মা’আরেফুল কোরআন - ৫৭ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৬৩-১৬৪ || আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর মহা ক্ষমতার বর্ণনা






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৬৩-১৬৪


 وَ اِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الرَّحۡمٰنُ الرَّحِیۡمُ ﴿۱۶۳ اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّهَارِ وَ الۡفُلۡکِ الَّتِیۡ تَجۡرِیۡ فِی الۡبَحۡرِ بِمَا یَنۡفَعُ النَّاسَ وَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ مِنَ السَّمَآءِ مِنۡ مَّآءٍ فَاَحۡیَا بِهِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِهَا وَ بَثَّ فِیۡهَا مِنۡ کُلِّ دَآبَّۃٍ ۪ وَّ تَصۡرِیۡفِ الرِّیٰحِ وَ السَّحَابِ الۡمُسَخَّرِ بَیۡنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ ﴿۱۶۴ 

সূরা আল-বাকারাহ ১৬৩-১৬৪ নং আয়াতের অর্থ

(১৬৩) আর তোমাদের উপাস্য, একই মাত্র উপাস্য। তিনি ছাড়া মহা-করুণাময় দয়ালু কেউ নেই! 
(১৬৪) নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাসমূহের চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ্ তা'আলা আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেছেন, তচ্ছ্বারা মৃত-যমীনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব রকম জীবজন্তু। আর আবহাওয়ার পরিবর্তনে এবং মেঘমালায় যা তাঁরই হুকুমের অধীনে আসমান ও যমীনের মাঝে বিচরণ করে—নিশ্চয়ই সে সমস্ত বিষয়ের মাঝে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য। 

সূরা আল-বাকারাহ ১৬৩-১৬৪ নং আয়াতের পূর্বাপর যোগসূত্র

   
যোগ্যসূত্র
আরবের মুশরিকরা যখন নিজেদের বিশ্বাসের পরিপন্থী আয়াত وَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ শুনল, তখন বিস্মিত হয়ে বলতে লাগল, সারা বিশ্বেরই কি একজন মাত্র উপাস্য হতে পারে ? যদি এ দাবি যথার্থ হয়ে থাকে, তবে তার কোন প্রমাণ উপস্থাপন করা উচিত। সুতরাং আল্লাহ্ তা’আলা তারই প্রমাণ পেশ করেছেন।

সূরা আল-বাকারাহ ১৬৩-১৬৪ নং আয়াতের তাফসীর

তাফসীরের সার-সংক্ষেপ
আর যে (সত্তা) তোমাদের সবার উপাস্য হওয়ার যোগ্য, তিনিই তো একমাত্র (ও প্রকৃত) উপাস্য। তাঁকে ছাড়া উপাসনার যোগ্য কেউ নেই। তিনিই মহান করুণাময় দয়ালু। (তাছাড়া আর কেউই এসব গুণ-বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ নেই। আর গুণ-বৈশিষ্ট্যের পরাকাষ্ঠা ব্যতীত উপাস্য হওয়ার অধিকারও বাতিল হয়ে যায়। কাজেই, একমাত্র ও প্রকৃত উপাস্য আল্লাহ্ ব্যতীত আর কেউ উপাসনার যোগ্য নয়)। নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে একের পর এক করে রাত-দিনের আগমনে এবং সাগর-সমুদ্রের বুকে (মানুষের জন্য কল্যাণকর বিষয় নিয়ে) জাহাজসমূহের চলাচল, মেঘের পানিতে, যাকে আল্লাহ্ তা’আলা আকাশ থেকে বর্ষণ করে থাকেন এবং অতঃপর সে (পানির) দ্বারা যমীনকে উর্বর করেন, তার শুকিয়ে যাওয়ার পর (অর্থাৎ তাতে শস্যরাজি উৎপন্ন করেন) এবং (সে শস্যের দ্বারা) সর্বপ্রকার জীবকে এই (যমীনে) ছড়িয়ে দিয়েছেন। (কারণ, জীব-জন্তুর জীবন ও বংশবৃদ্ধি এই খাদ্যশস্যের দৌলতে বাস্তবায়িত হয়) আর আবহাওয়ার (দিক ও অবস্থার) বিবর্তন (অর্থাৎ কখনও পুবাল কখনও পশ্চিমা) মেঘমালার অস্তিত্বে যা আসমান-যমীনের মাঝে বিদ্যমান থাকে, এ সমস্ত বিষয়েই (তওহীদ বা আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদের) প্রমাণ রয়েছে সে সমস্ত লোকের জন্য যারা (কোন বিষয় প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে নিজেদের) সুষ্ঠু বিবেকের অধিকারী।

