সাহাবাগণের জীবনকথা-৫২ || আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম (রাঃ) -এর জীবনী ||





আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম (রাঃ)


মুয়াযযিনুর রাসূল হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম সেই মহান সাহাবী যার জন্য সপ্তম আকাশের ওপর থেকে নবী করীমকে (সাঃ) তিরস্কার করা হয়েছে এবং যার শানে আল্লাহর নিকট থেকে হযরত জিবরাইল (আঃ) অহী নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট অবতরণ করেছেন। তিনি সেই গর্বিত মহাপুরুষ যার সম্পর্কে আল-কুরআনের সর্বমােট ষােলটি আয়াত নাযিল হয়েছ।

মদীনাবাসীরা তাকে ডাকতেন আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম বলে। তবে ইরাকীদের নিকট তিনি উমার ইবন উম্মে মাকতুম' নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন মক্কার কুরাইশ গােত্রের সন্তান। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন উম্মুল মু'মিনীন হযরত খাদীজা বিনতু খুওয়ালিদের মামাতাে ভাই। তার পিতা কায়েস। বিন যায়িদ ও মাতা আতিকা বিনতু আবদিল্লাহ। আবদুল্লাহকে অন্ধ অবস্থায় প্রসব করেন, এ কারণে মা ‘আতিকা উম্মু মাকতুম" নামে পরিচিতি লাভ করেন। মাকতুম অর্থ অন্ধ এবং উম্মু মাকতুম অন্ধের মা।

   

বাহ্যিক চক্ষু তার ছিল না। তবে একটি তীক্ষ্ম অন্তর্চক্ষু তিনি লাভ করেছিলেন। মক্কায় ইসলামের আলােকরশ্মি আত্মপ্রকাশের সূচনা কালটি তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তার অন্তর্চক্ষু উন্মুক্ত করে দেন। তিনি ঈমান আনেন। এভাবে তিনি হলেন ইসলামের প্রথম পর্বের বিশ্বাসীদের অন্যতম। মক্কার মুসলমানদের কুরবানী, ত্যাগ তিতিক্ষা, ধৈৰ্য্য ও দৃঢ়তার অংশীদার ছিলেন তিনিও। অন্যদের মত তিনিও শিকার হয়েছিলেন কুরাইশদের অত্যাচার ও উৎপীড়নের। তাদের হাজারাে জুলুম-অত্যাচারে তিনি একটুও দমেননি, একটুও সাহস হারা হননি, অথবা বলা যায়, তার ঈমান কখনাে দুর্বল হয়ে পড়েনি। তাদের জুলুম-অত্যাচার যতই বৃদ্ধি পেয়েছিল, তিনিও তত বেশী করে আল্লাহর দ্বীনকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আর সংগে সংগে আল্লাহর কিতাবের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছিল, শরীয়াতের সমঝও বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট তার সময় অসময়ে যাতায়াতও বেড়ে গিয়েছিল।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রতি তাঁর ভক্তি-ভালােবাসা ও পবিত্র কুরআন হিফজ করার প্রতি তার আগ্রহ এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, এ ব্যাপারে প্রতিটি সুযােগকে তিনি গনিমত মনে করতেন এবং প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাতেন। আগ্রহের আতিশয্যের কারণে অনেক সময় রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিজের জন্য এমনকি অন্যের জন্য নির্ধারিত সময়টুকুতেও তিনি ভাগ বসাতেন।

এটা সেই সময়ের কথা যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কার কুরাইশ নেতৃবর্গের ভীষণ চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি। তাদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তিনি দারুণ আগ্রহী। একদিন তিনি মিলিত হলেন, "উতবা ইবন রাবীয়া, শায়বা ইবন রাবীয়া, আমর ইবন হিশাম উরফে আবু জাহল, উমাইয়া ইবন খালফ এবং খালিদ সাইফুল্লাহর পিতা ওয়ালিদ ইবন মুগীরার সাথে। তিনি একেক জনের কাছে যাচ্ছেন, শলা পরামর্শ করছেন এবং তাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। তিনি আশা করছেন, তারা তাঁর দাওয়াত কবুল করুক অথবা কমপক্ষে তাঁর সংগী-সাথীদের ওপর অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে বিরত থাকুক। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি ব্যস্ত, এমন সময় সম্পূর্ণ অনাহূতভাবে আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম এসে হাজির। বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার কিছু আমাকে শিখিয়ে দিন। রাসূল (সাঃ) তার কথায় বিশেষ একটা গুরুত্ব না দিয়ে কুরাইশ নেতৃবর্গের প্রতি মনােযােগী থাকলেন। এই আশা ও বিশ্বাস নিয়ে যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তাতে আল্লাহর দ্বীনের সম্মান বৃদ্ধি পাবে ও দাওয়াতী কাজের সুবিধা হবে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সাথে আলােচনা-পরামর্শ শেষ করে যেইনা গৃহের দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছেন অমনি আল্লাহ তা'আলা তাঁকে পাকড়াও করলেন। তিরস্কার করে অহী নাযিল করলেনঃ

