মা’আরেফুল কোরআন - ৬২ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৭২-১৭৩ || প্রাণীর গোশত, চর্বি, রক্ত ও চামড়ার হালাল হারাম বিষয়ে আলোচনা







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৭২-১৭৩


 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُلُوۡا مِنۡ طَیِّبٰتِ مَا رَزَقۡنٰکُمۡ وَ اشۡکُرُوۡا لِلّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ اِیَّاهُ تَعۡبُدُوۡنَ ﴿۱۷۲  اِنَّمَا حَرَّمَ عَلَیۡکُمُ الۡمَیۡتَۃَ وَ الدَّمَ وَ لَحۡمَ الۡخِنۡزِیۡرِ وَ مَاۤ اُهِلَّ بِهٖ لِغَیۡرِ اللّٰهِ ۚ فَمَنِ اضۡطُرَّ غَیۡرَ بَاغٍ وَّ لَا عَادٍ فَلَاۤ اِثۡمَ عَلَیۡهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۷۳

সূরা আল-বাকারাহ ১৭২-১৭৩ নং আয়াতের অর্থ

(১৭২) হে ঈমানদারগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর। 
(১৭৩) তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জীব, রক্ত, শূকর মাংস এবং সেসব জীব-জন্তু, যা আল্লাহ্ ব্যতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালংঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন গোনাহ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু ।

সূরা আল-বাকারাহ ১৭২-১৭৩ নং আয়াতের তাফসীর

তাফসীরের সার সংক্ষেপ
(উপরের আয়াতে পবিত্র বস্তু-সামগ্রী খাবার ব্যাপারে মুশরিকদের ভুল ধারণা বাতলে দিয়ে তাদের সংশোধন করা উদ্দেশ্য ছিল। পরবর্তীতে ঈমানদারদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা সে ভুল ধারণার ক্ষেত্রে মুশরিকদের মতই আচরণ আরম্ভ না করে। প্রসঙ্গক্রমে ঈমানদারদের প্রতি স্বীয় নিয়ামতের উল্লেখ করে তাদেরকে শুকরিয়া আদায় করার শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে):


হে ঈমানদারগণ (আমার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি এ অনুমতি রয়েছে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে) যেসব পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আমি তোমাদেরকে দান করেছি, সেগুলোর মধ্য থেকে তোমরা (যা খুশি) আহার কর, (ভোগ কর) এবং (এ অনুমতির সাথে সাথে এ নির্দেশও বলবৎ রয়েছে যে, মুখ, হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকলাপে এবং এ সমস্ত নেয়ামত যে একান্তই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সে বিষয়ে অন্তরে বিশ্বাস রাখার মাধ্যমে) আল্লাহ্ তা’আলার শুকরিয়া আদায় কর, যদি তোমরা বাস্তবিকপক্ষেই তাঁর দাসত্বের সাথে যুক্ত থেকে থাক (বস্তুত এ সম্পর্ক একান্তই স্বীকৃত প্রকাশ্য। সুতরাং শুকরিয়া আদায় করাও যে ওয়াজিব তাও সুপ্রমাণিত)।

   

সূরা আল-বাকারাহ ১৭২-১৭৩ নং আয়াতের পূর্বাপর যোগসূত্র

যোগসূত্র
উপরের আলোচনায় বলা হচ্ছিল যে, হালাল বা বৈধ বস্তু-সামগ্রীকে হারাম বা অবৈধ সাব্যস্ত করো না। তারপর বলা হচ্ছে যে, মুশরিকদের মত তোমরাও হারামকে হালাল মনে করো না। এখানে মৃত বা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো নামে জবাই করা জীব-জন্তু যা মুশরিকরা খেত— তা থেকে বারণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এ কথাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নিকট অমুক অমুক জীব হারাম। এগুলো ছাড়া অন্যান্য জীব-জন্তুকে নিজের পক্ষ থেকে হারাম সাব্যস্ত করা ভূল। এতে পূর্ববর্তী বিষয়েরও সমর্থন হয়ে গেল।

(অতঃপর বলা হচ্ছে) আল্লাহ্ তা’আলা (শুধু) তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত জীব, (যা জবাই করা ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও জবাই করা ছাড়া মরে যায়)। আর রক্ত (যা প্রবাহিত হয়) এবং শূকর মাংস (তেমনি তার অন্যান্য অংশগুলোও) আর এমন সব জীবজন্তু যা (আল্লাহর নৈকট্য লাভের মানসে) আল্লাহ্ ব্যতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। (এ সমস্ত আল্লাহ্ হারাম করেছেন, কিন্তু সেসব বস্তু হারাম করেন নি, যা তোমরা নিজের পক্ষ - থেকে হারাম করে নিচ্ছ। যেমন, উপরে উল্লেখ করা হয়েছে)। তবে অবশ্য (এতে এতটুকু অবকাশ রয়েছে যে,) যে লোক (ক্ষুধার জ্বালায়) অনন্যোপায় হয়ে পড়ে (তার পক্ষে তা খাওয়ায়) কোন পাপ নেই। অবশ্য শর্ত হলো এই যে, খেতে গিয়ে সে যেন স্বাদ গ্রহণে আগ্রহী না হয় (প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেতে গিয়ে) যেন সীমালংঘন না করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু (তিনি এমন চরম সময়ে রহমত করে গোনাহর বস্তু থেকেও গোনাহ্ রহিত করে দিয়েছেন)।

সূরা আল-বাকারাহ ১৭২-১৭৩ নং আয়াতের জ্ঞাতব্য বিষয় সমূহ

হালাল ও হারাম খাবার খাওয়া

হালাল খাওয়ার বরকত ও হারাম খাদ্যের অকল্যাণঃ আলোচ্য আয়াতে যেমন হারাম খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে হালাল ও পবিত্র বস্তু খেতে এবং তা খেয়ে শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কারণ, হারাম খেলে যেমন মন্দ অভ্যাস ও অসচ্চরিত্রতা সৃষ্টি হয়, ইবাদতের আগ্রহ স্তিমিত হয়ে আসে এবং দোয়া কবূল হয় না, তেমনিভাবে হালাল খাওয়ায় অন্তরে এক প্রকার নূর সৃষ্টি হয়। তদ্দ্বারা অন্যায়-অসচ্চরিত্রতার প্রতি ঘৃণাবোধ এবং মততা ও সচ্চরিত্রতার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি অধিকতর মনোযোগ আসে, পাপের কাজে মনে ভয় আসে এবং দোয়া কবূল হয়। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর সমস্ত নবী-রসূলের প্রতি হেদায়েত করেছেনঃ

يَاأَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا

“হে আমার রসূলগণ! তোমরা পবিত্র খাদ্য গ্রহণ কর এবং নেক আমল কর।"

এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নেক আমলের ব্যাপারে হালাল খাদ্যের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনুরূপ হালাল খাদ্য গ্রহণে দোয়া কবূল হওয়ার আশা এবং হারাম খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় তা কবূল না হওয়ার অশঙ্কাই থাকে বেশি। রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, বহু লোক দীর্ঘ সফর করে আসে এবং অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে বলতে থাকে, ইয়া পরওয়ারদিগার! ইয়া রব !!’ কিন্তু যেহেতু সে ব্যক্তির পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের, পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় তার দোয়া কি করে কবূল হতে পারে? (মুসলিম, তিরমিযী, —ইবনে কাসীর-এর বরাতে)

