মা’আরেফুল কোরআন - ৪৭ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৪২ || নামাযের কেবলার পরিবর্তন






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৪২



 سَیَقُوۡلُ السُّفَهَآءُ مِنَ النَّاسِ مَا وَلّٰىهُمۡ عَنۡ قِبۡلَتِهِمُ الَّتِیۡ کَانُوۡا عَلَیۡهَا ؕ قُلۡ لِّلّٰهِ الۡمَشۡرِقُ وَ الۡمَغۡرِبُ ؕ یَهۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۱۴۲

(১৪২) এখন নির্বোধরা বলবে, কিসে মুসলমানদের ফিরিয়ে দিল তাদের ঐ কেবলা থেকে, যার উপর তারা ছিল ? আপনি বলুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা সরল পথে চালান ।

তফসীরের সার-সংক্ষেপ
(কা’বাগৃহ নামাযের কেবলা নির্দিষ্ট হওয়ার ফলে ইহুদীদের কেবলা পরিত্যক্ত হয়। এটি তাদের মনঃপূত না হওয়ার কারণে) এখন (এই) নির্বোধরা অবশ্যই বলবে, (মুসলমানদেরকে) তাদের পূর্বেকার কেবলা থেকে যেদিকে তারা মুখ করত (অর্থাৎ বায়তুল মোকাদ্দাস) কিসে (অন্যদিকে) ফিরিয়ে দিল ? আপনি (উত্তরে) বলুন, পূর্ব (হউক) পশ্চিম (হউক, সব দিকই) আল্লাহর (মালিকানাধীন। তিনি মালিক-সুলভ ক্ষমতার দ্বারা যেদিককে ইচ্ছা নির্দিষ্ট করেন। এ ব্যাপারে কারণ জিজ্ঞেস করার অধিকার কারও নেই। শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে এরূপ বিশ্বাসই হল সরল পথ। কিন্তু কারও কারও এ পথ অবলম্বন করার তওফীক হয় না। তারা অনর্থক কারণ খুঁজে বেড়ায়। তবে) আল্লাহ্ তা’আলা (নিজ কৃপায়) যাকে ইচ্ছা সোজা পথ বলে দেন।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
আলোচ্য আয়াতে কেবলা পরিবর্তন সম্পর্কে বিরোধিতাকারীদের আপত্তি বর্ণনা করে তার জওয়াব দেওয়া হয়েছে। আপত্তি ও জওয়াবের পূর্বে কেবলার স্বরূপ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে আপত্তি ও তার জওয়াবটি সহজে বোঝা যাবে।

নামাযের কেবলার পরিবর্তন

কেবলার শাব্দিক অর্থ মুখ করার দিক। প্রত্যেক ইবাদতে মু’মিনের মুখ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর দিকেই থাকে। আল্লাহর পবিত্র সত্তা পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণের বন্ধন থেকে মুক্ত, তিনি কোন বিশেষ দিকে অবস্থান করেন না। ফলে কোন ইবাদতকারী যদি যে দিকে ইচ্ছা সেদিকেই মুখ করত কিংবা একই ব্যক্তি এক সময় এক দিকে অন্য সময় অন্যদিকে মুখ করত, তবে তাও স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী হতো না।

কিন্তু অপর একটি রহস্যের কারণে সমস্ত ইবাদতকারীর মুখ একদিকেই হওয়া উচিত। রহস্যটি এই—ইবাদত বিভিন্ন প্রকার। কিছু ইবাদত ব্যক্তিগত, আর কিছু ইবাদত সমষ্টিগত । আল্লাহর যিকির, রোযা প্রভৃতি ব্যক্তিগত ইবাদত। এগুলো নির্জনে ও গোপনভাবে সম্পাদন করতে হয়। নামায ও হজ্ব সমষ্টিগত ইবাদত। এগুলো সঙ্ঘবদ্ধভাবে এবং প্রকাশ্যে সম্পাদন করতে হয়। সমষ্টিগত ইবাদতের বেলায় ইবাদতের সাথে সাথে মুসলমানদের সংঘবদ্ধ জীবনের রীতি-নীতিও শিক্ষা দেওয়া লক্ষ্য থাকে। এটা সবারই জানা যে, সংঘবদ্ধ জীবনব্যবস্থার প্রধান মৌলনীতি হচ্ছে বহু ব্যক্তিভিত্তিক ঐক্য ও একাত্মতা। এ ঐক্য যত দৃঢ় ও মজবুত হবে, সংঘবদ্ধ জীবন-ব্যবস্থাও ততই শক্ত ও সুদৃঢ় হবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও বিচ্ছিন্নতা সংঘবদ্ধ জীবনব্যবস্থার পক্ষে বিষতুল্য। এরপর ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু কি হবে, তা নির্ধারণ করার ব্যাপারে বিভিন্ন যুগের মানুষ বিভিন্ন মত পোষণ করেছে। কোন কোন সম্প্রদায় বংশকে কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করেছে, কেউ দেশ ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে এবং কেউ বর্ণ ও ভাষাকে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে সাব্যস্ত করেছে।

