মা’আরেফুল কোরআন - ৭৪ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৯৬-২০৩ || হজ ও উমরার বিস্তারিত আহকাম এই আয়াতগুলোর আলোচ্য বিষয়







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৯৬-২০৩


 وَ اَتِمُّوا الۡحَجَّ وَ الۡعُمۡرَۃَ لِلّٰهِ ؕ فَاِنۡ اُحۡصِرۡتُمۡ فَمَا اسۡتَیۡسَرَ مِنَ الۡهَدۡیِ ۚ وَ لَا تَحۡلِقُوۡا رُءُوۡسَکُمۡ حَتّٰی یَبۡلُغَ الۡهَدۡیُ مَحِلَّهٗ ؕ فَمَنۡ کَانَ مِنۡکُمۡ مَّرِیۡضًا اَوۡ بِهٖۤ اَذًی مِّنۡ رَّاۡسِهٖ فَفِدۡیَۃٌ مِّنۡ صِیَامٍ اَوۡ صَدَقَۃٍ اَوۡ نُسُکٍ ۚ فَاِذَاۤ اَمِنۡتُمۡ ٝ فَمَنۡ تَمَتَّعَ بِالۡعُمۡرَۃِ اِلَی الۡحَجِّ فَمَا اسۡتَیۡسَرَ مِنَ الۡهَدۡیِ ۚ فَمَنۡ لَّمۡ یَجِدۡ فَصِیَامُ ثَلٰثَۃِ اَیَّامٍ فِی الۡحَجِّ وَ سَبۡعَۃٍ اِذَا رَجَعۡتُمۡ ؕ تِلۡکَ عَشَرَۃٌ کَامِلَۃٌ ؕ ذٰلِکَ لِمَنۡ لَّمۡ یَکُنۡ اَهۡلُهٗ حَاضِرِی الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ﴿۱۹۶  اَلۡحَجُّ اَشۡهُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡهِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡهُ اللّٰهُ ؕؔ وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ ﴿۱۹۷   لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ اَنۡ تَبۡتَغُوۡا فَضۡلًا مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ فَاِذَاۤ اَفَضۡتُمۡ مِّنۡ عَرَفٰتٍ فَاذۡکُرُوا اللّٰهَ عِنۡدَ الۡمَشۡعَرِ الۡحَرَامِ ۪ وَ اذۡکُرُوۡهُ کَمَا هَدٰىکُمۡ ۚ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مِّنۡ قَبۡلِهٖ لَمِنَ الضَّآلِّیۡنَ ﴿۱۹۸   ثُمَّ اَفِیۡضُوۡا مِنۡ حَیۡثُ اَفَاضَ النَّاسُ وَ اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۹۹   فَاِذَا قَضَیۡتُمۡ مَّنَاسِکَکُمۡ فَاذۡکُرُوا اللّٰهَ کَذِکۡرِکُمۡ اٰبَآءَکُمۡ اَوۡ اَشَدَّ ذِکۡرًا ؕ فَمِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا وَ مَا لَهٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنۡ خَلَاقٍ ﴿۲۰۰   وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ یَّقُوۡلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ حَسَنَۃً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ ﴿۲۰۱   اُولٰٓئِکَ لَهُمۡ نَصِیۡبٌ مِّمَّا کَسَبُوۡا ؕ وَ اللّٰهُ سَرِیۡعُ الۡحِسَابِ ﴿۲۰۲   وَ اذۡکُرُوا اللّٰهَ فِیۡۤ اَیَّامٍ مَّعۡدُوۡدٰتٍ ؕ فَمَنۡ تَعَجَّلَ فِیۡ یَوۡمَیۡنِ فَلَاۤ اِثۡمَ عَلَیۡهِ ۚ وَ مَنۡ تَاَخَّرَ فَلَاۤ اِثۡمَ عَلَیۡهِ ۙ لِمَنِ اتَّقٰی ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّکُمۡ اِلَیۡهِ تُحۡشَرُوۡنَ ﴿۲۰۳

সূরা আল-বাকারাহ ১৯৬-২০৩ নং আয়াতের অর্থ

(১৯৬) আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ওমরাহ্ পরিপূর্ণভাবে পালন কর। যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে কোরবানীর জন্য যা কিছু সহজলভ্য, তাই তোমাদের উপর ধার্য। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা মুণ্ডন করবে না, যতক্ষণ না কোরবানী যথাস্থানে পৌঁছে যাবে। যারা তোমাদের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়বে কিংবা মাথায় যদি কোন কষ্ট থাকে, তাহলে তার পরিবর্তে রোযা করবে কিংবা খয়রাত দেবে অথবা কোরবানী করবে। আর তোমাদের মধ্যে হজ্জ ও ওমরাহ্ একত্রে একই সাথে পালন করতে চাও তবে যা কিছু সহজলভ্য, তা দিয়ে কোরবানী করাই তার উপর কর্তব্য। বস্তুত যারা কোরবানীর পশু পাবে না, তারা হজ্জের দিনগুলোর মধ্যে রোযা রাখবে তিনটি, আর সাতটি রোযা রাখবে ফিরে যাবার পর। এভাবে দশটি রোযা পূর্ণ হয়ে যাবে। এ নির্দেশটি তাদের জন্য, যাদের পরিবার-পরিজন মসজিদুল-হারামের আশেপাশে বসবাস করে না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক। সন্দেহাতীতভাবে জেনো যে, আল্লাহর আযাব বড়ই কঠিন। 
(১৯৭) হজ্জের কয়েকটি মাস আছে সুবিদিত। এসব মাসে যে লোক হজ্জের পরিপূর্ণ নিয়ত করবে, তার পক্ষে স্ত্রীর সাথে নিরাভরণ হওয়া জায়েয নয়। না অশোভন কোন কাজ করা, না ঝগড়া-বিবাদ করা হজ্জের সেই সময় জায়েয। আর তোমরা যা কিছু সৎকাজ কর, আল্লাহ্ তা জানেন। আর তোমরা পাথেয় সাথে নিয়ে নাও। নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর ভয়। আর আমাকে ভয় করতে থাক; হে বুদ্ধিমানগণ! তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করায় কোন পাপ নেই। 
(১৯৮) অতঃপর যখন তওয়াফের জন্য ফিরে আসবে আরাফাত থেকে, তখন মাশআরে হারামের নিকটে আল্লাহকে স্মরণ কর। আর তাঁকে স্মরণ কর তেমনি করে, যেমন তোমাদেরকে হেদায়েত করা হয়েছে আর নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে তোমরা ছিলে অজ্ঞ। 
(১৯৯) অতঃপর তওয়াফের জন্যে দ্রুতগতিতে সেখান থেকে ফিরে আস, যেখান থেকে সবাই ফেরে। আর আল্লাহর কাছেই মাগফেরাত কামনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ক্ষমাকারী, করুণাময়। 
(২০০) আর অতঃপর যখন হজ্জের যাবতীয় অনুষ্ঠান-ক্রিয়াদি সমাপ্ত করে সারবে, তখন স্মরণ করবে আল্লাহকে, যেমন করে তোমরা স্মরণ করতে নিজেদের বাপ-দাদাদেরকে; বরং তার চেয়েও বেশি স্মরণ করবে। তারপর অনেকে তো বলে যে, হে পরওয়ারদেগার, আমাদেরক দুনিয়াতে দান কর। অথচ তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই। 
(২০১) আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, হে পরওয়ারদেগার! আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান কর এবং আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা কর। 
(২০২) এদেরই জন্য অংশ রয়েছে নিজেদের উপার্জিত সম্পদের। আর আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। 
(২০৩) আর স্মরণ কর আল্লাহকে নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েকটি দিনে। অতঃপর যে লোক তাড়াহুড়া করে চলে যাবে, শুধু দু'দিনের মধ্যে, তার জন্যে কোন গোনাহ নেই, আর যে লোক থেকে যাবে তার উপর কোন গোনাহ নেই, অবশ্য যারা ভয় করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করতে থাক এবং নিশ্চিত জেনে রাখ, তোমরা সবাই তাঁর সামনে সমবেত হবে।

সূরা আল-বাকারাহ ১৯৬-২০৩ নং আয়াতের তাফসীর

হজ্জ ও ওমরাহ্ বিষয়ে নির্দেশাবলী

   

