তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন - ১০ || সূরা বাকারার তাফসীর, আয়াত ১-৩৯ || মোত্তাকীদের সফলতা || মোত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য





সূরা বাকারার তাফসীর

সূরা বাকারা আয়াত ১-৩৯

   
আলিফ, লাম-মীম,
এই তিনটি হচ্ছে 'হুরুফে মোকাত্তায়াত' অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত অক্ষরসমূহ এগুলো দিয়ে সূরাটির সূচনা হয়েছে। আর এর পরই আল্লাহর কেতাব সম্পর্কে বলা হয়েছে-

এই সেই কেতাব যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই, যা আল্লাহভীরুদের জন্য পথ নির্দেশিকা।

কোরআনের কয়েকটি সূরায় এ ধরনের বিক্ষিপ্ত বর্ণমালার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এর ব্যাখ্যা নানাভাবে করা হয়েছে। তন্মধ্যে আমি একটি ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করি। সেটি এই যে, এ দ্বারা ইংগিত এ কথাই বলা হয়েছে যে, এই গ্রন্থ এই সব বর্ণমালা দিয়েই লিখিত, যা আরব শ্রোতাদের নাগালের মধ্যেই বিদ্যমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি এমন এক অলৌকিক গ্রন্থ, যার সমতুল্য কোনো গ্রন্থ এই একই বর্ণমালা দিয়ে তারা রচনা করতে সক্ষম নয় । এই গ্রন্থ তাদেরকে বারবার চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে, যাও এর মত দশটি সূরা বা নিদেন পক্ষে একটি সূরাই রচনা করে আনো । কিন্তু তারা এই চ্যালেঞ্জের কেনো জবাব পর্যন্ত দিতে পারেনি।

মানুষের এই অপারগতা শুধু আল্লাহর কেতাবের সমকক্ষ আয়াত বা সূরা রচনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আল্লাহর সকল সৃষ্টিতেই ব্যাপৃত। সকল জিনিসের ক্ষেত্রেই আল্লাহর কারিগরী ও মানুষের কারিগরীতে এই পার্থক্য বিদ্যমান। মাটি যে সব অণু পরমাণু দিয়ে তৈরী, তার গুণাগুণ সবারই জানা। কিন্তু সে অণু পরমাণুগুলো দিয়ে মানুষ একটি খুঁটি, একটি পাত্র একটি দ্রব্য এমনকি একটি ইটও বানাতে সক্ষম হবে না। অথচ অতুলনীয় মৌলিক সৃজনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন মহান আল্লাহ তায়ালা সেই অণু পরমাণুগুলো থেকেই সৃষ্টি করেন স্পন্দনশীল সচেতন জীবন। এই জীবনই হলো আল্লাহর সেই রহস্যময় সৃষ্টি, যা সৃষ্টি করা তো দূরের কথা, তার রহস্য উন্মোচন করাও মানুষের সাধ্যাতীত। কোরআনও ঠিক তদ্রূপ। পরিচিত কতিপয় অক্ষর ও শব্দ। তা থেকে মানুষ রচনা করে কিছু বাক্য ও ছন্দবদ্ধ কবিতা। আর আল্লাহ তায়ালা রচনা করেন কোরআন ও সভ্য মিথ্যার প্রভেদকারী গ্রন্থ। নির্জীব দেহ ও সজীব প্রাণ সৃষ্টিতে যে পার্থক্য, প্রচলিত আরবী বর্ণমালা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক কোন কিছু রচনা করা আর মানুষ কর্তৃক কোন কিছু রচনা করাও রয়েছে সেই একই পার্থক্য । কল্পনার জীবনে ও আসল জীবনে যে ব্যবধান, এখানেও সেই একই ব্যবধান বিদ্যমান ।

