মা’আরেফুল কোরআন - ৬৭ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৮৩-১৮৪ || রোযা ফরজ হওয়া এবং রোযার মাস’আলা প্রসঙ্গ







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৮৩-১৮৪


 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿۱۸۳ اَیَّامًا مَّعۡدُوۡدٰتٍ ؕ فَمَنۡ کَانَ مِنۡکُمۡ مَّرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ وَ عَلَی الَّذِیۡنَ یُطِیۡقُوۡنَهٗ فِدۡیَۃٌ طَعَامُ مِسۡکِیۡنٍ ؕ فَمَنۡ تَطَوَّعَ خَیۡرًا فَهُوَ خَیۡرٌ لَّهٗ ؕ وَ اَنۡ تَصُوۡمُوۡا خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۸۴

সূরা আল-বাকারাহ ১৮৩-১৮৪ নং আয়াতের অর্থ

(১৮৩) হে ঈমানদারগণ ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরব করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। 
(১৮৪) গণনার কয়েকটি দিনের জন্য। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোযা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি রোযা রাখ তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার ।

সূরা আল-বাকারাহ ১৮৩-১৮৪ নং আয়াতের তাফসীর

    

হে ঈমানদারগণ ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তী (জাতিসমূহের) লোকদের উপর ফরয করা হয়েছিল, এই আশায় যেন তোমরা (রোযার কল্যাণে ধীরে ধীরে) পরহেযগার হতে পারে। (কেননা রোযা রাখার ফলে নফসকে তার বিভিন্নমুখী প্রবণতা থেকে সংযত রাখার অভ্যাস গড়ে উঠবে, আর এ অভ্যাসের দৃঢ়তাই হবে পরহেযগারীর ভিত্তি। সুতরাং) গণনার কয়েকটা দিন রোযা রাখ। (এ অল্প কয়টি দিনের অর্থ—রমযান মাস, যা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।) অতঃপর (এর মধ্যেও এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে যে,) তোমাদের মধ্যে যারা (এমন) অসুস্থ হয়, (যার পক্ষে রোযা রাখা কঠিন কিংবা ক্ষতিকর হতে পারে) অথবা (শরীয়তসম্মত) সফরে থাকে, (তার পক্ষে রমযান মাসে রোযা না রাখারও অনুমতি রয়েছে এবং রমযান ছাড়া) অন্যান্য সময়ে (ততগুলো দিন) গণনা করে রোযা রাখা (তার উপর ওয়াজিব)। আর (দ্বিতীয় সহজ পদ্ধতিটি, যা পরে রহিত হয়ে গেছে, তা এরূপ যে,) এ রোযা যাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টকর মনে হয় তারা এর পরিবর্তে (শুধু রোযার) ফিদইয়া’ (অর্থাৎ বদলা) হিসাবে একজন দরিদ্রকে খাদ্য খাওয়াবে (অথবা দিয়ে দেবে)। তবে যে ব্যক্তি খুশির সাথে (আরো বেশি) খয়রাত করে (অর্থাৎ আরো বেশি ফিদইয়া দিয়ে দেয়) তবে তা তার জন্য আরো বেশি মঙ্গলকর হবে এবং (যদিও আমি এরূপ অবস্থায় রোযা না রাখার অনুমতি দিয়েছি, কিন্তু এ অবস্থাতেও) তোমাদের পক্ষে রোযা রাখা অনেক বেশি কল্যাণকর, যদি তোমরা (রোযার ফযীলত সম্পর্কে) জানতে পার।

সূরা আল-বাকারাহ ১৮৩-১৮৪ নং আয়াতের বিষয় বস্তু

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
صوم - -এর শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা বা বেঁচে থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় খাওয়া, পান করা এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম ’সওম’। তবে সুবেহ্ সাদিক হওয়ার পূর্ব থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে একাধারে এভাবে বিরত থাকলেই তা রোযা বলে গণ্য হবে। সূর্যাস্তের এক মিনিট আগেও যদি কোন কিছু খেয়ে ফেলে, পান করে কিংবা সহবাস করে, তবে রোযা হবে না। অনুরূপ উপায়ে সব কিছু থেকে পূর্ণ দিবস বিরত থাকার পরও যদি রোযার নিয়ত না থাকে তবে তা রোযা হবে না।


