কুরআনের গল্পঃ হযরত সালেহ (আঃ)-এর মোজেযার উট ও সামুদ জাতির ধ্বংসের কাহিনী




হযরত সালেহ (আঃ)-এর উটের কাহিনী


হযরত সালেহ (আঃ) তার গোত্রের লোকদেরকে বার বার আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহবান করতে থাকেন। কিন্তু তারা তাঁর আহ্বানে সাড়া তো দেয়ইনি বরং উত্তর উত্তর তাদের বিরোধিতা আরও চরমে উঠল এবং কিভাবে তাঁকে হ্যাস্ত ন্যাস্ত করা যায় এবং সত্যের প্রচার ও প্রসারের পথে বাধা সৃষ্টি করা যায় সে ব্যাপারেই তারা বেশি প্রয়াসী হয়। যদিও তখন পর্যন্ত মাত্র কয়েকজন দুর্বল ও অসহায় লোক ঈমান গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সম্প্রদায়ের বাতিল মতামত ত্যাগ করেনি। আল্লাহ প্রদত্ত সুখ সম্পদ ও শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে ডুবে থেকেও নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেনি। বরং গর্ব ও অহংকারে মত্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অবশেষে নবুয়তের সত্যতার উপর দলীল আনার দাবী তুলেছে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হচ্ছে-

مَاۤ اَنۡتَ اِلَّا بَشَرٌ مِّثۡلُنَا ۚۖ فَاۡتِ بِاٰیَۃٍ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ ﴿۱۵۴

অর্থঃ “তুমিতো আমাদেরই মত মানুষ। অতএব যদি তুমি সত্যবাদী হও তা হলে তোমার নবুয়াতের স্ব-পক্ষে প্রমাণ পেশ কর।" (সূরাঃ ২৬/ আশ-শুআ'রাঃ আয়াত-১৫৪) 

   

হযরত সালেহ (আঃ) তাদের দাবীর জবাবে স্বীয় নবুয়াতের সত্যতার উপর প্রমাণ পেশ করতে সম্মত হলেন এবং প্রমাণের ধরন কি হবে তিনি তাদেরকে তা জিজ্ঞেস করলেন। হেজর শহরের উপকণ্ঠে একটি বড় পাথর ছিল। সে পাথরটির নাম ছিল 'কাতেবা'। তারা বলল যে, তিনি যেন মোজেযা হিসাবে উক্ত পাথর হতে দশ মাসের গর্ভবর্তী একটি উষ্ট্রী বের করে আনেন। আর তা বের হওয়ার সাথে সাথে যেন সে বাচ্চা দেয়। হযরত সালেহ (আঃ) তাদের থেকে এ মর্মে প্রতিশ্রুতি নিলেন যে, যদি আল্লাহ্ পাক তাদের দাবী অনুযায়ী মোজেযা প্রকাশ করেন তা হলে তারা ঈমান গ্রহণ করবে কি না? তারা সকলে ওয়াদা করল যে, যদি আল্লাহ পাক তাদের চাহিদা মোতাবেক মোজেযা দেখান তবে তারা সবাই ঈমান আনবে। তাদের ওয়াদা গ্রহণ করে হযরত সালেহ (আঃ) নামায আদায় করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। তিনি দোয়াতে রত থাকা অবস্থায়ই পাথরটি নড়ে উঠল। পাথর ফেটে দশ মাসের গর্ভবর্তী এক উষ্ট্রি বের হয়ে আসল । আর সাথে সাথে উষ্ট্রির একটি বাচ্ছা জন্ম নিয়ে উটনীর আশে পাশে ঘুরা ফেরা করতে লাগল ।

হযরত সালেহ (আঃ)-এর এ মোজেযা দেখে সামুদ জাতির প্রধান আমরের পুত্র জুনদা ও তার সঙ্গী সাথীরা ঈমান আমল । অন্যান্যরাও ঈমান আনতে চেয়েছিল কিন্তু যাওয়াব বিন আমর বিন লবীদ, এ গোত্রের প্রতিমা প্রস্তুতকারক আল হাবাব এবং তাদের গণকঠাকুর রিবাব প্রভৃতিরা তাদেরকে ঈমান গ্রহণ করা হতে বিরত রাখল। হযরত সালেহ (আঃ) তাঁর লোকদের উদ্দেশ্যে করে বললেন যে,

 وَ اِذۡ اَخَذَ رَبُّکَ مِنۡۢ بَنِیۡۤ اٰدَمَ مِنۡ ظُهُوۡرِهِمۡ ذُرِّیَّتَهُمۡ وَ اَشۡهَدَهُمۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ ۚ اَلَسۡتُ بِرَبِّکُمۡ ؕ قَالُوۡا بَلٰی ۚۛ شَهِدۡنَا ۚۛ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اِنَّا کُنَّا عَنۡ هٰذَا غٰفِلِیۡنَ ﴿۱۷۲

অর্থঃ নিশ্চয় তোমাদের রবের পক্ষ হতে তোমাদের নিকট এক উজ্জ্বল প্রমাণ এসেছে। তা হল আল্লাহ্র এ উষ্ট্রী যা তোমাদের জন্য নিদর্শন। সুতরাং তোমরা একে আল্লাহ্ যমীনে ছেড়ে দাও সে ইচ্ছামত ঘাস খাবে। আর তোমরা কোন প্রকার খারাপ নিয়তে এর দেহ স্পর্শও করবে না। যদি এরূপ কর তবে মর্মান্তিক শাস্তি তোমাদের জন্য অবধারিত। (সূরাঃ ৭/ আল-আ'রাফঃ আয়াত-৭৩)