আল কোরআন মোত্তাকীদের পথ নির্দেশিকা

এই সেই কেতাব, যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই
কোথা থেকে আসবে সন্দেহ সংশয়? অথচ তাদের জানা চেনা অক্ষর মালা দিয়ে কোরআনের অনুরূপ গ্রন্থ রচনায় তাদের অক্ষমতা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এই কেতাব সকল সন্দেহ সংশয়ের ঊর্দ্ধে এবং সুনিশ্চিতভাবে আল্লাহরই রচিত কেতাব। এরপর বলা হয়েছে এই কোরআন হলো- 'মোত্তাকীদের জন্য পথ নির্দেশিকা।

বস্তুত, সত্য ও সঠিক পথের সন্ধানদাতা হওয়াই এ কেতাবের আসল পরিচয়। এটাই তার স্বভাব ও প্রকৃতি। তবে এটি কার জন্যে? কার জন্যে কোরআন হেদায়াতকারী ও পথ নির্দেশক, কার জন্যেই বা সে আলোক বর্তিকা শুভাকাংখী ও শুভানুধ্যায়ী? এর জবাব এই যে, একমাত্র মোত্তাকী তথা আল্লাহভীরুদের জন্য। হৃদয়ে তাকওয়ার উপস্থিতিই মানুষকে এই গ্রন্থ দ্বারা উপকৃত হবার যোগ্য বানায়। এই তাকওয়াই তার মনমগযের গ্রন্থিগুলো খুলে দেয়, অতপর তার অভ্যন্তরে কোরআনের প্রবেশ ও ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেয়। তাকওয়াই হৃদয়কে কোন কিছু গ্রহণের ও সাড়া দেয়ার যোগ্যতা দান করে।
   
যে ব্যক্তি কোরআন থেকে হেদায়াত তথা সত্যের সন্ধান পেতে ইচ্ছুক, তাকে অবশ্যই কলুষ মুক্ত নির্মল ও খালেস মনে তা অধ্যয়ন করতে হবে। গোমরাহীতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সদা | সতর্ক, এমন একটা মন নিয়ে কোরআন পড়তে হবে। তা হলেই কোরআন তার রহস্য উন্মোচন ও তার আলোক বিকিরণের পথ উন্মুক্ত করে দেবে। এই ভীরু, সতর্ক, সচেতন, সংবেদনশীল এবং উপদেশ গ্রহণে প্রস্তুত হৃদয়কেই কোরআন স্বীয় নূর ও হেদায়াত দ্বারা ভরে দেয়। হযরত ওমর (রা.) একবার হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'তাকওয়া কী?' হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রা.) জবাব দিলেন, 'আপনি কি কখনো কন্টকাকীর্ণ পথ দিয়ে চলেছেন? হযরত ওমর (রা.) বললেন, হাঁ। হযরত উবাই (রা.) বললেন, কিভাবে চলেছেন? হযরত ওমর (রা.) বললেন, 'কাপড় চোপড় গুটিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে চলেছি।' হযরত উবাই বললেন, “ওটাই তো তাকওয়া।"

বস্তুত, বিবেকের সার্বক্ষণিক সচেতনতা ও সতর্কতা, চেতনা ও অনুভূতির স্বচ্ছতা, অব্যাহত ভীতি, নিরবিচ্ছিন্ন সাবধানতা, জীবন পথের কন্টকসমূহ থেকে আত্মরক্ষার প্রবণতা- এ সবেরই নাম তাকওয়া। জীবন পথের এই কাঁটাগুলো হচ্ছে প্রবৃত্তির কুৎসিত কামনা বাসনা ও প্ররোচনা। অন্যায় লোভ লালসা ও উচ্চাভিলাস, ভয় ভীতি ও শংকা, আশা পূরণে সক্ষম নয় এমন কারো কাছে মিথ্যা আশা পোষণ করা ক্ষতি বা উপকার সাধনে সক্ষম নয় এমন কারো মিথ্যা ভয়ে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি।