إِنَّمَا حَرَّمّ বাক্যের মধ্যে إِنَّمَا শব্দটি বাক্যের অর্থ সীমিতকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং আর্য়াতের অর্থ দাঁড়ায় যে, আল্লাহ তা’আলা শুধুমাত্র সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রী হারাম করেছেন, যেগুলো পরে উল্লিখিত হচ্ছে এমনি, পরবর্তী অন্য এক আয়াতে বিষয়টির আরো একটু ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যথাঃ

قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ

অর্থাৎ- হুযূর (সা)-কে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে যে—আপনি ঘোষণা করে দিন, "ইতিপূর্বে আমি ওহী মারফত যেসব বস্তু হারাম করেছি, আহার্য গ্রহণকারীদের পক্ষে সেগুলো ছাড়া অন্য কোন কিছুই হারাম নয়।”

এ দু’টি আয়াতের মর্ম অনুযায়ী প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, খোদ কোরআনেরই অন্যান্য আয়াত এবং বিভিন্ন হাদীসে অন্যান্য যে বস্তু হারাম হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, এ দু’আয়াতের দ্বারা কি সেসব বস্তু হারাম হওয়া রহিত করা হয়েছে?

উত্তর এই যে, প্রথম আয়াতে হালাল-হারামের সামগ্রিক নির্দেশ আসেনি কিংবা সম্পূরক আয়াতেও এমন কথা বলা হয়নি যে, পূর্ববর্তী আয়াতে যেসব বস্তুর নামোল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো ছাড়া অন্যান্য কোন কিছুই হারাম নয়। বরং প্রথম আয়াতে জোর দিয়ে শুধু এ কথাই বলা হয়েছে যে, যে বস্তু সামগ্রীর নাম এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে, এগুলো সম্পূর্ণ হারাম। কেননা, মুশরিকরা এমন কিছু বস্তুকে হালাল মনে করতো, যেগুলো আল্লাহর বিধানে হারাম। পক্ষান্তরে নিজেদের পূর্বসংস্কার এবং অভ্যাসের দরুন এমন কিছু বস্তুকে হারাম বলে গণ্য করতো, যেগুলো আল্লাহর বিধানে হালাল। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বিশেষ কতকগুলো বস্তুর নাম উল্লেখ করে জোর দিয়ে দিচ্ছেন যে, এসব বস্তু সম্পর্কে তোমাদের ধারণা যাই থাক না কেন, এগুলো নিশ্চিতরূপেই হারাম। এ ছাড়া, হারাম বস্তু আল্লাহ্ তা’আলাই যেহেতু ওহীর মাধ্যমে চিহ্নিত করে দিয়েছেন, সুতরাং তোমাদের ধারণা কিংবা সংস্কারের কারণে অন্য কোন কিছু হারাম হবে না।

আলোচ্য আয়াতে যে বস্তু-সামগ্রীকে হারাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর সংখ্যা চার। যেমন—মৃত পশু, রক্ত, শূকর মাংস এবং যেসব জানোয়ার আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর নামে উৎসর্গ করা হয়। উপরোক্ত চিহ্নিত চারটি বস্তুর সাথে স্বয়ং কোরআনেরই অন্য আয়াতে এবং হাদীস শরীফে আরো কতিপয় বস্তুর উল্লেখ এসেছে। সুতরাং সেসব নির্দেশ একত্র করে চিহ্নিত হারাম বস্তুগুলো সম্পর্কে কিছু বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে।

মৃত প্রাণীর গোশত

মৃতঃ এর অর্থ যেসব প্রাণী হালাল করার জন্য শরীয়তের বিধান অনুযায়ী যবেহ করা জরুরী, সেসব প্রাণীই যদি যবেহ ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে যেমন আঘাত প্রাপ্ত হয়ে, অসুস্থ হয়ে কিংবা দম বন্ধ হয়ে মারা যায়, তবে সেগুলোকে মৃত বলে গণ্য করা হবে এবং সেগুলোর গোশত খাওয়া হারাম হবে।

তবে কোরআন শরীফে অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ أُحِلَّ لَكُمْ صَيْدُ الْبَحْرِ ‘তোমাদের জন্য সামুদ্রিক শিকার হালাল করা হলো।’

এ আয়াতের মর্মানুযায়ী সামুদ্রিক জীব-জন্তুর বেলায় যবেহ করার শর্ত আরোপিত হয়নি। ফলে এগুলো যবেহ ছাড়াই খাওয়া হালাল। অনুরূপ এক হাদীসে মাছ এবং টিড্ডি নামক পতঙ্গকে মৃত প্রাণীর তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এ দু’টির মৃতকে হালাল করা হয়েছে। রসূল (সা) ইরশাদ করেছেন— আমাদের জন্য দু’টি মৃত হালাল করা হয়েছে--মাছ এবং টিড্ডি। অনুরূপ দু’প্রকার রক্তও হালাল করা হয়েছে। যেমন যকৃৎ ও কলিজা। (ইবনে কাসীর, আহমদ, ইবনে মাজাহ, দার-কুতনী) সুতরাং বোঝা গেল যে, জীব-জন্তুর মধ্যে মাছ এবং টিডিড নামক পতঙ্গ মৃতের পর্যায়ভুক্ত হবে না, এ দু’টি যবেহ না করেও খাওয়া হালাল হবে। এগুলো ধরা পড়ে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কিংবা স্বাভাবিকভাবে অর্থাৎ যে কোন অবস্থাতেই মরুক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না। তবে মাছ পানিতে মরে যদি পঁচে যায় এবং পানির উপরে ভেসে ওঠে, তবে তা খাওয়া যাবে না। (জাসসাস) অনুরূপ যেসব বন্য জীব-জন্তু ধরে যবেহ করা সম্ভব নয়, সেগুলোকে বিসমিল্লাহ্ বলে তীর কিংবা অন্য কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে যদি মারা হয়, তবে সেগুলোও হালাল হবে। তবে এমতাবস্থায়ও শুধু আঘাত দিয়ে মারলে চলবে না, কোন ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে আঘাত করা শর্ত।

প্রাণীর গোশত, চর্বি ও চামড়া সম্পর্কে মাস’আলা

মাস’আলা-১
বন্দুকের গুলীতে আহত কোন জন্তু যদি যবেহ করার আগেই মরে যায়, তবে সেগুলোও লাঠি বা পাথরের আঘাতে মরা জন্তুর পর্যায়ভুক্ত বিবেচিত হবে। কোরআনের অন্য এক আয়াতে যাকে চাই (মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত) বলা হয়েছে। অর্থাৎ খাওয়া হালাল হবে না। মৃত্যুর আগেই যদি যবেহ করা হয়, তবে তা হালাল হবে।