আল্লাহ্ হযরত সালেহ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন যে, হে নবী! আপনি ধৈর্যধারণ করুণ। আমি এ উষ্ট্রীকে প্রেরণ করেছি তাদের পরীক্ষা করার জন্য। সুতরাং পরীক্ষাকাল পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আর এ পরীক্ষা হবে উষ্ট্রীর সাথে সম্পর্কিত কিছু নিয়ম পালনের মধ্য দিয়ে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-

 اِنَّا مُرۡسِلُوا النَّاقَۃِ فِتۡنَۃً لَّهُمۡ فَارۡتَقِبۡهُمۡ وَ اصۡطَبِرۡ ﴿۫۲۷ وَ نَبِّئۡهُمۡ اَنَّ الۡمَآءَ قِسۡمَۃٌۢ بَیۡنَهُمۡ ۚ کُلُّ شِرۡبٍ مُّحۡتَضَرٌ ﴿۲۸

অর্থঃ (হে সালেহ।) আমি তাদেরকে পরীক্ষার জন্য উষ্ট্রী পাঠাচ্ছি। সুতরাং আপনি অপেক্ষা করুণ ও ধৈর্যধারণ করুণ। আর বলে দিন যে, পানি তাদের মধ্যে পালাক্রমে ভাগাভাগি হবে। প্রত্যেকে আপন আপন পালা অনুযায়ী (কূপে) হাযির হবে।" (সূরাঃ ৫৪/ আল-কামারঃ আয়াত ২৭-২৮)

কেননা, উষ্ট্রী এবং তারা একই কূপ হতে পানি পান করত। উষ্ট্রী পানি পান করার সময় কূপের সমস্ত পানি পান করে ফেলত। সম্প্রদায়ের লোকেরা তখন কূপে কোন পানিই পেত না। সুতরাং কওমের লোকদের জন্য এটা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। যদিও সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক ঈমান গ্রহণ করেনি । কিন্তু ভয়ে উট সম্পর্কে কোন কথা বলত না। হযরত সালেহ (আঃ) বুঝতে পারলেন যে, উটের পানি পান করার দ্বারা কওমের লোকদের কষ্ট হচ্ছে। তাই তিনি আল্লাহ্ পাকের অনুমতি সাপেক্ষে এ সম্বন্ধে মিমাংসা করলেন যে, একদিন উষ্ট্রী পানি পান করবে আর দ্বিতীয় দিন লোকেরা পানি পান করবে। আল্লাহ্ পাকের এ ফয়সালার কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে-

 هٰذِهٖ نَاقَۃٌ لَّهَا شِرۡبٌ وَّ لَکُمۡ شِرۡبُ یَوۡمٍ مَّعۡلُوۡمٍ ﴿۱۵۵

অর্থ : “এই উষ্ট্রীর পানি পান করার একদিন পালা। আর একদিন তোমাদের পানি পান করার পালা।” (সূরাঃ ২৬/ আশ-শুআ'রাঃ আয়াত ১৫৫)

এ নির্দেশানুসারে নির্ধারিত পালাক্রমে পানি পান করা শুরু হল। একদিন উষ্ট্রী ও তার বাচ্চা পানি পান করত আর দ্বিতীয় দিন গোত্রের লোকজন ও পশুসমূহ পান করত। কিন্তু যে দিন উষ্ট্রী পানি পান করত সে দিন গোত্রের লোকজন পানির পরিবর্তে উষ্ট্রী হতে দুধ দোহন করত। তারা নিজেদের ইচ্ছামত যে পরিমাণ দুধ দোহন করতে চাইত সে পরিমাণ দুধ দোহন করতে পারত। এমনকি পুর্ণ গোত্রের সমস্ত লোকের সর্বপ্রকার প্রয়োজন উটনীর দুধের দ্বারাই মিটে যেত ।

অতপর হযরত সালেহ (আঃ) প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী লোকদের আল্লাহর আযাব হতে রক্ষার জন্য তাদের প্রতি আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতের কথা স্মরণ করে দেন যাতে তারা আল্লাহ্ পাকের নাফরমানী হতে প্রত্যাবর্তন করে ।

وَ اذۡکُرُوۡۤا اِذۡ جَعَلَکُمۡ خُلَفَآءَ مِنۡۢ بَعۡدِ عَادٍ وَّ بَوَّاَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ تَتَّخِذُوۡنَ مِنۡ سُهُوۡلِهَا قُصُوۡرًا وَّ تَنۡحِتُوۡنَ الۡجِبَالَ بُیُوۡتًا ۚ فَاذۡکُرُوۡۤا اٰلَآءَ اللّٰهِ وَ لَا تَعۡثَوۡا فِی الۡاَرۡضِ مُفۡسِدِیۡنَ ﴿۷۴

