তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন - ৮ || সূরা বাকারার সংক্ষিপ্ত আলোচনা || সূরা বাকারাহ’র সূচনা ও সমাপ্তির সাদৃশ্য ||




কোরআনের মোজেযা

কোরআনের একটা চিরস্থায়ী মোযেজা এই যে, বনী ইসরাঈলের যে চরিত্র বৈশিষ্টের বিবরণ সে দিয়েছে সেটা তাদের সর্বকালের সকল বংশধরদেরই চিরন্তন চরিত্র বৈশিষ্ট। এটা ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেও যেমন ছিলো, ইসলামের পরেও আমাদের এ যুগ পর্যন্ত রয়েছে। এ কারণে কোরআনে হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর আমলে তাদেরকে ঠিক এমনভাবে সম্বোধন করা হয়েছে | যেন তারা স্বয়ং হযরত মূসা (আ.) ও তাঁর উত্তরসূরী নবীদের আমলেরই লোক। অতীতের ইসরাঈলী ও সমসাময়িক ইসরাঈলীদেরকে কোরআন একই বংশধর রূপে বিবেচনা করেছে, কেননা সমসাময়িক ইহুদীদের বৈশিষ্ট ও ভূমিকা অবিকল তাদের পূর্ব পুরুষদের মতই, আর ইসলাম ও পার্থিব জগত সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভংগী কালের বিরাট ব্যবধান সত্ত্বেও অভিন্ন। আলোচ্য সূরায় হযরত মূসার সময়কার ইহুদীদের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে করতে সহসা মদীনার ইহুদীদের এবং এই উভয় বংশধরের মধ্যবর্তী অন্যান্য সময়কার ইহুদীদের প্রসঙ্গ আলোচনায় যে দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়, তার কারণ এটাই। সে কারণে কোরআনের বক্তব্য ও ভাষ চিরন্তন ও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। কার্যত, সে মুসলিম জাতির আজকের নীতি ও তাদের প্রতি ইহুদীদের দৃষ্টিভংগি ও আচরণ নিয়েই বক্তব্য রেখেছে। ইহুদীরা ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী আন্দোলনকে আজ যে চোখে দেখছে আগামী কাল যে চোখে দেখবে এবং অতীতে যে চোখে দেখে এসেছে, তার পূর্ণ বিবরণ দিয়েছে, এ জন্যে কোরআনের অপরিবর্তনীয় বক্তব্যকে মুসলিম জাতির প্রতি চিরন্তন হুঁশিয়ারী হিসেবে গন্য করতে হবে। সে হুঁশিয়ারী মুসলিম জাতির সেই চিরস্থায়ী শত্রুদের বিরুদ্ধে যারা মুসলমানদের পূর্বপুরুষদের সাথে এ যুগের মতই চক্রান্ত ও প্রতারণার মাধ্যমে লড়েছে, লড়েছে রকমারি আকার-আকৃতি অথচ অভিন্ন প্রকৃতির যুদ্ধের মাধ্যমে। 
   

মুসলিম উম্মার পুনর্গঠন

ইহুদীদের এই চরিত্র বৈশিষ্ট বর্ণনা এবং মুসলমানদেরকে তাদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকতে বলার সাথে সাথে এ সূরায় মুসলমানদেরকে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। কেননা বনী ইসরাঈল অনেক আগে থেকেই সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং সর্বশেষে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার পথ রোধ করতে সচেষ্ট হয়েছে।

আগেই বলেছি যে, হিজরতের অব্যবহিত পর ইসলামী আন্দোলন যে শ্রেণীর মানুষের সম্মুখীন হয়েছিলো, তাদের বর্ণনা দিয়েই সূরা বাকারা শুরু হয়েছে। এ প্রসংগে ইহুদী নেতাদের শয়তানরূপে অভিহিত করে তাদের চরিত্র বৈশিষ্টের বিস্তারিত বিবরণও দেয়া হয়েছে। বস্তুত, মদীনার ইসলামী আন্দোলনের গতিরোধ করতে এই জাতী বিভিন্ন ভূমিকায় সক্রিয় থেকেছে। ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গোটা ইতিহাস জুড়েই এই শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। অতপর সুরা বাকারা তার প্রধান দু'টো আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলোচনার গতি শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। এর বক্তব্যের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মাঝেও একটা একক সুর যে ধ্বনিত হয়েছে এবং তাতে করে সূরার একটা বিশিষ্টতা যে ফুটে উঠেছে তা সুস্পষ্ট।