সওম বা রোযা ইসলামের মূল ভিত্তি বা আরকানের অন্যতম। রোযার অপরিসীম ফযীলত রয়েছে, যা এখানে বর্ণনা করা অপ্রাসঙ্গিক।

পূর্ববর্তী উম্মতের উপর রোযার হুকুম

মুসলমানদের প্রতি রোযা ফরয হওয়ার নির্দেশটি একটি বিশেষ নযীর উল্লেখসহ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশের সাথে সাথে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, রোযা শুধু তোমাদের প্রতিই ফরয করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও ফরয করা হয়েছিল। এর দ্বারা যেমন রোযার বিশেষ গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে, তেমনি মুসলমানদের এ মর্মে একটি সান্ত্বনাও দেওয়া হয়েছে যে, রোযা একটি কষ্টকর ইবাদত সত্য, তবে তা শুধু তোমাদের উপরই ফরয করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর উপরও ফরয করা হয়েছিল। কেননা সাধারণত দেখা যায়, কোন একটা ক্লেশকর কাজে অনেক লোক একই সাথে জড়িত হয়ে পড়লে তা অনেকটা স্বাভাবিক এবং সাধারণ বলে মনে হয়। (রূহুল মা’আনী)

কোরআনের বাক্য الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ অর্থাৎ যারা তোমাদের পূর্বে ছিল ব্যাপক অর্থবোধক । এর দ্বারা হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত সকল উম্মত এবং শরীয়তকেই বোঝায়। এতে বোঝা যায় যে, নামাযের ইবাদত থেকে যেমন কোন উম্মত বা শরীয়তই বাদ ছিল না, তেমনি রোযাও সবার জন্যই ফরয ছিল।

যাঁরা উল্লেখ করেছেন যে, مِنْ قَبْلِكُمْ বাক্য দ্বারা পূর্ববর্তী উম্মত ’নাসারা’দের বোঝানো হয়েছে, তাঁরা বলেন—এটা উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে; অন্যান্য উম্মতের উপর রোযা ফরয ছিল না, তাদের কথায় এ তথ্য বোঝায় না। —(রূহুল মা’আনী)

আয়াতের মধ্যে শুধু বলা হয়েছে যে, “রোযা যেমন মুসলমানদের উপর ফরয করা হয়েছে, তেমনি পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও ফরয করা হয়েছিল; একথা দ্বারা এ তথ্য বোঝায় না যে, আগেকার উম্মতগণের রোযা সমগ্র শর্ত ও প্রকৃতির দিক দিয়ে মুসলমানদের উপর ফরযকৃত রোযারই অনুরূপ ছিল। যেমন রোযার সময়সীমা, সংখ্যা এবং কখন তা রাখা হবে এসব ব্যাপারে আগেকার উম্মতদের রোযার সাথে মুসলমানদের রোযার পার্থক্য হতে পারে, বাস্তব ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই । বিভিন্ন সময়ে রোযার সময়সীমা এবং সংখ্যার ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়েছে। —(রূহুল মা’আনী)

لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

বাক্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ’তাকওয়া’ বা পরহেযগারীর শক্তি অর্জন করার ব্যাপারে রোযার একটা বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান। কেননা রোযার মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি অর্জিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সেটাই ‘তাকওয়া’ বা পরহেযগারীর ভিত্তি।

রুগ্ন ব্যক্তির রোযা

فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا বাক্যে উল্লিখিত ’রুগ্ন’ সে ব্যক্তিকে বোঝায়, রোযা রাখতে যার কঠিন কষ্ট হয় অথবা রোগ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে । পরবর্তী আয়াত وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ -এর মধ্যে সে দিকেই ইশারা করা হয়েছে। ফিকহবিদ আলেমগণের সর্বসম্মত অভিমত তা-ই।

মুসাফিরের রোযা

আয়াতের অংশ أَوْ عَلَى سَفَرٍ-এর মধ্যে مسافر না বলে أَوْ عَلَى سَفَرٍ শব্দ ব্যবহার করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