عَبَسَ وَ تَوَلّٰۤی ۙ﴿۱  اَنۡ جَآءَهُ الۡاَعۡمٰی ؕ﴿۲  وَ مَا یُدۡرِیۡکَ لَعَلَّهٗ یَزَّکّٰۤی ۙ﴿۳  اَوۡ یَذَّکَّرُ فَتَنۡفَعَهُ الذِّکۡرٰی ؕ﴿۴  اَمَّا مَنِ اسۡتَغۡنٰی ۙ﴿۵  فَاَنۡتَ لَهٗ تَصَدّٰی ؕ﴿۶ وَ مَا عَلَیۡکَ اَلَّا یَزَّکّٰی ؕ﴿۷  وَ اَمَّا مَنۡ جَآءَکَ یَسۡعٰی ۙ﴿۸ وَ هُوَ یَخۡشٰی ۙ﴿۹  فَاَنۡتَ عَنۡهُ تَلَهّٰی ﴿ۚ۱۰  کَلَّاۤ اِنَّهَا تَذۡکِرَۃٌ ﴿ۚ۱۱  فَمَنۡ شَآءَ ذَکَرَهٗ ﴿ۘ۱۲ فِیۡ صُحُفٍ مُّکَرَّمَۃٍ ﴿ۙ۱۳ مَّرۡفُوۡعَۃٍ مُّطَهَّرَۃٍۭ ﴿ۙ۱۴  بِاَیۡدِیۡ سَفَرَۃٍ ﴿ۙ۱۵ کِرَامٍۭ بَرَرَۃٍ ﴿ؕ۱۶

‘সে ভু কুঞ্চিত করলাে এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এলাে। তুমি কেমন করে জানবে- সে হয়তাে পরিশুদ্ধ হতাে অথবা উপদেশ গ্রহণ করতাে। ফলে উপদেশ তার উপকারে আসতাে। পক্ষান্তরে যে পরওয়া করেনা, তুমি তার প্রতি মনােযােগ দিয়েছ। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে তোমার কোন দায়িত্ব নেই। অন্যদিকে যে তােমার দিকে ছুটে এলাে, আর সে সশংকচিত্ত, তাকে তুমি অবজ্ঞা করলে। না, এরূপ আচরণ অনুচিত। এ তাে উপদেশবাণী। যে ইচ্ছে করবে স্মরণ রাখবে। 'তা আছে মহান লিপিসমূহে, যা উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন, পবিত্র, মহান, পূত-চরিত্র লিপিকর হস্তে লিপিবদ্ধ।' (সূরাঃ ৮০/ আবাসা, আয়াতঃ ৫১-১৬)।

এই অন্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমের শানে মােট ষোলটি আয়াত সহ হযরত জিবরাইল আল-আমীন সেদিন অবতরণ করেছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) অন্তঃকরণে। আয়াতগুলি আজ পর্যন্ত পঠিত হয়ে আসছে এবং যতদিন এ ধরাপষ্ঠে মানব জাতির জীবনধারা অব্যাহত থাকবে ততদিন তা পঠিত হবে। সেই দিন থেকে রাসূল (সাঃ) আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমকে বিশেষ সমাদর করতেন। তিনি এলে ডেকে কাছে বসাতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন এবং তার কিছু প্রয়ােজন থাকলে তা পূরণ করতেন। হযরত আয়িশা (রাঃ) তাকে লেবু ও মধুর সরবত বানিয়ে পান করাতেন, তিনি বলেনঃ 'আয়াত নাযিল হওয়ার পর এ ছিল তাঁর জন্য নির্ধারিত।' এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তিনি তাে সেই ব্যক্তি যার কারণে সপ্তম আকাশের ওপর থেকে তাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে।