কিন্তু আল্লাহর ধর্ম এবং পয়গম্বরদের শরীয়ত এ সব ইখতিয়ার-বহির্ভূত বিষয়কে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু করার যোগ্য মনে করেনি। প্রকৃতপক্ষে এসব বিষয় সমগ্র মানব জাতিকে একই কেন্দ্রে সমবেত করতে সমর্থও নয়। বরং চিন্তা করলে দেখা যায়, এ জাতীয় ঐক্য প্রকৃতপক্ষে মানব জাতিকে বহুধা-বিভক্ত করে দেয় এবং পারস্পরিক সংঘর্ষ ও মতানৈক্যই সৃষ্টি করে বেশি।

বিশ্বের সকল পয়গম্বরের ধর্ম ইসলাম ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ঐক্যকেই ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করেছে এবং কোটি কোটি প্রভুর ইবাদতে বিভক্ত বিশ্বকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতি আহবান জানিয়েছে। বলা বাহুল্য, এ কেন্দ্রবিন্দুতেই পূর্ব ও পশ্চিম, ভূত ও ভবিষ্যতের মানবমণ্ডলী একত্রিত হতে পারে। অতঃপর এ ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ঐক্যকে বাস্তবে রূপায়ণ এবং শক্তিদানের উদ্দেশ্যে তৎসঙ্গে কিছু বাহ্যিক ঐক্যও যোগ করা হয়েছে। কিন্তু এসব বাহ্যিক ঐক্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। তা এই যে, ঐক্যের বিষয়বস্তু কার্যগত ইচ্ছাধীন হতে হবে—যাতে সমগ্র মানব জাতি স্বেচ্ছায় তা অবলম্বন করে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হতে পারে। বংশ, দেশ, ভাষা, বর্ণ প্রভৃতি ঐচ্ছিক বিষয় নয়। যে ব্যক্তি এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, সে অন্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করতে পারে না। যে ব্যক্তি পাকিস্তানে অথবা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, সে বিলেতে অথবা আফ্রিকায় জন্মগ্রহণে সক্ষম নয়। যে ব্যক্তি কৃষ্ণকায়, সে যেমন স্বেচ্ছায় শ্বেতকায় হতে পারে না, ঠিক তেমনিভাবে একজন শ্বেতকায় ব্যক্তিও স্বেচ্ছায় কৃষ্ণকায় হতে পারে না।

এমন বিষয়কে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করা হলে মানবতা অপরিহার্যভাবে শতধা, এমনকি সহস্রভাবে বিভক্ত হয়ে পড়বে। এ কারণে সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত এসব বিষয়কে ইসলাম পরিপূর্ণ সম্মান দান করলেও, মানব ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু হতে দেয়নি। কারণ, এতে মানবমণ্ডলী শতধা বিভক্ত হয়ে যাবে। তবে ইসলাম ইচ্ছাধীন বিষয়সমূহে চিন্তাগত ঐক্যের সাথে সাথে কার্যগত ও আকারগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখেছে। এতেও এমন বিষয়কে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা স্বেচ্ছায় অবলম্বন করা প্রত্যেক পুরুষ-স্ত্রী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহুরে গ্রাম্য, ধনী-দরিদ্রের পক্ষে সমান সহজ হয়। কাজেই ইসলামী শরীয়ত সারা বিশ্বের মানুষকে পোশাক, বাসস্থান ও পানাহারের ব্যাপারে কোন এক নিয়মের অধীন করেনি। কারণ, প্রত্যেক দেশের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে প্রয়োজনাদিও ভিন্ন ভিন্ন। এমতাবস্থায় সবাইকে একই ধরনের পোশাক ও ইউনিফর্মের অধীন করে দিলে নানা অসুবিধা দেখা দেবে। যদি ন্যূনতম ইউনিফর্মেরও অধীন করে দেওয়া হয়, তাতেও মানবিক সমতার প্রতি অবিচার করা হবে এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত উৎকৃষ্ট পোশাক ও বস্ত্রের অবমাননা করা হবে। পক্ষান্তরে আরও বেশি দামের ইউনিফর্মের অধীন করে দেওয়া হলে দরিদ্র ও নিঃস্ব লোকদের পক্ষে অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