অর্থঃ এবং স্মরণ কর তোমরা আল্লাহর ঐ অনুগ্রহের কথা যখন আদ গোত্রের (ধ্বংসের) পর তিনি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। এবং পৃথিবীর মধ্যে তোমাদেরকে ঠিকানা করে দিয়েছেন যে, তোমরা এর নরম যমীনে বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ করতে পার এবং পাহাড় কেটে ঘর প্রস্তুত করতে পার। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্ পাকের নিয়ামতসমূহ স্মরণ কর এবং কমপক্ষে যমীনের উপর ফিতনা ফাসাদে লিপ্ত হয়ো না। (সূরাঃ ৭/ আল-আ'রাফঃ আয়াত-৭৪) 

সামুদ গোত্রের লোক অগাধ সম্পদের অধিকারী ও আরাম প্রিয় এবং শিল্পকর্মে খুব দক্ষ ছিল। তাই গ্রীষ্মকালে তারা নরম ভূমির উপর গৃহ নির্মাণ করে সেখানে বাস করত আর শীতকালে পাহাড়ের পাথর কেটে ঘর নির্মাণ করে সেখানে দিনযাপন করত। যদিও তারা উটনীর পানি পান করার পালা মেনে নিয়েছিল কিন্তু হযরত সালেহ (আঃ)-এর বিরোধিতা পরিত্যাগ করেনি বরং যারা ঈমান গ্রহণ করেছিল তাদেরকে ঈমানের পথ হতে সরানোর উদ্দেশে বিভিন্ন প্রশ্নে জর্জরিত করেছিল। কখনও কখনও এমন আচরণ করত যা দ্বারা ঈমানদারদের মনে দুর্বলতা দেখা দিত এবং ঈমানের ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি হত । অধিকন্তু তারা ঈমানদারদেরকে দুর্বল মনে করত। কিন্তু ঈমানদাররা তাদের ঈমানে অটল ও অবিচল ছিল। 1 যদিও তারা ছিল স্বল্প সংখ্যক। কিন্তু খুব ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে কাফেরদের প্রশ্নবাণের জবাব দিয়ে আসছেন। পবিত্র কোরআনে সামুদ জাতির নেতাদের এ আচরণের কথা ও ঈমানদারদের পক্ষ হতে তাদের আচরণের উত্তর প্রদানের কথা বলা হয়েছে।

 قَالَ الۡمَلَاُ الَّذِیۡنَ اسۡتَکۡبَرُوۡا مِنۡ قَوۡمِهٖ لِلَّذِیۡنَ اسۡتُضۡعِفُوۡا لِمَنۡ اٰمَنَ مِنۡهُمۡ اَتَعۡلَمُوۡنَ اَنَّ صٰلِحًا مُّرۡسَلٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ ؕ قَالُوۡۤا اِنَّا بِمَاۤ اُرۡسِلَ بِهٖ مُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۷۵

অর্থঃ “তাঁর সম্প্রদায়ের গর্ব ও অহংকারে মত্ত নেতারা ঈমান গ্রহণকারীদের দুর্বল মনে করত এবং বলত যে তোমরা বিশ্বাস কর যে সালেহ তার প্রভুর পক্ষ হতে রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছে? ঈমানদার লোকেরা বলত যে, নিশ্চয়ই তাঁকে যা সহ প্রেরণ করা হয়েছে আমরা তার প্রতি বিশ্বাস রাখি।” (সূরাঃ ৭/ আল-আ'রাফঃ আয়াত-৭৫) 

তাফসীরে কাশশাফে লিখিত আছে যে, ঈমানদারদের এরূপ উত্তরের অর্থ হচ্ছে তোমরা যে বিতর্কে পড়েছ অর্থাৎ তিনি রাসূল কি রাসূল নন এ তো বিতর্কের বিষয় নয়। বরং তিনি রাসূল হওয়াতে তো কোনরূপ সন্দেহ হতে পারে না। নিঃসন্দেহে তিনি রাসূল। আর তিনি যে সকল কথা বলেন তাও সন্দেহমুক্ত এবং তা সম্পূর্ণই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তবে তার প্রতি কারা ঈমান এনেছে আর কারা ঈমান আনেনি তা আলোচনার অপেক্ষা রাখে। আলহামদুলিল্লাহ! আমরা তাঁর সমস্ত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। ঈমানদারদের বক্তব্য শ্রবণ করে এ সম্প্রদায়ের অহমিকায় নিমজ্জিত নেতারা যা বলে উঠল কোরআন পাকে তা বর্ণিত হয়েছে-

اِنَّا بِالَّذِیۡۤ اٰمَنۡتُمۡ بِهٖ کٰفِرُوۡنَ 

অর্থঃ “নিঃসন্দেহে তোমরা যে বিষয়ের উপর বিশ্বাস রাখ আমরা তা অস্বীকার করি।" (সূরাঃ ৭/ আল-আ'রাফঃ আয়াত-৭৬) 

অতঃপর তাদের অহমিকা বৃদ্ধি পেয়ে এমন এক পর্যায় পৌছল যে, তারা উষ্ট্রী হত্যা করার পরিকল্পনা করতে পর্যন্ত কুণ্ঠাবোধ করল না। বস্তুত তারা স্বীয় কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বাহ্যিক কারণ হিসাবে যা দেখিয়েছিল তা হল উষ্ট্রীর বিভিন্ন উপত্যকায় ঘাস খাওয়ার জন্য চরে বেড়াত। এক রাস্তা দিয়ে যেত আর অপর রাস্তা দিয়ে প্রত্যাবর্তন করত। সৃষ্টিগতভাবে এটা এমন এক ভয়ানক দেহবিশিষ্ট ছিল যে, যখন এটা অন্যান্য জন্তুর নিকট দিয়ে চলত তখন অন্যান্য জন্তু ভয়ে পলায়ন করত। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তারা নিজেদের জন্য উষ্ট্রী বিপজ্জনক মনে করতে লাগল। তাই তারা উষ্ট্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করল।