মাস’আলা-২
ইদানীং এক রকম চোখা গুলী ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের গুলী সম্পর্কে কোন কোন আলেম মনে করেন যে, এসব ধারালো গুলীর আঘাতে মৃত জন্তুর হুকুম তীরের আঘাতে মৃত্যুর পর্যায়ভুক্ত হবে। কিন্তু আলেমগণের সম্মিলিত অভিমত অনুযায়ী বন্দুকের গুলী চোখা এবং ধারালো হলেও তা তীরের পর্যায়ভুক্ত হয় না। কেননা, তীরের আঘাত ছুরির আঘাতের ন্যায়, অপরপক্ষে বদুকের গুলী চোখা হলেও গায়ে বিদ্ধ হয়ে বারুদের বিস্ফোরণ ও দাহিকাশক্তির প্রভাবে জন্তুর মৃত্যু ঘটায়। সুতরাং এরূপ গুলীর দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত জানোয়ারও যবেহ করার আগে মারা গেলে তা খাওয়া হালাল হবে না।

মাস’আলা-৩
আলোচ্য আয়াতে “তোমাদের জন্য মৃত হারাম” বলাতে মৃত জানোয়ারের গোশত খাওয়া যেমন হারাম, তেমনি এগুলোর ক্রয়-বিক্রয়ও হারাম হিসেবে বিবেচিত হবে। যাবতীয় অপবিত্র বস্তু সম্পর্কেও সে একই বিধান প্রযোজ্য। অর্থাৎ এগুলোর ব্যবহার যেমন হারাম, তেমনি এগুলো ক্রয়-বিক্রয় করা কিংবা অন্য কোন উপায়ে এগুলো থেকে যে কোনভাবে লাভবান হওয়াও হারাম। এমনকি মৃত জীবজন্তুর গোশত নিজ হাতে কোন গৃহপালিত জন্তুকে খাওয়ানোও জায়েয নয়। বরং সেগুলো এমন কোন স্থানে ফেলে দিতে হবে, যেন কুকুর-বিড়ালে খেয়ে ফেলে। নিজ হাতে উঠিয়ে কুকুর-বিড়ালকে খাওয়ানোও জায়েয হবে না। (জাসসাস, কুরতুবী)

মাস’আলা-৪
’মৃত’ শব্দটি অন্য কোন বিশেষণ ছাড়া সাধারণভাবে ব্যবহার করাতে প্রতীয়মান হয় যে, হারামের হুকুমও ব্যাপক এবং তন্মধ্যে মৃত জন্তুর সমুদয় অংশই শামিল। কিন্তু অন্য এক আয়াতে عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ শব্দ দ্বারা এ বিষয়টিও ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে। তাতে বোঝা যায় যে, মৃর্ত জন্তুর শুধু সে অংশই হারাম যেটুকু খাওয়ার যোগ্য। সুতরাং মৃত জন্তুর হাড়, পশম প্রভৃতি যে সব অংশ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় না সেগুলো ব্যবহার করা হারাম নয়, সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা, কোরআনের অন্য এক আয়াতে আছেঃ

وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَى حِينٍ

এতে হালাল জানোয়ারসমূহের পশম প্রভৃতির দ্বারা ফায়দা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এখানে যবেহ করার শর্ত আরোপ করা হয়নি। (জাসসাস)

চামড়ার মধ্যে যেহেতু রক্ত প্রভৃতি নাপাকীর সংমিশ্রণ থাকে, সেজন্য মৃত জানোয়ারের চামড়া শুকিয়ে পাকা না করা পর্যন্ত নাপাক এবং ব্যবহার হারাম। কিন্তু পাকা করে নেওয়ার পর ব্যবহার করা সম্পূর্ণ জায়েয। সহীহ হাদীসে এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। (জাসসাস)

মাস’আলা-৫
মৃত জানোয়ারের চর্বি এবং তদ্দারা তৈরি যাবতীয় সামগ্রীই হারাম। এসবের ব্যবহার কোন অবস্থাতেই জায়েয নয়। এমনকি এসবের ক্রয়-বিক্রয় করাও হারাম।

মাস’আলা-৬
পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানীকৃত সাবান এবং অনুরূপ যেসব সামগ্রীতে জন্তুর চর্বি ব্যবহৃত হয়, সেগুলো ব্যবহার না করাই উত্তম। তবে সেগুলোতে মৃত জন্তুর চর্বি ব্যবহৃত হয় কিনা—এ সম্পর্কিত নিশ্চিত তথ্য অবগত না হওয়া পর্যন্ত ব্যবহার করা হারাম হবে না। কেননা, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর, হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী, হযরত আবূ মূসা আশ’আরী প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবী মৃত জানোয়ারের চর্বি শুধু খাওয়া হারাম বলেছেন, তবে অন্য কাজে ব্যবহার করা জায়েয বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সে কারণে এ সবের ক্রয়-বিক্রয় তাঁরা হালাল বলেছেন। (জাসাস)

মাস’আলা-৭
দুধের দ্বারা পনির তৈরি করার জন্য জন্তুর পেট থেকে সংগৃহীত এমন একটা উপাদান ব্যবহার করা হয়, আরবীতে যাকে ’নাফহা’ বলা হয়। এটি দুধের সাথে মেশানোর সাথে সাথেই দুধ জমে যায়। সংশ্লিষ্ট জানোয়ারটি যদি হালাল এবং আল্লাহর নামে যবেহকৃত হয় তবে তার নাফ্‌হা ব্যবহার করায়ও কোন দোষ নেই। কারণ, যবেহকৃত হালাল জন্তুর গোশত-চর্বি সবই হালাল। কিন্তু সে অংশটুকু যদি অযবেহকৃত অথবা কোন হারাম জন্তু থেকে নেওয়া হয়ে থাকে তবে তা দ্বারা প্রস্তুত পনির খাওয়া সম্পর্কে ফিকহশাস্ত্রবিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা (র) এবং ইমাম মালেক (র) সে পনির ব্যবহার করা যাবে বলে মত প্রকাশ করলেও ইমাম আবূ ইউসূফ, ইমাম মুহাম্মদ এবং সুফিয়ান সওরী (র) প্রমুখ একে নাজায়েয বলেছেন। (জাসসাস, কুরতুবী)

ইউরোপ ও অন্যান্য অ-মুসলিম দেশে তৈরি যেসব পনির আসে, সেগুলোতে হারাম এবং যবেহ না করা জন্তুর চর্বি বা ’নাফহা’ ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। এই পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ ফকীহর মতে এসব ব্যবহার না করাই উত্তম। অবশ্য ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মালেক (র)-এর অভিমতের ভিত্তিতে তা ব্যবহারের অবকাশ রয়েছে। তবে যেসব পনিরে শূকরের চর্বি ব্যবহৃত হয় যে কোন উপায়ে জানা যায়, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাপাক।

প্রাণীর রক্তের ব্যবহার

রক্তঃ আলোচ্য আয়াতে যেসব বস্তুসামগ্রীকে হারাম করা হয়েছে, তার দ্বিতীয়টি হচ্ছে রক্ত। এ আয়াতে শুধু রক্ত উল্লিখিত হলেও সূরা আন’আমের এক আয়াতে أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا অর্থাৎ ’প্রবহমান রক্ত’ উল্লিখিত হয়েছে। রক্তের সাথে ‘প্রবহমান’ শব্দ সংযুক্ত করার ফলে শুধু সে রক্তকেই হারাম করা হয়েছে, যা যবেহ করলে বা কেটে গেলে প্রবাহিত হয়। এ কারণেই কলিজা-যকৃৎ প্রভৃতি জমাট বাঁধা রক্তে গঠিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফিক্হবিদগণের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী পাক ও হালাল।

