মা’আরেফুল কোরআন - ৬১ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৭০-১৭১ || দ্বীনী বিষয়ে পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুস্বরণ বিষয়ে আলোচনা






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৭০-১৭১


 وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمُ اتَّبِعُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَاۤ اَلۡفَیۡنَا عَلَیۡهِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ لَوۡ کَانَ اٰبَآؤُهُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا یَهۡتَدُوۡنَ ﴿۱۷۰  وَ مَثَلُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا کَمَثَلِ الَّذِیۡ یَنۡعِقُ بِمَا لَا یَسۡمَعُ اِلَّا دُعَآءً وَّ نِدَآءً ؕ صُمٌّۢ بُکۡمٌ عُمۡیٌ فَهُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ ﴿۱۷۱

সূরা আল-বাকারাহ ১৭০-১৭১ নং আয়াতের অর্থ

(১৭০) আর যখন তাদেরকে কেউ বলে যে, সে হুকুমেরই আনুগত্য কর, যা আল্লাহ্ তা'আলা নাযিল করেছেন, তখন তারা বলে- কখনো না, আমরা তো সে বিষয়েরই অনুসরণ করব, যাতে আমরা আমাদের বাপ-সাদাদেরকে দেখেছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানতো না, জানতো না সরল পথও। 
(১৭১) বস্তুত এহেন কাফিরদের উদাহরণ এমন, যেন কেউ এখন কোন জীবকে আহ্বান করছে যা কোন কিছুই শোনে না, হার-ডাক আর চিৎকার ছাড়া—বধির, মূক এবং অন্ধ। সুতরাং তারা কিছুই বুঝে না ।

সূরা আল-বাকারাহ ১৭০-১৭১ নং আয়াতের তাফসীর

তাফসীরের সার-সংক্ষেপ
আর যখন কেউ সেসব (মুশরিক) লোককে বলে যে, আল্লাহ্ তা’আলা যে নির্দেশ (স্বীয় পয়গম্বরের প্রতি) নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী চলে, তখন (তারা উত্তরে) বলে, (তা হতে পারে না) আমরা তো বরং সে পথেই চলব, যে পথে আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। (কারণ, তারাও সে পথ অবলম্বনের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত ছিলেন। এ দাবির খণ্ডনে আল্লাহ্ বলেন) তারা কি সর্ববিষয়েই স্বীয় বাপ-দাদাদের পন্থায় চলবে। তাদের বাপ-দাদারা ধর্মীয় ব্যাপারে কোন কিছু না জানলেও কি এবং তাদের প্রতি কোন আসমানী গ্রন্থের হেদায়েত না থাকেলও কি ?

বস্তুত (অজ্ঞানতার ক্ষেত্রে) এ সমস্ত কাফিরের তুলনা সে সমস্ত জীব-জন্তুর অবস্থারই মত (যার কথা এ উদাহরণে বর্ণনা করা হচ্ছে) যে, এক লোক এমন এক জীবের পেছনে চিৎকার করে যাচ্ছে যে, হাঁক-ডাক আর চিৎকার (-এর শব্দ) ছাড়া তার কোন মর্মই শোনে না। (তেমনিভাবে) এ কাফিররাও (বাহ্যিক কথাবার্তা শোনে বটে, কিন্তু কাজের ব্যাপারে সম্পূর্ণ) বধির ( যেন কিছুই শোনে না), মূক (যেন এমন কোন কথাই তাদের মুখে সরে না), অন্ধ (কারণ, লাভ-ক্ষতির ব্যাপারে কোন কিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না)। কাজেই (তাদের সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ই যখন বিকল, তখন) তারা কোন কিছুই বুঝে না, উপলব্ধি করে না।

   

সূরা আল-বাকারাহ ১৭০-১৭১ নং আয়াতের আনুষঙ্গিক বিষয়

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

বাপ-দাদাদের অন্ধ অনুসরণ

এ আয়াতের দ্বারা বাপ-দাদা, পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুকরণ-অনুসরণের যেমন নিন্দা প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি বৈধ অনুসরণের জন্য কতিপয় শর্ত এবং একটা নীতিও জানা যাচ্ছে। যেমন, দু’টি শব্দে বলা হয়েছে لَا يَعْقِلُونَ এবং لَا يَهْتَدُونَ এতে প্রতীয়মান হয় যে, বাপ-দাদা পূর্বপুরুষদের আনুগত্য ও অনুসরণ এ জন্য নিষিদ্ধ যে, তাদের মধ্যে না ছিল জ্ঞান-বুদ্ধি, না ছিল কোন খোদায়ী হেদায়েত। হেদায়েত বলতে সে সমস্ত বিধি-বিধানকে বোঝায়, যা পরিষ্কারভাবে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে। আর জ্ঞানবুদ্ধি বলতে সে সমস্ত বিষয়কে বোঝানো হয়েছে, যা শরীয়তের প্রকৃষ্ট ‘নস’ বা নির্দেশ থেকে গবেষণা করে বের করা হয় ।