দ্বাদশ নির্দেশঃ হজ্জ ও ওমরাহ্ প্রভৃতিঃ আর (যখন হজ্জ ও ওমরাহ্ করতে হয়, তখন) হজ্জ ও ওমরাহ্‌কে আল্লাহ্ (সন্তুষ্টির) জন্য পূর্ণরূপে আদায় কর। (হজ্জের আমলসমূহ ও নিয়ম-কানুন যথাযথ পালনের সঙ্গে সঙ্গে যেন নিয়তও খাঁটি সওয়াব অর্জনেরই থাকে।) অনন্তর যদি (কোন শত্রুর তরফ থেকে অথবা কোন রোগ-ব্যাধির কারণে হজ্জ ও ওমরাহ্ পালনে) বাধাপ্রাপ্ত হও, তবে (সে ক্ষেত্রে নির্দেশ এই যে,) সামর্থ্যানুযায়ী কুরবানী (-এর পশু জবাই) করবে (এবং হজ্জ ও ওমরাহ্’র যে পরিচ্ছদ ধারণ করেছিলে তা খুলে ফেলবে। একে বলা হয় ’ইহরাম’ খোলা। ’ইহরাম, খোলার শরীয়তসম্মত পন্থা হলো মাথা মোড়ানো বা চুল কেটে ফেলা। আর চুল ছোট করার হুকুমও তাই। আর বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইহরাম খোলা শুদ্ধ নয়। বরং) ইহরাম খোলার উদ্দেশ্যে এমন সময় পর্যন্ত মাথা মুণ্ডন করাবে না, যে পর্যন্ত না (ঐ অবস্থায় যেসব) কুরবানী (-এর পশু জবাই করার নির্দেশ ছিল, সেসব পশু) যথাস্থানে না পৌঁছে যায়! (পশু কুরবানীর এই স্থান হলো সম্মানিত ’হরম’ এলাকাভুক্ত। কারণ এসব কুরবানীর পশু হরমের চৌহদ্দির মধ্যেই জবাই করা হয়। সেখানে যদি নিজে না যাওয়া যায়, তবে কারও মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে হবে। যখন কুরবানীর পশু জবাই করার জন্য নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে জবাই হয়ে যায়, তখন ইহরাম খোলা জায়েয হবে।) অবশ্য যদি তোমাদের মধ্যে কোন লোক অসুখে পড়ে অথবা মাথায় বেদনা অথবা উকুন ইত্যাদি কারণে কষ্ট পায় (এবং ঐ অসুখ বা কষ্টের কারণে পূর্বেই মাথা মোড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তবে (তার জন্য মাথা মুড়িয়ে) ফিদ্ইয়া (অর্থাৎ শরীয়ত নির্ধারিত পরিপূরক) দিয়ে দেওয়ার অনুমতি রয়েছে। সে ব্যক্তি তার এই ফিদ্ইয়াটি তিনটি রোযা রেখে (কিংবা ছয়জন মিসকীনকে ফিতরা পরিমাণ অর্থাৎ অর্ধসা’ গম) খয়রাত করলে অথবা (একটা ছাগল) জবাই করে দিলেই ফিদ্ইয়া আদায় হয়ে যায়)। অতঃপর যখন তোমরা শান্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে (অর্থাৎ পূর্ব থেকেই যদি কোন ভয়ভীতি বা সংঘর্ষ হওয়ার পর তা তিরোহিত হয়ে যায়, তবে সে ক্ষেত্রে হজ্জ ও ওমরাহ্ সম্পর্কিত কুরবানী প্রত্যেকের কর্তব্য নয়, বরং ঐ ব্যক্তির কর্তব্য) যে লোক ওমরাহর সঙ্গে হজ্জ মিলিয়ে লাভবান হয়েছে (অর্থাৎ হজ্জের সময় ওমরাহও করেছে, কেবল তারই উপর সামর্থ্য অনুযায়ী) কুরবানী (পশু জবাই করা) ওয়াজিব (আর যে ব্যক্তি কেবল হজ্জ করেছে বা শুধু ওমরাহ্ করেছে, তার জন্য কুরবানী ওয়াজিব নয়।) অতঃপর (হজ্জের নির্ধারিত দিনে যারা এক সঙ্গে হজ্জ ও ওমরাহ্ করে) যাদের কুরবানীর পশু সংগৃহীত না হয় যেমন দরিদ্র ব্যক্তি তাহলে (তাদের পক্ষে কুরবানীর পরিবর্তে) তিন দিনের রোযা রাখা কর্তব্য, হজ্জের দিনগুলোর মধ্যেই (শেষের দিনটি হচ্ছে যিলহজ্জ মাসের নবম তারিখ) এছাড়া সাত দিনের (রোযা কর্তব্য) যখন হজ্জ সমাপনান্তে তোমাদের ফিরে যাওয়ার সময় হবে (অর্থাৎ তোমরা যখন হজ্জের যাবতীয় কাজ শেষ করে ফেলবে, তা তোমরা ফিরে যাও কিংবা সেখানেই থাক।) এভাবে পূর্ণ দশ (দিনের রোযা) হয়ে গেল। (আর একথাও মনে রেখো, এইমাত্র হজ্জ ও ওমরাহ্ একত্রে পালন করার যে নির্দেশ এসেছে) তা (সবার জন্য জায়েয নয়, বরং বিশেষভাবে) সে ব্যক্তির জন্য (জায়েয) যার পরিবার (পরিজন) মসজিদুল হারামের (অর্থাৎ কা’বা ঘরের) নিকটে (আশেপাশে) থাকে না (অর্থাৎ মক্কার জন্য ইহরাম বাঁধার যে সীমানা নির্ধারিত রয়েছে, তার ভেতরে যাদের বাড়ি নয়।) আর (সেসব নির্দেশ সম্পাদন করতে গিয়ে) আল্লাহ্‌কে ভয় করতে থাক (যাতে কোন বিষয়ে কোন ব্যতিক্রম ঘটতে না পারে) এবং (নিশ্চিত করে) জেনে রাখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা (বিরুদ্ধাচারীদিগকে) কঠিন শাস্তি দান করে থাকেন।

হজ্জের (অনুষ্ঠান পালনের) জন্য কতিপয় মাস রয়েছে, যা (প্রসিদ্ধ এবং সবারই কাছে) সুবিদিত। (তার একটি হলো শাওয়াল মাস, দ্বিতীয়টি যিলকদ মাস এবং তৃতীয়টি যিলহজ্জ মাসের দশটি দিন)। সুতরাং যে সব লোক এসব (দিন)-এর মধ্যে (নিজের উপর) হজ্জের দায়িত্ব আরোপ করে নেয় (অর্থাৎ হজ্জের ইহরাম বেঁধে নেয়) তখন (তার জন্য) না কোন অশালীন কথা বলা (জায়েয) হবে, না কোন প্রকার নির্দেশ লংঘন করা চলবে। আর (তার পক্ষে) না কোন প্রকার ঝগড়া (বিবাদ) করা সমীচীন হবে। (বরং তার কর্তব্য হবে সর্বক্ষণ সৎ কাজে মনোনিবেশ করা।) আর (তোমাদের মধ্যে) যারা যে সৎ কাজ করবে আল্লাহ্ সে সম্পর্কে অবহিত থাকেন। (কাজেই তোমরা তার যথার্থ প্রতিদান পাবে।) আর (তোমরা যখন হজ্জের জন্য রওনা হবে তখন প্রয়োজনীয়) খরচ অবশ্যই (সাথে) নিয়ে নেবে। সবচেয়ে বড় কথা (এবং সৌন্দর্য) হচ্ছে, খরচের বেলায় (দারিদ্র্য প্রদর্শন থেকে) বেঁচে থাকা। আর তোমরা যারা বুদ্ধিমান, (এ সব নির্দেশ পালনের বেলায়) আমাকে ভয় করতে থাক (এবং কোন নির্দেশের ব্যতিক্রম করো না)।

(হজ্জের সফরে যাবার সময় যদি তোমরা কিছু বাণিজ্যিক সামগ্রী সাথে নিয়ে নেওয়া ভাল মনে কর, তাহলে) তাতে তোমাদের (হজ্জের মাঝে) সেটুকু জীবিকার অন্বেষণ করার কোনই পাপ হবে না, যা আল্লাহ্ তা’আলা (তোমাদের ভাগ্যে লিখে) রেখেছেন। অতঃপর তোমরা যখন আরাফাতে অবস্থানের পর সেখান থেকে ফেরার পথে মাশআরে হারাম-এর নিকটে (অর্থাৎ মুযদালিফায় এসে রাত্রি যাপন কর এবং ) আল্লাহকে স্মরণ কর (কিন্তু এই স্মরণ করার যে নিয়ম তাতে নিজের কোন মতামত আরোপ করো না, বরং) তেমনিভাবে স্মরণ করবে, যেমন করে (আল্লাহ্ স্বয়ং) বাতলে দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে (আল্লাহ্ কর্তৃক বাতলে দেওয়ার) পূর্বে তোমরা ছিলে নির্বোধ, অজ্ঞ। এছাড়া (এখানে আরও কতিপয় বিষয় স্মরণ রেখো—ইতিপূর্বে কোরাইশরা যেমন নিয়ম করে রেখেছিল যে, সমস্ত হাজী আরাফাত হয়ে সেখান থেকে মুযদালিফায় ফিরে যেতেন, আর) তারা সেখানেই রয়ে যেত; আরাফাতে যেতো না। কিন্তু তা জায়েয নয়, বরং তোমাদের সবাই (কোরাইশ কিংবা অ-কোরাইশ) সে স্থানটি হয়েই আসা কর্তব্য, যেখানে গিয়ে অন্যান্য সবাই ফিরে আসেন। আর (হজ্জের নির্দেশাবলীর ব্যাপারে পুরাতন রীতিনীতির উপর আমল করে থাকলে) আল্লাহর দরবারে তওবা কর। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করে দেবেন এবং অনুগ্রহ করবেন।


(জাহিলিয়াত আমলে কারও কারও অভ্যাস ছিল যে, হজ্জ সমাপনান্তে তারা মিনা’তে সমবেত হয়ে নিজেদের পিতা-পিতামহের গৌরব-বৈশিষ্ট্য বিবৃত করত; বস্তুত আল্লাহ্ তা’আলা এসব নিরর্থক কার্যকলাপের পরিবর্তে স্বীয় আলোচনার শিক্ষা দানকল্পে বলেন,) অতঃপর তোমরা যখন নিজেদের হজ্জের যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পাদন করে নেবে, তখন কৃতজ্ঞতা ও মাহাত্ম্যের সঙ্গে) আল্লাহ্ তা’আলার যিকির করো, যেমন করে তোমরা নিজেদের পিতৃ-পুরুষের স্মরণ করে থাক, বরং এই যিকির তার চেয়েও (বহু গুণ) গভীর হবে। (এবং তাই কর্তব্য। এ ছাড়া আরো কিছু লোকের অভ্যাস ছিল, হজ্জের মাঝে তারা আল্লাহরই যিকির করত, কিন্তু যেহেতু তারা পরকালে বিশ্বাসী ছিল না, তাই তাদের যাবতীয় যিকির পার্থিব কল্যাণ কামনায় ব্যয়িত হতো। আল্লাহ্ তা’আলা শুধু দুনিয়ার সম্পদ লাভের বাসনার নিন্দা করে তদস্থলে দুনিয়া ও আখিরাত—এ উভয় জাহানের কল্যাণ প্রার্থনার প্রতি উৎসাহ দান প্রসঙ্গে ইরশাদ করেনঃ) অতএব, কোন কোন লোক (অর্থাৎ কাফির) এমনও রয়েছে যারা (প্রার্থনা করতে গিয়ে বলেঃ) হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে (যা কিছু দান করবে) এ দুনিয়াতেই দিয়ে দাও (এ-ই যথেষ্ট। সুতরাং তাদের যা কিছু প্রাপ্য, তা তারা দুনিয়াতেই পাবে)। আর এহেন ব্যক্তি আখেরাতে (তার প্রতি অবিশ্বাস হেতু) কোন অংশই পাবে না। আবার কেউ কেউ (অর্থাৎ ঈমানদার) এমনও রয়েছে, যারা প্রার্থনা করতে গিয়ে বলে, ইয়া পরওয়ারদেগার! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান কর এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান কর। আর আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা কর। (বস্তুত এরা উপরোক্ত লোকদের মত হতভাগ্য নয়। বরং) এমন সব ব্যক্তিকে (উভয় জাহানের) বিরাট অংশ দেওয়া হবে, তাদের এই আমল (অর্থাৎ উভয় জাহানের কল্যাণ কামনার কারণে।) আর আল্লাহ্ শীঘ্রই হিসাব গ্রহণ করবেন। (কারণ কিয়ামতে হিসাব-নিকাশ হবে, আর কিয়ামত ক্রমাগতই ঘনিয়ে আসছে। শীঘ্রই যখন হিসাব গৃহীত হতে যাচ্ছে, তখন সেখানকার মঙ্গল-অমঙ্গল সম্পর্কে বিস্তৃত হয়ে যেয়ো না।) আর (’মিনা’তে বিশেষ প্রক্রিয়ায়) আল্লাহ্‌কে স্মরণ কর কয়েকদিন পর্যন্ত। (বিশেষত সে প্রক্রিয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট পাথরের প্রতি কাঁকর নিক্ষেপ করা। আর সে কয়েকটি দিন হচ্ছে, যিলহজ্জ মাসের দশ এগার ও বার তারিখ কিংবা তের তারিখও বটে, যাতে কাঁকর নিক্ষেপ করা হয়)। তারপর যে লোক কাঁকর নিক্ষেপ করে (দশই তারিখের পর) দু’দিনের মধ্যে (মক্কায় ফিরে আসার ব্যাপারে) তাড়াহুড়া করে, তার কোন পাপ হবে না। আর যে লোক (উল্লিখিত) দু’দিনের মাঝে (মক্কায়) ফিরে আসার ব্যাপারে দেরি করে (অর্থাৎ ১২ তারিখে না এসে বরং ১৩ তারিখে আসে) তারও কোন পাপ হবে না। (আর এসব বিষয়) তার জন্যই (নির্ধারিত) যে আল্লাহকে ভয় করে (এবং যে ভয় করে না, তার তো পাপ-পুণ্যের কোন বালাই নেই)। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক এবং সুদৃঢ় বিশ্বাস রেখো, তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে।

