কুরআনের গল্পঃ বাদশা শাদীদ ও বাদশা শাদ্দাদ এবং শাদ্দাদের বেহেস্ত নির্মাণের কাহিনী





শাদ্দাদের বেহেস্ত নির্মাণ এবং আল্লাহ পাকের গজব

শাদ্দাদের বেহেস্ত নির্মাণের কাহিনী কুরআন ও হাদিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাহিনীগুলোর একটি। বাদশা শাদ্দাদ ছিলেন বাদশা আদের পুত্র। সে ছিল হযরত হুদ (আঃ) এর কওমের একজন বাদশা। হযরত হুদ (আঃ) শাদ্দাদকে আল্লাহর একত্ববাদ তথা ইসলামের দাওয়াত দিলেন। শাদ্দাদ আল্লাহর নবী হযরত হুদ (আঃ) এর কাছে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, আমি যদি তোমার আল্লাহর প্রতি ঈমান আনি তাহলে তোমার আল্লাহ আমাকে কি দিবেন?’ হুদ (আঃ) বললেন, ‘তাহলে আল্লাহ তোমাকে বেহেস্ত দিবেন।’ শাদ্দাদ তাচ্ছিল্যতার সাথে হযরত হুদ (আঃ) কে প্রত্যাখান করল। সে বলল, ‘আমিই অনুরূপ একটি বেহেস্ত বানিয়ে নিব’।


হযরত হুদ (আ)-এর ইনতিকাল


হযরত হুদ (আঃ)-এর ওফাত ও তাঁর কবর সম্পর্কে আরবের অধিবাসীরা বিভিন্ন দাবী করে আসছে। যেমন হাজরামাউতের অধিবাসীদের দাবী হল যে আদ জাতির ধ্বংসের পর হযরত হুদ (আঃ) হিজরত করে হাজরামাউত শহরে এসেছিলেন এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বরমুত উপত্যকার সন্নিকটে হাজরামাউত শহরের পূর্ব পার্শ্বে তারীম নামক একটি শহর আছে। এ শহরের অদূরে তিনি সমাহিত হন। হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হাজরামাউতে (বালুর লাল পাহাড়) নামক একটি স্থান আছে। উক্ত স্থানে হযরত হুদ (আ)-এর কবর রয়েছে। তাঁর শিয়রের পার্শ্বে একটি ঝাউ গাছ স্থানটির শোভাবর্ধন করছে। অপরদিকে ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের দাবী হল যে, তিনি ফিলিস্তিনে সমাহিত হয়েছেন। তারা সেখানে তাঁর সমাধি নির্মাণ করেছে। তার স্মরণার্থে সেখানে মাহফিলও করে থাকে। কিন্তু হাজরামাউত সম্পর্কে যে বর্ণনা সেটাই অধিক সহীহ ও বিবেক সম্মত। কেননা, আদ জাতির বসতি তো হাজরামাউতের কাছেই ছিল। সুতরাং আদ সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আশে পাশের কোন এলাকায় বাসবাস করাই যুক্তি সঙ্গত।

   

শাদীদ ও শাদ্দাদের কাহিনী


বাদশাহ আদের দু পত্র ছিল। বড় পুত্রের নাম ছিল শাদীদ এবং ছোট পুত্রের নাম ছিল শাদ্দাদ।

বাদশা শাদীদের কাহিনী

আদের মৃত্যুর পর রাজ প্রথানুসারে জ্যেষ্ঠ পুত্র শাদীদ বাদশাহ হয়ে প্রবল প্রতাপের সাথে সাতশ' বছর পর্যন্ত রাজত্ব করেছিল। সে ছিল কাফের। তবে সে প্রজাদের সুখ-সুবিধার দিকে বিশেষ মনোযোগী ছিল। তার শাসন প্রণালী এমনই ন্যায়নিষ্ঠ ও কড়া ছিল যে, তার রাজ্যে বাঘ-ছাগল একঘাটে পানি পান করত। তার ন্যায় বিচার ও ন্যায়নিষ্ঠ শাসনের কথা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সে যেমন ন্যায়নিষ্ঠ শাসক ছিল, তেমনি জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায়ও তার যশ ও সুখ্যাতি ছিল। তার ন্যায় বিচার এবং সুশাসনের ঘটনাবলি প্রবাদের মত মনে হয়ে থাকে।