নিষ্ঠাবান মুসলমান (মোত্তাকীন), অবিশ্বাসী (কাফের) এবং কপট ও বর্ণচোরা মুসলমান তথা ছদ্মবেশী কাফের (মোনাফেক), এই তিন শ্রেণীর লোক সম্পর্কে সূরায় শুরুতেই আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনা প্রসংগেই কুচক্রী ইহুদী নেতাদের সম্পর্কেও বক্তব্য রাখা হয়েছে। এরপরই সমগ্র মানব জাতির কাছে আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করা এবং তাঁর রসূলের ওপর নাযিল করা কেতাবের প্রতি ঈমান আনার জন্যে উদাত্ত আহ্বান জানান হয়েছে। যারা আল্লাহর এই কেতাবের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সন্দিহান তাদেরকে কোরআনের অনুরূপ একটা সূরা রচনা করার জন্যে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে। অতপর কাফেদেরকে দোযখের হুমকি এবং মোমেনদের বেহেশতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এই পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, কাফেরদের আচরণে কোরআন বিস্ময় প্রকাশ করেছে। কোরআন বলছে-

'তোমরা আল্লাহকে কিভাবে অস্বীকার করবে? অথচ তোমরা প্রথম মৃত ছিলে তিনিই তোমাদের জীবন দিয়েছেন, তিনিই তোমাদের আবার মৃত্যু দেবেন। (সর্বশেষে) তিনিই আবার তোমাদের জীবন দান করবেন এবং এভাবে তোমাদের একদিন তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি এই পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (ব্যবহারের জন্যে তৈরী করেছেন। অতপর তিনি আসমানের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং সাত আসমান তৈরীর কাজকে সুষম করলেন, তিনি সবকিছু সম্পর্কেই সম্যক অবগত আছেন।' (আয়াত ২৮-২৯)

এখানে মানব জাতির জন্যে সমগ্র জগতের যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি করার কথা প্রসংগে প্রথম মানব আদম (আ.)-কে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি করে পাঠানোর ইতিবৃত্ত আলোচিত হয়েছে।

এই ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে মানব জাতির সাথে শয়তানের চিরন্তন বৈরীতার কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সব শেষে আল্লাহর বিধানকে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়ার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের শপথ পাঠ সম্পন্ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে,

'আমি (তাদের) বললাম, তোমরা সবাই (এবার) এখান থেকে নেমে যাও। (নতুন গন্তব্যস্থলে যাওয়ার পর), অবশ্যই সেখানে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে (জীবন বিধান সম্পর্কিত কিছু ) হেদায়াত আসবে। অতপর যে আমার সেই বিধান মেনে চলবে তাদের কোনো ভয় নেই, তাদের কোনো উৎকণ্ঠা (কিংবা) চিন্তারও কারণ থাকবে না। আর (যারা আমার বিধানকে অস্বীকার করবে এবং আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে (লাগামহীন জীবনযাপন করবে) তারা অবশ্যই জাহান্নামের বাসিন্দা হবে, তারা সেখানে থাকবে চিরদিন।' (আয়াত ৩৮-৩৯)

এর পরবর্তী অংশে বনী ইসরাঈল সম্পর্কে এক দীর্ঘ পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমি কিছু কিছু আভাস ইংগিত দিয়ে এসেছি। সে পর্যালোচনায় হযরত মূসার আমল থেকেই যে সব ভুল ভ্রান্তি, বিকৃতি শঠতা ও কপটতার তারা আশ্রয় নিয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দেবার সাথে মাঝে মাঝে তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনকে গ্রহণ করার দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের কেতাবের সমর্থক কোরআনকে মেনে নিতে বলা হয়েছে। সমগ্র 'আলিফ লাম' পারা জুড়ে এ পর্যালোচনা পরিব্যাপ্ত। এ পর্যালোচনা থেকেই বনী ইসরাঈল ইসলাম এবং তার রসূল ও কেতাবকে কিভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তার একটা পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠে। এ থেকে জানা যায় যে, তারাই ছিলো ইসলামকে জেনে শুনে অস্বীকারকারী প্রথম দল। তারা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করতো। তা পালন করতো না। তারা আল্লাহর কালামকে বুঝে বিকৃত করতো।