সূরা আল-বাকারাহ ১৯৬-২০৩ নং আয়াতের বিষয় বস্তু

হজ্জ ও ওমরার আহকাম

হজ্জ ও ওমরার আহকামঃ ’বির্’ বা প্রকৃত সৎকর্ম সংক্রান্ত পরিচ্ছেদসমূহ, যার ধারা সূরা বাকারার মাঝামাঝি থেকে চলছে, তাতে ১১তম নির্দেশ হচ্ছে হজ্জ সংক্রান্ত। আর হজ্জের সম্পর্ক যেহেতু মক্কা-মোকাররমা ও বায়তুল্লাহ অর্থাৎ কা’বা গৃহের সাথে জড়িত, সুতরাং এর সাথে সম্পৃক্ত কিছু মাস’আলা-মাসায়েল প্রসঙ্গক্রমে কেবলার বর্ণনা প্রসঙ্গে সূরা বাকারার ১২৫তম আয়াত থেকে ১২৮তম আয়াত পর্যন্ত (وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً থেকে وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا পর্যন্ত) আলোচিত হয়েছে। অতঃপর কেবলার প্রসঙ্গান্তে إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ আর্য়াতে সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে সায়ী করার নির্দেশও প্রসঙ্গত বর্ণিত হয়েছে। এক্ষণে আয়াত ১৯৬ থেকে ২০৩ পর্যন্ত (অর্থাৎ وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ থেকে শুরু করে فَمَنْ تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ পর্যন্ত) ধারাবাহিকভাবে হজ্জ ও ওমরাহর আহকাম ও মাসায়েলের সাথে সম্পৃক্ত।

হজ্জ সর্বসম্মতভাবে ইসলামের আরকানসমূহের মধ্যে একটি রুকন এবং ইসলামের ফরায়েয বা অবশ্য করণীয় বিষয়সমূহের মধ্যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফরয। কোরআনের বহু আয়াত এবং অসংখ্য হাদীসের মাধ্যমে এর প্রতি তাকীদ করা হয়েছে এবং এর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

অধিকাংশ ওলামায়ে-কেরামের মতে হিজরী তৃতীয় বছর, যে বছর ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সে বছরই সূরা আলে-ইমরানের একটি (وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ) আয়াতের মাধ্যমে হজ্জ ফরয করা হয়েছে। (ইবনে কাসীর) এ আয়াতেই হজ্জ ফরয হওয়ার শর্তসমূহ এবং মর্মার্থ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও হজ্জ না করার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

উপরোল্লিখিত আটটি আয়াতের মধ্যে প্রথম আয়াতঃ وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ -মুফাসসিরীনের ঐকমত্য অনুযায়ী হুদায়বিয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে যা ৬ষ্ঠ হিজরী সালে সংঘটিত হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, এ আয়াতের উদ্দেশ্য হজ্জ ফরয হওয়ার বিষয় বাতলানো নয়, তা পূর্বেই বাতলে দেওয়া হয়েছে, বরং এখানে উদ্দেশ্য হলো হজ্জ ও ওমরাহর কিছু বিশেষ নির্দেশ বর্ণনা করা।

ওমরার আহকাম

ওমরার আহকামঃ সূরা আলে ইমরানের যে আয়াতের মাধ্যমে হজ্জ ফরয করা হয়েছে তাতে যেহেতু শুধু হজ্জের কথাই বলা হয়েছে, ওমরার কোন আলোচনাই করা হয়নি, আর এই আয়াতে যাতে শুধু ওমরার কথাই আলোচনা করা হয়েছে, এর ফরয কিংবা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কোন কথাই বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে যে, কোন লোক যদি ইহরামের মাধ্যমে হজ্জ অথবা ওমরাহ আরম্ভ করে, তাহলে তার পক্ষে তা সম্পাদন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। যেমন সাধারণ নফল নামায-রোযার ব্যাপারে এই হুকুম যে, তা আরম্ভ করলে সম্পাদন করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। কাজেই এই আয়াতের দ্বারা ওমরাহ ওয়াজিব কি না তা বোঝায় না। বরং আরম্ভ করলে শেষ করতে হবে, তাই বোঝায়।

ইবনে কাসীর হযরত জাবিরের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেনঃ তিনি রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন । হুযূর ! ওমরাহ কি ওয়াজিব? তিনি বলেছিলেনঃ ওয়াজিব নয়, তবে যদি কর, খুবই ভাল। তিরমিযী বলেছেন, এই হাদীস সহীহ ও হাসান। সুতরাং ইমাম আবূ হানীফা (র) ও ইমাম মালেক (র) প্রমুখ ওমরাহকে ওয়াজিব বলেননি, সুন্নত বলে গণ্য করেছেন। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, হজ্জ অথবা ওমরাহ্ শুরু করলে তা আদায় করা ওয়াজিব। তবে প্রশ্ন উঠে, যদি কোন ব্যক্তি ওমরাহ্ শুরু করার পর কোন অসুবিধায় পড়ে তা আদায় করতে না পারে তাহলে কি হবে ? এর উত্তর পরবর্তী فَإِنْ أُحْصِرْتُمْ এ বাক্যে দেওয়া হয়েছে।

ইহরাম বাঁধার হজ্জ ওমরাহ্ করতে পারলে

ইহরাম বাঁধার পর কোন অসুবিধার জন্য হজ্জ অথবা ওমরাহ্ আদায় করতে না পারলে কি করতে হবেঃ এ আয়াত হুদায়বিয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। তখন রাসূল (সা) এবং সাহাবীগণ ইহরাম অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু মক্কার কাফিররা তাঁদেরকে হেরেমের সীমায় প্রবেশ করতে দেয়নি। ফলে তাঁরা ওমরাহ্ আদায় করতে পারলেন না। তখন আদেশ হলো ইহরামের ফিদইয়া স্বরূপ একটি করে কুরবানী কর। কুরবানী করে ইহরাম ভেঙ্গে ফেল। কিন্তু সাথে সাথে পরবর্তী আয়াত- وَلَا تَحْلِقُوا رُءُوسَكُمْ -এ বলে দেওয়া হয়েছে যে, ইহরাম খোলার শরীয়তসম্মত ব্যবস্থা মাথার চুল কাটা বা ছাঁটা ততক্ষণ পর্যন্ত জায়েয নয়, যতক্ষণ না ইহরামকারীর কুরবানী নির্ধারিত স্থানে পৌঁছবে।

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে নির্ধারিত স্থানের সীমানা হচ্ছে হেরেমের এলাকায় পৌঁছে কুরবানীর পশু জবেহ করা। তা নিজে না পারলে অন্যের দ্বারা জবাই করাতে হবে। এ আয়াতে অপারকতা অর্থ হচ্ছে, রাস্তায় কোন শত্রু কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হওয়া বা প্রাণনাশের আশংকা থাকা। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা (র) ও অন্যান্য কোন কোন ইমাম অসুস্থতাকেও অপারকতার আওতাভুক্ত করেছেন। তবে রাসূল (সা)-এর আমল দ্বারাও প্রমাণিত হয়েছে যে, কুরবানী করেই ইহরাম ছাড়তে হবে। কিন্তু বাতিলকৃত হজ্জ বা ওমরাহ্ কাযা করা ওয়াজিব। যেমন হুযূর (সা) এবং সাহাবায়ে কেরাম হুদায়বিয়া সন্ধির পরবর্তী বছর উল্লিখিত ওমরাহর কাযা আদায় করেছিলেন।

এ আয়াতে মাথা মুণ্ডনকে ইহরাম ভঙ্গ করার নিদর্শন বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় যে, ইহরাম অবস্থায় মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটা অথবা কাটা নিষিদ্ধ। এ হিসাবে পরবর্তী নির্দেশে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি হজ্জ ও ওমরাহ্ আদায় করতে গিয়ে কোন অসুবিধার সম্মুখীন নাও হয়, কিন্তু অন্য কোন অসুবিধার দরুন মাথা মুণ্ডন করতে বা মাথার চুল কাটাতে বাধ্য হয়, তবে তাকে কি করতে হবে?

ইহরাম অবস্থায় মাথা মুণ্ডন করলে

ইহরাম অবস্থায় কোন কারণে মাথা মুণ্ডন করলে কি করতে হবেঃ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ بِهِ أَذًى مِنْ رَأْسِهِ এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, যদি কোন অসুস্থতার দরুন মাথা বা শরীরের অন্য কোন স্থানের চুল কাটতে হয় অথবা মাথায় উকুন হওয়াতে বিশেষ কষ্ট পায়, তবে এমতাবস্থায় মাথার চুল বা শরীরের অন্য কোন স্থানের লোম কাটা জায়েয। কিন্তু এর ফিদইয়া বা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, আর তা হচ্ছে রোযা রাখা বা সদকা দেওয়া বা কুরবানী করা। কুরবানীর জন্য হেরেমের সীমারেখা নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু রোযা রাখা বা সদকা দেওয়ার জন্য কোন বিশেষ স্থান নির্ধারিত নেই। তা যে কোন স্থানে আদায় করা চলে। কোরআনের শব্দের মধ্যে রোযার কোন সংখ্যা নির্ধারিত নেই এবং সদকারও কোন পরিমাণ নির্দেশ করা হয়নি। কিন্তু রাসূলে করীম (সা) সাহাবী কা‘আব ইবনে ‘উজরাহর এমনি অবস্থার প্রেক্ষিতে ইরশাদ করেছেন, তিনটি রোযা এবং ছয়জন মিসকীনকে মাথা পিছু অর্ধ সা’ গম দিতে হবে। (বোখারী)

অর্ধ সা’ আমাদের দেশে প্রচলিত ৮০ তোলার সের হিসাবে প্রায় পৌনে দু-সের গমের সমান। এ পরিমাণ গমের মূল্য দিয়ে দিলেও চলবে।