বাদশা শাদীদের ন্যয় পরায়ণতার কাহিনী

নিম্নে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এর থেকেই বোঝা যাবে সুশাসনের ফলে দেশের জনসাধারণ কিরূপ সৎ এবং নিঃস্বার্থ হয়ে উঠেছিল এবং সাথে সাথে তাঁর বিচারের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তা ও ন্যয় পরায়ণতা সম্পর্কেও অবিহত হওয়া যাবে।

একবার এক প্রজা অন্য এক প্রজার নিকট একখন্ড জমি বিক্রয় করল। ক্রেতা স্বীয় প্রয়োজনে ক্রয়কৃত জমি খনন করতে গিয়ে ভূগর্ভে অজস্র স্বর্ণ ও রৌপ্য প্রাপ্ত হল। সে তা সম্পূর্ণ জমির পূর্বের মালিকের কাছে নিয়ে বলল, তোমার জমির নিচে এ মাল পাওয়া গেছে গ্রহণ কর জমি বিক্রেতা বলল, এ মাল আমি গ্রহণ করব কেন, এর মালিক তো এখন তুমি। কেননা, আমার বিক্রিত জমির নিচে যা পাওয়া গেছে তার ন্যায়তঃ অধিকার তোমার।

ক্রেতা বলল, তা কি করে হয়? আমি তো কেবল তোমার জমিটুকু খরিদ করেছি। আমার সাথে তো তোমার এমন কথা ছিল না যে, জমির সাথে অন্য কিছুরও আমি অধিকারী হব? 

এভাবে দু'জনের বাধানুবাদের পর কেউই জমির নিম্নস্থ মাল গ্রহণে রাজি হয়নি। অবশেষে তা বাদশাহ শাদীদের দরবারে গিয়ে পৌঁছে। সে দু জনের কথা শুনে অবাক হয়ে ভাবল যে, ধন-সম্পদের প্রতি এরূপ বীতরাগী হওয়া সত্যিই প্রশংসনীয়। সহসা সে ভেবে পেল না যে, কিভাবে এ ঘটনার ফায়সালা করবে। কিন্তু একমূহূর্ত চিন্তা করেই সে একটা সুন্দর বুদ্ধি আবিষ্কার করল। সে উভয়ের নিকট প্রশ্ন করে জানতে পারল যে, তাদের একজনের একটি পুত্র। এবং অন্য জনের একটি কন্যাসন্তান আছে। বাদশা তৎক্ষণাৎ পুত্র-কন্যাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে উক্ত ভূগর্ভস্থ ধন-সম্পদ তাদের স্বামী-স্ত্রী মধ্যে বিতরণ করে দিল। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে তখন তার এ অপূর্ব বুদ্ধিমত্তা এবং সুন্দর বিচারে খুশী হয়ে প্রত্যাবর্তন করল।

হুদ (আঃ) বাদশাহ শাদীদকে হেদায়েতের জন্য বহুবার তার দরবারে যাতায়াত করেছেন কিন্তু বহু সৎগুণ থাকা সত্ত্বেও সে সত্যধর্ম গ্রহণ করল না। শেষ পর্যন্ত বেঈমান অবস্থায় তাকে মৃত্যুবরণ করতে হল।


বাদশা শাদ্দাদের কাহিনী


শাদ্দাদ বাদশাহ শাদীদের প্রধান উজীর ছিল। শাদীদের মৃত্যুর পর সে বাদশাহী তখতে উপবেশন করল। সে বাদশাহী গ্রহণের পর হুদ (আঃ) তাকেও হিদায়াতের চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু শাদ্দাদ বেঈমানীর পথে ভ্রাতা শাদীদ অপেক্ষাও অগ্রগামী ছিল। সে হুদ (আঃ)-এর আহ্বানের প্রতি কোন আমলই দিল না। সে হুদ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলল, তুমি যে বার বার আমাকে তোমার রবের প্রতি ঈমান আনতে বলছ, তার প্রতি ঈমান আনলে সে আমাকে কি দান করবে?