এরপর মোত্তাকী বা আল্লাহভীরুদের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। শুধু মদীনায় যারা ঈমান আনয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের নয় বরং সর্বকালের সকল নিষ্ঠাবান মোমেনের গুণাবলী এ রকমই হয়ে থাকে।

'যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে, নামায কায়েম করে, আমি তাদেরকে যা কিছু দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে, তোমার ওপর ও তোমার পূর্বে নাযিল করা কেতাবগুলোর প্রতি ঈমান আনে সর্বোপরি আখেরাতের প্রতি সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখে।'

মোত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য

মোত্তাকীদের প্রথম গুণটি হলো সক্রিয় ও ইতিবাচক চেতনাগত ঐক্য। এই ঐক্যই তাদের মনে অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনা, ফরয কাজসমূহ সম্পাদন করা, সকল নবী রসূলের প্রতি ঈমান আনা এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান আনার প্রেরণা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। এই পরিপূর্ণতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা একমাত্র ইসলামী আকীদা ও এ আকীদায় বিশ্বাসের বৈশিষ্ট। বস্তুত শেষ নবীর মাধ্যমে আগত যে সর্বশেষ আকীদা ও আদর্শের ওপর সমগ্র মানব জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া কাম্য, যে আকীদা ও আদর্শের সমগ্র মানবজাতির ওপর কর্তৃত্বশীল হওয়া কাংখিত সে আকীদা অবশ্যই এমন হতে হবে যার উপর মানব জাতি স্বীয় আবেগ অনুভূতি ও জীবন পদ্ধতি সহকারে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে সক্ষম, সেই আকীদা ও আদর্শের এরূপ পূর্ণাংগ ও স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়াই বাঞ্ছনীয় । এতোটা পূর্ণাংগ হওয়া বাঞ্ছনীয় যেন চেতনা ও কাজ এবং ঈমান ও আমল সবই তার আওতায় এসে যায় ।

আমরা মোত্তাকীদের এই প্রথম গুণটির বিশদ বিবরণ দেয়া যখন শুরু করি এবং এই গুণটি থেকে উৎপন্ন এর প্রতিটি পৃথক পৃথক একককে যখন পর্যবেক্ষণ করি, তখন তা সমগ্র মানব জাতির জীবনে কতিপয় মৌলিক মূল্যবোধের উপস্থিতি প্রমাণ করে ।

যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে।
অর্থাৎ যা দেখা যায় না, শোনা যায় না এবং অংগ প্রত্যংগ দ্বারা অনুভব করা যায় না, তার প্রতি ঈমান আনে। ফলে ইন্দ্রিয়ের বাধা তাদের আত্মা এবং যে মহান শক্তি দ্বারা এসব আত্মা ও এই সৃষ্টি জগত অস্তিত্ব লাভ করেছে তার মাঝে আড়াল হয়ে দাঁড়াতে পারে না। অনুরূপভাবে, ইন্দ্রিয়ের বাধা তাদের আত্মা এবং সকল ইন্দ্রিয়াতীত শক্তি, বন্ধু ও তত্ত্বের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে না।