রক্তের ব্যবহার সম্পর্কে মাস’আলা

মাসআলা-১
যেহেতু শুধু প্রবহমান রক্তই হারাম ও নাপাক, কাজেই যবেহ করা জন্তুর গোশতের সাথে রক্তের যে অংশ জমাট বেঁধে থেকে যায়, সেটুকুও হালাল ও পাক । ফিকহবিদ সাহাবী ও তাবেয়ীসহ সমগ্র আলেম সমাজ এ ব্যাপারে একমত। একই কারণে মশা, মাছি ও ছারপোকার রক্ত নাপাক নয়। তবে রক্ত যদি বেশি হয় এবং ছড়িয়ে যায়, তবে তা ধুয়ে ফেলা উচিত। (জাসসাস)

মাস’আলা-২
রক্ত খাওয়া যেমন হারাম, তেমনি অন্য কোন উপায়ে তা ব্যবহার করাও হারাম। অন্যান্য নাপাক রক্তের ন্যায় রক্তের ক্রয়-বিক্রয় এবং তদ্দ্বারা অর্জিত লাভালাভ হারাম। কেননা কোরআনের আয়াতে ’রক্ত’ শব্দটি অন্য কোন বিশেষণ ব্যতীতই ব্যবহৃত হওয়ার কারণে রক্ত বলতে যা বোঝায়, তার সম্পূর্ণটাই হারাম প্রতিপন্ন হয়ে গেছে, ফলে রক্তের দ্বারা উপকার গ্রহণ করার সবগুলো দিকই হারাম সাব্যস্ত হয়েছে।


রোগীর গায়ে অন্যের রক্ত দেওয়ার মাস’আলা

এই মাস’আলার বিশ্লেষণ নিম্নরূপঃ রক্ত মানুষের শরীরের অংশ। শরীর থেকে বের করে নেওয়ার পর তা নাপাক। তদনুসারে প্রকৃত প্রস্তাবে একজনের রক্ত অন্যজনের শরীরে প্রবেশ করানো দু’কারণে হারাম হওয়া উচিত--প্রথমত, মানুষের যে কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্মানিত এবং আল্লাহ্ কর্তৃক সংরক্ষিত। শরীর থেকে পৃথক করে নিয়ে তা অন্যত্র সংযোজন করা সে সম্মান ও সংরক্ষণ বিধানের পরিপন্থী। দ্বিতীয়ত এ কারণে যে, রক্ত ‘নাজাসাতে-গলীযা’ বা জঘন্য ধরনের নাপাকী, আর নাপাক বস্তুর ব্যবহার জায়েয নয়।

তবে নিরুপায় অবস্থায় এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত যেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে চিন্তা-ভাবনা করলে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

প্রথমত, রক্ত যদিও মানুষের শরীরেরই অংশ, তথাপি এটা অন্য মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত করার জন্য যার রক্ত, তার শরীরে কোন প্রকার কাটা-ছেঁড়ার প্রয়োজন হয় না, কোন অঙ্গ কেটে পৃথক করতে হয় না। সুই-এর মাধ্যমে একজনের শরীর থেকে রক্ত বের করে অন্যের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। তদনুসারে রক্তকে দুধের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যা অঙ্গ কর্তন ব্যতিরেকেই একজনের শরীর থেকে বের হয়ে অন্যের শরীরের অংশে পরিণত হতে থাকে। শিশুর প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করেই ইসলামী শরীয়ত মানুষের দুধকে মানবশক্তির খাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে এবং স্বীয় সন্তানকে দুধ পান করানো মায়ের উপর ওয়াজিব সাব্যস্ত করে দিয়েছে। সন্তানদের পিতা কর্তৃক তালাকপ্রাপ্তা হলে পর অবশ্য শিশুকে দুধ পান করানো মায়ের উপর ওয়াজিব থাকে না। কেননা, সন্তানদের খাদ্য সংস্থানের দায়িত্ব পিতার, মায়ের নয়। তাই পিতা তখন সন্তানকে দুধ পান করানোর জন্য অন্য স্ত্রীলোক নিয়োগ করবে অথবা অর্থের বিনিময়ে সন্তানের মাতাকেই দুধ পান করানোর জন্য নিয়োগ করবে।

কোরআনের নির্দেশ হচ্ছেঃ

فَإِنْ أَرْضَعْنَ لَكُمْ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ

- “যদি তোমাদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীগণ তোমাদের সন্তানদের দুধ পান করায়, তবে তার বিনিময় পরিশোধ করে দেবে।"

মোটকথা, মায়ের দুধ মানবদেহের অংশ হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনের খাতিরে শিশুদের জন্য তা ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঔষুধরূপে বড়দের জন্যও। যথা ফতওয়ায়ে আলমগীরীতে বলা হয়েছেঃ

ولا بئس بأن يسعط الرجل بـلـبـن الـمرأة ويشربه للدواء 

- অর্থাৎ ঔষধ হিসাবে স্ত্রীলোকের দুধ পুরুষের পক্ষে নাকে প্রবেশ করানো কিংবা পান করায় দোষ নেই। (আলমগীরী)

ইবনে কুদামাহ্ রচিত ‘মুগনী’ গ্রন্থে এ মাস’আলা সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। (মুগনী, কিতাবুস সাইদ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ২০৬)

রক্তকে যদি দুধের সাথে ’কেয়াস’ তথা তুলনা করা হয়, তবে তা সামঞ্জস্যহীন হবে না। কেননা, দুধ রক্তেরই পরিবর্তিত রূপ এবং মানবদেহের অংশ হওয়ার ব্যাপারেও একই পর্যায়ভুক্ত। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, দুধ পাক এবং রক্ত নাপাক। সুতরাং হারাম হওয়ার প্রথম কারণ অর্থাৎ মানবদেহের অংশ হওয়ার ক্ষেত্রে তো নিষিদ্ধ হওয়ার ধারণা যুক্তিতে টেকে না। অবশিষ্ট থাকে দ্বিতীয় কারণ অর্থাৎ নাপাক হওয়া। এক্ষেত্রেও চিকিৎসার বেলায় অনেক ফিকহবিদ রক্ত ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন।

এমতাবস্থায় মানুষের রক্ত অন্যের দেহে স্থানান্তর করার প্রশ্নে শরীয়তের নির্দেশ দাঁড়ায় এই যে, সাধারণ অবস্থায় এটা জায়েয নয়। তবে চিকিৎসার্থে, নিরুপায় অবস্থায় ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে জায়েয। ’নিরুপায় অবস্থায়’ অর্থ হচ্ছে, রোগীর যদি জীবন-সংশয় দেখা দেয় এবং অন্য কোন ঔষধ যদি তার জীবন রক্ষার জন্য কার্যকর বলে বিবেচিত না হয়, আর রক্ত দেওয়ার ফলে তার জীবন রক্ষার সম্ভাবনা যদি প্রবল থাকে, তবে সে অবস্থায় তার দেহে অন্যের রক্ত দেওয়া কোরআন শরীফের সে আয়াতের মর্মানুযায়ীও জায়েয হবে, যে আয়াতে অনন্যোপায় অবস্থায় মৃত জন্তুর গোশত খেয়ে জীবন বাঁচানোর সরাসরি অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