হযরত হুদ (আঃ) বললেন, তাঁর প্রতি ঈমান আনলে বিনিময়ে তিনি তোমাকে অফুরন্ত সুখের নীড় জান্নাত দান করবেন। শাদ্দাদ বলল, তোমার রবের জান্নাতের আমার কোন প্রয়োজন নেই । ঐ রূপ একটি জান্নাত আমি নিজেই বানিয়ে নেব।


শাদ্দাদের বেহেশত নির্মাণের কাহিনী


শাদ্দাদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল আল্লাহর বেহেশতের মত একটি বেহেশত সে দুনিয়াতে নির্মাণ করবে। তার ভাগ্নে জোহাক তাজী তখন এক বিরাট রাজ্যের বাদশাহ ছিল। তদুপরি বাদশাহ জামশিদের বিশাল সম্রাজ্য অধিকার করে সে প্রায় বিশ্ববিজয়ী বাদশাহর মর্যাদাও ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল। বাদশাহ শাদ্দাদ তার দূত মারফত খবর পাঠাল যে, হে আমার ভাগ্নে তোমার রাজ্যে যত স্বর্ণ-রৌপ্য এবং মূল্যবান লাল, মোতি ও জওহেরাত প্রভৃতি আছে, তা সব সংগ্রহ করে আমার দরবারে পাঠিয়ে দেবে ও মেশক আম্বর এবং জাফরানাদি যা কিছু আছে, তাও যেন পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি দুনিয়ায় একটি বিরাট ও অনুপম বেহেশত তৈরি করতে চাই। সুতরাং আমার এ সকল দ্রব্যের একান্তই প্রয়োজন।

ভাগ্নে ছাড়া শাদ্দাদের অনুগত অন্যান্য যে সব রাজা-বাদশাহ ছিল তাদের নিকটও নির্দেশ পাঠাল যে, বাদশাহ শাদ্দাদ বেহেশত তৈরি করবে। সুতরাং তাদের যার যার দেশে যত সোনা ও মনি-মুক্তা, হীরা-জহরত আছে সব যেন সংগ্রহ করে শাদ্দাদের দরবারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকলেই শাদ্দাদের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করল ।

বেহেশতের স্থান নির্বাচনের জন্য সর্বত্র অসংখ্য লোক নিয়োগ করা হল। তারা বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখে অবশেষে আরব সীমান্তে ইয়ামন প্রদেশের একটি স্থানকে বেহেশত নির্মাণের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করল এবং তা শাদ্দাদকে অবহিত করা হল। ঐ স্থানের আয়তন ছিল একশ' চল্লিশ ক্রোশ।

বেহেশত নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন দেশ হতে হাজার হাজার সুদক্ষ কারিগর এসে হাজির হল। তাদের থেকে তিন হাজার সুদক্ষ কারিগর কাজে নিয়োগ করা হল। নির্মাণকার্য হওয়ার পর বাদশাহ শাদ্দাদ তার অধীনস্থ সকল রাজ্যের জনসাধারণের কাছে ঘোষণা করে দিল যে, যার নিকট যে কোন ধরনের স্বর্ণ-রৌপ্য আছে, তা যেন অবিলম্বে বাদশাহের দরবারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ নির্দেশের পরেও যদি কারও কাছে সামান্য স্বর্ণ-রৌপ্যের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। দলে দলে লোক নিযুক্ত করল তল্লাশি কার্য চালাতে

একস্থানে এক বিধবা বৃদ্ধার নাবালিকা কন্যার কণ্ঠে মাত্র চারিআনা রূপার তৈরি একটি অলংকার ছিল। এক তালাশকারীর চোখে পড়ায় সে এ গহনাটি এ বালিকার কণ্ঠ হতে ছিনিয়ে নেয় । দরিদ্র-দুঃখিনী বালিকাটি তার গহনার মায়ায় কেঁদে ধূলায় গড়াগড়ি দিতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে বালিকার বৃদ্ধা মা দুঃখ-বেদনায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাল, হে আমার রব। তুমি সবই অবগত। দুঃখিনীর প্রতি যালিম শাদ্দাদের অত্যাচারের দৃশ্য তোমার অদেখা নয়। তুমি ছাড়া আমাদের ফরিয়াদ শ্রবণ করার আর কেউ নেই। তুমি নিষ্ঠুর বাদশাহ শাব্দাদকে ধ্বংস করে তোমার দুর্বল বান্দাকে রক্ষা কর। বৃদ্ধার আহাযারী করুণ প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে মঞ্জুর হয়েছিল।