অদৃশ্যে বিশ্বাস এমন একটি জিনিস, যা অর্জন করার পর মানুষ পশুত্বের স্তর অতিক্রম করে মনুষত্ত্বের স্তরে উন্নীত হয়। এই দুটি স্তরের মাঝে ব্যবধান অনেক। পশু তার পশু-ইন্দ্রিয় দ্বারা যা অনুভব করে, তার বাইরে কিছুই উপলব্ধি করে না। পক্ষান্তরে মানুষ এ কথা বোঝে যে, পশু ইন্দ্ৰিয় বা পশু ইন্দ্ৰিয় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির আওতায় যে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ পরিমন্ডল বিরাজ করে, তার তুলনায় সৃষ্টি জগত অনেক বড় ও বিশাল। এটা আসলে মানুষের চিন্তা ও কল্পনা জগতে একটা সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করে। এ দ্বারা সে গোটা সৃষ্টি জগত, নিজ সত্তার এবং এই বিশ্বজগতে ক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর প্রকৃত রহস্য উপলব্ধি করতে পারে। বিশ্বজগত ও বিশ্বজগতের অন্তরালে বিরাজমান ক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনাকেও সে অনুভব করতে পারে। মানুষের পার্থিব জীবনেও তা সদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। যে ব্যক্তি নিছক নিজের ইন্দ্রিয়ানুভূতির আওতাধীন সীমিত পরিসরে জীবন যাপন করে, তার অবস্থা সেই ব্যক্তির মত হতে পারে না, যে স্বীয় অন্তদৃষ্টি ও সূক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা পরিদৃষ্ট বৃহত্তর জগতে অবস্থান করে এবং স্বীয় অন্তরাত্মা দ্বারা গভীরভাবে তার প্রতিধ্বনি ও ইশারা ইংগিত অনুধাবন করে। সে বুঝতে পারে যে, তার এই সীমিত জগতের পরিসর সময় ও স্থানের বিচারে তার চেয়ে অনেক বেশী প্রশস্ত ও ব্যাপক। সে এ কথাও বুঝতে পারে যে, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সৃষ্টিজগতের বাইরে সৃষ্টিজগতের চেয়ে বড় এবং তা থেকেই সে অস্তিত্ব লাভ করেছে। সেই মহাসত্য হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহর সত্তা, যাকে চক্ষু দিয়ে দেখাও যায় না এবং বিবেক বুদ্ধি দিয়ে সঠিকভাবে উপলব্ধিও করা যায় না।

এই মহান সত্তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার জন্য মানুষের চিন্তা শক্তিকে সৃষ্টি করা হয়নি। তাঁকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতাও এই ব্যক্তি মানুষকে দেয়া হয়নি, আর চিন্তাশক্তিকে এ কাজে ব্যয় করে কোনো লাভও নেই। বরঞ্চ এ কাজে ব্যয় করলে চিন্তাশক্তি ছিন্ন ভিন্ন ও ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তার চিন্তা শক্তিকে এই নিষ্প্রয়োজন কাজে নিয়োজিত করা থেকে রক্ষা করা হয়েছে। বস্তুত মানুষকে যে চিন্তা শক্তি দান করা হয়েছে, তা শুধু পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করার জন্যই দেয়া হয়েছে। তাই বলা যায়, মানুষের বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি প্রধানত নিকটতর পার্থিব জীবনের ব্যাপারেই দায়ী। এই নিকটবর্তী বাস্তব জীবনের তত্ত্বাবধান করা তাকে গভীরভাবে ও সর্বাত্মকভাবে পর্যবেক্ষণ করা, তাঁর বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজ করা ও উৎপাদন করা এবং পার্থিব জীবনকে উন্নত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করা তার দায়িত্বের আওতাভুক্ত। তবে এ দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে সেই আত্মিক শক্তির সম্মতি ও সমর্থন ক্রমে, যা প্রত্যক্ষভাবে বিশ্বজগত তার স্রষ্টার সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে, আর যে অদৃশ্য জগত তার বিবেকের আওতা বহির্ভূত, সেই অদৃশ্য জগত সংক্রান্ত জ্ঞানের যেটুকু তার অজানা, তা নিয়ে মাথা ঘামানো পরিত্যাগ করতে হবে। পৃথিবীর জীবন ও তার পরিবেশের প্রভাব দ্বারা সীমিত বিবেক বুদ্ধি দ্বারা অপার্থিব ও ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়গুলোকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত প্রজ্ঞা ও খোলা অন্তর্দৃষ্টির সাহায্য ছাড়া বুঝার চেষ্টা এবং অদৃশ্য জ্ঞানের যে অংশ বিবেকের আওতা বহির্ভূত, তাকে বুদ্ধি বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা প্রথমত ব্যর্থ, দ্বিতীয়ত, নিরর্থক ও বৃথা প্রয়াস মাত্র। ব্যর্থ এ জন্য যে, এই চেষ্টায় যে হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়, তাকে এই উদ্দেশ্যে বানানো হয়নি। আর বৃথা এই জন্য যে, এ ধরনের চেষ্টা মানুষের বোধশক্তির বিনাশ ও অপচয় ঘটায়। কেননা এই বিবেক বা বোধশক্তি এই কাজের জন্য সৃজিত নয়। মানুষের বিবেক যখন এই স্বতসিদ্ধ প্রথম সত্যটি মেনে নেয় যে, সসীম কখনো অসীমকে হৃদয়ংগম করতে পারে না, তখন নিজের যুক্তির প্রতি সম্মান দেখানোর খাতিরেই তাকে এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হতে হয় যে, অসীমকে উপলব্ধি করা তার পক্ষে অসম্ভব । সেই সাথে তাকে এ কথাও মেনে নিতে হয় যে, অজানাকে সে জানেনা বা বুঝে না বলে অদৃশ্যের গোপন জগতে সে জিনিসের অস্তিত্বই নেই একথা বলা যায় না। তাই উচিত হলো, অদৃশ্য ও ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়কে বিবেক বৃদ্ধির কাছে নয়, অন্য কোনো হাতিয়ারের কাছে সমর্পণ করতে হবে। এই জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হবে দৃশ্য অদৃশ্য এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব কিছু | যার মুঠোর ভেতরে সেই অসীম জ্ঞান ও অফুরন্ত প্রজ্ঞার অধিকারী মহান আল্লাহর কাছ থেকে। বিবেকের এই স্বতসিদ্ধ যুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন একমাত্র মোমেনরই কৃতিত্ব এবং মোত্তাকী তথা পরহেযগার লোকদের অন্যতম সদগুণ।

