اَمۡ اَنۡتَ مِنَ اللّٰعِبِیۡنَ ﴿۵۵

অর্থঃ সে বলল, তুমি আমাদের কাছে সত্য কথাই এনেছ বটে, তুমি তো কৌতুককারীদের দলভুক্ত। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৫৫)

আযরের উক্তির জবাবে ইবরাহীম (আঃ) বললেন- 

 قَالَ بَلۡ رَّبُّکُمۡ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ الَّذِیۡ فَطَرَهُنَّ ۫ۖ وَ اَنَا عَلٰی ذٰلِکُمۡ مِّنَ الشّٰهِدِیۡنَ ﴿۵۶

অর্থঃ ইবরাহীম (আঃ) বললেন- না, বরং আপনার রব তো তিনি যিনি আসমান-যমীনের স্রষ্টা, আর আমি এ বিশ্বাসের সাক্ষ্যদাতা। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৫৬)

তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে বললেন, হে আমার পিতা! আমি আপনার ইলাহ প্রতিমাগুলোর একটি ব্যবস্থা করে তবেই ছাড়ব। তাঁর শপথের বর্ণনায় আল্লাহ্ তা'আলা ইরশাদ করেন-

 وَ تَاللّٰهِ لَاَکِیۡدَنَّ اَصۡنَامَکُمۡ بَعۡدَ اَنۡ تُوَلُّوۡا مُدۡبِرِیۡنَ ﴿۵۷

অর্থঃ আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের প্রতিমাগুলো সম্পর্কে চিন্তা করব যখন তোমরা পশ্চাতে গমন করবে। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৫৭)

উক্ত শপথ ইবরাহীম (আঃ) মনে মনে করেছিলেন- অতঃপর সব লোক যখন শহরের বাইরে অনুষ্ঠিত মেলায় চলে গেল তখন তিনি প্রতিমালয়ে প্রবেশ করে সবগুলো মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন।

এ ঘটনার বর্ণনায় আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন-

فَجَعَلَهُمۡ جُذٰذًا اِلَّا کَبِیۡرًا لَّهُمۡ لَعَلَّهُمۡ اِلَیۡهِ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۵۸

অর্থঃ অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) সেগুলোকে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে ফেলেন, কিন্তু বড় দেব মুর্তিটিকে আস্ত রেখে দেন এ আশায়, সম্ভবতঃ তারা ফিরে আসবে এবং তাদের পূজ্য দেব মূর্তিগুলোকে অপমান অপদস্থতার অবস্থায় দেখতে পাবে। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৫৮)

ইবরাহীম (আঃ)-এর আশা ছিল, লোকেরা মেলা থেকে এসে তাদের পূজ্য দেব মূর্তিগুলোকে এহেন অপমাণিত অপদস্থ অবস্থায় দেখলে এগুলোর পূজা থেকে বিরত থাকবে। নমরূদের জাতির লোকেরা বছরে দু'দিন বেশ বড় ধরনের ও আনন্দ মুখর উৎসব পালন করত। এ মেলায় নমরূদের জাতির সুস্থ সবল সব লোকই অংশ গ্রহণ করত। আযর একদিন হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে বলল, হে বৎস! মেলা দেখতে আমাদের সাথে ময়দানে চল । তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। কুরআনের ভাষায়-

 فَنَظَرَ نَظۡرَۃً فِی النُّجُوۡمِ ﴿ۙ۸۸  فَقَالَ اِنِّیۡ سَقِیۡمٌ ﴿۸۹

অর্থঃ তিনি এক বার তারকাসমূহের প্রতি তাকিয়ে অতঃপর বলেন, আমি রোগাক্রান্ত, অতএব তাদের থেকে বিমুখ হলেন। (সূরাঃ ৩৭/ আস-সাফফাত, আয়াতঃ ৮৮-৮৯)

ইবরাহীম (আঃ) তার জাতির মূর্তিপূজকদেরকে এ ধরনের আরও কয়েকটি কথা বলেন, কিন্তু তারা এসব কথা আমল দেয়নি। তাফসীর গ্রন্থে ইবরাহীম (আঃ)- এর উক্তির সারমর্ম এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁর সম্বোধিত কাফেররা ছিল জ্যোতিষ। তাই তাদেরকে দেখাবার জন্য তারকারাজির প্রতি অথবা জ্যোতিষ শাস্ত্র দেখে তিনি বলে দিলেন- আমি রোগাক্রান্ত। যেহেতু ইবরাহীম (আঃ)- এর জাতির লোকেরা উৎসব পালন ও দেব মূর্তির পুজা অর্চনার জন্য বছরে দু'বার শহরের বাইরে অবস্থিত ময়দানে যেত। সুতরাং তারা প্রতিমালয়ের প্রতিমাগুলো ছেড়ে পূজার উদ্দেশ্যে ময়দানে যায়। ইবরাহীম (আঃ) এ সিদ্ধান্ত পৌঁছুলেন যে এসব দেব মূর্তি সবই তো মিথ্যা। এগুলোর ধ্বংস সাধনে কোন শাস্তি পেতে হবে না। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান পাওয়া যায় । তিনি একখানা কুড়াল নিয়ে মূর্তিগৃহে প্রবেশ করে সবগুলো দেব মূর্তির হাত-পা ভেঙ্গে কুড়ালখানা বড় মূর্তিটির কাঁধে ঝুলিয়ে রেখে বেরিয়ে আসেন। ইবলীস তার প্রতারণা আর প্রবঞ্চনার উপকরণগুলোর এ দুর্দশা দেখে কাঁদতে কাঁদতে মেলায় গিয়ে কাফেরদেরকে বলল, তোমাদের দেব মূর্তিগুলোর হাত পা ভেঙ্গে ওলট-পালট করে রাখা হয়েছে। একথা শুনেই কাফেররা স্ব-স্ব বাহনের নিকট দৌড়ে আসে। উদ্দেশ্য ছিল সওয়ার হয়ে তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছুবে। কিন্তু তাদের বাহন জানোয়ারগুলো সরে যায়। এতে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে পদব্রজেই শহরের দিকে ছুটল। মূর্তিগৃহে প্রবেশ করে মূর্তিগুলোর এ দৈন্যদশা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বলতে লাগল-