এদিকে বাদশাহ শাদ্দাদের বেহেশত নির্মাণে কাজ পুরাদমে চলছে। এ কাজে হাজার হাজার সুদক্ষ রাজমিস্ত্রি-কারিগর লিপ্ত হল। সর্বপ্রথম বিশাল ভূখণ্ডের চতুর্দিকে চল্লিশ গজ নিচ থেকে মর্মর পাথর দ্বারা বেহেশতের প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপন করা হল। তার উপর স্বর্ণ ও রূপা-নির্মিত ইট দ্বারা প্রাচীর নির্মাণ করা হল। প্রাচীরের উপরে জবরজদ এবং জবরজদ পাথরের ভীম ও বর্গার উপরে লাল বর্ণের আলমাছ প্রস্তর দ্বারা ঢালাই করে ছাদ নির্মাণ করা হল। মূল প্রাসাদের ভিতরে অসংখ্য অট্টালিকা সোনা ও রূপা দ্বারা প্রস্তুত ইট দ্বারা তৈরি করা হল। যেমনই বিস্ময়কর তেমনই অভাবনীয় সৌন্দর্য মণ্ডিতও বটে। সে বেহেশতের কথা আল্লাহ পাক স্বয়ং পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন যে, হে মুহাম্মদ! শাদ্দাদ পৃথিবীতে এমন বেহেশত নির্মাণ করেছিল পৃথিবীর আর কোন বাদশাহ কোনদিনই তেমন প্রাসাদ নির্মাণ করতে পারেনি। হে মুহাম্মদ" তুমি তো দেখনি তোমার প্রতিপালক সে বিরাট বিরাট প্রাসাদ নির্মাণকারীদের সাথে কিরণ ব্যবহার করেছেন।

শাদ্দাদের সে বেহেশতের মাঝে নির্মাণ করা হয়েছিল সোনা ও রূপার দ্বারা অপূর্ব বৃক্ষসমূহ। তার শাখা-প্রশাখাগুলো তৈরি হয়েছিল ইয়াকুত পাথর দিয়ে আর পত্রপল্লবসমূহ নির্মাণ হয়েছিল ছঙ্গে জবরজদ দিয়ে। এ বৃক্ষসমূহে মূল্যবান মণি, মুক্তা ও হীরা-জহরতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফল শোভা পাচ্ছিল। বেহেশতে মাটির পরিবর্তে শোভা পাচ্ছিল মেশক আম্বর এবং তার মেঝে তৈরি হয়েছিল মূল্যবান পাথর দিয়ে। এ পাথরসমূহ গাথুনীর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল সুরখীর বদলে মোতি মুক্তা ও চুল্লী পন্থাসমূহ। 

বেহেশতের প্রাঙ্গণ ঢালাই করা হয়েছিল মণি-মুক্তা দিয়ে এবং স্থানে স্থানে পয়ঃপ্রণালী নির্মাণ করে তা দ্বারা সর্বদা মুগ্ধ, শরাব এবং মধু প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বেহেশতের দরজার নিকটে চারটি বিরাট ময়দান তৈরি করে ওতে রং-বেরংয়ের মেওয়াদার বৃক্ষ লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ বৃক্ষগুলো অপূর্ব সুন্দর পরিপক্ক মেওয়াজাত ফল এবং নানাবিধ ফুল শোভা পাচ্ছিল। ময়দানসমূহের প্রত্যেকটিতে লক্ষাধিক সোনার কুরসী স্থাপন করা হয়েছিল। প্রত্যেকটি কুরসীর সামনে একটি করে টেবিল পেতে তাতে বিভিন্ন প্রকারের নিয়ামতসমূহ সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।