এ কারণে ইসলামী শরীয়ত মুসলমানদের জন্য কোন বিশেষ পোশাক বা ইউনিফর্ম নির্দিষ্ট করেনি, বরং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সব পন্থা ও পোশাক প্রচলিত ছিল, সবগুলো যাচাই করে অপব্যয়, অযথা, গর্ব ও বিজাতীয় অনুকরণভিত্তিক পন্থা ও পোশাক-পরিচ্ছদকে নিষিদ্ধ করেছে। অবশিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এমনি বিষয়াদিকে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করা হয়েছে, যা ইচ্ছাধীন, সহজলভ্য ও সস্তা। উদাহরণত জামাতের নামাযে কাতারবন্দী হওয়া, ইমামের ওঠা-বসার পূর্ণ অনুকরণ, হজ্জের সময় পোশাক ও অবস্থানের অভিন্নতা ইত্যাদি।

এমনিভাবে কেবলার ঐক্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর পবিত্র সত্তা যদিও যাবতীয় দিকের বন্ধন থেকে মুক্ত, তাঁর জন্য সবদিকই সমান, তথাপি নামাযে সমষ্টিগত ঐক্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববাসীর মুখমণ্ডল একই দিকে নিবদ্ধ থাকা একটি উত্তম, সহজ ও স্বাভাবিক ঐক্য পদ্ধতি। এতে সমগ্র পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণের মানবমণ্ডলী সহজেই একত্রিত হতে পারে। এখন সমগ্র বিশ্বের মুখ করার দিক কোন্‌টি হবে এর মীমাংসা মানুষের হাতে ছেড়ে দিলে তাও বিরাট মতানৈক্য এবং কলহের কারণ হয়ে যাবে। এ কারণে এর মীমাংসা আল্লাহ্ পক্ষ থেকে হওয়াই উচিত। হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের পৃথিবীতে অবতরণের পূর্বেই ফেরেশতাদের দ্বারা কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। আদম ও আদম সন্তানদের জন্য সর্বপ্রথম কেবলা কা’বাগৃহকেই সাব্যস্ত করা হয়।

إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِينَ

-মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ নির্মিত হয় তা মক্কায় অবস্থিত এবং এ গৃহ বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়েত ও বরকতের উৎস।

নূহ্ (আ) পর্যন্ত সবার কেবলাই ছিল এ কা’বাগৃহ। নূহের আমলে সংঘটিত মহাপ্লাবনের সময় সমগ্র দুনিয়া নিমজ্জিত হয়ে যায় এবং কা’বাগৃহের দেয়াল বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তারপর হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ) আল্লাহর নির্দেশে কা’বাগৃহ পুনঃনির্মাণ করেন। কা‘বাগৃহই ছিল তাঁর এবং তাঁর উম্মতের কেবলা। অতঃপর বনী ইসরাঈলের পয়গম্বরগণের জন্য বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা সাব্যস্ত করা হয়। আবুল আলীয়া বলেনঃ পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণ বায়তুল মোকাদ্দাসে নামায পড়ার সময় এমনভাবে দাঁড়াতেন, যাতে বায়তুল মোকাদ্দাসের ’ছখরা’ ও কা’বাগৃহ—উভয়টিই সামনে থাকে।-(কুরতুবী)

শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর উপর নামায ফরয করা হলে কোন কোন আলেমের মতে প্রথমদিকে কা’বাগৃহকেই তাঁর কেবলা সাব্যস্ত করা হয়। মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় পৌঁছার পর, কোন কোন রেওয়ায়েত অনুযায়ী হিজরতের কিছুদিন পূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা স্থির করার নির্দেশ আসে। সহীহ্ বোখারীর রেওয়ায়েত অনুযায়ী মহানবী (সা) ষোল-সতের মাস পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করেই নামায পড়েন। মসজিদে নববীর যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়তেন, সেখানে অদ্যাবধি চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে। (কুরতুবী)