আর যদি অনন্যোপায় না হয় এবং অন্য ঔষধ ব্যবহারে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়, তবে সে অবস্থায় রক্ত ব্যবহারের প্রশ্নে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ফিকহবিদ একে জায়েয বলেছেন এবং কেউ কেউ না-জায়েয বলেছেন। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ ফিকহর কিতাবসমূহে ‘হারাম বস্তুর দ্বারা চিকিৎসা’ শীর্ষক আলোচনায় উল্লিখিত হয়েছে।

শূকরের মাংস হারাম

শূকর হারাম হওয়ার বিবরণঃ আলোচ্য আয়াতে তৃতীয় যে বস্তুটি হারাম করা হয়েছে, সেটি হলো শূকরের মাংস। এখানে শূকরের সাথে ’লাহম’ বা মাংস শব্দ সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ইমাম কুরতুবী বলেন, এর দ্বারা শুধু মাংস হারাম—একথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়।

বরং শূকরের সমগ্র অংশ অর্থাৎ হাড়, মাংস, চামড়া, চর্বি, রগ, পশম প্রভৃতি সবকিছুই সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। তবে ’লাহম’ শব্দ যোগ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, শূকর অন্যান্য হারাম জন্তুর ন্যায় নয়, তাই এটি যবেহ করলেও পাক হয় না। কেননা, গোশত খাওয়া হারাম এমন অনেক জন্তু রয়েছে যাদের যবেহ করার পর সেগুলোর হাড়, চামড়া প্রভৃতি পাক হতে পারে, যদিও সেগুলো খাওয়া হারাম। কিন্তু যবেহ করার পরও শূকরের মাংস হারাম তো বটেই, নাপাকও থেকে যায়। কেননা, এটি একাধারে যেমনি হারাম তেমনি ’নাজাসে-আইন’ বা সম্পূর্ণ নাপাক। শুধু চামড়া সেলাই করার কাজে শূকরের পশম দ্বারা তৈরি সূতা ব্যবহার করা জায়েয বলে হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে। (জাসসাস, কুরতুবী)

আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে যা যবেহ করা প্রাণী হারাম

আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে যা যবেহ করা হয়ঃ আয়াতে উল্লিখিত চতুর্থ হারাম বস্তু হচ্ছে জীবজন্তু, যা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো নামে যবেহ অথবা উৎসর্গ করা হয়। সাধারণত এর তিনটি উপায় প্রচলিত রয়েছে।

প্রথমত, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যা উৎসর্গ করা হয় এবং যবেহ করার সময়ও সে নাম নিয়েই যবেহ করা হয়, যে নামে তা উৎসর্গিত। এ সুরতে যবেহকৃত জন্তু সমস্ত মত-পথের আলেম ও ফিকহবিদগণের দৃষ্টিতেই হারাম ও নাপাক । এটি মৃত এবং এর কোন অংশ দ্বারাই ফায়দা গ্রহণ জায়েয হবে না। কেননা وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ আয়াতে যে সুরতের কথা বোঝানো হয়েছে এ সুরতটি এর সরাসরি নমুনা, যে ব্যাপারে কারো কোন মতভেদ নেই।

দ্বিতীয় সুরত হচ্ছে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর সন্তুষ্টি বা নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যা যবেহ করা হয়। তবে যবেহ করার সময় তা আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ করা হয় যেমন, অনেক অজ্ঞ মুসলমান পীর-বুযুর্গগণের সন্তুষ্টি অর্জনের মানসে গরু, ছাগল, মুরগী ইত্যাদি মানত করে তা যবেহ করে থাকে। তবে যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নিয়েই তা যবেহ করা হয়। এ সুরতটিও ফকীহগণের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী হারাম এবং যবেহকৃত জন্তু মৃতের শামিল।

তবে দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে এ সুরতটি সম্পর্ক কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। কোন কোন মুফাসসির.এবং ফিকহবিদ এ সুরতটিকেও আয়াতে উল্লিখিত ’আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর নামে যবেহকৃত’ জীবের বিধানের অনুরূপ বিবেচনা করেছেন। যেমন, তফসীরে বায়যাবীর টীকায় বলা হয়েছেঃ

فكل ما نودى عليه بغير اسم الله فـهـو حـرام وان ذبـح بـاسـم تعالى حيث اجـمـع العلمـاء لو أن مسلما ذبح ذبيحة وقـصـد بذبـحـه التقرب إلى غير الله صار مرتدا وذبيحته ذبيحة مرتد

-অর্থাৎ “সে সমস্ত জন্তুই হারাম, যা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে উৎসর্গ করা হয়। যবেহ করার সময় তা আল্লাহর নামেই যবেহ করা হোক না কেন। কেননা, আলেম ও ফকীগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যদি কোন জন্তুকে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নৈকট্য হাসিল করার উদ্দেশ্যে কোন মুসলমানও যবেহ করে, তবে সে ব্যক্তি ’মুরতাদ’ বা ধর্মত্যাগী হয়ে যাবে এবং তার যবেহকৃত পশুটি মুরতাদের যবেহকৃত পশু বলে বিবেচিত হবে।”

দুররে মুখতার কিতাবুয যাবায়েহ অধ্যায়ে বলা হয়েছেঃ

 لو ذبح لقدوم الأمير ونحوه كواحد من العظمـاء يـحـرم لانه اهل به لغير الله ولو ذكر اسم الله وأقره الشامي

-যদি কোন আমীরের আগমন উপলক্ষে তাঁরই সম্মানার্থে কোন পশু যবেহ করা হয়, তবে যবেহকৃত সে পশুটি হারাম হয়ে যাবে। কেননা, এটাও “আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে যা যবেহ করা হয়”— এ আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত, যদিও যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নিয়েই তা যবেহ করা হয়। শামীও এ অভিমত সমর্থন করেছেন। (দুররে-মুখতার, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২১৪)

কেউ কেউ অবশ্য উপরোক্ত সুরতটিকে وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ আয়াতের সাথে সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করেন না। কেননা, আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি অনুসারে একেবারে সরাসরি তা বোঝায় না। তবে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর নৈকট্য বা সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত দ্বারা ‘আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর উদ্দেশ্যে যা উৎসর্গ করা হয়’ সে আয়াতের প্রতি যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় এ সুরতটিকেও হারাম করা হয়েছে। আমাদের বিবেচনায় এ যুক্তিই সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ ও সাবধানতাপ্রসূত।