   
   
পাশবিকতার স্তর থেকে ঊর্ধে আরোহণে মানুষের সিঁড়ি হচ্ছে অদৃশ্যে বিশ্বাস। এখান থেকেই মানুষ ও পশুর জীবন পথ আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু অতীতের বস্তুবাদীদের মতো এ যুগের বস্তুবাদীরাও মানুষকে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে চায়। তাদেরকে পশুত্বের জগতে নিয়ে যেতে চায়, যেখানে ইন্দ্রিয়াতীত জিনিসের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। আর এ না করাটাকেই তারা 'প্রগতি' নামে আখ্যায়িত করে। অথচ এটা হচ্ছে অধোপতি। মহান আল্লাহ তায়ালা আপন মোমেন বান্দাদেরকে এই অধোগতি থেকে রক্ষা করেছেন। তাই 'অদৃশ্যে বিশ্বাস' নামক গুণে তাদেরকে গুণান্বিত ও বৈশিষ্টমণ্ডিত করেছেন। আল্লাহর এই নেয়ামতের জন্য আমরা তাঁর শোকরিয়া জানাই । আর অধোগতি তাদের জন্যই নির্ধারিত হোক, যারা অধোপতনই কামনা করে।

এবং নামায কায়েম করে
নামাযের মধ্য দিয়ে তারা এই আল্লাহর এবাদাত ও আনুগত্যের বহিপ্রকাশ ঘটায়। এর দ্বারা তারা বিভিন্ন বন্ধু ও ব্যক্তির পূজার ঊর্ধে ওঠে। অসীম শক্তিমান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দিকে মুখ ফেরায় এবং কোনো বান্দার সামনে নয় বরং শুধুমাত্র আল্লাহর সামনে মাথা নোয়ায়। আর যে ব্যক্তি খালেছ মনে আল্লাহর জন্য সেজদা করে এবং দিবারাত্র এভাবে তাঁর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে সে বুঝতে পারে যে সে স্বয়ং আল্লাহর সাথে অটুট সম্পর্ক ও নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। তাই সে পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণাদি সংগ্রহের চাইতে অনেক উচ্চতর ও মহত্তর লক্ষ্য অর্জনে ব্যাপৃত হয়। সে স্বয়ং স্রষ্টার সাথে সংযোগ রক্ষা করে বিধায় নিজেকে অন্যান্য সৃষ্টির চেয়ে শক্তিশালী মনে করে আর এসবই হচ্ছে বিবেকের শক্তির উৎস। এগুলো তাকওয়া তথা সংযম ও পরহেযগারীরও উৎস এবং ব্যক্তিত্ব গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এভাবে নামায মোমেনের চিন্তা-চেতনা ও আচরণকে সর্বতোভাবে আল্লাহমুখী বানিয়ে দেয়।