আল্লাহর নির্দেশ পালন ক্ষেত্রে মহানবী (সা) ছিলেন আপাদমস্তক আনুগত্যের প্রতীক। সেমতে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়া অব্যাহত রাখলেও তাঁর স্বভাবগত আগ্রহ ও মনের বাসনা ছিল এই যে, আদম ও ইবরাহীম (আ)-এর কেবলাকেই পুনরায় তাঁর কেবলা সাব্যস্ত করা হোক। প্রিয়জনের মনের বাসনা পূর্ণ করাই আল্লাহ্ তা’আলার চিরাচরিত রীতি।

কবির ভাষায়ঃ

        “তুমি যেমন চাইবে আল্লাহ্ তেমনি চাইবেন,

         পরহেযগারের ইচ্ছা আল্লাহ্ স্মরণ করেন।"

মহানবী (সা)-এর অন্তরেও দৃঢ় আস্থা ছিল যে, তাঁর বাসনা অপূর্ণ থাকবে না। তাই ওহীর অপেক্ষায় তিনি বারবার আকাশের দিকে তাকাতেন। এ প্রসঙ্গেই কোরআনে বলা হয়েছেঃ

قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ

“-আপনার বারবার আকাশের দিকে তাকানো আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। আমি আপনাকে আপনার পছন্দমত কেবলার দিকে অবশ্যই ফিরিয়ে দেব। সেমতে ভবিষ্যতে আপনি নামাযে মসজিদে হারাম তথা কা’বাগৃহের দিকে মুখ করুন।" এ আয়াতে রসূলুল্লাহ (সা)-এর মনের বাসনা প্রকাশ করে তা পূর্ণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হয়েছে।

নামাযে হুবহু কা'বার দিকে মুখ করাই জরুরী নয় কা'বা যেদিকে অবস্থিত, সেদিকে মুখ করাই যথেষ্ট 
এখানে একটি ফিকহ্-বিষয়ক সূক্ষ্ম তত্ত্ব উল্লেখযোগ্য। আয়াতে কা’বা অথবা বায়তুল্লাহ্ বলার পরিবর্তে ’মসজিদে হারাম’ বলা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, দূরবর্তী দেশসমূহে বসবাসকারীদের পক্ষে হুবহু কা’বাগৃহ বরাবর দাঁড়ানো জরুরী নয়; বরং পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণের মধ্য থেকে যে দিকটিতে কা’বা অবস্থিত সেদিকে মুখ করলেই যথেষ্ট হবে। তবে যে ব্যক্তি মসজিদে হারামে উপস্থিত রয়েছে কিংবা নিকটস্থ কোন স্থান বা পাহাড় থেকে কা’বা দেখতে পাচ্ছে, তার পক্ষে এমনভাবে দাঁড়ানো জরুরী যাতে কা’বাগৃহ তার চেহারার বরাবরে অবস্থিত থাকে। যদি কা’বাগৃহের কোন অংশ তার চেহারা বরাবরে না পড়ে তবে তার নামায শুদ্ধ হবে না। কা’বাগৃহ যাদের চোখের সামনে নেই এ বিধান তাদের জন্য নয়। তারা কা’বাগৃহ কিংবা মসজিদে হারামের দিকে মুখ করলেই যথেষ্ট।

মোটকথা, হিজরতের ষোল-সতের মাস পর কা’বাগৃহ পুনর্বার মহানবী (সা) ও মুসলমানদের কেবলা নির্ধারিত হয়। এতে ইহুদী এবং কতিপয় মুশরিক ও মুনাফিক প্রশ্ন তুলে বলতে থাকে য, তাদের ধর্মে স্থিতিশীলতা নেই, রোজ রোজ কেবলা পরিবর্তন হতে থাকে ।

কোরআনের আলোচ্য আয়াতে ’নির্বোধরা আপত্তি করে’ শিরোনামে তাদের এ আপত্তিরই উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে আপত্তির যে জওয়াব দেওয়া হয়েছে তাতে তাদের বোকামির নিদর্শন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছেঃ

قُلْ لِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

অর্থাৎ—আপনি বলে দিনঃ পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহ্ তা’আলারই মালিকানাধীন। তিনি যাকে ইচ্ছা সোজা-সরল পথ প্রদর্শন করেন।