আল্লামা ইবনে জরীর (রহঃ) হতে উষ্ট্রী হত্যার ঘটনা নিম্নরূপ বর্ণিত হয়েছে, সামুদ সম্প্রদায়ে ওনায়যা বিনতে গনম বিন মুজলায় নাম্নী এক বুড়ী ছিল। তাহাকে উম্মে উসমানও বলা হত। সে কাফের ছিল এবং হযরত সালেহ (আঃ)-এর মারাত্মক শত্রু ছিল। প্রচুর সম্পদের অধিকারীনী ছিল সে। তার অতি রূপসী কয়েকটি কন্যা ছিল। সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা যাওয়ার বিন আমর ছিল তার স্বামী। সাদাকা বিনতে মাহইয়া বিন যুহায়র বিন মুখতার নাম্নী অন্য একজন পরমা সুন্দরী ধনাঢ্য নারী ছিল। প্রথমে যার সাথে তার বিবাহ হয়েছিল। সে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিল। ইসলাম গ্রহণের পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।

ওনায়যা ঘোষণা করে দিল যে, সম্প্রদায়ের যে লোক উষ্ট্রীকে হত্যা করতে পারবে সে তার যে কোন কন্যার পাণিগ্রহণ (বিবাহ) করতে চায় তাকে সে সুযোগ দেয়া হবে। আর সদকা ঘোষণা করল যে, সম্প্রদায়ের যে উষ্ট্রীকে হত্যা করতে পারবে সে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। সদকা প্রথমে আল হাবাব নামক সম্প্রদায়ের এক নেতার কাছে গিয়ে তার ইচ্ছা প্রকাশ করল যে, যদি সে উষ্ট্রী হত্যা করতে সক্ষম হয়, তবে সে নিজকে তার হাতে সোপর্দ করবে। কিন্তু আল হাবাব তা অস্বীকার করল। অবশেষে সে স্বীয় চাচাত ভাই মেসদাকে এ কার্যের জন্য আহবান করল। মেসদা তার প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করল। এদিকে ওনায়যা কেদার বিন সালেফকে এ কার্যের জন্য আহবান করল। কেদার বিন সালেফ অতি সুশ্রী, লাল বর্ণের খাট দেহবিশিষ্ট ব্যক্তি ছিল। অনেকের ধারণা যে, কেদার বিন সালেফের জন্ম অসৎ উপায়ে হয়েছে। যদিও সে সালেফের বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সেহবাদ নামক এক ব্যক্তির সন্তান। তার ঔরশ থেকে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু সালেফের বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে বলে তাকে সালেফের পুত্র বলা হত ।

ওনায়যা তার কাছে প্রস্তাব পাঠাল যে, যদি কেদার উষ্ট্রীটিকে হত্যা করে তবে ওনায়যা স্বীয় কন্যাদের থেকে যে কোন এক কন্যা তাকে দান করবে। কেদার বিন সালেফ তার প্রস্তাব কবূল করে মেসদাকে সাথে করে উটনী হত্যা করার জন্য চলল। পরে তাদের সাথে আরও সাতজন যোগ দিয়ে নয়জন হল। তারা সকলেই উক্ত সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় লোক ছিল । এভাবে সমস্ত কাফেররা তাদের কার্যে সহযোগিতা করল। তারা লক্ষ্য রাখল কখন উটনী পানি পান করে ফিরে আসে। কেদার বিন সালেফ পথের এক পার্শ্বে একটি পাথরের গা ঘেষে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আর মেসদা অন্য একটি পাথরের আড়ালে উৎ পেতে রইল। যখন উটনীটি মেসদার নিকট দিয়ে যাচ্ছিল তখন সে এর প্রতি তীর নিক্ষেপ করল। তীর উটনীর পায়ের গোড়ায় বিদ্ধ হল । এমতাবস্থায় ওনায়যা তার এক কন্যাকে কেদারের সম্মুখে আসার নির্দেশ দিল। তার এ কন্যা অতুলনীয় সুন্দরী ছিল। সে মন ভুলানো মুখশ্রী নিয়ে কেদারের সামনে হাজির হওয়ার পর কেদার তাকে পাওয়ার আশায় তলোয়ার নিয়ে উটনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তলোয়ারের আঘাতে উষ্ট্রীর পায়ের নিচের অংশ কেটে দিল। উটনী খুব জোরে আওয়াজ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। উটনী জোরে আওয়াজ করার কারণ ছিল স্বীয় বাচ্চাকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা। অতঃপর কেদার বর্শা দিয়ে উটনীর জীবনের স্পন্দন সমাপ্ত করে দিল । এ দিকে উটনীর বাচ্চা বিপদ দেখতে পেয়ে দৌড়িয়ে পাহাড়ে চলে গেল। আর পাহাড়ে গিয়ে একটি পাথরের উপর উঠল। তিনবার খুব জোরে আওয়াজ দেয়ার পর পাথর ফেঁটে গেল। উষ্ট্রীর বাচ্চা পাথরের ভিতর ঢুকে পড়ল। এভাবে উষ্ট্রীর বাচ্চা লোকচক্ষুর অন্তরালে উষ্ট্রীর কাছে চলে গেল। কোরআন মজিদে সংক্ষিপ্তভাবে এ ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে-