শাদ্দাদের জীবনের অবসান


শাদ্দাদ তার তৈরি বেহেশত নামক প্রাসাদে প্রবেশ করার উদ্দেশে হাজার হাজার সৈন্যের একবাহিনী নিয়ে তার দিকে অগ্রসর হল। প্রায় তিন হাজার গজ দূরে এসে তার বাহিনীসহ অবস্থান নিল। সেখান থেকে এবার ভিতর প্রবেশের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল । এমন সময় একটি হরিণের দিকে তার নযর পড়ল। যার পদসমূহ ছিল রূপার, শিংদ্বয় ছিল সোনার আর নয়ন দ্বয় ছিল ইয়াকুতের। শাব্দাদ তার রূপে মুগ্ধ হয়ে শিকার করার লোভে একাই তার পশ্চাদ্ধাবন করল। সে তার সেনাবাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে হঠাৎ করে ভয়ংকর আকৃতি বিশিষ্ট এক অশ্বারোহী তার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বলল, এ সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণের মাধ্যমে কি তোমার নিরাপত্তা মিলবে? শাদ্দাদ এটা শুনে কেঁপে উঠল আর জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? শাদ্দাদের প্রশ্নের জবাবে অশ্বারোহী বলল, আমি মালাকুল মওত। শাদ্দাদ বলল, তুমি এখানে কি চাও? আযরাঈল বলল, তুমি কি এখনও তা অনুভব করতে পার নাই.? আমি তো এখনই তোমার জান কবজ করব। শাদ্দাদ বলল, আমাকে আমার পরম সাধের বেহেশত এক নজর দেখার সুযোগ দাও। আযরাঈল বলল, আল্লাহর বিনা অনুমতিতে আমি তোমাকে এক মুহূর্তও সময় দিতে পারি না। আমার প্রতি নির্দেশ হল এখনই তোমার জান কবজ করা। শাদ্দাদ বলল, তবে আমাকে একটু ঘোড়া হতে নামতে দাও।

আযরাঈল (আ) বললেন- না তুমি যে অবস্থায় আছ সে অবস্থাতেই তোমার জান কবজ করা হবে। আর এটাই আল্লাহর নির্দেশ। তখন শাদ্দাদ ঘোড়া হতে নামবার জন্য তার এক পা যমীনের দিকে বাড়াল। আর এক পা ঘোড়ার রেকাবেই ছিল, তার বাড়িয়ে দেয়া পা অল্পের জন্য বেহেশতের চৌকাঠে ঠেকল না। ঠিক এ অবস্থায়ই আযরাঈল (আঃ) শাদ্দাদের জান দেহপিঞ্জর থেকে বের করে ফেললেন। তার বেহেশত নামের প্রাসাদে প্রবেশের আশা চিরতরে নির্মূল হয়ে গেল।

ইতোমধ্যে আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিব্রাইল এসে এমন প্রচন্ড হাঁক মারল যে, সে প্রচন্ড হাঁকে শাব্দাদের সমস্ত লোক লশকর এবং যানবাহনাদি যা যেখানে ছিল, সকলই মৃত্যু এবং ধ্বংস প্রাপ্ত হল। আর আল্লাহর হুকুমে অসংখ্য ফেরেশতা এসে তখনই শাদ্দাম নির্মিত বেহেশত নামক প্রাসাদ মাটির নিচে লুপ্ত করে দিল।

সাদ্দাদের এ বেহেশত কিয়ামতের পূর্বে কোনদিনই আত্মপ্রকাশ করবে না। এক বর্ণনায় আছে হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর খেলাফত কালে আবদুল্লাহ ইবনে কলব তাঁর উট হারিয়ে ফেলে। বিভিন্ন স্থানে তন্ন তন্ন করে তা তালাশ করতে করতে গিয়ে ইয়ামনের যে নির্দিষ্ট স্থানটিতে শাদ্দাদ তার বেহেশত বানিয়েছিল সেখানে গিয়ে পৌঁছল। উক্ত বেহেশতের নির্দিষ্ট স্থানটির উপর দিয়ে পথ অতিক্রমকালে সে বালুকার নিচে কতিপয় উজ্জ্বল জওহর দেখতে পেয়ে তা উঠিয়ে নিয়ে তা খলীফা মুআবিয়া (রা)-এর সম্মুখে পেশ করল।

সেখানে তখন কা'ব আহবার (রা) উপস্থিত ছিলেন। তিনি উক্ত জওহরগুলো দেখে বললেন, নিশ্চয় শাদ্দাদ নির্মিত বেহেশতের জওহর। কেননা, আমি স্বকর্ণে রাসূলুল্লাহ (স)-এর মুখে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে আবদুল্লাহ নামক কোন এক ব্যক্তি শাদ্দাদের বেহেশতের নিকট কারণবশতঃ গমন করে তার কিছু নিদর্শন দেখতে পাবে। এ ব্যক্তির নাম আবদুল্লাহ বলে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূল (স)-এর সে ভবিষ্যত বাণী আজ পুরাপুরিভাবে ফলে গেল ।