অতএব, তাদের আনুগত্য ও অনুসরণ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণটি সাব্যস্ত হলো এই যে, তাদের কাছে না আছে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কোন বিধি-বিধান, না আছে তাদের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার বাণীর-পর্যালোচনা গবেষণা করে তা থেকে বিধি-বিধান বের করে নেওয়ার মত কোন যোগ্যতা। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, কোন আলেমের ব্যাপারে এমন নিশ্চিত বিশ্বাস হলে যে কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানের সাথে সাথে তাঁর মধ্যে ইজতিহাদ (উদ্ভাবন)-এর যোগ্যতাও রয়েছে, তবে এমন-মুজতাহিদ আলেমের আনুগত্য অনুসরণ করা জায়েয । অবশ্য এ আনুগত্য তাঁর ব্যক্তিগত হুকুম মানার জন্য নয়, বরং আল্লাহ্ এবং তাঁর হুকুম-আহ্কাম মানার জন্যই হবে। যেহেতু আমরা সরাসরি আল্লাহর সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারি না, সেহেতু কোন মুজতাহিদ আলেমের অনুসরণ করি, যাতে আল্লাহর বিধি-বিধান অনুযায়ী আমল করা যায় ।

অন্ধ অনুসরণে পার্থক্য

অন্ধ অনুসরণ এবং মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণের মধ্যে পার্থক্য-
উপরোক্ত বর্ণনার দ্বারা বোঝা যায় যে, যারা সাধারণভাবে মুজতাহিদ ইমামদের অনুসরণের বিরুদ্ধে এ আয়াতটি উদ্ধৃত করেন, তারা নিজেরাই এ আয়াতের আসল প্রতিপাদ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নন।

এ আয়াতের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী লিখেছেন, এ আয়াতে যে পূর্ব-পুরুষের আনুগত্য ও অনুসরণের কথা নিষেধ করা হয়েছে, তার প্রকৃত মর্ম হলো ভ্রান্ত ও মিথ্যা বিশ্বাস ও কার্যকলাপের ক্ষেত্রে বাপ-দাদা পূর্ব-পুরুষের অনুসরণ। যথার্থ ও সঠিক বিশ্বাস ও সৎকর্মে তাদের অনুসরণ করা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন, সূরা ইউসুফে হযরত ইউসুফ (আ)-এর সংলাপ বর্ণনা প্রসঙ্গে এ দু’টি বিষয়ের বিশ্লেষণ করা হয়েছেঃ

إِنِّي تَرَكْتُ مِلَّةَ قَوْمٍ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَهُمْ بِالْآخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ آبَائِي إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ

-“আমি সে জাতির ধর্মবিশ্বাসকে পরিহার করেছি, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে না এবং যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে। পক্ষান্তরে আমি অনুসরণ করেছি আমাদের পিতা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব (আ)-এর ধর্মবিশ্বাসের।”


এ আয়াতের দ্বারা প্রকৃষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, মিথ্যা ও ভ্রান্ত বিষয়ে বাপ-দাদাদের অনুসরণ করা হারাম, কিন্তু বৈধ ও সৎকর্মের বেলায় তা জায়েয। বরং প্রশংসনীয়। ইমাম কুরতুবী এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মুজতাহিদ ইমামগণের আনুগত্য ও অনুসরণ সম্পর্কিত মাস’আলা-মাসায়েল এবং অন্যান্য বিধি-বিধানের উল্লেখও করেছেন।

তিনি বলেনঃ

تعلق قوم بهذه الآية في ذم التقليد (الي) وهذا في الباطل صحيح - أما التقليد في الحق فـاصل من أصول الدين وعـصـمـة مـن عصم المسلمين يلجاء إليها الجاهل المقصر عن درك النظر 

অর্থাৎ—“কিছু লোক এ আয়াতটিকে তকলীদ বা অনুসরণের নিন্দাবাদ প্রসঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। তবে এরূপ অনুসরণ করা কেবল অবৈধ ও বাতিল বিষয়ের ক্ষেত্রেই যথার্থ। কিন্তু সত্য-সঠিক বিষয়ে কারও অনুসরণের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। সত্য-সঠিক বিষয়ে (অন্যের) অনুসরণ করা তো বরং ধর্মীয় নীতিমালার একটা স্বতন্ত্র ভিত্তি এবং মুসলমানদের জন্য ধর্মের হেদায়েত লাভের একটা বড় উপায়। কারণ, যারা নিজেরা ইজতিহাদ বা উদ্ভাবনের যোগ্যতা রাখে না, ধর্মীয় ব্যাপারে অন্যের অনুসরণের উপরই তাদের নির্ভর করতে হয়।"
—(কুরতুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৪)





*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url