মা’আরেফুল কোরআন - ৫২ || সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৫১-১৫২ || যিকিরের ফযীলত ও যিকিরের তাৎপর্য







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৫১-১৫২


کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِنَا وَ یُزَکِّیۡکُمۡ وَ یُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۵۱  فَاذۡکُرُوۡنِیۡۤ اَذۡکُرۡکُمۡ وَ اشۡکُرُوۡا لِیۡ وَ لَا تَکۡفُرُوۡنِ ﴿۱۵۲

সূরা আল-বাকারাহ ১৫১-১৫২ নং আয়াতের অর্থ

(১৫১) যেমন আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসুল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণীসমূহ তেলাওয়াত করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দিবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দিবেন এমন বিষয়, যা কখনো তোমরা জানতে না। (১৫২) সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।

   

সূরা আল-বাকারাহ ১৫১-১৫২ নং আয়াতের তাফসীর

তাফসীরের সার-সংক্ষেপ
 (কা’বাগৃহ নির্মাণের সময় হযরত ইবরাহীম (আ) যেসব দোয়া করেছিলেন, কা’বাকে কেবলা নির্ধারণের মাধ্যমে আমি তা কবূল করেছি) যেভাবে (কবূল করেছি একজন রসূল প্রেরণ সম্পর্কিত দোয়া।) তোমাদের মধ্যে আমি একজন (মহান) রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছি (যিনি) তোমাদেরই একজন। তিনি আমার আয়াত (নির্দেশ)সমূহ তেলাওয়াত করে তোমাদের শুনিয়ে থাকেন এবং (জাহেলী যুগের ধ্যান-ধারণা ও আচার-আচরণ থেকে) তোমাদিগকে পবিত্র করেন এবং তোমাদিগকে (আল্লাহ্) কিতাব ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় বলে দেন। তিনি তোমাদিগকে এমন (উপকারী) বিষয়াদি শিক্ষা দেন, যেসব বিষয় সম্পর্কে তোমরা কিছুই জানতে না [পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও যে সম্পর্কে কোন তথ্য দেওয়া হয়নি। এভাবে একজন রসূল প্রেরণ করার জন্য হযরত ইবরাহীম (আ) যে দোয়া করেছিলেন, তারই বাস্তব প্রকাশ হয়ে গেল]। এসব (উল্লিখিত) নিয়ামতসমূহের জন্য আমাকে (যেহেতু আমিই তা দান করেছি) স্মরণ কর। আমিও তোমাদিগকে (অনুগ্রহের মাধ্যমে) স্মরণ রাখব ; আর আমার (নিয়ামতসমূহের) শোকরগুযারী কর এবং (নিয়ামত অস্বীকার করে বা আনুগত্য পরিহার করে আমার প্রতি) অকৃতজ্ঞ হয়ো না।

সূরা আল-বাকারাহ ১৫১-১৫২ নং আয়াতের বিষয়বস্তু

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
এ পর্যন্ত কেবলা পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা চলে আসছিল। এখানে বিষয়টিকে এমন এক পর্যায়ে এনে সমাপ্ত করা হয়েছে, যাতে এ বিষয়টির ভূমিকায় কা’বা নির্মাতা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দোয়ার বিষয়টিও প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর বংশধরদের মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদায় মহানবী (সা)-এর আবির্ভাব। এতে এ বিষয়েও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রসূলে করীম (সা)-এর আবির্ভাবে কা’বা নির্মাতার দোয়ারও একটা প্রভাব রয়েছে। কাজেই তাঁর কেবলা যদি কা’বা শরীফকে সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে তাতে বিশ্বয়ের কিংবা অস্বীকারের কিছুই নেই।

كَمَا أَرْسَلْنَا বাক্যে উদাহরণসূচক যে ’কাফ’ (ك) বর্ণটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার একটি ব্যাখ্যা তো উল্লিখিত তফসীরের মাধ্যমেই বোঝা গেছে। এ ছাড়াও আরেকটি বিশ্লেষণ রয়েছে, যা কুরতুবী গ্রহণ করেছেন। তা হলো এই যে, ’কাফ’-এর সম্পর্ক হলো পরবর্তী আয়াত فَاذْكُرُونِي -এর সাথে। অর্থাৎ, আমি যেমন তোমাদের প্রতি কেবলাকে একটি নিয়ামত হিসাবে দান করেছি এবং অতঃপর দ্বিতীয় নিয়ামত দিয়েছি রসূলের আবির্ভাবের মাধ্যমে, তেমনি আল্লাহ্ যিকিরও আরেকটি নিয়ামত। এসব নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে, যাতে এসব নিয়ামতের অধিকতর প্রবৃদ্ধি হতে পারে। কুরতুবী বলেন, এখানে كَمَا أَرْسَلْنَا-এর ’কাফ’টির ব্যবহার ঠিক তেমনি, যেমনটি সূরা আনফালের كَمَا أَخْرَجْنَا এবং সূরা হিজর-এর كَمَا أَنْزَلْنَا عَلَى الْمُقْتَسِمِينَ-এর মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ এতে ‘যিকির’-এর অর্থ হলো স্মরণ করা, যার সম্পর্ক হলো অন্তরের সাথে । তবে জিহ্বা যেহেতু অন্তরের মুখপাত্র, কাজেই মুখে স্মরণ করাকেও ‘যিকির’ বলা যায়। এতে বোঝা যায় যে, মৌলিক যিকিরই গ্রহণযোগ্য, যার সাথে মনেও আল্লাহর স্মরণ বিদ্যমান থাকবে। এ প্রসঙ্গেই মওলানা রুমী (র) বলেছেনঃ