 فَعَقَرُوا النَّاقَۃَ وَ عَتَوۡا عَنۡ اَمۡرِ رَبِّهِمۡ

অর্থঃ “অতঃপর তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করল আর স্বীয় প্রতিপালকের নির্দেশের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করল ।” (সূরাঃ ৭/ আল-আ'রাফঃ আয়াত-৭৭) 

যারা উষ্ট্রী হত্যা করেছে তাদেরকে পবিত্র কালামে সর্বাধিক বদবখত বলা হয়েছে।

 اِذِ انۡۢبَعَثَ اَشۡقٰهَا ﴿۪ۙ۱۲

অর্থঃ “যখন কওমের সবচেয়ে বদবখত এ জন্য খাড়া হল।” (সূরাঃ ৯১/ আশ-শামসঃ আয়াত ১২ ) 

হযরত সালেহ (আঃ) উষ্ট্রী হত্যার খবর পেয়ে খুব দুঃখ পেলেন এবং সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে এক জায়গায় সমবেত দেখতে পেলেন। তিনি উষ্টীটিকে মৃত দেখে কেঁদে ফেললেন। আর হযরত সালেহ (আঃ) সেখানেই আল্লাহর হুকুমে বলে দিলেন যে, তোমাদের জীবনের মাত্র আর তিনদিন বাকী আছে ।

فَعَقَرُوۡهَا فَقَالَ تَمَتَّعُوۡا فِیۡ دَارِکُمۡ ثَلٰثَۃَ اَیَّامٍ ؕ ذٰلِکَ وَعۡدٌ غَیۡرُ مَکۡذُوۡبٍ ﴿۶۵

অর্থঃ "তোমাদের তিনদিন আপন আপন ঘরে আরামে থাক। এটা আল্লাহর পক্ষ হতে প্রতিশ্রুতি, মিথ্যা নয়।” (সূরাঃ ১১/ হূদঃ আয়াত-৬৫)

এ ঘোষণায় তাদের কোন পরিবর্তন হল না। বস্তুতঃ যে সম্প্রদায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, তাদেরকে কোন নসীহত ও সতর্কবাণী ফল দিতে পারে না। বরং তারা তাঁর বাণীর প্রতি উপহাস ও ঠাট্টা করতে লাগল। আর বলতে লাগল যে আযাব কিরূপ? কোথা হতে আসবে? এর আলামতই বা কি? হযরত সালেহ (আঃ) বললেন যে, আযাবের আলামত শুনে রাখ- আগামীকাল বৃহস্পতিবার। আগামীকাল তোমাদের চেহারা হলুদবর্ণ ধারন করবে। নারী-পুরুষ বাচ্চা-বৃদ্ধ কেউ এ থেকে রক্ষা পাবে না। অতঃপর শুক্রবারে তোমাদের সকলের চেহারা লাল রং ধারণ করবে। আর শনিবারে তোমাদের চেহারা ঘোর কাল রং ধারণ করবে। আর ঐ দিনই হবে তোমাদের জীবনের শেষ দিন।

আযাবের কথা শুনে এ হতভাগ্য গোত্র তো আল্লাহ্ তাআলার কাছে গুনাহ মাফ চায়নি বরং হযরত সালেহ (আঃ) কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। তারা বলছিল যে, যদি হযরত সালেহ (আঃ) সত্যবাদী হন তবে তো নিশ্চয়ই আমাদের উপর আযাব আসবে। কাজেই আমরা ধ্বংস হওয়ার পূর্বেই তাকে ধ্বংস করে ছাড়ব। আর যদি তিনি মিথ্যাবাদী হন তাহলে মিথ্যার শাস্তি স্বরূপ তাকে উষ্ট্রীর পথ ধরাব। এমন সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুনারায় নয়জন একত্রিত হল। কুরআনে এ নয়জনের কথা উদ্ধৃত হয়েছে-

 وَ کَانَ فِی الۡمَدِیۡنَۃِ تِسۡعَۃُ رَهۡطٍ یُّفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا یُصۡلِحُوۡنَ ﴿۴۸

অর্থঃ এবং সে শহরে নয়জন লোক ছিল যারা যমীনে কুকর্মকারী ও গোলযোগ সৃষ্টিকারী আর সামান্য পরিমাণ সংশোধনও করত না।" (সূরাঃ ২৭/ আন-নামালঃ আয়াত-৪৮) 

হযরত সুদ্দী (রাঃ) হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে এক বর্ণনা নকল করেন যাতে উক্ত নয়জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। যথা- (১) দায়মী (২) দায়ীম (৩) হারমা (৪) হারীম (৫) দাব (৬) সাওয়াব (৭) রেবাব (৮) মিসদা (৯) কেদার বিন সালেফ। তারা বুধবার দিনের বেলায় উষ্ট্রী হত্যা করেছিল আর ঐদিন সন্ধ্যায় হযরত সালেহ (আঃ) কে হত্যা করার পরামর্শ করে। তাদের পরামর্শের কথা আল্লাহ্ কুরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন- 