শাদ্দাদের জন্মকাহিনী


তাওরীখের কিতাবে লিখিত আছে একদিন আল্লাহ্ তা'আলা হযরত আযরাইল (আ) কে জিজ্ঞেস করলেন যে, হে আযরাইল, তুমিত দীর্ঘকাল যাবৎ জীবের জান কবজের দায়িত্ব পালন করে আসছ। কোন জান কবজের সময় কখনও কি তোমার অন্তরে দয়ার উদ্রেক হয়েছে কখনও কি কারও প্রতি দয়া দেখিয়েছ? আযরাইল (আ) বললেন- হে মহান রব। জান কবজ কালে সকলের উপরই আমার রহম আছে কিন্তু আমি সবর্দাই আপনার হুকুমের প্রাধান্য দিয়ে থাকি? আল্লাহ পাক জিজ্ঞেস করলেন, তবে কার প্রতি তোমার সর্বাপেক্ষা বেশি দয়া হয়েছিল? আযরাইল (আ) বললেন, হে আমার রব। আপনার নির্দেশে আমি একদিন একটি নৌকা ধ্বংস করেছিলাম। যখন নৌকার তক্তাসমূহ ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেললাম তখন নৌকাটি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেল। নৌকার যাত্রীদের সকলেই মৃত্যু বরণ করল । কিন্তু নৌকার একটি তক্তা আপনার নির্দেশে এক গর্ভবতী নারীকে বাঁচিয়েছিল। আর ফেরেশতারা উক্ত তক্তাকে এক দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিল। দ্বীপে পৌঁছার পর উক্ত মহিলার একটি পুত্র সন্তান জন্ম হল। নব্য প্রসুত সন্তান দেখতে পেয়ে মহিলা তার সমস্ত দুঃখ দুর্দশা ভুলে গেল। কিন্তু তখনই নির্দেশ পেলাম যে. মাতার জান কবজ করতে হবে। আর নব্যজাত শিশুকে মাতার পাশে ফেলে রাখতে হবে। তখন এ ভেবে কেঁদে ছিলাম যে, এখন শিশুটির কি অবস্থা হবে? শিশুটির মৃত্যু ছাড়া কোন উপায় নেই অথবা কোন হিংসজন্তু তাকে খেয়ে ফেলবে।

দ্বিতীয়বার আমার দয়ার উদ্রেক হয়েছিল শাদ্দাদের প্রতি। কেননা, সে কয়েক বছর চেষ্টা করে প্রাসাদটি তৈরি করেছিল অথচ সে তা একনজর দেখা হতে বঞ্চিত রয়ে গেল। অন্তরে আফসোস নিয়েই তাকে দুনিয়া হতে বিদায় হতে হয়েছে। আল্লাহপাক বললেন, হে আযরাঈল শাদ্দাদই ছিল ঐ শিশু যার প্রতি তুমি দয়াদ্র হয়েছিলে। তার মাতার মৃত্যুর পর আমি সূর্য ও বায়ুকে নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা গ্রীষ্ম ও শীতের দ্বারা তাকে কষ্ট দিও না। তার এক আঙ্গুল হতে দুধ আর এক আঙ্গুল হতে মধুর ঝর্ণা প্রবাহিত করে দিয়েছিলাম। এভাবেই আমি তার জীবন রক্ষা করি।

অতঃপর তাকে বিশাল দেশের প্রতাপশালী সম্রাট করেছি। কিন্তু সে এ নিয়ামতের শুকরিয়াৎআদায় না করে খোদায়ীর দাবী করেছে। তাই আমার আযাব তাকে গ্রাস করেছে।



*****************************************


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
3 জন কমেন্ট করেছেন ইতোমধ্যে
  • নামহীন
    নামহীন ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ এ ৭:৪২ PM

    এই ঘটনার সত্যতা কি তা দয়া করে নিশ্চিত করুন

    • Ibrahim
      Ibrahim ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ এ ১১:৩৮ AM

      সাদ্দাতের এই কাহিনীটা সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে দ্বিমত আছে

    • Mohammadia Foundation ☑️
      Mohammadia Foundation ☑️ ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৩ এ ৮:৫২ PM

      আপনি ঠিক বলেছেন, তবে আমরা এটাকে গল্প হিসেবেই প্রকাশ করেছি। এটাকে শতভাগ সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে বিষয়টি এমন নয়।

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url