হজ্জ ও ওমরাহ্ একত্রে আদায় করার নিয়ম

হজ্জ মৌসুমে হজ্জ ও ওমরাহ্ একত্রে আদায় করার নিয়মঃ ইসলাম-পূর্ব যুগে আরববাসীদের ধারণা ছিল হজ্জের মাস আরম্ভ হয়ে গেলে অর্থাৎ শাওয়াল মাস এসে গেলে হজ্জ ও ওমরাহ্ একত্রে আদায় করা অত্যন্ত পাপ।

এ আয়াতে তাদের এ ধারণার নিরসন করে বলা হয়েছে যে, মীকাতের অভ্যন্তরে বসবাসকারীদের জন্য এ সময়ের মধ্যে হজ্জ ও ওমরাহ্ একত্রে সমাধা করা নিষেধ। কারণ তাদের পক্ষে হজ্জের মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ওমরাহর জন্য দ্বিতীয়বার মীকাতে গমন করা তেমন অসুবিধার ব্যাপার নয়। কিন্তু এ সীমারেখার বাইরে থেকে যারা হজ্জ করতে আসে, তাদের জন্যে দু’টিকেই একত্রে আদায় করা জায়েয করে দেওয়া হয়েছে। কেননা এত দূর-দূরান্ত থেকে ওমরার জন্য পৃথকভাবে ভ্রমণ করা খুবই কঠিন ও অসুবিধাজনক। সে সমস্ত নির্ধারিত স্থানকে মীকাত বলা হয়, যা সারা বিশ্বের হজ্জযাত্রীগণ যিনি যে দিক হতে আগমন করেন, যেসব রাস্তার প্রত্যেকটিতে একটি স্থান আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যখনই মক্কায় আগমনকারীরা এ স্থানে আসবে, তখন হজ্জ অথবা ওমরার নিয়তে ইরাম করা আবশ্যক। ইহরাম ব্যতীত এ স্থান হতে সামনে অগ্রসর হওয়া গোনাহের কাজ। যেমন বলা হয়েছে لِمَنْ لَمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ -এর অর্থ তাই। অর্থাৎ যাদের পরিবার-পরিজন মীকাতের সীমারেখার অভ্যন্তরে বসবাস করে না, তাদের জন্য হজ্জ ও ওমরাহ্ হজ্জ্বের মাসে একত্রে করা জায়েয।

অবশ্যই যারা হজ্জের মৌসুমে হজ্জ ও ওমরাহ্‌কে একত্রে আদায় করে, তাদের উপর এ দু’টি ইবাদতের শুকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব। তা হচ্ছে, কুরবানী করার সামর্থ্য যাদের রয়েছে তারা বকরী, গাভী, উট প্রভৃতি যা তাদের জন্য সহজলভ্য হয় তা থেকে কোন একটি পশু কুরবানী করবে। কিন্তু যাদের কুরবানী করার মত আর্থিক সঙ্গতি নেই তারা দশটি রোযা রাখবে। হজ্জের ৯ তারিখ পর্যন্ত তিনটি আর হজ্জ সমাপনের পর সাতটি রোযা রাখতে হবে। এ সাতটি রোযা যেখানে এবং যখন সুবিধা, তখনই আদায় করতে পারে। হজ্জের মধ্যে যে ব্যক্তি তিনটি রোযা পালন করতে না পারে, ইমাম আবূ হানীফা (র) এবং কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট সাহাবীর মতে তাদের জন্য কুরবানী করাই ওয়াজিব। যখন সামর্থ্য হয়, তখন কারো দ্বারা হেরেম শরীফে কুরবানী আদায় করবে।

তামাত্তু ও কেরান

তামাত্তু ও কেরানঃ হজ্জ্বের মাসে হজ্জের সাথে ওমরাহকে একত্রিকরণের দু’টি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে— মীকাত হতে হজ্জ ও ওমরাহর জন্য একত্রে ইহরাম করা। শরীয়তের পরিভাষায় একে ’হজ্জে-কেরান’ বলা হয়। এর ইরাম হজ্জের ইহরামের সাথেই ছাড়তে হয়, হজ্জের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে ইহরাম অবস্থায়ই কাটাতে হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, মীকাত হতে শুধু ওমরাহর ইহরাম করবে। মক্কা আগমনের পর ওমরাহর কাজকর্ম শেষ করে ইহরাম খুলবে এবং ৮ই যিলহজ্জ তারিখে মিনা যাবার প্রাক্কালে হারাম শরীফের মধ্যেই হজ্জের জন্য ইহরাম বেঁধে নেবে। শরীয়তের পরিভাষায় একে বলা হয় তামাত্তু কিন্তু فَمَنْ تَمَتّعَ َএ সাধারণ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

হজ্জ ও ওমরার আহকামে গাফলতি

হজ্জ ও ওমরার আহকামের বিরুদ্ধাচরণ এবং তাতে গাফলতি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধঃ শেষ আয়াতটিতে প্রথমে তাকওয়া অবলম্বন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে; যার অর্থ এসব নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত, সাবধান ও ভীত থাকা বোঝায়। অতঃপর বলা হয়েছে— وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ অর্থাৎ যে ব্যক্তি জেনেশুনে আল্লাহর নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে, তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। আজকাল হজ্জ ও ওমরাকারীগণের অধিকাংশই এ সম্পর্কে অসতর্ক। তারা প্রথমত হজ্জ ও ওমরাহর নিয়মাবলী জানতেই চেষ্টা করে না। আর যদিও বা জেনে নেয়, অনেকেই তা যথাযথভাবে পালন করে না। অনেকেই দায়িত্ব-জ্ঞানহীন মোয়াল্লেম ও সঙ্গীদের পাল্লায় পড়ে অনেক ওয়াজিবও পরিত্যাগ করে। আর সুন্নত ও মুস্তাহাবের তো কথাই নেই। আল্লাহ্ সবাইকে নিজ নিজ আমল যথাযথভাবে পালন করার তওফীক দান করুন।

হজ্জের মাস

হজ্জ সংক্রান্ত ৮টি আয়াতের মধ্যে দ্বিতীয় আয়াত ও তার মাস’আলাসমূহঃ الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ ’আশহুরুন’ শব্দটি ’শাহরুন’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ—মাস। পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছিল, যারা হজ্জ অথবা ওমরাহ্ করার নিয়তে ইহরাম বাঁধে, তাদের উপর এর সকল অনুষ্ঠানক্রিয়াদি সম্পন্ন করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। এ দু’টির মধ্যে ওমরাহর জন্য কোন সময় নির্ধারিত নেই। বছরের যে কোন সময় তা আদায় করা যায়। কিন্তু হজ্জের মাস এবং এর অনুষ্ঠানাদি আদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কাজেই এ আয়াতের শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছে যে, হজ্জের ব্যাপারটি ওমরার মত নয়। এর জন্য কয়েকটি মাস নির্ধারিত রয়েছে—সেগুলি প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত। জাহিলিয়তের যুগ থেকে ইসলামের আবির্ভাবের যুগ পর্যন্ত এ মাসগুলোই হজ্জের মাসরূপে গণ্য হয়ে আসছে। আর তা হচ্ছে শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহজ্জের দশ দিন। আবু উমামাহ্ ও ইবনে উমর (রা) হতে তা-ই বর্ণিত হয়েছে।-(মাযহারী) হজ্জের মাস শাওয়াল হতে আরম্ভ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এর পূর্বে হজ্জের ইহরাম বাঁধা জায়েয নয়। কোন কোন ইমামের মতে শাওয়ালের পূর্বে হজ্জের ইহরাম করলে হজ্জ আদায়ই হবে না। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে হজ্জ অবশ্য আদায় হবে, কিন্তু মাকরূহ হবে। (মাযহারী)

فَمَنْ فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ

এ আয়াতে হজ্জের ইহরামকারীদের জন্য নিষিদ্ধ কাজ-কর্মের কিছুটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ইহরাম অবস্থায় যেসব বিষয় থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য ও ওয়াজিব। আর তা হচ্ছে ’রাফাস’, ’ফুসূক’ ও ’জিদাল’। رَفَثَ ’রাফাস’ একটি ব্যাপক শব্দ, যাতে স্ত্রী সহবাস ও তার আনুষঙ্গিক কর্ম, স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা, এমনকি খোলাখুলিভাবে সহবাস সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনাও এর অন্তর্ভুক্ত। ইহরাম অবস্থায় এ সবই হারাম। অবশ্য আকার-ইঙ্গিত দূষণীয় নয়।

فُسُوقَ ’ফুসূক’-এর শাব্দিক অর্থ বাহির হওয়া। কোরআনের ভাষায় নির্দেশ লংঘন বা নাফরমানী করাকে ‘ফুসূক’ বলা হয়। সাধারণ অর্থে যাবতীয় পাপকেই ’ফুসূক’ বলে। তাই অনেকে এস্থলে সাধারণ অর্থই নিয়েছেন। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা) এস্থলে ’ফুসূক’ শব্দের অর্থ করেছেন—সে সকল কাজ-কর্ম, যা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ। স্থান অনুসারে এই ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত। কারণ সাধারণ পাপ ইহরামের অবস্থাতেই শুধু নয়, বরং সব সময়ই নিষিদ্ধ। 

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ ৬টি কাজ

যে সমস্ত বিষয় প্রকৃতপক্ষে নাজায়েয ও নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু ইহরামের জন্য নিষিদ্ধ ও না-জায়েয তা হচ্ছে ছয়টিঃ

(১) স্ত্রী-সহবাস ও এর আনুষঙ্গিক যাবতীয় আচরণ, এমনকি খোলাখুলিভাবে সহবাস সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা। 
(২) স্থলভাগের জীবজন্তু শিকার করা বা শিকারীকে বলে দেওয়া 
(৩) নখ বা চুল কাটা। 
(৪) সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যবহার। এ চারটি বিষয় স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্যই ইহরাম অবস্থায় হারাম বা নিষিদ্ধ। অবশিষ্ট দু’টি বিষয় পুরুষের সাথে সম্পৃক্ত। 
(৫) সেলাই করা কাপড় পরিধান করা 
(৬) মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা। অবশ্য মুখমণ্ডল আবৃত করা স্ত্রীলোকদের জন্যও না-জায়েয ।

আলোচ্য ছ’টি বিষয়ের মধ্যে স্ত্রী সহবাস যদিও ‘ফুসূক’ শব্দের অন্তর্ভুক্ত, তথাপি একে ’রাফাস’ শব্দের দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে এজন্য ব্যক্ত করা হয়েছে যে, ইহরাম অবস্থায় এ কাজ হতে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এর কোন ক্ষতিপূরণ বা বদলা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কোন কোন অবস্থায় এটা এত মারাত্মক যে, এতে হজ্জই বাতিল হয়ে যায়। অবশ্য অন্য কাজগুলোর কাফ্ফারা বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আরাফাতে অবস্থান শেষ হওয়ার পূর্বে স্ত্রী-সহবাস করলে হজ্জ ফাসেদ হয়ে যাবে। গাভী বা উট দ্বারা এর কাফ্ফারা দিয়েও পর বছর পুনরায় হজ্জ করতেই হবে। এজন্যই فَلَا رَفَثَ শব্দ ব্যবহার করে একে স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