নিজেদেরকে মোমেন বলে যাহির করে তারা মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিতো, কিন্তু নিজেরা পরস্পরে দেখা হলেই পরস্পরকে সাবধান করে দিতো যে মহানবীর নবুওতের সত্যতা সম্পর্কে তারা যে তথ্য জানে তা যেন কেউ মুসলমানদেরকে না জানায়। মুসলমানরা কুফরী অবস্থায় ফিরে যাক এটাই তারা কামনা করতো। এ উদ্দেশ্যে তারা ও খৃষ্টানরা দাবী করতো যে, আসল ও সঠিক পথের অনুসারী তো হচ্ছে তারাই। আর তাদেরকে বাদ দিয়ে হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর কাছে ওহী নিয়ে আসেন বলে জিবরাঈলের প্রতিও তারা আক্রোশ প্রকাশ করতে কসুর করতো না। মুসলমানদের কোনো কল্যাণ হওয়াই তারা পছন্দ করতো না এবং সব সময় অপেক্ষায় থাকতো যে, কখন তাদের একটা অঘটন ঘটে। মহানবীর ঘোষিত নির্দেশাবলীতে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টির যে কোনো সুযোগেরই তারা সদ্ব্যবহার করতো, যেমন কেবলা পরিবর্তনের। তারা মোনাফেকদের অনুপ্রেরণা ও কাফেরদের উৎসাহ যোগাতো।

   

এ কারণেই সূরা বাকারায় তাদের এসব অপ-তৎপরতার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা চালানো হয়েছে। হযরত মূসা (আ.) ও তাদের অন্যান্য নবীর প্রতি তাদের সেই ধরনের নীতি ও আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, যে আচরণ তাদের সকল বংশধর সকল যুগেই অব্যাহত রেখেছে এবং তাদেরকে এক অবিচ্ছিন্ন বংশধর এবং অপরিবর্তনীয় ও অশোধনীয় চরিত্র ও প্রকৃতির মানব গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই সমালোচনার উপসংহারে মুসলমানদেরকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, বনী ইসরাঈলের লোকেরা কখনো ঈমান আনবে এ আশা যেন তারা পোষণ না করে। কেননা স্বভাবগতভাবেই তাদের সে ইচ্ছাশক্তি অবলুপ্ত হয়ে গেছে এবং সে যোগ্যতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে। এখানে তাদের একমাত্র সঠিক পথের অনুসারী হওয়ার মুখোশ উন্মোচন করে চূড়ান্ত রায় দেয়া হয়েছে। তারাই হযরত ইবরাহীমের উত্তরাধিকারী, তাদের এই দাবী খন্ডন করে বলা হয়েছে যে, ইবরাহীম (আ.)-এর সত্যিকার অনুসারী হলো তারা যারা তার নীতি ও বিধান মেনে চলে এবং তিনি আল্লাহর সাথে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেই প্রতিজ্ঞার শর্ত পালন করে। সূরায় এ কথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, একদিকে যেমন ইহুদীরা ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করেছে ও আল্লাহর বিধানকে বিকৃত করেছে এবং সেই বিধানের প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় আল্লাহর খেলাফত ব্যবস্থা পুনর্বহালের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং অপরদিকে হযরত মোহাম্মদ (স.) ও তাঁর অনুগামীরা এই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন ও তার বাস্তবায়নের তৎপর হয়েছেন তখন ইবরাহীম (আ.)-এর প্রকৃত উত্তরাধিকার হযরত মোহাম্মদ ও তাঁর অনুগামীদের ওপরই এসে বর্তেছে। সূরায় এ কথাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, হযরত মোহাম্মদ (স.) ও তাঁর অনুগামীদের হাতে খেলাফতের এই উত্তরাধিকার অর্পণ কা'বা শরীফের স্তম্ভ নির্মাণ কালে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ.)-এর দোয়ারই ফলশ্রুতি। সে দোয়া হলো ।