প্রথমত শুধু অভিধানিক অর্থের সফর, যথাঃ বাড়িঘর থেকে বের হয়ে কোথাও গেলেই রোযার ব্যাপারে সফরজনিত ’রুখসত’ (অব্যাহতি) পাওয়া যাবে না, সফর দীর্ঘ হতে হবে। কেননা عَلَى سَفَرٍ শব্দের মর্মার্থ হচ্ছে, যে সফরের উপরে থাকে। এতে বোঝা যায় যে, বাড়িঘর থেকে পাঁচ-দশ মাইল দূরে গেলেই তা সফর বলে গণ্য হবে না। তবে সফর কতটুকু দীর্ঘ হতে হবে, সে সীমারেখা কোরআনে উল্লিখিত হয়নি। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদীস এবং সাহাবীগণের আমলের উপর ভিত্তি করে ইমাম আবূ হানীফা (র) এবং অন্যান্য কিছুসংখ্যক ফিকহবিদের মতে এ সফর কমপক্ষে তিন মনযিল দূরত্বের হতে হবে। অর্থাৎ একজন লোক স্বাভাবিকভাবে পায়ে হেঁটে তিনদিন যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ততটুকু দূরত্বের সফরকে সফর বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগের আলেমগণ ’মাইল’-এর হিসাবে এ দূরত্ব আটচল্লিশ মাইল নির্ধারণ করেছেন।

দ্বিতীয় মাস’আলাঃ عَلَى سَفَرٍ শব্দ দ্বারা একথাও বোঝা যায় যে, মুসাফির-এর প্রতি রোযার ব্যাপারে সফরজনিত ’রুখসত’ ততক্ষণই প্রযোজ্য হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সফরের মধ্যে থাকে। তবে স্বভাবতই সফর চলো অবস্থায় কোথাও সাময়িক যাত্রাবিরতি সফরের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটায় না। নবী করীম (সা)-এর হাদীস মতে এ যাত্রাবিরতির মেয়াদ ঊর্ধ্বপক্ষে পনের দিনের কম সময় হতে হবে। কেউ যদি সফরের মধ্যেই কোথাও পনের দিন অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তবে সে আর ’সফরের মধ্যে থাকে না। ফলে সে ব্যক্তির ক্ষেত্রে সফরজনিত ‘রুখসত’ প্রযোজ্য হবে না।

মাস’আলাঃ একই বাক্যাংশ দ্বারা এ কথাও বোঝায় যে, কেউ যদি সফরের মধ্যে কোন এক জায়গায় নয়, বরং বিভিন্ন জায়গায় মোট পনের দিনের যাত্রাবিরতি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তার সফরের ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে না। সে সফরজনিত রুখসত পাওয়ার অধিকারী হবে।

রোযার কাযা

فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ অর্থাৎ রুগ্ন বা মুসাফির ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় কিংবা সফরে যে কয়টি রোযা রাখতে পারবে না, সেগুলো অন্য সময় হিসাব করে কাযা করা ওয়াজিব। এতে বলা উদ্দেশ্য ছিল যে, রোগজনিত কারণে কিংবা সফরের অসুবিধায় পতিত হয়ে যে ক’টি রোযা ছাড়তে হয়েছে, সে ক’টি রোযা অন্য সময় পূরণ করে দেওয়া তাদের উপর ওয়াজিব। এ কথাটি বোঝানোর জন্য فَعَلَيْهِ الْقَضَاءُ (তার উপর কাযা ওয়াজিব, এতটুকু বলাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তা না বলে فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রুগ্ন এবং মুসাফিরদের অপরিহার্য রোযার মধ্যে শুধু সে পরিমাণ রোযার কাযা করাই ওয়াজিব, রোগী সুস্থ হওয়ার পর এবং মুসাফির বাড়ি ফেরার পর যে কয়দিনের সুযোগ পাবে। কিন্তু সে ব্যক্তি যদি এতটুকু সময় না পায় এবং এর আগেই মৃত্যুবরণ করে, তবে তার উপর কাযা কিংবা ’ফিদ্ইয়া’র জন্য ওসীয়ত করা জরুরী নয়।