جِدَالَ শব্দের অর্থে একে অপরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করা। এজন্যই বড় রকমের বিবাদকে جِدَالَ  বলা হয়। এ শব্দটিও অতি ব্যাপক। কোন কোন মুফাসসির এ শব্দের ব্যাপক অর্থই গ্রহণ করেছেন। আবার অনেকে হজ্জ ও ইহরামের সম্পর্ক হেতু এখানে ’জিদাল’-এর অর্থ করেছেন যে, জাহিলিয়তের যুগে আরববাসিগণ অবস্থানের স্থান নিয়ে মতানৈক্য করতো; কেউ কেউ আরাফাতে অবস্থান করাকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করতো, আবার কেউ কেউ মুযদালিফাতে অবস্থানকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করতো। তারা আরাফাতে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করতো না। পথিমধ্যে অবস্থিত একটি স্থানকেই ইবরাহীম (আ)-এর নির্ধারিত অবস্থানস্থল বলে মনে করতো। এমনিভাবে হজ্জের সময় সম্পর্কেও তারা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করতো। কেউ কেউ যিলহজ্জ মাসে হজ্জ করতো, আবার কেউ কেউ যিলকদ মাসে। এসব ব্যাপারে তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হতে থাকতো এবং এজন্য একে অপরকে পথভ্রষ্ট বলে অভিহিত করতো। তাই কোরআনে করীম وَلَا جِدَالَ বলে এসব বিবাদের মূলোৎপাটন করেছে। আর আরাফাতে অবস্থানকে ফরয এবং মুযদালিফাতে অবস্থানকে ওয়াজিব করা হয়েছে। এটাই হক ও সঠিক। উপরন্তু যিলহজ্জ মাসের নির্ধারিত দিনগুলোতেই হজ্জ আদায় করতে হবে—এ ঘোষণা করে এর বিরুদ্ধে ঝগড়া করাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আবার কেউ কেউ এ স্থলে ’ফুসূক’ ও ‘জিদাল’ শব্দদ্বয়কে সাধারণ অর্থে ব্যবহার করে এ অর্থ নিয়েছেন যে, ’ফুসূক’ ও ’জিদাল সবক্ষেত্রেই পাপ ও নিষিদ্ধ, কিন্তু ইহরামের অবস্থায় এর পাপ আরো অধিক। পবিত্র দিনসমূহে এবং পবিত্র স্থানে, যেখানে কেবল আল্লাহর ইবাদতের জন্য আগমন করা হয়েছে এবং ’লাব্বাইকা লাব্বাইকা’ বলা হচ্ছে, ইহরামের পোশাক তাদেরকে সব সময় একথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, তোমরা এখন ইবাদতে ব্যস্ত, এমতাবস্থায় ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি অত্যন্ত অন্যায় ও চরমতম নাফরমানীর কাজ।

সাধারণ ও ব্যাপক অর্থে ‘ফুসূক’, ’রাফাস’ ও ’জিদাল’ থেকে বিরত করা এবং এসব বিষয়কে হারাম গণ্য করার একটা কারণ এও হতে পারে যে, হজ্জের স্থান ও সময় মানুষের অবস্থা এমনি দাঁড়ায় যে, তার ফলে উল্লিখিত তিনটি বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার বহু আশংকা সৃষ্টি হয়। ইহরামের সময় প্রায়ই দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিজের পরিবার-পরিজন থেকে বহু দূরে অবস্থান করতে হয় । তাছাড়া তওয়াফ, সায়ী, আরাফাত, মুযদালিফা ও মিনার সমাবেশে যতই সতর্কতা অবলম্বন করা হোক, স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশা হয়েই থাকে। এমতাবস্থায় পূর্ণ সংযম অবলম্বন করা সহজ ব্যাপার নয়। কাজেই সর্বপ্রথম রাফাস-এর হারামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এমনিভাবে এ সমাবেশে চুরি ও অন্যান্য পাপ বা অপরাধও সাধারণত হওয়ার আশংকা থাকে প্রচুর । সেজন্য وَلَا فُسُوقَ বলে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে হজ্জব্রত পালনের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত এমন বহু সময় আসে, যাতে সফরসঙ্গী ও অন্যান্য মানুষের সাথে জায়গা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাধার খুবই আশংকা থাকে। কাজেই وَلَا جِدَالَ (কোন বিবাদ বিসংবাদ নয়) বলে এ সবকিছু থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কোরআনের ভাষালঙ্কার

কোরআনের ভাষালঙ্কারঃ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ  আয়াতের শব্দগুলো ‘না’-বাচক। হজ্জের মধ্যে এসব বিষয় নেই, অথচ উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সকল বিষয়ের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করা; যার জন্য لَا تَرَفُثُوْا وَلَا تَفْسُقُوْا وَلَا تُجَادِلُوْا শব্দ ব্যবহার করা উচিত ছিল। কিন্তু এখানে না-সূচক শব্দ ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হজ্জের মধ্যে এসব বিষয়ের কোন অবকাশ নেই। এমনকি এ সবের কল্পনাও হতে পারে না وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللَّهُ ইহরামকালে নিষিদ্ধ বিষয়াদি বর্ণনা করার পর উল্লিখিত বাক্যে হেদায়েত করা হচ্ছে যে, হজ্জের পবিত্র সময়ে ও পূতঃ স্থানগুলোতে শুধু নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং সুবর্ণ সুযোগ মনে করে আল্লাহর যিকির ও ইবাদত এবং সৎ কাজে সদা আত্মনিয়োগ কর। তুমি যে কাজই কর না কেন, তা আল্লাহ্ তা’আলা জানেন; আর এতে তোমাদেরকে অতি উত্তম বখশিশও দেওয়া হবে।

وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى - এ আয়াতে ঐ সমস্ত ব্যক্তির সংশোধনী পেশ করা হয়েছে, যারা হজ্জ ও ওমরাহ্ করার জন্য নিঃস্ব অবস্থায় বেরিয়ে পড়ে। অথচ দাবি করে যে, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করছি। পক্ষান্তরে পথে ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। নিজেও কষ্ট করে এবং অন্যকেও পেরেশান করে বলে, তাদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, হজ্জের উদ্দেশ্যে সফর করার আগে প্রয়োজনীয় পাথেয় সাথে নেওয়া বাঞ্ছনীয়, এটা তাওয়াক্কুলের অন্তরায় নয়। বরং আল্লাহর উপর ভরসা করার প্রকৃত অর্থই হচ্ছে আল্লাহ্প্রদত্ত আসবাবপত্র নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সংগ্রহ ও জমা করে নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করা। হুযূর (সা) হতে তাওয়াক্কুলের এই র‍্যাখ্যাই বর্ণিত হয়েছে। নিঃস্বতার নাম তাওয়াক্কুল বলা মূর্খতারই নামান্তর।

হজ্জের সফরে উপার্জন

হজ্জের সফরে ব্যবসা করা বা অন্যের কাজ করে রোজগার করাঃ لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ অর্থাৎ ’হজ্জের উদ্দেশ্যে সফরকালে ব্যবসায় বা মজ্দুরী করে কিছু উপার্জন করে নিলে কিংবা আল্লাহর দেয়া রিযিকের অন্বেষণ করলে তা তোমাদের জন্য দূষণীয় নয়।’

এ আয়াতের শানে-নুযুলের ঘটনা হচ্ছে এই যে, জাহিলিয়তের যুগে আরববাসিগণ যাবতীয় ইবাদত ও আচার-অনুষ্ঠানকে বিকৃত করে তাতে নানারকম অর্থহীন বিষয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল এবং ইবাদতকেও একেকটা তামাশার বস্তুতে পরিণত করে দিয়েছিল। এমনিভাবে হজ্জের আচার-অনুষ্ঠানেও তারা নানারকম গর্হিত কার্যকলাপে লিপ্ত হতো। মিনার সমাবেশ উপলক্ষে তাদের বিশেষ আড়ং বসত। প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হতো। ব্যবসা সম্প্রসারণের নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া হতো। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের পরে যখন মুসলমানদের উপর হজ্জ ফরয এবং এসব বেহুদা প্রথা রহিত করে দেওয়া হয়, তখন সাহাবীগণ (রা) যাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রাসূল (সা)-এর শিক্ষার পিছনে স্বীয় জানমাল কুরবান করতে প্রস্তুত ছিলেন, তাঁরা ভাবলেন, হজ্জের মওসুমে ব্যবসা বা কাজকর্ম করে কিছু উপার্জন করাও তো অন্ধকার যুগেরই উদ্ভাবন। ইসলাম হয়তো একে সম্পূর্ণ নিষেধ ও হারাম বলেই ঘোষণা করে দেবে। এমনকি এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর নিকট এসে প্রশ্ন করলেন, উট ভাড়া দেওয়া পূর্ব থেকেই আমার ব্যবসা। হজ্জের মওসুমে কেউ কেউ আমার উট ভাড়ায় নেয়, আমিও তাদের সাথে যাই এবং হজ্জ করে আসি। তাতে কি আমার হজ্জ সিদ্ধ হবে না? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বললেন, রাসূল (সা)-এর নিকটও এমনি এক ব্যক্তি এসেছিল এবং এমনি প্রশ্ন করেছিল । কিন্তু তিনি لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকে কোন উত্তর দেন নি। আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর তিনি তাকে ডেকে বলেন, হ্যাঁ তোমার হজ্জ শুদ্ধ হবে।

যা হোক, এ আয়াতে একথা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, হজ্জের সফরকালে কোন ব্যক্তি যদি কিছু ব্যবসা বা পরিশ্রম করে কিছু উপার্জন করে নেয়, তবে তাতে কোন দোষ নেই। তবে আরবের কাফিররা হজ্জকে যেরূপ ব্যবসার বাজার ও তামাশার বস্তুতে পরিণত করেছিল, কোরআন দু’টি বাক্যের দ্বারা তার সংশোধন করে দিয়েছে। তার একটি হলো এই যে, তোমরা যা কিছু উপার্জন করবে তা আল্লাহর অনুগ্রহ বিবেচনা করে সেজন্য কৃতজ্ঞ থাকবে। তাতে শুধু মুনাফা সংগ্রহই যেন উদ্দেশ্য না হয়।

فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ - বাক্যটিতে ঐদিকই ইঙ্গিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এ উপার্জনে তোমাদের কোন পাপ হবে না। এতে আরো ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ উপার্জন থেকেও যদি বেঁচে থাকতে পার, তবে আরো উত্তম। কেননা এতে পরিপূর্ণ আন্তরিকতা বা ইখলাসের মাঝে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে। তবে প্রকৃত বিষয়টি নিয়তের উপর নির্ভরশীল। যদি কারো মুখ্য উদ্দেশ্য পার্থিব মুনাফা অর্জন হয়, আর হজ্জের নিয়তটি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে অথবা হজ্জ ও ব্যবসা—উভয় নিয়ত সমান সমান হয়, তবে তা হবে ইখলাসের পরিপন্থী। এতে হজ্জের সওয়াব কম হবে। আর হজ্জের যে উপকারিতা ও বরকত হওয়া বিধেয় ছিল, তাও কম হবে। আর যদি প্রকৃত নিয়ত হজ্জই হয় এবং এ উদ্দেশ্যেই বের হয়ে থাকে, কিন্তু রাস্তা বা ঘরের খরচাদির অভাব পূরণ করার জন্য সামান্য ব্যবসা বা কাজকর্ম করে কিছু উপার্জন করে নেয়, তাহলে তা ইখলাসের পরিপন্থী নয়। এ ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে এই যে পাঁচদিন একান্তভাবে হজ্জের কাজগুলি করা হয় সে পাঁচদিন ব্যবসা বা কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে শুধু ইবাদতে ও যিকিরে ব্যস্ত থাকা। তাই কোন কোন আলেম এই পাঁচদিন ব্যবসা বা উপার্জনের কাজকর্ম নিষেধ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

আরাফাতের পর মুযদালিফাতে অবস্থান

আরাফাতে অবস্থানের পর মুযদালিফাতে অবস্থানঃ অতঃপর এ আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ

فَإِذَا أَفَضْتُمْ مِنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللَّهَ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ وَإِنْ كُنْتُمْ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الضَّالِّينَ

অর্থাৎ যখন তোমরা আরাফাত হতে প্রত্যাবর্তন কর, তখন মাশআরে-হারামের নিকট যেভাবে আল্লাহকে স্মরণ করার নিয়ম বলে দেওয়া হয়েছে, সে নিয়মে তাঁকে স্মরণ কর। তোমাদেরকে নিয়ম বলে দেওয়ার পূর্বে যেভাবে তাঁকে স্মরণ করতে, তা ছিল ভুল আর তোমরা ছিলে অজ্ঞ। এতে বাতলে দেওয়া হয়েছে যে, আরাফাত থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মুযদালিফায় রাত কাটানো এবং বিশেষ নিয়মে যিকির করা ওয়াজিব।

‘আরাফাত’ শব্দটি শাব্দিকভাবে বহুবচন। এটি একটি বিশেষ ময়দানের নাম, চৌহদ্দি সুপ্রসিদ্ধ। এ ময়দান হেরেমের সীমানার বাইরে অবস্থিত। হাজীদের জন্য ৯ই যিলহজ্জ এ ময়দানে সমবেত হওয়া এবং দুপুরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করা হজ্জের গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরয, যার কোন বিকল্প বা ক্ষতিপূরণ নেই।

আরাফাতকে ’আরাফাত’ বলার পিছনে অনেকগুলো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়। তবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, এ ময়দানে স্বীয় পালনকর্তার ইবাদত ও যিকির দ্বারা তাঁর নৈকট্য ও পরিচয় লাভে সমর্থ হওয়া যায় ।

তাছাড়া প্রাচ্য-প্রতীচ্য নির্বিশেষে দুনিয়ার সকল এলাকার মুসলমানগণও এখানে পারস্পরিক পরিচয় লাভের সুযোগ পান। কোরআনে যথেষ্ট তাকীদের সাথে বলা হয়েছে যে, আরাফাত থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মাশ’আরে হারামের নিকট অবস্থান করা কর্তব্য। মাশ’আরে হারাম একটি পাহাড়ের নাম, যা মুযদালিফাতে অবস্থিত। ’মাশ’আর’ অর্থ নিদর্শন এবং হারাম অর্থ সম্মানিত ও পবিত্র। সারমর্ম হচ্ছে যে, এ পাহাড়টি ইসলামী নিদর্শন প্রকাশের একটি পবিত্র স্থান, এর আশপাশের ময়দানসমূহকে মুযদালিফা বলা হয়। এ ময়দানে রাত যাপন করা এবং মাগরিব ও এশার নামায একত্রে মিলিয়ে পড়া ওয়াজিব। মাশ’আরে হারামের নিকট আল্লাহ্‌কে স্মরণ করা বলতে যদিও সর্বপ্রকার যিকির-আযকারই এর অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু মাগরিব ও এশার নামায একত্রে এশার সময় আদায় করাই মূলত এখানকার বিশেষ ইবাদত। আয়াতে বর্ণিত وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ - বাক্যটি সম্ভবত এ দিকেই ইঙ্গিত করে যে, আল্লাহ্ তা’আলাকে স্মরণ করার জন্য তিনি যে নিয়ম বাতলে দিয়েছেন, সে নিয়মেই তাঁকে স্মরণ কর। এতে স্বীয় মতামত ও কিয়াসকে প্রশ্রয় দিও না। কেননা, কিয়াস অনুযায়ী তো মাগরিবের নামায মাগরিবের সময় এবং এশার নামায এশার সময় পড়া উচিত। কিন্তু সে দিনের জন্যে আল্লাহর পছন্দ এই যে, মাগরিবের নামায দেরি করে এশার সময় এশার নামাযের সাথে পড়া হবে।

وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ

এ দ্বারা আরো একটি মৌলিক মাস’আলার উদ্ভব হয় যে, আল্লাহকে স্মরণ করা ও তাঁর ইবাদত করার ব্যাপারে মানুষ স্বাধীন নয় যে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই তা করবে। বরং আল্লাহর যিকির ও ইবাদতের নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে। নিয়ম মতে আদায় করলেই তা ইবাদত হবে, নিয়মের খেলাফ করা জায়েয নয়। এতে কম বা বেশি করা কিংবা আগে-পরে করা, যদিও এতে যিকির বা ইবাদত বেশি হয়, তবু তা আল্লাহর পছন্দ নয়। নফল ইবাদত-বন্দেগী বা খয়রাতে যারা কিছু বিশেষ নিয়ম-পদ্ধতি সংযোজন করে এবং এ নিয়ম অবশ্য পালনীয় মনে করে অথচ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা) এসব নিয়মকে অবশ্য পালনীয় বলেননি কিন্তু তারা এগুলোকে পালন না করাকে ভুল মনে করে, এ আয়াত সেসব ভ্রান্তিরই সংশোধন করে দিয়েছে যে, তা হচ্ছে জাহিলিয়ত যুগের এমন কতকগুলো প্রথা বা কুসংস্কার, যা স্ব স্ব রায় ও কিয়াসের দ্বারা তারা তৈরি করেছিল এবং এসব প্রথাকেই ইবাদত বলে ঘোষণা করেছিল।

অতঃপর তৃতীয় আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ

ثُمَّ أَفِيضُوا مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ 

অর্থাৎ অতঃপর তোমাদের উচিত যে, অন্যান্য লোক যেস্থান হয়ে প্রত্যাবর্তন করছে, তোমরাও সেস্থান হয়ে প্রত্যাবর্তন কর। আল্লাহর দরবারে তওবা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা ক্ষমা করে দেবেন এবং অনুগ্রহ করবেন।

এ বাক্যটির শানে নুযুল হচ্ছে এই যে, আরবের কুরাইশগণ যারা কা’বা ঘরের হেফাজতে নিয়োজিত ছিল, আর সে কারণে সমগ্র আরব দেশে তাদের মানসম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল সকল মহলে স্বীকৃত, তারা তাদের এক বিশেষ মর্যাদা রক্ষাকল্পে হজ্জের ব্যাপারেও কতকগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে নিয়েছিল। সকল মানুষ আরাফাতে যেতো এবং সেখানে অবস্থান করার পর প্রত্যাবর্তন করতো, কিন্তু তারা রাস্তায় মুযদালিফাতে অবস্থান করতো আর বলতোঃ

যেহেতু আমরা কা’বা ঘরের রক্ষক ও সেবায়েত, এজন্য হেরেমের সীমারেখার বাইরে যাওয়া আমাদের জন্য উচিত নয়। মুযদালিফা হেরেমের সীমারেখার অন্তর্ভুক্ত এবং আরাফাতের বাইরে অবস্থিত। এ অজুহাতে মুযদালিফাতেই তারা অবস্থান করতো এবং সেখান থেকেই প্রত্যাবর্তন করতো। বাস্তবপক্ষে এসব ছল-ছুঁতার উদ্দেশ্য ছিল অহংকার ও অহমিকা প্রকাশ করা এবং সাধারণ মানুষ থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা। আল্লাহ্ তা’আলা এ আদেশ দ্বারা তাদের সে অহমিকার সংশোধন করে দিয়েছেন এবং তাদের নির্দেশ করেছেন যে, তোমরাও যেখানেই যাও, যেখানে অন্যান্য লোক যাচ্ছে অর্থাৎ আরাফাতে এবং অন্যান্য লোকের সাথেই তোমরা ফিরে এসো। একে তো সাধারণ মানুষ হতে নিজেকে স্বতন্ত্র করে রাখা একটি অহংকারজনিত কাজ, যা থেকে সর্বদা বিরত থাকা আবশ্যক। বিশেষ করে হজ্জের সময়ে পোশাক, ইহরামের স্থান ও অন্যান্য কাজ কর্মের মাঝে একটা সমন্বয় সাধন করে যেখানে এ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, সকল মানুষই সমান, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বড়-ছোট, রাজা-প্রজার কোন ভেদাভেদ নেই; তখন ইহরাম অবস্থায় এ পার্থক্য প্রদর্শন অনেক বড় অপরাধ।

মানবিক শিক্ষার ব্যবস্থা

মানবিক সমতার সুবর্ণ শিক্ষার কার্যকর ব্যবস্থাঃ কোরআনে হাকীমের এ বাণীর দ্বারা সমাজনীতির একটি পরিচ্ছেদ সামনে এসেছে যে, সামাজিক বসবাস ও অবস্থানের বেলায় বড়দের পক্ষে ছোটদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে স্বাতন্ত্র্য বিধান করা উচিত নয় বরং মিলেমিশে থাকা কর্তব্য। তাতে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি, ভালবাসা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি হয়, আমীর ও গরীবের পার্থক্য মিটে যায় এবং মজুর ও মালিকের মধ্যকার বিরোধের সমাধান হয়ে যায়। তাই রাসূলে করীম (সা) বিদায় হজ্জের ভাষণে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় ইরশাদ করেছেনঃ অনারবের উপর আরবদের এবং কালোর উপর সাদার কোন বৈশিষ্ট্য নেই। বৈশিষ্ট্যের বুনিয়াদ হলো পরহেজগারী বা আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই যারা মুযদালিফায় অবস্থান করে অন্যান্য লোকের তুলনায় নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইতো, তাদের সে আচরণ কোন অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