قَالُوۡا تَقَاسَمُوۡا بِاللّٰهِ لَنُبَیِّتَنَّهٗ وَ اَهۡلَهٗ ثُمَّ لَنَقُوۡلَنَّ لِوَلِیِّهٖ مَا شَهِدۡنَا مَهۡلِکَ اَهۡلِهٖ وَ اِنَّا لَصٰدِقُوۡنَ ﴿۴۹

অর্থঃ “তারা পরস্পরকে বলল যে, তোমরা সকলে আল্লাহর নামে শপথ কর যে, আমরা অবশ্যই সালেহ (আ)-এর উপর ও তাঁর সাথে সম্পর্কিত লোকদের উপর হামলা করব অতপর আমরা সকলেই তাদের আত্মীয়স্বজন অভিভাবকদেরকে বলব যে আমরা তো সেখানে উপস্থিতই ছিলাম না। আর শপথ করে করে এও বলবে যে নিশ্চয়ই আমরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সত্যবাদী" (সূরাঃ ২৭/ আন-নামালঃ আয়াত-৪৯) 

অতপর তারা যখন হযরত সালেহ (আঃ)-কে হত্যা করতে আসল তখন আল্লাহ্ আকাশ হতে তাদের প্রতি পাথর বর্ষণ করে তাদের জীবন লীলা সাঙ্গ করে দিলেন। মুহাম্মদ বিন ইসহাকের এক বর্ণনায় রয়েছে যে, উষ্ট্রী হত্যার পর উল্লেখিত নয়জন সালেহ (আঃ)কে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হল। তারা তাকে হত্যা করার জন্য রাতে তাঁর ঘরে আসল। আল্লাহ্পাক পাথর বর্ষণ করে তাদেরকে চর্বিত ঘাসের ন্যায় করে দিলেন। তারা নির্ধারিত সময়ে গোত্রের লোকদের কাছে ফিরে না যাওয়ায় তারা অস্থির হয়ে পড়ল। অবশেষে হযরত সালেহ (আঃ)-এর বাড়ীতে এসে দেখল যে তাদের নেতা নয়জনের মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে । তখন গোত্রের লোকেরা হযরত সালেহ (আঃ)-কে বলল যে, আপনি তাদেরকে হত্যা করেছেন। অতঃপর তারা তাঁকে হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তার উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হল। হযরত সালেহ (আঃ)-এর বংশের লোকেরা তাদেরকে রুখে দাঁড়াল। হযরত সালেহ (আঃ)-এর পক্ষে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে তাদেরকে বলল, আল্লাহর কসম। তাকে হত্যা করতে তোমাদেরকে কখনও সুযোগ দেয়া হবে না। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনদিনের মধ্যে অবশ্যই তোমাদের প্রতি আযাব নেমে আসবে। যদি তিনি এ ব্যাপারে সত্যবাদী হয়, তবে এখন তাকে কিছু করতে গেলে আল্লাহ্ পাক তোমাদের উপর অধিক অসন্তুষ্ট হবেন । সুতরাং আল্লাহ পাককে অধিক রাগান্বিত করো না। আর যদি তিনি মিথ্যাবাদী হন, তাহলে তোমরা তিনদিন পর যা ইচ্ছা হয় করো। সম্প্রদায়ের লোকেরা এ কথার উপর নির্ভর করে রাতে ফিরে গেল।

আবদুর রহমান বিন আবূ হাতেমের বর্ননায় রয়েছে যে, সামুদ সম্প্রদায়ের নেতারা পরস্পরে পরামর্শ করল যে সালেহ (আঃ) তিনদিন পরে আমাদেরকে ধ্বংস করে আমাদের হাত হতে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা এর পুর্বেই তাকে ও তার অনুসারীদেরকে হত্যা করে তাদের হাত হতে পরিত্রাণ পেতে চাই। হেজর শহরের উপকণ্ঠে এক পাহাড়ের গুহায় হযরত সালেহ (আঃ) একটি নামাযের কুঠুরী প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি সেখানে নামায আদয় করতেন। গোত্রের নেতারা তাকে হত্যা করার জন্য পাহাড়ের গুহার দিকে চলল। তারা বলাবলি করতে লাগল যে, যখন সে নামায পড়বার জন্য এখানে আগমন করবে তখন আমরা তাকে হত্যা করব । তাকে হত্যা করে পরে তার পরিবার পরিজন ও অনুসারীদেরকে হত্যা করব। এ সব কথা বলাবলি করতে করতে তারা গুহার ভিতর প্রবেশ করল, এদিকে আল্লাহপাক তাদের প্রতি বৃষ্টির ন্যায় পাথর বর্ষণ করলেন। তারা অবস্থা বেগতিক দেখে তথা হতে দৌড়ে পলায়ন করতে চাইল কিন্তু সম্ভব হল না। পাথরের আঘাত গুহার ভিতরই চর্বিত ঘাসের ন্যায় হয়ে মরে রইল। তাদের গোত্রের লোকেরা জানতে পারল না যে, তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করা হয়েছে। আর তারা জানল না যে, তাদের বাকী লোকদের সাথে কিরূপ আচরণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক কুরআন মজীদে উল্লেখ করেন-

وَ مَکَرُوۡا مَکۡرًا وَّ مَکَرۡنَا مَکۡرًا وَّ هُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۵۰ فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ مَکۡرِهِمۡ ۙ اَنَّا دَمَّرۡنٰهُمۡ وَ قَوۡمَهُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿۵۱