রাসূল (সাঃ) ও মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের কঠোরতা ও অত্যাচারের মাত্রা যখন সীমা ছেড়ে গেল, আল্লাহ তা'আলা মুসলমানদেরকে হিজরাতের অনুমতি প্রদান করলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন তাঁদেরই একজন যারা খুব দ্রুত দ্বীনের খাতিরে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি এবং হযরত মুসয়াব ইবন উমাইর (রাঃ) সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম মক্কা থেকে মদীনায় উপনীত হন। আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম মদীনায় পৌঁছে বন্ধু মুসয়াব ইবন উমাইরকে সংগে নিয়ে মানুষের বাড়ীতে যেয়ে যেয়ে কুরআন ও আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দিতে শুরু করেন। হযরত বাররা ইবন আযিব (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হিজরত করে মদীনায় আমাদের নিকট আসেন মুসয়াব ইবন উমাইরইবন উম্মে মাকতুম (রাঃ)। তাঁরা মদীনায় এসেই আমাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন।'

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে এলেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমবিলাল ইবন রাবাহকে মুসলমানদের মুয়াযিন নিয়োগ করেন। তারা দু’জন ছিলেন মুসলিম উম্মাতের প্রথম মুয়াযযিন। এভাবে তারা প্রতিদিন পাঁচবার কালেমাতুত তাওহীদের প্রচার, মানুষকে সৎকর্মের দিকে আহ্বান ও কল্যাণের প্রতি উৎসাহদানের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে থাকেন। বিলাল আযান দিতেন, আর ইবন উম্মে মাকতুম দিতেন ইকামাত। মাঝে মাঝে আযান দিতেন ইবন উম্মে মাকতুম, আর ইকামাত দিতেন বিলাল (রাঃ)। রমযান মাসে তারা অন্য একটি কাজও করতেন। মদীনার মুসলমানরা ওঁদের একজনের আযান শুনে সেহরী খাওয়া শুরু করতেন এবং অন্যজনের আযান শুনে খাওয়া বন্ধ করতেন। বিলালের আযান শুনে লােকেরা সেহরীর জন্য জেগে উঠতো। এদিকে আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম প্রতীক্ষায় থাকতেন সুবহে সাদিকের। সুবহে সাদিক হওয়ার সাথে সাথে তিনি আযান দিতেন, আর সে আযান শুনে লােকেরা খাওয়া বন্ধ করতাে।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হিজরাতের পর যুদ্ধ-বিগ্রহের পালা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ইবন উন্মে মাকতুম স্বীয় অক্ষমতার কারণে জিহাদে অংশগ্রহণে অপরাগ ছিলেন। বদর যুদ্ধের পর আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রিয় নবীর ওপর কিছু আয়াত নাযিল করেন। আয়াতগুলি মুজাহিদদের সুমহান মর্যাদা ও জিহাদ থেকে বিমুখ হয়ে যারা গৃহে অবস্থান করেন, তাদের ওপর মুজাহিদদের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়। আয়াতগুলির বিষয়বস্তু ইবন উম্মে মাকতুমের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুজাহিদদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তিনি ভীষণ ব্যথিত হন। যখন এ আয়াত নাযিল হলােঃ

 لَا یَسۡتَوِی الۡقٰعِدُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ غَیۡرُ اُولِی الضَّرَرِ وَ الۡمُجٰهِدُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ

-গৃহে অবস্থানকারী মু'মিনগণ এবং আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদগণ সমমর্যাদার অধিকারী হবে না।' (সূরাঃ ৪/ আন-নিসা, আয়াতঃ ৯৫)