মাস’আলাঃ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ বাক্যে যেহেতু এমন কোন শর্তের উল্লেখ নেই, যদদ্বারা বোঝা যেতে পারে যে, এ রোযা একই সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে রাখতে হবে, না মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে রাখলেও চলবে সুতরাং যার রমযানের প্রথম দশ দিনের রোযা ফউত হয়েছে সে যদি প্রথমে দশ তারিখের কাযা করে, পরে নয় তারিখের তারপর আট তারিখের কাযা হিসাবে করতে থাকে, তবে তাতে কোন অসুবিধা হবে না। অনুরূপভাবে দশটি রোযার মধ্যে দু’-চারটি করার পর বিরতি দিয়ে অবশিষ্টগুলো কাযা করলেও কোন অসুবিধা হবে না। কেননা আয়াতের মধ্যে এরূপভাবে কাযা করার ব্যাপারেও কোন নিষেধাজ্ঞা উল্লিখিত হয়নি।

রোযার ফিদ্ইয়া

أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ এ আয়াতের স্বাভাবিক অর্থ দাঁড়ায় যেসব লোক রোগজনিত কারণে কিংবা সফরের দরুন নয়, বরং রোযা খাব পূর্ণ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রোযা রাখতে চায় না, তাদের জন্যও রোযা না রেখে রোযার বদলায় ‘ফিদ্ইয়া’ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সাথে সাথেই এতটুকু বলে দেওয়া হয়েছে যে, وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ অর্থাৎ রোযা রাখাই হবে তোমাদের জন্য কল্যাণকর। 

উপরোক্ত নির্দেশটি ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগের, যখন লক্ষ্য ছিল ধীরে ধীরে লোকজনকে রোযায় অভ্যস্ত করে তোলা । এরপর অবতীর্ণ আয়াত فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ -এর দ্বারা প্রাথমিক এ নির্দেশ সুস্থ-সবল লোকদের ক্ষেত্রে রহিত করা হয়েছে। তবে যেসব লোক অতিরিক্ত বার্ধক্যজনিত কারণে রোযা রাখতে অপারগ কিংবা দীর্ঘকাল রোগভাগের দরুন দুর্বল হয়ে পড়েছে অথবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়েছে সেসব লোকের বেলায় উপরোক্ত নির্দেশটি এখনো প্রযোজ্য রয়েছে। সাহাবী ও তাবেয়ীগণের সর্বসম্মত অভিমত তা-ই। (জাসসাস, মাযহারী)

বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, নাসায়ী ও তিরমিযী প্রভৃতি হাদীসের সমস্ত ইমামগণই সাহাবী হযরত সালামা-ইবনুল আকওয়া (রা)-এর সে বিখ্যাত হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন যাতে বলা হয়েছে যে, যখন وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হয়, তখন বলা হয়েছে যে, যখন আমাদেরকে এ মর্মে ইখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল যে, যার ইচ্ছা হয় সে রোযা রাখতে পারে এবং যে রোযা রাখতে না চায়, সে ‘ফিদইয়া’ দিয়ে দেবে। এরপর যখন পরবর্তী আয়াত فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ নাযিল হলো, তখন রোযা অথবা ’ফিদইয়া’ দেওয়ার ইখতিয়ার রহিত হয়ে সুস্থ-সমর্থ লোকদের উপর শুধুমাত্র রোযা রাখাই জরুরী সাব্যস্ত হয়ে গেল।

মসনদে আহমদে উদ্ধৃত হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রা) বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে বলা হয়েছে যে, ইসলামের প্রথম অবস্থায় নামাযের নির্দেশের বেলায় তিনটি স্তর অতিক্রান্ত হয়েছে; রোযার ব্যাপারেও অনুরূপ তিনটি স্তর অতিক্রান্ত হয়। রোযার নির্দেশ-সংক্রান্ত তিনটি স্তর হচ্ছে এরূপঃ