অর্থঃ “তারা ষড়যন্ত্র করেছে। আর আমিও তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের এক ব্যবস্থা করেছি কিন্তু তারা তা জানে না। সুতরাং তাদের ষড়যন্ত্রের পরিণাম কি হয়েছে দেখে নাও। আমি তাদেরকে এবং তাদের সম্পুর্ণ কওম ধ্বংস করে দিয়েছি।” (সূরাঃ ২৭/ আন-নামালঃ আয়াত-৫০-৫১) 

অতঃপর পরের দিন সকালে হযরত সালেহ (আঃ)-এর কথা অনুসারে তাদের সকলের মুখমণ্ডলের বর্ণ হলুদ হয়ে গেল। যেন তাদের চেহারা হলুদ বর্ণ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা ছিল আযাবের প্রথম নিদর্শন। কিন্তু এ নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার পরও তারা সতর্ক হয়নি। আল্লাহ্ পাকের উপর ঈমান আনয়নের বদলে হযরত সালেহ (আঃ)-এর প্রতি তাদের হিংসা ও গোস্বা আরও অধিক বৃদ্ধি পেল। এখন গোত্রের সকলেই তাঁকে হত্যা করার সুযোগ সন্ধান করতে লাগল। মানুষের যখন অন্তর অন্ধ হয়ে যায় আর মস্তিষ্কের চিন্তাধারায় বিকৃতি আসে তখন লাভকে মনে করে ক্ষতি আর ক্ষতিকে মনে করে লাভ। ভালকে মনে করে খারাপ আর খারাপকে মনে করে ভাল।

শুক্রবারে সকালে নিদ্রা হতে জেগে সকলে নিজনিজ মুখমণ্ডল লাল দেখতে পেল। আর তৃতীয় দিন অর্থাৎ শনিবারে সকালে পরস্পর তাদের মুখমণ্ডল ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ দেখতে পেল। অবশেষে সকলেই নিজেদের জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ল । এখন কেবল আযাবের অপেক্ষা। কেমন আযাব আসবে? কোন্ দিক থেকে এবং কোন্ সময় আসবে? এভাবে শনিবার কেটে রাত্র ও পার হয়ে গেল । পরের দিন রবিবার ভোরে যখন সূর্য উদিত হয়ে পূর্ণভাবে আরো বিকিরণ করেছিল তখন যমীনের নিচের দিক হতে ভয়ানক ভূমিকম্প আরম্ভ হয়ে গেল। গোত্রের সমস্ত লোক দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগল। এমতাবস্থায় আকাশ হতে এক বিকট আওয়াজ ধ্বনিত হল। ফলে সকলেই ঝড়ে পতিত খেজুর বৃক্ষের ন্যায় অধঃমুখ হয়ে মৃত্যুবরণ করল। সম্পূর্ণ এলাকা স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষের কোলাহল এক নিমিষে থেমে গেল। জনাকীর্ণ কোলাহলপূর্ণ জনপদ নীরব, নিথর ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন-

فَاَخَذَتۡهُمُ الرَّجۡفَۃُ فَاَصۡبَحُوۡا فِیۡ دَارِهِمۡ جٰثِمِیۡنَ ﴿۷۸

অর্থঃ অতঃপর তাদেরকে ভূকম্পন আক্রমণ করলে তারা অধঃমুখে আপন গৃহে পড়ে রইল ।" (সূরাঃ ৭/ আল-আ'রাফঃ আয়াত ৭৮)

আল্লাহ্ পাক আরো ইরশাদ করেন-

وَ اَخَذَ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوا الصَّیۡحَۃُ فَاَصۡبَحُوۡا فِیۡ دِیَارِهِمۡ جٰثِمِیۡنَ ﴿ۙ۶۷

অর্থঃ "আর জালেমদেরকে বিকট ধ্বনি পাকড়াও করল ফলে তারা স্ব-গৃহে নিম্নমুখি হয়ে পড়ে রইল ।” (সূরাঃ ১১/ হূদঃ আয়াত ৬৭) 

এক বর্ণনায় আছে যে, চতুর্থ দিনে হযরত জিবরাঈল (আ) খুব জোরে চিৎকার করেন। তার চিৎকারে তাদের অন্তর ফেঁটে গেল। আর সাথে সাথে সকলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ।

অনেক বর্ণনায় আছে যে, সকল কাফেরই ধ্বংস হয়েছিল কেবল মাত্র একটি বাঁদী বেঁচে ছিল। আযাব নাযিল হওয়ার সময় সে বসা ছিল। তার নাম ছিল কলবা বিনতে সলক। সে হযরত সালেহ (আঃ)-এর মারাত্মক দুশমন ছিল। সে আযাব অবতীর্ণ হতে দেখে তার পদদ্বয় সোজা করে দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ল। এভাবে সে বেচে গেল। পরে সে কিভাবে আযাব অবতীর্ণ হয়েছে তা মানুষের নিকট বর্ণনা করেছে। এ সময় সে তৃষ্ণার্ত হয়ে মানুষের কাছে পানি চেয়ে পান করার পর মরে গেল।

অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, আমরা একবার রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে তায়েফের দিকে যাচ্ছিলাম। আমরা আবূ রেগালের কবরের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন এটা আবূ রেগালের কবর। সে বনু সকীফের ঊর্ধ্বতন পুরুষ। সে সামুদ গোত্রের লোক। সামুদ গোত্রের প্রতি আল্লাহর আযাব নাযিলের সময় সে মক্কার হেরম শরীফের ভিতরে ছিল। হেরম শরীফের সম্মানার্থে আল্লাহ্ পাক তাকে আযাব হতে রক্ষা করেছেন। পরে যখন হেরেম শরীফ হতে বের হল তখন যে আযাবে সামুদ সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছিল সে আযাবে সেও মারা গেল। তাই তাকে এখানেই দাফন করা হয়েছে। তাকে দাফনের সময় তার সাথে স্বর্ণের একটি লাঠিও দাফন করা হয়েছে। তোমরা চাইলে কবর খনন করে দেখতে পার। উপস্থিত সাহাবারা কবর খনন করে স্বর্ণের লাঠিটি বের করে আনলেন।

এজন্য তাফসীর বিশারদদের অনেকে বলেন যে, সামুদ গোত্রের সকল কাফেরই ধ্বংস হয়েছিল। একমাত্র আবূ রেগাল বেঁচে ছিল। উপরোল্লিখিত বর্ণনা হতে জানা যায় শুধু কলবা নাম্নী বাঁদী বেঁচে ছিল। আর আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-এর বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কেবল আবূ রেগাল বেঁচে ছিল । সম্ভাবনা রয়েছে যে, উভয়ে বেঁচে ছিল। আবূ রেগাল বেঁচে ছিল হরম শরীফে আর কলবা বেঁচে ছিল হেজর শহরে।

এ ভয়াবহ আযাবের কবলে হযরত সালেহ (আ) ও তাঁর অনুসারীরা পতিত হননি। আল্লাহ পাক স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে রক্ষা করেছিলেন। কথিত আছে যে, হযরত সালেহ (আ)-এর অনুসারীর সংখ্যা ছিল চার হাজার। আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন-

 فَلَمَّا جَآءَ اَمۡرُنَا نَجَّیۡنَا صٰلِحًا وَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَهٗ بِرَحۡمَۃٍ مِّنَّا وَ مِنۡ خِزۡیِ یَوۡمِئِذٍ ؕ اِنَّ رَبَّکَ هُوَ الۡقَوِیُّ الۡعَزِیۡزُ ﴿۶۶

অর্থঃ "অনন্তর আমার আযাবের হুকুম হলে সালেহ এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদের সকলকে স্বীয় রহমত ও অনুগ্রহের দ্বারা আযাব হতে রক্ষা করেছি এবং ঐদিনের লাঞ্ছনা হতেও রক্ষা করেছি। নিশ্চয় আপনার রব মহা শক্তিশালী ও জবরদস্ত।” (সূরাঃ ১১/ হূদঃ আয়াত-৬৬) 

তাফসীরবিদরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সামুদ জাতির পতনের পর হযরত সালেহ (আঃ) তাঁর উম্মতদেরকে সঙ্গে নিয়ে ঐ স্থান পরিত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছেন। তবে তিনি কোথায় গিয়েছিলেন সে সম্পর্কে ওলামাদের মতভেদ রয়েছে। তাফসীরে খাযেনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ফিলিস্তিনে রমলা নামক স্থানে বসবাসের জন্য চলে গিয়েছিলেন। কেননা, এ এলাকা হেজর শহরের কাছেই অবস্থিত। এছাড়া এ স্থান শস্য শ্যামল ও ফল উৎপাদক এলাকা। গৃহপালিত পশু চরাবার উপযুক্ত ঘাস ক্ষেত ও পানি পান করানোর উপযুক্ত ব্যবস্থাও রয়েছে। এজন্য অনেকে মনে করে যে, তাঁরা শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তীনে বসবাস করেছেন। আবার অনেকের ধারণা তিনি শেষপর্যন্ত তাঁর চার হাজার উন্মতসহ ইয়ামেনের কাছে হাজরামাউত এলাকায় চলে যান। কেননা, এটাই তাদের আসল বাসস্থান। সেখানে একটি কবর রয়েছে। কথিত আছে যে, এ কবর সালেহ (আঃ)-এর।

সাইয়েদ আলূসী (রঃ) এর মতে, সামুদ গোত্রের পতনের পর তিনি মক্কায় চলে যান এবং সেখানে বসবাস করেন। এবং সেখানেই তিনি ইনতিকাল করেন। কাবার পশ্চিম দিকে হেরম শরীফের ভিতরেই তাঁর কবর রয়েছে। তিনি এ এলাকা ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় তাঁর উম্মতদেরকে সাথে নিয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত সম্প্রদায়ের কাছে আসেন। এ সময় তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন- কোরআনের ভাষায়-

 یٰقَوۡمِ لَقَدۡ اَبۡلَغۡتُکُمۡ رِسَالَۃَ رَبِّیۡ وَ نَصَحۡتُ لَکُمۡ وَ لٰکِنۡ لَّا تُحِبُّوۡنَ النّٰصِحِیۡنَ 

অর্থঃ “হে আমার কওম আমি আমার রবের পয়গাম তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি এবং আমি তোমাদের কল্যাণ চাচ্ছি। কিন্তু তোমরা কল্যাণ কামনাকারীদেরকে পছন্দ কর না।” (সূরাঃ ৭/ আল-আ'রাফঃ আয়াত ৭৯)




*********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url