আর আমি তাদেরকে যা দান করেছি তা থেকে দান করে
তারা প্রথমেই স্বীকার করে নেয় যে, তাদের ধন সম্পদ যা কিছু আছে তা তাদেরকে প্রদত্ত আল্লাহর সম্পদ, তাদের নিজেদের সৃষ্টি করা সম্পদ নয়। আর এই স্বীকৃতি থেকে সৃষ্টি হয় আল্লাহর দুর্বল ও অভাবী বান্দাদের প্রতি বদান্যতা, আল্লাহর পরিবার হিসাবে আখ্যায়িত গোটা সৃষ্টিজগতের সাথে সংহতি ও একাত্ত্বতা এবং মানবীয় সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের চেতনা, আর এই সকল জিনিসের প্রকৃত তাৎপর্য ফুটে ওঠে হিংসাবিদ্বেষ থেকে আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে, আর বদান্যতা ও দানশীলতা দ্বারা প্রবৃত্তির শুদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়েও এ বিষয়টি ফুটে ওঠে। এই স্বীকৃতি মানব জীবনকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবর্তে সহযোগিতা ও সহ অবস্থানের ময়দানে পরিণত করে, দুর্বল ও অক্ষমকে নিরাপত্তা দান করে এবং নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসভার পরিবর্তে সহযোগিতা ও সহ অবস্থানের ময়দানে পরিণত করে, দুর্বল ও অক্ষমকে নিরাপত্তা দান করে এবং নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার পরিবর্তে স্নেহ প্রীতি দয়া ও মমতার পরিবেশে তাদের জীবন যাপন নিশ্চিত করে।

“ইনফাক” তথা দান করা বলতে যাকাত ও সদকাকে বুঝায়। জনকল্যাণে যা কিছুই ব্যয় করা হয়, তার সবই এর আওতাভুক্ত। যাকাত ফরয হবার আগেই সাধারণ দান-সদকার বিধান প্রবর্তিত হয়েছিলো। পরে যাকাত একটা স্বতন্ত্র বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু সাধারণ দান-সদকাও এর পাশাপাশি চালু থাকে। রসূল (স.) বলেছেন, 'মানুষের ধন-সম্পদে যাকাত ছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। সূরা বাকারার উপরোক্ত আয়াত যাকাত ফরয হওয়ার আগেই অবতীর্ণ হয়েছিলো। তাই এই আয়াতে যাবতীয় দান-সদকা অন্তর্ভুক্ত এবং আয়াতে সে কথাই বুঝানো হয়েছে।