“(তারা আরো বললো,) হে আমাদের মালিক, আমাদের উভয়কেই তুমি তোমার অনুগত মুসলিম বান্দা বানাও। আমাদের পরবর্তী বংশধরদের মাঝ থেকেও তুমি তোমার অনুগত (বান্দা) বানিয়ে দাও। (হে মালিক) তুমি আমাদের তোমার এবাদাতের আনুষ্ঠানিকতাসমূহ দেখিয়ে দাও। (যদি আমরা এতে কোনো ভুলত্রুটি করি, তাহলে) তুমি আমাদের তাওবা কবুল করো, কারণ তুমিই একমাত্র তাওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু। হে আমাদের মালিক; (আমাদের) এই বংশের মধ্যে এদের নিজেদের মাঝ থেকে তুমি এমন একজন রাসূল পাঠাও, যে তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনাবে। তাদেরকে তোমার কেতাবের জ্ঞান শিক্ষা দেবে, উপরন্তু সে তাদের পরিচ্ছন্ন করে দেবে। (হে আল্লাহ, তুমি আমাদের এই দোয়া কবুল করো), কারণ তুমিই শক্তিশালী ও পরম কুশলী।” (আয়াত ১২৮-১২৯)

এই পর্যায়ে এসে মহানবী (স.) ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সংগঠনকে লক্ষ্য করে নতুন নির্দেশাবলী জারী করা শুরু হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বে নিযুক্ত এই সংগঠনটির জীবন যাপনের বুনিয়াদী শিক্ষা দেয়া আরম্ভ হয়েছে এবং সংগঠনের সুনির্দিষ্ট রূপকাঠামো এবং তার চিন্তা ও কর্মের পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়েছে।

ইসলামী সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে নতুন কেবলা নির্ধারণ ছিলো এই পর্যায়ের প্রথম কাজ। সে কেবলা হচ্ছে পবিত্র কা'বা। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ.)-কে এই পবিত্র ঘর নির্মাণের ও তাকে শেরেকের নোংরামী থেকে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর এবাদাতের জন্যে নির্দিষ্ট করতে আদেশ দিয়েছিলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনে মনে এই কেবলার দিকে মুখ ফেরানোর আগ্রহ পোষণ করতেন, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলতেন না।

এরপর মুসলিম সংগঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদানের মধ্য দিয়ে সূরা সামনে অগ্রসর হয়েছে। চিন্তা ও এবাদাতের প্রণালী এবং পারস্পরিক আচরণ ও লেন-দেনের পদ্ধতি এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুসলিম জামায়াতকে এ কথাও বলা হয়েছে যে, আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তারা মৃত নয়; বরং তারা চিরঞ্জীব। ভীতি সন্ত্রাস, ক্ষুধা-দারিদ্র ও আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির উদ্দেশ্য মোমেনের অকল্যাণ সাধন করা নয়, বরং তাকে পরীক্ষা করা। যারা এ সব আপদ বিপদে ধৈর্য ধারণ করে তারা আল্লাহর অফুরন্ত করুণা, দয়া ও হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়। আর শয়তান মানুষকে দারিদ্রের ভয় দেখিয়ে খারাপ কাজের প্ররোচনা দেয় এবং আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের আশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতি দেন । আরো বলা হয়েছে যে, আল্লাহ মোমেনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর কাফেরদের অভিভাবক হলো আল্লাহদ্রোহী শক্তি। তারা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এই সূরায় মোমেনদের জন্যে খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে কিছু হালাল হারামও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ভালো কাজের বাহ্যিক রূপটাই যে মুখ্য নয়, বরং তার অন্তর্নিহিত রূপটাই যে মুখ্য, সে কথাও এতে বলে দেয়া হয়েছে। অভপর কেসাসের বিধান, মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ওসিয়ত বা উইল করা সংক্রান্ত বিধি, রোযা, হজ্জ, বিবাহ, তালাক ও পারিবারিক বিধি, জেহাদের নিয়ম কানুন, সদকা ও সুদ সংক্রান্ত বিধি এবং ধার লেন-দেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধিমালাও এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