উপরোক্ত সুরতটি হারাম হওয়ার সমর্থনে কোরআনের অন্য আর একটি আয়াতও দলীল হিসেবে পেশ করা যায় । সে আয়াতটি হচ্ছে وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ বাতিলপন্থীরা যেসব বস্তুর পূজা করে থাকে, সেই সবকিছুকে نصب বলা হয়। সেমতে আয়াতের অর্থ হয়ঃ সে সমস্ত পশু যেগুলোকে বাতিল উপাস্যের উদ্দেশ্যে যবেহ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ উল্লিখিত রয়েছে। এতে বোঝা যায় যে,  وَمَا أُهِلَّ بِهِ আয়াতের সরাসরি প্রতিপাদ্য সে সমস্ত পশু, যেগুলো যবেহ করার সময় অন্য কোন কিছুর নামে যবেহ করা হয়। এরপরই ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ আয়াত এসেছে। এ আয়াতে যবেহ করার সময় আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর নাম নেওয়ার কথা উল্লেখ নেই, শুধু মূর্তি বা বাতিল উপাস্যের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যবেহ করার কথা এসেছে। এতে এখানে সে সমস্ত জন্তুও এ সুরতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে যবেহ করা হলেও আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর সন্তুষ্টি অর্জন করার লক্ষ্যে যবেহ করা হয়েছে। (মাওলানা থানবীর ব্যাখ্যা)।

ইমাম কুরতুবীও তাঁর তফসীরে উপরোক্ত মতই সমর্থন করেছেন। তাঁর অভিমত হচ্ছেঃ

 وجرت عادة العرب بالمياح بـاسـم المقصود بالذبيحة وغلب ذلك في استعمالهم حتى عبر به عن النية التي هي علة التحريم 

অর্থাৎ আরবদের স্বভাব ছিল যে, যার উদ্দেশ্যে যবেহ করা হতো, যবেহ করার সময় তার স্বরে সে নামই উচ্চারণ করতে থাকতো। ব্যাপকভাবে তাদের মধ্যে এ রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য প্রত্যাশা — যা সংশ্লিষ্ট পশু হারাম হওয়ার মূল কারণ, সেটাকে ’এহলাল’ অর্থাৎ ’তার স্বরে নামোচ্চারণ’ শব্দ দ্বরা বোঝানো হয়েছে।

ইমাম কুরতুবী দু’জন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আলী (রা) এবং হযরত আয়েশা সিদ্দীকার ফতওয়ার উপর ভিত্তি করেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

হযরত আলী (রা)- এর শাসনামলে বিখ্যাত কবি ফরাযদাক-এর পিতা গালেব একটি উট যবেহ করেছিল। যবেহ করার সময় তাতে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নাম উচ্চারণ করা হয়েছিল বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এতদসত্ত্বেও হযরত আলী (রা) সে উটের গোশত وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ আয়াতের মর্মানুযায়ী হারাম বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং সাহাবীগণও হযরত আলী (রা)-এর এ সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছিলেন।

অনুরূপ ইমাম মুসলিম তাঁর ওস্তাদ ইয়াহ্ইয়া ইবনে ইয়াহ্ইয়ার সনদে হযরত আয়েশা সিদ্দীকার একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন। সে হাদীসের শেষভাগে রয়েছে যে, একজন স্ত্রীলোক হযরত আয়েশা (রা)-কে প্রশ্ন করেছিলেন, হে উম্মুল মু’মিনীন ! আজমী লোকদের মধ্যে আমাদের কিছুসংখ্যক দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তাদের মধ্যে সব সময় কোন-না-কোন উৎসব লেগেই থাকে। উৎসবের দিনে কিছু হাদিয়া-তোহফা তারা আমাদের কাছেও পাঠিয়ে থাকে। আমরা তাদের পাঠানো সেসব সামগ্রী খাবো কিনা? জবাবে হযরত আয়েশা (রা) বলেছিলেনঃ

وأما ما ذبح لذالك اليوم فلا تأكلوا ولكن كلوا مـن اشـجـارهـم . 

অর্থাৎ- সে উৎসব দিবসের জন্য যেসব পশু যবেহ করা হয়, সেগুলো খেয়ো না, তবে তাদের ফলমূল খেতে পার। —(তফসীরে কুরতুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৭)।

মোটকথা, দ্বিতীয় সুরতটি, যাতে নিয়ত থাকে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নৈকট্য লাভ, কিন্তু যবেহ করা হয় আল্লাহর নামেই, সেটিও হারাম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর সন্তুষ্টি বা নৈকট্য অর্জন, এর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকার দরুন وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ আয়াতের হুকুম । দ্বিতীয় আয়াত وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ এরও প্রতিপাদ্য সাব্যস্ত হওয়ার এ শ্রেণীর পশুর মাংসও হারাম হবে।

তৃতীয় সুরত হচ্ছে পশুর কান কেটে অথবা শরীরের অন্য কোথাও কোন চিহ্ন অঙ্কিত করে কোন দেব-দেবী বা পীর-ফকীরের নামে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেগুলো দ্বারা কোন কাজ নেওয়া হয় না, যবেহ করাও উদ্দেশ্য থাকে না। বরং যবেহ করাকে হারাম মনে করে। এ শ্রেণীর পশু আলোচ্য দু’ আয়াতের কোনটিরই আওতায় পড়ে না, এ শ্রেণীর পশুকে কোরআনের ভাষায় ‘বাহীরা’ বা সায়েবা নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের পশু সম্পর্কে হুকুম হচ্ছে যে, এ ধরনের কাজ অর্থাৎ কারো নামে কোন পশু প্রভৃতি জীবন্ত উৎসর্গ করে ছেড়ে দেওয়া কোরআনের সরাসরি নির্দেশ অনুযায়ী হারাম, যেমন বলা হয়েছেঃ

مَا جَعَلَ اللَّهُ مِنْ بَحِيرَةٍ وَلَا سَائِبَةٍ

অর্থাৎ- আল্লাহ্ তা’আলা বাহীরা বা সায়েবা সম্পর্ক কোন বিধান দেননি। তবে এ ধরনের হারাম আমল কিংবা সংশ্লিষ্ট পশুটিকে হারাম মনে করার ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণেই সেটি হারাম হয়ে যাবে না। বরং হারাম মনে করাতেই তাদের একটা বাতিল মতবাদকে সমর্থন এবং শক্তি প্রদান করা হয়। তাই এরূপ উৎসর্গিত পশু অন্যান্য সাধারণ পশুর মতই হালাল।

শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট পশুর উপর তার মালিকের মালিকানা বিনষ্ট হয় না, যদিও সে ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে এরূপ মনে করে যে, এটি আমার মালিকানা থেকে বের হয়ে যে নামে উৎসর্গ করা হয়েছে, তারই মালিকানাতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শরীয়তের বিধানমতে যেহেতু তার সে উৎসর্গীকরণই বাতিল, সুতরাং যে পশুর উপর তার পরিপূর্ণ মালিকানা কায়েম থাকে। সেমতে উৎসর্গকারী যদি সেই পশু কারো নিকট বিক্রয় করে কিংবা অন্য কাউকে দান করে দেয়, তবে ক্রেতা ও দানগ্রহীতার জন্য সেটি হালাল হবে। পৌত্তলিক সমাজের অনেকেই মন্দির বা দেব-দেবীর নামে পশু-পাখি উৎসর্গ করে সেগুলো পূজারী বা সেবায়েতদের হাতে তুলে দেয়। সেবায়েতরা সেসব পশু বিক্রয় করে থাকে। এরূপ পশু ক্রয় করা সম্পূর্ণ হালাল।