আর যারা তোমার ওপর এবং তোমার পূর্বে নাযিলকরা ওহীর ওপর ঈমান রাখে।
এটা মুসলিম উম্মাহর যথোপযুক্ত গুণ। মুসলিম উম্মাহ হচ্ছে মানব জাতির প্রথম অভ্যুদয়কাল থেকেই আসমানী আকীদা-বিশ্বাস ও নবুওয়তের উত্তরাধিকারী, ঈমান ও নবুওয়তের ঐতিহ্যবাহী অমূল্য সম্পদের সংরক্ষক এবং কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে বিচরণকারী সকল যুগের মোমেনদের বিশাল কাফেলার তারা নেতা ও পথ প্রদর্শক। আর এই গুণ বৈশিষ্টের বদৌলতে তারা মানব জাতির বৃহত্তর ঐক্যে বিশ্বাসী, সকল নবীর প্রতি সমভাবে শ্রদ্ধাশীল এবং সমগ্র মানব জাতির একই মারুদে আস্থাশীল । এ গুণটির অধিকারী হওয়ায় মোমেনদের অন্তরাত্মা বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের | বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও গোঁড়ামি থেকে মুক্ত থাকে, যতক্ষণ সে সঠিক পথে চলতে থাকে। এই গুণের ধারকরা এ কথা বুঝতে পেরে পরম পরিতৃপ্ত ও আশ্বস্ত থাকে যে, আল্লাহ তায়ালা সকল যুগের ও সকল প্রজন্মের মানব জাতির রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। একই ধর্ম ও একই পথ নির্দেশিকা দিয়ে ক্রমাগতভাবে নবী ও রসূলদের প্রেরণের মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই চিরন্তন তত্ত্বাবধানের সাক্ষর রেখেছেন। উক্ত গুণ বৈশিষ্টের ধারক বলেহ মুসলিম উম্মাহ্ এমন এক আদর্শে সমুজ্জল, যা যুগ-যুগান্তরের শত আবর্তনেও অটল ও অবিচল থাকে, নিকষ কালো অন্ধকারে নিকদর্শক নক্ষত্র যেমন স্থির নিশ্চল থাকে এবং সঠিক অবস্থাও মূলত ভাই ।

আর তারা আখেরাতেও সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী
এটা হচ্ছে আল্লাহভীরুদের সর্বশেষ বৈশিষ্ট। এ বৈশিষ্টটি ইহকালকে পরকালের সাথে যুক্ত করে দেয়। এটি কর্মকে কর্মফলের সাথে এবং সূচনাকে পরিণতির সাথে সমন্বিত করে। এ বৈশিষ্টটি মানুষকে এই চেতনা দান করে যে, সে নিরর্থক বৃদ্ধা ও নিষ্ফল সৃষ্টি নয়, তাকে তার | কর্মফল না দিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে না এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারালয় তার অপেক্ষায় রয়েছে। এই আশ্বাস এই জন্য দেয়া হয়, যেন তার মন প্রশান্তি লাভ করে ও নিশ্চিন্ত হয়, সৎকর্মের দিকে ধাবিত হয় এবং আল্লাহর ন্যায় বিচার ও করুণার প্রতি আস্থাশীল হয়।

যারা ইন্দ্রিয়ের সীমিত গণ্ডির মধ্যে বসবাস করে এবং যারা বিশাল সৃষ্টি জগতের প্রশস্ত অংগনে অবস্থান করে, আখেরাত বিশ্বাস হচ্ছে উক্ত দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী সীমারেখা। যারা দুনিয়ার জীবনকেই সব কিছু মনে করে, আর যারা দুনিয়ার জীবনকে একটি পরীক্ষার জায়গা মনে করে এবং সীমিত ও সংকীর্ণ এই পার্থিব জীবনের অপর পারেই প্রকৃত জীবন বিরাজ করছে বলে বিশ্বাস করে উক্ত দুই ধরনের মানুষের মধ্যে এই আখেরাত বিশ্বাসটাই আসলে বিভক্তি রেখা টেনে দেয়।
   