সূরা আল-বাকারাহ ১৬৩-১৬৪ নং আয়াতের আনুষঙ্গিক বিষয়

তওহীদের মর্মার্থ

وَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ- বিভিন্নভাবেই আল্লাহ্ তা’আলার তওহীদ বা একত্ববাদ সপ্রমাণিত রয়েছে। উদাহরণত তিনি একক, সমগ্র বিশ্বের বুকে তাঁর না কোন তুলনা আছে, না তাঁর কোন সমকক্ষ আছে। সুতরাং একক উপাস্য হওয়ার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।
দ্বিতীয়ত--উপাস্য হওয়ার অধিকারেও তিনি একক। অর্থাৎ তাঁকে ছাড়া অন্য আর কেউই ইবাদতের যোগ্য নয়।
তৃতীয়ত--সত্তার দিক দিয়ে তিনি একক। অর্থাৎ অংশ-বিশিষ্ট নন। তিনি অংশ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে পবিত্র। তাঁর বিভক্তি কিংবা ব্যবচ্ছেদ হতে পারে না।
চতুর্থত--তিনি তাঁর আদি ও অনন্ত সত্তার দিক দিয়েও একক। তিনি তখনও বিদ্যমান ছিলেন, যখন অন্য কোন কিছুই ছিল না এবং তখনও বিদ্যমান থাকবেন, যখন কোন কিছুই থাকবে না। অতএব, তিনিই একমাত্র সত্তা যাঁকে واحد বা ’এক’ বলা যেতে পারে। وَاحِدٌ শব্দটিতে উল্লিখিত যাবতীয় দিকের একত্বই বিদ্যমান রয়েছে। -(জাসসাস)
তারপর আল্লাহ্ তা’আলার প্রকৃত একত্ব সম্পর্কে বাস্তব লক্ষণ ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে, যা জ্ঞানী-নিজ্ঞান নির্বিশেষে যে কেউই বুঝতে পারে। আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের চিরাচরিত বিবর্তন তাঁরই ক্ষমতার পরিপূর্ণতার এবং একত্ববাদের প্রকৃত প্রমাণ। এসব বিষয়ের সৃষ্টি ও অবস্থিতিতে অপর কারও হাত নেই।
তেমনিভাবে পানির উপর নৌকা ও জাহাজ তথা জলযানসমূহের চলাচলও একটি বিরাট প্রমাণ। পানিকে আল্লাহ্ তা’আলা এমন এক তরল পদার্থ করে সৃষ্টি করেছেন যে, এমন তরল ও প্রবহমান হওয়া সত্ত্বেও তার পিঠের উপর লক্ষ লক্ষ মণ ওজনবিশিষ্ট বিশালকায় জাহাজ বিরাট ওজনের চাপ নিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলাচল করে। তদুপরি এগুলোকে গতিশীল করে তোলার জন্য বাতাসের গতি ও নিতান্ত রহস্যপূর্ণভাবে সে গতির পরিবর্তন করতে থাকা প্রভৃতি বিষয়ও এদিকেই ইঙ্গিত করে যে, এগুলোর সৃষ্টি ও পরিচালনার পিছনে এক মহাজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞ সত্তা বিদ্যমান। পানীয় পদার্থগুলো তরল না হলে যেমন এ কাজটি সম্ভব হতো না, তেমনি বাতাসের মাঝে গতি সৃষ্টি না হলেও জাহাজ চলতে পারতো না; এগুলোর পক্ষে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করাও সম্ভব হতো না। এ বিষয়টিই কোরআনে হাকীম এভাবে উল্লেখ করেছেঃ
إِنْ يَشَأْ يُسْكِنِ الرِّيحَ فَيَظْلَلْنَ رَوَاكِدَ عَلَى ظَهْرِهِ 
অর্থাৎ “আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে বাতাসের গতিকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন এবং তখন এ সমস্ত জাহাজ সাগরপৃষ্ঠে ‘ঠায়’ দাঁড়িয়ে যাবে।" 
بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ 