হজ বিষয়ে জাহিলিয়ত আমলের রেওয়াজসমূহের সংশোধন

জাহিলিয়ত আমলের রেওয়াজসমূহের সংশোধন এবং মিনাতে অর্থহীন সমাবেশের প্রতি নিষেধাজ্ঞাঃ ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ আয়াতে জাহিলিয়ত যুগের কিছু প্রথার সংশোধন করা হয়েছে। (১) জাহিলিয়ত যুগে আরবরা যখন আরাফাত, মুযদালিফা, তওয়াফ, কুরবানী ইত্যাদি কাজ শেষ করে মিনাতে অবস্থান করতো, তখন সেখানকার সমাবেশগুলোতে শুধু কবিতা প্রতিযোগিতা, নিজেদের ও পিতৃপুরুষদের গৌরবময় ইতিহাসের আলোচনা ইত্যাদি বাজে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। তাদের সে মজলিসগুলো আল্লাহ্ তা’আলার যিকির-আযকার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতো। এ মূল্যবান দিনগুলোকে তারা নানা অর্থহীন কাজকর্মে নষ্ট করতো। তাই ইরশাদ হয়েছেঃ যখন তোমরা ইহরামের কাজ শেষ করবে এবং মিনাতে সমবেত হবে, তখন তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর এবং নিজেদের ও পূর্বপুরুষদের সত্য-মিথ্যা গৌরব বর্ণনা থেকে বিরত থাক। তাদেরকে তোমরা যেভাবে স্মরণ করতে, সেস্থানে এর চাইতেও অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ কর। কোরআনের এই আয়াত আরববাসীদের সেই মূর্খজনোচিত কাজকে রহিত করে মুসলমানদেরকে হেদায়েত করেছে যে, এ দিনগুলো এবং সে স্থানটি আল্লাহর ইবাদত ও যিকিরের জন্য নির্ধারিত। এসব জায়গায় আল্লাহর ইবাদত ও যিকিরের যে ফযীলত তা আর কোথাও হতে পারে না; তাই একে সুবর্ণ সুযোগ মনে করা উচিত।

তাছাড়া হজ্জ এমন একটি ইবাদত, যা দীর্ঘ প্রবাসের কষ্ট সহ্য করা, পরিবার-পরিজন হতে দীর্ঘদিন দূরে থাকা, ব্যবসা-বাণিজ্য বর্জন করা এবং হাজার হাজার টাকা ব্যয় করার পর লাভ করা যায়। এতে নানারকম দুর্বিপাকের সম্মুখীন হওয়াও অসম্ভব নয়, যার ফলে মানুষ শত চেষ্টা সত্ত্বেও হজ্জ সম্পাদনে কৃতকার্য হতে পারে না।

যখন আল্লাহ্ তা’আলা সমস্ত বাধা-বিপত্তি দূরীভূত করে তোমাকে তোমার উদ্দেশ্য সফল হবার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং তুমি হজ্জের ফরয কাজ শেষ করেছ, তখন নিঃসন্দেহে এটা শুকরিয়া আদায় করারই ব্যাপার। তাই এখন অধিক মাত্রায় আল্লাহর যিকিরে আত্মনিয়োগ করা কর্তব্য। এই মূল্যবান সময়কে বাজে কাজ এবং বেহুদা কথাবার্তায় নষ্ট করো না। জাহিলিয়ত আমলে লোকেরা এ মূল্যবান সময় তাদের পূর্বপুরুষদের আলোচনায় ব্যয় করতো, দীন-দুনিয়ার কোথাও যার কোন সুফল ছিল না। সেস্থলে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করে এ মূল্যবান সময়টুকু ব্যয় কর। যার মধ্যে কেবল উপকারই উপকার। এতে দুনিয়ার জন্যও উপকার, আখেরাতের জন্যও উপকার বিদ্যমান। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে কবিতার আসর জমিয়ে তাতে পূর্বপুরুষদের গৌরব ও দাম্ভিকতা প্রচারের রেওয়াজ অবশ্য নেই, কিন্তু এখনও হাজার হাজার মুসলমান রয়েছে, যারা এ সুবর্ণ সুযোগকে বেহুদা সমাবেশ, বেহুদা দাওয়াত ও অন্যান্য বাজে কাজে ব্যয় করে। এসব ব্যাপারে সতর্কীকরণের জন্য এ আয়াতটিই যথেষ্ট।

কোন কোন মুফাসসির এই আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন যে, তোমরা আল্লাহ্‌কে তেমনিভাবে স্মরণ কর, শিশুরা যেমন স্মরণ করে তার মাতা-পিতাকে। তখন তাদের প্রথম বাক্য এবং সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দটি হয় ’আব্বা বাবা’। এখন তোমরা সাবালক ও বুদ্ধিমান, সুতরাং ’আব’ শব্দের পরিবর্তে ’রব’ শব্দ বলতে থাক। চিন্তা কর শিশু পিতাকে এজন্যই ডাকে যে, সে তার যাবতীয় কাজের জন্য তার পিতার মুখাপেক্ষী। মানুষ সামান্য চিন্তা করলে বুঝতে পারবে যে, সে সব সময় সব কাজের জন্য আল্লাহর প্রতি আরও বেশি মুখাপেক্ষী। তাছাড়া অনেক সময় মানুষ গর্বভরে নিজ পিতাকে স্মরণ করে। যেমন জাহিলিয়ত যুগের লোকেরা করতো। তবে এ আয়াতের দ্বারা এ কথাও ঘোষণা করা হয়েছে যে, গৌরব ও সম্মানের জন্যও আল্লাহ্‌কে স্মরণ করার চাইতে অন্য কোন যিকির বেশি কার্যকর নয়।

জাহিলিয়ত যুগের আর একটি প্রথার সংশোধনে ইসলামী ভারসাম্যঃ জাহিলিয়ত যুগে এ গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে পূর্ব পুরুষদের স্মরণ এবং কবিতা প্রতিযোগিতায় অতিবাহিত করার রীতিটি যেমন নিষ্প্রয়োজন ছিল, তেমনিভাবে হজ্জের মধ্যে আল্লাহর যিকির করাও কিছু কিছু লোকের অভ্যাস ছিল। কিন্তু তাদের সে যিকিরের উদ্দেশ্য থাকত একমাত্র দুনিয়ার মান-ইযযত ও ধন-দৌলত হাসিল করা। এতে আখেরাতের প্রতি কোন কল্পনাও তাদের মনে জাগতো না। এ ত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে এ আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে কোন কোন লোক হজ্জের সময় দোয়া করে বটে, কিন্তু তা একান্তই দুনিয়ার উন্নতির জন্য, পরকালের কোন চিন্তাই তাদের থাকে না। তারা পরকালে কিছুই পাবে না। কেননা, তাদের এ কার্যপদ্ধতিতে বোঝা যায় যে, তারা হজ্জের ফরয শুধু প্রথাগতভাবে আদায় করতো অথবা দুনিয়াতে প্রতিপত্তি ও প্রভাব বিস্তারের জন্য করতো; আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা বা পরকালে মুক্তি পাওয়ার কোন ধ্যান-ধারণাই তাদের ছিল না। এখানে একথাও চিন্তা করার বিষয় যে, পার্থিব বিষয়ে প্রার্থনাকারীদের কথা এ আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে যে, তারা বলেঃ

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا

এর সাথে حَسَنَةً শব্দ ব্যবহারের উল্লেখ নেই। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, জাগতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা এমনিভাবে নিমগ্ন যে, কোন প্রকারে শুধু নিজের চাহিদা পূরণ হোক, এটাই তাদের কাম্য—চাই তা ভাল হোক বা মন্দ, সৎ পথে অর্জিত হোক বা অসৎ পথে, মানুষ একে পছন্দ করুক বা নাই করুক।

এ আয়াতে সেসব মুসলমানকেও সতর্ক করা হয়েছে, যারা হজ্জব্রত পালনকালে এবং এ পবিত্র স্থানে কৃত দোয়াসমূহে পার্থিব উদ্দেশ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে এবং অধিকাংশ সময় সেজন্য ব্যয় করে। আমাদের অবস্থাও একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, অনেক মুসলমান ধনী ব্যক্তি যেসব দোয়া কালাম পাঠ করে বা বুযুর্গ লোকদের দ্বারা করায়, তাতেও দুনিয়ার সমৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি-অগ্রগতির জন্যই করে বা করায়। তারা অনেক দোয়া-কালাম পাঠ করে এবং নফল ইবাদত করে ভাবে যে, আমরা অনেক ইবাদত করে ফেলেছি। কিন্তু বাস্তবে এটা এক প্রকার দুনিয়াদারী পূজায় পরিণত হয়। অনেক লোক জীবিত বুযুর্গান এবং মৃত বুযুর্গানের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এতেও তাদের উদ্দেশ্য থাকে তাদের দোয়া-তাবিজ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য সফল করা, দুনিয়ার বিপদাপদ হতে নিরাপদ থাকা। এসব লোকের জন্যও এ আয়াতে উপদেশ রয়েছে। যাবতীয় বিষয়ই আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত যিনি সর্বজ্ঞ। স্বীয় কাজ-কর্মে একটা হিসাব-নিকাশ করা সবারই কর্তব্য। যিকির-আযকার, ইবাদত-বন্দেগী এবং হজ্জ ও যিয়ারতে তাদের নিয়ত কি ? এ আয়াতের শেষে হতভাগ্য বঞ্চিত সেসব লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারপর নেক ও ভাগ্যবান লোকদের কথা আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেনঃ

وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

অর্থাৎ তাদের মধ্যে এমনও কিছু লোক রয়েছে, যারা তাদের প্রার্থনায় আল্লাহর নিকট দুনিয়ার কল্যাণ কামনা করে এবং পরকালের কল্যাণও কামনা করে এবং জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে।

এতে শব্দটি প্রকাশ্য ও গোপনীয় যাবতীয় কল্যাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক। দুনিয়ার কল্যাণ-যেমন শারীরিক সুস্থতা, পরিবার-পরিজনের সুস্থতা, হালাল রুযীর প্রাচুর্য, পার্থিব যাবতীয় প্রয়োজনের পূর্ণতা নেক আমল, সচ্চরিত্র উপকারী বিদ্যা, মান-সম্মান, সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি, আকীদার সংশোধন, সিরাতে মুস্তাকীমের হিদায়েত, ইবাদতে একাগ্রতা প্রভৃতিসহ অসংখ্য স্থায়ী নিয়ামত এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও সাক্ষাত লাভ প্রভৃতি সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

মোটকথা, এটি এমন এক পূর্ণাঙ্গ দোয়া, যাতে ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় প্রয়োজন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের শান্তি ও আরাম-আয়েশও এর আওতাভুক্ত। অবশেষে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হুযূর (সা) এ দোয়াটি খুব বেশি পরিমাণে পাঠ করতেনঃ