উল্লেখিত গুণ ও বৈশিষ্ট কয়টির প্রত্যেকটিই মানুষের জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য এগুলো মোত্তাকী বা সৎ লোকদের গুণ বৈশিষ্ট। এই গুণ বৈশিষ্টগুলোর মাঝে পূর্ণ সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিরাজমান। আখেরাত বিশ্বাসই এই গুণ বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে পরিপূর্ণ ও সুসমন্বিত ঐক্য গড়ে তোলে। বস্তুত তাকওয়া হলো বিবেকের সচেতনতা, তাকওয়া হলো চেতনার এমন একটি অবস্থার নাম, যা থেকে চিন্তা ও কর্মের উন্মেষ ঘটে, যার সাহায্যে মনের বিভিন্ন আবেগ ও বাহ্যিক অংগ প্রত্যংগের বিভিন্ন তৎপরতার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যা গোপন ও প্রকাশ্যে আল্লাহর | সাথে মানুষের প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন করে এবং যার সাহায্য পেয়ে মানবাত্মা মানুষের আরো নিকবর্তী ও ঘনিষ্ঠ হয়। ফলে আত্মার সাথে দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের আড়াল ঘুচে যায়, দূরত্ব হ্রাস পায় এবং জানা ও অজানা সব এসে এক জায়গায় মিলিত হয়। যখন আত্মা ঘনিষ্ঠ হয় এবং যাহের ও বাতেন (গোপন ও প্রকাশ্য) এর পর্দা অপসৃত হয় তখন গায়েব তথা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আসল গায়েবের সাথে আত্মার সম্মিলন, পরিতৃপ্তি লাভ এবং পর্দা অপসারণের স্বাভাবিক ফল হিসাবেই দেখা দেয়। তাকওয়া ও গায়েবের প্রতি ঈমানের সাথে সাথে আল্লাহর মনোনীত পন্থায় এবং আল্লাহ তায়ালা ও তার বান্দার মধ্যে সংযোগ সূত্র হিসাবে তাঁর এবাদাত করা, আল্লাহর | দানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এবং দরিদ্রের প্রতি ভ্রাতৃত্বের মনোভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে, নিজ সম্পদের একাংশ দান করা, অতীতের সকল মোমেন জাতিসমূহের প্রতি বিবেকের ঔদার্য প্রদর্শন এবং প্রত্যেক নবীর নবুওয়ত ও মোমেনের সাথে আত্মীয়সূলভ সম্পর্কের অনুভূতি ও আখেরাতের প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস এসব বৈশিষ্ট মিলিত হয়ে তৎকালীন মদীনার মুসলিম দলের নিখুঁত ছবি তুলে ধরে। সে দলটি ছিলো ইসলামের দিকে প্রথম ধাবিত হওয়া আনসার ও মোহাজেরদের দ্বারা গঠিত। এসব গুণ বৈশিষ্টে সমৃদ্ধ হয়ে সে দলটি হয়ে উঠেছিলো এক অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ দল । এই ঈমানী উপাদানটি তার মধ্যে যথার্থই মূর্ত হয়ে উঠেছিলো, তাই আল্লাহ তায়ালা এই দলের দ্বারা পৃথিবীতে ও সমগ্র মানব জাতির জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী সংঘটিত করেছেন। এরই প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে,

মোত্তাকীদের সফলতা

তারাই তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে পাওয়া তারা সরল সঠিক পথে আছে এবং তারাই সফলকাম।

এভাবেই তারা সরল সঠিক পথ পেয়েছে, এভাবেই সফলকাম হয়েছে। হেদায়াত ও সাফল্য লাভের পথ হচ্ছে উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত ও নির্দেশিত ঈমানী গুণাবলী অর্জনের পথ।

'আর যারা (এ বিষয়গুলোকে) অস্বীকার করে, তাদের তুমি (পরকালের কথা বলে) সাবধান করো আর না করো (কার্যত) উভয়টাই (তাদের জন্যে) সমান, এরা কখনো ঈমান আনবে না । (এভাবে কুফরী করার কারণে) আল্লাহ তায়ালা তাদের মন মগ্য ও শ্রবণ শক্তির ওপর সিল মেরে দিয়েছেন। (আসলে এদের দৃষ্টিশক্তির ওপরও) আবরণ পড়ে আছে। এই ধরনের লোকদের জন্যে কষ্টদায়ক এক ভীষণ শাস্তি রয়েছে।' (আয়াত ৬-৭ )





****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url