 রাসূলুল্লাহ (সা) কাতিবে অহী হযরত যায়িদ বিন সাবিতকে (রা) আয়াতটি লিখতে বললেন। এমন সময় ইবন উম্মে মাকতুম সেখানে পৌছলেন। আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ, সক্ষম হলে আমিও তাে জিহাদে অংশগ্রহণ করে মুজাহিদদের মর্যাদা লাভ করতে পারতাম।'
তারপর অত্যন্ত বিনীতভাবে আল্লাহর নিকট দু'আ করলেনঃ 'হে আল্লাহ আমার অপারগতা সম্পর্কে অহী নাযিল করুন, হে আল্লাহ আমার ওজর সম্পর্কে অহী নাযিল করুন।' তার এ আকাথা আল্লাহর নিকট এতই মনঃপূত হয়েছিল যে, সংগে সংগে অহী নাযিল করে অনন্তকালের জন্য জগতের সকল অক্ষম ব্যক্তিদের জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দান করেন। নাযিল হয়

لَا یَسۡتَوِی الۡقٰعِدُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ غَیۡرُ اُولِی الضَّرَرِ وَ الۡمُجٰهِدُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ بِاَمۡوَالِهِمۡ وَ اَنۡفُسِهِمۡ ؕ فَضَّلَ اللّٰهُ الۡمُجٰهِدِیۡنَ بِاَمۡوَالِهِمۡ وَ اَنۡفُسِهِمۡ عَلَی الۡقٰعِدِیۡنَ دَرَجَۃً ؕ وَ کُلًّا وَّعَدَ اللّٰهُ الۡحُسۡنٰی ؕ وَ فَضَّلَ اللّٰهُ الۡمُجٰهِدِیۡنَ عَلَی الۡقٰعِدِیۡنَ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿ۙ۹۵

-ওজরগ্রস্তরা ছাড়া যেসব মুসলমান গৃহে অবস্থান করে, মর্যাদায় তারা তাদের সমকক্ষ নয়, যারা জান মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে।' (সূরাঃ ৪/ আন-নিসা, আয়াতঃ ৯৫)

 এখানে। [غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ ] বাক্যাংশ দ্বারা সকল অক্ষম ব্যক্তিকে জিহাদের হুকুম থেকে ব্যতিক্রম ঘোষণা করা হয়েছে।

তবে এই হুকুমের কারণে তার জিহাদে গমনের উৎসাহ কমার পরিবর্তে আরাে বৃদ্ধি পেল। তার মহান অন্তঃকরণ অক্ষমদের সাথে ঘরে বসে থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, মহান অন্তঃকরণ সর্বদাই মহৎ কাজ ছাড়া পরিতুষ্ট হতে পারে না। ইবন হাজার আসকিলানী আল ইসাব্যগ্রন্থে বলেনঃ অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও কখনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। মানুষকে তিনি বলতেন, আমার হাতে পতাকা নিয়ে তােমরা আমাকে দু' সারির মাঝখানে দাড় করিয়ে দাও। আমি অন্ধ, পালানাের কোন ভয় নেই।' 

হযরত ইবন উম্মে মাকতুম যদিও অক্ষমতার কারণে জিহাদের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত ছিলেন, তবে তার থেকে বড় পৌরব ও সম্মান তিনি অর্জন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন নেতৃস্থানীয় মুহাজির ও আনসারদের সংগে নিয়ে মদীনার বাইরে কোন অভিযানে গমন করতেন, তখন ইবন উম্মে মাকতুমকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। এ সময় তিনি মসজিদে নববীতে নামাযের ইমামতির দায়িত্ব পালন করতেন। সুতরাং আবওয়ার, বাওয়াত, যুল আসীর, জুহাইনা, সুয়াইক, গীতফান, হামরাউল আসাদ, নাজরান, যাতু রুকা প্রভৃতি অভিযানের সময় মােট তের বার এ গৌরব তিনি অর্জন করেন। বদর যুদ্ধের সময় কিছুদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে হযরত আবু লুবাবাকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ওফাতের পর থেকে হযরত উমারের (রাঃ) খিলাফত কালের শেষ পর্যন্ত তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কেবল এতটুকু জানা যায় যে, তিনি কাদেসিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মুসলিম বাহিনীর পতাকা সমুন্নত রেখেছিলেন। ঐতিহাসিক ওয়াকিদীর মতে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন। তবে ইবন সা'দ তার ‘তাবাকাতে যুবাইর ইবন বাককারের সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কাদেসিয়ার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। অধিকাংশ সীরাত লেখক এই বর্ণনাকে অধিকতর সহীহ মনে করেছেন।