 قَالُوۡا مَنۡ فَعَلَ هٰذَا بِاٰلِهَتِنَاۤ اِنَّهٗ لَمِنَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۵۹

অর্থঃ তারা বলতে লাগল, কে আমাদের উপাস্য দেবতাদের এ দৈন্যদশা করেছে, নিশ্চয়ই সে কোন অত্যাচারী হবে। আমরা তার থেকে এ অপকর্মের প্রতিশোধ গ্রহণ করব। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৫৯)

এসব কথা শুনে লোকেরা বলল- 

 قَالُوۡا سَمِعۡنَا فَتًی یَّذۡکُرُهُمۡ یُقَالُ لَهٗۤ اِبۡرٰهِیۡمُ ﴿ؕ۶۰

অর্থঃ আমরা এক যুবককে দেব মূর্তিগুলোর সম্পর্কে আলোচনা করতে শুনেছি, তাকে ইবরাহীম বলা হয়। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৬০)

অতএব ইবরাহীম (আঃ)-কে ডাকা হল । এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-

 قَالُوۡا فَاۡتُوۡا بِهٖ عَلٰۤی اَعۡیُنِ النَّاسِ لَعَلَّهُمۡ یَشۡهَدُوۡنَ ﴿۶۱

অর্থ : তারা সকলে বলল, নিয়ে আস তাকে লোকজনের সম্মুখে, সম্ভবত তারা তাকে দেখবে। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৬১)

নমরূদ হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আঃ)-কে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করল-

 قَالُوۡۤا ءَاَنۡتَ فَعَلۡتَ هٰذَا بِاٰلِهَتِنَا یٰۤـاِبۡرٰهِیۡمُ ﴿ؕ۶۲

অর্থঃ তারা বলল, হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলোর এ দশা করেছ? এটা তোমারই কাজ। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৬২)

তিনি জবাবে বলেন-

 قَالَ بَلۡ فَعَلَهٗ ٭ۖ کَبِیۡرُهُمۡ هٰذَا فَسۡـَٔلُوۡهُمۡ اِنۡ کَانُوۡا یَنۡطِقُوۡنَ ﴿۶۳

অর্থঃ ইবরাহীম বলেন, এটা আমার কাজ হবে কেন, বরং এটা তাদের মধ্যে যেটা বড় তারই কাজ; সুতরাং বড়টাকেই জিজ্ঞেস কর, যদি সেটি কথা বলে! (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৬৩)

জবাবে তারা বলল, ইবরাহীম! প্রতিমারা কি কথা বলে! সেগুলো শুনেও না, আর নড়াচাড়াও করে না । ইবরাহীম (আঃ) বলেন, যে গুলো কথা বলতে পারে না, দেখেনা শুনে না, নড়াচড়া করতে পারে না, তবে কোন দৃষ্টিতে সেগুলোকে খোদা বলে থাক। আবার সেগুলোর উপাসনাও কর । 

ইব্রাহীমের জবাব শুনে তারা মস্তক অবনত করে বলল, এ তো সে সত্যই বলছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-

ثُمَّ نُکِسُوۡا عَلٰی رُءُوۡسِهِمۡ ۚ لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَا هٰۤؤُلَآءِ یَنۡطِقُوۡنَ ﴿۶۵

অর্থঃ পরে তারা শীর অবনত করে বলতে লাগল, তুমি জান যে, প্রতিমাগুলো কথা বলে না। (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৬৫)

তাদের এ অবস্থা দেখে হযরত ইবরাহীম (আঃ) বুঝে ফেললেন, এরা লা জওয়াব হয়ে গেছে। এবার তিনি বলেন কুরআনের ভাষায় -

قَالَ اَفَتَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مَا لَا یَنۡفَعُکُمۡ شَیۡئًا وَّ لَا یَضُرُّکُمۡ ﴿ؕ۶۶  اُفٍّ لَّکُمۡ وَ لِمَا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۶۷

অর্থঃ (ইবরাহীম) বলেন, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সবের উপাসনা করছ যেগুলো না তোমাদের কোন উপকার করতে পারে আর না অপকার। তোমাদের জন্য দুঃখ! তোমরা কেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে এসবের উপসনা করছ! তোমরা কিছুই বুঝ না! (সূরাঃ ২১/ আল-আম্বিয়া, আয়াতঃ ৬৬-৬৭)

কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর আহবানের দিকে কর্ণপাত করেনি। যেহেতু তাদের সত্য ও হক কথা শুনার অভ্যাস ছিল না, সত্য দর্শনের মনোভাব ছিল না তাই তারা এত বড় নবীর হক দাওয়াত নিয়ে হাসি তামাসা ও ঠাট্টা বিদ্রূপ শুরু করে। আর ধাপে ধাপে অধিকতর ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা প্রকাশ করে।





****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url