শব্দের দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সামুদ্রিক জাহাজের মাধ্যমে এক দেশের মালামাল অন্য দেশে আমদানী-রফতানী করার মাঝেও মানুষের জন্য এত বিপুল কল্যাণ নিহিত রয়েছে, যা গণনাও করা যায় না। আর এ উপকারিতার ভিত্তিতেই যুগে যুগে, দেশে দেশে নতুন নতুন বাণিজ্য পন্থা উদ্ভাবিত হয়েছে। 
এমনিভাবে আকাশ থেকে এভাবে পানিকে বিন্দু বিন্দু করে বর্ষণ করা, যাতে কোন কিছুর ক্ষতি সাধিত না হয়। যদি এ পানি প্লাবনের আকারে আসত, তাহলে কোন মানুষ, জীবজন্তু কিংবা অন্যান্য জিনিসপত্র কিছুই থাকত না। অতঃপর পানি বর্ষণের পর ভূ-পৃষ্ঠে তাকে সংরক্ষণ করা মানুষের সাধ্যায়ত্ত ব্যাপার ছিল না। যদি তাদেরকে বলা হতো, তোমাদের সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনমত ছ’মাসের প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণ করে রাখ, তাহলে তারা পৃথক পৃথকভাবে কি সে ব্যবস্থা করতে পারত ? আর কোনক্রমে রেখে দিলেও সেগুলোকে পচন কিংবা বিনষ্ট হওয়ার হাত থেকে কেমন করে রক্ষা করত ? কিন্তু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন নিজেই সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছেঃ 
فَأَسْكَنَّاهُ فِي الْأَرْضِ وَإِنَّا عَلَى ذَهَابٍ بِهِ لَقَادِرُونَ 
অর্থাৎ—“আমি পানিকে ভূমিতে ধারণ করিয়েছি যদিও বৃষ্টির পানি পড়ার পর তাকে প্রবাহিত করেই নিঃশেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল।” 
কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা পানিকে বিশ্বাসী মানুষ ও জীব-জন্তুর জন্য কোথাও উন্মুক্ত খাদ-খন্দে সংরক্ষিত করেছেন, আবার কোথাও ভূমিতে বিস্তৃত বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে ভূমির ভেতরে পৌঁছে দিয়েছেন। তারপর এমন এক ফল্গুধারা সমগ্র যমীনে বিছিয়ে দিয়েছেন, যাতে মানুষ যে কোন খানে খনন করে পানি বের করে নিতে পারে। আবার এই পানিরই একটা অংশকে জমাট বাঁধা সাগর বানিয়ে তুষার আকারে পাহাড়ের চূড়ায় চাপিয়ে দিয়েছেন যা পতিত কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একান্ত সংরক্ষিত। অথচ ধীরে ধীরে গলে প্রাকৃতিক ঝরনাধারার নহরের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সারকথা- উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলার পরিপূর্ণ ক্ষমতার কয়েকটি বিকাশস্থলের বর্ণনার মাধ্যমে তওহীদ বা একত্ববাদ প্রমাণ করা হয়েছে। তফসীরকারক আলেমগণ এ সমস্ত বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। (জাসসাস, কুরতুবী প্রভৃতি তফসীরগ্রন্থ দ্রষ্টব্য)। 
যোগসূত্রঃ উল্লিখিত আয়াতে তওহীদের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছিল। অতঃপর আলোচ্য আয়াতে মুশরিকদের ভ্রান্তি এবং তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে।






******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url