برزبان تسبیح در دل گاؤ وخر * ایں چنیں تسبیح کے دارد اثر

অর্থাৎ, মুখে থাকবে তসবীহ; আর মনে থাকবে গরু-গাধার চিন্তা, এমন তসবীহর ক্রিয়া কি হবে ? তবে এতদসঙ্গে একথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, কোন লোক যদি মুখে তসবীহ্ জপে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু তার মন যদি অনুপস্থিত থাকে অর্থাৎ যিকিরে না লাগে, তবুও তা একেবার ফায়দাহীন নয়। হযরত আবু ওসমান (র)-এর কাছে জনৈক ভক্ত এমনি অবস্থায় অভিযোগ করেছিল যে, মুখে মুখে যিকির করি বটে, কিন্তু অন্তরে তার কোনই মাধুর্য অনুভব করতে পারি না; তখন তিনি বললেন, তবুও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর যে, তিনি তোমার একটি অঙ্গ--জিহ্বাকে তো অন্তত তাঁর যিকিরে নিয়োজিত করেছেন।--(কুরতুবী)

যিকিরের ফযীলত

যিকিরের ফযীলত অসংখ্য। তন্মধ্যে এটাও কম ফযীলত নয় যে, বান্দা যদি আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহলে আল্লাহ্ তাকে স্মরণ করেনো। আবু ওসমান মাহদী (র) বলেছেন, আমি সে সময়টির কথা জানি, যখন আল্লাহ্ তা’আলা আমাদিগকে স্মরণ করেন। উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি তা কেমন করে জানতে পারেন ? বললেন, তা এজন্য যে, কোরআন করীমের ওয়াদা অনুসারে যখন কোন মু’মিন বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ্ নিজেও তাকে স্মরণ করেন। কাজেই বিষয়টি জানা সবার জন্যই সহজ যে, আমরা যখন আল্লাহর স্মরণে আত্মনিয়োগ করব, আল্লাহ্ তা’আলাও আমাদের স্মরণ করবেন।

আর আয়াতের অর্থ হলো এই যে, তোমরা যদি আমাকে আমার হুকুমের আনুগত্যের মাধ্যমে স্মরণ কর, তাহলে আমিও তোমাদেরকে সওয়াব ও মাগফিরাত দানের মাধ্যমে স্মরণ করব।

হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর (রা) ’যিকরুল্লাহ্’র তফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যিকিরের অর্থই হচ্ছে আনুগত্য এবং নির্দেশ মান্য করা। তাঁর বক্তব্য হচ্ছেঃ

فـمـن لـم يطعه لم يذكره وان كثر صلاته وتسبيحه 

অর্থাৎ- যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করে না, সে আল্লাহর যিকিরই করে না, প্রকাশ্যে যত বেশি নামায এবং তসবীহ্‌ই সে পাঠ করুক না কেন।

যিকিরের তাৎপর্য

মুফাসসির কুরতুবী ইবনে-খোয়াইয-এর আহকামুল কোরআনের বরাত দিয়ে এ সম্পর্কিত একখানা হাদীসও উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসটির মর্মার্থ হচ্ছে যে, রসূল (সা) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্য করে অর্থাৎ তাঁর হালাল ও হারাম সম্পর্কিত নির্দেশগুলোর অনুসরণ করে, যদি তার নফল নামায-রোযা কিছু কমও হয়, সে-ই আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে সে নামায-রোযা, তসবীহ-তাহলীল প্রভৃতি বেশি করে করলেও প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে না।

হযরত যুননুন মিসরী (র) বলেন, “যে ব্যক্তি প্রকৃতই আল্লাহকে স্মরণ করে, সে অন্য সব কিছুই ভুলে যায়। এর বদলায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলাই সবদিক দিয়ে তাকে হেফাজত করেন, এবং সব কিছুর বদলা তাকে দিয়ে দেন।”

হযরত মু’আয (রা) বলেন, “আল্লাহর আযাব থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে মানুষের কোন আমলই যিকরুল্লাহর সমান নয়।" হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত এক হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “বান্দা যে পর্যন্ত আমাকে স্মরণ করতে থাকে বা আমার স্মরণে যে পর্যন্ত তার ঠোঁট নড়তে থাকে, সে পর্যন্ত আমি তার সাথে থাকি।”





********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url