প্রাসঙ্গিকভাবে হযরত মূসার পর বনী ইসরাঈলের প্রসঙ্গ ও হযরত ইবরাহীমের কাহিনী আলোচিত হয়েছে। তবে প্রথম পারার পরবর্তী অংশে প্রধানত মুসলিম দলের সাংগঠনিক কাঠামো বিনির্মাণ, সংগঠনকে ইসলামী আদর্শে প্রতিষ্ঠা, আল্লাহর বিধান ও পদ্ধতি অনুসারে খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, তার অস্তিত্বের জন্যে অপরিহার্য সুনির্দিষ্ট আদর্শিক ও চিন্তাগত পদ্ধতি নির্ণয় এবং এত বড় গুরুদায়িত্ব বহনের জন্যে যিনি তাকে মনোনীত করেছেন সেই আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক দৃঢ় করা ও ঘনিষ্ঠ করার জন্যে প্রস্তুত করাই সূরার প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সূরা বাকারাহ’র সূচনা ও সমাপ্তির সাদৃশ্য
সব শেষে দেখতে পাই সূরার উপসংহারে এর প্রারম্ভিক বিষয়েরই পুনরুক্তি করা হয়েছে। এ পর্যায়ে ইসলামের বুনিয়াদী আকীদা ও দর্শন এবং সকল কেতাব, সকল নবী ও অদৃশ্যের প্রতি মুসলিম জাতির ঈমান আনার ও আনুগত্য করার অপরিহার্যতা বর্ণনা করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে,

'আল্লাহর রসূল সেই বিষয়ের ওপরই ঈমান এনেছে, যা তার ওপর তার মালিকের পক্ষ নাযিল করা হয়েছে, আর যারা রসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারাও সবাই সেই একই বিষয়ের ওপর ঈমান এনেছে। এদের সবাই ............... (হে মোমেন ব্যক্তিরা এই বলে তোমরা দোয়া করো) হে আমাদের মালিক, যদি আমরা কিছু ভুলে যাই, জীবনে চলার পথে কোথায়ও যদি আমরা কোনো ভুল করে বসি, তার জন্যে তুমি আমাদের পাকড়াও করো না, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ওপর যে ধরনের বোঝা তুমি চাপিয়েছিলে, তা আমাদের ওপরও চাপিয়ো না, হে আমাদের মালিক, যে বোঝা বইবার শক্তি সামর্থ আমাদের নেই, তা তুমি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ো না, তুমি আমাদের ওপর মেহেরবানী করো, | আমাদের তুমি মাফ করে দাও, আমাদের ওপর তুমি দয়া করো, তুমিই আমাদের (একমাত্র) আশ্রয় দাতা বন্ধু, অবিশ্বাসী কাফেরদের মোকাবেলায় তুমি আমাদের সাহায্য করো।' (আয়াত ২৮৫-২৮৬)

এভাবে সুরাটির শেষাংশ ও প্রথমাংশের মধ্যে চমৎকার সমন্বয় ও সাযুজ্য স্থাপিত হয়েছে। গোটা সূরার সকল আলোচ্য বিষয় মোমেনদের ও ঈমানের দু'টি গুণ বৈশিষ্টের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। 

১-২৯ আয়াত তথা প্রথম তিন রুকু জুড়ে বিস্তৃত এই অংশ হচ্ছে কোরআনের এই বিশালকায় ও সর্ববৃহৎ সূরার সূচনা পর্ব। ইহুদীরা ছাড়া অন্য যেসব গোত্র মদীনায় ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে ছিলো এ আয়াতগুলোতে আমরা তাদের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট দেখতে পাই। ইহুদীদের সম্পর্কে অবশ্য এখানে একটি ক্ষুদ্র ইংগিত দেয়া হয়েছে। বস্তুত এই ইংগিতটুকুই যথেষ্ট। তাদেরকে 'মোনাফেকদের প্ররোচক শয়তান' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই আখ্যার ভেতরে তাদের বহুসংখ্যক নিকৃষ্ট স্বভাবের আভাস দেয়া হয়েছে এবং তাদের আসল ভূমিকার দিকেও ইংগিত করা হয়েছে। একটু পরেই এ ব্যাপারে বিশদ বিবরণ আসছে।