এক শ্রেণীর কুসংস্কারগ্রস্ত মুসলমানকেও পীর-বুযুর্গের মাযারে ছাগল-মুরগী ইত্যাদি ছেড়ে আসতে দেখা যায়। মাযারের খাদেমরাই সাধারণত উৎসর্গিত সেসব জন্তু ভোগ-দখল করে থাকে। যেহেতু মূল মালিক খাদেমগণের হাতে এগুলো ছেড়ে যায় এবং এগুলোর ব্যাপারে খাদেমদের পূর্ণ ইখতিয়ার থাকে, সেহেতু এ শ্রেণীর জীবজন্তু ক্রয় করা, যবেহ করে খাওয়া, বিক্রয় করে লাভবান হওয়া সম্পূর্ণ হালাল।

দেব-দেবী বা পীর-বুযুর্গদের নামে মানত করা হারাম

আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নামে মানত সম্পর্কিত মাস’আলাঃ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য যে কোন কিছুর নামে জীব-জানোয়ার উৎসর্গ করার সাথে সম্পর্কযুক্ত আরো একটি মাস’আলা হচ্ছে পৌত্তলিকদের দেব-দেবী এবং কোন কোন অজ্ঞ মুসলমান কর্তৃক পীর-বুযুর্গদের মাযার-দরগায় যেসব মিষ্টান্ন বা খাদ্যবস্তু মানত করা হয় বা সেসবের নামে উৎসর্গ করা হয়, সেগুলোতেও মূল কারণ-

-‘আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন কিছুর সন্তুষ্টি বা সান্নিধ্য অর্জনের লক্ষ্য থাকে বলেই অধিকাংশ ফিকহবিদ হারাম বলেছেন। আর এগুলো খাওয়া-পরা, অন্যকে খাওয়ানো এবং বেচাকেনা করাকেও হারাম বলা হয়েছে। বাহরুর-রায়েক প্রভৃতি ফিকহর কিতাবে এ ব্যাপারে সবিস্তার বিবরণ রয়েছে। এই মাস’আলাটি উৎসর্গিত পশু-সংক্রান্ত মাস’আলার উপর কেয়াস করে গ্রহণ করা হয়েছে।

ক্ষুধার্ত নিরুপায় অবস্থার মাস’আলা

ক্ষুধার আতিশয্যে নিরুপায় অবস্থার বিধি-বিধানঃ উল্লিখিত আয়াতে চারটি বস্তুকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। অতঃপর এর ব্যতিক্রমী বিধানও বর্ণনা করা হয়েছে। যথা—

فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ 

এই হুকুমে এতটুকু অবকাশ রাখা হয়েছে যে, ক্ষুধার আতিশয্যে যে ব্যক্তি নিতান্তই অনন্যোপায় হয়ে পড়বে, সে যদি উল্লিখিত হারাম বস্তু থেকে কিছুটা খেয়েও নেয়, তবে তার কোন পাপ হবে না। কিন্তু এর জন্য শর্ত হলো এই যে, সে (১) স্বাদ গ্রহণের প্রতি আগ্রহী হবে না এবং (২) প্রয়োজনের পরিমাণ অতিক্রম করবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ অত্যন্ত ক্ষমাকারী, মহা দয়ালু।

এখানে ক্ষুধার তাড়নায় মরণোন্মুখ ব্যক্তির প্রাণ রক্ষার জন্য দু’টি শর্তে উল্লিখিত হারাম বস্তু নিতান্ত প্রয়োজন পরিমাণে খাওয়ার পাপকে তুলে দেওয়া হয়েছে।

শরীয়তের পরিভাষায় ক্ষুধার আতিশয্যে ব্যাকুল সে ব্যক্তিকে বলা হয়, যার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। সাধারণ কষ্ট কিংবা প্রয়োজনকে ব্যাকুলতা বলা হয় না। কাজেই যে লোক ক্ষুধার এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয় যে, তখন কোন কিছু না খেতে পারলে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে, তখন সে ক্ষেত্রে তার পক্ষে দু’টি শর্তে—এসব হারাম বস্তু খেয়ে নেওয়ার অবকাশ রয়েছে। একটি শর্ত হলো যে, উদ্দেশ্য হবে শুধুমাত্র জান বাঁচানো বা প্রাণ রক্ষা করা, খাবার স্বাদ গ্রহণ করা উদ্দেশ্য হবে না। দ্বিতীয়ত, সে খাবারের পরিমাণ এতটুকুতে সীমিত রাখবে, যাতে শুধু প্রাণটুকুই রক্ষা পেতে পারে, পেট ভরে খাওয়া কিংবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া তখনও হারাম হবে।

মরণাপন্ন অবস্থায় হারাম বস্তু খাওয়া

গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ এ ক্ষেত্রে কোরআন করীম মরণাপন্ন অবস্থায়ও হারাম বস্তু খাওয়াকে হালাল বা বৈধ বলেনি, বলেছে لا جناح عليه (তাতে তার কোন পাপ নেই)। এর মর্ম এই যে, এসব বস্তু তখনও যথারীতি হারামই রয়ে গেছে, কিন্তু যে লোক খাচ্ছে তার অনন্যোপায় অবস্থার প্রেক্ষিতে হারাম খাদ্য গ্রহণের পাপ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কোন বস্তুর হালাল হওয়া আর গোনাহ মাফ হয়ে যাওয়া এক কথা নয়, এ দু’য়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ক্ষুধার তাড়নায় অনন্যোপায় লোকদের জন্য যদি এসব বস্তু হালাল করে দেওয়া উদ্দেশ্য হতো, তাহলে হারাম বা অবৈধতাকে রহিত করে দেওয়াই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখানে ’তার কোন পাপ নেই’ কথাটি যোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে এই তাৎপর্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হারাম হওয়ার বিষয়টি যথাস্থানে বহাল রয়েছে এবং সেটি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করার যে পাপ তাও পূর্বের মতোই বলবৎ রয়েছে। তবে অনন্যোপায় ব্যক্তির জন্য হারাম বস্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে সে পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে মাত্র।

ঔষধ হিসাবে হারাম বস্তুর ব্যবহার

অনন্যোপায় অবস্থায় ঔষধ হিসাবে হারাম বস্তুর ব্যবহারঃ উপরোক্ত আয়াতের মর্মানুযায়ী একথাও সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, কারো জীবন বিপন্ন হয়ে পড়লে সে ঔষধ হিসাবে হারাম বস্তু ব্যবহার করতে পারে। তবে আয়াতের মর্মার্থ অনুযায়ীই এ ব্যাপারেও কিছু শর্ত রয়েছে বলে মনে হয়। প্রথমত, প্রকৃতই অনন্যোপায় এবং জীবন সংশয়ের মত অবস্থা হতে হবে। সাধারণ কষ্ট বা রোগব্যাধির ক্ষেত্রে এ নির্দেশ কার্যকর হবে না। দ্বিতীয়ত, হারাম বস্তু ছাড়া অন্য কোন কিছুই যদি এ রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে কার্যকর না হয় কিংবা যদি পাওয়া না যায়। কঠিন ক্ষুধার সময়ও অবকাশ এমন ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যখন প্রাণ রক্ষা করার মত আর অন্য কোন হালাল খাবার না থাকে কিংবা সংগ্রহ করার কোন ক্ষমতা না থাকে। তৃতীয়ত, সে হারাম বস্তু গ্রহণে যদি প্রাণ রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়। ক্ষুধার তাড়নায় অনন্যোপায় ব্যক্তির জন্য যেমন এক লোকমা হারাম মাংস খেয়ে নেওয়া সাধারণত তার প্রাণ রক্ষার নিশ্চিত উপায়। যদিও কোন ঔষধ এমন হয় যে, তার ব্যবহার উপকারী বলে মনে হয় বটে, কিন্তু তাতে তার সুস্থতা নিশ্চিত নয়, তাহলে এমতাবস্থায় সে হারাম ঔষধের ব্যবহার উল্লিখিত আয়াতের ব্যতিক্রমী হুকুমের আওতায় জায়েয হবে না। এরই সঙ্গে আরও দু’টি শর্ত কোরআনের আয়াতে উল্লিখিত রয়েছে যে, তার ব্যবহারে কোন উপভোগ যেন উদ্দেশ্য না হয় এবং যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার করা না হয়।