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

কা’বাঘরের তওয়াফের সময় বিশেষভাবে এ দোয়া করা সুন্নত। এ আয়াতে ঐ সমস্ত মূর্খ দরবেশদেরও সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে, যারা কেবল পরকালের জন্য প্রার্থনাকেই ইবাদত মনে করে এবং বলে থাকে যে, আমাদের দুনিয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবপক্ষে তাদের এ দাবি ভুল এবং তাদের ধারণা অপরিপক্ক। কেননা, মানুষ তার অস্তিত্ব ও ইবাদত সব প্রয়োজনেই দুনিয়ার মুখাপেক্ষী। তা না হলে ধর্মীয় কাজকর্ম করাও সম্ভব হতো না। সেজন্যই যেভাবে পরকালের মঙ্গলামঙ্গল আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে দুনিয়ার মঙ্গলামঙ্গল ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রার্থনা করা আম্বিয়ায়ে কিরামের সুন্নত। যে ব্যক্তি প্রার্থনার মাঝে দুনিয়ার মঙ্গল-অমঙ্গল প্রার্থনা করাকে তাকওয়ার পরিপন্থী বলে মনে করে, সে নবীগণের মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ । তবে শুধু দুনিয়ার প্রয়োজনকে জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত করাও চলবে না। বরং দুনিয়ার চিন্তা ও ফিকিরের চাইতে অধিক পরিমাণে পরকালের চিন্তা ও ফিকির করতে হবে ও দোয়া করতে হবে।

আয়াতের শেষাংশে সেই দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকদের প্রতিদান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যারা প্রার্থনাকালে ইহ ও পরকালের মঙ্গলামঙ্গল কামনা করেন। তাদের পরিণাম বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তাদের সঠিক নেক আমল ও দোয়ার প্রতিদান তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে দেওয়া হবে। অতঃপর ইরশাদ হয়েছেঃ

وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ - অর্থাৎ আল্লাহ্ অতি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। কেননা, তাঁর ব্যাপক জ্ঞান এবং কুদরতের দ্বারা সমস্ত সৃষ্ট জগতের সারা জীবনের হিসাব গ্রহণের জন্য মানুষের যে সমস্ত বস্তুর প্রয়োজন হয়, আল্লাহ্ তা’আলার এ সবের প্রয়োজন হয় না। কাজেই তিনি সারা মাখলুকাতের সমস্ত হিসাব অতি অল্প সময়ে বরং মুহূর্তে গ্রহণ করবেন।

দিনের বেলায় মিনাতে অবস্থান এবং আল্লাহর স্মরণের তাকীদঃ অষ্টম আয়াতটি হজ্জ সংক্রান্ত শেষ- আয়াত। এতে হাজীগণকে আল্লাহর যিকিরের প্রতি অনুপ্রাণিত করে তাদের হজ্জের উদ্দেশ্যের পরিপূর্ণতা এবং পরবর্তী জীবনে সংশোধনের জন্য হেদায়েত দান করা হয়েছে।

وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَعْدُودَاتٍ - অর্থাৎ তোমরা নির্ধারিত কয়েকটি দিনে আল্লাহ্কে স্মরণ কর। এই কয়েকদিন হচ্ছে তাশরীকের দিনসমূহ, যাতে প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তকবীর বলা ওয়াজিব। অতঃপর একটি মাস’আলার আলোচনা করা হচ্ছে যে, মিনায় অবস্থান এবং জমরাতে পাথর নিক্ষেপ করা কতদিন পর্যন্ত আবশ্যক। জাহিলিয়ত যুগের লোকেরা এতে মতানৈক্য করেছে। কেউ কেউ ১৩ই যিলহজ্জের সূর্যাস্ত পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা ও জমরাতে প্রস্তর নিক্ষেপ করাকে জরুরী বিবেচনা করত। আর যারা ১২ তারিখে সেখান থেকে ফিরে আসত, তাদেরকে পাপী বলে ধারণা করত এবং এই কাজকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করা হতো। আবার একদল ছিল, যারা ১২ তারিখে প্রত্যাবর্তন করাকে জরুরী মনে করতো এবং ১৩ তারিখ পর্যন্ত অবস্থান করাকে পাপ বলে মনে করতো। এ আয়াতে এ দু’টি বিষয়েরই মীমাংসা করে দেওয়া হয়েছে।

فَمَنْ تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَنْ تَأَخَّرَ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ

অর্থাৎ যারা ঈদের পর মাত্র দু’দিন মিনাতে অবস্থান করেই প্রত্যাবর্তন করে, তাদেরও কোন পাপ নেই, আর যারা তৃতীয় দিন পর্যন্ত অবস্থান করার পর প্রত্যাবর্তন করে তাদেরও কোন পাপ নেই। পক্ষান্তরে এ দু’টি দল যে একে অপরকে পাপী বলে থাকে, তারা উভয়েই ভুল পথে রয়েছে।

সঠিক কথা হচ্ছে এই যে, হাজীগণ উভয় ব্যাপারেই স্বাধীন। তাঁরা যে কোন একটিতে আমল করতে পারেন। তবে তৃতীয় দিন পর্যন্ত অবস্থান করাই উত্তম। ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি দ্বিতীয় দিন সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করে, তার জন্য তৃতীয় দিনের প্রস্তর নিক্ষেপ ওয়াজিব নয়। কিন্তু মিনাতে থাকা অবস্থায় সূর্যাস্ত হয়ে গেলে তৃতীয় দিনের প্রস্তর নিক্ষেপ ওয়াজিব। তবে তৃতীয় দিনের প্রস্তর নিক্ষেপ পরদিন সকালেও করা যায়।

মিনা থেকে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে হাজীগণকে স্বাধীন বলার পর যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, দ্বিতীয় দিন প্রত্যাবর্তন করলেও কোন পাপ নেই, আর তৃতীয় দিন প্রত্যাবর্তন করলেও কোন পাপ নেই; এসব কাজ তাদের জন্য যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর আহকাম মান্য করে । কেননা, প্রকৃতপক্ষে হজ্জ তাদেরই জন্য। কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

 إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ - অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা তাদের ইবাদতই গ্রহণ করেন, যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং যারা আল্লাহর অনুগত ও প্রিয় বান্দা। আর যারা হজ্জের পূর্বে পাপ কাজে লিপ্ত ছিল এবং হজ্জের মধ্যেও নির্ভয়ে বেপরোয়াভাবে পাপ কাজ করেছে এবং হজ্জের পরেও পাপ কাজে লিপ্ত রয়েছে তাদের জন্য হজ্জ কোন উপকারেই আসবে না। অবশ্য তাদের ফরয আদায় হয়ে যাবে এবং হজ্জ সম্পাদন না করার পাপে পাপী হবে না। সবশেষে বলা হয়েছেঃ

اتَّقَى وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ - অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহর দরবারে সমবেত হবেই। তিনি তোমাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় যাবতীয় কাজ-কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন এবং পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করবেন। ইতিপূর্বে হজ্জের যত আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে তন্মধ্যে এ বাক্যটি সে সবগুলোর প্রায় সমতুল্য। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, হজ্জের দিনে যখন হজ্জের কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাক, তখনও আল্লাহকে ভয় কর এবং পরে হজ্জ করেছ বলে অহংকার করো না, তখনও আল্লাহকে ভয় কর এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাক। কারণ আমলসমূহের ওজন করার সময় মানুষের পাপ তাদের নেক আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। নেক আমলের প্রভাব ও ওজন প্রকাশ হতে দেয় না। হজ্জ সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, মানুষ যখন হজ্জ করে ফিরে আসে, তখন সে তার পূর্ব-কৃত পাপ থেকে এমনভাবে মুক্ত হয়, যেন সে সদ্য জন্মগ্রহণ করেছে। এখানে তাই হাজীগণকে পরবর্তী জীবনের জন্য পরহেযগারী অবলম্বন করতে বিশেষভাবে তাকীদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা পূর্বের পাপ থেকে মুক্ত হয়েছ। পরের জন্য সতর্ক হও। তবেই ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল তোমাদের জন্য নির্ধারিত থাকবে। পক্ষান্তরে হজ্জ সমাপনের পর পুনরায় পাপ কাজে লিপ্ত হলে পূর্বের পাপ মোচনের কোন ফল লাভ করা যাবে না। এ ব্যাপারে আলিমগণ মন্তব্য করেছেন যে, হজ্জ কবুল হওয়ার লক্ষণ হচ্ছে এই যে, হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পার্থিব মায়া কাটিয়ে যারা পরকালের প্রতি আকৃষ্ট হবে, এমন ব্যক্তির হজ্জ কবূল হয় এবং তাদের পাপও মোচন হয়। তাদেরই দোয়া কবুল হয়। হজ্জ সম্পাদনকালে মানুষ বারবার আল্লাহর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও ফরমাবরদারীর প্রতিজ্ঞা করে । কোন হাজী যদি তার সে প্রতিজ্ঞার কথা সর্বদা স্মরণ রাখে, তবেই পরবর্তীকালে তা রক্ষা করার যথাবিহিত ব্যবস্থা করতে পারে।

জনৈক বুযুর্গ বলেছেন, আমি হজ্জ থেকে ফিরে আসার পর আমার মনে একটি পাপের ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি হয়, এমতাবস্থায় এক গায়েবী শব্দে আমাকে বলা হয়ঃ তুমি কি হজ্জ করনি?

এ শব্দ আমার এবং সে পাপের মধ্যে একটি দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে রক্ষা করেন। আল্লামা জামীর শিষ্য জনৈক তুরস্কবাসী মনীষী সব সময় নিজের মাথার উপরে একটি আলো লক্ষ্য করতেন, তিনি হজ্জে গিয়ে হজ্জ সমাপনের পর এ অবস্থা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা না হয়ে একেবারে রহিত হয়ে গেল। পরে মাওলানা জামী (র)-এর সাথে আলোচনা করলে তিনি বললেন, হজ্জ করার পূর্বে তোমার মধ্যে নম্রতা ও দীনতা ছিল, নিজেকে পাপী মনে করে আল্লাহর দরবারে আরাধনা করতে। হজ্জ করার পর তুমি নিজেকে নেক ও বুযুর্গ মনে করছ, কাজেই এই হজ্জ তোমার অহংকারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্যই তোমার অবস্থার এহেন পরিবর্তন।

আহকামে-হজ্জের বর্ণনা শেষে তাকওয়া ও পরহেযগারী সম্পর্কে তাকীদ দেওয়ার একটি কারণ যে, হজ্জ একটি অতি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত আদায় করার পর শয়তান সাধারণত মানুষের মনে বড়ত্ব ও বুযুর্গীর ভাব জাগিয়ে তোলে, যা তার যাবতীয় আমলকে বরবাদ করে দেয়। কাজেই আয়াতের শেষাংশে বলে দেওয়া হয়েছে যে, যেভাবে হজ্জের পূর্বে ও হজ্জের মধ্যে আল্লাহকে ভয় করা এবং পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য তেমনি হজ্জের পরে আরো বেশি করে আল্লাহকে ভয় কর এবং পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার অনুশীলন করতে থাক, যাতে করে ইবাদত বিনষ্ট হয়ে না যায়।

وفقنا لما تحب وترضى من القول والفعل والنية اللهم






**********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url