এতে কেবলামুখী হওয়ার তাৎপর্য বিধৃত হয়েছে যে, কা’বা এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দান করে আল্লাহ্ তা’আলাই এ দু’টিকে পর্যায়ক্রমে কেবলা বানিয়েছেন, এছাড়া কা’বা কিংবা বায়তুল মোকাদ্দাসের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে এ দু’টিকে বাদ দিয়ে কোন তৃতীয় বা চতুর্থ বস্তুকেও কেবলা সাব্যস্ত করতে পারতেন। বস্তুত যা কেবলা বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে, সেদিকে মুখ করলে যে সওয়াব হয়, তার একমাত্র কারণ আল্লাহর আনুগত্য। এ আনুগত্যই কা’বার পুনর্নির্মাতা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ধর্মের মৌলিক বিষয়। এ বিষয়টি অন্য এক আয়াতে আরও সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছেঃ

لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ .

অর্থাৎ—পশ্চিম দিক অথবা পূর্বদিকে মুখ করার মধ্যে স্বতন্ত্র কোন সওয়াব বা পুণ্য নেই, কিন্তু আল্লাহর উপর ঈমান ও আনুগত্যের মধ্যেই পুণ্য নিহিত রয়েছে। অন্য এক আয়াতে বলেনঃ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী যেদিকেই মুখ করবে, সেদিকেই আল্লাহর মনোযোগ আকৃষ্ট পাবে।

এসব আয়াতে কেবলা অথবা কেবলামুখী হওয়ার তাৎপর্য ফুটিয়ে তুলে বলা হয়েছে যে, এসব স্থানের নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নেই; বরং কেবলা হিসেবে আল্লাহ্ তা’আলা যে এগুলোকে মনোনীত করছেন, এটাই সে স্থানের শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র কারণ। এ দু’দিকে মুখ করার মধ্যে সওয়াবের কারণও আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। মহানবী (সা)-এর বেলায় কেবলা পরিবর্তনের রহস্য সম্ভবত এই যে, কার্যক্ষেত্রে মানুষ জেনে নিক যে, কেবলা কোন পূজনীয় মূর্তি বিগ্রহ নয়; বরং আসল বিষয় হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ। এই নির্দেশ যখন বায়তুল মোকাদ্দাস সম্পর্কে অবতীর্ণ হলো তখন তারা এদিকেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। পরবর্তী আয়াতে স্বয়ং কোরআন এ রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেঃ

 وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنْتَ عَلَيْهَا إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّنْ يَنْقَلِبُ عَلَى عَقِبَيْهِ

অর্থাৎ—আপনি পূর্বে যে কেবলার দিকে ছিলেন তাকে কেবলা করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল-কে রসূলের অনুসরণ করে এবং কে পেছনে সরে যায়, তা প্রকাশ করা।

কেবলার তাৎপর্য বর্ণনার মধ্যে নির্বোধ আপত্তিকারীদেরও জওয়াব হয়ে গেছে। তারা কেবলার পরিবর্তনকে ইসলামী মূলনীতির পরিপন্থী মনে করত এবং এজন্য মুসলমানদের ভর্ৎসনা করত । পরিশেষে বলা হয়েছেঃ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ এতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নির্দেশের জন্য কোমর বেঁধে প্রস্তুত থাকাই হলো সরল পথ। আল্লাহর কৃপায় মুসলমানরা এ সরল পথ অর্জন করেছে।

হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত রয়েছে, রসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, তিনটি বিষয়ের কারণে আহলে কিতাবরা মুসলমানদের সাথে সর্বাধিক হিংসা করে। প্রথমত, ইবাদতের জন্য সপ্তাহে একদিন নির্দিষ্ট করার নির্দেশ সব উম্মতকেই দেওয়া হয়েছিল। ইহুদীরা শনিবারকে এবং খৃষ্টানরা রবিবারকে নির্দিষ্ট করে নেয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে সে দিনটি ছিল শুক্রবার, যা মুসলমানদের ভাগে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, পরিবর্তনের পর মুসলমানদের জন্য যে কেবলা নির্ধারিত হয়েছে, অন্য কোন উম্মতের ভাগ্যে তা জোটেনি। তৃতীয়ত, ইমামের পেছনে ‘আমীন’ বলা। এ তিনটি বিষয় একমাত্র মুসলমানরাই প্রাপ্ত হয়েছে। আহলে কিতাবরা এগুলো থেকে বঞ্চিত। -(মসনদে আহমদ)






Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url