উল্লিখিত আয়াতের পরিষ্কার বর্ণনা ও ইঙ্গিতসমূহের দ্বারা যেসব শর্ত ও বাধ্যবাধকতার বিষয়ে জানা যায়, সে সমস্ত শর্তসাপেক্ষে যাবতীয় হারাম ও নাপাক ঔষধের ব্যবহার তা খাবারই হোক কিংবা বাহ্যিক ব্যবহারেরই হোক সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ফিকহবিদগণের ঐকমত্যে জায়েয। এ সমস্ত শর্তের সারমর্ম হলো পাঁচটি বিষয়ঃ

(১) অবস্থা হবে অনন্যোপায়। অর্থাৎ প্রাণনাশের আশংকা সৃষ্টি হলে, (২) অন্য কোন হালাল ঔষধ যদি কার্যকর না হয় কিংবা পাওয়া না যায়, (৩) এই ঔষধের ব্যবহারে আরোগ্য লাভ যদি নিশ্চিত হয়, (৪) এর ব্যবহারে যদি কোন আনন্দ উদ্দেশ্য না হয়, এবং (৫) প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার করা না হয়।

চিকিৎসা ও ঔষধে হারাম বস্তুর ব্যবহার

অনন্যোপায় অবস্থা ব্যতীত সাধারণ চিকিৎসা ও ঔষধে হারাম বস্তুর ব্যবহারঃ অনন্যোপায় অবস্থা সংক্রান্ত মাস’আলাটি তো উল্লিখিত শর্ত সাপেক্ষে কোরআনের স্পষ্ট আয়াত ও ওলামাগণের ঐকমত্যে প্রমাণিত হয়ে গেল, কিন্তু সাধারণ রোগ-ব্যাধিতেও না-পাক ও হারাম ঔষধ ব্যবহার করা জায়েয কিনা, এ মাস’আলার ব্যাপারে ফকীগণের মতবিরোধ রয়েছে। অধিকাংশ ফকীহর মতে অনন্যোপায় অবস্থা এবং উল্লিখিত শর্তাশর্তের অবর্তমানে কোন হারাম বস্তু ঔষধরূপে ব্যবহার জায়েজ নয়। কারণ, হাদীসে রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ্ ঈমানদারদের জন্য কোন হারামের মধ্যে আরোগ্য রাখেন নি।” – (বুখারী)

অপরাপর কোন কোন ফকীহ্ হাদীসে উদ্ধৃত এক বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে একে জায়েয সাব্যস্ত করেছেন। ঘটনাটি হলো ওরায়নাবাসিগণের, যা সমস্ত হাদীস গ্রন্থেই উদ্ধৃত রয়েছে। তা হলো এই যে, এক সময় কিছু সংখ্যক গ্রাম্য লোক মহানবী (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়। তারা ছিল বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। মহানবী (সা) তাদেরকে উষ্ট্রীর দুধ ও মূত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন, যাতে তারা আরোগ্য লাভ করেছিল।

কিন্তু এ ঘটনায় এমন কতিপয় সম্ভাব্যতা বিদ্যমান, যাতে হারাম বস্তুর ব্যবহারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। কাজেই সাধারণ রোগ-ব্যাধির ক্ষেত্রে অনন্যোপায় অবস্থা এবং শর্তসমূহের উপস্থিতি ছাড়া হারাম ঔষধ ব্যবহার না করাই হচ্ছে আসল হুকুম ।

কিন্তু পরবর্তী যুগের ফকীহগণ বর্তমান যুগে হারাম ও নাপাক ঔষধপত্রের আধিক্য এবং সাধারণ অভ্যাস ও জনগণের দুর্বলতার প্রতি লক্ষ্য রেখে অন্য কোন হালাল ও পবিত্র ঔষধ এ রোগের জন্য কার্যকর নয় কিংবা পাওয়া না যাওয়ার শর্তে তা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।

كما في الدر المختار قـبـيـل فصل البير اختلف في التداوى بالمحرم وظاهر المذهب المنع كما في رضاع البحر ولكن نقل المصنف ثم وههنا عن الحاوى قـيـل يرخص إذا علم فـيـه الشفاء ولم يعلم دواء آخر كما رخص في الخمر للعطشان وعليه الفتوى . ومثله في العالمگيريه

অর্থাৎ—দুরে-মুখতার গ্রন্থের ‘বি’র’ বা কূপ-সংক্রান্ত পরিচ্ছদের পূর্বে উল্লেখ রয়েছে যে, হারাম বস্তু-সামগ্রী ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করার প্রশ্নে মতবিরোধ রয়েছে। সাধারণভাবে শরীয়ত অনুযায়ী উহা নিষিদ্ধ। যেমন, ‘বাহরোর-রায়েক’ গ্রন্থের স্তন্যদান সংক্রান্ত পরিচ্ছেদেও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ‘তানবীর’ রচয়িতা এক্ষেত্রে স্তন্যদান সম্পর্কেও ’হাবী কুদসী’ থকে উদ্ধৃত করেছেন যে, কোন কোন ওলামা ঔষধ ও চিকিৎসার জন্য হারাম বস্তু সামগ্রীর ব্যবহারকে এই শর্তে জায়েয বলেছেন যে, সে ঔষধের ব্যবহারে আরোগ্য লাভ সাধারণ ধারণায় নিশ্চিত হতে হবে এবং কোন হালাল ঔষধও তার বিকল্প হিসাবে যদি না থাকে। যেমন, একান্ত তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির জন্য মদের এক ঘোট পান করে জীবন রক্ষা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। একই অভিমত আলমগিরিতেও ব্যক্ত করা হয়েছে।

মাসআলাঃ উল্লিখিত বিশ্লেষণে সে সমস্ত বিলেতী ঔষধপত্রের হুকুমও জানা গেল, যা ইউরোপ প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানী হয়ে আসে এবং যাতে শরাব, এ্যালকোহল কিংবা অপবিত্র বস্তুর উপস্থিতি জানাও নিশ্চিত। বস্তুত যেসব ঔষধে হারাম ও নাপাক বস্তুর উপস্থিতি সন্দিগ্ধ, তার ব্যবহারে আরও অধিকতর অবকাশ রয়েছে। অবশ্য সতর্কতা উত্তম। বিশেষত যখন কোন কঠিন প্রয়োজন থাকে না তখন সতর্কতা অবলম্বন করাই কর্তব্য।





*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url