চতুর্দশ হিজরী সনে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন পারস্য বাহিনীর সাথে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধের। তিনি বিভিন্ন প্রদেশের ওয়ালীদের লিখলেনঃ

যার একখানা হাতিয়ার, একটি ঘােড়া বা উষ্ট্ৰী অথবা বুদ্ধিমত্তা আছে, এমন কাউকে বাদ দিবে না। তাদের প্রত্যেককে আমার নিকট জলদি পাঠিয়ে দেবে।

মুসলিম জনগণ হযরত ফারুকে আজমের এ আহ্বানে ব্যাপকভাবে সাড়া দিল। চর্তুদিক থেকে মানুষ বন্যার স্রোতের ন্যায় মদীনার দিকে আসতে লাগলাে। অন্ধ আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমও ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি মুজাহিদদের কাতারে শামিল হয়ে চলে এলেন মদীনায়। খলীফা উমার (রাঃ) এই বিশাল বাহিনীর আমীর নিযুক্ত করলেন হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাসকে (রাঃ)-কে। যাত্রাকালে খলীফা তাকে নানা বিষয়ে উপদেশ দান করে বিদায় জানালেন।


মুসলিম বাহিনী যখন কাদেসিয়ায় পৌছলাে, হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম বর্ম পরে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে সামনে এলেন এবং মুসলিম বাহিনীর আলাম বা পতাকা বহনের দায়িত্বটি তাঁকে দেয়ার আহ্বান জানালেন। বললেনঃ হয় এ পতাকা সমুন্নত রাখবাে, নয় মৃত্যুবরণ করবাে।

এই কাদেসিয়া প্রান্তরে মুসলিম ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে যে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় বিশ্বের সমর ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত খুব কমই আছে। অবশেষে চূড়ান্ত যুদ্ধের তৃতীয় দিনে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্য ও সর্বাধিক গৌরবময় সিংহাসনের পতন ঘটে। আর সেইসাথে তাওহীদের পতাকা পত্ পত্ করে উড়তে থাকে এই সুবিশাল পৌত্তলিক ভূমিতে। অসংখ্য শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এ মহাবিজয় অর্জিত হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাকতুমও ছিলেন সেই অগণিত শহীদদের একজন। যুদ্ধশেষে দেখা গেল রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তিনি মুসলমানদের পতাকাটি জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে আছে।

ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন অন্ধ। মসজিদে নববী থেকে তার বাড়ীটিও ছিল একটু দূরে। পথে নালা নর্দমা ঝােপ জাংগল পড়তাে। সব সময়ের জন্য কোন সাহায্যকারীও তাঁর ছিলনা। এত অসুবিধা সত্বেও নিয়মিত মসজিদে নববীতে এসে নামাজ আদায় করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ একদিন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একজন অন্ধ, আমার বাড়ীটিও মসজিদ থেকে বেশ দূরে, আমাকে পথ দেখিয়ে নেওয়ার জন্য একজন লােকও আছে, তবে সে আমার মনঃপূত নয়। এমতাবস্থায় আপনি আমাকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দেবেন কি? তিনি বললেনঃ “তুমি আযান শুনতে পাও?' বললাম হ্যা। বললেনঃ তােমার জন্য আমি কোন অনুমতির পথ দেখতে পাচ্ছিনা। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাড়ী ও মসজিদের মধ্যে খেজুর বাগান ও ঝােপ-জংগল রয়েছে। সব সময় পথ দেখানাে লােকও আমি রাখতে পারিনে। এমতাবস্থায় আমি কি ঘরে নামায আদায় করতে পারি? তিনি বললেনঃ তুমি কি ইকামাত শুনতে পাও? বললাম হ্যা, রাসূল (সাঃ) বললেনঃ তা হলে তুমি মসজিদে এসেই নামায আদায় করাে। (হায়াতুস সাহাবা, ৩য়, ১২১) আযান ও ইকামতের আওয়াজ তার ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতাে এ কারণে তিনি অন্ধ হওয়া সত্বেও ঘরে নামায আদায়ের অনুমতি পাননি। হযরত উমার (রাঃ) তাঁর খিলাফতকালে তাকে একজন রাহনুমা (পথ প্রদর্শক) দিয়েছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেজ। হযরত আনাস ও যার বিন জাইশ তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তাহীবুল কামাল, ২৮৯)



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url