-“হুযূর (সা) যখন মদীনায় আসেন তখন প্রতি মাসে তিনটি এবং আশুরার দিনে একটি রোযা রাখতেন। এরপর রোযা ফরয হওয়া সংক্রান্ত كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ আয়াত নাযিল হয়। এ অবস্থায় সবারই ইখতিয়ার ছিল যে, কেউ রোযাও রাখতে পারত অথবা তার বদলায় ‘ফিদইয়া’ও প্রদান করতে পারত। তবে তখনো রোযা রাখাই উত্তম বিবেচিত হতো। তারপর আল্লাহ তা’আলা দ্বিতীয় আয়াত فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ নাযিল করলেন । এ আয়াতে সুস্থ-সবল লোকদের এ ইখতিয়ার ’রহিত করে’ তাদের জন্য শুধু রোযার বিধানই প্রবর্তন করে। তবে অতি বৃদ্ধ লোকদের বেলায় সে ইখতিয়ার অবশিষ্ট রাখা হয়েছে তারা ইচ্ছা করলে এখনো রোযা না রেখে ’ফিদইয়া’ দিয়ে দিতে পারে।

তৃতীয় পরিবর্তন হয়েছে যে, প্রথমাবস্থায় ইফতারের পর থেকে শয্যা গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত খানা-পিনা এবং যৌনক্ষুধা মেটানোর অনুমতি ছিল। কিন্তু বিছানায় গিয়ে একবার ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথে দ্বিতীয় দিনের রোযা শুরু হয়ে যেতো। এরপর ঘুম ভাঙলে রাত থাকা সত্ত্বেও খানাপিনা কিংবা স্ত্রী সম্ভোগের অনুমতি ছিল না। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ শীর্ষক আয়াত নাযিল করে সুবেহ সাদিক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খানাপিনা প্রভৃতি সর্বকিছুই চলতে পারে—এরূপ অনুমতি দিয়েছেন। এমনকি এরপর থেকে শেষ রাত্রে উঠে সেহরী খাওয়া সুন্নত করে দিয়েছেন। বুখারী, মুসলিম, আবূ দাঊদ প্রভৃতিতে একই মর্মে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। —(ইবনে কাসীর)

ফিদ্ইয়ার পরিমাণ এবং আনুষঙ্গিক মাস’আলা

একটি রোযার ফিদইয়া অর্ধ সা’ গম অথবা তার মূল্য। আমাদের দেশে প্রচলিত আশি তোলার সের হিসাবে অর্ধ সা’ পৌনে দু’সেরের কাছাকাছি হয়। এই পরিমাণ গম অথবা নিকটবর্তী প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী তার মূল্য কোন মিসকিনকে দান করে দিলেই একটি রোযার ’ফিদইয়া’ আদায় হয়ে যায়। ফিদইয়া কোন মসজিদ বা মাদ্রাসায় কার্যরত কোন লোকের খেদমতের পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েয নয়।

মাস’আলাঃ এক রোযার ফিদইয়া একাধিক মিসকিনকে দেওয়া অথবা একাধিক রোযার ফিদইয়া একই সাথে এক ব্যক্তিকে দেওয়া দুরস্ত নয়। শামী, বাহরুর রায়েক-এর হাওয়ালায় এমনই বর্ণনা করেছেন। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র) বয়ানুল-কোরআনেও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে এমদাদুল ফতওয়াতে থানবী (র) লিখেছেন যে, ফতওয়া হচ্ছে এক রোযার ফিদইয়া একাধিক মিসকিনকে দেওয়া এবং একাধিক রোযার ফিদইয়া এক মিসকিনকে দেওয়া - এ উভয় সুরতই জায়েয। শামীতেও অনুরূপ ফতওয়া রয়েছে। এমদাদুল ফতওয়াতে অবশ্য বলা হয়েছে যে, একাধিক রোযার ফিদইয়া একই সময়ে এক ব্যক্তিকে না দেওয়াই উত্তম। তবে কেউ বলেছেন, দিয়ে দিলে তা আদায় হয়ে যাবে।

মাস’আলাঃ যদি কোন ব্যক্তির পক্ষে ’ফিদইয়া’ প্রদান করার সামর্থ্য না থাকে, তবে সে ব্যক্তি ইস্তেগফার পড়তে থাকবে এবং মনে মনে নিয়ত করবে যে, সমর্থ হলে পরই তা আদায় করে দেবে। —(বয়ানুল-কোরআন)





*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url