এই বৈশিষ্টসমূহ চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে কোরআনের বর্ণনাভংগীর বিচিত্র মহিমা ফুটে উঠেছে। শব্দ এখানে রেখা ও বর্ণের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। বস্তুত শব্দের মাধ্যমেই চিত্র অংকন দ্রুততর হয়ে থাকে। তারপর এসব চিত্র অতি দ্রুত গতিতে সচল হয়ে ওঠে, মনে হয় যেন জীবনের রংগমালায় তা সদা আলোড়িত। এখানে সূরার শুরুতে অল্প কয়েকটি শব্দে ও বাক্যে তিন ধরনের মানুষের চিত্র ফুটে উঠেছে। এর প্রতিটি শ্রেণী মানব জাতির বিরাট বিরাট গোষ্ঠীর জীবন্ত নমুনাস্বরূপ। এ নমুনা শুধু জীবন্ত নয় বরং আসল ও মৌলিক, যুগে যুগে ও দেশে দেশে তা বারংবার আবির্ভূত হয়ে থাকে। ফলে মানুষ, যে দেশে ও যে যুগেই জন্ম লাভ করুক না কেন, এই তিন শ্রেণীর বাইরে যেতে পারে না। এটাই হচ্ছে কোরআনের মোজেযা।

   

উক্ত সংক্ষিপ্ত শব্দে ও মুষ্টিমেয় কয়টি আয়াতে এই চিত্র পরিপূর্ণ রূপে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। সে চিত্র শুধু যে স্পষ্ট, তাই নয়, বরং জীবনের স্পন্দনেও স্পন্দিত এবং তার বৈশিষ্টসমূহ চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট। ফলে যত দীর্ঘ ও বিশদ বিবরণ দেয়া হোক না কেন, এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনার মত এত দ্রুত বোধগম্য, এত সাজানো গোছানো এবং এত শ্রুতিমধুর বর্ণনা আর হয় না।

আয়াতগুলোতে এই তিন ধরনের মানুষের ছবি তুলে ধরার পর সকল মানুষকে প্রথম শ্রেণীর | মানুষে পরিণত হবার আহ্বান জানানো হয়েছে। সকলকে আহ্বান জানানো হয়েছে এক আল্লাহর এবাদাত ও আনুগত্যের যিনি একমাত্র স্রষ্টা ও একমাত্র জীবিকা দাতা। তাঁর শরীক ও সমকক্ষ কেউ নেই। আর যারা রসূল (স.)-এর রেসালাত সম্পর্কে এবং তাঁর কাছে কেতাব নাযিল হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে, তাদেরকে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে যে, তারা পারলে এর কোনো সূরার মতো একটি সূরা রচনা করে আনুক। আর তা না পারলে সন্দেহ পোষণের জন্য তাদেরকে কঠোর ও ভয়ংকর শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। অতপর মোমেনদেরকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এবং তাদের জন্য যে চিরস্থায়ী সুখের উপকরণ প্রস্তুত রয়েছে তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এরপর যেসব ইহুদী মোনাফেক কোরআনে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক বিভিন্ন উদাহরণ পেশ করায় নাক সিটকাতো এবং এই অজুহাতে কোরআন আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হওয়া গ্রন্থ কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাতো, তাদের জবাব দেয়া হয়েছে। তাদেরকে এই মর্মে সাবধান করা হয়েছে যে, যে আল্লাহ তায়ালা মৃতকে জীবিত ও জীবিতকে মৃত করেন, যিনি সকল সৃষ্টির স্রষ্টা সর্ব জগতের দক্ষ পরিচালক, বিশ্ব নিখিলের কোথায় কি আছে সে সম্পর্কে সম্যক অবগত পৃথিবীর সকল সৃষ্টিকে একমাত্র মানুষের কল্যাণার্থে সৃষ্টি করে মানুষকে অনুগৃহীত করেছেন এবং এই বিশাল সাম্রাজ্যে তাকে নিজের খলীফা ও প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন। সেই আল্লাহকে তারা কিভাবে অস্বীকার করে এবং কিভাবে তাঁর অবাধ্য হয়?

সূরা বাকারার প্রথম তিন রুকুর প্রধান প্রধান বক্তব্যের এই হলো সংক্ষিপ্ত সার। এবার আমরা এই সংক্ষিপ্তসারকে একটু বিশদভাবে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো ।







******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.





এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url